সালমা চৌধুরী
সালমা চৌধুরী

প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | ভালোবাসার জয়

৫২ ভিউ
০ মন্তব্য
১ মিনিট

তানভির বিড়বিড় করতে করতে নিজের রুম পর্যন্ত যেতেই ফোনে কল বেজে উঠল৷ তানভিরের বেস্ট ফ্রেন্ড সোহাগ কল দিচ্ছে৷ তানভির কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সোহাগ একদমে কতকি বলতে থাকলো। তানভির প্রখর তপ্ত স্বরে বলল, ” আমাকে এসব বলে কোনো লাভ নাই৷ আমি এখন আসতে পারবো না। এমপির সাথে একটা পোগ্রামে যেতে হবে। ” “প্লিজ দোস্ত৷ একটু আয়! ” “আরে ভাই আমার সময় নাই। ”

” শুন তানভির, আমাকে যতই ব্যস্ততা দেখাস সমস্যা নাই। কিন্তু তোর গার্লফ্রেন্ড এর জন্য অন্তত আয়।” ” একদম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবি না। তোর আমার মাঝখানে ও কে কেনো টানতেছিস?” “কারণ আমার কথা তুই গুরুত্ব দিচ্ছিস না। প্লিজ তানভির, জাস্ট ৫ মিনিট লাগবে, আয় তুই। ” তানভির ভারী কন্ঠে শুধালো,


“বন্যা কি এখনও ভার্সিটিতে? ” “আমি তোর কাছে সকাল থেকে চিল্লাচিল্লি করছি, তুই আমাকে পাত্তা দিচ্ছিস না৷ বন্যার নাম শুনতেই কন্ঠস্বর পাল্টে গেছে। দাঁড়া, এখন থেকে তোকে ওর কসম দিয়ে সব কাজ করাবো।” তানভির রাগান্বিত কন্ঠে বলল, ” আর যাই করিস, কোনোদিন ওর নাম নিয়ে কসম কাটতে বলবি না। পরিবারের বাহিরে ও আমার একমাত্র দূর্বলতা। তাছাড়া কসম কাটা ঠিক না। ”

“আচ্ছা ঠিক আছে, কাটাবো না কসম। এখন বল আসবি ?” “বন্যা যদি সত্যি ই ভার্সিটিতে থাকে তাহলে আসবো।” “আরে আছে আছে। প্রয়োজনে আটকিয়ে রাখবো। তাও তুই আয়। আমার কাজ টা কিন্তু করে দিতে হবে। ” ” ভুলেও বন্যাকে কিছু বলতে যাইস না। আমি আসতেছি।”

তানভির দ্রুত বেড়িয়ে পরেছে। এদিকে মেঘ আবিরের আড়ালে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। তানভির চলে গেছে অনেকক্ষণ আগে, মেঘ আতঙ্কে এখনও চোখ খুলতে পারছে না। আবির ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে অপলক দৃষ্টিতে মেঘকে দেখছে। তিরতির করে কাঁপছে মেঘের ওষ্ঠদ্বয়, লজ্জা আর ভয়ে নাকের ডগা আর গাল পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। নিস্তব্ধতা বুঝতে পেরে মেঘ ধীরে ধীরে চোখ মেলল ৷ সরাসরি চোখ পরল আবিরের চোখের দিকে। আবিরের নেশাক্ত দৃষ্টি দেখে মেঘ লজ্জায় মাথা নিচু করে ঘাড় কাত করে তানভিরকে দেখার চেষ্টা করলো। তানভিরকে রুমের কোথাও দেখতে না পেয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

” ভাইয়া কোথায়?” “চলে গেছে ” “কেন?” “সেটা আমি কিভাবে বলবো, তোর ভাইকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে।” হঠাৎ দেয়ালের দিকে আবিরের নজর পরে। যে হাতটা দিয়ে নিজেকে আঁটকেছিল সেই হাতে যে রঙ ছিল আবিরের সেটা খেয়াল ই ছিল না। মেঘের চুল বাঁচাতে গিয়ে উল্টো দেয়াল নষ্ট করে ফেলেছে। আবিরের সাথে সাথে মেঘ ও চোখ ঘুড়িয়ে তাকালো। দেয়ালে আবিরের হাত দেখে আর্তনাদ করে উঠল,

“এটা আপনি কি করলেন?” “আমি ইচ্ছে করে করছি নাকি? তোর চুল বাঁচাতেই তো করেছি। ” মেঘ একটু দূরে সরে দেয়ালটাকে দেখে পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” আমি এখানটায় এখন কিভাবে ডিজাইন করবো?”

আবির মেঘের হাতের কব্জিতে শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে রঙের বক্সে চুবিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালে ছাপ দিল। যেখানে আবির হাতটা রেখেছিল ঠিক সেখানেই। মেঘ আটকানোর খুব চেষ্টা করেছে কিন্তু আবিরের শক্তির সামনে মেঘ অতি নগন্য একটা মানুষ৷ আবিরের হাতের রঙ অনেকটা শক্ত হয়ে যাওয়ায় ঠিকমতো বুঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু মেঘের হাতের ছাপ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। ভালোভাবে খেয়াল করলে মেঘের ছোট্ট হাতকে ঘিরে আবিরের বড় হাতের অপ্রখর ছাপ টা ঠিকই চোখে পরে। মেঘ ক্ষুদ্ধ হয়ে বলল,

” আপনি এমন করলেন কেন?” ” কি ডিজাইন করবি ভেবে পাচ্ছিস না তাহলে কি করব?” মেঘ শক্ত কন্ঠে বলল, ” আমি কিন্তু সম্পূর্ণ দেয়াল টায় নষ্ট করে ফেলবো।” আবির মুচকি হেসে বলল, ” একদিনের জন্য রুম তোকে দিয়ে দিয়েছি, সাজাবি নাকি নষ্ট করবি পুরোটাই তোর উপর। আমি কিছুই বলবো না। ” মেঘ শীতল কণ্ঠে বলে উঠল,

“মাঝখানে হাতের ছাপটার কারণে কি পঁচা লাগছে। আপনি এমনটা না করলেও পারতেন। ” আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “তুই তোর কাজ শেষ কর, তারপর দেখিস কত সুন্দর লাগে। ” মেঘ মুখ ভোঁতা করে ঠোঁট ভেঙে কাঁদো কাঁদো মুখ করে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির মুচকি হেসে দু আঙুলে মেঘের রাগে ফুলে উঠা নাকটা আলতোভাবে চেপে মোলায়েম কন্ঠে বলল, ” দেয়াল জুড়ে এত সুন্দর পেইন্টিং থাকবে আর তাতে ডিজাইনারের হাতের ছাপ থাকবে না তা কি করে হয়! ছাপ টার নিচে তোর নামটাও লিখে দিস। ” “বাসার মানুষ দেখলে কি ভাববে!”

” বাসার মানুষ যখন জিজ্ঞেস করবে এই ডিজাইন কে করেছে? তখন আমি কি বলবো? শেওড়াপাড়ার পে*ত্নীটা ডিজাইন করে দিয়ে গেছে নাকি আমার কাল্পনিক বউটা এসে করেছে?” মেঘ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে রাগী স্বরে বলল, “কথায় কথায় বউ বউ করবেন না। আমি কিন্তু বড় আব্বুকে বলে দিব ” “কি বলবি?”

“বলবো আপনি সারাদিন বউ বউ করেন, অথচ বিয়ের কথা বললে ভাব নেন। আপনাকে ডাক্তার দেখাতে হবে! ” আবির নিঃশব্দে হেসে শুধালো, “তুই কি আমায় ইন্ডাইরেক্টলি পাগল বললি? ” “মুখের উপর কিভাবে বলবো! ” “কিহ?”

আবির এক পা এক পা করে এগুচ্ছে, মেঘ পেছাতে পেছাতে চেঁচিয়ে উঠল, “এমন করলে আমি কিন্তু চিৎকার করবো।” “কর চিৎকার। কাকে ডাকবি ডাক, দেখি তোকে কে বাঁচায়। ” মেঘ ভেঁজা কন্ঠে ডেকে উঠল, ” আম্মু বাঁচাও!” আবির মেঘের মুখ চেপে ধরে ঠাট্টার স্বরে বলল,

“ছিঃ মেঘ! যেভাবে মামনিকে ডাকছিস, মামনি ভাববে আমি তোকে ধ*… ছিঃ ” মেঘ বিস্ময়কর দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির মেঘের মুখ ছেড়ে কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “সরি, তোকে আর ডিস্টার্ব করব না। তুই তোর কাজ শেষ কর। ”

আবির টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেছে৷ মেঘ আহাম্মকের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। আবির ভাই যে রাগ করেছে এটা ওনার কথাতেই বুঝা গেছে। মেঘ কি করবে তাই ভাবছে। আচমকা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে নজর পরতেই মেঘ সব ভুলে গেল। গালে আবিরের হাতের স্পর্শ, গলা আর ঘাড়েও আঙ্গুলের দাগ, নাক আর কপাল জুড়েও রঙ লেগে আছে। মেঘ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভাবছে আর বার বার লজ্জায় ললিত হয়ে যাচ্ছে৷ মেঘ নিজের গালে হাত রেখে আবিরের স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করছে ওমনি বুকের ভেতর কম্পন শুরু হয়ে গেছে । আচমকা মীম দরজায় দাঁড়াতেই মেঘ তাড়াহুড়ো করে দেয়ালের দিকে ঘুরে মাথায় ওড়না দিল যাতে রঙের দাগ মীম কোনোভাবেই না দেখে। মীম দৌড়ে এসে উত্তেজিত কন্ঠে শুধালো, “আপু তুমি আমায় দেখে কি লুকাইছো? দেখি এদিকে ঘুরো তো৷ ”

মেঘ দেয়ালে রঙ করতে করতে তপ্ত স্বরে বলল, “ডিস্টার্ব করিস না৷ রুমে যা ” “তুমি কি লুকাচ্ছো বলো, তাহলেই চলে যাব।” মেঘ হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “আবির ভাই কিন্তু ওয়াশরুমে আছে। ডাকবো?” মীম উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

“ভাইয়া রুমে আগে বলবা না, আমি গেলাম। পরে এসে দেখবো তুমি কি লুকাইছো। ” মেঘ কিছুক্ষণ ভেবে পুনরায় কাজ শুরু করল। আবির ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে ভেজা শরীরে টিশার্ট গায়ে দিয়ে ফোন নিয়ে চুপচাপ রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে, মেঘের দিকে একবারের জন্য তাকিয়েও দেখে নি। মেঘ অসহায় মুখ করে আবিরের যাওয়ার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলো। চোখেমুখে বিষন্নতা ভর করেছে, তবুও সবকিছু একপাশে রেখে কাজে মনোযোগ দিল। আবির নিচে নামতেই মীম ছুটে গেল মেঘকে দেখতে। ততক্ষণে মেঘ রঙ দিয়ে গালে আর গলায় থাকা আঙুলের ছাপ গুলো মুছে ফেলেছে। মীম রুমে ঢুকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“তখন কি লুকাইছিলা?” মেঘ স্বাভাবিক ভাবে ঘুরে মীমের গালে রঙের দু আঙুল ছুঁইয়ে বলল, “তোর কাছ থেকে আমি কি লুকাবো বল?” “আপু তোমার গালে এত রঙ কেন?” “খেয়াল ছিল না, হুট করে গালে হাত দিয়ে ফেলছিলাম। ” দুটা দেয়াল ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে মীম বলল, “আপু, দুটা ডিজাইন ই অনেক সুন্দর হয়েছে। ভাইয়ার রুমটা অন্যরকম সুন্দর লাগছে। ” মেঘ মৃদুস্বরে বলল,

“সত্যি সুন্দর হয়েছে?” “১০০% সত্যি। ” “ওনার কি পছন্দ হবে? কিছুই তো বললেন না” “আমি বলছি ভাইয়ার পছন্দ হবেই হবে। তাছাড়া তুমি যা এঁকে দিবা ভাইয়া সেটার ই প্রশংসা করবে দেইখো। সেটা যদি ব্যাঙের ছাতাও হয় তবুও বলবে অনেক সুন্দর হয়েছে। ” মীম বিছানার উপর বসে পা ঝুলাচ্ছে আর মেঘের সাথে গল্প করছে। মেঘ আবিরের কথা মতো নিজের হাতের ছাপটার নিচে নিজের নাম লিখেছে তাছাড়া একসাইডে ‘সাজ্জাদুল খান আবির’ নাম লিখে ডিজাইনও করে দিয়েছে। মীমকে কিছু জিনিস দিয়ে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে। বাকি গুলো নিয়ে মেঘ পেছন পেছন আসছে। এতক্ষণের মধ্যে আবির একবারও উপরে যায় নি৷ মীম নিচে আসতেই আবির প্রশ্ন করল,

” তোর বোনের কাজ শেষ হয়েছে? ” “হ্যাঁ। অনেকক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে।” আবির কোনো কথা না বলেই নিজের রুমে চলে গেছে। দুটা দেয়ালের ডিজাইনের কারণে রুমটাকে চেনায় যাচ্ছে না। আবিরের রুম টা খান বাড়ির সবগুলো রুমের থেকে বড়। এক সময় এই রুমে আলী আহমদ খান আর মালিহা খান থাকতেন। ওনাদের জন্য ই মূলত বানানো হয়েছিল পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যার কারণে আলী আহমদ খানরা নিচে চলে আসেন। আর রুমটা আবিরের দখলে চলে যায়। রুমটার ঠিক মাঝামাঝিতে দরজাটা অবস্থিত।

ভেতরে একপাশে আবিরের ব্যবহার্য সব প্রয়োজনীয় সামগ্রী আর অন্য পাশে সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ছোটবেলার সাইকেল থেকে শুরু করে, লাগেজ, ক্রিকেট, ফুটবল খেলার যাবতীয় জিনিসপত্র, পুরোনো একটা ওয়ারড্রব আরও অনেককিছু। ঐদিকের সব জিনিসপত্র বড় কাপড় দিয়ে ঢাকা। মালিহা খান বলেছিলেন পুরোনো জিনিসপত্র স্টোররুমে রেখে দিতে কিন্তু আবির সেগুলো সরাতে রাজি হয় নি। রুমে আর্ট করায় এখন এক পাশ অতিরিক্ত সুন্দর হয়ে গেছে আর অন্যপাশ অগোছালো।

তবে আবিরের সেদিকে মনোযোগ নেই। আবির উদ্রিত নয়নে দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে। একবার চোখ পরছে নিজের নামের দিকে পুনরায় নজর আঁটকায় মেঘের হাতের ছাপে সেই সাথে লেখা ‘Megh’ নামটার উপর। অকস্মাৎ আবিরের মুখে হাসি ফুটে। অন্যদিকে তানভির ভার্সিটির সামনে আসতেই সোহাগ আর শিমুলকে দেখতে পেল। ওরা তানভিরকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে আসলো। তানভির প্রশ্ন করল,

“বন্যা কোথায়?” ” চল,আমাদের কাজটা আগে শেষ করে আসি! ৫ মিনিটের কাজ। ” “বন্যার সাথে আগে দেখা করবো তারপর তোদের ব্যাপারটা ভেবে দেখব।” “দুটা মেয়ের সাথে ঐদিকে গেল। ”

তানভির ওদের দেখানো পথে বাইক স্টার্ট দিল। থামলো ঠিক বন্যাদের পেছনে। বন্যারা পেছন ফিরে তাকিয়েও দেখল না। তানভির ঘনঘন হর্ন দিতে লাগলো। একপ্রকার বিরক্ত হয়ে বন্যা পেছন ফিরতেই দেখলো তানভির বাইক থেকে নিরেট দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বন্যা চেহারা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। তানভির গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এদিকে আসো।”

বন্যা বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে আসলো। তানভির প্রখর তপ্ত স্বরে বলল, “ফোন দিলে ফোন রিসিভ করার প্রয়োজন মনে করো না। ইদানীং ফোন বন্ধ করে রেখেছো। সমস্যা কি?” বন্যা স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ” আমার ফোন নষ্ট হয়ে গেছে, নতুন ফোন কিনতে হবে। আব্বু বলছেন আগামী সপ্তাহে ফোন কিনে দিবেন।” “ওহ৷ আর কোনো কারণ নেই তো?” “আর কি কারণ থাকবে?”

“ভাইয়া যখন এক্সিডেন্ট করেছিল তখন তোমাকে রাগে উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলাম তারজন্য দুঃখিত। ভাইয়ার র*ক্তা*ক্ত দেহ দেখে আমি তখন মানসিকভাবে ভেঙে পরেছিলাম। বুঝে না বুঝে তোমার সাথে রাগ দেখিয়েছি৷ ” বন্যা মলিন হেসে বলল, ” কোনো ব্যাপার না। আমি কিছু মনে করি নি। আপনার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো এভাবেই রিয়েক্ট করতাম নয়তো আরও বেশি করতাম৷ ” “I am really Sorry, Bonna.” “এত ফরমালিটি করতে হবে না। আমি সত্যি ই কিছু মনে করি নি। আবির ভাইয়া এখন কেমন আছেন? মেঘ কেমন আছে?”

