সালমা চৌধুরী
সালমা চৌধুরী

প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | অপ্রকাশিত প্রেম

৪৮ ভিউ
০ মন্তব্য
১ মিনিট

মীমের মুখে অকল্পনীয় কথাটা শুনতেই আবিরের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছে অকস্মাৎ মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেছে,নিঃশ্বাস আঁটকে আছে গলায়, শ্বাসনালীতে তুফান। মুহুর্তের মধ্যে চোখের শিরা উপশিরা রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে, বক্ষস্পন্দন বেড়ে আকাশ ছোঁয়ার পথে। আবির নিজের সর্বোচ্চ অনুবলে মেঘকে যতই আগলে রাখতে চাইছে প্রতিনিয়ত ততই বিপাকে পড়ে যাচ্ছে। মেঘের মুখে নিরন্তর হাসি ফুটাতে আবির নিজের সাথে একের পর এক নিগূঢ় বিগ্রহ করেই চলেছে তারপরও কোনো কিনারা পাচ্ছে না। কন্ঠস্বরে তেজ ঢেলে আবির শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” মেঘ কোথায়?” ” আম্মুরা সবাই আপুর রুমে বসে আছে আর আপুকে সাজুগুজু করতে বলছে কিন্তু আপু চুপচাপ বসে আছে। ” আবির চোখ বন্ধ জোরে শ্বাস টেনে পরপর সর্বশক্তি দিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে নিরূদ্ধ করার চেষ্টা করলো। অতঃপর নিরেট কন্ঠে বলল, ” ওকে বলিস সাজুগুজু করতে হবে না আর দেখিস ঐদিনের মতো কান্নাকাটি যেন না করে। আমি দেখছি।” মীম আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,


” আপনি এখন বাসায় আসলে সমস্যা হবে।” আবির অদম্য কন্ঠে বলল, “বাসায় আসবো না। শুন, তোর দায়িত্ব হলো যত দ্রুত সম্ভব তুই ছেলের বাবার নাম টা জেনে আমায় কোনোভাবে টেক্সট করে জানাবি।” মীম শীতল কণ্ঠে বলল, ” আচ্ছা। ”

আবির কল কেটে দিয়েছে। মীমের সাথে আবির শান্ত স্বরে কথা বলেছে ঠিকই কিন্তু আবিরের ভেতর টা রাগ আর দুশ্চিন্তায় ফেটে যাচ্ছে। মেঘ বাসায় অল্প সাজুগুজু করলেই আবিরের কলিজায় আঘাত লাগে, নিজের দৃষ্টি সামলে একের পর এক দোয়া পড়তে থাকে যাতে মেঘের উপর শয়*তানের কুনজর না পড়ে। সেখানে কোথাকার কোন পরিবার মেঘকে দেখতে আসবে এটা আবির বেঁচে থাকতে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারবে না।

তানভিরকে কল দিতে দিতে আবির দ্রুত অফিস থেকে বেড়িয়ে গেছে। রাকিব, রাসেল কারো সাথেই দেখা হয় নি। এদিকে মেঘ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে, আশেপাশে আম্মু, বড় আম্মু, কাকিয়া সবাই মেঘকে বুঝাচ্ছে, রেডি হতে বলছে। মেঘের সেসবে মনোযোগ নেই, আজ মেঘের চোখে এক ফোঁটা পানিও নেই। সেদিন প্রথমবারের মতো কেউ বা কারা দেখতে আসবে কথাটা শুনে মেঘ নিজেকে শান্ত রাখতে পারে নি তারউপর আবিরের উদাসীনতা মেঘকে আরও বেশি কাঁদিয়েছিল৷ কিন্তু রাতের বেলা আবিরের কথা শুনে মেঘ সবটায় বুঝেছিল আর নিজেই নিজেকে বকেওছিল। তাই আজ মেঘের মনে আতঙ্কের রেশ মাত্র নেই, দিব্যি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আঙ্গুর খাচ্ছে। হালিমা খান চাপা স্বরে বললেন,

“এই মেঘ, আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবি? উঠে রেডি হ৷ ওনারা কখন জানি চলে আসেন। তখন তোর আব্বু রাগারাগি করবে।” মেঘ স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল, ” আম্মু, আমি শান্তি করে খাচ্ছি এটা কি তোমার সহ্য হচ্ছে না?” “সহ্য হবে না কেন? তুই রেডি হস নি শুনে তোর আব্বু যে চিল্লাচিল্লি করবে। তখন আমি কি করব? ওনারা চলে গেলে না হয় আবার খাইস। ” আকলিমা খান শান্ত স্বরে বললেন,

” তোমার আব্বু আর বড় আব্বুকে তো চিনোই। সময়ের কাজ সময়ে না হলে মেজাজ গরম হয়ে যায়।” এমন সময় মীম রুমে আসছে, নিচে আব্বু চাচ্চুর কথোপকথনে ছেলে আর তার বাবার নাম শুনে আম্মুর নাম্বার থেকে আবিরকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে অতঃপর উপরে আসছে। আলী আহমদ খান বাসায় নেই, ইকবাল খানকে আকলিমা খান জানানোর পরপর ই তিনি বাসায় চলে আসছে। মোজাম্মেল খানকে বার বার বুঝানোর চেষ্টা করছেন। অথচ মোজাম্মেল খান কিছু বুঝতেই চাইছে নাম। আবিরকে কল দিয়ে বললে আবির উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলবে এই ভয়ে ইকবাল খান নিজেই বুঝানোর চেষ্টা করছেন। মীম মেঘের রুমে ঢুকতেই মেঘ খাওয়া বন্ধ করে চোখ তুলে তাকালো, সহসা মীম চোখের ইশারায় আবিরকে জানানোর কথাটা বুঝিয়ে দিয়েছে। মেঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আম্মুদের দিকে এক পলক তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, ” তোমরা থামো। আগে ওনারা আসুক তারপর আমি সাজবো।”

