সালমা চৌধুরী
সালমা চৌধুরী

প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | ভালোবাসার পরীক্ষা

সমাপ্ত

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | সিজন ১ | পর্ব - ৫২

৭৪ ভিউ
০ মন্তব্য
১ মিনিট

আলী আহমদ খান গুরুভার কন্ঠে বললেন,

“তোমার ফুপ্পিকে আসতে বলেছি প্রয়োজনে আবার বলবো কিন্তু তোমার ফুপাকে কিছু বলতে বলো না আমায়। এই একটা মানুষের জন্য আমার পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গেছে তাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না আমি৷ ” মালিহা খান ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,

“আর কতদিন মনের ভেতর বিদ্বেষ পুষে রাখবেন। এবার অন্ততঃ সবকিছু ঠিক করে নেন। ” “তোমরা কি চাইছো? আমি নিজে থেকে সব ভুলে ঐ লোকের সাথে কথা বলি?” আবির তপ্ত স্বরে বলল, “নাহ। মনের বিরুদ্ধে আপনাকে কিছু করতে বলছি না। আপনি ফুপ্পিকে সত্যিই বাসায় আনতে চাইলে ফুপ্পিকে কল দিয়ে ভালোমন্দ কথা বলে দাওয়াত দিবেন, বাসার সবাইকে নিয়ে আসতে বলবেন। এটুকুই। ” “আমার কাছে ওদের কারো নাম্বার নেই। ”


“নাম্বার আমি সংগ্রহ করে দিচ্ছি।” “আচ্ছা ঠিক আছে দিও।” সকালবেলা খাবার টেবিলে আবির আর মোজাম্মেল খান ব্যতীত সবাই উপস্থিত। আলী আহমদ খান খাবার শেষ করে স্বাভাবিক কন্ঠে শুধালেন, ” তোমাদের ফুপ্পিকে বাসায় দাওয়াত দিতে চাচ্ছি। এ ব্যাপারে তোমাদের কোনো মতামত থাকলে বলতে পারো। ” খুশিতে গদগদ হয়ে মেঘ বলল, “কোনো মতামত নেই। ফুপ্পি আসলেই হবে।” তানভিরের সরল স্বীকারোক্তি,

“আপনার বোনকে আপনি বাসায় আনতে চাচ্ছেন এ ব্যাপারে আমাদের মতামতের থেকেও আপনাদের মতামত টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আব্বু, আপনি, কাকামনি প্রয়োজনে আম্মুরা আছেন ওনাদের সাথে কথা বলে আপনারা যা সিদ্ধান্ত নেয়ার নিতে পারেন।” “আমরা আমাদের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া তোমার আব্বু আজ আসবে আবশ্যকতায় আবার আলোচনা করবো। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে তারা আসলে তোমরা তাদের সাথে কেমন আচরণ করবে?” তানভির মৃদু হেসে বলল,

“সে বিষয়ে আপনার টেনশন করতে হবে না। আমি, আমার বোনেরা কিংবা আদি, ওনাদের মনে আঘাত দেয়ার মতো কোনোপ্রকার খারাপ আচরণ করবো না। আপনার এবং এই বাড়ির সম্মান রক্ষার্থে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”

মীম আর আদিও তানভিরের সঙ্গে তাল মেলালো। মীম আর আদিকে মেঘ অনেকদিন আগে থেকেই ফুপ্পির কথা বলছে। ফুপাতো ভাইবোনদের কথাও বলেছে। তাদের সাথে পরিচিত হতে মীম আর আদিও খুব এক্সাইটেড। মোজাম্মেল খান দুপুরের পরপর বাসায় আসছেন, এসেই সরাসরি আবিরের রুমে চলে গেছেন। আলী আহমদ খানের ছেলের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার কারণে আবিরকে কিছু না বললেও মোজাম্মেল খান একায় সেই ঝাঁঝ মিটিয়েছেন। টানা ২ ঘন্টা আবিরের উপর রাগ ঝেড়েছেন, বহুবছর আগে আলী আহমদ খানের এক্সিডেন্টের ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিটা ঘটনার নিগূঢ় বর্ণনা দিয়েছেন। হালিমা খান দু একবার থামানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু এতে লাভ হওয়ার বদলে উল্টো ক্ষতি হয়েছে ।