“দুজনেই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।” বন্যা হঠাৎ ই ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে শুধালো, “একটা কথা জিজ্ঞেস করব?” “হ্যাঁ অবশ্যই। ” “আপনি মিনহাজ আর তামিমকে কি করছিলেন?” “কেনো? কোনো সমস্যা? ”

“না না৷ ওরা অনেকদিন ভার্সিটিতে আসে নি। এখন আসলেও অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে তাই বলছিলাম..! ” “ওহ আচ্ছা। এসব কোনো বিষয় না। আমি বেশি কিছু করি নি। আমার জায়গায় ভাইয়া থাকলে ওদের আর কোনোদিন দেখতেও পারতা না। ” তানভির একটু থেমে আবার প্রশ্ন করল, “ওহ একটা কথা, ভার্সিটিতে কেউ তোমাকে ডিস্টার্ব করে?” বন্যা মনে মনে আওড়াল, “ডিস্টার্ব করলেও তো আপনাকে বলবো না।” স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ” নাহ। ”

“যদি মনে করো আমাকে না বললে আমি কিছু জানতে পারবো না তাহলে এটা তোমার ভুল ধারণা, বরং তুমি নিজ থেকে জানালে তোমারই লাভ। ” বন্যা কপাল গুটিয়ে ধীর কন্ঠে বলল, “এখন আসি। ” “যেতে বলছি তোমায়?” “আমার তাড়া আছে। ” “কেন?কেউ অপেক্ষা করছে?” “মানে..” “কিছু না।” “ভার্সিটিতে পরশুদিন পোগ্রাম আছে কষ্ট করে মেঘকে জানিয়ে দিয়েন৷ ” “ঠিক আছে। এখন চলো” “কোথায়?” “তোমায় কিছু খাওয়ায়। ”

“আমি আজ কিছু খাবো না। অন্য কোনো দিন আমি আপনাদের খাওয়াবো।” তানভির ভারী কন্ঠে বলল, “সেসব পরে দেখা যাবে, এখন বাইকে বসো। একগ্লাস আঁখের জুস হলেও খেতে হবে। না হয় আমি ধরে নিব, তুমি আমার উপর রাগ করে আছো। ” “আমি সত্যি রেগে নেই। বিশ্বাস করুন।” “মানলাম & বিশ্বাসও করলাম, এখন চলো।”

বন্যা দাঁতে দাঁত চেপে বাইকে উঠে বসলো। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তানভিরের সঙ্গে দু গ্লাস আঁখের জুস খেয়েছে। শুধুমাত্র মেঘের ভাই বলে বাধ্য হয়ে বন্যা তানভিরের সাথে কথা বলে, না হয় কোনোদিন বলতো না। মিনহাজ আর তামিমকে বন্যা দু একবার জিজ্ঞেস করেছিল, কি হয়েছিল বলতে কিন্তু ওরাও কিছু বলে না। বারবার কথা এড়িয়ে যায়, তারজন্য বন্যাও তেমন জোর করে না। তবে ভালো কিছু যে ঘটে নি, বন্যা ১০০% নিশ্চিত।

আবিরের অসুস্থতার পর থেকে মেঘ মিনহাজদের কথা ভুলেও ভাবে না৷ বন্যা কিছু বললেও তেমন পাত্তা দেয় না, এমনকি রেগুলার ভার্সিটিও আসে না। বাড়ির কেউ কিছু বললে, শরীর খারাপ, মন খারাপ বলে নানান বাহানা দেয় আর বাকি সব তানভির সামলায়। না বোনকে কিছু বলতে পারে আর না বাসায়৷ মেঘের চোখে তানভির সেরা ভাই হলেও বন্যার চোখে তানভির একজন রাজনীতিবিদ, দাপটী, ভি*লেন টাইপের ছেলে। এত বছর যাবৎ মেঘকে শাসন করা দেখে বন্যা তানভিরকে ভয় পেত, মিনহাজদের ঘটনার পর থেকে বন্যা আরও বেশি আতঙ্কে থাকে। দূরত্ব মেইনটেইন করে চলে। তানভির বন্যাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে সোহাগ দের কাছে আসছে৷ সোহাগ ঠাট্টার স্বরে বলল,

“আগে আসতেই চাইছিলি না আর এখন….” তানভির মুচকি হেসে বলল, ” কতদিন পর মেয়েটাকে দেখলাম।” “আহা! কত আবেগ! ” “কোথায় যাবি বলছিলি চল” বিকেল থেকেই মেঘ আর মীম শপিং এ যাবে বলে পাগলামি করছে। তানভিরকে যেতে বলা হয়েছিল কিন্তু তানভির পোগ্রামে ব্যস্ত বলে যেতে পারবে না ৷ মেঘ আর মীম একা যেতে পাগলামি শুরু করেছে৷ ওদের হাউকাউ শুনে আবির নিচে আসছে। আবিরকে দেখেই দুই বোন চুপ করে গেছে৷ সদ্য ঘুম থেকে উঠে আসায় আবিরের চোখগুলো লাল টকটকে হয়ে আছে।

আবির অস্ফুট কন্ঠে শুধালো, “কি হয়েছে তোদের?” মেঘ, মীম কেউ কোনো কথা বলল না। আকলিমা খান বললেন, “ওরা শপিং এ যেতে চাচ্ছে।” “যেতে চাচ্ছে যাক, সমস্যা কি?” “একা যেতে চাচ্ছে! ” আবির কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “একা যেতে হবে কেন? তোমরা না গেলে আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি । ” মেঘ আর মীম দুজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “নাহ!”

রাগে আবিরের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। কপাল কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো, “সমস্যা কি তোদের?” মেঘ মাথা নিচু করে উত্তর দিল, “কোনো সমস্যা নাই” “সমস্যা না থাকলে কাকিয়াদের নিয়ে শপিং এ যা৷ বেশি ত্যাড়ামি করবি না। ঠিক আছে?”

মেঘ একদৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে উপর নিচ মাথা নাড়লো। অনুমতি ছাড়া একা শপিং এ যাওয়া অসম্ভব বিষয় এটা তাদের অজানা নয়, তবুও চেষ্টা করে দেখছিল, যদি অনুমতি পেয়ে যায়। আবির আগের ভাবমূর্তি বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে, মেঘ আর মীম তাড়াহুড়ো করে নিজেদের রুমে চলে গেছে। হালিমা খান আর আকলিমা খানের সঙ্গে মীম আর মেঘ শপিং এ গেছে। মেঘ আর মীম সুযোগ বুঝে আবিরের জন্য ২-৩ টা সাদা টিশার্ট, আর দুজনের জন্য ৩ টা পাঞ্জাবি কিনে নিয়ে আসছে। মেঘরা বাসায় ফিরতেই তানভির ভার্সিটির পোগ্রামের কথা বলেছে৷ আবিরও সেখানেই উপস্থিত ছিল৷ মেঘ নিজের হাতের শপিং ব্যাগ গুলো লুকিয়ে নিজের রুমে নিয়ে গেছে৷ আবির বিষয়টা খেয়াল করেও কিছু বলে নি৷

আবির রাতে ঘুমানোর জন্য রুমে ঢুকে দরজা চাপাতেই রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেছে। আবিরের দরজার আড়ালে মেঘের হাতের ছাপটা আগের মতো বেরঙিন নেই। মেঘ সেখানে নীল রঙের ছাপ দিয়েছে, এমনকি অন্য হাতের ছাপও দিয়েছে। পাশাপাশি মেঘের দু হাতের ছাপ দেখে আবির মুচকি হেসে বলল, ” পাগলি একটা। ”

পোগ্রামের দিন ঠিক সময় মতো মেঘ ভার্সিটিতে চলে আসছে৷ মেঘকে দেখে মিনহাজ আর তামিম এগিয়ে এসে শুধালো, “কেমন আছিস? ” মেঘ অন্যদিকে মুখ করে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ। ”

মেঘ ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। বন্যা আর মেঘ দুজনেই আজ গাউন ড্রেসের সঙ্গে হিজাব পড়ে আসছে। মেঘ আর বন্যা কিছুটা সামনে এগুতেই লিফাত নামের ছেলেটার সাথে দেখা। লিফাতের হাতে সিগারেট, বন্যা আর মেঘকে দেখেই থতমত খেল। সিগারেট পেছনে ফেলে শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছো তোমরা?” বন্যা আর মেঘ দুজনেই কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে৷ বন্যা ঠান্ডা কন্ঠে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো।” বন্যা মেঘের হাত ধরে বলল, “চল এখান থেকে।!

মেঘ তখনও সরু নেত্রে লিফাতকে পরখ করছে। ছেলেটার মুখে রহস্যময় হাসি৷ লিফাত প্রশ্ন করল, ” কেউ কেমন আছো জিজ্ঞেস করলে প্রতিত্তোরে তাকেও জিজ্ঞেস করতে হয় এটাও কি জানো না?” বন্যা শক্ত কন্ঠে জবাব দিল, “নাহ। জানি না। ” বন্যা মেঘকে টেনে নিয়ে চলে গেছে । মেঘ কপাল কুঁচকে শুধালো, “এই ছেলে আবার কে?” “রসায়ন ডিপার্টমেন্টের চতুর্থ বর্ষের এক বড় ভাই৷ ” “তোর সাথে কথা বলতে আসছে কেন?”

“আল্লাহ জানেন। তুই তো ইদানীং তেমন ক্লাসে আসিস না, একদিন আমি ফোনে কথা বলছিলাম, তখন এই ছেলে ইচ্ছে করেই আমার কাছে গেছে। আমি হঠাৎ ঘুরাতে প্রায় ধাক্কা লেগেই গেছিল, কথা বার্তা নেই হুট করে আমাকে ধমকিয়ে চলে গেছে। এরপর থেকে দেখলেই কেমন করে হাসে, এটা সেটা জিজ্ঞেস করে৷ ইচ্ছে করে মা*থাটা ফা*টিয়ে দেয়। ”

“ভাইয়াকে বলবো?” “না না না৷ তোর ভাই আরেক ডেঞ্জারাস পাবলিক। ঐদিন দেখা হয়ছিল পরেও জিজ্ঞেস করতেছিল, আমাকে কেউ ডিস্টার্ব করে কি না!” “তুই কি বলছিস?” “আমি না করছি।” “কেনো?” “তোর ভাই মিনহাজদের যে অবস্থা করছে, আমি আর কাউকে বিপদে ফেলতে চাই না।” “তাহলে আবির ভাইকে বলি?”

“ভুলেও না। তোর এই গু*ন্ডাপা*ন্ডা ভাইদেরকে আমার ব্যাপারে কিছু বলবি না।” “তুই গুন্ডাপান্ডা কাকে বলছিস? আমার আবির ভাই ভাই হিরো নট ভি*লেন ওকে?” “আর তোর ভাই?” “আমার ভাই ও হিরো৷ মিনহাজদের যদি মে*রেও থাকে, ভাইয়া কি শুধু শুধু মা*রছে নাকি? আমার কর্মকাণ্ডে তোর কি তখন আমাকে মা*রতে ইচ্ছে করে নি? বল করে নি?” “করেছে। ”

“তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়েও আমার কাজে তুই আমার উপর বিরক্ত হয়ছিস৷ এমনকি আমি নিজেই আমার উপর বিরক্ত ছিলাম। সেখানে ভাইয়া না মিনহাজকে চিনে, আর না তামিমকে চিনে। আবির ভাই আর তানভির ভাইয়ার প্রাণ এক সুতোয় বাঁধা, ওদের একজনের কিছু হলে আরেকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাঁচাবে। সেখানে সামান্য মা*ইর আর এমন কি!” বন্যা উদাসীন কন্ঠে বলল, “এখন চল, অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে ” মেঘ আর বন্যা ভেতরে ঢুকলো। পেছন দিকে বসতে যাবে এমন সময় ওদের একজন ক্লাসমেট সামনে থেকে ডেকে বলল,

“মেঘ, তোরা এখানে আয়। তোদের জন্য সিট আছে।” মেঘ আর বন্যা এগিয়ে গেল। পাশাপাশি দুটা সিটে মেঘ আর বন্যা বসলো৷ ওদের সামনের সারিতেই লিফাতের বন্ধুরা বসা, কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই লিফাত এসে বসলো। মেঘ আর বন্যা লিফাতকে দেখেই পেছনে চলে যাওয়ার জন্য ফিসফিস শুরু করল। লিফাত পেছনে ঘুরে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “আরে তোমরা এখানে, কোনো কিছু লাগলে শুধু একবার বলবা, সাথে সাথে এনে দিব। ” বন্যা আর মেঘ দুজনেই রাগে ফুঁসছে। বন্যা কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেউ একজন রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল,

” তোর কলিজাটা আমার লাগবে, দে এখন ” মেঘ আর বন্যা দুজনেই চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকালো৷ লিফাত ও আঁতকে উঠে সেদিকে তাকালো। চোখ পর্যন্ত ঢেকে রাখা ক্যাপ টা সরাতেই তানভিরের মুখটা স্পষ্ট দেখা গেল। লিফাতের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তানভিরকে দেখে বন্যা আর মেঘ দু’জনেই ভয় পাচ্ছে। লিফাত বেশ কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎ ই হেসে ফেলল। তানভির চোখ মুখ কুঁচকে পুনরায় বলল,

“কি হলো দিবি না? মেয়েদের প্রতি এত যত্ন, যা চাইবে সাথে সাথে এনে দিবি আর আমি সামান্য কলিজাটা চাইছি তুই সেটা দিতেই রাজি হচ্ছিস না! লিফাত, তোর থেকে এটা আশা করি নি।” লিফাত হঠাৎ ই অস্বাভাবিকভাবে হাসতে শুরু করল, হাসতে হাসতে বলল, ” আরে ভাই তুমি? তোমার কি লাগবে বলো শুধু! দেখো তোমার ভাই তোমার জন্য কি করে!” তানভিরের চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল, “আপাতত তোর কলিজাটা হলেই হবে৷ চাইলে তোর হার্টটাও দিতে পারিস, আমিও দেখি ঐখানে ঠিক কতজনকে জায়গা দিয়েছিস৷ ”

লিফাত মুখে হাসি রেখেই বলল, এই সর সর, আমাকে সাইড দে। লিফাত এগিয়ে আসতেই তানভির বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো । লিফাত তানভিরকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, “প্লিজ ভাই, এখানে অনেক জুনিয়র আছে। ওদের সামনে আমার মানসম্মান টা ডুবিয়ো না। প্লিজ।” তানভির রাগান্বিত কন্ঠে গজগজ করতে করতে বলল,

“তোর হিসাবের খাতায় এখন অব্দি ১০০০ খানের মেয়ের নাম উঠেছে। আর কত?” “সরি ভাই। তুমি এখানে কেন আসছো ওরা কি তোমার কিছু হয়? নাকি অন্য কারো জন্য আসছো?” “যেই বন্যার পিছনে ঘুরঘুর করছিস সে একান্ত ই আমার, তার পাশের জন আমার একমাত্র বোন আর আবির ভাইয়ার পার্সোনাল সম্পত্তি। তুই ভুল জায়গায় হাত বাড়িয়েছিস লিফাত, তোকে কি করা উচিত নিজেই বল। ” “সরি ভাইয়া। প্লিজ মাফ করে দাও। আমি জানতাম না ওরা তোমার কাছের লোক।” “তোকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি লিফাত, ভবিষ্যতে কোনো মেয়ের দিকে কুনজর দিলে, সার্টিফিকেট নিয়ে বের হতে পারবি না বলে দিলাম। ”

“প্লিজ তানভির ভাই, এমনটা করো না। প্রয়োজনে আমি তোমার পায়ে ধরে মাফ চাইবো। আবির ভাইয়া কোথায় আছেন, আমি ওনার পায়ে ধরে মাফ চেয়ে নিবো। তবুও এমন কিছু করো না ভাই। ” “ঠিক আছে৷ লাস্ট বারের মতো ছেড়ে দিচ্ছি। ” লিফাত একগাল হেসে বলল,

“থ্যাংক ইউ ভাই। ” তানভির ভারী কন্ঠে বলল, “মনে থাকে যেন।” “অবশ্যই। ” লিফাত নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো। পেছন ফেরা তো দূর ঘাড় পর্যন্ত কাত করছে না। তানভির মেঘ আর বন্যার জন্য কিছু খাবার আগেই কিনে নিয়ে আসছিল। সেগুলো দিয়ে ক্যাপ পড়তে পড়তে বলল, “আমি আসছি।” মেঘ হাসিমুখে বলল, “অনুষ্ঠান দেখবা না?” “আমি অনুষ্ঠান দেখতে আসি নি। যে কাজে আসছিলাম তা শেষ । অনুষ্ঠান শেষে বাসায় চলে যাস, উল্টাপাল্টা ঘুরিস না। ” তানভির চলে গেছে। খুশিতে মেঘের চোখ চকচক করছে। বন্যার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল, “দেখেছিস, আমার ভাই সেরাদের সেরা। তুই না বললেও ঠিকই জেনে ফেলছে৷ ঐ ছেলে মাফ যে চাইছে দেখছিস! ”

বন্যা ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে রাগী স্বরে বলল, “তুই গিয়ে শুনছিলি? মাফ নাও চাইতে পারে ” মেঘ ভ্রু কুঁচকে বলল, “এই তুই কি আমার ভাইয়ের পাওয়ার নিয়ে সন্দেহ করছিস? আমি সিউর এই ছেলে ভাইয়ার কাছে মাফ চাইছে৷ বিশ্বাস না হলে ছেলেকে ডাক দে, যদি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে তাহলে বুঝবো ভাইয়া কিছু বলে নি। আর যদি কন্ঠস্বর বদলে যায় তাহলে বুঝবো ভাইয়া ঝাড়ছে৷ ” বন্যা ভাবলেশহীন জবাব দিল,

“আমি পারব না। ” মেঘ ভেঙচি কেটে বলল, ” না পারলে নাই, আমার ভাই যে হিরো তার প্রমাণ আমার দিতেই হবে। ” মেঘ সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে ডাকলো, “Excuse me vaiya.” ছেলেটা পেছনে না তাকিয়েই ঢোক গিলে ধীর কন্ঠে জবাব দিল, “জ্বি আপু, কিছু বলবেন? আমাদের জন্য কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? আমরা কি পেছনে চলে যাব?” মেঘ তাড়াহুড়ো করে বলল,

“না পেছনে যেতে হবে না। আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ” মেঘ বন্যার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “দেখলি?”

