প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | হানিমুনের হাতছানি
আবির দু*র্বোধ্য দৃষ্টিতে মেঘের ক্র*ন্দনরত ধৃষ্টতায় চেয়ে আছে। মেঘের নিরন্তর কান্নায় আবিরের হৃ*দয় ভে*ঙেচু*রে ত*ছনছ হয়ে যাচ্ছে তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শান্ত স্বরে বলল, “নিষ্করুণ এই পৃথিবীতে হয়তো কেউ আছে যে তোকে তার পৃথিবী মনে করে, তোর সামীপ্যে তার মন অনুরঁজিত হয় । খোঁজে দেখিস তোর আশেপাশে এমন কেউ আছে যে তোর কন্ঠস্বর শুনার জন্য প্রতিনিয়ত ছটফট করে। চিৎকার করে বললেই কেউ কারো আপন হতে পারে না। ” মেঘ কাঁদছে আর বিড়বিড় করে বলছে,
“সেই কেউ টা কি সারাজীবন কেউ হয়েই থাকবে?” আবির মৃদু হেসে বলল, “হয়তো না। সময় হলে ঠিকই আপন করে নিবে।” মেঘ আড়চোখে আবিরকে দেখে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ” হ্যাঁ, তবে আমাকে নয় হয়তো আমার লা**শ টাকে। ” আবির তেজঃপূর্ণ কন্ঠে চিৎকার করল, “একটা থা*প্প*ড় মারবো তোকে।”
কথাটা বলতে বলতে হাত উপরে তুললো আবির। ক্রু*দ্ধ আঁখিতে চাইলো মেঘের অভিমুখে, ক্রোধে আবিরের নাকের ডগা ফুলে উঠেছে। মেঘ কিছুটা সরে গিয়ে তাকালো আবিরের দিকে, ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আবির সঙ্গে সঙ্গে হাত নামিয়ে নিল। মেঘ ভ্রু কুঁচকে ভেজা কন্ঠে বলল, “থামলেন কেনো? এখন থা*প্প*ড় দিলে অনুভব করতে পারবো লা**শ হয়ে গেলে তো আর পারবো না। দেন” আবির আবারও চিৎকার করল,
“মেঘ।” আবির উঠে পাশে থাকা একটা কাঠের চেয়ারে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে লা*থি মেরে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। মেঘ কিছুক্ষণ সে পথে নিশ্চুপ চেয়ে রইলো তারপর সোফার উপর দুই পা তুলে হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। মেঘ এখানে আসতে চাইছিল না কিন্তু তানভির জোর করে নিয়ে আসছে। এখানে আসার পর থেকে তানভির, আসিফ আর আরিফ আড্ডায় মগ্ন হয়ে আছে। ১০ মিনিটও হয় নি আবির এক গ্লাস শরবত নিয়ে আসছে। মেঘের মাথায় হাত রাখতেই মেঘ আঁতকে উঠে তাকালো। আবির পাশে বসে শান্ত স্বরে বলল,
“শরবত টা খান। ” মেঘ শক্ত কন্ঠে বলতে চাইলো, ” খাবো না।” কিন্তু আবিরের আ*গ্নে*য়গি*রির লা*ভা*র ন্যায় লা*ল বর্ণের দুচোখে চোখ পড়তেই ভ*য়ে আর কিছু বললো না। শরবতের গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে গ্লাস ভর্তি শরবত শেষ করে ফেলল। আবির ধীর হস্তে মেঘের দুচোখ মুছে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
” গায়ে হলুদের পোগ্রামে এসে এভাবে কাঁদলে মানুষ উল্টাপাল্টা ভাববে। এখন শান্ত হ, কিছুক্ষণ রেস্ট নে পরে বাসায় গিয়ে আবার কাঁদিস। ” মেঘ আকুল কন্ঠে শুধালো, ” আমি কাঁদলে আপনার বুঝি খুব ভালো লাগে?” আবির মনে মনে আওড়াল, ” তোর চোখে পানি দেখলে কলিজা ফেটে যায় আমার।” আবির একপলক মেঘের দিকে তাকিয়ে উঠে চলে যাচ্ছে। মেঘ মলিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ” কিছু বললেন না?”