মালিহা খান শান্ত স্বরে মেঘকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু মেঘের এক কথা, দেখতে আসলে তবেই সে সাজবে। এমনকি তাদের দেখানোর জন্য মেঘ সবকিছু রেডিও করে রেখেছে৷ ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাসায় মেহমান আসছে না। মালিহা খান আর আকলিমা খান মেঘের রুমে বসে আছেন তবে সেদিকে মীম, মেঘের কোনো মনোযোগ নেই। মীম মেঘের উপর হেলান দিয়ে শুয়ে তার স্কুলের গল্প করছে আর মেঘ মীমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর গল্প শুনছে। মোজাম্মেল খান আর ইকবাল খান অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন কিন্তু কেউ ই আসছে না। প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো জ্যামে আঁটকে আছে এজন্য কল দেন নি কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে একপ্রকার বিরক্ত হয়ে কল দিলেন সেই লোকের নাম্বারে। প্রথমবারেই কল রিসিভ হলো। মোজাম্মেল খান তপ্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনারা কোথায় আছেন?” লোকটা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ” আমি অফিসে আছি। ” মোজাম্মেল খান বিরক্তভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ” আমাদের বাসায় আসার কথা কি ভুলে গেছেন?” লোকটা ঢোক গিলে কিছুক্ষণ থেমে অতঃপর বললেন, ” নাহ ভাই ভুলি নাই কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গেছে।” “কি সমস্যা? ”

লোকটা আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। মোজাম্মেল খান এবার হালকা রাগী স্বরে বললেন, ” কি হলো?” “আসলে ভাই কিভাবে বলল, আমার ছেলে অন্য এক মেয়েকে পছন্দ করে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না বলছে। তাই শুধু শুধু… ” মোজাম্মেল খান রাগে কটমট করে বললেন, ” আপনার ছেলে অন্য কাউকে পছন্দ করে কি না সে কথা কি আগে জানা উচিত ছিল না? আর সেদিন আপনার ছেলে তো সামনেই ছিল, আপনারা আগ্রহ না দেখালে আমি তো আপনাদের কখনোই জোর করতাম না। ” লোকটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বললেন,

” আমাদের মাফ করে দিবেন ভাই আর পারলে দোয়া করবেন। ” মোজাম্মেল খান রাগে কল কেটে দিয়েছেন। নিজে দায়িত্ব নিয়ে বাসায় এত এত আয়োজন করিয়েছেন সেখানে তারা আসবে না এটা তিনি মানতেই পারছেন না। আগের বার তানভিররা কিছু একটা করেছিল ভেবে এবার আবির তানভিরকে কিছু জানান ই নি। অথচ এবারও একই সমস্যা। মোজাম্মেল খান মনে মনে ভাবছেন, “ছেলের যদি অন্য কোথাও পছন্দই থাকতো তাহলে সেদিন আমার মেয়ের ব্যাপারে এত আগ্রহ দেখিয়েছিল কেন? আমার মেয়েকে দেখার জন্য এত উতলা হয়ে গেছিল কেন?” ইকবাল খান মিটিমিটি হেসে বললেন,

” থাক ভাইয়া, মন খারাপ করো না।” মোজাম্মেল খান ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছেন, চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন।ইকবাল খান উপরে গিয়ে মেঘের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমরা যে যার রুমে যাও, ওনারা আসবেন না। ” মালিহা খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন, ” আসবেন না কেন?” “ছেলের অন্য কাউকে পছন্দ। ” মেঘ ফিক করে হেসে ফেলল, মেঘের দেখাদেখি মীম ও হাসছে৷ মালিহা খান রাগী স্বরে বললেন, ” এই মেঘ হাসছিস কেন?” আবারও বললেন,

“তোর আব্বু কোথায় কি ছেলে দেখে বলতো? আগের বার কি সব অজুহাত দেখালো এবার বলে ছেলে অন্য মেয়েকে পছন্দ করে৷ সকালেও তো শুনলাম ছেলে তোকে দেখার জন্য খুব আগ্রহী৷ এখন এসবের মানে কি?” মেঘ বড় আম্মুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মনে মনে আওড়ালো, ” শ্বাশুড়ি আম্মু, ঐ ছেলের আমাকে দেখার আগ্রহ থাকলে কি হবে তোমার ছেলের তো বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তোমার ছেলে সবার সামনে যতই স্বাভাবিক থাকুক না কেন আড়ালে ঠিকই আমাকে নিয়ে ভাবে। আর আমি সিউর ঐ ছেলের গার্লফ্রেন্ড আজই আবিষ্কৃত হয়েছে আর সেটা তোমার ছেলেই করেছে। ”

