পদ্মজাকে নতুন করে আবার সাজানো হয়েছে। বাসর রাত নিয়েও হাওলাদার বাড়ির হাজারটা রীতি। সেসব পালন হচ্ছে। পদ্মজা নিয়ম-রীতি পূরণ করছে ঠিকই,তবে মন অন্য জায়গায়। বিকেলে সে দেখেছে, আমির রিদওয়ানের পাঞ্জাবির কলার দুই হাতে ধরে কিছু বলছে। খুব রেগে ছিল। তবে কী রিদওয়ানই এসেছিল রাতে?
‘ও বউ উডো। এহন ঘরে গিয়া খালি দুইজনে মিললা দুই রাকাত নফল নামায পইড়া লইবা। আনিসা যাও লইয়া যাও। দিয়া আও ঘরে।’ বললেন ফরিনা। পদ্মজা কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে বাস্তবে ফিরে আসে। খলিল হাওলাদারের দুই মেয়ে শাহানা,শিরিন এবং আনিসা পদ্মজাকে নিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে। আমিরের ঘরে ঢুকতে আর কয়েক কদম বাকি। পদ্মজা ঘোমটার আড়াল থেকে চোখ তুলে তাকায়। দরজা গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো। টকটকে লাল গোলাপ। হাওলাদার বাড়ির গোলাপ বাগান অলন্দপুরে খুবই জনপ্রিয়। পদ্মজার শুভ্র, শীতল অনুভূতি হয়। কত সুন্দর দেখাচ্ছে! ঘরে ঢুকতেই তাজা গোলাপ ফুলের ঘ্রাণে শরীর-মন অবশ হয়ে আসে। শুধু বিছানা নয়,পুরো ঘর লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো।
শাহানা পদ্মজাকে বিছানায় বসিয়ে দিল। এরপর বলল,’ডরাইবা না। রাইতটা উপভোগ করবা। এমন রাইত জীবনে একবারই আসে।’
পদ্মজার লজ্জায় মরিমরি অবস্থা! সারা দেহ থেকে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। আনিসা সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখছে। একসময় বলল,’আমার বাসর রাতটাও হুবুহু এই রকম ছিল। চারিদিকে গোলাপের ঘ্রাণ। ফুলের ঘ্রাণে ভালোবাসা আরো জমে উঠেছিল।’
‘এই বাড়ির বউদেরই কপাল। আমরা এই বাড়ির ছেড়ি হইয়াও জামাইর বাড়িতে বাসর রাইতের ঘর কাগজের ফুল দিয়ে সাজানি দেখতে হইছে।’ বলল শিরিন। আনিসা কণ্ঠে অহংকার ভাব নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গীতে বলল,’এসব পেতে যোগ্যতা লাগে। যোগ্যতা ছাড়া ভালো কিছু পাওয়া যায় না। আমি উচ্চশিক্ষিত এবং সুন্দরী ছিলাম। ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য ছিলাম তাই পেয়েছি। আর পদ্মজা যথেষ্ট সুন্দরী, গ্রামে থেকেও পড়ালেখায় খুব ভালো। তাই সেও যোগ্য। তোমাদের না আছে পড়াশোনা না আছে কোনো ভাল গুণ। গায়ের রঙও ময়লা। কাগজের ফুলই তোমাদের জন্য ঠিক ছিল।’
আনিসার কথাগুলো শুনতে পদ্মজার খুব খারাপ লাগে। কোনো মানুষকে এভাবে বলা ঠিক না। শিরিন হইহই করে উঠল,’এই রূপ বেশিদিন থাকব না ভাবি। এতো দেমাগ ভালা না। বিয়ার এতদিন হইছে একটাও বাচ্চা দিতে পারছো? পারো নাই। তাইলে এই গরিমা (অহংকার) দিয়া কী হইবো? সন্তান ছাড়া নারীর শোভা নাই।’
