সালমা চৌধুরী
সালমা চৌধুরী

প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | অপেক্ষা এবং প্রাপ্তি

৬১ ভিউ
০ মন্তব্য
১ মিনিট

মেঘ খানিক চুপ থেকে সন্ধিহান কন্ঠে বলে উঠল, “মালা আপুর সাথে কত রাত আনলিমিটেড কথা বলেছেন বলতে পারবেন? মালা আপুর মতো আর কত মেয়ের জীবন নষ্ট করেছেন?” আবির গম্ভীর কন্ঠে বলল, “রাতভর আনলিমিটেড কথা তাও আবার মালার সাথে? আল্লাহ কোথায় আছো? আমায় উঠায় নেও। এই অবিশ্বাসের দুনিয়ায় আমি আর থাকতে চাই না।”

” ঢং করতেছেন কেনো?বলেন নি কথা? অস্বীকার করতে পারবেন?” “হ্যাঁ বলেছি। তবে শুধুমাত্র মামা,মামি আর মাইশা আপুর সাথে। যেহেতু ফোন মালার ছিল তাই রিসিভ করলে Hi/ hello এটুকু কথায় হতো। এমনকি এই মালার যন্ত্রণায় রাতের বেলা ফোন বন্ধ করে ঘুমাইতাম। বিশ্বাস না হলে বাসার সবাইকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে নতুন ফোনও নিয়েছিলাম এটা শুধুমাত্র তানভির জানতো।”

“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন? আপনি নিষ্পাপ? দুধে ধৌয়া তুলসীপাতা?” আবির মৃদুস্বরে বলল, “একদম ই না। আমি নচ্ছার, বদমাশ, ধৃষ্ট, লুচ্চা অথবা লম্পট তবে সেটা শুধুমাত্র একজনের জন্য। সে ব্যতীত পৃথিবীর কেউ আমার দিকে আঙুল তুলে বলতে পারবে না আমি তার দিকে কুনজর দিয়েছি কিংবা তার সাথে বেহুদা কার্যকলাপ করেছি।”

“কে সে?” ” কেনো বলবো? কোন এক বৃষ্টিস্নাত রাতে কেউ একজন আমাকে বলেছিল ‘আপনি যা বলবেন, যে অবস্থাতেই বলবেন আমি সাথে সাথে বিশ্বাস করে ফেলবো৷’ তার বিশ্বাস এতটায় ঠুনকো যে কেউ কিছু বললেই তার বিশ্বাসের ঘরের বাতি নিভে যায়। তাকে আমি আমার মনের কথা কিভাবে বলবো? সে বরং তার মনের ঘরে অবিশ্বাসই পুষতে থাকুক।” মেঘ আশাহত কন্ঠে বলল,

” আচ্ছা সরি।” “আজ সরি বলছেন দু’দিন পর ভুলে যাবেন। দেখা গেল আজ থেকে তিন মাস পর কেউ একজন এসে বলল সে দু মাসের প্রেগন্যান্ট আর তার বাচ্চার বাবা আবির। আপনিও নাচতে নাচতে সে কথা বিশ্বাস করে ফেলবেন। অথচ আবির চারমাস যাবৎ দেশের বাহিরে৷” ” আমি এতটাও নির্বোধ নয়।” “তা ঠিক কতটুকু চতুর আপনি? আপনাকে রাগানোর জন্য কেউ ইচ্ছেকৃত আজেবাজে কথা বলছে আর আপনি সবকিছু বুঝতে পেরেও রাগ করে বসে আছেন৷ বাহ! একটা সময় পর্যন্ত মালা আমাকে খুব জ্বালিয়েছে এটা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু গত ছয়মাসের উপরে মালার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ ই হয় নি৷ এখন বিশ্বাস করা না করা আপনার উপর৷ ”

“বললাম তো সরি৷” “ঠিক আছে৷ এখন খেতে যান।” “আপনি খেয়েছেন?” “না খাবো।” “আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।” “আল্লাহ হাফেজ।”

দিন কাটছে দ্রুতগতিতে। প্রত্যেকে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। আবির না থাকায় অফিসের কাজের চাপ আলী আহমদ খানকে একা সামলাতে হচ্ছে। মোজাম্মেল খানকে ঢাকা আর রাজশাহীতে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। তানভির নিজেও প্রচুর ব্যস্ত হয়ে গেছে। পুরোদমে পরীক্ষার প্রিপারেশন নিচ্ছে সাথে আবিরের অফিসের কিছু কাজকর্মও সামলাতে হচ্ছে। তবে মেঘ একদম রিলাক্সে আছে। সকালবেলা আবিরের কলে ই ঘুম ভাঙে তার।

টুকটাক কথা বলে উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়েই পড়তে বসে। সারাদিন ভার্সিটি, ঘুরাঘুরির ফাঁকেও আবিরকে মেসেজের পর মেসেজ করে। আবিরও যথাসম্ভব মেঘের মেসেজের রিপ্লাই দেয়ার চেষ্টা করে। সারাক্ষণ মেসেজে আর অডিও কলে কথা বললেও কেউ কাউকে ভিডিও কল দেয় না। সন্ধ্যায় বাসার সবার সাথে ভিডিও কলে কথা বললেও মেঘের সাথে তেমন কথা হয় না। মেসেজে করা দুষ্টামির জন্য মেঘ লজ্জায় ভিডিও কলে আবিরের দিকে তাকাতেই পারে না অন্যদিকে আবির কথা বলতে গেলে তুই, তুমি আর আপনি মিক্সড করে ফেলে। আশেপাশে মা -কাকিয়া, মীম, আদি থাকে মাঝে মাঝে আলী আহমদ খানও থাকেন। সবার সামনে এভাবে কথা আঁটকে যাওয়া, মেঘের লাজুক চেহারা দেখে নিজেকে সংযত রাখতে না পারা সবকিছুর জন্য ভিডিও কলে মেঘের সঙ্গে কথা বলতেই চায় না।

মাস খানেক কেটে গেছে। তানভিরের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা চলছে। আজও পরীক্ষা আছে তাই সময়মতো পরীক্ষা দিতে গেছে। মীমরা কেউ বাসায় নেই। সারাদিন একা একা কিছুই ভালো লাগছে না মেঘের। আবিরের সঙ্গে দুপুরেই কথা হয়েছে, একটু পর মিটিং আছে বলে ঠিকমতো কথাও বলতে পারে নি। মেঘ ফোন হাতে নিয়ে নিচে যাচ্ছিলো, তানভিরের রুম পর্যন্ত এসে হঠাৎ ই থেমে গেছে। রুমের দরজাটা খোলা৷ মেঘ দরজা থেকে রুমে উঁকি দিতেই দেখল, রুম এলোমেলো হয়ে আছে। সচরাচর মেঘ তানভিরের রুমে যায় ই না, রুম গুছানোর তো প্রশ্ন ই আসে না। রুমের বেহাল অবস্থা দেখে নিজের ই ইচ্ছে হলো রুমটা গুছিয়ে দেয়ার।

টেবিল আর বিছানায় বই খাতার ছড়াছড়ি। গতকালের ধৌয়া শার্টগুলোও এমনিই পড়ে আছে। মেঘ গুন গুন করে গান গাইতেছে আর একটা একটা করে শার্ট ইস্ত্রি করছে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে শার্টগুলো ওয়ারড্রবে রাখতে গিয়ে দেখল ওয়ারড্রবের অবস্থা আরও খারাপ। শার্ট, প্যান্ট আর টিশার্ট যাচ্ছেতাই অবস্থায় ফেলে রেখেছে।

এ পর্যায়ে এসে মেঘের রাগ উঠে গেছে। একটা মানুষ এতটা অযত্নশীল হয় কেমন করে। মেঘ রাগে গজগজ করতে করতে ওয়ারড্রব গোছাচ্ছে। আচমকা একটা ক্যাটালগ দেখে মেঘ থমকে গেল। মেয়েদের ড্রেসের ক্যাটালগ, হাতে নিয়ে ভালোভাবে দেখতেই দুই চোখ প্রসারিত হয়ে গেছে। মেঘ সঙ্গে সঙ্গে নিজের ফোন বের করে ছবি খোঁজতে লাগলো। কিন্তু এত এত ছবির ভিড়ে কাঙ্ক্ষিত ছবি খোঁজে পেলো না তাই ক্যাটালগ টা একপাশে রেখে দ্রুত জামাকাপড় গোছাতে শুরু করলো। কোনোরকমে সব গুছিয়ে ক্যাটালগ আর ফোন নিয়ে নিজের রুমে ছুটলো। ফ্রেশ হয়ে ১৫ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। হালিমা খান ঘুমাচ্ছিলেন তাই মালিহা খানকেই আপাতত বলে বেড়িয়েছে। রিক্সা নিয়ে সরাসরি বন্যাদের বাসায় আসছে।

বন্যাদের বাসায় ও তেমন কেউ নেই। আপু আর আংকেল অফিসে, বন্যার ভাইও খেলতে বেরিয়েছে। অনেকক্ষণ দরজায় ডাকার পর বন্যার আম্মু এসে দরজা খুলে দিয়েছে। মেঘ সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেই বন্যার রুমের দিকে ছুটলো। বন্যা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পরপর দুবার ডাকতেই বন্যার ঘুম ভেঙেছে। মেঘকে দেখে বন্যা এক লাফে শুয়া থেকে উঠে বসছে। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে বাসায় চলে আসছে এটা যেন অবিশ্বাস্য ঘটনা। বন্যা থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল,

“তুই হঠাৎ আমাদের বাসায়?” “তোকে দেখতে মন চাচ্ছিলো তাই আসছি।” “সকালেই না দেখা হলো।” ” তাতে কি হয়ছে? আসতে পারি না? এখন কি চলে যাব?” “এই না না। আমি এমনি বললাম। কল দিয়ে জানালিও না হুট করে আসছিস তারজন্য। তোর ভাই জানে?” “না। ভাইয়া পরীক্ষা দিতে গেছে। আচ্ছা শুন, তোর ঈদের ড্রেসটা একটু বের কর তো। যেটা গিফট পাইছিলি। ” “কেনো?” “দেখব একটু।”

“ঐ ড্রেস দেখতে বাসায় আসছিস? বললেই ছবি পাঠিয়ে দিতাম।” “তুই বড্ড বেশি কথা বলিস। চুপচাপ ড্রেস বের করে দে। ” বন্যা উঠে ওয়ারড্রব থেকে ড্রেস বের করে মেঘের হাতে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেছে। মেঘ প্যাকেট থেকে ড্রেস টা বের করতে করতে বন্যা এসে শান্ত কন্ঠে শুধালো, “কি হয়েছে বলবি?”

মেঘ কপট রাগী স্বরে বলল, ” আমার জন্য সেমাই এর বরফি নিয়ে আয়।” ” আছেই কি না কি জানি!” “না থাকলে বানিয়ে নিয়ে আসবি যা এখন।”

মেঘের এমন আচরণের মানে বুঝলো না বন্যা। তবুও মেঘের কথা মতো বরফি আনতে নিচে চলে গেল। গতকাল বিকেলে আপু আর বন্যা মিলে সেমাই এর বরফি বানিয়েছিলো। সকালে সেখান থেকেই কয়েকটা মেঘের জন্য নিয়েছিল। কিন্তু মিষ্টি আর মিনহাজ দেখে ফেলায় মেঘের ভাগ থেকে ওদেরকেও ভাগ দিতে হয়েছিল।এদিকে মেঘ ড্রেসটা বিছানার উপর ছড়িয়ে রেখে ব্যাগ থেকে সেই ক্যাটালগ টা বের করে ভালোভাবে পরখ করতে লাগতো। ক্যাটালগ আর ড্রেসে কালার ব্যতীত বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই। মেঘের ঠোঁট জুড়ে মুচকি হাসি, দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,

” ওহ আচ্ছা, বড়লোক বাপের ছেলেটা তবে আমার একমাত্র ভাই তানভির খান ছিল! আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে গিফট পাঠানো। দাঁড়াও দেখাচ্ছি!” মেঘ ক্যাটালগ ব্যাগে রেখে ড্রেস টা ভাঁজ করছে আর একা একায় বিড়বিড় করছে। এরমধ্যে বন্যা বরফি আর পিঠা নিয়ে আসছে। বন্যাকে দেখেই মেঘ চুপ হয়ে গেছে। বন্যা ড্রেস ওয়াড্রবে রাখতে রাখতে বলল, “তোর কি হয়েছে আজ?” উত্তর না দিয়ে মেঘ প্রশ্ন করল,

“এই ড্রেসের মালিকের সন্ধ্যান পেয়েছিলি?” “নাহ। সন্ধ্যান পেলে তোকে অবশ্যই জানাতাম।” মেঘ খাচ্ছে আর আনমনে হাবিজাবি ভাবছে। বন্যা একা একায় কথা বলছে কিন্তু সেসব কথা মেঘের মস্তিষ্কে ঢুকছেই না। বন্যার আম্মু ডাকছে শুনে বন্যা আবারও নিচে গেল। মেঘের মস্তিষ্কে দ্বিধাদ্বন্দের আনাগোনা চলছে। এই ড্রেস তানভির পাঠিয়েছে এটা ১০০% সিউর। বন্যার প্রতি কেয়ার দেখে মেঘের আগেও সন্দেহ হয়েছিল তবে আজ মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছে। কিন্তু বন্যার মনে কি চলছে এখনও বুঝা যাচ্ছে না। এরমধ্যে আবির কল দিয়েছে। মেঘ কল রিসিভ করে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম” “ওয়ালাইকুম আসসালাম।কি ব্যাপার? কোথায় আপনি?” “বন্যাদের বাসায় আসছি।” “কেনো?” “গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল।” “কি কাজ বলা যাবে?” “আপনি জানেন….”