মালিহা খান শীতল কণ্ঠে বললেন, “কিরে কি ভাবছিস? ওনারা আসে নি বলে মন খারাপ করছিস?” মেঘ স্ব শব্দে হেসে বলল, ” নাহ গো৷ আমি ভাবছি তোমরা কত কষ্ট করে সারাদিন রান্না করলে এই খাবারগুলো কিভাবে খেয়ে শেষ করবো। ” মালিহা খান আর আকলিমা খান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। ইকবাল খান নিঃশব্দে হেসে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছেন। মেঘ মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” আমার ফোনটা দে তো, ভাইয়া আর আবির ভাইকে কল দিয়ে আসতে বলি, একসাথে খাবো। ” মীম ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে ফোন এনে মেঘকে দিল৷ মেঘ তানভির আর আবির দুজনকেই কল দিয়েছে তবে ছেলের ব্যাপারে কিছু বলে নি শুধু খাবার খেতে দাওয়াত দিয়েছে। মেঘের ফাজলামো দেখে মালিহা খান আর আকলিমা খান দুজনেই চুপচাপ বেড়িয়ে গেছেন। ওনারা চলে যেতেই মেঘ আর মীম নিজেদের মধ্যে ফিসফিস শুরু করে দিয়েছে।

সন্ধ্যের আগে আগে আবির বাসায় আসছে। পড়নে ছাই রঙের শার্টের হাতা কনুই অব্দি ফোল্ট করা, বুকের উপরের বোতাম টা খুলা, চুলগুলো অগোছালো, শ্যাম বর্ণের চেহারা ঘামে চিকচিক করছে, এক হাত পকেটে, অন্য হাত স্বাভাবিক রেখে বাসার ভেতরে ঢুকছে। সোফায় মোজাম্মেল খান বসে আছেন, ওনার পাশেই হালিমা খান দাঁড়িয়ে আছেন।মোজাম্মেল খান অতর্কিতে নিজের মনের ভেতরের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন আর হালিমা খান চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেসব শুনছেন৷ মালিহা খানরা যে যার রুমে, ইকবাল খান একটা কাজে বেড়িয়েছেন। আবির স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে গেল। এক পলক মামনির দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলল,

” মামনি, এককাপ কফি করে দিবা প্লিজ?” হালিমা খান আবিরকে খানিক দেখে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তুই ফ্রেশ হয়ে নে, আমি কফি বানিয়ে পাঠাচ্ছি।” “পাঠাতে হবে না। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতেছি।” আবির সচরাচর নিজের কফি নিজেই করে, সকালে মাঝে মধ্যে মালিহা খান নয়তো হালিমা খান করে দেন। আজ মূলত মোজাম্মেল খানের জন্যই অসময়ে মামনির কাছে কফি চাইছে আবির যাতে মোজাম্মেল খানের চিল্লাচিল্লি টা কমে। আবির দুটা সিঁড়ি উঠতেই মোজাম্মেল খান আড়চোখে আবিরকে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

” কোথায় ছিলে?” আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “অফিসে। কেনো?” “তানভির কোথায়?” আবিরের ভাবলেশহীন জবাব, “আমি কি জানি!” মোজাম্মেল খান সূক্ষ্ম নেত্রে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আবির মৃদু হেসে বলল, “আমি কি যাব, চাচ্চু?” “যাও।”

হালিমা খান কফি করতে রান্নাঘরে চলে গেছেন। মোজাম্মেল খান সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। আবিরের কথা বার্তা খুব স্বাভাবিক, সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ে নি। তানভির জানলে এতক্ষণে সে অবশ্যই রিয়েক্ট করতো, অথচ তানভিরও এখন পর্যন্ত শান্ত। সারাদিন বাসায় ফেরে নি, বাসার কারো সাথে ফোনে কথা বলতেও তিনি দেখেন নি। তারমানে তানভিরও কিছু জানে না। মোজাম্মেল খান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললেন, “তানভির, আবির কিছু না জানলে এমনটা হলো কিভাবে? তাহলে কি সত্যিই ঐ ছেলের অন্য জায়গায় পছন্দ আছে? ”

আবির কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে শার্ট পাল্টিয়ে টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ে নিচে আসছে। মোজাম্মেল খান তখনও সোফায় বসা। তাই আবির সোফায় না বসে সরাসরি রান্নাঘরে চলে গেছে, কফির কাপ নিতে নিতে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ” কিছু হয়েছে নাকি?” হালিমা খান তপ্ত স্বরে বললেন, “নাহ। তেমন কিছু না। ”

মোজাম্মেল খানের কড়া নিষেধ আবির কিংবা তানভিরের সামনে মেঘের বিয়ে সম্পর্কিত কোনো আলোচনা যেন না হয়। আবির সবটায় জানে তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। আবির মোজাম্মেল খানকে খানিকক্ষণ পরখ করে শক্ত কন্ঠে বলল, ” চাচ্চুকে অতিরিক্ত টেনশন করতে বারণ করো৷ মেয়ের বিয়েই হলো না এখনি চুল পাকিয়ে ফেলতেছেন। লোকে কি বলবে? ”

আবিরের দুষ্টামী বুঝতে পেরে হালিমা খান মৃদু হেসে বললেন, ” আমাকে বলছিস কেনো? তুই গিয়ে বল।” আবির হাতে কফির কাপ নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে ডাকলো, “চাচ্চু।” মোজাম্মেল খান আবিরের দিকে সরাসরি তাকিয়ে আস্তে করে বললেন, “বলো। ” আবির ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল,

” মামনি বলতেছে আপনার চুল নাকি পেকে যাচ্ছে। আপনাকে এখন আর আগের মতো ভালো লাগে না। ” মোজাম্মেল খান অনচ্ছ হেসে বললেন, ” তাই নাকি?” এরমধ্যে হালিমা খান রান্নাঘর থেকে তেড়ে এসে আবিরের হাতে আস্তে করে থা*প্প*ড় দিয়ে বললেন, ” এই ফাজিল, আমি কখন এই কথা বললাম?” আবির অনিশ্চয়তার স্বরে জবাব দিল, “তুমি মনে মনে ভাবছিলে। ঐটাই চাচ্চুকে জানালাম।” হালিমা খান রাগী রাগী মুখ করে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ মোজাম্মেল খান আবির আর হালিমা খান দুজনকেই কিছুক্ষণ দেখে গুরুভার কন্ঠে বলল,