এরমধ্যে রাজনীতিবিদদের আগমন ঘটলো। আশেপাশে বসা জুনিয়র রা সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিচ্ছে। মেঘ আর বন্যা স্বাভাবিক ভাবেই বসে রইলো। একজনের নজর মেঘদের দিকে পরতেই সামনের দুতিন জনকে ডেকে বলল, অকস্মাৎ ওরা থমকে গেল৷ ঘুরে এসে মেঘদের কাছে দাঁড়ালো। মেঘ আর বন্যা মনে মনে ভয় পাচ্ছে। ভাবছে, দাঁড়ায় নি বলে হয়তো ওনারা বকা দিতে আসছেন। তাদের মধ্যে একজন মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, “আসসালামু আলাইকুম আপু।” “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”

“তোমরা এত পেছনে বসছো কেনো? আসো সামনে এসে বসো।” মেঘ আর বন্যা দুজনেই থতমত খেয়ে বলল, “না ভাইয়া, আমরা এখানেই ঠিক আছি। ” “তা বললে হবে না আপু। আবির ভাইয়াকে এত করে রিকুয়েষ্ট করার পরও ওনি আমাদের পোগ্রামে আসেন নি। অবশ্য তার জন্য আমরায় দায়ী৷ ভাইয়া বারবার বলেছিল ওনাকে নিয়ে যেন কোনোরকম প্ল্যান না করি৷ কিন্তু আমাদের মন তাতে সায় দেয় নি, ভাইয়ার জন্য স্পেশাল আয়োজন করেছিলাম। ভাইয়া কোনোভাবে খবর পেয়েছে তারপর আর পোগ্রামেই আসে নি। সেসব পুরোনো কথা বাদ দেয়, এখন তোমরা যেহেতু আজকের পোগ্রামে আসছো, আমাদের উচিত তোমাদের সর্বোচ্চ আপ্যায়ন করা। প্লিজ তোমরা সামনে এসে বসো, প্লিজ ”

৪-৫ একসঙ্গে রিকুয়েষ্ট করতে শুরু করেছে। ওনাদের এত রিকুয়েষ্ট করা দেখে মেঘ আর বন্যা ভীষণ লজ্জায় পরে গেছে। পুরো হলের মানুষ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মেঘ আর বন্যার দিকে। যাদের দাপটে সবাই আতঙ্কে থেকে সেখানে তারা প্রথম বর্ষের দুই মেয়েকে এত রিকুয়েষ্ট করতেছে এটা সবার কল্পনার বাহিরে। মেঘ আর বন্যা বাধ্য হয়ে সামনে গিয়ে বসলো। এত সামনে বসে পোগ্রাম দেখতে মেঘ আর বন্যা দু’জনের ই অস্বস্তি লাগছে৷ উঠে যেতেও পারছে না, একটু নড়লেই দুএকজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

“আপু কোনো সমস্যা? কিছু লাগবে?” তাই উঠে যেতেও পারছে না। পোগ্রামের বিরতিতে মেঘদের খাবার পর্যন্ত দিয়ে গেছে৷ তানভির নিজেও অনেক খাবার কিনে দিয়ে গেছিলো। মেঘ আর বন্যা শুধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে কিছুই খেতে পারছে না। মেঘ বাধ্য হয়ে আবিরকে কল দিল। আবির অফিসে কাজ করছিল। গতকাল থেকেই অফিসে আসছে। অফিসে আসলেও এখনও বাইক চালানোর অনুমতি পায় নি আবির। দুদিন যাবৎ আলী আহমদ খান নিজের সাথেই আবিরকে অফিসে নিয়ে যান, আবিরও বাধ্য ছেলের মতো আব্বুর সঙ্গেই যায়। মেঘ কল দিতেই আবির মুচকি হেসে কল রিসিভ করল,

মেঘ সালাম দিলো। আবির সালামের উত্তর দিয়ে শুধালো, ” কি ব্যাপার? তাদের আপ্যায়নে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিস?” মেঘ উদ্বেগপূর্ণ কন্ঠে জানতে চাইলো, “আপনি কিভাবে জানেন?” ” তোর আশেপাশে কখন কি ঘটনা ঘটে সব আপডেট ই আমার কাছে থাকে। ” “ওনারা কল দিয়েছিল?” “আমায় না জানিয়ে তোকে কিছু বললে ওদের যে কি অবস্থা হবে এটা তুই না জানলেও ওরা খুব ভালো করে জানে৷ খাবার খাইছিস?”

“নাহ। ” “খেয়ে নে। না হয় একটার পর একটা দিতেই থাকবে৷ ওদের অতিরিক্ত ভালোবাসায় অতিষ্ঠ হয়ে আমি যোগাযোগ কমিয়ে ফেলেছি। এতদিনে তোকে পেয়েছে, তোকে ঠিকঠাক আপ্যায়ন করতে না পারলে ওরা ঘুমিয়েও দুঃস্বপ্ন দেখবে। বুঝলি।” মেঘ মৃদু হেসে বলল,

“আমাদের পোগ্রাম দেখতে ভালো লাগছে না, সামনে এনে বসাইছে সব বিরক্ত লাগছে। ” “কিছুক্ষণ দেখে বেশি খারাপ লাগলে আমার কথা বলে বেড়িয়ে পরিস৷ ” “আচ্ছা। আপনি আসবেন?” “কেনো? অনুষ্ঠান দেখতে নাকি ওদের কর্মকান্ড দেখতে?” “নাহ নাহ, এমনি। আসবেন কি না জিজ্ঞেস করছি।” আবির মন খারাপ করে বলল,

“জানিস ই তো আব্বু আমাকে বাইক নিয়ে বের হতে দেয় না। আব্বুর গাড়ি আমি নিব না, আসলে রিক্সা নিয়ে আসতে হবে। আসবো?” মেঘ খানিক ভাবল, এমনিতেই আবিরের শরীর দূর্বল, এ অবস্থায় যদি আবার কোনো এক্সিডেন্ট ঘটে সে ভয়ে মেঘ বলল, “নাহ, আপনার আসতে হবে না। ”

“রাগ করছিস? আমি রিক্সা নিয়ে আসি, সমস্যা নেই। ” “সত্যি রাগ করি নি। আপনি পুরোপুরি সুস্থ হলে অনেক ঘুরতে পারবো৷ এখন না হয় বড় আব্বুর লক্ষ্মী ছেলে হয়েই থাকুন ” আবির নিঃশব্দে হেসে বলল, ” সাবধানে থাকিস আর কোনো সমস্যা হলে জানাইস। ” মেঘ ঠাট্টার স্বরে বলল, ” জানাবো না। ” “কেনো?” “কারণ আমি জানি, আমার কোনো সমস্যা হওয়ার আগেই কেউ বা কারা, কোনো না কোনো ভাবে আমাকে প্রটেক্ট করবেই। ”

“এত কনফিডেন্ট?” “Yes, Sir” “Okay Mam. পাকনামি রেখে এখন খেয়ে নেন।” “আচ্ছা। আপনি খেয়েছেন?” “আব্বু আমাকে খাওয়ার উপরই রেখেছেন। ঘন্টায় ঘন্টায় খাবার পাঠাচ্ছেন। এখন মনে হচ্ছে অফিসে না এসে বাসায় থাকলেই ভালো হতো।” ” ঠিক আছে খান, রাখি তাহলে ” “ওকে।”

মেঘ আবার ডাকলো, “আবির ভাই….!” “হুমমমমমমম” “কিছু না৷ রাখছি।” মেঘ কল কেটে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। বন্যা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মেঘ ভ্রু নাচিয়ে শুধালো, ” এখন কি আমার ভাইয়া আর আবির ভাইয়ের ক্ষমতা সম্পর্কে আইডিয়া হয়ছে?” বন্যা অস্থির হয়ে বলল,

“সেসব হয়েছে, কিন্তু তুই আগে এটা বল, তুই আর আবির ভাই কি রিলেশনে আছিস?” “হ্যাঁ” “সত্যি? ওনি কি তোকে প্রপোজ করে ফেলছেন?”

“প্রপোজ করেন নি। তবে আমি মনে মনে এক্সেপ্ট করে নিয়েছি। কেন বল তো?” “তোদের এত সুন্দর কথোপকথন শুনে আমার নিজের ই শান্তি শান্তি লাগছে।” মেঘ মুচকি হাসলো, সাথে বন্যাও।



পর্ব - ৫৪ (২)

চৈত্রের উত্তপ্ত আবহে নগর যেন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। শহর জুড়ে বৃষ্টির জন্য হাহাকার৷ আরোপিত শীতলতার আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত আবির, তবুও গাত্র ঘেমে নাজেহাল অবস্থা। পূর্বের তুলবায় কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে। একফোঁটা বৃষ্টির আশায় সবাই অসহায়ের মতো আকাশের পানে চেয়ে আছে। অসহ্য গরমের জন্য আজ অফিস একটু তাড়াতাড়ি ই ছুটি হয়েছে। আবিরকে ফুপ্পি সকাল থেকে অনেকবার কল দিচ্ছিলো, আবির সুস্থ হয়েছে শুনে বার বার যেতে বলছিল কিন্তু আলী আহমদ খান আবিরকে কোনোমতেই যেতে দিবেন না, অন্ততপক্ষে এই ভর দুপুরে তো নয় ই। এমনকি বিকেলেও যেতে দেন নি। আবিরও বাবার মুখের উপর কিছু বলে নি। আবির বাসায় ফেরার পর থেকেই দেখছে মেঘ আর মীম মামনিদের পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে। মামনিরা বারবার বারণ করছে দেখে আবির এগিয়ে গিয়ে শুধালো,


” কি হয়েছে তোদের? ” মীম চট করে বলল, “ফুপ্পি কল দিয়েছিল, আমাদেরকে বাসায় যেতে বলেছেন কিন্তু আম্মুরা যেতে দিচ্ছে না।” আবিরের কপালে কয়েকস্তর ভাঁজ পড়েছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “ফুপ্পি সকাল থেকে আমাকেও বার বার কল দিচ্ছেন, কোনো সমস্যা ই হলো কি না!” আবির ফের জিজ্ঞেস করল,


“মামনি, তোমাদের কিছু বলেছে?” “তেমন কিছু বলে নি। শুধু বলছেন তোরা যেন রাতে ওখানে খাওয়াদাওয়া করিস। ” “তোমাদের কিছু বলে নি?” “আমাদের শুক্রবারের দাওয়াত দিয়েছে। আবার বললো আসিফ আর আরিফকে পাঠিয়ে দাওয়াত দিবে। তোর আব্বুকেও কল দিয়ে বলবে বললো।” আবির স্বাভাবিক ভাবে বলল, “আমি ভেবেছিলাম শুধু আমাকেই কল দিচ্ছে। সকালে বলছি বিকালে আসতে পারি! কিন্তু গরমের জন্য আব্বু যেতে দেন নি, জোর করে বাসায় নিয়ে আসছে। ”


” রাতে ঝড় হতে পারে ভেবে, তোর চাচ্চুও ওদের পাঠাতে না করলো। এদিকে আফা বার বার কল দিয়েই যাচ্ছে। তানভিরও কল দিয়ে বলল ওদের পাঠাতে, তানভির নাকি কাজ শেষ করে ফুপ্পির বাসায় যাবে। ” “আচ্ছা, আমি ফুপ্পির সাথে কথা বলছি।শুক্রবারে সবাই গেলে আজ তাহলে কারো যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ” “সেই বরং ভালো। তুই কথা বলে দেখ।”


আবির ফোন হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছে, মেঘ কপাল গুটিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির একটু দূরে যেতেই মেঘ দ্রুত আবিরের কাছে গিয়ে হাতে চিমটি কাটলো। আবির তাকাতেই মেঘ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে তাকালো, মেঘের চোখের পাপড়ি ঘনঘন কাঁপছে, হালিমা খান, আকলিমা খান আর মীম তিনজনের নজরই মেঘের দিকে। মেঘ তড়িঘড়ি করে আবিরের থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। মেঘ চোখ মুখ গুটিয়ে কিছু একটা বুঝাতে চাচ্ছে। মেঘের ইশারায় বুঝানো কথা আবিরের বোধগম্য হলো না। পরপর দুবার ভ্রু নাচিয়ে নিঃশব্দে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। মেঘ চাপা স্বরে বিড়বিড় করে বলল,


“আজ আইরিনের জন্মদিন৷ সে বায়না ধরেছে আজ আমাদের নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াবে।তারজন্য ফুপ্পি বার বার কল দিচ্ছেন।” আবির মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল, “তোকে কে বলছে?” “জান্নাত আপু।” “আচ্ছা দেখছি,কি করা যায়।” আবির আলী আহমদ খানের রুমে চলে গেছে। মেঘকে ডেকে আকলিমা খান জিজ্ঞেস করলেন, “আবিরকে কি বলছিস ?” মেঘ হাসিমুখে বলল,


” দেখো কাকিয়া, ফুপ্পিরা সবাই আমাদের বাসায় আসছে, খাওয়াদাওয়া করেছে, সারাদিন সময় দিয়েছে। প্রথমবার ফুপ্পি আমাদের যেতে বলছেন, আমাদের কি যাওয়া উচিত না বলো?” “অবশ্যই উচিত। কিন্তু তোর আব্বু যে না করে গেল।” “আবির ভাই বড় আব্বুর সাথে কথা বলতে গেছেন। দেখবা বড় আব্বু রাজি হয়ে গেছে। তখন আব্বু আর কিছুই বলতে পারবে না। ” আকলিমা খান হেসে বললেন, “তোদের মাথায় সারাক্ষণ শুধু দুষ্টু বুদ্ধি ঘুরে তাই না!”