মোজাম্মেল খানের রাগ আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। তানভির যেমন আবিরের প্রতি কনসার্ন তেমনি মোজাম্মেল খানও বড় ভাইয়ের অতিশয় ভক্ত। আলী আহমদ খানের এত বছরের পরিশ্রম, এই পরিবারের প্রতি অগাধ ভালোবাসা সবটায় মোজাম্মেল খানের খুব কাছ থেকে দেখা। আবির আর তানভির দুজনের ছন্নছাড়া আচরণে আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খান দু’জনেই অনেক বেশি চিন্তিত। কাজের চাপে আবিরের একটু আধটু সিরিয়াসনেস দেখা গেলেও তানভির বরাবরই গা ছাড়া ভাবে চলে। তারউপর আবির ইচ্ছেকৃত তানভিরকে আরও বেশি আগলে রাখে যা মোজাম্মেল খানের একেবারেই পছন্দ না।

আবিরের পাশাপাশি তানভিরও যদি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পারিবারিক ব্যবসাটা সামলাতো তাহলে এতদিনে তাদের অবস্থান আরও উপরে থাকতো। একমাত্র ছেলের প্রতি মোজাম্মেল খানের ভালোবাসা যেমন আছে তেমনি দুশ্চিন্তারও অন্ত নেই। আবির পড়াশোনায় ভালো, কাজেও খুব মনোযোগী কিন্তু তানভির সম্পূর্ণ উল্টো। বর্তমানে যা করছে তাতে ও যদি গুরুত্ব না থাকে তবে ছেলের ভবিষ্যৎ কি হবে সেই নিয়েই দুশ্চিন্তা করেন প্রতিনিয়ত। সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে আজ আবিরের সামনে। আবির চুপচাপ মাথানিচু করে চাচ্চুর সব কথা শুনছে। আবির চাইলেও এখন কিছুই বলতে পারবে না। একটা কথা বলতে গেলে মোজাম্মেল খান আরও ১০ কথা শুনাবেন তার থেকে বরং চুপ থাকায় শ্রেয়। আবির নিজের মনকে বুঝাচ্ছে,

“আবির আর যাই করিস না কেন, শ্বশুরের সাথে কখনো ত্যাড়ামি করিস না। আবির ধৈর্য রাখতে হবে, ২ ঘন্টা কেন আরও ৩ ঘন্টা বকলেও সহ্য করে নিতে হবে। শ্বশুরকে রাগালে বউকে আর নিজের করে পাবি না। সো বি কেয়ার ফুল আবির। ” এরমধ্যে মেঘ আবিরের জন্য এক গ্লাস দুধ নিয়ে আসছে। আব্বুর রাগ দেখে মেঘের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। দুধ নিয়ে ভেতরে আসবে নাকি চলে যাবে বুঝতে পারছে না। চলে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়ে আবারও দাঁড়িয়ে পরলো।

মেঘ মনে মনে আওড়াল, “আজ আমার জন্য আবির ভাইয়ের এ অবস্থা। আব্বু ওনাকে একা বকবেন কেন, আমিও তো বকা খাওয়ার অর্ধেক অংশীদার। ”

মেঘ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও রুমের দিকে পা বাড়ালো। কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে মোজাম্মেল খান সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। মেঘের হাতে দুধের গ্লাস থরথর করে কাঁপছে। মেঘ অন্য হাত দিয়ে শক্ত করে গ্লাসটা ধরে রেখেছেন। মোজাম্মেল খান মেঘকে দেখে একটু থামলেন। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে রাগী স্বরে বললেন, ” তারা এক্সিডেন্ট করে একেক দিন একেকজন পরে থাকবে আর ঘর গুষ্টি মিলে তাদের সেবা করবে। করো করো, আরও বেশি করে সেবা করো। দুধের সাথে আপেল, আঙ্গুর, কলাও নিয়ে আসতা। ” মেঘ একগাল হেসে বলল,