আবির কোনো উত্তর না দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। আবিরের এমন আচরণে মেঘের বড্ড অভিমান হলো। আবির বেড়িয়ে যেতেই জান্নাত, আইরিন, মীম একে একে ডেকে গেছে কিন্তু মেঘকে এক চুলও নাড়াতে পারে নি। আবির বাসা থেকে বেড়িয়ে কোথায় যেন চলে গেছে, রাকিব ফোনের পর ফোন দিচ্ছে। আগামীকাল রাকিবের বিয়ে কোথায় একটু আনন্দ করবে, কিন্তু বন্ধুর জন্য তারও উপায় নেই। এক ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে আবির ফোন ধরছে না, বাসায়ও ফিরছে না। রাকিব, আসিফ, তানভির একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। কারো কল ই রিসিভ করছে না আবির। মেঘ চুপচাপ বসে বসে সবার কর্মকাণ্ড দেখছে, মনের ভেতরে ভয় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সে কল দিবে না বলে জেদ ধরে বসে আছে। প্রায় দেড় ঘন্টা পর আবির বৃষ্টিতে অর্ধেক ভিজে বাসায় আসছে। আবিরকে দেখেই রাকিব হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
“কোথায় গেছিলি তুই?” “তোর গেস্টদের সাথে দেখা করতে৷ ” “ফোন ধরে বলা যাইতো না? তোর যন্ত্রণায় কি বিয়েটাও করতে পারবো না?” আবির মলিন হেসে বলল, “সরি৷ ” রাকিব এবার গলার স্বর নিচু করে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়ছে আবির?” “আরে কিছু হয় নি।”
আবির রুমে ঢুকতেই মেঘের দিকে এক পলক তাকালো, আবিরকে রুমে ঢুকতে দেখেই মেঘ পা নামিয়ে স্বাভাবিকভাবে বসেছে। আবির একটা চেয়ার টেনে একপাশে বসে পরেছে, আইরিন তাড়াতাড়ি করে একটা টাওয়েল নিয়ে আসছে৷ আবিরের অর্ধেক শরীর ভেজা। আইরিন স্বাভাবিক স্বরে বলল, “নাও মাথাটা মুছো, আমি আসিফ ভাইয়ার একটা শার্ট নিয়ে আসি৷ ” আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“টাওয়েল, শার্ট কিছুই লাগবে না আমার৷ ” আইরিন ভ্রু কুঁচকে ভারী কন্ঠে বলল, “এমনিতেই ভিজে আসছো আবার মাথাও মুছতেছো না৷ পরে কিন্তু সর্দি লেগে যাবে ” আবির ভাবুক স্বরে বলল, ” তারপর কি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ম*রে যাবো?” আইরিন কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ” বাজে কথা বলো কেন, নাও মাথা মুছো ” আবির ভারী কন্ঠে বলল, ” ম*রে গেলে মাথা মুছে কি করবো? নিয়ে যা টাওয়েল।”
মেঘ তড়িৎ বেগে বসা থেকে উঠে এসে আইরিনের থেকে টাওয়েল নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল, “আইরিন একটা শার্ট নিয়ে আসো।” আইরিন শার্ট আনতে চলে গেছে। মেঘ আবিরের চুল মুছতে মুছতে রাগী স্বরে বলল, ” আমি কাউকে ম*রে যেতে বলি নি।” এমন সময় রাকিব ওদের ডাকতে রুমে আসছে, এই দৃশ্য দেখে দুহাতে মুখ লুকিয়ে ঠাট্টার স্বরে বলল, ” আমি মনে হয় ভুল রুমে চলে আসছি৷ এখন কি করবো?” আবির তপ্ত স্বরে বলল,
” মাফ চা ।” মেঘ আবিরকে থামিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ” আপনি ঠিক রুমেই এসেছেন, ভেতরে আসুন।” রাকিব ঠাট্টার স্বরে আবারও বলল, ” বন্ধু আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দিস।” রাকিব বিড়বিড় করতে করতে রুমে আসলো, ” যেই জীবনে এমন যত্ন পেলাম না সেই জীবনের প্রতি ধি*ক্কার জানায়।”
মেঘ টাওয়েল সরিয়ে আবারও সোফায় গিয়ে বসলো। এই রুমে কোনো মানুষজন নেই৷ গায়ে হলুদের মঞ্চ ভেতরের দিকে একটা বড় রুমে করা হয়েছে। আত্মীয় স্বজন এমনকি তানভিররাও মঞ্চের কাছেই আড্ডা দিচ্ছে। মেঘের ভালো লাগছিল না বলে এই রুমে এসে বসে ছিল, মেঘের জন্য আবিরও এই রুমেই এসে বসেছে। রাকিব মঞ্চে যায় আবার একটু পর পর আবির মেঘকে নিতে আসে৷ আইরিন আশিফের একটা শার্ট মেঘকে দিয়ে চলে গেছে। মেঘ শার্ট এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” এটা পড়ে আসুন।” ” শার্ট পড়ে কি হবে? ম*রে গেলে তো লা*শ ই হয়ে যাব।” মেঘ এবার অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো, মেঘের ইচ্ছে করছিল আবিরের মুখ চেপে ধরতে কিন্তু পারলো না। রাকিব রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে রাগী স্বরে বলল, ” ৫ মিনিটের মধ্যে তোদের নাটক শেষ করে যদি ভেতরে না আসিস তাহলে তোদের দু’টাকে মে*রে আমি কা*ল জে*লে চলে যাব।”
মেঘ মৃদু হেসে বলল, ” তাহলে রিয়া আপু কি করবে?” ” কি আর করবে? জে*লখা*না*র বাহিরে বসে কাঁ*দবে। তোমরা তো আর কোনো উপায় রাখতেছো না।” আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” মুখ টা বন্ধ করে যা, আমরা আসতেছি।” আবির পাঞ্জাবি খুলে সেকেন্ডের মধ্যে শার্ট পড়ে ফেলেছে। মেঘ আবিরের ভেজা পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে কপাল গুটিয়ে প্রশ্ন করল,
“আপনি কোথায় গেছিলেন? আর এত ভিজলেন কিভাবে ?” আবির সরু নেত্রে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “তোর না হওয়া শ্বশুর আর তার ছেলেটাকে দেখতে গেছিলাম।” আবির রুম থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে, মেঘ নিঃশব্দে হেসে প্রশ্ন করল, ” পছন্দ হয়েছে?” আবির ঘাড় ঘুরিয়ে চাপা স্বরে বলল, ” খুব।”
মেঘ মিটিমিটি হাসছে, এতক্ষণ যাবৎ মনের কোণে জমে থাকা অভিমান গুলো মুহুর্তেই গায়েব হয়ে গেছে। বিকেলে মেহমান না আসার কারণ টা মেঘ এখন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। চোখ- মুখ মুছে ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি নিয়ে মঞ্চে গেল। মীম মেঘকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, “মন ভালো হয়েছে তোমার?” “হুমমমমমম।” “এখন কিভাবে ভালো হলো?”