এটুকু বলতেই বন্যা রুমে আসছে৷ মেঘ কথাটা গিলে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ” আপনার মিটিং শেষ?” “হুমমমম। কি বলতে চাইছিলেন?” “কিছু না। এখন রাখছি পরে কথা বলব।” মেঘ কল কাটতেই বন্যা চাপা স্বরে বলল, “আজ একটা ‘আপনি’ নেই বলে কেউ ফোন দিয়ে খোঁজও নেয় না। আমাদের বাসায় আসছিল ২০ মিনিটও হয় নি এরমধ্যে ফোন দিয়ে ফেলেছে৷ এত প্রেম!”

মেঘ মেকি স্বরে বলল, ” আমি তোর মতো অনুভূতি চাপিয়ে রাখতে পারি না। তুই কাউকে পছন্দ করলে বল, আপনির ব্যবস্থা না হয় আমিই করে দিব।” “আমার পছন্দের কেউ নেই। এমনি মজা করলাম তোর সাথে। ” “সত্যিই কেউ নেই?” বন্যা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলল, “থাকলে কি তোকে বলতাম না?” “কি জানি! নাও বলতে পারিস।” “তোর আজ হয়ছে কি বলবি আমাকে? ত্যাড়া ত্যাড়া কথা কেনো বলছিস?” “কিছু হয় নি।”

বন্যা আর মেঘের আরও কিছুক্ষণ আলাপচারিতা চলল। মেঘ আজ তেমন কিছু বলতেই পারছে না। বন্যাকে ভাবি বানানোর চিন্তা একান্তই মেঘের ছিল। কিন্তু তানভির বন্যাকে পছন্দ করে এটা ভেবেই মেঘ আশ্চর্য হচ্ছে। তার থেকেও বড় কষ্ট এটায় যে তানভির আজ পর্যন্ত মেঘকে একটাবার বলার প্রয়োজনও মনে করে নি। তানভির পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরে মেঘকে না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কল দিয়েছে। মেঘ ওয়াশরুমে ছিল তাই বন্যা কল রিসিভ করেছে। তানভির উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

“কোথায় তুই?” “মেঘ আমাদের বাসায় আসছে।” বন্যার কন্ঠ শুনে তানভির গলা ঝেড়ে বলল, ” আশেপাশে বনু থাকলে ফোনটা দাও।” “আপনার বনু আশেপাশে থাকলে নিশ্চয়ই আমি ফোনটা রিসিভ করতাম না। মেঘ ওয়াশরুমে। ” “ওহ৷ বের হলে আমাকে কল দিতে বলো।”

বন্যা পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করতে যাবে তারমধ্যে কল কেটে দিয়েছে। মেঘ আসতেই বন্যা জানিয়েছে। মেঘ কল দিতে গিয়ে খেয়াল করল ফোনে ব্যালেন্স শেষ। ততক্ষণে বন্যা নাস্তার প্লেটগুলো নিয়ে নিচে চলে গেছে। বন্যার ফোনের লক মেঘের জানায় আছে। মেঘ স্বাভাবিকভাবেই বন্যার ফোন হাতে নিয়ে লক খুলে তানভিরের নাম্বার লিখতে শুরু করল। ৫-৬ ডিজিট লিখতেই ‘Villain’ নামে সেইভ করা তানভিরের নাম্বার ভেসে উঠেছে । মেঘ ভাবলেশহীন চোখে চেয়ে আছে। হাসবে নাকি রাগ করবে সেটাও বুঝতে পারছে না। ভাইয়ের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসায় রাগটায় প্রকাশ পেলো। বন্যা রুমে আসতেই মেঘ বাজখাঁই কণ্ঠে বলে উঠল,

” ভাইয়ার নাম্বার ভিলেন দিয়ে সেইভ করেছিস কেনো?” “এমনি।” “আমার ভাই তোর সাথে কি এমন করেছে?” “কিছুই করে নি।” “তো?” “তো কি আবার? মন চাইছে তাই এই নামে সেইভ করেছি।” মেঘ আনমনে কিছু ভেবে শক্ত কন্ঠে শুধালো, ” আমার ভাই কে কি তোর সহ্য হয় না?ভাইয়ার আচরণে বিরক্ত ? ভাইয়া কি তোর সাথে বাজে ব্যবহার করেছে?” মেঘ প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করাতে বন্যার কুঞ্চিত ভ্রু যুগল আরও বেশি কুঞ্চিত হলো। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বন্যা সুগভীর কন্ঠে বলল,

” তোর ভাইকে সহ্য না হবার মতো কোনো কারণ ই নেই আর না ওনি আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছেন। সেদিন একটা মুভি দেখছিলাম, নায়ককে ভিলেন বলে ডাকে। নায়কটা তোর ভাইয়ের মতো দেখতে তারজন্য এই নামে সেইভ করেছিলাম। ফোন দে ডিলিট করে দিচ্ছি।” মেঘের ঠোঁট জুড়ে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটলো। চক্ষুপল্লব ঝাপ্টে হাস্যোজ্জ্বল মুখে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে উঠল, “No problem Baby. ভালোবেসে দিয়েছো যখন পাল্টাতে হবে না। আমার ভাই ভিলেনরূপী নায়ক হলে আমার কোনো আপত্তি নেই।” বন্যা চাপা স্বরে বলল,

” আমি এতকিছু ভেবে দেয় নি৷ মাথায় আসছে এমনি দিয়েছি। ভালোবাসা আবার কোথা থেকে আসলো।” মেঘ নির্বিকার ভঙ্গিতে শুধালো, “তুই আমার ভাইকে ভালোবাসিস না?” আচমকা মেঘের এমন প্রশ্নে বন্যা কেঁপে উঠলো। পূর্ণ মনোযোগে মেঘের অভিমুখে তাকালো। কোনো উত্তর দিতে পারছে না। শরীর জুড়ে অজানা শিহরণ, মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরনে তোলপাড় চলছে। দাঁতে দাঁত পিষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে৷ আগে হলে মুখের উপর বলে দিত, “না, ভালোবাসি না।”

আজ চাইলেও এই দুটা শব্দ বলতে পারছে না। মনে হচ্ছে কেউ মুখ চেপে ধরে আছে। বুকের ভেতর পিনপিন ব্যথা হচ্ছে। মেঘ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখের পাতা পিটপিট করছে, ঠোঁটে মৃদু হাসি লেগেই আছে৷বন্যা কাচুমাচু করে বলে উঠল, ” আমি ওনাকে নিয়ে এমন কিছু ভাবি না।” মেঘ ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে বলল, “তাহলে কাকে নিয়ে ভাবো সোনা? গলির মোড়ের মোখলেস মিয়াকে নিয়ে?” “মোখলেস মিয়া আবার কে?” ” মনে নেই? সেদিন যে বলল ব্যাটায় তোমাকে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায়!”

“What?” “কী?” “কিসের কী?” “ওয়াট অর্থ কী। ” বন্যা মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল, “ফাজলামো করছিস?” “তুই ও তো আমার ভাইয়ের জীবন নিয়ে ফাজলামো করছিস ” “মানে?” “কিছু না। ভাইয়াকে কল দিচ্ছি চুপ কর।” বন্যার ফোন থেকে কল দেয়ায় তানভির রিসিভ করে ধীর কন্ঠে বলল, “বলো।” “ভাইয়া আমি মেঘ।”

“হ্যাঁ, বল।” “তোমার কি মন খারাপ? পরীক্ষা ভালো হয় নি?” “হয়েছে মোটামুটি। তুই যে আম্মুকে না বলে চলে গেলি। আম্মু টেনশন করছিল।” “বড় আম্মুকে বলে আসছি। বড় আম্মু বলে নি?” “বড় আম্মু বাসায় ছিল না। আম্মু কল দিয়েছে তুই নাকি রিসিভ করিস নি।” “আমি ভাবছি আম্মু বকা দিতে কল দিয়েছে তাই রিসিভ করি নি।” “বাসায় কখন আসবি?” মেঘ বন্যার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “তুমি এসে নিয়ে যাও।”

“আমি চারঘন্টা পরীক্ষা দিয়ে বাসায় আসছি কিছুক্ষণ হলো। এখন বের হওয়ার মতো এনার্জি নেই। তুই রিক্সা করে চলে আয়।” “আমি না হয় চলে আসবো। কিন্তু একজন যে কত কষ্ট করে তোমার জন্য রান্না করছে। তুমি আসলে খাওয়াবে বলে।” বন্যা তড়িৎ বেগে মেঘের মুখ চেপে ধরেছে। তানভির ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, “কে?” মেঘ বন্যার হাত সরিয়ে আস্তে করে বলল, “বন্যা।”

“ওহ। তাকে রান্না করতে বারণ কর আর তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।” ” আমি কিছু বলতে পারব না। বন্যা এত কষ্ট করে রান্না করছে আর তুমি এমন আচরণ করছ? তুমি এসে আমায় নিয়ে যাবে এটায় ফাইনাল। আর না হয় আমি এখানেই থাকবো। বাই।” বন্যা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি তোর ভাইয়ের জন্য রান্না করছি?” “নাহ।কিন্তু এখন করবি।” “আমি পারবো না।”

“আমার একমাত্র ভাই আসতেছে। যত্নের কোনো ত্রুটি থাকলে তোর আব্বু আম্মু আর বড় আপুকে ইচ্ছেমতো বিচার দিবো সাথে আমার স্পেশাল নাটক ফ্রী। ” “এমনভাবে বলছিস যেন আমি ওনার স্পেশাল কেউ আর ওনার যত্ন নিতে আমি বাধ্য।” মেঘ ব্যাগ নিয়ে বের হতে হতে বলল, “হয়ে যা স্পেশাল কেউ। কে বারণ করেছে?” মেঘ ড্রয়িং রুমে বসে বন্যার আম্মুর সঙ্গে গল্প করছে।আর বার বার বন্যাকে ডেকে বলছে, “ভাইয়ার কিন্তু ডিম বেশি দেয়া নুডলস পছন্দ।”

“মশলা চা করিস। এটাও ভাইয়ার পছন্দ। বাকি তোর মর্জি।” বন্যা হাতের কাছে যা যা পেয়েছে তা ই রেডি করছে। অনেকক্ষণ পর তানভির আসছে। কলিং বেল বাজতেই মেঘ ড্রয়িং রুম থেকে ডেকে উঠল, “বন্যা দেখ কে আসছে। ” বন্যার মা বলল, “আমি দেখছি।” “না না আন্টি। আপনি বসুন৷ বন্যা যাচ্ছে।”

অন্য সময় হলে মেঘ নিজেই দরজা খুলতে ছুটতো। কারণ বন্যাদের বাসার সবার সঙ্গে মেঘের সম্পর্ক খুব ভালো। বাসায় আসলে বন্যার থেকেও বেশি বাকিদের সাথে আড্ডা দেয়। বন্যা আর তানভিরকে পরীক্ষা করতে আজ মেঘ ইচ্ছে করেই তানভিরকে বাসায় ডেকেছে। দরজা খুলে বন্যা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। তানভির ভ্রু নাচাতেই বন্যা রীতিমতো বিষম খেয়ে উঠলো। তানভির নেভি ব্লু রঙের শার্ট- কালো প্যান্ট পড়ে ফরমাল গেটআপ নিয়ে আসছে। বন্যা কাশতে কাশতে সালাম দিতেই ভুলে গেছে। তানভির কপাল গুটিয়ে বলল, “পানি খাও। ঠিক হয়ে যাবে। ”

বন্যা দ্রুত ভেতরে চলে গেছে। মেঘ আড়চোখে ভাইকে দেখেই ভড়কালো। ভাইয়ের এমন গেটআপ দেখে আশ্চর্যের চূড়ায় পৌছে গেছে। তানভির বন্যার আম্মুর সঙ্গে কথা শেষ করে খাবারগুলো ওনার হাতে দিল। ওনি খাবার নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেছেন। তানভির মেঘের পাশে সোফায় বসলো। মেঘ ভ্রু কুঁচকে তানভিরকে দেখেই যাচ্ছে। মেঘ বিস্ময় সমেত জানতে চাইল, “আমরা কি বউ দেখতে আসছি?”

তানভির ভ্রু কুঁচকে সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে বলল, ” কেনো?” “এভাবে আসছো কেনো?” “ভালো লাগছে না?” “অনেক বেশি ভালো লাগছে। কিন্তু এই গেটআপে কেনো আসছো?” “ধৌয়া শার্টগুলো সব ইস্ত্রি করে রেখেছিস৷ তাই ভাবলাম ফরমাল গেটআপে আসলে তোর ভালো লাগবে।” মেঘ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেকি স্বরে বলল, “আমার ভালো লাগবে তাই? অন্য কোনো কারণ নাই?”