“সব রেডি করা আছে। দুধ খাওয়া শেষ হলেই ঐগুলা নিয়ে আসবো। ” মোজাম্মেল খান তীব্র বিরক্তি আর বিদ্রুপের স্বরে কথাটা বলেছিলেন অথচ মেঘ তা বুঝতে না পেরে উল্টো সাবলীল ভঙ্গিতে অচতুর স্বীকারোক্তি দিয়েছে। মেঘের উত্তর শুনে মোজাম্মেল খান কয়েক মুহুর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন। মেঘ উত্তর দেয়ার পর নিজেই কনফিউশানে পরে গেছে, আব্বু কি ঠাট্টা করলো নাকি সিরিয়াসলি বলছে এটায় বুঝতে পারছে না । আবির মেঘের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। মোজাম্মেল খান পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে আবিরকে উদ্দেশ্য কি যেন বলেছেন। মেঘ সে কথা বুঝেছে কি বুঝে নি কে জানে! কপাল কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল, ” এক্সিডেন্টের কারণে যে পরিমাণ রক্ত শরীর বেড়িয়েছে তা পূরণ করতে দুধ, ডিম, ফল খাওয়াবো না তো কি আপনার বকা খাওয়াবো? ”

মোজাম্মেল খান মেঘকে শুধালেন, “তানভির কোথায়?” মেঘের চোখ আবিরের দিকে পরতেই দেখল আবির মাথা দিয়ে না করতেছে। মেঘ সহসা মাথা নিচু করে উত্তর দিল, “জানি না।”

এরমধ্যে হালিমা খান ফল, সাথে ডিম সিদ্ধ নিয়ে আসছেন। রুমে ঢুকতে ঢুকতে চড়া গলায় বললেন, “তানভির যেখানেই থাকুক অন্তত এখন এখানে তাকে ডাকবো না। ২ ঘন্টা যাবৎ ছেলেটাকে ইচ্ছেমতো কথা শুনাচ্ছেন। আর কত! আপনি এখন যান এখান থেকে। ফ্রেশ হয়ে আসুন আপনাকে খেতে দিচ্ছি। আর ছেলেটাকেও শান্তিতে খেতে দিন।”

তানভির ঘন্টাখানেক আগেই বাসায় আসছে। আবিরের রুমে আসতেও চেয়েছিল কিন্তু হালিমা খান বারণ করেছেন। মোজাম্মেল খানের সামনে আবির আর তানভির দুজনেই গুরুতর আসামি। দোষ যেই করুক না কেন, শাস্তি দু’জনেরই প্রাপ্য। হালিমা খানের উদ্বেল কন্ঠের কথাবার্তা শুনে মোজাম্মেল খান আর কথা বাড়ালেন না। নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। হালিমা খান আবিরের কাছে ফলের প্লেট টা রেখে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুই বরং এখানে থাক। আমি তোর আব্বুর জন্য খাবার রেডি করি।”

মেঘ ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। হালিমা খান চলে যেতেই আবির ফলের প্লেটের দিকে তাকালো৷ হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর জন্য যে যে ফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে সব ফলে প্লেট ভর্তি করে নিয়ে আসছে। আবির ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, “এত ফল আনছিস কেন। কে খাবে?” “আপনি খাবেন ”

” এত ফল খাইয়ে একদিনে আমার শরীর ঠিক করার প্ল্যান করছিস নাকি?” ” একদিনে না পারি কিছুদিনেই ঠিক করে ফেলব ইনশাআল্লাহ।” আবির সুস্থির কন্ঠে বলল, “এত খেতে পারবো না। যেটুকু পারবো সেটুকুই খাবো৷ ” মেঘ মুচকি মুচকি হাসছে। মেঘের রহস্যময় হাসি দেখে আবির ভ্রু যুগল নাকের গুঁড়ায় টেনে রাশভারি কন্ঠে শুধালো, “এভাবে হাসার কারণ কি? মনের ভেতর কি চলছে, হুমমমমম?”