মেঘ মীমের কানের কাছে বিড়বিড় করে বলল, ” আমাকে আজ যাদের দেখতে আসার কথা ছিল আবির ভাই তাদের… ” মীম আতঙ্কিত কন্ঠে শুধালো, “কি করেছে?” মেঘ মেকি স্বরে বলল, ” তেমন কিছু না, তুই বুঝবি না।”
মেঘকে হাসিখুশি দেখে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। ফুপ্পি আগেও কয়েকবার মেঘের কাছে যেতে চেয়েছিল কিন্তু জান্নাত যেতে দেয় নি।কারণ ফুপ্পি মেঘকে বুঝাতে গেলে দেখা যাবে দুজনেই কেঁদে একাকার অবস্থা করে ফেলবে। ছেলের শ্বশুর বাড়িতে এসে শ্বাশুড়ি কাঁদছে বিষয়টা আত্মীয়রা ভালো চোখে নিবে না তাই জান্নাত ওনাকে মেঘের কাছে যেতে দেন নি৷ প্রায় ২-৩ ঘন্টা গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম চলেছে। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে সাথে বজ্রপাত। আলী আহমদ খান আবিরকে কল দিলেন। আবির রিসিভ করে বলল,”হ্যাঁ আব্বু, বলো।”
“কি করছো?” ” এখন খাবো, খেয়েই বের হবো।” আলী আহমদ খান ঠান্ডা কন্ঠে বললেন, ” যদি থাকার সমস্যা না থাকে তাহলে আজ রাত টা ওখানেই থাকো। দিনের অবস্থা খুব ই খারাপ কখন কোন অঘটন ঘটে বলা যায় না। আজ আসার দরকার নেই। ” “আচ্ছা, ঠিক আছে। ”
আবির সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। গভীর রাতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। মেঘের প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে, সারাদিন যাবৎ কাঁদতে কাঁদতে এখন মাথা ব্যথায় চোখ মেলতে পারছে না। খেতেও ইচ্ছে করছে না আবিরের জোরাজোরিতে কোনো রকমে অল্প খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। মেঘ, মীম, আইরিন সবাই এক রুমে শুয়েছে৷
মাঝরাতে কারো কান্নার শব্দে হঠাৎ করেই মেঘের ঘুম ভেঙে গেছে। একে অপরিচিত জায়গা, আশেপাশে সব অন্ধকার। কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে বাড়ছে, মনে হচ্ছে কোনো ছেলে কাঁদছে। মেঘের মনে আতঙ্ক আর কৌতূহল দুটায় বাসা বেঁধেছে। ধীরে ধীরে শুয়া থেকে ফ্লোরে পা রাখতেই কোনো মানুষের পায়ে পা লাগলো ওমনি মেঘ লাফ দিয়ে উঠেছে ৷ তারপর মনে পড়লো রাকিব ভাইয়ার ২-৩ টা কাজিন রাতে এই রুমে শুয়েছিল। মেঘ ভয়ে ভয়ে রুম থেকে বের হলো৷ দুটা রুম পরে একটা রুমে আলো জ্বলছে সেটা সোফার রুম আর সেই রুম থেকেই কান্নার শব্দ আসছে। মেঘ বুক ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে পা বাড়ালো সেই রুমের উদ্দেশ্য।
যত এগিয়ে যাচ্ছে, পুরুষালী কন্ঠের কান্নার শব্দ তত বেশি তীব্র হচ্ছে। আশেপাশে দু একজনের চাপা স্বর ভেসে আসছে৷ মেঘ রুমের দরজায় দাঁড়াতেই চমকে উঠলো। ফুপ্পি সোফায় বসে আছেন, আবির ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে ফুপ্পির উরুতে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদছে। আবিরের একপাশে তানভির অন্যপাশে আসিফ ফ্লোরে বসে আবিরকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। ফুপ্পি আবিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আবির অঝোরে কাঁদছে। জান্নাত আশিফের পাশে সোফায় বসা। হঠাৎ দরজায় মেঘকে দাঁড়ানো দেখে জান্নাত হিমশীতল কন্ঠে ডাকল,
“মেঘ, তুমি এখানে?” মেঘের দৃষ্টি আবিরের পানে, মেঘের বুকের ভেতরটা ছলাৎ ছলাৎ করছে। আবির ভাইকে এভাবে কাঁদতে দেখে কাদম্বিনীর দম বন্ধ হয়ে আসছে, হৃৎস্পন্দন থেমে গেছে। জান্নাতের মুখে মেঘের নাম শুনে আবির সহ সবাই আঁতকে উঠল। মেঘ রুমে ঢুকতে ঢুকতে আর্তনাদ করে উঠল,
“কি হয়েছে ওনার?” আবির চোখ মুছে সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। আবিরের পেছন পেছন তানভিরও বেড়িয়েছে। মেঘ আবারও জিজ্ঞেস করল, “আবির ভাইয়ের কি হয়েছে, ফুপ্পি? ওনি কাঁদছিলেন কেনো?” ফুপ্পিও ভেতরে ভেতরে কাঁদছেন। আসিফ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ” তেমন কিছু হয় নি, এমনি খারাপ লাগছিল৷ তোমার না মাথা ব্যথা? যাও, ঘুমাও গিয়ে। ” মেঘ একবার ফুপ্পিকে দেখছে আবার আসিফ ভাইয়াকে দেখছে আবার জান্নাত আপুকে দেখছে। আসিফ আবারও বলল,