” তাহলে আমার এখন কি করতে হবে?” আবির ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে বলল, “সবসময় হাসিখুশি থাকবেন, সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবেন। নিজেকে সময় দিবেন সাথে মামনিকেও ৷ বাকিটা মামনি বলবে, আমি এখন পালায়” আবির টেবিলের উপর কাপ রেখে সিঁড়ি দিকে ছুটছে। মোজাম্মেল খান ঠোঁটে অস্পৃশ্য হাসি রেখেই হালিমা খানের দিকে তাকালেন। আবিরের অকপটে বলা কথাগুলো হালিমা খানের মনের অন্তরালে লুকানো অব্যক্ত অনুভূতি। হালিমা খান স্বচ্ছ দৃষ্টিতে আবিরের দৌড় দেখছেন৷ ২-৩ সিঁড়ি ফাঁক দিয়ে দিয়ে দ্রুত উঠছে ছেলেটা, ওর উপরে ওঠার তাড়া দেখে মনে হচ্ছে,

“সবেমাত্র কাউকে আ*হত কিংবা নি*হত করে আসছে। ” আশপাশের মসজিদে মাগরিবের আজান পড়ছে। মোজাম্মেল খান বসা থেকে উঠে উচ্চ স্বরে ডাকল, “আবির, নামাজে যাবে না?” আবির নিজের রুমে যেতে যেতে বলল, “টুপি নিয়ে আসছি।”

মোজাম্মেল খান ওজু করে আবিরের জন্য অপেক্ষা করছেন, আবিরও ওজু করে মাথায় টুপি দিতে দিতে নিচে আসছে। বাসায় আর কেউ নেই তাই আবির আর মোজাম্মেল খান একসঙ্গে নামাজের জন্য বেড়িয়েছেন। মোজাম্মেল খান যেতে যেতে হঠাৎ ই গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তানভির কি নামাজ পড়ে? ফজরে না হয় উঠতে পারে না বাকি ওয়াক্ত কি পড়ে?” আবির নিরুদ্বেগ কন্ঠে বলল, ” আমি সমসময় নামাজের কথা বলি কিন্তু বাহিরে ঠিকমতো নামাজ পড়ে কি না জানি না।” মোজাম্মেল খান ভারী কন্ঠে বললেন, ” তুমি একটু বুঝিয়ে বলো৷”

মোজাম্মেল খানের ভারী কন্ঠে বলা কথাতে আবির কপাল কুঁচকালো৷ মোজাম্মেল খানের মস্তিষ্কে যখন যা আসে তাই। এতক্ষণ মেঘের ব্যাপারে ভাবছিল এখন সেই ভাবনায় এসেছে তানভির, তাও আবার তানভিরের নামাজ নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন। আবির মনে মনে আওড়ালো, ” তানভিরকে নামাজে নিয়মিত করার ঔষধ আমার জানা আছে। খুব শীঘ্রই ঔষধ দিতে হবে।” মোজাম্মেল খানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আবির বলল, ” আপনি চিন্তা করবেন না, ফজর থেকে তানভিরও আমাদের সাথেই নামাজে যাবে।” “দেখো, যদি উঠাতে পারো।” আবির মুচকি হেসে বলল,

” প্রয়োজনে সারারাত না ঘুমিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে একেবারে ঘুমাবে।” মোজাম্মেল খান আবিরের কথা শুনে ক্ষীণ হাসলেন। নামাজ শেষে অফিসের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে বাসায় আসছে দুজন। ততক্ষণে মেঘরা সবাই নামাজ শেষ করে নিচে চলে আসছে। তানভিরও বাসায় ফিরেছে। চার ভাই-বোন মিলে সিরিয়াস কোনো আলোচনায় ব্যস্ত তবে সেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো খাবার। আবির আর মোজাম্মেল খানকে একসঙ্গে বাসায় ঢুকতে দেখে তানভির ভ্রু কুঁচকালো। সচরাচর সবাই একসঙ্গে নামাজে গেলে আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খান সামনে গল্প করতে করতে চলে যান, পেছনে আবির, তানভির আর ইকবাল খান টুকাটুকি কথা বলে৷ তানভির না থাকলে আবির আর ইকবাল খান একসঙ্গে যান। তবে এই প্রথমবার বাসায় কেউ না থাকাতে আবির আর তানভিরের আব্বু একসঙ্গে বাসায় আসছে তবুও এমন একটা দিনে। আবিররা আসতেই মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে আবিরকে দেখে নিল, আবিরের মাথায় টুপি, সাবলীল ভঙ্গিতে আব্বুর সাথে কথা বলছে তা দেখে মেঘের হৃদয়ের ধুকপুকানি তীব্র হতে শুরু করেছে। মালিহা খান খেতে ডাকছেন তাই আলী আহমদ খান আর ইকবাল খান ব্যতীত বাকি সবাই গিয়ে খেতে বসেছে। রাকিবের নাম্বার থেকে তানভিরের ফোনে বার বার কল আসতেছে। তানভির রিসিভ করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