আনিসা রেগেমেগে ফুঁসে উঠে। গলা উঁচু করে বলে,’সমস্যা আমার নাকি তোমাদের পেয়ারের ভাইয়ের সেটা খোঁজ নাও আগে। আমি এখুনি জাফরকে সব বলছি। এতদিন পর বাড়িতে এসেছি এসব নোংরা কথা সহ্য করতে? অপমান সহ্য করতে? কালই চলে যাব আমি।’
আনিসা রাগে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায়। পদ্মজা হতবাক।শাহানা শিরিনকে ধাক্কা দিয়ে বলল,’এত কিছু কেন কইতে গেলি? জানস না,এই ছেড়ি কেমন? আমি হের বড় হইয়াও হেরে কিছু কই না। এহন আরেক ভেজাল হইবো।’
‘যা হওয়ার হইয়া যাক। আমরারে কেমনে পায়ে ঠেলতাছিল দেহো নাই? এইডা তো আমরার বাপের বাড়ি। এতো কথা কেন হুনতে হইবো?’ শিরিনের কণ্ঠ কঠিন। সে আজ এর শেষ দেখেই ছাড়বে।
‘নতুন বউডার সামনে এমনডা না করলেও হইতো। ও পদ্ম তুমি বেজার হইয়ো না। এরা সবসময় এমনেই লাইগা থাহে।’
পদ্মজা হাসার চেষ্টা করে। শাহানা দরজার বাইরে থাকিয়ে দেখে আমির আসছে নাকি। রাত তো কম হলো না। শাহানা আরো অনেকক্ষণ সময় নিয়ে পদ্মজাকে বুঝালো। কী কী করতে হবে, কীভাবে স্বামীকে আঁচলে বেঁধে রাখতে হয়। পদ্মজা সব মনোযোগ সহকারে শুনে।
আমির ঘরে ঢুকতেই শাহানা,শিরিন বেরিয়ে গেল। আমির দরজা লাগিয়ে পালঙ্কের পাশে এসে দাঁড়ায়। পদ্মজা পালঙ্ক থেকে নেমে আমিরের পা ছুঁয়ে সালাম করে। আমির দুই হাতে পদ্মজাকে আঁকড়ে ধরে দাঁড় করায়। অনুভব করে পদ্মজা কাঁপছে। প্রচন্ড শীতে মানুষ যেভাবে কাঁপে,ঠিক তেমন। আমির দ্রুত ছেড়ে দেয়। বলে,’পানি খাবে?’
পদ্মজা মাথা নাড়িয়ে জানায়, সে পানি খাবে। আমির এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। পদ্মজা এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে পানি শেষ করে। সারা শরীর কাঁপছে। শাহানা,শিরিন বের হতেই বুকে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়। ঘরে চারটা হারিকেন জ্বালানো। যেদিকে চোখ যায় সেখানেই গোলাপ ফুল। ফুলের ঘ্রাণে চারিদিক মৌ মৌ করছে। এমন পরিবেশে বিয়ের প্রথম রাতে পর পুরুষকে স্বামী রূপে দেখা কোনো সহজ অনুভূতি নয়। আমির গ্লাস নিতে এগিয়ে আসলে পদ্মজা আঁতকে উঠে,এক কদম পিছিয়ে যায়। আমির একটু শব্দ করেই হাসে। পদ্মজা ভীতু ভীতু চোখে তাকায়। আমির বলে,’হাতে গ্লাস নিয়ে সারারাত কাটাবে নাকি? দাও আমার কাছে।’
আমির গ্লাস টেবিলের উপর রেখে আসে। পদ্মজা পালঙ্কের এক কোণে চুপটি করে বসে আছে। তার ডান পা অনবরত কাঁপছে। মনে মনে দোয়া করছে, মাটি যেন ফাঁক হয়ে যায়। আর সে তার ভেতর ঝাঁপ দিয়ে পাতালে হারিয়ে যেতে চায়। নয়তো লজ্জা,আড়ষ্টতায় প্রাণ এখুনি গেল বুঝি! আমির দূরত্ব রেখে পদ্মজার সোজাসুজি বসে। পদ্মজার এক পা যে কাঁপছে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার দৃষ্টি অস্থির। এদিকওদিক তাকাচ্ছে। আমির মজা করে জানতে চাইল,’পালানোর পথ খুঁজছো নাকি?’
‘না..না তো।’ বলল পদ্মজা।
‘তাহলে কী খুঁজছো?’