” ঘুমাতে যাও, মেঘ।” জান্নাতের চোখে চোখ পড়তেই সেও ইশারা দিলো। মেঘ আবারও এসে রুমে শুয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই ঘুম আসছে না। চোখের সামনে বার বার আবিরের কান্নারত মুখমণ্ডল ভেসে উঠছে৷ মনের আকাশ অমাবস্যার ন্যায় ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে, কোথাও এক বিন্দু আলোর ছিটেফোঁটাও নেই। আবির কেনো কাঁদছিল, কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না৷ বুকের ভেতর ভীষণ রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে। রুমে অফুরন্ত বাতাস থাকার স্বত্তেও মেঘ বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, মনে হচ্ছে কিছু একটা গলা চেপে ধরে আছে।
এপাশ ওপাশ হাসফাস করতে করতে মেঘ আবারও ঘুমিয়ে পরেছে। সকালে নাস্তা করেই আবিররা বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেছে। তানভির গাড়ি চালাচ্ছে আবির চোখ বন্ধ করে পাশের সীটে বসে আছে। মেঘ আবিরকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ খোঁজছে কিন্তু কোনোভাবেই পাচ্ছে না। আবির আর তানভির বাসায় এসে শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে দুপুরের দিকে আবারও বেড়িয়েছে। রুমে শুয়ে বসে কোনোভাবেই মন টিকছে না মেঘের । বন্যাকে কল দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেছে তবুও মন স্থির হচ্ছে না। মেঘ নিচে আসতেই আলী আহমদ খান জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমরা বিয়েতে যাও নি?” মেঘ আস্তে করে বলল, ” যেতে ইচ্ছে করছিল না।” “শরীর খারাপ? ” “নাহ।” আলী আহমদ খান মেঘকে খানিক দেখে মোলায়েম কন্ঠে বলল, ” কি নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করো?” মেঘ মৃদু হেসে বলল,
“দুশ্চিন্তা করি না বড় আব্বু। ” আলী আহমদ খান ধীর কন্ঠে বলল, “আম্মু, এক কাপ চা করে দিতে পারবে?” “এখনি নিয়ে আসছি। ” “আমি চিনি কম খায়। ” মেঘ মলিন হেসে বলল, ” জানি, বড় আব্বু।” মেঘ কিছুক্ষণের মধ্যেই এককাপ চা নিয়ে আসছে। আলী আহমদ খান এক চুমুক চা খেয়ে হেসে বললেন, “মাশাআল্লাহ, চা খুব ভালো হয়েছে।” মেঘ মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বলল, ” চা ভালো না লাগলে সত্যি কথা বলতে পারেন।আমি কিছু মনে করব না।” “বসো।”
মেঘ চুপচাপ পাশের সোফায় মাথা নিচু করে বসেছে। আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে বলে উঠলেন, ” শুনো, কোনোকিছু ভালো না লাগলে আমি যেমন সরাসরি বলতে পারি তেমন ভালো হলে প্রশংসাও করতে পারি৷ চা টা সত্যিই ভালো হয়েছে। তার থেকেও বড় বিষয় তোমার বড় আম্মুর সাহায্য ছাড়া তুমি প্রথমবার আমার জন্য এত ভাল চা করেছো,তারজন্য ধন্যবাদ। ” ” আপনাকেও ধন্যবাদ, বড় আব্বু। ” আলী আহমদ খান ধীর কন্ঠে শুধালেন, ” আম্মু, তোমার কি মন খারাপ?” বড় আব্বুর ধীর কন্ঠে বলা কথাতে মেঘের মন গলে গেছে৷ চোখ ছলছল করছে, মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। ঠোঁটে জোর করে ধরে রাখা মিথ্যা হাসিটা আর ধরে রাখতে পারছে না। মেঘ ঢোক গিলে শীতল কণ্ঠে বলল, “নাহ।”
মেঘ আর বসে থাকতে পারলো না। চিবুক নামিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের রুমে চলে গেছে। গত রাত থেকে অস্থির হয়ে থাকা মন টা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। আবির আর তানভির বেশ রাত করে বাসায় ফিরেছে ততক্ষণে সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আবির সকালে উঠেই কোথায় বেড়িয়েছে। আজ আবিরদের বাসার সবার দাওয়াত, মেঘ যেতে না চাইলেও সবার জোরাজোরিতে বাধ্য হয়ে যাচ্ছে। মেঘ দূর থেকে রিয়া আপুকে দেখছে। মেয়েটাকে জান্নাত আপুর বিয়েতে দেখেছিল তখন সে রাকিব ভাইয়ার প্রেমিকা ছিল আজ সে বউ বেশে বসে আছে। মেঘ মনে মনে আওড়াল, “পূর্ণতা পাওয়া ভালোবাসা গুলো একটু বেশিই সুন্দর। রাকিব ভাইয়ার ৭ বছরের ভালোবাসা আজ পূর্ণতা পেয়েছে৷ কত ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে ওনারা এক হতে পেরেছেন এটা শুধু ওনারাই জানেন। আমি তো এক বছরের পরিশ্রান্ত হয়ে গেছি, ৭ বছর ধৈর্য রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব। রাকিব ভাইয়া আর রিয়া আপু আপনাদের ভালোবাসা আজীবন বেঁচে থাকুক। ”