মেঘের মুচকি হাসি প্রখর হলো। বেশকিছু সময় চলবো মেঘের অঁবাধ হাসি। আবির বিস্তীর্ণ আঁখিতে চেয়ে আছে তার কাদম্বিনীর দুটি নেত্রে। আজ কতদিন পর আবিরের প্রিয়তমার অকৃত্রিম হাসি দেখছে যাতে নেই কোনোরকম কৃপণতা। দীর্ঘ সময়ের হাসির নিমিত্তে মেঘের চোখ দুটা টলমল করছে। গাঢ় কমলা রঙের একটা জামার সাথে সাদার মধ্যে হ্যান্ডপ্রিন্টের একটা ওড়না মেঘের গায়ে জড়ানো।

কমলা আর সাদার কম্বিনেশনে মেঘকে আজ অপরূপা লাগছে, সেই সাথে ঠোঁট গুলো আজ মাত্রাতিরিক্ত লাল দেখা যাচ্ছে, চোখের নিচে কাজল কিছুটা লেপ্টে আছে। নিরবধি হাসির কারণে ঘামে চিকচিক করছে নাকের ডগা। কোনো রমণীর প্রেমে পরার জন্য এরচেয়ে বড় কারণ বোধহয় আর হয় না। মুগ্ধতায় আবিরের দু চোখ আঁটকে আছে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে,বাস্তব আর কল্পনা গুলিয়ে যাচ্ছে। মেঘ চেষ্টা করেও নিজের হাসি থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে । দিশাবিশা না পেয়ে বাধ্য হয়ে নিজের হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে হাসি থামানোর চেষ্টা করলো। আবির তখনও নিরেট দৃষ্টিতে চেয়েই আছে। দৃষ্টির গভীরতা জুড়েই অবিশ্রান্ত ভালোবাসার সুবাস৷ মেঘের মোহমায়ায় জর্জরিত আবিরের হৃদয়।

মেঘ হাসি থামিয়ে আবিরের দিকে তাকাতেই আবির ভ্রু জোড়া নাচালো। মেঘ ঠোঁট বেঁকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ” আপনি এগুলো খাওয়া শুরু করুন। আমি আসছি।” “কোথায় যাচ্ছিস?” “আসতেছি এখনি।”

মেঘ কিছুক্ষণের মধ্যে দুটা প্লেট হাতে ফিরে আসলো। এক প্লেট ভর্তি ফল আরেক প্লেটে এক হালি সিদ্ধ ডিম। মেঘ ঠোঁটে হাসি রেখে প্লেট দুটা আবিরের সামনে রাখতেই আবির বিষম খেয়ে উঠল৷ কাশতে কাশতে আবিরের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অলরেডি আবিরের সামনে ১ হালি ডিম, এক প্লেট ভর্তি ফল, তারউপর মেঘ আরও এক হালি ডিম আর এক প্লেট ফল নিয়ে আসছে। আবির কাশতে কাশতে বলল, ” এইইই, এসবের মানে কি?” মেঘ হেসে বলল,

“এই সবগুলো আপনি এখন খেয়ে শেষ করবেন। আর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। ” আবির বিপুল চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘের যত্ন দেখে মনে হচ্ছে একদিনেই আবিরকে পুরোপুরি সুস্থ করে ফেলবে । শরীর থেকে যে পরিমাণ রক্ত বের হয়ছে তা একদিনেই পূরণ করে ছাড়বে। আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একগ্লাস দুধ, একহালি ডিম আর এক প্লেট ফল কোনোরকমে খেয়ে শেষ করেছে। মেঘ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আবিরকে পরখ করছে। খাওয়াতে কোনো প্রকার গাফিলতি যেন না করতে পারে। আবির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল,

“ম্যাম, আমি কি একটু রেস্ট নিতে পারবো?” ” বেশি কষ্ট হচ্ছে? ” “একটু তবে আপনি বললে শেষ করে ফেলব।” “থাক, পরে খেয়ে নিয়েন৷ এখন আমি আসছি। ” আবির উদাসীন কন্ঠে বলল, “আচ্ছা। ”

আলী আহমদ খান বাসায় ফিরেই আবিরের থেকে নাম্বার নিয়ে গেছেন। মোজাম্মেল খান সহ বাকিদের সাথে কথা বলে অবশেষে মাহমুদা খানের নাম্বারে কল দিলেন৷মাহমুদা খানের ফোনে অলরেডি আলী আহমদ খানের নাম্বার ভাইজান লিখে সেইভ করা তাই চিনতে অসুবিধা হয় নি। কল দেয়ার পর প্রথমবারেই কল রিসিভ হলো। মাহমুদা খান কন্ঠ খাদে নামিয়ে ধীর কন্ঠে বললেন,