মেঘ আর মীম দুজনেই হাসছে। এরমধ্যে আবির বেড়িয়ে এসে বলল, ” হাসাহাসি রেখে এখন রেডি হতে যা, কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হতে হবে৷ ” হালিমা খান প্রশ্ন করলেন, “আবির, তুই কি বাসা চিনিস?” আচমকা এমন প্রশ্নে আবির থতমত খেল, নিরবে ঢোক গিলল৷ মেঘ শান্ত স্বরে বলল, “আজকাল বাড়িঘর চিনতে হয় না, বুঝছো আম্মু। ফোন নাম্বার আছে, গুগল ম্যাপ আছে কোনো না কোনোভাবে চলে যাওয়া যাবে। ” হালিমা খান আর কিছু বললেন না। মেঘ, মীম আর আদি কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “চল চল রেডি হতে হবে। ”


আদি আমতা আমতা করে বলল, “আমি আম্মুকে ছাড়া যাব না৷ তোমরা যাও৷ ” মেঘ কপাল গুটিয়ে বলল, ” তুই কবে বড় হবি! মীম চল আমরায় যায়। ” আবিরের সহজ স্বীকারোক্তি, “তোরা রেডি হয়ে আমাকে ডাকিস।” “ঠিক আছে । ”


মেঘ আর মীম দুজনেই রুমে চলে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ই মেঘ রেডি হয়ে গেছে, যথারীতি আবিরকে আর মীম দরজা থেকে ডেকে নিচে চলে আসছে। আবিরও রেডি হয়ে নিচে আসছে। মীম এখনও নামছে না দেখে মেঘ আবিরের ভয়ে চিল্লিয়ে উঠল, “এই মীম, তাড়াতাড়ি আয়। ” মীম রুম থেকে বেড়িয়ে আসছে। পড়নে বাসার জামা দেখে মেঘ রাগী কন্ঠে বলল, “এতক্ষণেও হয় নি তোর!” আবির ভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,


“এখনও রেডি হস নি কেন?” মীম মাথা নিচু করে বলল, “তোমরা যাও, আমি যাব না। ” আবির প্রশ্ন করল, “যাবি না কেন?আমরা অপেক্ষা করছি, যা রেডি হয়ে আয়। ” মীম চাপা স্বরে জানাল, “আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, আমি যাব না।” আকলিমা খান রাগে কটকট করে বললেন, “এতক্ষণ তো যাওয়ার জন্য দুই বোন বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছিলি, এখন কি হলো?” আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,


“তুই কিছু বলছিস?” মেঘ থমথমে কন্ঠে বলল, “নাহ, আমি কিছুই বলি নি।” মেঘ মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এই মীম, কি হয়ছে তোর, চল না যাই৷ অনেক মজা হবে। ” “আপু তোমরা যাও, প্লিজ৷ আমার ভালো লাগছে না।” আকলিমা খান কিছুটা রেগে বললেন, ” থাক, ওরে আর তেল মারতে হবে না। তোরাই বরং যা৷ ” আবির গাড়ির চাবি মামনিকে দিয়ে বলল, “দুজন গেলে গাড়ি নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই৷ চাবিটা রেখে দিও। ” “আবির গাড়ি নিয়ে যাহ। তোর আব্বু বা চাচ্চু শুনলে রাগ করবে।” আবির গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,


” ফুপ্পিদের বাসা পর্যন্ত গাড়ি নাও যেতে পারে।” আবির বেড়িয়ে গেছে। মেঘ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজেও ছুটলো। মীম মুচকি হেসে দরজার পানে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “তোমাদের দু’জনের মাঝে আমি কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না৷ ” আবির রিক্সা ডেকে নিজে উঠে পরপর হাত বাড়িয়ে মেঘকে উঠালো৷ মেঘ ঘাড় ফিরিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টি তার নিরেট। পাশাপাশি বসাতে আবিরের হাতের সাথে বার বার ধাক্কা লাগছিল, অজান্তেই মেঘের বুকের বাম পাশে ব্যথা অনুভব হলো। আবিরের সংস্পর্শ পেয়ে মেঘের মন কল্পনায় ভাসতে শুরু করেছে৷ আবির তাকাতেই সরাসরি মেঘের চোখে নজর পরল, মেঘের গভীর চাউনি, রাস্তার পাশের কৃত্রিম আলোতে আবিরের কাদম্বিনীকে অতীব মায়াবী লাগছে৷ আবির টেনেহিঁচড়ে দৃষ্টি সরালো। এই চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে আবির নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, অন্য জগতে পাড়ি জমাতে ইচ্ছে করে। প্রায় অনেকটা পথ অতিক্রম করে ফেলেছে, অথচ মেঘ ঘোরেই আঁটকে আছে। অবশেষে আবির গলা খাঁকারি দিয়ে ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করল,


“আইরিনের জন্য কি নিবো?” আবিরের কন্ঠ শুনে মেঘ চমকে উঠে, রিক্সার গতি আর নিজেকে একসঙ্গে সামাল দিতে না পেরে নড়ে ওঠে৷ আবির তৎক্ষনাৎ বামহাতে মেঘের কাঁধে হাত রেখে স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করে, “ঠিক আছিস?” “হ্যাঁ” “আইরিনের জন্য কি নিবো?” ” আপনার যা ইচ্ছে নিন।” ” আমি আন্দাজি কি নিবো? মেয়েদের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। তারজন্য ই তো তোর মতামত জানতে চাইছি৷ ” মেঘ আড়চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ” আপনি আমার মতামত জানতে চাচ্ছেন? ”


“বাব্বাহ! মতামত জানতে চেয়ে অন্যায় করে ফেললাম নাকি?” “হ্যাঁ, করেছেন। অনেক বড় অন্যায় করেছেন। বাই দ্য ওয়ে, আপনি মেয়েদের পছন্দ- অপছন্দ জানেন না তাহলে আমাকে সুন্দর সুন্দর গিফট দেন কিভাবে?” “তুই সবকিছু নিজের সঙ্গে তুলনা করিস কেন বুঝলাম না! তোকে কিছু দিতে গেলে আমার একবারের জন্যও ভাবতে হয় না। আমি কনফিডেন্টলি বলতে পারি, আমার দেয়া ২০ টাকার একটা গোলাপ কিংবা ২০ হাজার টাকা দামের কোনো গিফট দুটায় তোর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাকিদের ক্ষেত্রে আমি তা পারবো না। ”


মেঘ বিপুল চোখে তাকিয়ে মনে মনে আওড়াল, “এই কনফিডেন্স টা নিয়ে আমায় প্রপোজ করতে পারেন না? আপনি তো জানেন আমি হ্যাঁ ই বলবো তাহলে কেনো করেন না প্রপোজ? ” আবির মেঘের গাঢ় কালো পল্লবে চোখ রেখে বলল, ” এভাবে তাকাইস না মেঘ, তছনছ হয়ে যাবো।”


মেঘ সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিল, আবির ভাই নামক অসুখ টা ইদানীং মেঘকে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে। আবিরের বলা কথা, আচরণ সবেতেই অন্যরকম মাধুর্যতা মিশ্রিত। ধীরে ধীরে মেঘও বুঝতে পারছে আবির ভাই তার জীবনে বিশালাকৃতির গাছের ন্যায় ভূমিকা পালন করছে, গাছের শেকড় আর ঢাল পালার মতোই মেঘকে সকলপ্রকার অশুভ অঁচল থেকে আগলে রাখছে। আইরিনের জন্য গিফট কিনে যথাসময়ে বাসায় উপস্থিত হয়েছে, ততক্ষণে তানভিরও চলে আসছে। আড্ডা, খাওয়াদাওয়া শেষে প্রায় অনেক রাত করে ফুপ্পির বাসা থেকে বেড়িয়েছে। ততক্ষণে আকাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সাথে মেঘের গর্জন। মেঘ উৎফুল্ল মেজাজে সামনে হাঁটছে। তানভির বাসা থেকে বেড়িয়ে তপ্ত স্বরে বলল,


“ভাইয়া, অনেক রাত হয়ে গেছে তুমি বরং বনুকে নিয়ে বাইক দিয়ে চলে যাও। ” “বাসা থেকে অনুমতি নিয়ে প্রথমবারের মতো ও কে নিয়ে রাতের বেলা বেড়িয়েছি, এত তাড়াতাড়ি বাসায় চলে গেলে কিভাবে হবে! তাছাড়া আব্বু আমায় বাইক চালানোর অনুমতি দেন নি, হাজার হোক আমি আব্বুর বাধ্য সন্তান! আব্বুর অনুমতি ব্যতীত বাইক চালাতে পারি না। ”


“দিনের অবস্থা ভালো না৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। তারপর ভিজে যেতে হবে। ” “ভিজলাম সমস্যা কি? জ্বর হলে না হয় দুজনের ই হলো। ” তানভির রাগী স্বরে বলল, “একবার জ্বরে ভোগে শিক্ষা হয় নি তোমাদের? ” আবির নাক কুঁচকে বলল, “তখন কি একসাথে ভিজছিলাম নাকি? তাছাড়া মাঝে মাঝে বৃষ্টি বিলাস করা ভালো, এতে ভালোবাসা বাড়ে। বুঝছিস?” ” হ্যাঁ, তোমার প্রেম বিষয়ক আজগুবি লজিক খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি। ” আবির এগিয়ে যেতে যেতে বলল,


“তুই কিন্তু একা বাসায় যাইস না।” তানভির চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “হ্যাঁ,হ্যাঁ তোমাদের জন্য আমি এখন গাছতলায় বসে থাকি আর শুধু শুধু বৃষ্টিতে ভিজি। নাকি?” আবির ঘাড় ঘুরিয়ে মুচকি হেসে বলল, “ভাইও তোর, বোনও তোর তাই দায়িত্বটাও তোর ই। ” আবির হাসতে হাসতে সামনে চলে গেছে। তানভির না চাইতেই মৃদু হাসলো। আবিরের যখন যা ইচ্ছে হয় তাই করে। এটা তানভিরের থেকে আর কেউ ই ভালো জানে না। আবিরের সব পাগলামির একমাত্র সাক্ষী তানভির। আবিরের বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে মানে এখন তাকে ভিজতেই হবে। তানভির বাইক স্টার্ট দিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে আবারও বলল, “তাড়াতাড়ি চলে এসো।”


মেঘ আশেপাশে তাকাচ্ছে আর গুটিগুটি পায়ে হাঁটছে। কিছুক্ষণ রাস্তাটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে হঠাৎ প্রশ্ন করল, “এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢুকায় যেত, তাহলে আনেন নি কেন গাড়ি?” “কেন আনি নি তার উত্তর এখন তোকে দিতে পারবো না। সময় হলে নিজেই বুঝতে পারবি৷ ” মেঘ বলার মতো কথা খোঁজে পাচ্ছে না বলে চুপচাপ হাঁটছে। আবিরও নিশ্চুপ হাঁটছে । কোলাহলশূন্য নির্জন পথ, রাস্তা গুটিকয়েক বাইক আপন গতিতে ছুটছে। ফুপ্পিদের বাসার গলি থেকে বেড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে মেঘ হঠাৎ ই আকুল কন্ঠে শুধালো, ” আমরা বাসায় যাব কিভাবে?” “বাসায় না গেলে হবে না? ”


মেঘ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আবিরের দিকে চেয়ে আছে। এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে। কোথায় তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন তা না উল্টো মজা করছেন। ধীরে ধীরে বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়েছে। মেঘের গর্জনের শব্দ আর বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা দেখে মেঘ ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছে। দিনের বেলা বৃষ্টি তার খুব বেশি পছন্দ হলেও রাতের বেলা বিদ্যুৎ চমকালেই মেঘের কলিজা শুকিয়ে যায়৷ আতঙ্কে মেঘের হাঁটার গতি কমে গেছে, বার বার আকাশের পানে তাকাচ্ছে আর আর আস্তে আস্তে হাঁটছে। আবির বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ মেঘের হাবভাব পর্যবেক্ষণ করে শুধালো,


“কোনো সমস্যা? ” মেঘ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, “আপনি গাড়িটা নিয়ে আসেন নি কেন? আমার ভয় লাগতাছে। রাস্তায় একটা রিক্সাও নেই এখন কিভাবে বাসায় যাব?” আবিরের নির্লিপ্ত জবাব এলো, “আমি ভেবেছিলাম তুই অনেক সাহসী মেয়ে।” মেঘ ঠান্ডা কন্ঠে বলল, ” আমি দিনের বেলা সাহসী কিন্তু রাতের বেলা ভিষণ ভীতু। ” আবির শান্ত চোখে চেয়ে মনে মনে কিছু একটা ভেবে মৃদু হাসলো। মেঘের সেদিকে মনোযোগ নেই, একবার বিদুৎ চমকাচ্ছে আর মেঘের গা কেঁপে উঠছে।


আবির উদাসীন কন্ঠে শুধালো, “আমি কাছে থাকা স্বত্তেও তুই এত ভয় পাচ্ছিস? তাহলে আমি থেকে কি লাভ হলো?” মেঘ নিশ্চুপ। ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে দুজন, কারো মুখেই কোনো শব্দ নেই। আবির কিছু বলতে চেয়েও বার বার ঢোক গিলে কথা গিলছে । বৃষ্টিস্নাত পথে প্রেয়সীর হাতে হাত রেখে বুকের বাম প্রকোষ্ঠে লুকায়িত কথাগুলো বলার সুপ্ত ইচ্ছে আবিরের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুত এক দেয়াল বার বার আঁটকে দিচ্ছে আবিরকে।


পরিবার নামক বেড়াজালে আবির আবদ্ধ হয়ে আছে, মেঘ আবিরকে ভালোবাসে, অনেক বেশিই ভালোবাসে কিন্তু আবিরকে পাওয়ার জন্য আদোও কি মেঘ পরিবারের সামনে দাঁড়াতে পারবে? যেখানে আবির নিজেই বাড়ির সবার মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে যোগ্য ভাবতে পারছে না সেখানে মেঘ তো কিছুই না। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি বাড়ছে, সেই সাথে বিদ্যুৎ চমকানোর মাত্রাও বেড়েছে৷ দুজনেই কাকভেজা হয়ে গেছে, আবিরের পড়নে নেভিব্লু রঙের শার্টটা ভিজে গায়ের সঙ্গে একবারে লেপ্টে গেছে। ফোন আর ওয়ালেট টা ফুপ্পির বাসা থেকেই পলিথিনে পেঁচিয়ে নিয়ে আসছিলো। মেঘ আজ থ্রিপিস পড়েছিল, চুলে খোঁপা করে মাথায় ওড়না দিয়েছিল কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেছে। সরু রাস্তায় বড় বড় কদম ফেলায় আবির মেঘের থেকে কিছুটা এগিয়ে গেছে। প্রবল বৃষ্টিতে মেঘ হাঁটতেই পারছে না। আবির সামনে থেকে মেঘের দিকে তাকালেই মেঘ তেজঃপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল, “আপনি আমায় ফেলে চলে যাচ্ছেন কেন? দেখছেন না আমি ভয় পাচ্ছি? ”


আবিরের পদযুগল থমকে গেছে, একপলক সামনে তাকালো পুনরায় আড়চোখে চেয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল, “কোলে নিতে হবে?” মেঘ শশব্যস্ত হয়ে আবিরের দিকে তাকালো। সহসা মনে পড়ে গেছে আবিরের সঙ্গে কোনো এক বিকেলে বৃষ্টিতে ভেজার ঘটনা। সেদিন হোঁচট খাওয়ার পরপর আবিরের কোলে তোলার ঘটনা মনে পড়তেই মেঘ থতমত খেয়ে বলল, ‘নাহ নাহ, আপনি শুধু আমার কাছাকাছি থাকুন। ”


আবির নিজের হাত বাড়ালো, মেঘ একহাতে আবিরের হাতটা ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু মেঘের ছোট্ট হাত আবিরের মোটা হাতকে ঠিকমতো ধরতে না পেরে সহসা দু’হাতে আবিরের বাহু চেপে ধরেছে। আবির চাপা স্বরে বলল, ” মুরগির কলিজা নিয়ে রাতে ঘুমাস কিভাবে তুই?” মেঘ ঠোঁট উল্টিয়ে আবিরের দিকে তাকাতেই আবারও বিদ্যুৎ চমকালো, মেঘ ভয়ে দুহাতে আবিরের বাহু আরও শক্ত করে ধরেছে। আবিরের নিজের অন্য হাত মেঘের হাতের উপর রেখে কোমল কন্ঠে বলল,


“ভয় পাইস না, আমি আছি তো!” আবিরের স্পর্শ সেইসঙ্গে মোলায়েম কন্ঠে বলা ছোট্ট একটা কথাতেই মেঘের মন থেকে ভয় ডর সব একেবারে চলে গেছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আকাশের পানে চেয়ে মুচকি হেসে বলল, ” আমার আবির ভাই আমার পাশে থাকলে আর কিচ্ছু চাই না। যদি আজ আমার মৃ*ত্যুও হয় তবে যেন আবির ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে ম*রতে পারি। ”


আস্তে আস্তে মেঘের ভ*য় অনেকটায় কে*টে গেছে। আবিরের হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে মেঘও নিজের মতো হাঁটছে। তবে আবিরের হাত একবারের জন্যও ছাড়ছে না।মেঘ আর আবির ফুপ্পিদের বিষয়ে টুকিটাকি কথা বলছে। এতবছর আবিরকে নিয়ে তেমন মাথা না ঘামালেও এখন আবিরের ব্যাপারে মেঘের খুব চিন্তা। মেঘ আচমকা প্রশ্ন করে বসল, “আবির ভাই, আপনি কি এখনও সি*গারে*ট খান?” আবির ভ্রু গুটিয়ে বলল,