“আর কি কারণ থাকবে?” এরমধ্যে বন্যা দুকাপ চা নিয়ে আসছে। মেঘ একটা কাপ হাতে নিতে নিতে ঝটপট বলল, ” ভাইয়া চিনি কম খায়। তোকে বলতে মনে নেই। ” বন্যা মৃদু হেসে বলল, “চিনি কম ই দিয়েছি।”

মেঘ এবার দ্বিতীয় দফায় আশ্চর্য হলো। কি হচ্ছে এসব? মেঘ নিজেই নিজের কপাল চাপড়ে মনে মনে বলল, ” ছিঃ এত বেকুব মানুষও হয়? আবির ভাই ঠিকই বলে আমি আসলেই নির্বোধ। আমি তাদের মেলানোর জন্য ঝড় তুফানের সঙ্গে যুদ্ধ করছি এদিকে তারা অলরেডি মনে মনে দুজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। বাহ! অসাধারণ৷” তানভির চা খাচ্ছে বন্যা রান্নাঘরের দরজা থেকে নিপুণ দৃষ্টিতে তানভিরকে দেখছে৷ ফরমাল ড্রেসে সব ছেলেদের অন্যরকম সুন্দর লাগে। বন্যা না চাইতেও বার বার তানভিরের প্রতি দৃষ্টি আটকাচ্ছে। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা প্রচন্ড বেগে উঠানামা করছে। কানের লতি গরম হয়ে গেছে৷ মেঘ চা শেষ করে কাপ রাখতে গিয়ে বন্যার দিকে নজর পরলো।

মেঘ মনে মনে বিড়বিড় করল, ” আর একবার বলিস শুধু আমার ভাইকে ভালোবাসিস না। এমন মাইর দিবো কাঁদতে কাঁদতে বলবি, I love Tanvir.” তানভির তাকাতেই বন্যার সঙ্গে চোখাচোখি হলো। বন্যা থতমত খেয়ে চোখ নামিয়ে সরে গেছে। তানভির আড়চোখে চেয়ে আছে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটলো৷ মেঘ সারাবেলা বন্যা আর তানভিরের কর্মকাণ্ড দেখল আর একা একায় বিড়বিড় করলো। খাওয়াদাওয়া শেষে আন্টির থেকে বিদায় নিয়ে মেঘ আর তানভির বেরিয়ে পরেছে৷ বন্যাও পেছন পেছন যাচ্ছে৷ তানভির কিছুটা সামনে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে সরাসরি বন্যার দিকে নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

“তখন আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিলে কেনো?” “কই তাকায় নি তো।” বন্যার গলার স্বর কাঁপছে। চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে মিথ্যা বলছে। বন্যা চোখ নামিয়ে নিয়েছে। তানভির জানতে চাইল, “আমি কি দেখতে এতই খারাপ? তাকাতেও ইচ্ছে হয় না?” গমগমে পুরুষালী স্বর কানে বাজতেই বন্যা উৎকণ্ঠিত কন্ঠে বলল,

“কে বলেছে আপনি দেখতে খারাপ? মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর লাগছে আপনাকে। কারো নজর না লাগে।” কথাটা বলেই বন্যা নিজের মুখ চেপে ধরেছে। বাতাসে উড়তে থাকা বন্যার চুলগুলো চোখ মুখ ঢেকে দিচ্ছে। তানভিরের হৃদয়ে অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে। বন্যার চোখ বন্ধ, মুখ থেকে চুল সরাতে তানভির হাত বাড়ালো৷ পেছন থেকে মেঘের ডাকে তানভিরের ঘোর কাটলো৷ তানভির হাত নামিয়ে আস্তে করে বলল, “নিজের হাতে চা করে খাওয়ানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ৷আসছি।” মেঘের সামনে আসতেই মেঘ ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,

“বাসায় যাওয়ায় ইচ্ছে নেই?” “চল।” অন্য সময় হলে তানভির দুটা কথা শুনাতো বা একটু রাগ হলেও দেখাতো। আজ কোনো রিয়াকশন নেই দেখে মেঘ হা হয়ে তাকিয়ে আছে। গাড়িতে বসেও একদৃষ্টিতে তানভিরকে পরখ করছে। তানভির মুচকি মুচকি হাসছে আর আস্তে করে গাড়ি চালাচ্ছে। মেঘ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে মনে মনে বলল, “তোমার মিটিমিটি হাসি বের করছি। ওয়েট” গলির মোড় পর্যন্ত আসতেই একটা সিঙ্গারার দোকান দেখিয়ে মেঘ উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “ভাইয়া ঐ ছেলেটাকে দেখছো। ” তানভির এক সেকেন্ডের জন্য তাকিয়ে আস্তে করে বলল,

” হু৷ কে?” “বন্যার বয়ফ্রেন্ড। ” কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্রই তানভির অকস্মাৎ গাড়ির ব্রেক কষল৷ আচমকা ব্রেক কষায় আর একটুর জন্য মাথায় বারি খেতে নিছিলো৷ তানভিরের পূর্ণ মনোযোগ দোকানে। আগে এক সেকেন্ডের জন্য তাকানোতে ঠিকমতো খেয়াল করে নি। দোকানে অল্প বয়স্ক কোনো ছেলেই নেই। দু’জন দোকানদার আছে যার মধ্যে একজনের বয়স ৬০+ আরেকজন বয়স ৩৫+ হবে। তানভির ভ্রু কুঁচকে শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কোনটা?” “লাল শার্ট পড়নে।”

তানভির আবারও দোকানের দিকে তাকালো। ৬০+ বয়সের লোকের পড়নে লালের মতো একটা শার্ট। হয়তো ওনার ছেলে বা নাতির শার্ট হবে। তানভির ভারী কন্ঠে বলল, “ওনি ছেলে? আর বন্যার বয়ফ্রেন্ড?” “অবশ্যই। তুমি বিশ্বাস করো না? চলো। আমাকে দেখলেই শালী শালী ডাকবে দেইখো । এমনকি সিঙ্গারার দাম ও নিবে না।” “কেনো?”

“বাহ রে! বন্যাকে ওনার ভালো লাগে৷ বিয়ে করতে চায়৷ আমি বন্যার বেস্ট ফ্রেন্ড শুনে আমাকেও ফ্রি-তে সিঙ্গারা খাইয়েছে। ওনার নাম মোখলেস মিয়া, বয়স ৬৭। ওনার দুই বউ আর ৬ ছেলেমেয়ে আছে। ” তানভির মেঘের দিকে আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে শুধালো, ” এতকিছু তুই কিভাবে জানিস?

“জানি জানি। বেস্টু আমার, আমি জানবো না তো কে জানবে হুম? এখন চলো বিয়ের ঘটকালি টা করে আসি। ” “ভাইয়া যদি এসব কর্মকাণ্ডের কথা জানতে পারে তাহলে তোর খবর ই আছে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তুই মোখলেস মিয়ার বিয়ার ঘটকালি করিস?” মেঘ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, “আমার বেস্টুর বিয়ে হওক তুমি কি চাও না?” “তাই বলে ওনি?”

“ওনার চোখে বন্যার প্রতি ভালোবাসা দেখেছি আমি।” তানভির গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বিড়বিড় করল, “বন্যার প্রতি কারো চোখে ভালোবাসা উতলে পড়লে সেই চোখ ই কানা করে ফেলব।” মেঘ বলে উঠল, “বিড়বিড় করে কি বলো। ” “কিছু না।”

“বন্যার বিয়েতে আমি কিন্তু লেহেঙ্গা পড়বো৷ আর লেহেঙ্গা টা তুমি কিনে দিবা।” তানভির গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে তপ্ত স্বরে বলল, “মুখ টা বন্ধ রাখ নয়তো রাস্তায় ফেলে চলে যাব।” মেঘ ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসছে আর মনে মনে বলছে, “লাগছে লাগছে৷ একদম কলিজায় লাগছে। ”



পর্ব - ৬৬ (২)

তানভির পুরো রাস্তা গাল ফুলিয়ে রেখেছে। মেঘ তানভিরকে জ্বালানোর জন্য বন্যাকে কল দিল। বন্যা কল রিসিভ করতেই মেঘ বলল, ” দুলাভাই এর মনটা বোধহয় খারাপ। তুই একটু দেখা করে যাস।” তানভির আবারও ব্রেক কষল। অগ্নিদৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ আড়চোখে তানভিরের ভাব দেখে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। বন্যা হুঙ্কার দিয়ে উঠল,


“দুলাভাই কে আবার?” “মোখলেস দুলাভাই এর কথা বলছি।” “রাখ ফোন।” বন্যা কল কেটে দিয়েছে। মেঘ তানভিরের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, ” যাবে।” তানভিরের রক্তাভ দু চোখ। শ্বাস ছেড়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল, “ডাফার” ( মাথামোটা/মূর্খ মানুষ) মেঘ ঠোঁট বেঁকিয়ে ভেঙছি কেটে শান্ত স্বরে জবাব দিল, “আর তুমি ডাফারের ভাই।”


তানভির নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে আবারও গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিল। দু মিনিট পর মেঘ তানভিরকে শুনিয়ে শুনিয়ে গান গাচ্ছে, “ফুল ফোটে শাখায় শাখায় ব্যথা ধরে বুকে কি প্রেমেতে মন মাতাইলা অশ্রু ঝরে চোখে আমার আসমান করে আন্ধার সুখের নিদ্রা হবে কি তোমার বন্ধু আমায় ছাড়া।” তানভির রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিল, “চুপ থাকতে বলছি।”


“আমার বন্ধুর বিয়ে হয়ে গেলে আমায় ছেড়ে চলে যাবে। আমি কি কাঁদবো না? একটু গানও গাইবো না? এত খারাপ কেনো তুমি?” “দেখ, ৪ ঘন্টা পরীক্ষা দিয়ে আসছি। মাথা এমনিতেই গরম আছে। বেশি কথা বলবি না।” “ঠিক আছে।” “মেঘের মতোন উড়ে উড়ে অন্তরটারে খালি করে করলা দিশাহারা ” তানভির তাকাতেই মেঘ মুখ চেপে বলল, “আমার কোনো দোষ নাই। নিজে থেকেই গান বের হচ্ছে। ”


তানভির কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ভগ্ন হৃদয় নিয়ে গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিল। বাসায় ঢুকতেই আলী আহমদ খানের সঙ্গে দেখা। আলী আহমদ খান হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ” দুই ভাই-বোন সেজেগুজে কোথায় গিয়েছিলে?” “আমার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম আর ভাইয়া আমাকে আনতে গিয়েছিল।” “ঠিক আছে যাও।” মেঘ ব্যাগ ঘুরাতে ঘুরাতে ভেতরে চলে গেছে। তানভির চাবি রেখে সরাসরি নিজের রুমে চলে গেছে। মাগরিবের পর পর ই আবিরের কল আসছে। মেঘ কল রিসিভ করতেই আবির জিজ্ঞেস করল,


“বাসায় আসছিস?” “জ্বি।” “কি করছিস?” ” আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।” “হ্যাঁ বল। ” কিছু একটা ভেবে মেঘ আবারও থেমে গেল। আস্তে করে বলল, ” কিছু না।” “কোনো সমস্যা?” “নাহ।পরে জানাবো আপনাকে। ” “অপেক্ষায় রইলাম।”


মেঘ ঘন্টাদুয়েক পর নিচে আসছে। মীমরা না থাকায় বাসাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আলী আহমদ খান আজ একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পরেছেন। হালিমা খান আর মালিহা খান সোফায় বসে গল্প করছেন। মেঘ হালিমা খানের কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে। তানভির সন্ধ্যা থেকে বাসায় নেই। বেশকিছুক্ষণ যাবৎ আবির মেঘকে মেসেজ-কল দিচ্ছে, মেঘের হাতে ঘড়ি নেই,ফোনও সাইলেন্ট করা তাই বুঝতে পারে নি। হালিমা খানরা উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেছে। মেঘ আনমনে ফোনের পাওয়ার বাটন চাপতেই আবিরের ৭ টা কল আর অনেকগুলো মেসেজ চোখে পড়লো। মেঘ লাফিয়ে উঠে তড়িঘড়ি করে আবিরকে কল দিল। বারবার ওয়ার্নিং দেয়া সত্ত্বেও ঘড়ি রুমে রেখে নিচে এসে রিলাক্সে টিভি দেখছে।সবার ভয়ে ফোন সাইলেন্ট করে রাখাটাও ইদানীং অভ্যাস হয়ে গেছে। আবির রাগান্বিত কন্ঠে বলল,


” তুই কি ভালো হবি না?” ” হবো।” “কবে?” “পরশুদিন।” “আজ কি সমস্যা? ” মেঘ মলিন হেসে বলল, ” ভালো হলে একবারে হতে হবে না? তাই একদিন রেস্ট নিয়ে তারপর ভালো হবো।” “দিনদিন তুই বড্ড ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস।” “জ্বি। আর আমার গুরু স্বয়ং সাজ্জাদুল খান আবির।”


আবির না চাইতেও হেসে ফেলল। মুখের গম্ভীর ভাব মুহুর্তেই সরে গেছে। ধীর কন্ঠে বলল, ” তানভির কোথায়?” “জানি না।” “সমস্যা কোনো? ” “আমি কি জানি? কার মনে কি চলে সেটা দেখার দায়িত্ব কি আমার?” “না। কিন্তু তোর নামে বিচার দিলো কেন?”