হঠাৎ মেঘের নজর পরলো রিয়া হাতের ইশারায় মেঘকে ডাকছে। মেঘ সহসা এগিয়ে গেল। রিয়া বসা থেকে উঠে মেঘকে জড়িয়ে ধরলো৷ আকস্মিক ঘটনায় মেঘ বেশ আশ্চর্য হলো। বিয়া শান্ত স্বরে বলল, ” আবির ভাইয়া হেল্প না করলে আমাদের বিয়েটায় হতো না৷ ভাইয়াকে অনেক ধন্যবাদ ।” মেঘ কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল, ” ওনার ধন্যবাদ আমাকে কেনো দিচ্ছেন?” রিয়া মৃদু হেসে বলল,
“ওনাকে তো জড়িয়ে ধরতে পারবো না তাই তোমাকে জড়িয়ে ধরলাম। ” রিয়া অপ্রতিভ কন্ঠে আবারও শুধালো, ” বাই দ্য ওয়ে, আবির ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরার অনুমতি কি তুমি কোনো মেয়েকে দিবে?” মেঘ সঙ্গে সঙ্গে চোখ গোল করে তাকালো, বুকের ভেতরের ক্রোধ টা দীর্ঘনিঃশ্বাস হয়ে বেড়িয়ে আসলো। ক্রোধিত কন্ঠে বলল, “নাহ।” রিয়া মেঘের দু গালে হাত রেখে মোলায়েম কন্ঠে জানতে চাইলো, ” আবির ভাইয়াকে খুব ভালোবাসো তাই না?” মেঘের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছে, দুচোখ ছলছল করছে। মেঘ সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। রিয়া ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,
” এই মেঘ, একদম কাঁদবে না। তোমার আবির ভাই দেখলে আমার সর্বনাশ করে ফেলবে। ” “কেনো?” রিয়া ঢোক গিলে নিজেকে সংযত করে বলল, “ভাববে আমি তোমাকে বাজে কথা বলেছি। ” মেঘ হুট করে প্রশ্ন করে বসলো, ” আপু, আবির ভাইয়া কোথায় জানেন? ওনার কি হয়েছে বলতে পারবেন?” ” কি হয়েছে সঠিক জানি না তবে ওদের কথোপকথন শুনে মনে হয়েছে ভাইয়া কোনো বিষয় নিয়ে খুব বেশি ডিপ্রেশনে আছেন। ” “কি বিষয়?”
“সেটা বলতে পারবো না গো। ওরা দুই বন্ধু এমন ধাতু দিয়ে তৈরি যা শেয়ার করবে না তা পেটে বো*ম্ব মারলেও বলবে না। তুমি সাবধানে থেকো, আর ভাইয়ার যত্ন নিও যদিও আমি জানি তুমি খুব কেয়ারিং। ” মেঘ কপাল গুটালো। এমন সময় রাকিব এসে বলল, ” কি ব্যাপার আমার অবর্তমানে আমাকে নিয়ে কি আলোচনা চলছে?” রিয়া ঠাট্টার স্বরে বলল, “আহ! আসছে আমার সেলিব্রিটি গো। তাকে নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। ” রাকিব সহাস্যে বলল,
” আমকে নিয়ে আলোচনা না করলে কি হবে আমার বন্ধুকে নিয়ে ঠিকই করেছো। বলো করো নি?” রিয়া ভেংচি কেটে বলল, “হ্যাঁ করেছি। তো?” “আমার বন্ধু সেলিব্রিটি হলে তার বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে আমিও সেলিব্রিটি। ” “ওহ আচ্ছা। এই নিয়ম কবে থেকে চালু হলো?” “আজ এই মুহুর্ত থেকে।”
মেঘ তাদের খুন শুঁটি দেখছে আর হাসছে। রাকিব হঠাৎ মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই মেঘ, তুমি তো কিছুই খেলে না, তাড়াতাড়ি খেতে যাও। আবির তোমার জন্য না খেয়ে উপরে অপেক্ষা করছে। ” মেঘ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “আবির ভাই কখন আসছেন?” “অনেকক্ষণ।”
মেঘ দ্রুত ছুটছে। রিয়া রাকিবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ” তুমি না কিছুক্ষণ আগে বলে গেলা ভাইয়া আসে নি। ” “আরে মাত্রই আসছে।” “তাহলে মেঘকে অনেকক্ষণ বললা কেনো?” “আবিরের প্রতি মেঘের এই উদগ্রীব টা দেখতে খুব ভালো লাগে। আবির বলতেই মেয়েটা অজ্ঞান।” রিয়া ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তোমরা দুই বন্ধু শুধু মেয়েদের কষ্টই দিতে পারো। মেয়েটা আবির ভাইয়ার জন্য এত পাগল তারপরও ভাইয়া কিছু বলে না কেন?”