“নাহ। কেনো?” “সত্যি করে বলুন, আপনি কবে থেকে সি*গারে*ট খাওয়া শুরু করেছিলেন আর কবে শেষ করেছেন? নাকি এখনও খান?” রোমান্টিক আবহাওয়ায় মেঘের এমন প্রশ্ন আবিরের কাটা গায়ে নুনের ছিটার মতো লাগছে। আবির কড়া গলায় বলল, ” এখন এসব প্রশ্ন করার সময়?” মেঘ গাল ফুলিয়ে চোখ নামিয়ে ধীর কন্ঠে বলল, “তারমানে আপনি এখনও সি*গা*রেট খান?” আবির বিরক্ত হয়ে মেঘের দিকে তাকালো পরপর এদিক সেদিক তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,


” আমি মিথ্যা কথা বলি না মেঘ, তারপরও যদি তোর আমাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তাহলে আমার কিছুই বলার নেই। ” মেঘ হতবাক হয়ে গেছে। আবিরকে ইদানীং কিছু বললেই ছ্যাত করে উঠে৷ বিশেষ করে বিশ্বাস নিয়ে কথা বললে তো উপায় ই নেই। মেঘ মনোযোগ দিয়ে কতক্ষণ আবিরকে দেখে প্রশ্ন করল, “কি হয়েছে আপনার? এভাবে কথা বলছেন কেন?” আবির জোর গলায় বলা শুরু করল,


” আমি কখনো কারো বিশ্বাস ভঙ্গ করি নি। তোর তো নয় ই। সি*গা*রেট আমার নে*শা না, যখন কোনো বিষয়ে খুব বেশি রে*গে থাকি, দিশাবিশা পায় না তখন একটু আধটু সিগা*রেট খেতাম এটুকুই ৷ তারপরও এত বছরে হাতে গুনা কয়েকটা সি*গারেট ই খেয়েছি। এসব এখন অতীত। সি*গারেট ছেড়েছি বহুদিন হলো, ছোঁয় ও না পর্যন্ত। সেদিনের পর তুই কোনোদিন আমার হাতে সিগা*রেট দেখেছিস? রুমে পেয়েছিস? নাকি আমার গায়ে সি*গারেটের গন্ধ পেয়েছিস? তবুও কেন এত অবিশ্বাস? তোর সন্দেহের তালিকায় কেনো সবসময় আমার নামটায় থাকে? এখনও এই মানুষটাকে একেবারে বিশ্বাস করা যায় না? ”


আবির একরাশ হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলেছে। শেষ প্রশ্ন গুলো বলার সময় আবিরের গলা কাঁপছিল । অজানা এক ক্রোধে আবির আবার দগদগে স্বরে বলল, “তানভির কে কল দিয়ে তোকে নিয়ে যেতে বলি।” মেঘ আর্তনাদ করে উঠল, “কেনো?” “আর যাই হোক, আবির কখনো কাউকে জোর করবে না অন্ততপক্ষে তাকে বিশ্বাস করতে তো নয় ই। আমার সত্যিই গাড়িটা নিয়ে আসা উচিত ছিল। ” মেঘ মায়াবী দৃষ্টিতে চেয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,


“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি আপনাকে বিশ্বাস করি, অনেক বেশি বিশ্বাস করি। সত্যি বলছি। ভাইয়াকে কল দিবেন না, প্লিজ। আমি আপনার সাথেই যাব। ” আবির উদাসীন কন্ঠে বলল, ” যেখানে তুই ই আমাকে বিশ্বাস করতে পারিস না সেখানে তোর বাবা মায়ের চোখে তো আমি মস্ত বড় অপরাধী হয়ে যাব। তোর জ্বর হলে কেউ আমায় ছেড়ে কথা বলবে না। ” আবির দু পা এগুতেই,মেঘ এক হাতে আবিরের আঙুল ধরার চেষ্টা করে কিন্তু আবির আঙুল ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতেই মেঘ তড়িঘড়ি করে আবিরের সামনে গিয়ে সরাসরি আবিরের শার্ট আঁকড়ে ধরে সাফাই দেয়ার মতো করে আকুল কন্ঠে বলে উঠল,


” আমি আর কোনোদিন আপনাকে এমন কথা বলব না, আপনাক কখনও অবিশ্বাস করব না৷ আপনি যা বলবেন, যে অবস্থাতেই বলবেন আমি সাথে সাথে বিশ্বাস করে ফেলবো৷ প্লিজ আপনি রাগ করবেন না, প্লিজ৷ আমি কানে ধরছি….” এতক্ষণ আবির শক্ত থাকলেও মেঘের শেষ বাক্যে আবির তৎক্ষনাৎ মেঘের হাত চেপে ধরলো৷ মেঘের হাত তখনও আবিরের বুকেই ছিল, সবেমাত্র কানে ধরার জন্য হাত তুলতে যাচ্ছিলো। তার আগেই আবির আঁটকে দিয়েছে। আবিরের রাগ মুহুর্তেই দমে গেল। ভারী কন্ঠে বলল,


” অতি সামান্য কারণে আবির কাউকে এত বড় শাস্তি দিবে না!” মেঘ ফের বলে উঠল, “আপনি রাগ করলে আমার খুব ভয় হয়..” আবির অনুচিন্তন মনে শুধালো, “কিসের ভয়?” মেঘ বিড়বিড় করে বলল, “আপনাকে হারানোর। ” ঝুম বৃষ্টিতে মেঘের বিড়বিড় করে বলা কথাটা আবির ঠিকমতো বুঝতে পারে নি। সিউর হতে আবির পুনরায় শুধালো, ” কি বললি?”


মেঘ কিছু না বলে আবিরের উপর মাথা ঠেকালো। অনেকক্ষণ যাবৎ বৃষ্টিতে ভেজার কারণে মেঘের শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে অকস্মাৎ ভয়ে আবিরের বুক কাঁপছে, মেঘের শরীর যদি আবার খারাপ হয়! আবির তড়িঘড়ি করে বলল, “শরীর খারাপ লাগছে?”


মেঘ সহসা আবিরের থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো। প্রিয় মানুষের সাহচর্য পেলে মানুষ সব ভুলে যায়। মেঘের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে৷ ঘোরের মধ্যে কখন যে আবিরের বুকে মাথা রেখেছে সেটা খেয়াল ই করে নি৷ আবির ডাকতেই মেঘের ঘোর কেটে গেছে। লজ্জায় মাথা নিচু করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আবির পিছু পিছু ডাকছে, কিন্তু মেঘ তাকাতেই পারছে না। আবির এগিয়ে গিয়ে মেঘের মাথার কিছুটা উপরে দুহাত রাখলো। যেন সরাসরি বৃষ্টির পানি মেঘের মাথায় না পড়ে। মেঘ চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল একবার, পুনরায় লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। আবির ভাই মানুষটা কেমন জানি, এই রাগ করেন,এই আবার ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নেন।


ওনার মন বুঝার সাধ্যি পৃথিবীর কারোর নেই৷ কিছুটা এগুতেই মেঘ চা খাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে অথচ আবির খোঁজছে মেডিকেল শপ৷ নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অসময়ে মেঘকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে এখন নিজেই টেনশন করছে। মেঘের সেদিকে খেয়াল নেই, সে নিজের মতো ঘুরছে আর চায়ের দোকান খোঁজছে । জীবনে প্রথমবার গভীর রাতে বৃষ্টিতে ভিজছে, মেঘের মন এমনিতেই খুব উতলা হয়ে আছে তারউপর সাথে আবির ভাই। বাসার সব চিন্তা ভুলে বৃষ্টি উপভোগ করছে আর আবিরের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে আছে। অবশেষে একটা চায়ের দোকানে মেঘকে বসিয়ে আবির পকেট থেকে ফোন আর ওয়ালেট বের করছে। উপরে টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। মেঘ আপনমনে বসা থেকে সেই চালের দিকে চেয়ে আছে। টিনের চালের মাতাল করা শব্দে মেঘের ভাবনারা ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। মেঘ আবিরের দিকে তাকাতেই আবির বলে উঠল,


” বৃষ্টির শব্দটা ভালো লাগছে?” “হ্যাঁ! আগে বর্ষাকালে নানা বাড়ি গেলে এই শব্দটা শুনতাম, অনেক ভালো লাগতো। কতবছর পর আবার শুনছি। ” আবির প্রশ্ন করল, “লাল চা খাবি নাকি দুধ চা?” “লাল চা খাব।” “ঠিক আছে ম্যাম।” আবির চলে গেল। হঠাৎ ই মেঘের কানে আবিরের কন্ঠ বেজে উঠলো, “মামা, আপনি বসুন। চা আমি বানাচ্ছি।”


মেঘ আঁতকে উঠে পিছনে ঘুরলো। সত্যি সত্যি আবির চা বানাচ্ছে । মেঘ তৎক্ষনাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ভেতরে থাকা হৃদপিণ্ড ছুটছে দিগবিদিক, ঠোঁটে ফুটে উঠেছে প্রশান্তির হাসি। অকস্মাৎ মনে দুশ্চিন্তারাও ভর করেছে, নিজের অজান্তেই বলে উঠল, ” এত সুখ আমার কপালে সইবে তো?” সঙ্গে সঙ্গে মেঘ নিজের মাথায় গাট্টা মেরে বলল, “কি সব বাজে কথা ভাবছিস!”


আবির দুকাপ চা নিয়ে এগিয়ে আসলো৷ আদা, লেবু দিয়ে দুকাপ চা নিয়ে আসছে। আবিরকে দেখে মেঘ পুনরায় চেয়ারে বসলো। মেঘকে এককাপ চা দিয়ে আবির পাশের চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিল। মেঘ একচুমুক চা খেয়ে মেঘ মুগ্ধ হয়ে আবিরের পানে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি আর ঠিক কি কি পারেন একটু বলবেন?” আবির নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ” বলতে পারবো না, তবে প্র্যাক্টিকেললি সব পারবো।” “বাহ! বড় আব্বু আর বড় আম্মুর একমাত্র ভদ্র ছেলে। আপনি ছেলে হয়ে যা পারেন আমি মেয়ে হয়েও তা পারি না।” আবির উদগ্রীব হয়ে বলল,


“আমি কখনোই ভদ্র ছেলে ছিলাম না। আমি এক নাম্বারে অসভ্য আর অভদ্র একটা ছেলে। তাছাড়া তোকে কাজ শিখতে বলেছে কেউ? তোর যখন যা লাগবে শুধু অর্ডার করবি!” মেঘ প্রশ্ন করল, ” আপনি অভদ্র এটা কে বলছে? ” “তোর আব্বু৷ ” মেঘ হেসে বলল,


” আব্বুর চোখে দুনিয়ার সব ছেলেরায় অভদ্র। দেখবেন দুদিন পর থেকে আদিকেও এভাবেই কথা শুনাবে।” আবিরও মলিন হাসলো। নিষ্টুর এই পৃথিবীতে সবার প্রিয় হয়ে উঠা কারো পক্ষেই সম্ভব না। তবে আবিরের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র নিজেকে প্রমাণ করা। আবির অভদ্র নয় তবে অসভ্য তো বটেই। মেঘকে কাছে পেলে আরও বেশি অসভ্য হয়ে যায়। এজন্য মেঘের দিকে ঠিকমতো তাকাচ্ছেই না। আবির ফোন চেক করতেই দেখলো মোট ১৭ টা কল আসছে। বাসা থেকে ৮ টা কল আসছে, তানভিরও ৪-৫ বার কল দিয়েছে, ফুপ্পি, রাকিব ও কয়েকবার কল দিয়েছে।


এখন ফোন দিলেই যে যার মতো কথা শুনাবে তারপর আবার মন খারাপ হবে সেই ভেবে কাউকেই কল ব্যাক করে নি। রাস্তায় একটা মেডিকেল শপ থেকে মেঘকে ঔষধ কিনে খাইয়েছে যাতে জ্বর না আসে। আবির আশেপাশে রিক্সা খোঁজছে, বাসার মানুষের থেকেও বেশি টেনশন হচ্ছে মেঘকে নিয়ে। কারণ মেঘকে সামাল দেয়ার মতো মানসিক অবস্থা আবিরের নেই। বৃষ্টির পানিতে চিকচিক করা মেঘের দু গাল, গোলাপের ভেজা পাপড়ির মতো লাল টকটকে দুই ঠোঁটে তাকানো মাত্রই আবিরের বুকে কম্পন অনুভব করে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নেয়। কিন্তু মেঘ নিজের মতো করে কথা বলছে, হুটহাট আজগুবি প্রশ্ন করতে শুরু করে যে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো পরিস্থিতি আবিরের নেই। তাই মেঘকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে চাচ্ছে। একটা ফুলের দোকান দেখে মেঘ বলে উঠল,


“আবির ভাই, আমাকে একটা গোলাপ ফুল কিনে দিবেন?” “নাহ।” “কেনো?” ” গোলাপ ব্যতীত অন্য কোনো ফুল নে। ” “লাল গোলাপ গুলো খুব সুন্দর লাগছে। একটা নেয়?” “বললাম তো নাহ।” মেঘ মন খারাপ করে দুটা বেলীফুলের মালা নিয়েছে। আবির টাকা দিয়ে বেড়িয়ে এসে বলল, “দে পড়িয়ে দেই। ”


“প্রয়োজন নেই।” “কেন?” “কারণ এগুলো মীমের জন্য নিয়েছি।” “ওয়েট আরও কয়েকটা নিয়ে আসি। ” “লাগবে না। আমার জন্য আনলে লাল গোলাপ নিয়ে আসুন।” আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “চল সামনে যায়, সামনে হয়তো রিক্সা পাবো।” মেঘ উষ্ণ স্বরে বলল, “তবুও গোলাপ দিবেন না?” “নাহ।”


মেঘ রাগে ফোঁসতে ফোঁসতে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টি কমে এসেছে। তবে গাছ থেকে এখনও টুপটুপ করে পানি পড়ছে। আবির মেঘের গমনপথে চেয়ে ভারী কন্ঠে বলল, “যেই ফুল তোকে অন্য কোনো ছেলে দিতে চেয়েছিল, সেই ফুল আমার চোখে বিষের মতো। আবির সেই বিষ ছুঁবে না। ” এদিকে তানভির বাসার কাছে গাছের নিচে বাইকে বসে আছে আর ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। বৃষ্টি কমাতে আবিরকে কয়েকবার কল পর্যন্ত দিয়েছে কিন্তু আবির ফোন ই ধরছে না। হঠাৎ বন্যার কথা ভেবে কল দিল বন্যার নাম্বারে। অনেকদিন পর বন্যার ফোনে কল ঢুকছে। প্রথমবার রিসিভ হলো না। দ্বিতীয় বার রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে বন্যা প্রশ্ন করল,


“হ্যালো কে?” তানভির কপাল গুটিয়ে বলল, “বাহ! এত অপরিচিত হয়ে গেলাম?” বন্যা তৎক্ষনাৎ বলে উঠল, “আসসালামু আলাইকুম” “ওয়ালাইকুম আসসালাম।” “সরি তানভির ভাই। নতুন ফোন তাই নাম্বার টা সেইভ ছিল না। ” “ওহ আচ্ছা। ফোন কবে কিনলা?” “আজকেই কিনেছি। আপনি কি বাহিরে?” “হ্যাঁ। কেনো?”


“বৃষ্টি, বাতাস এসবের শব্দ হচ্ছে মনে হয় ।” “ওহ আচ্ছা। গাছতলায় বসে আছি তাই এমন শব্দ হচ্ছে। ” “গাছতলায় কেন?” “এমনিতেই একটু কাজ ছিল। রাতে খেয়েছো?” “জ্বি। আপনি?” “হ্যাঁ ফুপ্পিদের বাসায় খেয়ে আসলাম।” “ফুপ্পিরা কেমন আছেন?” “আলহামদুলিল্লাহ ভালো।” “আচ্ছা ভালো থাকুন, রাখি এখন।” “কেনো?” “ঘুমাবো।” “আচ্ছা ঘুমাও। ”


তানভিরের কথা শেষ হওয়া মাত্রই আবির আর মেঘ আসছে। যথারীতি তিন জনেই কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরেছে৷ রাত ১১ টার উপরে বেজে গেছে, অথচ তিন ভাই ই সোফায় বসে আছে। কাঠগড়ায় মেঘ,আবির আর তানভির। মেঘ হাঁচি দিতেই আবির মাথা নিচু করে কপাল গুটিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে। আজ একটা ঘূর্ণিঝড় হতে চলেছে যার সূচনা মেঘের একটা হাঁচিই করে দিল। আবির মাথা নিচু করে মেঘকে আস্তে করে বলল, “রুমে যা। ”


মেঘ কোনোদিকে না তাকিয়ে ভেজা জামা নিয়েই নিজের রুমে দিকে ছুটছে৷ ড্রয়িং রুম, সিঁড়ি সব ভিজে গেছে। আলী আহমদ খান মেঘের দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় আবিরদের দেখলো৷ গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল, “তোমাদের এই অবস্থা কেন?” আবির সাফাই দেয়ার স্বরে বলল, “আপনিই বলেছেন বাইক যেন না চালাই। আর রাস্তায় রিক্সা পায় নি।” “গাড়ি নাও নি কেন?” “ফুপ্পিদের বাসা পর্যন্ত গাড়ি ঢুকবে কি না সিউর ছিলাম না৷ ” “বাসা পর্যন্ত না যাক রাস্তা পর্যন্ত তো যেতো?”