মেঘ এপর্যায়ে আঁতকে উঠল।মনে মনে প্রচুর ভয় পাচ্ছে। যদি সত্যি সত্যি মোখলেস মিয়ার কথা বলে দেয় তখন কি হবে! মোখলেস মিয়া সম্পর্কে বন্যার দাদা হয়। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও বন্যার আব্বুর সাথে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক আছে। কিছুদিন আগে মেঘ এমনিতেই বন্যাদের বাসায় গিয়েছিলো। তখন মোখলেস মিয়া ওদের ডেকে সিঙ্গারা আর পিঁয়াজু খাইয়েছিল। সেখানেই মজার ছলে বন্যাকে বিয়ের কথা বলেছিল। বন্যা আর মেঘ সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। তবে আজ বন্যাদের বাসায় যাওয়ার সময় আবারও সেই মোখলেস মিয়ার সাথে দেখা। শালী শালী ডেকে রিক্সা থামিয়ে মেঘের খোঁজ-খবর নিয়েছে। ওনার কথা মাথায় ছিল বলে তানভিরকে রাগানোর জন্য ইচ্ছে করেই ওনার বিয়ের ঘটকালির ব্যাপারে বলেছে। আবিরের কানে এসব গেলে আস্ত রাখবে না। মেঘ ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল,


“কি বিচার দিয়েছে? ” “সেসব বাদ দে। ও আছে কোথায়? ফোন দিচ্ছি রিসিভও করছে না। কি হয়েছে একটু বলবি?” মেঘ নাক টেনে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, “ওহ! আপনি এতগুলো কল ভাইয়ার জন্য দিচ্ছিলেন। আমি আরও ভাবছিলাম আমার জন্য। ভাইয়া বাসায় আসলে জানাবো আপনাকে। বাই।” “কল কাটলে স্বপ্নে এসে থাপ্পড় দিব বলে রাখলাম।” “স্বপ্নে আমায় থাপ্পড় না দিয়ে টর্চ লাইট নিয়ে নিজের ভাই কে খুঁজতে থাকুন। সেটা বেশি কাজে দিবে। এই বাড়ির সবাই স্বার্থপর। শুধু নিজের স্বার্থ বুঝে। ”


“আপনার লেকচার হলে অনুগ্রহ করে বলুন কি হয়েছে? বন্যার কিছু হয়েছে?” “বাহ! বাহ! অসাধারণ। এখন বন্যার খোঁজও নিচ্ছেন। অথচ আমি জলজ্যান্ত একটা মানুষ ৮ মিনিট ৪২ সেকেন্ড যাবৎ কথা বলছি আমাকে একটা বার জিজ্ঞেস করলেন না আমি ঠিক আছি কি না! আল্লাহ ওনার আগে আমায় উঠায় নেও। স্বার্থপর দুনিয়ায় আমিও আর থাকতে চাই না।” আবির শ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কন্ঠে বলতে শুরু করল,


” আর যাই করিস না কেন, তানভিরের পরীক্ষা চলছে বিষয়টা মাথায় রাখিস। এমনিতেই পড়াশোনা করে না, পরীক্ষাগুলো ভালোভাবে শেষ করতে পারলে অন্ততপক্ষে অনার্স পাশ তো করতে পারবে। ” “যার ভাই তার খবর নাই আরেকজনের চিন্তায় ঘুম আসছে না। এত দুশ্চিন্তা করে কি করবেন শুনি? কেজি দরে দুশ্চিন্তা বিক্রি করবেন? তার থেকে বরং আমার উপর ছেড়ে দেন। আমি সবকিছু দেখে নিব। রিলাক্সে ঘুমান আপনি।” আবির শুকনো মুখেই বিষম খেলো। কাশতে কাশতে বলল, ” আমার দুশ্চিন্তার গুরু স্বয়ং মাহদিবা খান মেঘ।”


মালিহা খান খেতে ডাকছে তাই তাড়াতাড়ি কল কেটে মেঘ খেতে চলে গেছে। খাবার টেবিলে কেবল তিনজন। মেঘ কোনোরকমে অল্প খাবার খেয়ে একটা আচারের বক্স নিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখছে আর আচার খাচ্ছে। মালিহা খান রুমে চলে গেছেন। হালিমা খান রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছেন। এমন সময় তানভির বাসায় আসছে। অন্তরের জ্বালাপোড়া চোখেমুখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেঘের করা দুষ্টামি বুঝতে পেরেও তানভির শান্ত থাকতে পারছে না। তানভিরকে দেখেই হালিমা খান রান্নাঘর থেকে বলে উঠলেন,


” তুই কি একটু শান্তি দিবি না আমাকে? পরীক্ষা দিয়ে আসছিস কিছু খাস ও নি। তোদের নিয়ে আর কত টেনশন করবো?” তানভির এক পলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে। মেঘ তানভিরকে দেখেই উচ্চস্বরে বলে উঠল, “আম্মু তুমি রিলাক্সে থাকতে পারো।” সঙ্গে সঙ্গে তানভিরকে শুনিয়ে শুনিয়ে আস্তে করে বলল, “কারণ ভাইয়ার জন্য চিন্তা করার মানুষ আছে।”


তানভির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ফিরে তাকাল। চিবিয়ে চিবিয়ে বিড়বিড় করতে করতে রুমে চলে গেছে। এক সময় তানভির নিজেই মালিহা খানকে রিলাক্সে থাকতে বলেছিল। আবিরের জন্য চিন্তা করার মানুষ আছে শুনে সেদিন মেঘের মনের আকাশে মেঘ জমেছিল। তাই আজ মেঘ ইচ্ছে করেই ভাইকে রাগাচ্ছে। সকাল ১১ টার উপরে বেজে গেছে অথচ তানভিরের খবর নেই। শুক্রবার বলে কেউ তেমন কিছু বলছেও না৷ মেঘ দুবার খেতে গিয়েও ফিরে আসছে। ভাই কে রাগিয়ে একা খেতেও ইচ্ছে করছে না। তানভির গতরাতও খায় নি। অনেকক্ষণ ডাকার পর তানভির রুমের দরজা খুলে দিয়েছে। মেঘ ভ্রু গুটিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,


” বিরিয়ানি খাবা? ” “না। ” “আমি রান্না করেছি৷ ” “খিদে নেই। ” “আমার আছে। সকাল থেকে খায় নি। চলো” রাত থেকে খাওয়া নেই। ঝগড়া করার মতো এত এনার্জিও নেই। তাই তানভির শান্ত স্বরে বলল, “ফ্রেশ হয়ে আসছি। ” “তোমার ফোনের লকটা খুলে দিয়ে যাও।” “কেনো?” “আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই।”


তানভির ফোনের লক খুলে মেঘকে ফোন দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেছে। মেঘ তড়িঘড়ি করে বন্যার নাম্বার খুঁজতে লাগলো। Bonna, Megh’s Friend, Bonu’s Friend সব নামে খোঁজে ফেলেছে। তবুও পাচ্ছে না। বন্যার নাম্বার পুরোটা মুখস্থও নেই। মেঘ চটজলদি নিজের রুমে গিয়ে ফোন থেকে বন্যার নাম্বার বের করে কয়েকটা ডিজিট লিখতেই “Miss Egoistic” নাম আসছে। এমন নাম দেখে মেঘ নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল। মেঘ আনমনে বলে উঠল,


“আবির ভাইয়ের ফোনে আমার নাম্বার কি নামে সেইভ করা?” মেঘ রুম থেকে বের হতে হতে বন্যাকে কল দিল। বন্যা রিসিভ করে স্বাভাবিকভাবে সালাম দিল। মেঘ মুড নিয়ে বলল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন?” “জ্বি ভালো। তুই ওনার নাম্বার থেকে ফোন কেন দিয়েছিস?” মেঘ শীতল কন্ঠে বলল, “ভাইয়া অসুস্থ হয়ে গেছে। ” বন্যা উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো, “কি হয়েছে ওনার?”


“তোদের বাসায় চা খেতে গিয়ে একটা ১ গ্রামের পিঁপড়া খেয়ে ফেলছিল। পিঁপড়াটা যেতে যেতে গলায় একটা কামড়ও দিয়েছে৷ আমি বার বার বলেছি বেশি করে পানি খেতে কিন্তু ভাইয়া পানি না খেয়ে অপলক দৃষ্টিতে কোনদিকে তাকিয়ে হা করে বসে ছিল যাতে পিঁপড়া টা হেঁটে হেঁটে বেড়িয়ে আছে। কিন্তু এত ফাজিল পিঁপড়া বের তো হলোই না উল্টো ভাইয়ার হৃদয়ে গিয়ে ঢুকে পরেছে। গতকাল বিকেল থেকে হৃদয়ে অনবরত কামড়াচ্ছে। আমার ভাইয়ের কোমল হৃদয়টাকে কামড়ে ছিদ্র করে ফেলতেছে। দেশে বন্যা হোক বা না হোক, আমার ভাইয়ার হৃদয়ে বন্যা নিশ্চিত।”


( পিঁপড়া বলতে বন্যার প্রতি তানভিরের প্রেমানুভূতি বুঝানো হয়েছে🤭) “কি আবোলতাবোল কথা বলছিস৷ এটা আবার কেমন রোগ?” ” আবোলতাবোল না রে ভাইয়া রাতে মাথা ঘুরে বিছানায় পড়ে গেছিল। ১২ ঘন্টা বেহুঁশ ছিল, I mean ঘুমে ছিল। মাত্র হুঁশ আসছে, I mean সজাগ হয়ছে।” “এগুলো রোগ লক্ষণ ?” ” ১৬ ঘন্টা না খেয়ে থাকা, টানা ১২ ঘন্টা ঘুমানো কি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে তোর?” “তো এখন কি করবি?”


“এই রোগের চিকিৎসা মনে হয় এখনও আবিষ্কৃত হয় নি। কারো হৃদয়ে…..” তানভির বেড়িয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, “কোন রোগের চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় নি?” মেঘ তাড়াতাড়ি কল কেটে দিয়েছে। তানভির এক দৃষ্টিতে মেঘকে দেখছে। মেঘ ঠোঁট ভিজিয়ে, ঘন ঘন পল্লব ঝাপ্টে বলতে শুরু করল, ” ঐসব বাদ দাও। ভাবছি বন্যার বিয়েটা ভেঙে দিব।” “কিসের বিয়ে?”


“মোখলেস মিয়ার কথা কাল বললাম না তোমায়। সারারাত ভেবে দেখলাম ওনার কাছে বিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। ” “হঠাৎ মাথায় সুবুদ্ধি উদয় হলো কেমন করে? ” “দেখো, মোখলেস মিয়ার চোখে ভালোবাসা থাকলেও হৃদয়ে একটুও জায়গা নেই। দুই বউ, ৬ ছেলে-মেয়ে, ১০-১২ জন নাতি-নাতনীর ভিড়ে আমার বেবিটাকে খোঁজেও পাওয়া যাবে না। এজন্য ভাবলাম আরও কিছুদিন সময় নিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা করে একজনের সঙ্গে বিয়ে দিব। তুমি কি বলো?”


“আমিও তাই বলি। ওর বড় বোনের বিয়ে হোক তারপর না হয় ভেবে দেখবো।” মেঘ আড়চোখে চেয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলল, ” বন্যার বিয়ের ঘটকালি করতে তুমি কিন্তু আমায় সাহায্য করবা৷ ঠিক আছে? ” মেঘের কথা শুনে তানভির কেশে উঠল। ঘুরেফিরে মেঘ সেই একই কাহিনীতেই আটকাচ্ছে। তানভির মুখ ফুলিয়ে উত্তর দিল,


“আমার সময় নেই। ” “ঠিক আছে। প্রয়োজন নেই৷ লেহেঙ্গা কিন্তু তোমার কিনে দিতে হবে এটা মনে রেখো। আর যেই সেই লেহেঙ্গা কিনবো না। বন্যার আর আমার লেহেঙ্গার ডিজাইন সেইম হতে হবে।” “আচ্ছা। ” “এখন চলো খেতে যায়।” “চল।”


আলো আঁধারে কাটছে দিন। কেবল এক সপ্তাহের মধ্যে মেঘের পরীক্ষা করা শেষ। তানভির যে বন্যাকে ভালোবাসে এটা তানভিরের আচরণ আর কথাতেই স্পষ্ট বুঝা যায়৷ কিন্তু বন্যা এখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। তানভিরের প্রতি হৃদয়ে উদিত উষ্ণ অনুভূতিকে পুরোপুরি স্বীকারও করতে পারছে না আবার মন থেকে বাদ ও দিতে পারছে না। মেঘ তবুও হাল ছাড়ছে না।


আবিরের বেঁধে দেয়া সময়ের ৫০ দিন কেটে গেছে। আগামীকাল ১০ অক্টোবর, আবিরের জন্মদিন। মেঘ সন্ধ্যার পর থেকে কথা বলার জন্য রেডি হয়ে বসে আছে। আবিরের নিষেধাজ্ঞার কথা মাথায় রেখে তেমন কোনো আয়োজন করে নি। প্রতিদিনের মতো আজও রাত ১০.৩০ নাগাদ আবিরের কল আসছে।


সব কাজ শেষ করে শুয়ে মেঘের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমানো টা আবিরের বাজে স্বভাব হয়ে গেছে। অন্যদিন কিছুক্ষণ কথা বলেই মেঘ কল কেটে দেয় তবে আজ তার ব্যতিক্রম। ২ মিনিট কথা বলে দুজনেই ৫ মিনিট নিরবতা পালন করে কিন্তু কেউ কল কাটে না। মেঘের মন খারাপ হবে ভেবে আবির হাজার ব্যস্ত থাকলেও সচরাচর মেঘের কল কাটে না। এমনকি মুখ ফুটে বলেও না যে “ব্যস্ত আছি”। আজও তেমনটায় ঘটছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সময়ের পার্থক্য মোটামুটি ২ ঘন্টা হওয়ায় এখানে ১১:৪৫ বাজায় সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই রাত ০১:৪৫ বেজে গেছে। মেঘ আপন মনে গল্প করছে আর আবির মনোযোগী শ্রোতার মতো মেঘের সব কথা শুনছে। প্রয়োজনে নিজেও অল্পস্বল্প উত্তর দিচ্ছে। রাত ঠিক ১২ টা বাজতেই মেঘ মোলায়েম কন্ঠে বলতে শুরু করলো,


