আমি পদ্মজা | পর্ব – ৮১

15 Min Read

পদ্মজা পূর্ণার মনের অবস্থা টের পাচ্ছে। তার মতো সহ্যশক্তি নেই পূর্ণার। পদ্মজা পূর্ণার হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বললো,’মন এতো দূর্বল হলে কি চলে?’
পূর্ণা পদ্মজার দিকে তাকালো। পদ্মজা চোখের ইশারায় বাকিটুকু পড়তে বলে। পূর্ণা এক হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছে পড়া শুরু করলো-
——
আমাদের দাদুর সঙ্গ পেয়ে আমির ছোট থেকেই নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়েছে। কাকার কথায় দাদু আমিরকে আলাদা করে সময় দিতেন। আমির কাকার বড় শিকার ছিল। আমিরের চাল-চলন ছিল অন্যরকম। তাকে ছোট থেকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে,মেয়েরা ভোগের বস্তু। শিখিয়েছে টাকার ক্ষমতা আর পৈশাচিক আনন্দ কেমন! দাদু শুরু থেকে সব জানেন। তিনি কাকা আর আব্বাকে উৎসাহিত করতেন। আমাদের দাদাকেও সাহায্য করেছেন। দাদুর সোনার অলংকারের প্রতি দূর্বলতা ছিল খুব। এই দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আমার দাদা,আব্বা,কাকা দাদুকে ব্যবহার করেছেন। দাদুর সাথে দাদুর এক বোনও ছিল। দাদুর বোন বলতে আপন নয়,পরিচিত। দুজন নারী মিলে সহযোগিতা করে এসেছে বছরের পর বছর। আমির নারীর শরীর ভোগ করার চেয়ে , আঘাত করতে পছন্দ করতো। প্রথম তিন বছর সে কোনো মেয়ের সাথে জোরপূর্বক মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেনি। সবসময় প্রতিটি মেয়ের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে।

প্রথম প্রথম আমার খারাপ লাগতো। কিন্তু একসময় অভ্যস্ত হওয়ার সাথে উপভোগ করতে থাকি। আমিরের যখন আঠারো বয়স তখন থেকে সে যৌনতার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। পাশের গ্রামের এক মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে। মেয়েটা দেখতে মিষ্টি ছিল। আমিরকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছে। বিশ্বাস করে নিজের ইজ্জত সঁপে দিয়েছিল, বিনিময়ে এরপরদিন লাশ হয়ে নদীর ঢেউয়ে ভেসে যেতে হয়েছে! আমিরের নারী আসক্তি তীব্র হয়ে উঠে। কিন্তু জোরপূর্বক কিছু করতে সে নারাজ। বেছে নেয় ছলনার পথ,প্রতারণার পথ। কতগুলো মেয়েকে সে ঠকিয়ে ভোগ করেছে তার হিসেব নেই আমার কাছে। ঢাকায় পড়তে গিয়ে কারো মাধ্যমে নারী পাচারের সাথে যুক্ত হয়। তারপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। টাকার পাহাড় গড়ে উঠে। পদ্মজা,তোমার খারাপ লাগবে। তাও বলতে হচ্ছে, তুমি যেমন আমিরের জীবনের প্রথম মেয়ে নও তেমন বউও নও! শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুন্দরী এক মেয়েকে আমির বিয়ে করেছিল। সেই মেয়েটি নিঃসন্দেহে রূপসী ছিল। সে বিয়ের পূর্বে শারিরীক সম্পর্কে আগ্রহী ছিল না বলে আমির তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মেয়েটি তার পরিবারে না জানিয়ে আমিরকে বিয়ে করে। এক সপ্তাহ পর মেয়েটি যখন আমিরের কাছে তিক্ত হয়ে উঠে, তখন মৃত্যু মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়ায়! মেয়েটির পরিবারের কেউ জানতেও পারেনি,তাদের বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়েছিল! আর সে স্বামীর হাতেই মারা গিয়েছে! আমির তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। সে তখনই ঠান্ডা মাথায় পুরো ঘটনার চিহ্ন মুছে দেয়। এটাই কিন্তু ওর একটা বিয়ে নয়। আমির আরেকটা বিয়েও করেছিল। ভিন্ন ধর্মের এক সুন্দরী মেয়েকে। তার বেলায়ও হবুহু ঘটনা ঘটে। সে মেয়ের মৃত্যু আমি নিজচোখে দেখেছি। কিন্তু কিছু বলিনি। বলতে ইচ্ছে হয়নি! মন বলতে কিছু ছিল না তখন। মেয়েটা মৃত্যুর পূর্বে অবাক হয়ে দেখছিল আমিরকে। সে বোধহয় বিশ্বাস করতে পারছিল না,যাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছে সে তাকে খুন করছে! আমির কিন্তু খুন করার ঘন্টাখানেক পরই অন্য মেয়ের সাথে সময় কাটিয়েছে! আমিরের বাড়ি-গাড়ি সব হয়। যেকোনো নারী আমিরকে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিত নির্দ্বিধায়। আমির দেখতে একটু শ্যামলা হলেও ওর কথাবার্তা, চাল-চলন, চাহনি ছিল আকর্ষণ করার মতো। যতগুলো মেয়ে আমিরকে ভালোবেসেছে বেশিরভাগই আমিরের থুতুনির কাটা দাগটা দেখে প্রেমে পড়েছে। আমির সম্পর্কিত আর কিছু বলার নেই। এইটুকুতেই তুমি আমিরের স্থান বুঝে যাবে। তোমার স্বামী একা খারাপ এই কথা বলার মুখ নেই আমার। আমি কিছু কম করিনি!