“রাস্তায় রাখবো, তারপর কোনো এক্সিডেন্ট হলে আই মিন চু*রি হলে গাড়ির দায় কে নিবে? আমি?” আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে বললেন, “তুমি না নিলে তোমার বাপেই না হয় দায় নিতো। যত যাই হোক গাড়ি টা তো তোমার বাপের ই। ” আবির মৃদু হেসে বলল, ” আমার জন্য কাউকে কোনো দায় নিতে হবে না৷ আর আমিও অযথা কোনো দায় নিতে চাই না। ” মোজাম্মেল খান এবার চেঁচিয়ে উঠলেন, ” তোমাদের ঘাড়ত্যাড়ামির জন্য আমার মেয়েটাকে কেন ভিজিয়েছো? ওর কিছু হলে! ” আবির রাশভারি কন্ঠে বলল, “আপনার মেয়ের কিছু না হলেই তো হলো! ”


এতরাতে এখানে কথা বাড়ালে ঝামেলা হবে ভেবেই মোজাম্মেল খান হুঙ্কার দিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে চলে গেছেন। ইকবাল খান ও নিজের রুমে চলে গেছেন। আলী আহমদ খান কাজের মহিলাকে ডেকে ফ্লোর মুছার কথা বলে নিজেও ভেতরে চলে গেছেন। আবির ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। রুমে গিয়ে রাগে বিছানার উপর ফোন ছুঁড়ে ফেলে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেছে৷ আবিরের রাগের একমাত্র কারণ সে নিজেই। আবির শাওয়ার নিয়ে আবার রান্নাঘরে এসে মেঘের জন্য স্যুপ আর কফি করে নিয়ে গেছে। মেঘকে ডাকতেই মেঘ দরজা খুলে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,


“ভেতরে আসুন ” আবির গুরুতর কন্ঠে বলল, “নাহ থাক, কখন আবার চেঁচিয়ে তোর আব্বুকে ডাকবি। ” মেঘ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থেকে খাবার গুলো নিলো। আবির সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে। তানভির ফ্রেশ হয়ে আবিরের রুমে আসছে। মূলত মিনহাজদের ব্যাপারে কথা বলতেই এসেছে। আবিরের এক্সিডেন্টের পর থেকে মেঘের মতো আবিরও ওদের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। তানভিরকে প্রথম এক দুবার জিজ্ঞেস করলেও এরপর থেকে একবারের জন্যও তাদের কথা জিজ্ঞেস করে নি। তানভির আজ নিজ থেকেই কথা বলতে আসছে।


আজ শুক্রবার। ফুপ্পির বাসাতে আজকে সবার দাওয়াত৷ নামাজ পড়েই সবাই রওনা দিয়েছে। আবির, তানভিররা, মেঘ, মীম,আদি ইকবাল খানের গাড়িতে যাচ্ছে৷ বাকিরা আলী আহমদ খানের গাড়িতে। আরিফ আর আসিফ দুজনেই গলির মোড় থেকে ওনাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে৷ মীম আরিফকে দেখেই বড় করে ভেঙছি কাটলো। আত্মীয়তার সম্পর্কের খাতিরে আরিফ মৃদুভাবে হাসলো। মেঘ মীমকে সারাদিন সামলে রেখেছে, যেন কোনোভাবেই কোনো অঘটন না ঘটায়। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে বিকেলের দিকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে । আগামী পরশু থেকে রমজান শুরু তাই ফুপ্পির জোরাজোরিতে আজই সবাইকে আসতে হলো। ফুপ্পির সাথে সবার ই খুব ফরমাল সম্পর্ক৷ আবিররা ফুপ্পিকে যতটা আপন করে নিয়েছে বড় ঠিক ততটা পারছে না।


মাঝরাতে হঠাৎ ই আবিরের ফোনে কল বাজতেছে। আবির ঘুমের ঘোরে প্রথমে কেটে দিয়েছে। খানিকক্ষণ বাদে আবারও ফোনে কল বাজতেছে। আবির কল রিসিভ করে অর্ধ ঘুমন্ত অবস্থায় জিজ্ঞেস করল, “কে?” “পে*ত্নী।”



পর্ব - ৫৪(৩)

আবির ঘুমের ঘোরেই মুচকি হাসলো। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বিমোহিত কন্ঠে জানতে চাইল, “আবির কি কোনো অন্যায় করেছে? তা না হলে, মাঝরাতে পরীর বদলে পে*ত্নী কেন কল দিবে আমায়?” “হ্যাঁ। আপনি মস্ত বড় অ*পরা*ধ করেছেন।” আবিরের চোখ বন্ধ, এখনও ঘুমের রেশ লেগে আছে চোখে মুখে। আধঘুমে থেকেই আবির পুনরায় প্রশ্ন করল,


” সর্বনাশ! অপ*রা*ধ টা কি বলা যাবে?” মেঘ নিচু কন্ঠে বলল, “আপনি আমার প্রথম কল টা ধরলেন না কেন?” আবির চোখ মেলে ফোনের দিকে তাকালো। তড়িঘড়ি করে কল লিস্ট চেক করল। ঘুমের ঘোরে কল কাটার ঘটনা মনে পড়তেই মাথা চুলকে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,


“Ops! Sorry. ঘুমের মধ্যে কিভাবে বুঝবো যে আপনি কল দিয়েছেন? সরি ” সদ্য ঘুম থেকে উঠা আবিরের ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠ শুনে মেঘের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে কি যেন হৃদ*য়ে ছু*রি*র ন্যা*য় তোলপাড় চালাচ্ছে। সবকিছু যেন মুহুর্তেই ত*ছনছ করে দিবে। মেঘ বুকের বাম প্রকোষ্ঠে হাত রেখে নিজেকে সংযত করে ধীরস্থির কন্ঠে প্রশ্ন করে, “সেহরি খাবেন না? উঠুন। ” আবির নীরস গলায় বলল, “না খেয়ে কত রমজান কাটিয়েছি! এখন না খেয়ে রোজা রাখা অভ্যাস হয়ে গেছে। ” মেঘ শক্ত কন্ঠে বলল,


” না খেয়ে থাকতেন কেন? ” “তখন তো আর কেউ কল দিয়ে জাগিয়ে দিত না আমায়।” মেঘ চাপা স্বরে বলে উঠল, ” এখন যেহেতু জাগিয়ে দিচ্ছে, তারমানে বুঝতে হবে অভ্যাস পরিবর্তন করার সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ওঠেন, আমি রাখছি। ” আবির তপ্ত স্বরে ডাকল, “মেঘ…” “জ্বি৷ ”


” নিজেকে সবকিছুতে জড়িয়ে রাখিস। কোনো একটাকে কেন্দ্র করে চললে পরবর্তীতে তার ব্যথাটা সহ্য করতে পারবি না। ” মেঘ কপাল গুটিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো, “রাত-বিরেতে এসব কি কথা বলছেন? উঠবেন নাকি উঠবেন না বলুন? ” “আরে বাবা এখনি উঠতেছি৷ হাত মুখটা ধৌয়ে আসছি। ” “ওকে।”


মেঘ কল কেটে তাড়াতাড়ি নিচে আসছে। ততক্ষণে টেবিলে খাবার রেডি৷ প্রথম রোজা বলে আজ আদিও উঠেছে। আবির হাত মুখ ধৌয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচে আসছে, আসার সময় তানভিরকেও ডেকে নিয়ে আসছে। মেঘের বিপরীতে বসতে বসতে আবির অল্প করে ভ্রু নাচালো । মেঘ অপ্রখর হেসে চিবুক নামিয়ে নিল। খাওয়া শেষে যে যার মতো রুমে চলে গেছে। আবির নামাজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। মেঘ রেস্ট নেয়ার জন্য একটু শুয়েছে। বন্যাকে নেটে দেখে সঙ্গে সঙ্গে কল দিল। বন্যা কল রিসিভ করামাত্র মেঘ বলে উঠল, “আসসালামু আলাইকুম। সেহরি খেয়েছো জানু? ” “মাত্রই খেয়ে আসলাম। তুমি খেয়েছো বেবি?” “হ্যাঁ খেয়েছি৷ এখন রেস্ট নিচ্ছি।” বন্যা ঠাট্টার স্বরে বলল,


” সাবধান, রোজা রমজানের দিন৷ দিনের বেলা মন কে সংযত রাখিস। আবির ভাইয়াকে ঢ্যাবঢ্যাব করে দেখিস না আর ওনাকে নিয়ে বেশি ভাবিসও না৷ ” মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “ওনাকে দেখব কিভাবে? ওনি সারাদিন অফিসেই থাকবেন৷ আচ্ছা একটা কথা বলবি?” “কি? ”


“আমি যদি রোজা রেখে পাঞ্জাবি বা টিশার্ট পেইন্ট করি তাহলে কি আমার রোজা হালকা হয়ে যাবে?” বন্যা হাসতে হাসতে বলল, “হ্যাঁ হয়ে যাবে কারণ তুই রঙ করতে করতে আবির ভাইয়ার কথা ভাববি। তাই দিনের বেলা জামা কাপড়ের দিকে ভুলেও তাকাবি না। বুঝলি?”


“আচ্ছা ঠিক আছে। নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে। রাখছি। ” বন্যা কল কাটতেই দেখল তানভিরের আইডি থেকে মেসেজ আসছে। ছোট করে লেখা, “সেহরি খেয়েছো?” বন্যা উত্তর দিল, “জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি খেয়েছেন?” “হ্যাঁ৷ ”


কোনো পাশ থেকেই আর কোনো মেসেজ আসলো না। তানভির ২-৩ বার কিছু লিখেও বার বার মুছে দিয়েছে। কিছু একটা বললে সেই মেসেজ মেঘকে দেখালে বোনের নজরে তানভির ছোট হয়ে যাবে সেসব ভেবেই তানভির কিছু লিখতে পারছে না। প্রায় ৫ মিনিট পর বন্যার আইডি থেকে মেসেজ আসলো, “গুড নাইট৷ ” তানভির মলিন হেসে লিখল, “গুড নাইট & টেইক কেয়ার। ”


সকালে মেঘের ঘুম ভাঙার আগেই আবির অফিসে চলে গেছে। বাড়ি সম্পূর্ণ নিরব। মেঘ একে একে সবার রুমেই চক্কর দিয়ে আসছে। মীম আর আদি টিউশনে গেছে, তানভির, আবির, আলী আহমদ খানরা কেউ বাসায় নেই। বাড়ির তিন কর্তী নিজেদের রুমে কুরআন শরীফ পড়ছেন। মেঘ ঘুরে ফিরে নিজের রুমে এসে শাওয়ার নিয়ে ওজু করে সেও কুরআন শরীফ পড়তে বসেছে৷ ইফতারের আগমুহূর্তে আবিররা বাসায় ফিরেছে। প্রথম রোজা তাই মালিহা খান বার বার সবাইকে বলে দিয়েছিলেন যেন ইফতারের আগেই চলে আসে৷ মেঘ শরবত বানাচ্ছে, মীম মেঘকে সাহায্য করছে। আর আদি দুপুর থেকেই সোফায় পরে আছে। ১০ মিনিট পর পর জিজ্ঞেস করে, “মেঘাপু, আর কতক্ষণ? ”


“আপু আর কতক্ষণ পরে আজান দিবে?” মেঘ আর মীম আদি কে বুঝিয়ে রাখতে রাখতে নিজেরাই ক্লান্ত হয়ে গেছে। আদি এইযে শোফায় শুয়েছিল আর উঠতেই পারছে না। আবির ইফতারের আগে আগে এসে আদিকে কোলে করে চেয়ারে নিয়ে বসিয়েছে। চেয়ারে বসেও আদি হেলে পড়ে যাচ্ছে । আদির অবস্থা দেখা মীম মিটিমিটি হাসছে। আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে বললেন, “এভাবে হেসো না, এমন দিন সবাই পার করে আসছে। ”


সঙ্গে সঙ্গে মীমের হাসি থেমে গেছে। চুপচাপ ইফতার করতে বসে পরেছে। মেঘ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শরবতে একটু পর পর চিনি দিচ্ছে৷ প্রথমবারের মতো শরবত বানানোর দায়িত্ব মেঘ নিয়েছে। যদি ঠিকঠাক না হয় তাহলে বাড়ির সবার সামনে নাক কাটা যাবে। এজন্য আরও বেশি ভয় পাচ্ছে৷ আবারও চিনি দিতে যাবে তখনই আবির মৃদু স্বরে বলল, “আর কত চিনি দিবি! থাম এবার। তোর চিনি দেয়া দেখে একদিনেই সবার ডায়াবেটিস হয়ে যাবে। ” মেঘ কপাল গুটিয়ে তাকালো কিন্তু কিছু বলল না৷ তানভির বলে উঠল,


“প্রথম বার শরবত বানাচ্ছে তাই এই অবস্থা। সপ্তাহ খানেক বানালেই অভ্যাস হয়ে যাবে। ” আকলিমা খান রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে প্রশ্ন করলেন, ” তানভির, সবসময় তো তুমিই শরবত বানাও। এবার দায়িত্ব মেঘকে দিয়েছো কেনো?” তানভির মুচকি হেসে বলল,


” সবসময় আমার শরবত খেয়েছো এবার আমার বোনের হাতের শরবত খাবে। সমস্যা কি?এই রমজান যেমন স্পেশাল তেমন শরবত টাও স্পেশাল হবে।” “রমজান স্পেশাল কেন?” “বাহ রে! কতবছর পর ভাইয়ার সাথে রমজান পালন করছি। তাছাড়া আমাদের ফুপ্পিকে পেয়েছি। স্পেশাল হবে না?” “হ্যাঁ, অবশ্যই। ”


ব্যস্ততার মধ্যেই রমজান কাটছে সবার। ঈদের ছুটির জন্য বেশিরভাগ কাজ আগেভাগে শেষ করে রাখছে। সময় করে ইকবাল খান সিলেট আর মোজাম্মেল খান কিছুদিনের জন্য রাজশাহী গেছেন। আলী আহমদ খান আর আবির মিলেই অফিস সামলাচ্ছে। আলী আহমদ খান ইফতারের আগে আগে বাসায় চলে গেলেও আবির প্রতিদিন ফিরতে পারে না। আব্বুর অফিসের কাজ শেষ করে নিজের অফিসে যাওয়ার আগে, মাঝে মাঝে রাস্তাতেই মাগরিবের আজান পড়ে যায়, মাঝে মাঝে রাকিবদের সাথে ইফতার করে৷ কিন্তু প্রতিদিন মাগরিবের নামাজের পরপরই মেঘ কল দেয়। কল দিয়ে প্রথম প্রশ্ন টায় থাকে,


“ইফতার করেছেন? কি কি খেয়েছেন?” দ্বিতীয় প্রশ্ন, “বাসায় কখন আসবেন?” প্রতিদিন ই মেঘের একই রুটিন। আবিরের বাসায় ফেরার সময় অনুসারে মেঘ নিজের কাজ শেষ করে। আবির বাসায় ইফতার করে বের হলে ফিরতে ফিরতে প্রায় ১-২ টা বেজে যায়৷ আর ইফতার বাহিরে করলে তারাবির নামাজ শেষে বাসায় চলে আসে। মেঘও সেই অনুযায়ী নামাজ শেষ করে পাঞ্জাবি ডিজাইন করতে থাকে। আবির ফিরলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে৷ রাত ছাড়া এখন আবিরকে দেখা যায় না বললেই চলে৷ তাই রাতটায় আবিরকে দেখার উত্তম সময়৷ যেদিন আবির বেশি রাত করে বাসায় ফিরে সেদিন সেহরিতে আবির মেঘকে আগে কল দেয়৷ অন্যদিনগুলোতে মেঘ আবিরকে কল দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়৷ পাশাপাশি রুমে থেকেও সামনাসামনি কারো মুখে কোনো কথা নেই৷


আজ শুক্রবার অফিস বন্ধ থাকায় আবির সকাল থেকে জামাকাপড় ধৌয়তেছে। মেঘ কোনো কারণে ছাদে গিয়ে দেখে ছাদ ভরে আছে আবিরের শার্ট আর টিশার্টে। সবগুলোর মধ্যে সাদা শার্টের সংখ্যায় বেশি। সবগুলো গুনে শেষ করে মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করতে করতে মেঘ নিচে নামছে৷ আবির আরও কতগুলো শার্ট আর পাঞ্জাবি নিয়ে উপড়ে উঠছে৷ মেঘকে বিড়বিড় করে নামতে দেখে প্রশ্ন করল, ” ভরদুপুরে ছাদে গেছিলি কেন?” মেঘ উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “একটা মানুষের ২৭ টা সাদা শার্ট কিভাবে থাকবে পারে?” আবির ভ্রু কুঁচকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,


“আরও ৫ টা এখনও পড়িই নি।” “এত শার্ট দিয়ে কি করবেন?” “ধৌয়ে দিলাম, যেগুলো ছোট হবে সেগুলো দিয়ে দিব। ” মেঘ চাপা স্বরে আওড়াল, “আমাকে দুটা শার্ট দিয়েন।” আবির ভারী কন্ঠে শুধালো, “তোর শার্ট লাগবে?” মেঘ বিপুল চোখে চেয়ে তাড়াতাড়ি এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লো৷ মনে মনে বলল, “ইশশশ, ওনি শুনে ফেলল!”