“মেঘের এক বছরের ভালোবাসা দেখেই তুমি হতাশ অথচ আবির কতগুলো বছর যাবৎ নিজের সাথে নিজে লড়াই করে চলেছে সে বেলায়?” মেঘকে ছুটতে দেখে দেখে আবির কপাল গুটিয়ে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “এভাবে ছুটছিস কেন?” “আপনি কোথায় ছিলেন?” “একটু কাজ ছিল। খাস নি শুনলাম। কেনো? খিদে পায় নি?” “নাহ। ” আবির কপট দুষ্টামির স্বরে বলল,
“পেটের তিনভাগ যদি রাগ, জেদ আর অভিমানে ভরে থাকে বাকি একভাগে তো পানিই থাকে। তাহলে আর খিদা লাগবে কেন?” মেঘ ওষ্ঠ উল্টে বিড়বিড় করে বলল, ” মোটেই না।” ” সবাই খেয়েছে তুই খাস নি কেন?” “আপনি আসছিলেন না তাই।” ” কল দিয়ে বলছিলি একবার?” মেঘ চোখ পিটপিট করে তাকালো, ধীর কন্ঠে বলল,
” মনে ছিল না। ” আবির তপ্ত স্বরে বলল, ” বাহ! খুব ভালো। ” ঈদের বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আবিরদের অফিস শুরু হয়ে গেছে, ভার্সিটিও খুলে গেছে। রাকিব আর রিয়া হানিমুনে গেছে তাই আবিরের একা সবকিছু সামলাতে হচ্ছে। দুই অফিস সামলে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে আবির। এক বিকেলে মেঘকে কল দিল আবির। মেঘ কল রিসিভ করতেই আবির বলল, ” আমাকে দেয়ার মতো একটুখানি সময় কি হবে আপনার?” আবিরের আহ্লাদী কন্ঠে বলা কথা শুনে মেঘ মুচকি হেসে বলল, “কেনো হবে না? আপনি চাইলেই হবে।” “তাহলে রেডি হয়ে বের হন। ”
মেঘ রেডি হয়ে বের হতেই দেখলো একটা রিক্সা দাঁড়ানো। মেঘ আশপাশে আবিরকে খোঁজছে কিন্তু আবির কোথাও নেই। অনেকটা সামনে যেতেই দেখল আবির একটা গাছের নিচে দাঁড়ানো। মেঘ ডাকতেই রিক্সায় উঠে বসলো। মেঘ আবিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ” বড় আব্বু তো সেদিন আপনাকে বাইক চালানোর অনুমতি দিয়েছে তাহলে আপনার বাইক কোথায়?” “অফিসে।”
“রিক্সা দিয়ে কোথায় যাচ্ছি?” “দেখি কোথায় যেতে পারি। ” অনেকটা পথ গিয়ে দুজনেই রিক্সা থেকে নামলো। কোলাহল শূন্য একটা রাস্তা। হঠাৎ দু একটা গাড়ি আপন গতিতে ছুটছে। আবির মেঘকে নিয়ে একটা কালো রঙের নতুন ঝকঝকে প্রাইভেট কারের কাছে গিয়ে থামলো। আবির মৃদু হেসে প্রশ্ন করল, “গাড়িটা কেমন?” মেঘ নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বলল, ” ভালোই।” “পছন্দ হয় নি?” “কার না কার গাড়ি৷ আমি পছন্দ করে কি করবো?” আবির উদাস ভঙ্গিতে বলল, ” গাড়িটা আজ ই কিনেছি। কেমন হয়েছে?” মেঘের ভাবলেশহীন জবাব, ” আপনার সাথে ফাইজলামি মানায় না।” আবির ভ্রু গুটিয়ে বলল,
” আমি ফাইজলামি করতে যাব কেন? সত্যি সত্যি আমার গাড়ি। এই যে চাবি ” মেঘ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আবিরের হাতে থাকা চাবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে জানতে চাইল, ” আপনি গাড়ি কিনেছেন?” “জ্বি, ম্যাডাম। ” “কিন্তু কেন?” আবির ভারী কন্ঠে বলল, “গাড়ি পছন্দ হয়েছে কি না সেটা বল?” মেঘের গাড়ির দিকে মনোযোগ নেই। রাগী স্বরে বলল, ” গাড়ি আমি দুচোখে সহ্য করতে পারি না।” আবির মুচকি হাসলো। মেঘ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ” আপনার বাইক কোথায়?” “অফিসে। কেন?”