“আপনি আমার চঞ্চল হৃদয়ের এক টুকরো সিদ্ধি, পরিত্যক্ত শ্বাপদসংকুলের মোহগ্রস্ত দিনলিপি। চরাঞ্চলে জন্মানো শরতের শুভ্রতার প্রতীক, ভোরের শিশির ভেজা ঘাসে শিউলি ফুলের বৈচিত্র্যময় কম্রের মতোন আপনার জন্মদিন অনুষঙ্গের উষ্ণতায় ছেয়ে যাক। আপনার সকল অপূর্ণ ইচ্ছে পূর্ণতা পাক।” ‘শুভ জন্মদিন ‘


আবির একদম স্তব্ধ হয়ে গেছে। নিজের জন্মদিনের কথা মনেই ছিল না তার। মেঘের মায়াভরা কান্না জড়িত কন্ঠ শুনে আবিরের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেছে। মেঘ উবু হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মেঘের কান্নার শব্দে আবিরের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা। মাসখানেক মেঘের আচরণে বিন্দুমাত্র খারাপ লাগা প্রকাশ পায় নি। সারাক্ষণ উল্লাস আর খুনসুটিতেই মেতে থাকতো। অপ্রসন্ন হৃদয়ের ভাঁজে জমতে থাকা অজস্র অভিমানগুলো জাহির করতে একটা পুরুষ্টু বক্ষঃস্থল প্রয়োজন। মোহমায়ায় জড়ানো একটা বিশ্বস্ত বুক। মেঘের কান্নার শব্দে দিশেহারা আবির। শীতল কন্ঠে শুধালো,


” এই স্প্যারো, এভাবে কাঁদছিস কেনো?” মেঘ বালিশে মুখ গুঁজে কান্না আড়াল করার চেষ্টা করছে। আবিরের নেশাক্ত কন্ঠের আবদার, “ভিডিও কল দেয়?” মেঘ তড়িঘড়ি করে শুয়া থেকে উঠে বসে ভেজা কন্ঠে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “না।”


“আমার জন্মদিনে সামান্যতম আবদার করার অধিকার যদি আমার না থাকে তাহলে এই জন্মদিনকে আমি সারাজীবনের জন্য ব্যান করবো।” মেঘ আস্তে করে বলল, “ব্যান করতে হবে না, দিচ্ছি কল।” আবির ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসলো। মেঘ চোখ মুছতে মুছতে ভিডিও কল দিল। রুম অন্ধকার থাকায় স্পষ্ট দেখা না গেলেও ফোনের ক্ষুদ্র আলোতে মেঘের ধবধবে ফর্সা মুখ, ঝলমল করা ভেজা চোখ আর লাল হয়ে থাকা নাকের ডগা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আবির নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আদরমাখা কন্ঠে বলল, “এবার বলুন, আমার আবেদনময়ীর আবদার কি?”


আবিরের ছুরির ন্যায় সূক্ষ্ম নেত্রের চাহনিতেই মেঘ ঘায়েল হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর তান্ডব চলছে, শ্বাসপ্রশ্বাস এলোমেলো। মেঘের দুচোখ পানিতে টইটম্বুর হয়ে আছে, কেবল অশ্রু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা। বুক খুঁড়ে আসা কান্না গিলে মেঘ দূর্বল কন্ঠে জানাল, ” আপনাকে আমার সামনে দেখতে চাই।” আবির মুচকি হেসে বলল, “তারপর? ”


“আপনি কবে আসবেন? আর কতদিন? আপনার কি একবারের জন্যও আমার কথা মনে হয় না? কেনো বুঝেন না আপনি, খুব মিস করছি আপনাক।” কঠিন বাস্তবতায় খোলস বন্দি করে রাখা নিজের অনুভূতিগুলো দীর্ঘনিশ্বাসের আড়ালে লুকিয়ে আবির কোমল কন্ঠে বলল, ” আমি অবুঝ নয়, মেঘ।” মেঘ আকুল কন্ঠে আবারও শুধালো, ” আসবেন কবে আপনি? ” “সেটা আমার থেকে ভালো আপনার জানার কথা। আপনিই বলুন।” “আরও ১০০ দিন। আমি বোধহয় মরেই যাব।”


আবির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই মেঘ ভয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। আবিরের রুমে আলো জ্বলছে, এয়ারকন্ডিশন অন থাকা সত্ত্বেও আবিরের শরীর ঘামছে। টেবিল থেকে একটা অপ্রয়োজনীয় কার্ড হাতে নিয়ে বাতাস করছে। মেঘ গভীর মনোযোগ দিয়ে আবিরকে দেখে। হাত দিয়ে বাতাস করার কারণে ফোন কিছুটা দূরে সরিয়েছে, মেঘের নজর নগ্ন লোমশ বুকে পড়তেই লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিয়েছে। আবির রুমের ছাদের দিকে তাকিয়ে আনমনে কিছু ভাবছে। মেঘ পল্লব ঝাপ্টে আবারও তাকালো। এবার নজর পরে থুতনির নিচে থাকা একটা কালো তিলের দিকে। সেইভ করার কারণে দাঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা তিলটা আজ একটু বেশিই ঝলমল করছে। মেঘ সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ঘোরে ডুবে গেছে। আবির নেশাক্ত কন্ঠে ডাকল,


“এইযে প্রলয়ংকরী কতবার বলল এভাবে তাকালে, কুচ কুচ হোতা হে তুম নেহি সামঝো গে।” মেঘ লাজুক হেসে চোখ ঘুরাতেই চেঁচিয়ে উঠল, “আপনার পেছনে কে?” মেঘের চেঁচানোতে আবিরও লাফিয়ে উঠেছে। আশেপাশে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল, “কোথায় কে?”


“আমি দেখেছি, কে জানি চলে গেছে এখান থেকে। ” “রুমে কেউ নেই। পর্দা নড়ছে সম্ভবত এটায় চোখে পড়ছে।” “আপনি আমায় মিথ্যা কথা বলছেন। রুমে নিশ্চিত কেউ আছে৷ আপনি যে একদিন বলেছিলেন আপনার বউ আছে। সে কি আপনার রুমে?” “ঐ ঐ একদম চুপ৷ কথায় কথায় চরিত্রে দাগ দিবি না বলে দিলাম। আমার চরিত্র বেলীফুলের মতো সুগন্ধময় আর পবিত্র। ক্যামেরা ঘুরাচ্ছি নিজের চোখে দেখ।”


আবির ক্যামেরা ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ রুম ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। সবশেষে মেঘ মলিন হেসে বলল, “আচ্ছা মানছি।” “মনের ভেতর শুধু সন্দেহ আর সন্দেহ। গরম পানি খেয়ে অবিশ্বাসের চারাগুলো মেরে অন্ততপক্ষে কিছুসংখ্যাক বিশ্বাসের চারা রোপণ করিয়েন।” “হুমমমম। ঘুম পাচ্ছে।” “ঘুমান।”


বেশকিছু দিন কেটে গেছে। মেঘ আজ সকাল সকাল ভার্সিটিতে এসে বসে আছে। বন্যা আসতেই ছুটে গিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে একটা কিটকেট চকলেট ধরিয়ে দিল। বন্যা অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ” এত খুশি কেনো আজ?” মেঘ একটা চকলেট ছিঁড়ে খাচ্ছে। মেঘের দেখাদেখি বন্যার নিজের চকলেটটা খেতে শুরু করলো। মেঘ আর বন্যা পাশাপাশি হাঁটছে। মেঘ আচমকা বলে উঠল, ” শুক্রবারে ভাইয়ার জন্য বউ দেখতে যাব।” সঙ্গে সঙ্গে বন্যার পা থেমে গেছে। গলায় চকলেট আঁটকে গেছে। নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে। মেঘ পিছনে ঘুরে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “ক্লাসে চল, মেয়ে দেখাচ্ছি।”


বন্যা চেহারায় বিষন্নতার ছাপ। অর্ধেক খাওয়া চকলেট পুনরায় মেঘকে ফেরত দিয়ে দিয়েছে। ব্রেঞ্চে বসতেই মেঘ একটা মেয়ের ছবি বের করে দিয়েছে। বন্যা না তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল, “আমাকে দেখাচ্ছিস কেনো?” “তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তুই দেখবি না?” “দরকার নেই।” “দেখ না।”


বন্যা এবার ছবির দিকে তাকালো৷ মেয়েটা দেখতে তানভিরের থেকেও অনেক বেশি গুলুমুলু। গালে টুলও পড়ে। দেখতো বেশ সুন্দরী। বন্যা ঢোক গিলে ছোট করে বলল, “ভালো।” “শুধু ভালো? আমার কিন্তু অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে। আজ আবির ভাইকে দেখাবো। ওনারও ঠিক পছন্দ হবে।” বন্যা অন্যদিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “তোর ভাইয়ের পছন্দ হয়েছে?” “ভাইয়া তো একদম পাগল হয়ে গেছে। আজ বললে আজ ই বিয়ে করে ফেলবে। তাছাড়া ছবিটাও ভাইয়ায় দিয়েছে আমাকে।”


মেঘ মনে মনে বলল, “আল্লাহ মিথ্যা বলছি বলে মাফ করো, প্লিজ।” বন্যা ভ্রু কুঁচকে মেঘের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ” ভালোই হলো তুই তোর ভাবি পেয়ে গেছিস।” “হ্যাঁ। আগামী শুক্রবার দেখতে যাবো। তারপর বিকেলে তোর সঙ্গে দেখা করবো। ঠিক আছে? ” “আমার সঙ্গে দেখা করতে হবে কেনো?” “মেয়ে পছন্দ হয়েছে কি হয় নি তা জানাতে হবে না?” “তার প্রয়োজন নেই। বিয়ে হলে নিশ্চয় শুনবো। ”


বন্যার গলা কাঁপছে। কথা বলতে পারছে না। মেঘ আড়চোখে তাকিয়ে বন্যার হাবভাব দেখে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “তুই বস, আমি আবির ভাইয়ের সাথে কথা বলে আসছি।” বন্যা ব্যাগে মুখ গুঁজে বসে আছে। মেঘ ফোন নিয়ে বেড়িয়ে গেছে৷ ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর মিষ্টি, মিনহাজদের সঙ্গে রুমে আসছে। বন্যা তখনও মুখ গুঁজেই বসে আছে। মিষ্টি ডাকতেই বন্যা মুখ তুলে তাকালো৷ চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। বন্যা বরাবরই আবেগ চেপে রাখে৷ তার রাগ অভিমানের বহিঃপ্রকাশও তেমন ঘটে না। কিন্তু আজ যেন বন্যার অন্য রূপ ভেসে উঠেছে। মিষ্টি মাঝখানে বসেছে। মেঘ আর বন্যা দু-পাশে। বন্যার দৃষ্টি জানালার দিকে, এক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে আছে। মেঘ মিষ্টিকে একটা একটা করে ড্রেস দেখাচ্ছে। তানভিরের বিয়ের উপলক্ষে অনলাইনে লেহেঙ্গা, শাড়ি পছন্দ করছে৷ বন্যা সেসব না দেখলেও সবকিছু ঠিকই কানে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে মিষ্টি বলল,


“আবির ভাই না বড়। আবির ভাইয়ের বিয়ে রেখে তানভির ভাইকে বিয়ে করাবে?” “আবির ভাইয়ের বউ ফিক্সড মানে আমি তো ফিক্সড ই। এখন শুধু দেশে ফেরার অপেক্ষা। এরমধ্যে ভাইয়ার জন্য মেয়ে ঠিক করে রাখবো। প্রয়োজনে আংটি পড়িয়ে রাখবো তারপর দুই ভাই-বোন একসঙ্গে বিয়ে করবো। আমিও বাসাতেই থাকবো, ভাইয়াও বাসায় থাকবে। শুধু নতুন ভাবির আগমন ঘটবে।” মিষ্টি বন্যার দিকে তাকিয়ে বলল, ” তুই না বলছিলি বন্যাকে ভাবি বানাবি” “তখন মজা করে বলছিলাম। কোথায় আমাদের ব্রিলিয়ান্ট বন্যা আর কোথায় আমার বেপরোয়া, ভন্ড ভাই তানভির। দু’জনকে মানাবে নাকি? ”


“কিন্তু… ” “কোনো কিন্তু না৷ বন্যার সামনে আবার এসব কথা বলছিস? তুই জানিস না বন্যার এসব শুনতে ভালো লাগে না। আমার ভাইকে বন্যা দুচোখের এক চোখেও সহ্য করতে পারে না। সেখানে আমার ভাইকে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না। চুপ কর।” বন্যা নির্বাক চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘের চোখে মুখে উজ্জ্বলতার ছিটেফোঁটাও নেই । সিরিয়াস মুডে কথাগুলো বলেছে। বন্যার অন্তর জ্বলছে, চোখ রক্তাভ হয়ে আছে, টলমল করছে চোখ। যেকোনো মুহুর্তে বাঁধ ভাঙা কান্না শুরু হবে। বন্যা দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলল,


“সাইড দে।” “কোথায় যাবি?” “ওয়াশরুমে।” ক্লাস শেষে বেড়িয়ে আসতেই তানভিরের সঙ্গে দেখা৷ মেঘই মেসেজ করে আসতে বলেছে। ইদানীং অফিসে যাওয়ার কারণে তানভিরের ড্রেসআপেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। আজ একটা চেক শার্ট ইন করে পড়েছে,চোখে সানগ্লাস হাতে বন্যার দেয়া সেই ঘড়িটা। বন্যা একপলক তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। আজ সালাম পর্যন্ত দিচ্ছে না। কাছাকাছি আসতেই তানভির সালাম দিল। বন্যা উত্তর দিচ্ছে না দেখে মেঘ ই সালামের উত্তর দিল। তানভির বন্যাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল,