মেঘ দ্রুত নিজের রুমে চলে গেছে। আবির নামাজ পড়ে এসে সেই যে ঘুমিয়েছে এরমধ্যে রাকিব প্রায় ২২ টা কল দিয়েছে। আবির ঘুম থেকে উঠে এতগুলো কল দেখে ভয়ে ভয়ে কল দিল। রাকিব কল রিসিভ করেই হুঙ্কার দিল, “আজকে রোজা রাখছি বলে, তোকে বকতে পারছি না৷ কতগুলো কল দিলাম কই ছিলি?” “ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমাইছিলাম। কেনো? ” “একটু ঝামেলা হয়ছে। একটু না বেশিই ঝামেলা। ” “ফোনে বলবি নাকি দেখা করবি?” “ইফতার করে বের হইস।” আবির উষ্ণ স্বরে জানালো,


“শরীর টা খুব দূর্বল। তুই বাসায় আয়। এখনি চলে আয় সমস্যা নেই। ” “নাহ নাহ। এখন আসলে সবার সাথে ইফতার করতে হবে। তোর বাপেরে আমি বিরাট ভয় পায়। ওনি আমার দিকে তাকালেই মনে হয়, আমি গড়গড় করে সব বলে দিব।” ”কি বলে দিবি?” “তোর আর মেঘের ব্যাপারে যা জানি সব এমনিতেই মুখ ফঁসকে বলে দিব। তারচেয়ে বরং ইফতারের পরে আসি৷ ” “তোর ইচ্ছে। ” নামাজ শেষে আবির বাসায় আসার ১০ মিনিট পর ই রাকিব বাসায় আসছে। মালিহা খানকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে সরাসরি আবিরের রুমে চলে গেছে। আবিরকে বিস্তারিত ঘটনা বলার পর আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,


” তুই এখন কি চাচ্ছিস?” “আমি রিয়াকে বিয়ে করতে চাচ্ছি।” “এখনি বিয়ে করবি?” “সব জানাজানি হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বিয়ের সিদ্ধান্ত না নিলে পরবর্তীতে ঝামেলা আরও বাড়বে। ” আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “তাহলে আন্টিকে তুই বুঝা।” ‘গতকাল রাত থেকে আম্মু আমার সাথে কথা বলে না। প্রথমে ভাবছি ঠিক হয়ে যাবে। আজকে বিকাল নাগাদ যখন কথায় বলছে না তখন বাধ্য হয়ে বাসা থেকে চলে আসছি। ” “এখন আমি কি করতে পারি সেটা বল।”


রাকিব মলিন হেসে বলল, “তুই আম্মুকে বুঝাবি। ” আবির হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ” আমি আমার পরিবার মানাতে পারছি না বলে বিয়েই করতে পারছি না৷ সেখানে তুই আসছিস আমাকে দিয়ে তোর পরিবার মানাতে? বাহ! রাকিব বাহ!” “প্লিজ বন্ধু, তুই ছাড়া আমার কে আছে বল?” “তুই আমার কাছে যেকোনো সমস্যার সমাধান চা আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। কিন্তু যেই মারপ্যাচে আমি আঁটকে আছি সেটার সমাধান আমার কাছে চাইস না৷ ”


রাকিব আকুল কন্ঠে বলে উঠল, “এতদিন আমার বাসায় সমস্যা ছিল না শুধু রিয়ার বাসায় সমস্যা ছিল। কিন্তু এখন ওদের বাসার সাথে সাথে আম্মুও প্যাঁচ ধরে বসে আছে। জান্নাত আম্মুকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করছে, কিন্তু আম্মু কথা মানার অবস্থাতেই নেই। ” আবির রাশভারি কন্ঠে বলল,


“দেখ, এর সমাধান আমার কাছে নেই। তুই যেমন আব্বুকে ভয় পাস আমিও তেমন আন্টিকে ভয় পায়। আমার এখনও মনে আছে, ছোটবেলা গণিত পরীক্ষায় তুই দুই নাম্বার কম পেয়েছিলি বলে রাস্তার মাঝখানে তোকে কি মাই*রটায় না দিয়েছিল৷ সেই থেকে আমি তোর বাসায় যায় না। ” “তুই না গেলে কি হবে। আম্মু তোকে খুব ভালোবাসে। তোর কথা বললে যেকোনো অনুমতি দিয়ে দেন। কিন্তু এই ব্যাপারটা সিরিয়াস তাই তোকে নিয়ে যেতে হবে।”


“আমার পা টা ঠিক হয়ছে বেশিদিন হয় নি। আব্বু এখনও বাইক চালানোর অনুমতি দেন নি৷ রিক্সায় করে অফিসে যায় আমি৷ সেখানে তোর বিয়ের কথা বলতে তোদের বাসায় যায় আর আন্টির হাতে মা*ইর খেয়ে আবার বিছানায় পড়ি নাকি? গতবার আমার শ্বশুর বেশি না মাত্র ২ ঘন্টা ঝাড়ছিল, এবার কিছু হলে সোজা মা*র্ডা*র করে ফেলবে। তুই কি চাস না আমি বিয়ে করি? ২-১ টা পরী আমাদের সংসারে আসুক, তোকে চাচ্চু বলে ডাকুক? আর আমায় আব্বু! ” রাকিব গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল,


” একটা প্রবাদ বাক্য আছে, অইবো পোলা ডাকবো বাপ তে যাইবো মনে পাপ। তোর অবস্থা হইছে এরকম।” আবির ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল, “আমার পোলা লাগতো না। একটা মেয়ে হলেই হবে যাকে ঘিরে আমাদের ছোটখাটো একটা সংসার হবে। ” রাকিব রাগান্বিত কন্ঠে বলল, ” আর কত কল্পনায় ভাসবি এবার বাস্তবে আয়। বাস্তবে এসে আমাকে বাঁচা৷ ” “আমি পারবো না, দুঃখিত।” মেঘ দরজা থেকে উঁচু স্বরে বলল,


“আসবো?” আবির ঠোঁটে হাসি রেখে বলল, “হ্যাঁ, আসেন।” মেঘ মোলায়েম কন্ঠে বলল, “বড় আম্মু আপনাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছেন।” রাকিব ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো আপু?”


“আলহামদুলিল্লাহ ভালো৷ আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?” “আমি ভালো নেই। আমার অবস্থা খুব খারাপ। ” “কেনো ভাইয়া? কি হয়েছে?” “তোমার আবির ভাইকে একটু বলো আমাকে সাহায্য করতে। ও ছাড়া আমি কাউকে ভরসা করতে পারবো না। তুমি একবার বলো মেঘ!” মেঘ ভ্রু কুঁচকে সরু নেত্রে চেয়ে আছে, আচমকা প্রশ্ন করল, “কি বলবো?” আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “কিছু না। তুই রুমে যা। ”


“নাহ মেঘ। তুমি যাবে না। তুমি আবিরকে একবার বলো তারপর চলে যেও। ” মেঘ আবারও প্রশ্ন করল, “বলবো কি আমি?” “তুমি বলো আমাকে যেন আবির সাহায্য করে। ” মেঘ আবিরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মসৃণ কন্ঠে বলল, “রাকিব ভাইয়া কিসের সাহায্য চাচ্ছেন। করে ফেলুন সাহায্য! ” আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “ঠিক আছে। তুই যা এখন।” রাকিব পুনরায় বলে উঠল, ” আপু, তুমি জিজ্ঞেস করো, আবির সাহায্য করবে কি না! হ্যাঁ অথবা না। ” আবির চেঁচিয়ে উঠে বলল,


” হ্যাঁ হ্যাঁ করব সাহায্য, হইছে? ” রাকিব স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসিমুখে বলল, “এই না হলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ” আবির অগ্নিদৃষ্টিতে রাকিবের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ চলে যেতে নিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করল, “আচ্ছা কি হয়ছে?” রাকিব স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করল, “তুমি রিয়া কে চিনো?” “আপনার গার্লফ্রেন্ড রিয়া আপু?” রাকিব আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাহ! আবির” পুনরায় মেঘকে বলল,


“হ্যাঁ। আমাদের বাসার সবাই রিয়ার ব্যাপারে মোটামুটি জানতো। বিয়া দু একবার আমাদের বাসায়ও আসছে। সবার সাথে আলাপ ও হয়েছে। রিয়া শারীরিক ভাবে একটু অসুস্থ, এটা আমার বাসায় কেউ জানতো না, গতকাল কথায় কথায় এটা বলেছি তারপর থেকে শুরু হয়ছে আম্মুর চিল্লাচিল্লি। বাড়ির বড় বউ হবে, রোগী হলে কিভাবে হবে? লোকে কি বলবে? সারাজীবন ডাক্তারের কাছে দৌড়াইতে দৌড়াইতে শেষ হয়ে যাব।আরও কত কি! আম্মু এখন আমার সাথে কথায় বলতেছে না। তাই তোমার আবির ভাইকে বলতেছি, আমাদের বাসায় যেতে, আম্মুকে একটু বুঝাতে। ”


“বিয়া আপুর কি সমস্যা? ” “শ্বাসকষ্ট, এলার্জির সমস্যা আরও কিছু সমস্যা আছে।” মেঘ জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে উদাসীন কন্ঠে মনে মনে বলল, ” রিয়া আপুর সামান্য সমস্যার কারণে আন্টি কত বছরের সম্পর্ক মানছেন না।আর আমি যে তাড় ছিঁড়া এটা জানার পর আমার শ্বাশুড়ি কি আমাকে মেনে নিবেন?” আবির মেঘকে ডাকতেই মেঘ নড়েচড়ে উঠল,কথা শেষ করে দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। মেঘ যেতেই রাকিব বলল, “আজ মেঘ আসছিল বলে বেঁচে গেলাম।” আবির রাগান্বিত কন্ঠে বলল,


” লোকে এজন্যই বলে কাউকে দূর্বল জায়গা চিনাতে নেই। ” “আমি নিজেই এখন আধমরা তাই তো মেঘকে দিয়ে সাহায্য চাইলাম। আচ্ছা, তুই না একবার বলছিলি মেঘ অসুস্থ। ঠিকই তো দেখলাম।” আবির কপাল গুটিয়ে গুরুভার কন্ঠে বলল, ” অসুস্থ না রে, বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। ধমকের হাত থেকে বাঁচতে শ্বশুরের মুখের উপর বলছিলাম,


“আপনার মেয়ের কিছু না হলেই তো হলো।” যেই কথা সেই কাজ, আমার শ্বশুর সকাল বিকাল দেখে মেয়ের জ্বর, সর্দি আসছে কি না! কারণ কিছু একটা হলেই আমায় ইচ্ছে মতো ঝাড়তে পারবে। ওনি যদি ঢালে ঢালে চলে তবে আমিও চলি পাতায় পাতায়। সপ্তাহ খানেক মেঘকে গরম পানির উপর রেখেছি, সারাক্ষণ গরম পানি খেয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াইছি, প্রাকৃতিক ঔষধ সহ যতধরনের ঘরোয়া পদ্ধতি আছে সব চেষ্টা করে ফেলছি৷ আল্লাহ র রহমতে সর্দি-জ্বর কিছু হয় নি৷ ”


“তোর জীবন এখন ডিসকভারি চ্যানেলের বাঘ আর হরিণের মতো হয়ে গেছে। জামাই শ্বশুরের চ্যালেঞ্জ৷ চাচ্চু যেদিন জানতে পারবে ওনার পরীর মতো মেয়ের পিছনে তোর মতো বানর ঘুরঘুর করছে৷ তখন ওনার কি অবস্থা হবে আবির?” “সেই দিন নিয়ে এখনও ভাবি নি। যা হবে সেদিনই হবে। বাঁচা আর ম*রা দু হাতে নিয়েই ওনাদের সম্মুখীন হবো। ” “আচ্ছা এখন চল, নামাজ পড়ে আমাদের বাসায় যাবি। ”


আবির আচ্ছা বলার আগেই জান্নাত আবিরের নাম্বারে কল দিল। আবির রিসিভ করতেই জান্নাত বলল, “আবির ভাইয়া, রাকিব ভাইয়া বাসা থেকে চলে গেছে, ভাইয়ার ফোনও বন্ধ। আম্মু টেনশনে অসুস্থ হয়ে পরেছিল, এখন কিছুটা সুস্থ হয়েছে। ভাইয়ার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন। আপনি ভাইয়াকে খোঁজে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় আসুন, প্লিজ।” “আচ্ছা আসতেছি ”


আবির আর রাকিব ঘন্টাখানেকের মধ্যে রাকিবদের বাসায় আসছে। আন্টি আংকেলের সাথে কথা বলে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রিয়াকে কল দিয়ে রিয়ার আম্মুর সাথেও কথা বলে। প্রায় ঘন্টাদুয়েক আলাপ-আলোচনা শেষে রাকিব আর রিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ঈদের একদিন পরেই বিয়ে। রিয়ার পরিবার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে অনেকেই এই বিয়েতে রাজি না তাই মোটামুটি ঘরোয়া ভাবে বাসাতেই পোগ্রাম করা হবে। আবির বাসায় ফিরতেই আলী আহমদ খান শুধালেন,


“কোথায় ছিলে?” “রাকিবদের বাসায় গিয়েছিলাম। ” “রাকিব দেখলাম সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় আসলো আবার তুমি এখন ওদের বাসা থেকে ফিরছো। কোনো সমস্যা? ” “নাহ আব্বু। তেমন কোনো সমস্যা না। রাকিবের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ঈদের একদিন পর বিয়ে।” আলী আহমদ খান রাশভারি কন্ঠে বললেন, ” কোথায় ঈদের পর তোমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তা না হয়ে তোমার বন্ধুর বিয়ে করছে । ভালো ভালো। ” আবির মনে মনে আওড়াল, “যাকে বিয়ে করতে চাই তাকে বিয়ে না দিলে এই ঈদ কেন, একেরপর এক ঈদ কেটে গেলেও আবির অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। ”


দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এক সপ্তাহে পরেই ঈদুল ফিতর। খান বাড়িতে শপিং এর মেলা বসেছে। আলী আহমদ খান, ইকবাল খান, মোজাম্মেল খান তিনজনই আলাদা আলাদাভাবে সবার জন্য জামাকাপড় এনেছে। বছরে একবার ই ওনারা নিজে শপিং এ যান। তাছাড়া তানভিরও সবার জন্য জামাকাপড় এনেছে। বাড়ির ছোট দুই কর্তী একদিন মেঘদের শপিং এ নিয়ে গিয়ে সবার জন্য শপিং করিয়ে এনেছে। মেঘের অলরেডি ৫-৬ সেট ড্রেস হয়ে গেছে। তবে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির থেকে এখনও কিছু পাওয়া হয় নি তাই মেঘের মন তেমন ভালো না। আবিরদের পাঞ্জাবি, টিশার্টের কাজ কমপ্লিট৷ এখন শুধু দেয়ার অপেক্ষা। আজ সকাল থেকে তানভির আবিরকে খোঁজছে।। আবির রাকিবের বিয়ের শপিং করতে বেড়িয়েছে। আবির দুপুরের দিকে বাসায় আসতেই তানভির ছুটে গেল। আবির নির্বিকার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,


“কি হয়েছে তোর? ” তানভির অনচ্ছ হেসে বলল, “ওর জন্য একটা ড্রেস কিনেছি। কিভাবে দিব বুঝতে পারছি না। হেল্প করো।” ” আমার হেল্প করতে হয় কেন? সামনে যেতে না চাইলে নিজের বুদ্ধি কাজে লাগা। ” “মানে?” “তোর বোনকে যেভাবে গিফট পাঠিয়েছিলি সেভাবে পাঠা। ” “ও যদি না পড়ে?” “এত চিন্তা করলে অকালে চুল পেঁকে যাবে। তোর কাজ গিফট দেয়া, এক্সেপ্ট করবে কি না সেটা তার বিষয়। ” “ঠিক আছে।”