তবে আমির কাকির ব্যাপারে ছিল দূর্বল। তার সব সাবধানতা ছিল কাকিকে নিয়ে! কাকি যেন কিছু জানতে না পারেন। আমির ঢাকা থাকার কারণে,কাকি কখনো সন্দেহও করেননি। তার আগে সন্দেহ করেছিলেন কিন্তু প্রমাণ পাননি। যেদিন কাকি তোমাকে আর আমিরকে তোমাদের বাড়ি থেকে আনতে গিয়েছিলেন। সেদিন তোমরা আসার পর রাতে কাকি জানতে পারেন আমির অনেক আগে থেকে কাকার সাথে কাজ করছে। এমনকি ঢাকা এই কাজই করে। আমির কাকার সাথে ডিল নিয়ে আলোচনা করছিল। খুব চাপ ছিল মাথার উপর। চিন্তায় আমির অসতর্ক হয়ে যায়। কাকির ঘরেই কাকার সাথে নারী পাচারের বিষয়ক কথা বলছিল। আর কাকিও সব শুনে ফেলেন। তিনি খুব কাঁদেন। রাগে আমিরকে অনেকগুলো থাপ্পড় দেন। আমির কিছু বলেনি। চুপচাপ থাপ্পড় খেয়েছে। কাকি আমিরকে নিষেধ করেন, আমির আর যেন আম্মা না ডাকে। আর যেন দেখা না করে। আমির কাকিকে সামলানোর অনেক চেষ্টা করেছে। পারেনি। কাকির খুব কষ্ট হচ্ছিলো। ঘৃণায় আমিরের শার্ট টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলেছেন। কাকির নখের দাগ আমিরের পেটে-বুকে হয়তো এখনো আছে। কাকির বেঁচে থাকার সুতোটাই ছিঁড়ে যায়। সারা রাত্রি হাউমাউ করে কেঁদেছেন। অনেকবার কাকিকে স্বান্তনা দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সাহস হয়নি। আমি নিজেই তো একটা নিকৃষ্ট মানব! আবার সেদিন রাতে তুমি রুম্পার সাথে ছিলে। রুম্পা যদি সব বলে দেয় তোমাকে সে ভয়ে আমির রিদওয়ানকে পাহারায় রেখেছিল। লতিফাকে দিয়ে খাবারে ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিল। যাতে রুম্পা ঘুমিয়ে পড়ে। আমির অনেক ছলচাতুরী করেছে,তুমি যাতে কিছু না জানতে পারো।