“কেমন আছো?” বন্যা নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ নিজের ব্যাগটা গাড়িতে রেখে আহ্লাদী কন্ঠে বলল, “ভাইয়া আমি ওদের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি। তোমরা দাঁড়াও।” মেঘ দ্রুত সরে গেছে। তানভির এক দৃষ্টিতে বন্যাকে দেখছে। বন্যার উত্তর না পেয়ে দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করল, “তোমার কি কানে সমস্যা? কথা শুনো না?” বন্যা চোখ তুলে তাকাতেই তানভির বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠেছে। বন্যার ফ্যাকাশে চোখ মুখ দেখে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,


“কি হয়েছে তোমার? তুমি কি অসুস্থ? ” “না। ঠিক আছি।” “তোমাকে দেখে একদম ঠিক লাগছে না। ডাক্তার দেখিয়েছো?” ” আমি চলে যাচ্ছি, মেঘকে বলে দিয়েন।” বন্যা পা বাড়াতেই তানভির বন্যার বাহু চেপে ধরে শক্ত কন্ঠে বলল, “এক পা বাড়ালে এর ফলাফল খুব খারাপ হবে।” মেঘকে আসতে দেখেই তানভির হাত ছেড়ে রাগী স্বরে বলল, “চুপচাপ গাড়িতে বসো।” মেঘ এসে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,


“ভাইয়া বন্যাকে মোখলেস দুলাভাই এর দোকান পর্যন্ত নামিয়ে দিও, প্লিজ।” তানভির আর বন্যা দু’জনেই অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। মেঘ ফিক করে হেসে বলল, “উপস, সরি। মোখলেস দুলাভাই না মোখলেস দাদা।” তানভির আবারও বলল, “বন্যা গাড়িতে বসো।” মেঘও বলল, ” তাড়াতাড়ি আয়।”


তানভির গাড়ি চালাচ্ছে। মেঘ বন্যাকে এক এক করে জামা দেখাচ্ছে। শুক্রবারে কি পড়বে সেসব ভেবে মেঘ ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। বন্যা না পারতেও মেঘের এসব পাগলামি সহ্য করছে৷ তানভির গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে মিররে বন্যাকে দেখছে৷ কিছুদূর যেতেই মেঘ বলল, “ভাইয়া আমাকে দুটা ড্রেস কিনে দিবা?” “দিব নে।” “দিব নে না। আজ ই দিতে হবে।” “আজ ই?”


“হ্যাঁ। তোমাকে না বলছিলাম শুক্রবারে পড়ার জন্য ড্রেস লাগবে। আজ বন্যাও সাথে আছে পছন্দ করতে সমস্যা হবে না। ” তানভির ঘাড় ঘুরিয়ে বন্যার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ” তোমার শরীর ঠিক আছে? শপিং এ যেতে পারবে?” বন্যা উত্তর দেয়ার আগে মেঘ বলল,


“কেন যেতে পারবে না? আমি বলছি মানে যেতেই হবে। তুমি মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাও৷ আব্বুর দুই ডায়মন্ড গাড়িতে বসা। যদি কিছু হয় তাহলে আব্বু তোমার হাড্ডি মাংস আলাদা করে ফেলবে৷ সামনে তাকাও।” ২ টা শোরুম ঘুরে মেঘের জন্য দুটা ড্রেস নিয়েছে আর মীমের জন্য একটা। তানভিরের এক পরিচিত ভাইয়ের ক্লিনিক থেকে বন্যার প্রেশার, হিমোগ্লোবিন টেস্ট করে বন্যাকে বাসা পর্যন্ত নিয়ে গেছে। মেঘ বার বার বলছিল মোখলেস দাদার দোকানের সামনে নামিয়ে দিতে কিন্তু তানভির সোজা বাসার সামনে পর্যন্ত নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় মেঘ জোর করে একটা ড্রেস বন্যাকে দিয়ে শুক্রবারে পড়ার জন্য বলেছে। বন্যা নিতে না চাইলেও তানভির আর মেঘের জোরাজোরিতে বাধ্য হয়েই নিয়েছে। বন্যা বাসায় ঢুকা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর মেঘকে নিয়ে তানভির বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। যেতে যেতে তানভির প্রশ্ন করল,


“তোর বেস্টুর আজ কি হয়েছে? উল্টাপাল্টা আচরণ করছিল কেন?” ” টিকটিকি খামছি মারছে এজন্য মাথা ঠিক নেই।” “টিকটিকি খামছি দেয়?” মেঘ ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিল, “আরে বাবা স্বপ্নে দিছে। স্বপ্নে সব সম্ভব। বুঝছো?”


” ভাইয়া ঠিক ই বলে। এক তাড় ছিঁড়া তুই আরেক তাড় ছিঁড়া তোর বান্ধবী। তোদের যন্ত্রণায় আমরা পাগল হয়ে যাচ্ছি।” “পাবনা যাবা?” “মরতে?” “না ঘুরতে।” তানভির চোখ রাঙাতেই মেঘ দাঁত বের করে হাসলো।


আজ শুক্রবার। সকাল থেকে মেঘ একায় বাড়িঘর মাতিয়ে রেখেছে। এই ফেসিয়াল করছে, এই চোখে শসা লাগিয়ে বসে আছে, চুলের যত্ন নিচ্ছে। তানভির ঘন্টাখানেক সোফায় বসে মেঘের কর্মকাণ্ড দেখছে। একপর্যায়ে মীমকেও টেনে নিয়ে আসছে৷ দু’জন ফিসফিস করে কথা বলছে আর রূপচর্চা করছে। তানভির অনেকক্ষণ খেয়াল করে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “এত সাজুগুজু করার কারণ কি? কোথায় যাবি তোরা?” “ঘুরতে।” “একা যাওয়া যাবে না। যেখানেই যাস আমি নিয়ে যাব।” মেঘ আঁতকে উঠে বলল,


” আজকে অন্ততপক্ষে তোমাকে নিতে পারবো না। ” “তাহলে অনুমতিও আমি দিতে পারবো না। আব্বুকে বলে অনুমতি নিও। আমি ডিরেক্ট ভেটো দিব।” মেঘ কপালে কয়েকস্তর ভাঁজ ফেলে গুরুতর কন্ঠে বলল, ” আজ যেতে না দিলে তুমিই পস্তাবে । আর কিছুই বলব না আমি।”



বোনাস পর্ব 

তানভির চোখ ছোট করে গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল, “আমি পস্তাবো কেনো?” মেঘ এপাশ ওপাশ মাথা দুলিয়ে আস্তে করে বলল, “বলবো না।” “না বললে যেতে দিব না কিন্তু। ” মেঘ চুল উড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে যেতে মেকি স্বরে বলল,


“তুমি যে ভেটো দিবে এটা আমি আগে থেকেই জানতাম। তাই গতকাল রাতেই বড় আব্বু, আব্বু, কাকামনি, বড় আম্মু, আম্মু, কাকিয়া এমনকি আবির ভাইয়ের থেকেও অনুমতি নিয়ে ফেলেছি। কোথায় বিচার দিতে যাবে, যাও।” মেঘ এক প্রকার নাচতে নাচতে রুমে চলে গেছে। মীম ও তার পিছু পিছু ছুটলো। তানভির রাগে কটমট করছে। ইদানীং মেঘের দুষ্টামির মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে, একা সামলানো যাচ্ছে না। মেঘ আগেও দুষ্টামি করতো তবে লিমিটেড। আবির আসার পর মেঘ অনেকটায় শান্ত হয়ে গিয়েছিল। আবিরের সাথে মনোমালিন্যের কারণে ৮-৯ বছর কথা হয় নি বলে সেই দূরত্ব টা কমাতে একটু সময় লেগেছে।


এডমিশন টেস্ট আর আবিরের প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে দুষ্টামির চিন্তা মাথায় ই আসে নি। এখন সেই দুষ্টামির ভূত টা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আবির কোনো কারণে অভিমান করলেও মেঘের সামনে সেই অভিমান ১ মিনিটের বেশি টিকতেই পারে না। আবির যতক্ষণ না হাসবে ততক্ষণ পর্যন্ত মেঘের আজগুবি কথাবার্তা চলতেই থাকে। গতকালও তেমনটায় ঘটেছে। মেঘের একা ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে আবির রাজি ছিল না তাই আবিরকে রাজি করাতে মেঘকে বহু কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে। এক পর্যায়ে “তেলাপোকার আর্তনাদ” গল্প শুনিয়ে আবিরকে পটিয়ে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি নিয়েছে। তবে অবশ্যই শর্তসাপেক্ষে। আবির মেসেজে তিন পাতার এক লিস্ট পাঠিয়েছে যেখানে কি করা যাবে না, কি করা যাবে, কিভাবে চলতে হবে সব নির্দেশনা দেয়া। মেঘ সব শর্ত মেনেই রাজি হয়েছে।


মেঘ আর মীম রেডি হতে রুমে চলে গেছে। তানভির আবিরকে কল দিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল, “ভাইয়া, তোমার কলিজাকে আমি আর সামলাতে পারছি না। সে এখন আমার কলিজা ছিদ্র করে ফেলতেছে।” আবির মৃদু হেসে বলল, “আর তো কয়েকটা দিন। একটু সহ্য করে নে।” “তুমি নাকি ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছো?” “কি করবো বল! এমন ভাবে আবদার করে যে না করতে পারি না।” “কোথায় যাবে কিছু বলছে?” ” বন্যা, মিনহাজ ওদের সাথেই বের হবে বললো।”


” আমি নিয়ে গেলে কি হতো? ইদানীং মনে হয় দুই বান্ধবীর মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। ভার্সিটিতে কেউ কারো সাথে কথা বলে না। গত দুদিন বন্যা ভার্সিটিতেও আসে নি। কল দিলাম রিসিভও করে নি। আজ আবার ঘুরতে যাচ্ছে বিষয়টা ঠিক ভালো লাগছে না।” ” তুই ওদের চিনিস না? মনোমালিন্য থাকলেও দেখবি আজকে ঠিক মিলে গেছে। ” “সেটাও ঠিক। আচ্ছা, পরে কথা হবে। ” “ওকে। ”


৩ টার দিকে মেঘ আর মীম সেদিনের কেনা ড্রেস পড়ে সেজেগুজে বেরিয়েছে। তানভির সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছু বলছে না। মেঘ যেতে যেতে তানভিরের দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে ভেঙচি কাটলো৷ তানভির চোখ রাঙাতেই মেঘ দাঁত কেলিয়ে চলে গেছে। বাসার সামনে থেকে রিক্সা করে দুই বোন গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিল। ফোনের লোকেশন দেখে মিনহাজদের দেয়া ঠিকানা পর্যন্ত পৌঁছেছে। বন্যারা আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। মিনহাজ আর তামিম কাছেই একটা বাসায় থাকে। সেখান থেকে একটা টেবিল এনে একটা খালি জায়গায় রেখে তারউপর কেক এর বক্স রেখেছে। আজ তামিমের মিথ্যা জন্মদিন, সেই উপলক্ষে ই এই আয়োজন।


গত পাঁচদিনে বন্যার সাথে মেঘের ফোনে কথা হয় নি বললেই চলে৷ ক্লাসে দেখা হলেও মেঘ সারাক্ষণ শুধু ভাইয়ের বিয়ে নিয়েই বকবক করেছে৷ গত দুদিন বন্যা ক্লাসেও আসে নি৷ বন্যার ব্যাপারে কথা বলার জন্য গত পরশুদিন বন্যার অনুপস্থিতিতে মিনহাজদের সাথে আলোচনায় বসেছিল মেঘ। মেঘের প্ল্যান জানিয়ে সবার মতামত নিয়ে সবকিছু রেডি করেছে। এমনকি মিনহাজদের থ্রেট ও দিয়েছে যেন আবির বা তানভির কিছু জানতে না পারে৷ সেদিন ই মিনহাজদের আনব্লক করে ফেসবুকে এড করে ওদের দিয়ে একটা গ্রুপ খুলিয়েছে।


সেখানে গত দুদিনে মেঘ আর মীম যা যা করেছে সব আপডেট দিয়েছে। এমনকি গতকাল বিকেলে মীম, আদি আর মেঘ মিলে তানভিরকে জোর করে ফেসিয়াল করিয়েছে সেই ছবি তুলেও গ্রুপে দিয়েছে। বন্যা সব মেসেজ দেখলেও কোনো রিপ্লাই করে নি। তানভিরের ফেসিয়ালের ছবি দেয়ার পর থেকে বন্যা নেটেও নেই। মেঘ সন্ধ্যার পর মিষ্টিকে দিয়ে বন্যার নাম্বারে কল দিয়েছিল। ২-৩ বার কল দেয়ার পর বন্যার বোন কল রিসিভ করে জানিয়েছে বন্যার ১০৪° ফা জ্বর। রাতে মিষ্টি আরও ২-৩ বার কল দিয়ে খোঁজ নিয়েছে কিন্তু মেঘ একবারও কল দেয় নি। আজ দুপুরে মিনহাজ বন্যাকে কল দিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছে। বন্যার শরীরে তখনও জ্বর ছিলই তবে কম। মিনহাজ তামিমের জন্মদিনের কথা জানিয়ে খুব জোরাজোরি করে রাজি করেছে সাথে এটাও বলেছে যেন মেঘের দেয়া ড্রেস টা পড়ে আসে৷ বন্যা তখন জিজ্ঞেস করেছিল,