” হ্যাঁ রাকিব ভাইয়া,বলো।” “আবির কোথায় রে?” “আছে পাশেই। খেতে বসছে।” “আবির বিকালে কাউকে না বলে হুট করে অফিস থেকে চলে গেছে। তারপর থেকে কল ধরছে না। কি হয়ছে? সবকিছু ঠিক আছে?” ” হ্যাঁ একদম। ভাইয়ার ফোন রুমে, মাত্র নামাজ থেকে এসে খেতে বসেছে।” “তাহলে অফিস থেকে হুট করে চলে গেছিলো কেনো?” “খাওয়াদাওয়া শেষ করি তারপর তোমার সাথে দেখা করে বলব। ” “আচ্ছা ঠিক আছে। ”

সবাই সবার মতো খাচ্ছে। কারো মুখেই প্রয়োজনের বাহিরে কোনো কথা নেই। তানভির একটু পর পর আবিরকে ইশারায় এটা সেটা বুঝাচ্ছে আবার প্রশ্নও করছে তবে মোজাম্মেল খান তাকালেই চুপ হয়ে যায়।খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবির আর তানভির বেড়িয়েছে যদিও আবির যেতে চাচ্ছিলো না কিন্তু তানভির একপ্রকার জোর করেই নিয়ে গেছে।

রাকিব আর রাসেল অফিস থেকে বেড়িয়ে প্রতি সপ্তাহের সেই সুপরিচিত আড্ডাখানায় আবিরদের জন্য অপেক্ষা করছে। আবির এসেই চুপচাপ বসে পরেছে, মালিহা খান জোর করে একটু বেশিই খাইয়েছেন তাই এত নড়াচড়া করতে ভালো লাগছে না। এমনকি আবির বাইকও নিয়ে আসে নি। তানভিরের বাইকে এসেছে। রাকিব আবিরকে দেখেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কিরে কি হয়েছে তোর? অফিস থেকে কোথায় চলে গেছিলি?” আবির ঠান্ডা কন্ঠে বলল, ” আজ ও কে আবার দেখতে আসার কথা ছিল।” রাকিব চেঁচিয়ে উঠল, “কি? তারপর?”

এরমধ্যে তানভির বাইক পার্ক করে চলে আসছে। এসেই রাকিবের সামনে রাখা একটা চেয়ারের উপর নিজের ডান পা তুলে, ডানহাতের তিন আঙুল ভাঁজ করে বাকি দুই আঙুল রাকিবের কপালের কিছুটা উপরে মাথায় ধরে রাগান্বিত কন্ঠে চিৎকার করল,

” হারামীর বাচ্চা, বিয়ে করার খুব শখ তোর? তাও আবার আমার Sparrow কে? বিয়ে তো বহু দূর তুই আমার মেঘকে কল্পনাতেও দেখতে পারবি না।”



পর্ব - ৫৮(২)

তানভিরের গতিবিধি দেখে রাকিব থ হয়ে গেছে,চা বিক্রেতা মামাও আঁতকে উঠেছেন। আশেপাশের কয়েকজন বিস্ময় সমেত তাকিয়ে আছে। আবির চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মিটিমিটি হাসছে। রাকিব ঢোক গিলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তানভির বাজখাঁই কন্ঠে আবারও বলে উঠল,


” Don’t say anything. I don’t want to hear anything from your mouth. যদি তোর মুখ থেকে একটা শব্দ বের হয় তবে তোর বাপ এখানে এসে শুধু তোর লা**শ টায় পাবে।” রাকিব নিষ্পলক দৃষ্টিতে তানভিরের ক্রোধিত চেহারার পানে চেয়ে আছে। তানভিরের চোখে মুখে হাসি উপচে পড়ছে তবুও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে। রাসেল অবাক চোখে সে-সব দেখছে। অকস্মাৎ রাকিব হাসতে শুরু করলো, তানভির তখনও রাগী লুক করে চেয়ে আছে। আবির গুরুভার কন্ঠে বলল, ” তোর নাটক দেখানোর জন্যই জোর করে আমায় নিয়ে আসছিস, তাই না?”


“চিন্তা করিস না, সেরা অভিনেতার পুরস্কার এবার তুই ই পাবি।” ওদের হাসি দেখে তানভির নিজের হাসি আঁটকে রাখতে পারলো না। হাসতে হাসতে রাকিবের মাথা থেকে হাত সরিয়ে, চেয়ার থেকে পা নামিয়ে টিস্যু দিয়ে চেয়ার টা মুছে বসলো। শুকনো গলায় ঢোক গিলে আহত স্বরে বলল, ” ইসস, থামালে কেন আমাকে?” রাকিব তখনও হেসেই যাচ্ছে। হাসি কিছুটা কমিয়ে বলল, “পেছনে তাকিয়ে দেখ, মানুষ যেভাবে তোকে দেখছে মনে হচ্ছে পুলিশ আসতে বেশি দেরি নেই। ” তানভির অকস্মাৎ পেছন ফিরে তাকালো। প্রায় ১৫-২০ জন লোক দাঁড়ানো, দৃষ্টিতে আতঙ্ক । তানভির থতমত খেয়ে বলল,


” এ ভাই, আমি কিছু করি নাই।” লোকজন এখনও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। তানভির ভ্রু কুঁচকে উষ্ণ স্বরে বলল, ” বিশ্বাস করুন আমি কিছু করি নি। দেখুন, আমার হাতে কিচ্ছু নাই।” আবির আর রাকিব হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। চা বিক্রেতা মামা মৃদুস্বরে বললেন, “আরে কোনো সমস্যা নাই। ওরা সবাই ভাই ভাই, এমনিতেই মজা করছে। আপনারা যান।” আস্তে আস্তে মানুষ চলে যাচ্ছে, যেতে যেতেও বার বার তানভিরকে দেখছে৷ কয়েকজন এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তানভির তাদের দেখে বিড়বিড় করে বলল,