“আসসালামু আলাইকুম ভাইজান।” “ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস?” “আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছ ?” “আলহামদুলিল্লাহ। কোথায় আছিস?” “বাসায়। আবির কেমন আছে?” “আগের থেকে কিছুটা সুস্থ।” “ভাবিরা কেমন আছে? বাকি সবাই কেমন আছে?” “আলহামদুলিল্লাহ ভালো। যে কারণে তোকে ফোন দেয়া, আগামীকাল তোদের বাসার সবাইকে আমাদের বাসায় দাওয়াত। সবাইকে নিয়ে সকাল সকাল বাসায় চলে আসিস। আমার যেন দ্বিতীয় বার ফোন দিতে না হয়৷ ” “ঠিক আছে, ভাইজান।”

মাহমুদা খান ফোন রেখেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছেন, আইরিন আর আরিফ ও মায়ের সাথে সাথে কাঁদছে। জন্মের পর থেকে মা কে দেখে আসছে ভাইদের জন্য সবসময় কান্না করেন, ঈদ কিংবা কোনো উৎসব আসলেই তাদের মায়ের কান্না দেখতে হয়। ২৮ বছর পর খান বাড়িতে ঢুকার অনুমতি পেয়েছেন, সেই খুশিতে নিজের কান্না আটকে রাখতে পারছেন না। আলী আহমদ খানের রাগ এত সহজে কমে যাবে এটা কেউ কল্পনাও করতে পারে নি। আবিরও ভেবেছিল অন্ততপক্ষে ১-২ বছর চেষ্টা করলে হয়তো বা আব্বুর রাগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কিন্তু বোনকে প্রথম দেখাতেই ওনি সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিবে এটা কেউ ই ভাবে নি।

আজ সকাল থেকে খান বাড়ির অন্দরমহলে কাজের ধুম পরেছে। দুজন হেল্পিং হ্যান্ড, বাড়ির তিন কর্তী সহ মেঘ, মীম আর আদিও কাজে ব্যস্ত। মেঘ কাজের ফাঁকে ফাঁকে আবিরকে দেখে আসে। আবিরের হাত অনেকেটায় ঠিক হয়েছে, তবে পায়ের ব্যথাটা এখনও অনেক বেশি। আজ তিনভাই একসঙ্গে বাজার করতে বেড়িয়েছেন৷ বোনের পছন্দ মতো মাছ থেকে শুরু করে সবজি, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসছে।

মীম, মেঘ মিলে চুপিচুপি একটা বরণডালাও সাজিয়েছে যেটা মীমের রুমে লুকিয়ে রেখেছে। আবির সুযোগ মতো মেঘকে ডেকে ঠান্ডা মাথায় সব বুঝিয়ে দিয়েছে, মেঘ যেন কোনো প্রকার উশৃংখল আচরণ না করে। আব্বু, চাচ্চুর প্রতি আবিরের বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস নেই, মেঘকে না আটকালে কখন কোন অঘটন ঘটবে তার আশঙ্কায় আছে। মেঘকে প্রটেক্ট করতে আজ আবিরও সামনে থাকতে পারবে না, তানভির কখন কোন কাজে ব্যস্ত থাকবে তাও বলা যায় না।

যদি ফুপ্পির সাথে ফুপাকে দেখে আবিরের আব্বুর মাথা গরম হয়ে যায় তাহলেই সব ধ্বংস হয়ে যাবে। আবিরই বলেছিল ফুপ্পিকে বাসায় আনার কথা, কারণ এখন আবিরের অসুস্থতার কারণে আলী আহমদ খানের মন এমনিতেই খুব নরম, এমতাবস্থায় ফুপ্পিকে না আনতে পারলে পরবর্তীতে কবে সুযোগ পাবে তা জানা নেই।