“আমি যে অসুস্থ এটা কি মেঘ জানে?” মিনহাজ স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিয়েছিল, “জানলেই বা কি মেঘের এখন তোর কথা ভাবার সময় আছে নাকি। সে তার ভাবিকে নিয়ে ব্যস্ত৷ ” বন্যা আর কিছু না বলেই কল কেটে দিয়েছিল। শুধুমাত্র বন্ধুদের কথা ভেবে শরীরে জ্বর নিয়েও বন্যা আসছে। মেঘ দু’হাত পেছনে রেখে সোজা টেবিলের কাছে দাঁড়ালো। মীম মেঘের পাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম দিয়ে বন্যাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল,


“বন্যাপু তুমি কি অসুস্থ?” বন্যা উত্তর দেয়ার আগেই মেঘ মীমের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলল, ” তুই কি বন্যার খোঁজ নিতে আসছিস? যার জন্মদিন তাকে উইশ কর।” মীম আস্তে করে বলল, “সরি। ” মীম পরপর মিনহাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “Happy birthday Tamim Vaiya” মিনহাজ হেসে বলল, “আমি তামিম না, মিনহাজ।” “জানি। এখন আমি কি করব? ”


“না মানে আমার দিকে তাকিয়ে উইশ করলা তাই বললাম। ” “ইচ্ছে করেই করেছি।” “মানে?” মীম মেকি স্বরে শুধালো, “আজ কার জন্মদিন ?” মীম মনে মনে বিড়বিড় করল, “জন্মদিনের নামগন্ধ নেই উইশ নিয়ে পড়ে আছে।” তামিম কথা কাটিয়ে বলল, “আরে বাদ দে। জন্মদিন যার ই হোক কেক সবাই মিলে খাবো।” বন্যা চাপা স্বরে বলল, “তাড়াতাড়ি কর। বাসায় যেতে হবে।” তামিম তপ্ত স্বরে বলল,


“বাইকে আসার সময় ছু*রি টা রাস্তায় পরে ভেঙে গেছে। মেঘকে বলছিলাম ছু*রি নিয়ে আসতে৷” মেঘকে উদ্দেশ্য করে শুধালো, “ছু*রি আনছিস?” মেঘ বন্যার দিকে তাকিয়ে পেছন থেকে এক হাত সামনে এনে টেবিলে রাখতেই মিনহাজ চেঁচিয়ে উঠলো, “তোকে কেক কাঁটার প্লাস্টিকের ছু*রি আনতে বলেছিলাম। তুই মানুষ কাঁ*টার ছু*রি নিয়ে আসলি কেন?” মেঘ বন্যার দিকে তাকিয়ে থেকেই উত্তর দিল, “কোন কাজে লাগে বলা যায় না।” তামিম চোখ বড় করে বলল,


“ভাবি আমাদের সেই মুডে আছে। আজ এসপারওসপার করেই ছাড়বে।” বন্যা ঢোক গিলে শান্ত স্বরে বলল, “ওর মুডে থাকার দিন, ও তো মুডেই থাকবে। কেক কাটলে কাট না হয় আমি চলে যাব।” মেঘ ছু*রি টা এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে কাঠের টেবিলের মাঝ বরাবর ছু*রিটা কুপতে কুপতে রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিল, “আজ এখানে আমি ছাড়া কারো কথা চলবে না।” মেঘের এমন আচরণে বন্যা সহ সবাই কেঁপে উঠলো। মেঘ বন্যার দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল, ” তোকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আমার সাথে নাটক করার চেষ্টাও করবি না। তালবাহানা করলে একদম মে*রে গাছতলায় ফেলে চলে যাব৷”


বন্যা ভ্রু গুটিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে তোর?” স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া বইছে, মেঘ টেবিলের পাশ কাটিয়ে বন্যার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেঘের দু হাত পেছনে। মিষ্টি ফোন বের করে ভিডিও অন করলো। বাকিরা উৎসুক দৃষ্টিতে মেঘকে দেখছে। মেঘের বিধ্বংসী মনোভাব দেখে বন্যা কিছুটা ভীত হয়ে আছে। মেঘ রক্তিম আকাশের পানে তাকিয়ে উষ্ণ নিঃশ্বাস ছেড়ে বন্যার অভিমুখে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,


“আমার হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে যাদের অস্তিত্ব আছে তাদের মধ্যে তুই একজন। আমার প্রাণচঁচল্যে তোর অবস্থান রক্তিম অরুণের মতোন। তুই পাশে আছিস বলে আমি বারংবার ভেঙেচুরে নবরূপে রাঙিয়েছি নিজেকে। তোর প্রতি আমার বিশ্বাস সুবিশাল সমুদ্রের গভীরতায় ন্যায় দৃঢ়। তোকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে আমার প্রাপ্তির খাতা পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আমি জানি, তুই নিজের থেকেও বেশি আমায় ভালোবাসিস আর আমার থেকেও বেশি ভালোবাসিস আমার ভাইকে। তুই বুঝতেও পারছিস না, তানভির ভাইয়ার জন্য তোর বুকের বা পাশে বিদ্যমান ৩০০ গ্রামের হৃদপিণ্ডটা প্রতিনিয়ত ঠিক কতটা অস্বাভাবিকভাবে স্পন্দিত হচ্ছে। ভাইয়ার তমসাচ্ছন্ন ক্ষয়িষ্ণু হৃদয়ের একগুচ্ছ আতশবাজি তুই, বিষাদে ন্যস্ত অভিপ্রায়ের একমাত্র প্রণয়িনী তুই।ভাইয়ার বেপরোয়া জীবন নবলব্ধে সাজানোর উত্তমা উপদেষ্টা হবি তুই। কথা দিচ্ছি, ভাইয়ার জীবনে অদ্বিতীয়া হয়ে থাকবি সারাজীবন।”


বন্যা হতবিহ্বল। দৃষ্টি নিরেট। বন্যার নিস্তব্ধ আঁখি যুগল মেঘের অভিমুখে স্তব্ধ হয়ে আছে। মেঘ হাঁটু গেড়ে বসে পেছন থেকে গোলাপ ভর্তি হাত সামনে এনে বন্যার দিকে ধরে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে শুধালো, ” তুই কি ভাইয়ার কল্পনার রাজ্যের কল্পতরু হবি? তার সঙ্কীর্ণ সাম্রাজ্যের মহারানী হবি?” বন্যার চোখ টলমল করছে। জ্বরের ঘোরে ভার হয়ে থাকা মাথাটা অনবরত ঘুরছে। মসৃণ গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরতে বেশি সময় লাগল না। গত পাঁচদিন গুমরে গুমরে অনেক কেঁদেছে যেটা বন্যার চোখ মুখ দেখলেই বুঝা যায়। বন্যার দুচোখ বেয়ে অনর্গল পানি পরছে। মেঘ মীমের দিকে তাকিয়ে গুরুভার কন্ঠে বলল,


“তোকে কি দাওয়াত দিয়ে আনতে হবে?” মীম থতমত খেয়ে বলল, “সরি, সরি। তোমার কথা শুনে টাশকি খেয়ে ফেলছিলাম।” মীম এগিয়ে এসে মেঘের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে সেই ফুলের তোড়ায় হাত রেখে দু’জন একসঙ্গে উচ্চস্বরে বলে উঠল, “আপনি কি আমাদের ভাবি হবেন? তানভির খানের একমাত্র বউ হবেন?” বন্যার শরীর কাঁপছে। ভেজা চোখে মেঘ আর মীমের দিকে তাকিয়ে আছে। তামিম রাশভারি কন্ঠে বলল, “বন্যা ভাবি তাড়াতাড়ি রাজি হোন, নয়তো মেঘ ভাবির মাথা আবারও গরম হয়ে যাবে।” বন্যা সবার দিকে তাকালো। মিনহাজ, তামিম, সাদিয়া একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টি একায় ভিডিও করছে। বন্যা পুনরায় মেঘদের দিকে তাকালো। মেঘ স্ট্রং থাকলেও মীম এক পায়ের উপর নিজের ভর রাখতে না পেরে মেঘের উপর হেলে পড়ছে। মেঘ তড়িঘড়ি করে চেঁচিয়ে উঠল,


“আরে বেডি তাড়াতাড়ি হ্যাঁ বল, পড়ে যাচ্ছি তো।” বন্যা ফুল ধরতে ধরতে বিহ্বলতায় উত্তর দিল, ” ইনশাআল্লাহ, তোমাদের ভাবি হবো আমি।” ততক্ষণে মীমের শরীরের ভরে মেঘ মাটিতে পরে গেছে, মীম মেঘের উপর পরছে৷ বন্যার একহাতে ফুল অন্যহাতে মেঘের ঘাড়ে ধরে আটকাতে গিয়ে নিজের ওড়নায় টান খেয়ে বন্যাও মেঘদের উপর পরছে। বন্যা তখনও একহাতে মেঘের কাঁধ আঁকড়ে ধরে আছে যেন মাথায় চাপ না খায়। মিষ্টির ভিডিও তখনও চলমান। সাদিয়া, তামিম দ্রুত এগিয়ে গেছে৷ সাদিয়া মীমকে টেনে তুলেছে৷ মীমের পায়ে অল্প চাপ খেয়েছে তাই ব্যথায় আর্তনাদ করছে। মিষ্টি মিনহাজকে ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি মেঘ আর বন্যাকে টেনে তুলেছে। ব্যথা পেয়েছে যেমন তেমন নতুন জামাগুলোতে মাটি আর ময়লা লেগে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেছে। মিনহাজ, তামিম আর সাদিয়া হাসতে হাসতে একদম বসে পরেছে। মিনহাজ হাসতে হাসতে বলল,


“আমার জীবনে দেখা সেরা প্রপোজ। সারাজীবন মনে থাকবে। দেখবি তোদের ননদ ভাবির সম্পর্ক সারাজীবন এমনই থাকবে। যাই করতে যাবি একটা করে অঘটন ঘটাবি। ” মেঘ হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ” চুপ থাক নয়তো তোর মুখে কসটেপ লাগায় দিব।” মেঘ বন্যার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,


“সরি, তুই ভাইয়াকে ভালোবাসিস এটা তোকে বুঝাতে পাঁচদিন তোর সঙ্গে খুব বাজে ব্যবহার করেছি। সরি বেবি ” বন্যা কোনো কিছু না বলে আচমকা মেঘকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কান্না ভেজা দুচোখ বেয়ে আবারও পানি ঝরছে। মেঘও বন্যার পিঠ বরাবর দুহাত পেঁচিয়ে ধরেছে। বন্যা এবার হাউমাউ করে কান্না শুরু করেছে। এত বছরের বন্ধুত্বে বন্যাকে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখেনি মেঘ। বরাবরই চুপচাপ আর শান্তশিষ্ট থাকে, কাঁদলেও কখনো কারো সামনে কাঁদে না অথচ আজ সেই মেয়ে খোলা আকাশের নিচে অবাধে কেঁদে চলেছে। মেঘ শীতল কন্ঠে বলল, ” সরি তো। প্লিজ এভাবে কান্না করিস না। আমি জানতাম তুই ভাইয়াকে ভালোবাসিস কিন্তু তোকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে তুই কখনোই স্বীকার করতি না তারজন্য আমাকে এসব করতে হয়েছে। প্লিজ সরি।”


বন্যা কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট কন্ঠে বলতে শুরু করল, “আমি বুঝতেও পারি নি কবে আমি ওনাকে এত বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। তুই সেদিন ঐ মেয়ের ছবি দেখানোর পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারি নি, খেতে পর্যন্ত পারি নি। আমার নিঃশ্বাস নিতে পর্যন্ত কষ্ট হচ্ছিলো। সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল আমি সব হারিয়ে ফেলছি। কি যেন নেই আমার৷ চারপাশ শূন্য লাগছিল আমার৷ আমি ওনাকে অনেক ভালোবাসি বেবি৷ ” মেঘ বন্যাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দুচোখ মুছে শান্ত কন্ঠে বলল,


” আমার ভাবি হতে তুই সত্যি রাজি তো ? ” বন্যা মলিন হেসে বলল, “রাজি। কিন্তু… ” মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে জানতে চাইল, “কিন্তু কি?” “তুই যে বলছিলি আজ মেয়ে দেখতে যাবি?” ” লে হালুয়া! তুই কি ছেলে নাকি?” বন্যা শ্বাস ছেড়ে রাগী স্বরে বলল, “দূর ফাজলামো করিস না। ঐ মেয়েটা কে ছিল?” “আমি চিনি না। ফেসবুকে পেয়েছিলাম। ” “ফাজিল মেয়ে। কিন্তু বললি যে তোর ভাই রাজি?” “ওমা। ভাইয়া তোকে লাভ করলে রাজি হবে না?” “তোর ভাই আমায় পছন্দ করে?” “নাহ। ডিরেক্ট ভালোবাসে। ” “তোকে বলছে?” মেঘ বিষন্ন চিত্তে তাকিয়ে বলল,


“বললে আজ আমাদের জায়গায় ভাইয়া থাকতো আর আমরা ক্যামেরাম্যান থাকতাম। বুঝলি? অনেক চেষ্টা করার পরও ভাইয়া যখন কিছু বলছিল না তখন বাধ্য হয়ে আমাকে এই পথ বেঁচে নিতে হয়েছে। ভাইয়া কবে বলবে সে আশায় থাকলে আমি মরে ভূ*ত হয়ে যেতাম। তার থেকে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে ফেললাম।” মেঘ একটু থেমে আবার বলে উঠল, “আবির ভাইয়ের মতো ডায়লগ দেয়,