” আমাকে দেখেই এত ভয় পাচ্ছে ভাবছি ভাইয়াকে দেখলে তাদের কি হতো!” রাসেল চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ” আবির কি আজ নিজের রূপ দেখিয়েই ফেলছে? মিনহাজদের ঘটনায় আমি কত কষ্টে আবিরকে আটকাইছিলাম তারপরও পারলাম না। সেই তো গিয়ে এক্সিডেন্ট করলো। ” রাকিব শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “আবির কি এভাবেই হুমকি দিছিলো, তানভির?” তানভির মেকি স্বরে বলল, “দূর! এটা তো শুধু ট্রেইলার ছিল।”


রাকিব আর রাসেল বিস্ময়কর দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ” আমাকে এভাবে দেখার কি আছে? ” “দেখছি তুই ঠিকঠাক আছিস কি না! ” “আমার আবার কি হবে?” “নাহ। কিছু না। তা এভাবে আর কতদিন?” “জানি না।” রাকিব ঠাট্টা কন্ঠে বলল, ” তোদের জন্য প্রতিনিয়ত আমার সংসারে ঝগড়া হয় ” আবির ভ্রু কুঁচকে বলল, ” আমরা কি করলাম?”


“তুই কি করিস নাই। মেঘকে তুই ইচ্ছে করে কষ্ট দিচ্ছিস, মেঘের ভালোবাসা বুঝতেছিস না। সেদিন তো রিয়া রাগে বলতাছে মেঘকে তার কোন কাজিনের বউ করে নিয়ে যাবে।” আবির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” রাকিব তোর বউকে সামলে রাখিস। উল্টাপাল্টা কথা বললে তোর বউকে মে* রে তোকে বিপত্নীক করে ফেলবো।” রাকিব মৃদুস্বরে বলল, “এমন করিস না ভাই। আমার একটায় বউ।” তানভির স্ব শব্দে হেসে বলল,


” তোমাদের তো একটা হলেও আছে অন্তত বলতে পারো, সে আমার। এদিকে আমার যে একটাও নেই।” আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” থাকবে কিভাবে নির্বোধের মতো কোথাকার কোন মেয়ের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার সময় মনে ছিল না? খোঁজ খবর না নিয়ে ধুম করে প্রেমে পড়ে গেছে৷ আসছে আমার প্রেমিক পুরুষ। ” তানভির মন খারাপ করে বলল, ” তখন না হয় আমি নির্বোধ ছিলাম। এখন তো বোধ হয়েছে আমার৷ আর ঠিকঠাক কাউকে পছন্দও করেছি। তাহলে তাকে কেন পাচ্ছি না?” আবির শক্ত কন্ঠে বলল,


“নামাজ পড়িস কয় ওয়াক্ত? আল্লাহ র কাছে কতবার তাকে চাস?” “মাঝে মাঝে চাই।” “তাহলে আর কি, মাঝে মাঝেই আসবে।” তানভির কপাল গুটিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। আবির ভারী কন্ঠে বলল, ” দেখ তানভির, তুই ফজর থেকে আমার সাথে নামাজে যাবি। কাল থেকে যদি এক ওয়াক্ত নামাজ মিস করিস তাহলে তোর না হওয়া প্রেমিকার কাছে তোর নামে অপপ্রচার করবো।” তানভির নিরেট কন্ঠে বলল, “কি?” আবির খানিক হেসে বলল,


“তাছাড়া আমি আমার শ্বশুর আব্বাকে কথা দিয়েছি। সেই কথা তো আমার রাখতেই হবে। প্রয়োজনে তোকে কানে ধরে নিয়ে যেতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। ” তানভির ঠাট্টার স্বরে বলল, ” বাহ! শ্বশুর কে পটানোর ধান্দা নাকি?” আবির নিঃশব্দে হাসলো। রাকিব তানভিরের দিকে তাকিয়ে বলল, ” ঐ খানের ঝামেলা সমাধান হয়েছে? নাকি বেঁধে রেখে আসছিস?” “ভাইয়া গেলে বাঁধার প্রয়োজন পড়ে না। সবকিছু একদম সমাধান করেই আসছি৷ ” রাসেল বলল, ” ঝামেলা কি বেশি হয়ছিল?”


“তোমরা তো ভাইয়াকে চিনোই। বনুর ব্যাপারে সামান্যতম বিষয়েই যে পরিমাণ ক্ষিপ্ত হয় সেখানে বনুর বিয়ের বিষয় উঠে গেছে। কি হতে পারে ভাবো! সিচুয়েশন এতই খারাপ হয়ে গেছিলো যে হয় এসপার নয় উসপার হয়েই যেতো। তখন ছেলের বাবা আসছে, ঐ অবস্থায় ছেলেকে বাঁচাতে ডিরেক্ট ভাইয়ার পায়ে ধরতে ফেলতেছিল। তারপর তাড়াতাড়ি সরিয়ে সবকিছু মোটামুটি নরমাল করেছি এমন সময় আব্বু কল দিয়েছে। তখন আর কি, ভাইয়া যা যা শিখিয়ে দিয়েছে ওনিও তাই তাই বলছে৷ এইসবই। ” রাকিব তপ্ত স্বরে বলল,


” আমাকে একটা কল দিতে পারতি। ” ” আমি নিজেও জানতাম না। ভাইয়া আমায় ঠিকানা দিয়ে শুধু আসতে বলেছে।” আবির ঠান্ডা কন্ঠে বলল, “সেসব কথা বাদ দে। এখন বল কাজটা শেষ হয়েছে?” রাকিব ধীর কন্ঠে বলল, “আমি যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি তুই রাতে সময় করে একটু দেখে নিস,প্লিজ।” “আচ্ছা। ”