আমার আর রুম্পাকে তুমি নতুন জীবন পেতে সহযোগিতা করেছো তাই তোমাকে আমাদের গল্পটাও বলতে চাই। জানি না আর কতদিন বাঁচব। পালিয়ে এসেছি! আমিরের হাত অনেক লম্বা। ওর আমাকে খুঁজে পেতে সময় লাগবে না। বরং অবাক হচ্ছি,এতদিনেও আমির আমাকে খুঁজে পায়নি কেন?
রুম্পাকে আমার জন্য কাকা পছন্দ করেছিলেন। বিয়ের প্রথম দিনই বুঝতে পারি,রুম্পা সরল সোজা একটা মেয়ে। রুম্পার সঙ্গ ছিল অনেক শান্তির। কখন যে ভালোবেসে ফেলি বুঝিনি। বিয়ের মাস কয়েক পর বৈশাখ মাসে আমি পাতালঘরে ছিলাম। আমার সামনে নগ্ন মেয়ে ছিল। তখন পাতালঘরের চারপাশেএতো নিরাপত্তা ছিল না। হুট করে দেখি রুম্পা চলে এসেছে। তারপরের দিনগুলো বিষাক্ত হয়ে উঠে। রুম্পাকে রিদওয়ান মারে,আব্বা মারে,কাকা মারে। আমি চুপচাপ মেনে নেই। কিন্তু খুব কষ্ট হতো। নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি। নিজের প্রতি ঘৃণা হতো। স্বামী হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ লাগতো। রিদওয়ান আমার অজান্তে আমার ভালোবাসার বউকে ধর্ষণ করে। এই খবর ধর্ষণের এক সপ্তাহ পর শুনেছি। কিন্তু আমি এমনই কাপুরুষ যে রিদওয়ানকে মারতে গিয়ে উল্টো মার খেয়ে চুপ হয়ে গিয়েছি! রুম্পা তেজি মেয়ে ছিল। ও রাগে বার বার বলেছে,পুলিশের কাছে যাবে। সব বলে দিবে। তাই রুম্পাকে মারার পরিকল্পনা করা হয়। আমি রুম্পার সাথে লুকিয়ে দেখা করি। ওর পায়ে ধরে ক্ষমা চাই। আর বলি,পাগলের ভান ধরে থাকতে। আমি মাঝে মাঝে দেখা করব। রুম্পা তেজি হলেও মৃত্যুকে ভয় পেতো খুব। পাগলের ভান ধরে থাকলে বাঁচতে পারবে এই কথা শুনে খুব কাঁদে। আর তাই করে। সে যে এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচতে চায়! রুম্পার চিৎকার,চেঁচামেচি শুনে আব্বা,কাকা ধরে নেয় রুম্পার মাথা ঠিক নেই। তবে আমিরের দৃষ্টি ঈগলের মতো। প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারে,রুম্পা পাগল নয়। মানসিক ভারসাম্যও হারায়নি। তাও কেন যেন কাউকে কিছু বলেনি! রুম্পা কিন্তু তখনো জানতো না আমির এই কাজে যুক্ত আছে। আমির আর রুম্পার সম্পর্ক ভাইবোনের মতো ছিল। আমির পরিবারের সাথে সবসময় সহজ-সরল থেকেছে। একদম সাধারণ একটা মানুষের মতো। শুরু হয় রুম্পার বন্দী জীবন আর আমার নিঃসঙ্গ রাত। একটা দিনও শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। কাপুরুষ শব্দটা সর্বক্ষণ খুঁড়ে-খুঁড়ে খেয়েছে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে দেখা করেছি। বুঝতে পেরেছি,রুম্পাকে আমি খুব ভালোবাসি। আব্বা,চাচা আর ছোট ভাই আমির এই তিন জনের ভয়ে এক পাও বাড়ানোর সাহস হয়নি। একজন লোক আমাদের দল ছেড়ে পালিয়েছিল। বিনিময়ে তার নির্মম মৃত্যু হয়েছে। সে ভারত চলে গিয়েছিল। তাও আমির ধরে ফেলেছে! বলো তো পদ্মজা,এমন ঘটনা জানার পর আমার মতো কাপুরুষ আর কী ই বা করতো? ধিক্কার আমার নিজের জীবনকে! আমাকে তো কুকুরের খাবার হওয়া উচিত! রুম্পাকে তুমি ঢাকা নিয়ে যেতে চেয়েছিলে তাই আমির বাবলুকে আদেশ করে,রুম্পাকে খুন করতে। আমি এই খবর পেয়ে পালানোর কথা ভাবি। পথে বাবলু আটক করে তখন তুমি ফেরেশতার মতো হাজির হও। এই ঋণ শোধের উপায় আমার জানা নেই।