তোকে বৌমনি ডাকার জন্য যদি অধিকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয় তবে আমি সেই অধিকারনামায় স্বাক্ষর করে হলেও তোকে বৌমনি ডাকবো৷ তুই আমার ভাবি মানে আমার ই ভাবি। পৃথিবীর কেউ তোকে আমার ভাবি হওয়া থেকে আটকাতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। ” বন্যা আনমনে হেসে বলল, “ইনশাআল্লাহ। ”


মীম এক পা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মেঘদের কাছে আসতে আসতে বলল, ” বন্যাপু, আমি যে তোমার ছোট ননদ এটা কি তোমার মনে আছে?” বন্যা আলতোভাবে মীমকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বলল, “ওলে সোনা। তুমি আমার কিউট ননদী, তোমাকে আমি কিভাবে ভুলবো বলো। ” মেঘ ভেঙচি কেটে বিড়বিড় করে বলল, “আজ কিউট না বলে।” মিনহাজ ঠাট্টার স্বরে বলে উঠল,


” আপনি কিউট না বলেই একজন নিজের জান জীবন দিয়ে আপনাকে আগলে রাখে। আপনার দিকে কেউ নজর দেয়ার আগেই আধমরা করে ফেলে। আপনাদের মুখে এসব সাজে না ভাবি। বরং আমি আর তামিম এসব বললে মানা যেতো। ” তামিম পাশ থেকে বলল, “সহমত বন্ধু।” বন্যা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “তামিমের না জন্মদিন? কেক কাটব না?” মেঘ ভেঙচি কেটে বলল, ” আমার ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করে আসছি কি তামিমের জন্মদিন করতে নাকি?” মেঘ নিজের হাতে বক্স থেকে কেক বের করল। কেক এর উপর লেখা, প্রিয় বন্যা,


“ভাবি হবি?” হ্যাঁ/হ্যাঁ মেঘ বলল, ” দুটা অপশন দিলাম যেকোনো একটা বেছে নিতে পারিস। ” “এখানে দুটা অপশন? ” ” অবশ্যই। একটা আমার অপশন আরেকটা মীমের অপশন। ” কেক কেটে খেয়ে সবাইকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিল৷ সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় না গেলে নিশ্চিত বকা খাবে। রেস্টুরেন্টে বন্যা আর মেঘ পাশাপাশি বসে খাচ্ছে আর ফিসফিস করে গল্প করছে। মেঘ সবার উদ্দেশ্যে হুঙ্কার দিল,


” আমার ভাই কিংবা আমার ওনার কানে যদি আজকের ঘটনার একাংশ যায় তাহলে তোদের সাথে চিরদিনের জন্য বন্ধুত্ব ভেঙে দিব। আর বন্যা, তোকেও সাবধান করছি। তুই আমাদের ভাবি কিন্তু তানভির ভাই এর প্রেমিকা না। ভাইয়া প্রপোজ না করা পর্যন্ত তুই যদি কোনো প্রকার আলগা পিরিত দেখাস তাহলে তোকেও দেখে নিব।” “ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি কর। জ্বর বাড়তেছে, শরীর খারাপ লাগছে। বাসায় চলে যাব।” “রিক্সা দিয়ে এতদূর গেলে আরও বেশি কষ্ট হবে। দাঁড়া ভাইয়াকে কল দিচ্ছি।” “এই না না, প্লিজ। ওনাকে কল দিস না।”


“চুপ করে বসে থাক। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে বউ বানানোর যোগ্যতা না থাকলে বিয়ে কিভাবে দিব?” মেঘ তানভিরকে কল দিয়ে আসতে বলেছে। তানভিরও চটজলদি রেডি হয়ে রওনা দিয়েছে। ওদের খাওয়া শেষ হতে হতে তানভির চলে আসছে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে তানভিরের সামনে আসতেই তানভির পর পর তিনজনের দিকে তাকালো। তিনজনের জামার অবস্থা দেখে তানভির গম্ভীর কন্ঠে শুধালো, “তোরা কি ফুটবল খেলতে গেছিলি?”


মেঘ একটা বক্সে “হ্যাঁ” লেখা একটুকরো কেক তানভিরের মুখের সামনে ধরে বলল, “এটা পুরস্কার। এবার হা করো” “কিসের পুরস্কার? আর কেকে হ্যাঁ লেখা কেনো?” “তুমি আমাদের ভালোবাসো না?” “হ্যাঁ” “এটায় লেখা। এখন হা করো।”


তানভির হা করতেই মেঘ কেক মুখে দিয়ে অস্থির হয়ে বলল, “এখন চলো আমার বেবি অসুস্থ। ” মেঘ আর মীম দ্রুত গাড়ির দিকে চলে গেছে। বন্যার মাথা ঘুরছে তবুও আস্তে করে পা বাড়ালো। তানভির উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চাইলো, “কি হয়েছে তোমার?” “জ্বর।”


জ্বর শব্দটা কানে বাজতেই তানভির এগিয়ে এসে বন্যার কপালে হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে বন্যার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছে। মেঘ আর মীম দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে মেঘ দ্রুত দু হাতে মীমের চোখ ঢেকে মেকি স্বরে বলল, ” রোমান্টিক সীন দেখার বয়স হয় নি তোর। ” তানভিরের পেশিবহুল হাতে নজর পড়তেই বন্যা চোখ নামিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, “হাত সরান।” “হাত সরাবো কেনো? এত জ্বর নিয়ে বাহিরে ঘুরছো কোন সাহসে? আর হাতে এত ফুল কেনো? কে দিয়েছে? কেক ই বা কিসের ছিল?” বন্যা কি বলবে বুঝতে না পেরে আস্তে করে বলতে নিল, “তামিমের..”


এটুকু বলতেই তানভির কপাল থেকে হাত সরিয়ে চিৎকার করল, “তামিম তোমায় ফুল দিয়েছে? ” “না না।” “তাহলে কে দিয়েছে?” “মেঘ। ” “সত্যি তো?” “বিশ্বাস না হলে মেঘকে জিজ্ঞেস করুন।” “বনুকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। ডাক্তার দেখিয়েছিলে?” “না। ঔষধ খেলেই কমে যাবে।” তানভির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,


” এই মেয়ে তুমি এত কেয়ারলেস কেনো? সেদিন যে বললাম প্রেশার কম, খাওয়াদাওয়া করতে ঠিক মতো৷ কথা মানলে না কেনো? উল্টো জ্বর বাঁধিয়েছো। ” বন্যা কিছু না বলে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে। তানভির পেছন পেছন গজগজ করতে করতে যাচ্ছে, “কল দিলে কল রিসিভ করে না, কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না, নিজের যত্ন পর্যন্ত নেয় না। এর থেকে রোবটও শতগুণে ভালো। ”


বন্যা সামনে যেতে যেতে তানভিরের কথা শুনে মুচকি হাসলো। বন্যাকে ডাক্তার দেখিয়ে, ঔষধ আর কিছু ফল কিনে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তারপর ওরা বাসায় আসছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে মেঘ মাগরিবের নামাজ পড়েই ঘুমিয়ে পরেছে। ফোন টেবিলের উপর সাইলেন্ট অবস্থায় পড়ে আছে। আবির সন্ধ্যার পর সবার সাথে কথা বলার সময় মেঘের সাথে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু মেঘ আশেপাশে নেই শুনে তেমন জোরও করে নি। কিন্তু মেঘের সঙ্গে কথা বলার জন্য মনটা ছটফট করছে। মেঘদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে তানভির একটা কাজে শহরের বাহিরে গেছে আগামীকাল ফিরবে। মেঘের সাথে কথা বলার জন্য দুই তিনবার আম্মু, মামনির নাম্বারে কল দিয়েছে কিন্তু মেঘের কথা বলতে পারছে না। কাকিয়ার ফোন প্রায় সময় মীমের কাছে থাকে সেই ভেবে কাকিয়াকেও কল দিয়েছে কিন্তু আজ ফোন কাকিয়ার কাছেই। আবির এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ফুপ্পিকে কল দিল। ফুপ্পি এশার নামাজ পড়ছেন তাই জান্নাত ফোন রিসিভ করে সালাম দিল৷ জান্নাতের কন্ঠ বুঝতে পেরে আবির সালামের উত্তর দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,


” কেমন আছো?” “আলহামদুলিল্লাহ ভালো তবে রেগে আছি। ” “কেনো আপু?” “ভাইয়া, আজ আমি তোমার ভাবি হিসেবে কথা বলছি।” “জ্বি ভাবি বলুন।” জান্নাত মনমরা হয়ে বলল, “আমাদের বিবাহ বার্ষিকীতে মেঘকে আসতে দিলে না কেনো? আম্মুকে দিয়ে তোমাকে কতগুলো কল দিলাম, আমি নিজে দিলাম, তানভির ভাইকে পর্যন্ত কতগুলো কল দিয়েছি। এটা কি তুমি ঠিক করলে?” আবির মুচকি হেসে বলল,


“আমি চিন্তা করেছি, আমার বউকে এখন থেকে একা কারো বাসায় যেতে দিব না। একা একা ঘুরলে আমার কথা ভুলে যাবে। এইযে আজ, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেড়িয়ে সারাদিনেও আমার খোঁজ নেয় নি।” “একদম ঠিক করেছে। এত বউ পাগল যেহেতু বউকে নিয়েই চলে যাইতা।” “আমি তো নিয়ে আসতাম ই। কিন্তু আপনার মামা শ্বশুর মানে আমার আব্বাজান শুনলে হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবেন এই ভয়ে আনতে পারি নি। ” “মেঘের আব্বু শুনলে মনে হয় হার্ট অ্যাটাক করতো না?” “জ্বি না। আমার শ্বশুর অনেক স্ট্রং আর ওনাকে যদি আজ বলি মেয়েকে পাঠিয়ে দিতে ওনি এক কথায় রাজি হয়ে যাবেন। ” জান্নাত উত্তেজিত কন্ঠে বলল,


” সত্যি? মেজো মামা জানে? তুমি বলে ফেলছো?” “আমি বলি নি কিন্তু ওনি রাজি। ” “এটা আবার কেমন কথা?” “এটা এমন ই কথা। সেসব বাদ দেন। এখন আমার বাসায় ফোন দিয়ে আমার বউটাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে আমাকে কল দিতে বলুন। বউকে খুব মিস করছি। ” “আমাকে এসব বলতে তোমার লজ্জা লাগছে না?” “আপনি বললেন আজ আপনি আমার ভাবি৷ তাই দেবর হিসেবে ভাবির কাছে আবদার করায় যায়। রাখছি এখন।” “আচ্ছা। ”


জান্নাত যথারীতি হালিমা খানকে কল দিয়ে মেঘের সাথে কথা বলার নাম করে মেঘকে ঘুম থেকে তুলে আবিরের কথা বলেছে। মেঘ তড়িৎ বেগে উঠে ওয়াশরুম থেকে চোখমুখে পানি দিয়ে এসে আবিরকে কল দিল। আবির অডিও কল কেটে ডিরেক্ট ভিডিও কল দিল। মেঘ ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে সালাম দিল। আবির সালামের উত্তর দিয়ে তপ্ত স্বরে বলল, ” কারো কি আমার জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা হয়?” “সরি ঘুমিয়ে পরেছিলাম।” “আমিও সরি। ঘুম ভাঙানোর জন্য। ” মেঘ মুচকি হেসে বলল, ” আপনার এই পরিবর্তনের পেছনে নিশ্চিত কোনো রহস্য আছে৷ কি রহস্য বলুন তো। ” আবির লাজুক হেসে বলল,


” আমি বলুম না আমার শরম করে।” মেঘ চক্ষু যুগল প্রশস্ত করে বলল, “আপনার শরমও আছে?” আবির উত্তর না দিয়ে মেঘের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। মেঘ বার বার ডাকছে কিন্তু আবিরের নজর স্থির৷ মেঘ এবার রাগী স্বরে বলল, ” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?” ” আপনার যেহেতু মনে হয় আমি নির্লজ্জ তাই আজ থেকে আমি নির্লজ্জের মতো আচরণ করব।” মেঘ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে। আবিরের দৃষ্টি মেঘকে বরাবরই নাজেহাল করে সেই সঙ্গে আবিরের উল্টাপাল্টা কথাতে মেঘ এখন হতবিহ্বল। আবির খানিক চুপ থেকে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,


” শুনলাম কোথায় পরে গিয়ে জামাকাপড় নষ্ট করে আসছিস। শরীরে ব্যথা পেয়েছিস?” “না। তেমন ব্যথা পায় নি। কোমড়ে একটু লাগছে।” “কি করতে গেছিলি?” “একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে গেছিলাম। কাউকে বলা যাবে না।” “আমাকেও বলা যাবে না?” “আপনাকে অবশ্যই বলবো। কিন্তু এখন না প্লিজ। আপনি দেশে ফিরলে আপনাকে সারপ্রাইজ দিব।” ” এখন কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে।”


আবিরের মুখের অপ্রত্যাশিত কথা শুনে মেঘ বাগাড়ম্বরপূর্ণ হয়ে গেছে। গলা খাঁকারি দিয়ে আস্তে করে বলল, ” ওহ নো। আপনি আমায় ভয় পান? কতটা?” আবির ভ্রু কুঁচকে চাপা স্বরে বলল, ” আপনাকে না আপনার কর্মকাণ্ডকে ভয় পায়।”