তানভির বন্যার ঠিকানা দিয়ে ড্রেস কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিয়েছে। কুরিয়ার থেকে বক্স নিয়ে বন্যা রুমে গেল। সন্দেহ নিয়ে বক্স খুলতেই বিশাল গর্জিয়াছ এক ড্রেস বের হলো। ড্রেসের ওজনই বলে দিচ্ছে ড্রেসটা অনেক দামী। বন্যা সঙ্গে সঙ্গে মেঘকে কল দিয়ে সব ঘটনা খুলে বলল। মেঘ অচতুর কন্ঠে বলল, “গিফট কে পাঠালো সেটা বড় বিষয় না। গিফট পেয়েছিস এটা নিয়েই খুশি থাক।” “এত দামী ড্রেস কি করব আমি? কেউ হয়তো ভুলে পাঠাইছে।” মেঘ তাড়িত বেগে বলল,


“আরে বোকা! ঠিকানা তোর বাসার, ফোন নাম্বার তোর মানে কেউ ইচ্ছে করেই তোকে পাঠিয়েছে।” “আমি এই ড্রেস পড়ব না। যেভাবে আছে সেভাবেই রেখে দিব।” মেঘ সঙ্গিনভাবে ধমকে উঠে, “তুই ড্রেস না পড়লে মজা টা করবো কিভাবে?” “কিসের মজা?” “তুই ড্রেস টা পড়ে ছবি তুলে একটা ছবি ফেসবুকে পোস্ট করবি, তারপর দেখব পরিচিত মানুষের বাহিরে কে তোর ছবিতে রিয়েক্ট দেয়। সেখান থেকে খোঁজে নিব, মনে মনে কে তোকে পছন্দ করে। আর কোন বড়লোক বাপের ছেলে এত দামী ড্রেস তোর জন্য পাঠায়।” “আমি পারবো না।”


“চুপ, আমি যা বলছি তাই হবে। এ ব্যাপারে আমি আর কোনো কথা শুনবোও না মানবোও না।” “কিরে? তোর আবার কি হলো?” “না দেখছিলাম, আবির ভাইয়ের স্টাইলে কথা বললে কেমন লাগে, রাখি এখন, টা টা। ” “আচ্ছা। টা টা। ”


আগামীকাল ঈদ৷ মেঘ এখনও অপেক্ষায় আছে আবির তাকে একটা ড্রেস গিফট করছে। আর সেটা মেঘ ঈদের দিন সকালে পড়বে। অথচ আবির এখনও ড্রেস দিচ্ছে না। এদিকে দুপুর থেকে হালিমা খান মেঘদের পার্লারে যেতে বলছেন, মেহেদী দেয়ার জন্য বুকিং দিয়ে রেখেছে আরও ১ মাস আগে। কিন্তু মেঘের পার্লার যাওয়াতে মনোযোগ নেই। এক ফাঁকে মেঘ ছুটে গেল আবিরের রুমে। আবিরকে ডেকে বলল, “আবির ভাই আপনি আমায় মেহেদী দিয়ে দিবেন না?” “কেন? মেহেদী আর্টিস্ট কোথায়?”


“আর্টিস্টের কাছে দিব না। আপনি রাতে দিয়ে দিবেন। ” “আমি পারব না। মীমকে নিয়ে তাড়াতাড়ি মেহেদী দিতে যা। ইফতারের আগে আগে চলে আসিস। ” মেঘ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, “মাইশা আপুর বিয়েতে আপনি কত সুন্দর করে মেহেদী দিয়ে দিছিলেন, আজকে একটু দিয়ে দেন না! প্লিজ” আবির রাগান্বিত কন্ঠ বলল, “মেঘ, উল্টাপাল্টা বায়না ধরবি না। যা বলছি তা শুন।”


মেঘ মন খারাপ করে নিজের রুমে চলে গেছে। মেহেদী দিবে না বলার পরও বাড়ির সবাই জোর করে পার্লারে পাঠিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরেই মেঘ দেখল তার বিছানার উপর একটা শপিং ব্যাগ রাখা৷ শপিং এ দুটা ড্রেস, একটা হলুদ রঙের আরেকটা গাঢ় নীল রঙের। দুটা ড্রেস ই খুব সুন্দর তবে মেঘের নীল ড্রেস টা বেশি পছন্দ হয়েছে। মেঘ ড্রেস দেখতে দেখতে আজান পড়ে গেছে। মেঘ দ্রুত ইফতার করতে চলে গেছে। ইফতার করে রুমে এসে নামাজ শেষে আবারও ড্রেস গুলো দেখছে। আবির ইশার নামাজ পড়তে বের হতেই মেঘ আবিরের জন্য ডিজাইন করা দুটা পাঞ্জাবি আর টিশার্ট গুলো আবিরের রুমে রেখে আসছে। তানভিরের রুমেও একটা পাঞ্জাবি আর একটা টিশার্ট রেখে আসছে।


আবির কিছুক্ষণ পর রুমে এসে দেখলো পাঞ্জাবির উপর ছোট একটা চিরকুট। হাতে নিতেই দেখল এতে লেখা, ” আপনার Sparrow-র দেয়া প্রথম পাঞ্জাবি। ভালো লাগলে চোখ খুলে পড়বেন, ভালো না লাগলে চোখ বন্ধ করে পড়বেন, তবুও পড়তেই হবে। ” সাথে আরেকটা চিরকুটে লেখা, ” আপনি আমার কোমল মনে আঘাত দিয়েছেন তাই আমি রাগ করেছি, খুব রাগ করেছি। সামান্য একটু মেহেদী দিয়ে দিলে আপনার খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? আপনি আমার মনের ছোট ছোট অভিযোগে সৃষ্টি বিশালাকার পর্বত। আপনাকে ঘিরে আমার যত অভিযোগ ছিল সব ঈদের চাঁদের কাছে সঁপে দিয়েছি। তবুও দোয়া করি আপনি ভালো থাকুন, পৃথিবীর সব সুখ আপনাকে ঘিরে রাখুক, ঈদ মোবারক। ” আবির চিরকুট টা পড়ে মুচকি হেসে বলল,


“পৃথিবীর সব সুখ যদি আমায় ঘিরে রাখে তবে আমি সেই সুখের চাদর দিয়ে তোকে ঘিরে রাখবো। তোর মনের ঘরে চুল পরিমাণ অভিযোগ ঢুকার রাস্তাও রাখবো না। তোকে আমার ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখবো। একদিন কেন, সারাজীবন তোকে রাঙিয়ে রাখার দায়িত্ব আমি নিবো ইনশাআল্লাহ। ”


মেঘ আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পরেছে। এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছে। ঘুম ভাঙতেই তড়িঘড়ি করে উঠে শাওয়ার নিতে চলে গেছে। ফজরের নামাজ পড়ে ঘন্টাখানেক কুরআন শরীফ পড়েছে। তারপর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে মেঘের দুচোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়তে শুরু করেছে। দাদা, দাদু সহ যত আত্মীয় মারা গেছেন তাদের কথা ভেবেই মেঘ কাঁদছে৷ নামাজ পড়েও তাদের দোয়া করেছে । ঘন্টাখানেক নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে মেঘ ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধৌয়ে রেডি হতে শুরু করলো। বিছানা ছড়ানো ৮ টা ড্রেস। সবগুলোই সুন্দর কিন্তু মেঘের নজর এক আবিরের ড্রেসেই আঁটকে গেছে। খুব ভেবে চিন্তে আবিরের দেয়া নীল রঙের ড্রেসটায় পরেছে।


সাথে নীল রঙের বড় বড় কানের দুল, হাতে নীল চুড়ি। শুরুতেই চুল শুকিয়ে স্ট্রেইট করে নিয়েছিল সেই চুলে মাঝখানে সিঁথি করে দুপাশে দুটা কাঁকড়া বেন্ট দিয়ে ডিজাইন করে চুল বেঁধেছে। পেছন থেকে সব চুল ছাড়া, তবে স্ট্রেইট করার জন্য খুব সুন্দর লাগছে। মুখে হালকা মেকাপ করে ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছে। সাজা শেষে রুম থেকে বেড়িয়ে সেদিক সেদিক উঁকি দিচ্ছে, কোথাও কেউ নেই, আবিরের রুমেও দেখে এসেছে আবির নেই। হঠাৎ বড় আব্বুকে নামাজ থেকে ফিরতে দেখে মেঘ দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেছে, আর আবিরের উপরে আসার অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর আবির উপরে আসামাত্রই মেঘ রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা আবিরের সামনে গিয়ে বসে পরেছে। মেঘের এমনকান্ডে আবির কিছুটা ভড়কে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে দু পা পিছিয়ে দাঁড়ালো । মেঘ উপরে তাকিয়ে দুহাতে আবিরের দু পা স্পর্শ করলো। ততক্ষণে আবির নিচু হয়ে মেঘের দু কাঁধ আলতোভাবে হাত রেখে বলল,


“সালাম করতে হবে না, ওঠেন।” মেঘ সালাম করে ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আবিরের পড়নে মেঘের দেয়া সাদা পাঞ্জাবি। তা দেখে মেঘের ওষ্ঠ যুগল আরও বেশি প্রশস্ত হলো।মেঘের কল্পনায় আবির ভাইকে যতটা সুন্দর লেগেছিল বাস্তবে তার থেকে বহুগুণ বেশি সুন্দর লাগছে। আবিরও নির্বাক হয়ে মেঘকে দেখছে, নীল রঙ আবিরের খুব প্রিয় তবে সচরাচর নীল রঙের কিছু আবির কিনে না। কারণ প্রিয় মানুষকে প্রিয় রঙের ড্রেসে দেখলে মুগ্ধতায় চোখ সরাতে পারবে না ভেবেই এই রঙটাকে এড়িয়ে যায় । তবে দোকানে নীল রঙের জামাটা দেখে এত পছন্দ হয়েছিল যে না কিনে থাকতেই পারে নি। অকস্মাৎ আবির ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করল,


“সালামি লাগবে?” মেঘ মুচকি হেসে বলল, ” আগে দোয়া করবেন তারপর সালামি দিবেন।” আবির মেঘের মাথায় হাত রেখে সুমধুর কন্ঠে বলল, ” দোয়া করি জীবনে অনেক বড়, সবসময় হাসি খুশি থাক” মেঘ নাক সিটকিয়ে বলল, “এসব দোয়া তো সবাই করে, আপনি বরং ইউনিক দোয়া করুন।” “দোয়াও আবার ইউনিক হয়?” “হ্যাঁ হয়। ”


আবির মাথা থেকে হাত নামিয়ে দুহাতে মেঘের দুগালে আলতোভাবে হাত রাখলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে স্নিগ্ধশীতল কন্ঠে বলল, ” আমি দোয়া করি, তোর মনের সব ইচ্ছে পূরণ হোক। ছোট থেকে বড় ইনফেক্ট যেগুলো তুই মনে মনে ভাবিস কিংবা ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে বা কল্পনায় দেখিস সেই সব ইচ্ছে পূরণ হোক। তুই যা চাস, যাকে চাস ঠিক যেভাবে চাস সেভাবেই যেন পেয়ে যাস। তোর আকাশ জুড়ে ভালোবাসার বৃষ্টি হোক, যেই বৃষ্টি তোর মনে জমে থাকা অভিযোগ, অভিমান গুলোকে ধৌয়ে মুছে বিলীন করে দিবে সেই সঙ্গে আগামী দিনগুলোতেও তোর মন ভালো রাখবে। প্রয়োজনে বৃষ্টির ফোঁটার সাথে সাথে দুটা হাঁসের বাচ্চাও আসুক। যেগুলো তোকে সারাদিন হাসাবে। মহিলা হাঁসটার নাম হবে মেঘ, পুরুষ হাঁসের নাম যা খুশি রেখে দিস। তারপর তাঁদের একটা সংসার হবে ।পরে ডিম হবে, বাচ্চা দিবে.. আরও বলবো?”


মেঘ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, “এটা আপনার ইউনিক দোয়া?” “তো কি দোয়া চাস বল?” “থাক দোয়া করতে হবে না। সালামি দেন!” “কত লাগবে? ২ টাকা নাকি ৫ টাকা? ” “আপনার যত ইচ্ছে দেন । সালামি চাইতে নেই। ” “আবির পকেট থেকে একটা নতুন ৫০০ টাকার বান্ডেল বের করে দিল।” মেঘ অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ” এত টাকা নিয়ে কি করব?” “তোর বোধশক্তি হওয়ার পর প্রথমবার সালামি দিচ্ছি৷ কম কেনো দিব?” মেঘ আবিরের দিকে তাকিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,


“ধন্যবাদ। ” “সালামি দিলে আবার ধন্যবাদও দেস?” “সালামির জন্য ধন্যবাদ দেয় নি। পাঞ্জাবির জন্য দিয়েছি। ” “ওহ আচ্ছা। তাহলে আপনাকেও ধন্যবাদ, জামাটা পড়ার জন্য। ” মেঘ রুমে যেতে যেতে হঠাৎ বলে উঠল, “আমি কিন্তু পুরুষ হাঁসের নাম ফিক্সড করে ফেলেছি। ” আবির মুচকি হেসে বলল, “আমি জানি। ”


আবির নিজের রুমে চলে যাচ্ছে।মেঘ নিজের রুমে এসে টাকাগুলো ড্রয়ারে রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে, “পুরুষ হাঁস টা আবির আর মহিলা হাঁসটা মেঘ। একদিন তাদের বিয়ে হবে। তাদের সাজানো ছোট্ট একটা সংসার হবে। তারপর তাদের ঘর আলো করে একটা রাজকন্যা না হয় রাজপুত্র আসবে। উফফফ” বলেই মেঘ লজ্জায় দুহাতে নিজের মুখ ডেকে ফেলেছে। ব্লাশ দেয়ায় গাল দুটা যতটা লাল হয়েছিল এসব কথা ভেবে দু গাল তিনগুণ বেশি লাল হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই মেঘ স্বাভাবিক হয়ে নিচে নামলো। মেঘের ড্রেস দেখে কাকিয়া বলল, ” এই ড্রেসটা অনেক সুন্দর। তোকে খুব ভালো লাগছে। কিন্তু তুই যেটা পছন্দ করে কিনলি সেটা পরিস নি কেন?” মেঘ হাসিমুখে বলল,


“ঈদ সাতদিন থাকে। সবার দেয়া ড্রেস ই পড়বো।” তানভির নামাজের সময় তাড়াহুড়ো করে গেছিল বলে মেঘের দেয়া পাঞ্জাবি টা পড়ে যেতে পারে নি। বাসায় এসে তাড়াতাড়ি করে মেঘের দেয়া পাঞ্জাবি পড়ে নিচে আসছে। আবিরও ততক্ষণে নিচে আসছে। সবাই একবার আবিরকে দেখছে আবার তানভিরকে। হালিমা খান প্রশ্ন করলেন,


“তোরা কি সেইম পাঞ্জাবি কিনছিস?” তানভির ঠোঁটে হাসি রেখে বলল, ” পাঞ্জাবি গিফট পেয়েছি। ” “কে দিল?” “বনু আমাকে আর ভাইয়াকে গিফট করেছে!” “ডিজাইন নিজে করেছিস?” মেঘ ছোট করে বলল, “হ্যাঁ!” “বাহ! খুব সুন্দর হয়েছে। তোর আব্বু চাচ্চুদেরও দিতি।” “ভালো লাগলে ইনশাআল্লাহ আগামী ঈদে সবাইকে দিব।” “ইনশাআল্লাহ। ”


সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ৫ ভাইবোন মিলে ঘুরতে বেড়িয়েছে। তানভির ড্রাইভ করছে আবির তার পাশের সিটে বসে আছে। ফুপ্পির বাসা থেকে অলরেডি ঘুরে অল্প নাস্তা করে আসছে। রাস্তায় যেতে যেতে মেঘ হঠাৎ ই বলে উঠল, “ভাইয়া চলো না বন্যাদের বাসার এদিকে যায়।” আবির আর তানভির দুজনেই আঁতকে উঠল। তাদের প্ল্যান ছিল এদিক সেদিক ঘুরে শেষে বন্যাদের বাসার এদিকে যাবে । কিন্তু মেঘ শুরুতেই বলে ফেলল। তানভির মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করল,


“ঐদিকে কেন?” “বন্যা ঈদে কোথাও বের হয় না। আমরা যেহেতু বের হয়ছি ওকে দেখে আসি৷ ” আবির মৃদু হেসে বলল, “শুধু দেখে আসবি কেন? ওকে নিয়ে আসিস। সবাই এক সঙ্গে ঘুরবো।” “আচ্ছা। বলবো ওকে। ”