মেঘ কাঁদো কাঁদো মুখ করে আবারও শুধালো, ” আপনি গাড়ি কেনো কিনলেন?” আবির মৃদু হেসে বলল, ” মাঝে মাঝে নিজের অবস্থান বুঝাতে তীব্র অপছন্দের জিনিসকেও পছন্দের তালিকায় যুক্ত করতে হয়৷ ” মেঘ শীতল কণ্ঠে বলল, ” আপনি বাইক চালাবেন নাকি গাড়ি?” আবির মেকি স্বরে বলল, ” আমি বাইক চালাবো আর তুই গাড়ি। ” মেঘ স্ব শব্দে হেসে বলল, “আমি গাড়ি চালালে আপনার গাড়ি আহত হবে আর আমি নি…!”
আবির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই মেঘ মুখ বন্ধ করে ফেলেছে। আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “চল, ঘুরে আসি। ” মেঘ আবিরের পাশের সীটে বসে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির বাইক কেনাতে বাইকে উঠার জন্য মেঘ যতটা আগ্রহী ছিল, গাড়িতে উঠার জন্য সেই আগ্রহের এক অংশও নেই। ইট পাথরের শক্ত দেয়ালের মতোই খান বাড়ির প্রতিটা মানুষ পাষাণ হয়ে যাচ্ছে। সবাই সবার আপন হওয়া স্বত্তেও মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর মানবের ন্যায় আচরণ করে। আলী আহমদ খান একায় দুটা গাড়ি কিনেছেন, ইকবাল খান নিজের টাকায় আলাদা গাড়ি কিনেছেন, অবশেষে আবিরও গাড়ি কিনেছে। এ যেন প্রতিযোগিতা চলছে, নিজেদের অবস্থান যাচাই এর প্রবল প্রতিযোগিতা। আবির হঠাৎ ই মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” গাড়ি কিনেছি বলে রাগ করেছিস?” মেঘ মলিন হেসে বলল, ” নাহ, রাগ করি নি। আপনার ইচ্ছে হয়েছে তাই কিনেছেন এতে রাগ করার কি আছে?” মেঘ এবার ঠান্ডা কন্ঠে বলল, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি?” “হুমমম।” “রাকিব ভাইয়ার গায়ে হলুদের রাতে আপনি কাঁদছিলেন কেনো?” বেশকিছু সময় নিশ্চুপ থেকে আবির তপ্ত স্বরে বলল, ” নিজের করা ভ্রান্তিগুলো অতর্কিতে বুকের ভেতর প্রদীপ্ত আগুনের উত্তাপ সৃষ্টি করলে সহস্রবার চেষ্টার পরও নিজেকে অবিচল রাখা যায় না। ”
মেঘ কিছুই বুঝতে পারে নি তাই প্রতিত্তোরে কিছু বলতেও পারলো না। ঘন্টাখানেক মেঘকে নিয়ে ঘুরে অবশেষে রাস্তার একপাশে গাড়ি থামালো আবির। আশেপাশে অনেক মানুষ। মেঘ আবিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “আমরা এখানে কেনো আসছি?” এমন সময় মিনহাজ আর তামিম এগিয়ে আসছে। ওদের দেখেই মেঘ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমি এখানে থাকবো না।” আবির মেঘের হাত ধরে আঁটকে দিল। মিনহাজ আর তামিম এগিয়ে এসে কোমল কন্ঠে বলল, “সরি ভাই।”
আবির মৃদু হেসে দুজনের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল, “কোনো ব্যাপার না।” মেঘ রাগে কটমট করছে। আবির এত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে দেখে মেঘের আরও বেশি রাগ হচ্ছে। মিনহাজ আর তামিম আবিরের সাথে টুকিটাকি কথা বলছে। আর মেঘ ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। হঠাৎ কেউ একজন পেছন থেকে মেঘের চোখে ধরে, মেঘ চোখে হাত রেখে বুঝার চেষ্টা করল। আনমনেই বলল, “বন্যা?”