আর কী বলবো আমি? এখন সিদ্ধান্ত তোমার। তুমি কী করবে! আমিতো সব জানিয়ে দিয়েছি। কিছু কথা না জানালেই নয়। আমির আমার কাছে সবসময় স্বচ্ছ ছিল। কিন্তু তুমি আসার পর আমি তাকে চিনতে পারি না। যখন তোমাদের বিয়ে হয় ভেবেই নিয়েছিলাম কয়দিন পর তোমার লাশও দেখতে হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। উল্টা আমির পাল্টে যায়। চারিদিকে কঠোর নিরাপত্তা দেয়া হয়। গ্রাম থেকে ঢাকা ফিরেই সুন্দরী দুই মেয়েকে সঙ্গ দেয়ার কথা ছিল। এই দুই মেয়েকে হাতের মুঠোর আনতে আমিরের সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে। সুযোগ পেয়েও আমির তাদের কাছে টানতে পারেনি। বছরখানেকে বুঝে যাই, আমির সত্যি তোমাকে ভালোবেসেছে! কোনো মেয়ের শরীর আর টানেনি আমিরকে। এ নিয়ে আব্বা,কাকার মাঝে অনেক কথা হয়েছে। আমির যদি সব ছেড়ে দেয়? আমার মনের কোণে আশা জাগে,আমির এবার আমার মতো অনুভব করবে। এই কালো জগতকে তার কালোই লাগবে। আমি নিজ চোখে দেখেছি,আমিরকে তোমার জন্য ছটফট করতে। তোমার অসুখ হলে সবকিছু ভুলে যেতো। তোমার চিন্তায় এক জায়গায় স্থির থাকতে পারতো না। এমনকি ঢাকার বাড়ি সহ আমাদের বাড়িটাও আমির তোমার নামে করে দিয়েছে। আমিরের যত সম্পদ আছে সব তোমার নামে করা। আমিরের কিন্তু নিজস্ব বলতে কিছু নেই। সে নিঃস্ব। এই খবর রিদওয়ান বা আব্বা,কাকা কেউ জানে না। কোনো কাক-পক্ষীও জানে না। চট্টগ্রাম সমুদ্রের কাছে তোমার জন্য একটা বাংলো বাড়ি বানাচ্ছে। বাড়ি বানানোর টাকা একত্রিশটা মেয়ে পাচার করার বিনিময়ে অগ্রিম নিয়েছিল। এখন সেই চাপ মাথায় নিয়ে ঘুরছে। হাতে সময় কম। কিন্তু মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না! আমার জানামতে, তুমি ধার্মিক ও পবিত্র একটা মেয়ে। তুমি এতকিছু জানার পর আমিরকে মেনে নিতে পারবে না। তোমার বিবেক তোমাকে সঠিক পথ দেখাবে। আমি যা জানি সব বলেছি। আমির তোমাকে ভালোবাসে এই কথাটা কঠিন সত্য। তুমি যদি আমিরের কাছে তার দুই চোখ চাও সে তোমার সামনে ছুরি ধরে হাঁটুগেড়ে বসে বলবে নিয়ে নাও! ছয় বছরে আমিরের যে রূপ,তোমার প্রতি যে টান আমি দেখেছি তা থেকে আমার এটাই মনে হয়। আমির তোমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে। এমন মানুষের মনে এতো ভালোবাসা দেয়ার কোনো উদ্দেশ্য হয়তো সৃষ্টিকর্তার আছে। শুনেছি,সৃষ্টিকর্তার সব সৃষ্টি কোনো উদ্দেশ্যে করা। এখন সবটা তোমার সিদ্ধান্ত। আমি এইটুকুও মিথ্যে বলিনি। তুমি বুদ্ধিমতী একটু চোখ কান খোলা রাখলেই বুঝতে পারবে। যে পদক্ষেপই নাও না কেন সাবধান থেকো। আমিরের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটা পক্ষীও উড়ে যেতে পারে না।
রুম্পা তোমাকে ভালোবাসা জানিয়েছে। কখনো সুযোগ মিললে আমাদের আবার দেখা হবে। আমার মৃত্যু যেকোনো সময় হয়ে যেতে পারে। রুম্পাকে যদি আবার ওই বাড়িতে নেয়া হয় তুমি দেখে রেখো। আল্লাহ তোমার সাথে আছেন। আমার জন্য দোয়া করো। আল্লাহ আমার শাস্তি যেন রুম্পাকে না দেন। আমাকেই যেন দেন। আর আমাকে ক্ষমা করে দেন। আমি অনুতপ্ত। এতো বড় চিঠি লিখে অভ্যেস নেই। ভুল হলে ক্ষমা করো। ভালো থেকো বোন।