ওরা চারজন বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়েছে । তবে আজ বেশিরভাগ আলোচনা হয়েছে রাকিবের বিবাহিত জীবন নিয়ে। ঘন্টাখানেক পর আবিররা বাসার উদ্দেশ্যে চলে গেছে। আলী আহমদ খান নিজের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরেই মোজাম্মেল খানকে ডেকেছেন। মোজাম্মেল খান আসতেই জিজ্ঞেস করলেন, “ওনারা আসছিলেন?” “নাহ ভাইজান।” “আসেনি কেনো?” “সঠিক জানি না তবে বলেছেন ছেলের অন্য মেয়েকে পছন্দ। ”


“তাহলে আর কি, আপাতত ছেলে দেখা বন্ধ করে কাজে মনোযোগ দে। সামনে ঈদ আসতে চললো।” “এবারের ঈদে আমি কিছু করতে পারবো না। যা করার সব আবির আর তানভির করবে।” আলী আহমদ খান চিন্তিত কন্ঠে শুধালেন, “ওরা কি পারবে?” “পারবে না কেনো? বড় হয়েছে দায়িত্ব নিতে হবে না?” ‘আচ্ছা বলে দেখিস। কিন্তু আপাতত ছেলে দেখা বন্ধ রাখ। ” মোজাম্মেল খান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,


“ঠিক আছে, রাখলাম বন্ধ। কিন্তু ভালো ছেলে পেলে অবশ্যই বাসায় নিয়ে আসবো।” “আগে দেখ, ভালো ছেলে পাস কি না।” মোজাম্মেল খান রাশভারি কন্ঠে শুধালেন, ” তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছো ভাইজান? ” আলী আহমদ খান মেকি স্বরে বললেন, ” ঠাট্টা করবো না তো কি করবো? এই বলিস ছেলে ভালো, পরিবার ভালো অথচ ছেলে বাসা পর্যন্ত আসেই না৷ আমি কিভাবে বুঝবো ভালো নাকি খারাপ?” মোজাম্মেল খান প্রখর তপ্ত স্বরে বললেন,


” ঠিক আছে, এর পর আমি গিয়ে ছেলেকে বাসায় নিয়ে আসবো।” আলী আহমদ খান উদাসীন কন্ঠে বললেন, “আচ্ছা। আসলে আমাকে খবর দিস। ”


এদিকে মেঘ একটু পর পর বেলকনিতে যাচ্ছে, আবিরের জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ বাইকের শব্দ শুনতেই বেলকনিতে ছুটলো। তানভিরের পেছনে আবির বসা, আবিরকে দেখেই মেঘের মুখে হাসি ফুটলো। আবির রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর মেঘ আসছে। ভেতরে না ঢুকে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আবিরকে দেখছে। আবির পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে, হঠাৎ নিজের ফোন নিতে হাত বাড়াতেই মেঘকে নজরে পড়লো। মেঘের চোখে মুখে প্রশান্তির হাসি, আবেশিত দৃষ্টিতে আবিরকে দেখছে। আবির মেঘকে আপাদমস্তক দেখে উষ্ণ স্বরে বলল,


“কি ব্যাপার ম্যাম, বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? রুমে আসার জন্য কি আপনাকে আলাদাভাবে আমন্ত্রণ জানাতে হবে?” মেঘ মুচকি হাসলো৷ উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল, ” আজকের ছেলে টা কেমন ছিল?” আবির নিঃশব্দে হেসে বলল, ” আপনি কেমন আশা করেছিলেন?” “রাজপুত্রের মতো।” আবিরের আঁখি যুগল খানিক প্রশস্ত হলো৷ সহসা ঠোঁটের কোণে সহসা হাসি ফুটে উঠেছে। অতঃপর আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,


” রুমে আসুন, ম্যাম। ” “নাহ। আপনি কাজ করুন।” আবির ল্যাপটপের দিকে একপলক তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল, ” রাত অনেক হয়েছে, ঘুমাতে যান।” মেঘ শান্ত স্বরে বলল, “ঘুম আসতেছে না।” আবির অকস্মাৎ ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “কেনো?”


আবিরের অভিপ্রায় বুঝতে পেরে ঠোঁটে হাসি রেখে মেঘ অত্যন্ত গুরুতর কন্ঠে জবাব দিল, ” হবু জামাই টাকে খুব মিস করছি। ” আবির সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপ বিছানায় ফেলে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “কি?” মেঘ স্ব শব্দে হেসে এক দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেছে। আবির এগিয়ে গিয়ে রুমের দরজায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। মেঘের করা ছোট ছোট দুষ্টামি গুলো আবিরের বরাবর ই খুব প্রিয়৷ আবির রুমে এসে আবারও কাজে মনোযোগ দিল। ঘন্টাখানেক পর মেঘের নাম্বার থেকে একটা মেসেজ আসছে,


” Miss You অনেকটা নিচে লেখা হবু জামাই। ” আবির মেসেজ টা দেখে আবারও হাসলো। ঘড়িতে তখন ১২ টার উপরে বাজে। আবির রিপ্লাই দিল, ” ঘুম না আসলে ছাদে চলুন তাঁনাদের সাথে আড্ডা দিয়ে আসি।” দুমিনিট বাদেই মেঘ মেসেজ দিল, ” আমি ছাদেই আছি।”