পদ্মজা নিরুত্তর রইল। আমির পদ্মজার আরো কাছে এসে বসে। এক হাতে পদ্মজার এক হাত ছুঁতেই পদ্মজা,’ ও মাগো!’ বলে চিৎকার করে উঠে। আমির পদ্মজার আকস্মিক চিৎকারে থতমত হয়ে গেল। পদ্মজা ভয়ে ঢোক গিলে। সময়টা যেন যাচ্ছেই না। সে যদি পারতো পালিয়ে যেতো। ভয়ংকর অনুভূতিদের খেলা চারিদিকে! আমির হা করে পদ্মজার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এরপর দূরে গিয়ে বসে,পদ্মজাকে বলল,’আমার সাথে সহজ হওয়ার চেষ্টা করো। আমার দিকে ফিরে বসো। গল্প করি।’
পদ্মজা আমিরের দিকে ফিরে বসে। তবে দৃষ্টি বিছানার চাদরে নিবদ্ধ। আমির প্রশ্ন করে,’আমার সম্পর্কে কতটুকু জানো?’
‘খুব কম।’ মিনমিনিয়ে বলল পদ্মজা।
‘আমি তোমার চেয়ে বারো বছরের বড়। জানো?’
‘এখন জানলাম। তবে আপনার আচরণ ছোটদের মতো।’ পদ্মজা মৃদু হেসে আমিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল। আমির বলল,’ আমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আরো আছে।’
‘বুঝতে পেরেছি। আপনার কথাবার্তা এখন বড়দের মতো মনে হচ্ছে।’
‘ঢাকা আমার ব্যবসা আছে।’
‘শুনেছি।’
‘আমার সাথে তোমাকেও ঢাকা যেতে হবে।’
‘আচ্ছা।’
‘এই বাড়ির চেয়েও বিশাল বড় বাড়িতে আমি একা থাকি। যতক্ষণ বাইরে থাকব তোমাকে একা থাকতে হবে। ভয় পাওয়া যাবে না।’
‘আমি ভয় পাই না।’
‘আমাকে তো ভয় পাচ্ছো।’ আমির হেসে বলল। পদ্মজা নিরুত্তর।
‘কথা বলো।’
‘কী বলব?’
‘আচ্ছা, আসো একটা মজার খেলা খেলি।’
পদ্মজা উৎসুক হয়ে তাকাল। আমির বলল,’দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব। যার চোখের পলক আগে পড়বে সে হেরে যাবে।’
পদ্মজা খেলতে রাজি হয়। এই খেলাটা সে পূর্ণার সাথেও খেলেছে। পদ্মজা অনেকক্ষণ এক ধ্যাণে তাকিয়ে থাকতে পারে। তাই তার আত্মবিশ্বাস আছে, সেই জিতবে। বরাবরই জিতে এসেছে। আমির এক,দুই, তিন বলে খেলা শুরু করে। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকে একধ্যাণে। পদ্মজা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমিরকে পরখ করে। আমিরের চুল খাড়া করে উল্টা দিকে ফিরানো। থুতুনির নিচে কাটা দাগ। গালে হালকা দাঁড়ি। শ্যামলা গায়ের রঙ। ঘন ভ্রু,চোখের পাঁপড়ি। পরেছে সাদা পাঞ্জাবি। এতো বেশি ভালো লাগছে দেখতে। আমির পদ্মজার রূপে আগে থেকেই দিওয়ানা। তার উপর এতক্ষণ তাকিয়ে থেকে অনুভূতির দফারফা অবস্থা। সে মুগ্ধ হওয়া কণ্ঠে বলল,’পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী আমার বউ। কী ভাগ্য আমার!’
‘আপনিও সুন্দর।’ কথাটা মুখ ফসকে বলে উঠল পদ্মজা। যখন বুঝতে পারল লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল। আমির খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলল,’তোমার পলক পড়েছে। আমি জিতে গেছি।’
পদ্মজা লজ্জায় নখ খুঁটতে থাকে। আমির নিজের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,’আমি জানি আমি কতোটা সুন্দর! রঙটা একটু কালো হতে পারে। তবে আমি সুন্দর। তোমার মুখে শোনার পর থেকে ধরে নিলাম,পৃথিবীর সেরা সুন্দর পুরুষের নাম আমির হাওলাদার।’
পদ্মজার দুই ঠোঁট নিজেদের শক্তিতে আলগা হয়ে গেল। সে আমিরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, মানুষ নিজের প্রশংসা নিজে কীভাবে করতে পারে। আমিরের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, সে সত্যিই পৃথিবীর সেরা সুন্দর পুরুষ। পদ্মজা ফিক করে হেসে দিল। আমির তাকাল। বলল,’হাসছো কেন?’