ইতি,
আলমগীর।

——-
পূর্ণা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে তার বুক ভিজে গিয়েছে। সে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে বললো,’আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আপা। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।’
পদ্মজা পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরলো। পূর্ণা পদ্মজার বুকে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে থাকলো। পদ্মজা তার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলে। পূর্ণা দুই হাতে শক্ত করে ধরে পদ্মজাকে। তার প্রিয় বোনের এতো কষ্ট! সে সহ্য করতে পারছে না। পূর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বললো,’ভাইয়া তোমার আগে আরো দুটো বিয়ে করেছে। এই ব্যথা কীভাবে সহ্য করেছো আপা?’
পদ্মজা কান্না আটকিয়ে রেখেছিল। এই কথা শুনে ভেতর থেকে কান্না আপনা আপনি চলে আসে। পূর্ণাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। একটা মানুষ খুঁজছিল সে,যাকে জড়িয়ে ধরে মনখুলে কাঁদা যাবে। আমির অত্যাচারী, হিংস্র,নারী ব্যবসায়ী এইটুকুর ব্যথাই সে হজম করতে পারেনি। চিঠি পড়ে যখন জানতে পারলো,আমির নারী আসক্ত ছিল। এমনকি বিয়েও করেছে। তখন ইচ্ছে হচ্ছিল,গলায় ফাঁস লাগিয়ে মরে যেতে। ঠান্ডা মেঝেতে বসে হাত-পা ছড়িয়ে কেঁদেছে। বার বার চোখে ভেসে উঠেছে আমিরের সাথে অনেক মেয়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। একজন স্ত্রীর জন্য এটা কতোটা বেদনাদায়ক হতে পারে,তার কোনো পরিমাপ নেই। পদ্মজা চোখের জল মুছলো। পূর্ণাকে সামনাসামনি বসিয়ে বললো,’ এখন কাঁদার সময় নয়। তোকে আমি সব জানিয়েছি,যাতে প্রেমাকে দেখে রাখতে পারিস। আর নিজেও সাবধানে থাকিস। আমি একটা ছুরি দেব। নিজের সাথে রাখবি। রিদওয়ানের নজর ভালো না। প্রেমার দায়িত্ব তোর। তোর বিয়ে দিয়ে দেব তিন-চারদিনের মধ্যেই।’

‘আপা?’ পূর্ণার কণ্ঠটা অদ্ভুত শোনায়। পদ্মজা তাকালো। পূর্ণা ঢোক গিলে নতজানু হয়ে কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বললো,’ভাইয়ার কোনো ক্ষতি করো না আপা।’
কথা শেষ করেই জোরে কেঁদে উঠলো পূর্ণা। সে বুঝতে পারছে সে অন্যায় আবদার করেছে। পাপীর প্রতি মায়া দেখাচ্ছে। কিন্তু আমিরকে সে আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। আমির কখনো বড় ভাইয়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। মাথার উপরের ছাদ হয়ে থেকেছে। সবচেয়ে বড় কথা তার প্রিয় বোনের ভালোবাসার মানুষ আমির। কেউ না জানুক সে জানে,আমির ছাড়া পদ্মজা বেঁচে থেকেও মৃত। পদ্মজা তার মা হেমলতার মতো হয়েছে। সত্যকে,ন্যায়কে বেছে নিবে। ভালোবাসার সিন্দুকটা তালা মেরে রাখবে। তারপর কষ্টে ধুঁকে-ধুঁকে মরবে। পূর্ণার কথা শুনে পদ্মজা অবাক হয়ে উচ্চারণ করলো,’পূর্ণা!’
পূর্ণা পদ্মজার কোলের উপর মাথা নত করে বললো,’আপা,আমি খুব খারাপ। কিন্তু তোমার সুখ আমার কাছে সবচেয়ে বড়। ভাইয়া তোমাকে ভালো রাখবে। ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে। আগের সব ভুলে যাও। মাফ করে দাও। আমি জানি তুমি ভাইয়াকেও ছাড়বে না। ভাইয়ার কিছু করে ফেলবে। আপা,দোহাই লাগে। তোমার সুখ নষ্ট করো না।’

পদ্মজা আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে অবস্থান করছে। পূর্ণা মাথা তুলে তাকায়। পদ্মজা প্রশ্ন করে,’ আর যে মেয়েগুলো অত্যাচারিত হয়েছে? যে মেয়েগুলো ঠকেছে? যে মেয়েগুলো যন্ত্রনায় ছটফট করে জীবন দিয়েছে? তাদের প্রতি অন্যায়ের শাস্তি কে দিবে?’
পূর্ণার সহজ উত্তর,’তোমাকে তো কিছু করেনি। তোমাকে তো ভালো রাখবে।’
পদ্মজা নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। সে ভেবেছিল পূর্ণা ঘৃণায় আমিরকে খুন করতে চাইবে। খুন করতে চাইবে রিদওয়ান, খলিল আর মজিদকে। কিন্তু এ তো উল্টা সুর তুলছে! পদ্মজা গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে পূর্ণাকে থাপ্পড় দিল। পূর্ণা আকস্মিক ঘটনায় নিজেকে শক্ত রাখার সুযোগ পায়নি। বিছানা থেকে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে। পদ্মজার নাক লাল হয়ে গেছে। সে রাগে পূর্ণাকে বললো,’ ছিঃ! তুই আম্মার মেয়ে!’

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।