বন্যা চোখ ছেড়ে দিয়ে সামনে এসে বলল, “হ্যাঁ বেবি।” পেছন থেকে মিষ্টিরাও বেড়িয়ে আসছে। সবাইকে দেখে মেঘের মন আবারও খারাপ হয়ে গেছে। আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “মেঘ, যা হয়েছে সব ভুলে যা। একটা সময় পর পরিবার থেকেও বন্ধুরা আপন হয়। তুই এখন সেই সময়ে আছিস। সামান্য বিষয় নিয়ে রাগ করে থাকিস না, প্লিজ।” মেঘ রাগে ফোঁস করে বলল, ” ঐটা সামান্য বিষয় ছিল না আর আমার কোনো বন্ধুর প্রয়োজন নেই। ” আবির শান্ত স্বরে বলল,
” প্লিজ মেঘ, এত রাগ করে থাকিস না। ” মিষ্টি, মিনহাজ, তামিম কানে ধরে সরি বলছে। মেঘ তবুও মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। মেঘ রাগে কটকট করে বলল, “আপনি বাসায় না গেলে আমি একায় চলে যাব।” মিনহাজ আর তামিম কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, ” তোর পায়ে ধরলে মাফ করবি আমাদের?” মেঘ রাগী স্বরে বলল, “নাহ। তোরা তোদের মতো থাক আমি আমার মতো থাকবো।” আবির মেঘকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” আমি চাই না আমার কারণে তুই তোর বন্ধুদের সাথে এমনভাবে সম্পর্ক নষ্ট করে দেস। ঐটা শুধুই একটা এক্সিডেন্ট ছিল আর কিছুই না। ওখানে কারো দায় ছিল না বুঝার চেষ্টা কর। তুই নিজেকে আর কষ্ট দিস না, প্লিজ।” “আমি পারবো না৷ আমি ভুল করেছি আমি আমার ভুলের শাস্তি হিসেবে নিজেকে একা করেছি। আমি একায় থাকবো। ” আবির ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
” আমার কথা মানবি না?” মেঘ এবার থামলো। চোখ ছোট করে আবিরের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলল, ” আপনি ওদের সাথে মিশার জন্য এত জোর করছেন কেনো?” আবির মলিন হেসে বলল, ” জানি না। কিন্তু আমি চাই তুই ওদের সাথে আগের মতো চলাফেরা কর। তুই আমার কথা মানবি কি না বল?” মেঘ কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” আমি ওদের সাথে কথা বললে আপনি যদি খুশি হোন তাহলে আমি কথা বলবো।” “ধন্যবাদ।”
আবির সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। আড্ডা দেয়া শেষ হলে নিতে আসবে। মেঘরা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে শান্তশিষ্ট জায়গা দেখে বসলো। মিষ্টি উদগ্রীব হয়ে বলল, ” সরি মেঘ, আমাদের করা দুষ্টামি তে এত বড় বাঁশ খাবো ভাবতেই পারি নি। প্লিজ মাফ করে দে। ” তামিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আসলে আমাদের জায়গা থেকে যেটাকে ঠিক মনে হয়েছিল আমরা সেটায় করেছি কিন্তু আমাদের করা কাজটা যে ভুল ছিল সেটা বুঝতেই পারি নি।” বন্যা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” আমি বহুবার তোদের সাবধান করেছিলাম, তোরা আমার কথা পাত্তায় দেস নি। তোদের জন্য তানভির ভাইয়ার কাছে কত বক খেতে হয়েছে আমার। এর দায় কে নিবে?” মিনহাজ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ” আসলেই আমাদের সেদিন তোর কথা শুনা উচিত ছিল। একমাত্র তুই ই ঠিক ছিলি।” মিষ্টি বলে উঠল,
“বন্যা মেঘের ব্যাপারে বরাবর ই ঠিক থাকে, আমরাই বার বার ভুল প্রমাণিত হয়। আসলে আমরা মেঘের সত্যিকারের বন্ধু না। ডিপার্টমেন্টে পরিচয়, হয়তো ৪-৫ বছর একসঙ্গে পড়বো তারপর যে যার মতো সব ভুলে চলে যাব। কিন্তু বন্যা, সে কিন্তু সেই স্কুল জীবন থেকে মেঘের সাথে আছে। মেঘ কেমন, ওর ইচ্ছে, পছন্দ -অপছন্দ সবকিছু বন্যা সবচেয়ে বেশি জানে অথচ আমরা বন্যার কথা না শুনে নিজেরা মায়া দেখিয়ে উল্টো বিপদে পড়লাম।” তামিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “সত্যি ই বন্যার মতো বান্ধবী পাওয়া ভাগ্যের বিষয়।” মেঘ বলল,
” সেই ঘটনার পর আমিও বুঝেছি বন্যা ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধু নেই যে সত্যি ই আমার ভালো চাই।” মিষ্টি খানিক থেমে আবারও বলল, “এই মেঘ, বন্যা তো তোর বেস্টফ্রেন্ড তাই না?” “হুমমমম। একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। ছোট থেকে অনেক বান্ধবী হারিয়েছি কিন্তু বন্যা সবসময় আমার পাশে ছিল আর এখনও আছে। আল্লাহ বোধহয় চান আমরা সবসময় একসাথে থাকি।” বন্যা হেসে বলল,
“হ্যাঁ, এজন্যই তো দুজনে এক সাবজেক্টে চান্স পেয়েছি।” মিষ্টি মেঘের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল, ” মেঘ তুই চাইলে তোদের সম্পর্কটা সারাজীবন এমন রাখতে পারবি।” “কিভাবে?” মিষ্টি মোলায়েম কন্ঠে বলল, ” বন্যাকে তানভির ভাইয়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলে বন্যা তোর ভাবি হয়ে যাবে তাহলে তোদের সম্পর্ক আজীবন এমনই থাকবে, ইনশাআল্লাহ।” বন্যা চেঁচিয়ে উঠলো,
” জীবনেও না, পা*গলের মতো কথা বলিস না।” মেঘ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলল, “সত্যি ই তো। আমি এটা কোনোদিন ভাবি নি কেনো?” মেঘ বন্যার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
” বেবি তুমি কি আমার ভা…….’ বন্যা মেঘের মুখ চেপে ধরে রাগী স্বরে বলল, ” আপনি যাকে অফারটা দিচ্ছেন সে আপনার তাড় ছিঁড়া অফার শুনার জন্য একদম প্রস্তুত নয়, সরি।”