আবির এক লাফে বিছানা থেকে নেমে দ্রুত দৌড়ে ছাদে গেল। তাঁনাদের প্রতি মেঘের এক আকাশ সমান ভয়, যার জন্য সন্ধ্যার পরে আবিরের রুমটাও পার হয় না। আবিরের উপর রাগ করে একদিন রাতে ছাদে এসে বৃষ্টিতে ভিজেছিল আর আজ দ্বিতীয় দিন। আবির ছাদে আসতেই মেঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” আমি কি আপনাকে বিরক্ত করেছি?” মেঘের মাথা থেকে পরে যাওয়া ওড়নাটা আবির দুহাতে আবারও মাথায় তুলে দিল। লোকে বলে রাত বিরাতে ছাদে তাঁনারা ঘুরাফেরা করে৷ তাঁনাদের নজর যেন মেঘের উপর না পড়ে সেই ভয়েই আবির মেঘের কপাল পর্যন্ত ওড়না টেনে দিয়েছে।


চিরচেনা গায়ের গন্ধ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ মাত্রই মেঘের অন্তঃস্থলে শিহরণ জাগে। মৃদু আলোতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আবির মোলায়েম কন্ঠে বলল, ” মাঝে মাঝে বিরক্ত কি জিনিস বুঝতেই পারি না৷ ” মেঘ নিজেকে সামলে উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ঐ ছেলেটার সাথে দেখা করেছিলেন আপনি? ” আবির কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “ঐ ছেলের ব্যাপারে কথা বলার জন্য আমার কাছে কোনো সময় নেই। চলে যাচ্ছি আমি।” আবির ঘুরতেই মেঘ আবিরের হাত চেপে ধরলো। আবির আড়চোখে তাকাতেই মেঘ সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে ধীর কন্ঠে বলল,


” আপনি বলেছিলেন তাঁনাদের সাথে গল্প করবেন।” আবির মনে মনে আওড়াল, “আমার যে আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। তাঁনারা তো বাহানা মাত্র। ” মেঘ আর আবির মুখোমুখি দুটা সিঙ্গেল সোফায় বসা। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। মেঘ নীরবে বসে নিজের হৃদয়ের প্রবল ধুকপুকানি সহ্য করছে, ক্ষণে ক্ষণে আবিরের দিকে তাকাচ্ছে তবে আবিরের নিগূঢ় দৃষ্টি দেখে স্থির থাকতে পারছে না। কথা বলতে গিয়ে বার বার কথা গিলছে৷ ধীরে ধীরে শরীর ঘামতে শুরু করেছে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সামলে মেঘ আচমকা ডাকলো,


” আবির ভাই…” সুপরিচিত কন্ঠস্বরের চিরচেনা জবাব, “হুমমমমমমম” আবিরের মোহমায়ায় জড়ানো মেঘ বিমোহিত নয়নে আবিরকে দেখে ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে জানতে চাইলো, ” আব্বু এমন করছেন কেনো?” মেঘের আকুল কন্ঠে বলা কথাটায় আবির নড়েচড়ে বসলো। ধীর কন্ঠে বলল, ” জানি না। ” “আপনি এভাবে আর কতদিন আমাকে বাঁচাবেন?” “জানি না।”


মেঘ একটু রাগী স্বরে বলল, ” আপনি কি কিছুই জানেন না?” আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল, “তোর কাছে একটা জিনিস চাইবো। দিবি?” ওমনি মেঘের হৃৎস্পন্দন বাড়তে শুরু করেছে। আবিরের আকুল আবেদনে মেঘের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। মেঘ তপ্ত স্বরে বলল, ” কি চান?” ” সাহস। ”


আবিরের কথা শুনে মেঘ আনমনেই হেসে ফেলল। লজ্জায় চিবুক খানিক নামিয়ে বলল, “আপনি আমার কাছে সাহস চাচ্ছেন? ” আবির ঢোক গিলে শান্ত স্বরে বলল, ” হ্যাঁ চাইছি৷ ” “কেনো?” “নিজের করা ভুলগুলো প্রতিনিয়ত তাড়া করে আমায়, জানি না কখন কি হবে। যদি পারিস একটু সাহায্য করিস৷ ” “কিসের ভুল? কি করেছেন আপনি? কিসের সাহায্য চাইছেন?”


আবিরের শাণিত চাহনি মেঘের হৃদয়ের তোলপাড় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবিরের কথার মানে বুঝতে পারছে না। বুকটা ধড়াস ধড়াস করে কাঁপছে। মেঘ প্রখর নেত্রে দীর্ঘ সময় আবিরকে নিরীক্ষণ করলো, একবারের জন্য পল্লব ফেললো না । আবির দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে বসে আছে। ভেতরে ভেতরে কাঁদছে এটা বুঝতে পেরেই মেঘ তড়িৎ বেগে আবিরের কাছে এগিয়ে গেলো। আবিরের মাথায় হাত রেখে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো, “আবির ভাই, কি হয়েছে আপনার?”


মেঘের স্পর্শ পেয়ে আবিরের ভেতরের কান্না কিছুটা প্রকাশিত হলো। আবিরের কান্না দেখে মেঘের রাকিবের গায়ে হলুদের রাতের কথা মনে পড়ে গেছে। মেঘ আর্তনাদ করে উঠলো, “আপনি কাঁদছেন কেনো? কি হয়েছে বলুন আমায়, প্লিজ।” “প্লিজ বলুন।”


আবির হঠাৎ ই মেঘের হাতটা শক্ত করে ধরলো৷ আকস্মিক ঘটনায় মেঘের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছে। ক্রন্দনরত অবস্থায় আবির কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, “I am Sorry, Megh. I am really sorry.”