পদ্মজা হাসি চেপে বলল,’কই না তো। আপনার আম্মা বলেছিলেন, দুই রাকাত নফল নামায আদায় করতে।’
‘আমার আম্মা তোমার আম্মা না?’
‘হুম।’
‘এখন থেকে আপনার আম্মা না শুধু আম্মা বলবে। গয়নাগাটি নিয়েই নামায পড়বে? অস্বস্তি হবে না? খুলো এবার।’
পদ্মজা অবাক হয়ে জানতে চাইল,’শিরিন আপা বললেন, গয়নাগাটি নাকি স্বামি খুলে দেয়। তাহলে?’
আমির তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে বলল,’তাই নাকি? দাও খুলে দেই।’
পদ্মজা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। আমতাআমতা করে বলল,’এ..এটা বোধহয় নিয়ম না। তাই আপনি জানতেন না। আমি…আমি পারব।’
___________
দুই রাকাত নফল নামাযের সাথে তাহাজ্জুদের নামাযটাও পড়েছে দুজন। আমির তাহাজ্জুদ নামাযের নিয়ম জানে না। পদ্মজা হাতে কলমে শিখিয়েছে। আমিরও মন দিয়ে শিখেছে এবং নামায পড়েছে। এরপর পদ্মজা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জানালার সামনে বিশাল বড় জঙ্গল। সে আমিরকে প্রশ্ন করল,’এই জঙ্গলে নাকি কী আছে?’
আমির পদ্মজার প্রশ্ন শুনেনি। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পদ্মজার দিকে। গায়ে কোনো অলংকার নেই। খোলা চুল কোমর অবধি এসে থেমেছে। মধ্য রাতের বাতাসে তার চুল মৃদু দুলছে। আমির অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেয়। পদ্মজার কোমর পিছন থেকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে,পদ্মজার কেঁপে উঠে বড় করে নিঃশ্বাস নেয়া অনুভব করে গভীরভাবে। পদ্মজার হৃৎপিণ্ড থমকে যায়। পায়ের তলার মাটি শিরশির করে উঠে। তবে,অদ্ভুত বিষয় শুরুর মতো আমিরের স্পর্শ অস্বস্তি দিচ্ছে না তাকে। বরং ধারালো কোনো অজানা অনুভূতিতে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমির পদ্মজার ঘাড়ে থুতুনি রেখে বলল,’প্রথম যেদিন তোমাকে দেখি সেদিনই মনে মনে পণ করি তোমাকেই বিয়ে করব। তবে ভাবিনি প্রথম দিনই আমার কারণে এতোটা অপদস্থ হতে হবে তোমাকে। অনেক চেষ্টা করেছি সব আটকানোর, পারিনি। সেদিনই বাড়ি ফিরে আব্বাকে বলি,আমি বিয়ে করতে চাই পদ্মজাকে। প্রথম প্রথম কেউ রাজি হচ্ছিল না। পরে রাজি হয়ে যায়। মনে হচ্ছে,চোখের পলকে তোমাকে পেয়ে গেছি।’
পদ্মজা নিশ্চুপ। সে অবাধ্য, অজানা অনুভূতিদের সাথে যুদ্ধ করবে নাকি সখ্যতা করবে ভাবছে। আমির পদ্মজাকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরায়। পদ্মজা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। আমির বলল,’তোমায় আমি পদ্ম ফুল দিয়ে একদিন সাজাব। নিজের হাতে সাজাব।’
‘কথা বলো। আল্লাহ,আবার কাঁপছো! আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো, স্থির হতে পারবে। এই কী হলো?’
পদ্মজা শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে আমিরের উপর। আমির দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখে। সেদিন রাতে জান্নাতের সুবাস এসেছিল ঘরে। পদ্মজা নিজের অস্তিত্বের পুরো অংশ জুড়ে স্বামীরূপে একজন পুরুষকে অনুভব করে। ভালোবাসাটা শুরু হয় সেখান থেকেই। মন মাতানো ছন্দ এবং সুর দিয়ে শুরু হয় জীবনের প্রথম প্রেম,প্রথম ভালবাসা।