প্রায় ১২ টার দিকে ফুপ্পিরা বাসায় আসছেন। মেঘ নিচ থেকে চিৎকার করে মীমকে ডাকছে। অথচ মীম রুমে সাজুগুজু করতে ব্যস্ত। মাহমুদা খান, ওনার হাসবেন্ড, আইরিন, আসিফ, জান্নাত সবাই এসেছে। আসিফ গতকাল ই দেশে ফিরেছে৷ আবিরদের সারপ্রাইজ দিবে ভেবেই কিছু জানায় নি। মীম বরণডালা নিয়ে আসছে না দেখে মেঘও ডাকাডাকি বন্ধ করে দিয়েছে। বাসায় ঢুকেই সবাই আবিরকে দেখার জন্য আবিরের রুমে চলে গেছে। মেঘ গ্লাস হাতে নিয়ে আবিরের রুমে যাচ্ছে এসময় মীম উপরের বেলকনিতে থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,

“আপু ওনারা কোথায়?” মেঘ রুষ্ট হয়ে বলল, “ওনারা চলে আসছে। ” মেঘ আবিরের রুমে চলে গেছে। মীম কি বুঝলো কে জানে। দ্রুত রুমে চলে গেছে। সহসা একহাতে বরণডালা নিয়ে অন্যহাতে পা অব্দি ঢাকা লং ড্রেসের এক পাশ উঠিয়ে ছুটছে। মীমের পড়নে গাঢ় জলপাই রঙের একটা গাউন ড্রেস, একপাশে ওড়না সেফটিপিন দিয়ে আটকানো, স্ট্রেইট চুলগুলো কাঁধের নিচ পর্যন্ত পৌঁছেছে, মেঘ নিজেই মীমের চোখে আইলাইনার আর কাজল দিয়ে দিয়েছে,মীম ঠোঁটে রঞ্জকও লাগিয়েছে।

মীমের একহাতে কালো ফিতার ঘড়ি, অন্য হাতে কতগুলো চুড়ি, এক পায়ে পায়েল সাথে পুতুলওয়ালা নরম তুলতুলে স্যান্ডেল পড়নে। এলোপাতাড়ি দৌড়ের কারণে মীমের কাঁধ ছাড়ানো চুলগুলো রীতিমতো লাফাচ্ছে। আশপাশ কোনোদিকে তাকানোর মতো সময় নেই। বরণডালা হাতে নিয়ে মেইনগেইট পার হতেই আচমকা একছেলের সাথে ধাক্কা লাগতেই সামনের ছেলেটা দ্রুত সরে গেছে। মীমের হাতের বরণডালা সহ ফুলের পাপড়ি সব পরে গেছে, সাথে সাথে মীমও ধপাস করে নিচে পরে গেছে। ব্যাথায় মীম চিৎকার করে উঠল,

“ও মা গো।” চিকন লম্বা এক ছেলে দু কদম এগিয়ে এসে শুধালো, “ব্যথা পেয়েছো?” মীম রাগে কটকট করে বলল, ” এই কে আপনি, আমার বাসায় এসে আমাকে ফেলে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করেন ব্যথা পাইছি কি না! আপনার সাহস তো কম না।” আবারও আর্তনাদ করতে করতে বলল, “উফফফ! আমি শেষ” ছেলেটাও খেপা স্বরে বলল,

” নিজে দেখে চলতে পারো না আবার আমায় দোষারোপ করছো? আমি কি তোমায় ফেলছি নাকি? নিজের গায়ে জোর নাই আবার আমায় বলতে আসে।” মীম এখনও মাটিতে পরে আছে।মীমের রাগ মাথায় উঠে যাচ্ছে, রাগে কটকট করতে করতে বলল, “একদম গায়ের জোর নিয়ে কথা বলবেন না। আপনি ইচ্ছে করে আমায় ফেলছেন। আমি এখনি ভাইয়াকে ডাকবো।”

এমন সময় মেঘ আসছে। দরজার সামনে মীমকে বসে থাকতে দেখে মেঘ কপাল কুঁচকে শুধালো, “কিরে তুই এখানে বসে আছিস কেন?” মীম ফোঁস করে উঠল৷ গাল ফুলিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের স্বরে বলা শুরু করল, “আমি এখানে শুধু শুধু বসে আছি না। এই ছেলে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। ” মেঘ ছেলের দিকে তাকাতেই ছেলেটা নিরুদ্বেগ কন্ঠে বলল,

“আপু বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দেয় নি। ভেতর থেকে কে ছুটে আসছে আমি কিভাবে বুঝবো! আমি ভেতরে ঢুকছি সে হুট করে সামনে চলে আসছে, আমি ভয় পেয়ে কিছুটা সরে গেছি আর সে পরে গেছে। ” “নাহ আপু৷ ওনি ইচ্ছে করে ফেলছে। তুমি ভাইয়াকে এখনি ডাকো। এই ছেলের বিচার করতে হবে। উফফ আমার কোমর টা মনে হয় ভেঙেই গেছে। ” মেঘ মৃদু হেসে বলল,

“আরিফ, তুমি ভেতরে যাও।” আরিফ ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “আপু সত্যিই আমি ইচ্ছে করে ফেলি নি।” মেঘ তপ্ত স্বরে বিড়বিড় করে বলল, “বুঝতে পেরেছি, তবে একটু সাবধানে থেকো। এসেই পাগলকে উস্কে দিয়েছো, এর পরিণাম কি হবে আমার জানা নেই। ভেতরে যাও।”

আরিফ ভেতরে চলে গেছে। মীম রাগান্বিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, “আপু ওনি ঐ ছেলেকে ভেতরে ঢুকতে দিলে কেন? ঐ ছেলে আমায় এত ব্যথা দিল তবুও তুমি তাকে ছেড়ে দিলে? তুমি আমার বোন হয়ে এটা করতে পারলে?”

মেঘ হাত বাড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “মুখ টা বন্ধ করে ওঠ। কাজের কাজ কিছুই করতে পারিস না, তখন চিৎকার করে ডাকলাম, বরণডালা নিয়ে নামতে তুই নামিস নি। ওরা সবাই ভেতরে চলে গেছে এতক্ষণে তোর খবর হয়েছে। বরণ তো হলোই না বরং শুধু শুধু কোমড়ে ব্যথা টা পেয়েছিস। সাথে ড্রেস টাও নষ্ট করেছিস। ” মীম মেঘের হাত ধরে কোনো রকমে উঠলো। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না। মেঘ মীমের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,

” পা টা শক্ত করে ঝাড়া দে, দেখবি ঠিক হয়ে গেছে।” মেঘের কথা মতো মীম দুই তিনবার চেষ্টা করলো। কিছুটা ঠিক হওয়ার পর মেঘকে ধরে ধরে ভেতরে ঢুকলো। আবিরের রুমের দরজার সামনে আসতেই আকলিমা খান শুধালেন, “কিরে কি হলো তোর?” মীম রাগে বলতে নিল, “এই ছে..”

মেঘ তাড়াতাড়ি মীমের মুখ চেপে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “এমনি ব্যথা পেয়েছে।” আকলিমা খান পুনরায় বললেন, “সারাদিন উল্টাপাল্টা দৌড়াবে, ব্যথা তো পাবেই। বেশি ব্যথা পাইছিস?” সিরিয়াস আলোচনায় মীমের ব্যথাটা আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে ফেলছে, আবিরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে বলল, “আরে বেশি কিছু হয় নি। আমি এখনি ঔষধ দিয়ে দিচ্ছি। তোমরা কথা বলো।”

মেঘ মীমকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেছে। আবিরের রুমে আলী আহমদ খান ব্যতীত আর সবাই উপস্থিত। আলী আহমদ খান নিজের রুমেই বসে আছেন। বোনের প্রতি ক্রোধ কিছুটা কমলেও, বোনের হাসবেন্ডকে তিনি এখনও মন থেকে মানতে পারছেন না।


তাই সামনেই আসছেন না। মোজাম্মেল খান, মালিহা খান, হালিমা খান আলোচনা করে মাহমুদা খান আর ওনার হাসবেন্ডকে আলী আহমদ খানের রুমে পাঠাচ্ছেন ৷ ২৮-৩০ বছরের গড়ে ওঠা অদম্য অন্তরাল ভাঙতে মাহমুদা খান এবং ওনার হাসবেন্ড প্রয়োজনে আলী আহমদ খানের পায়ে ধরতেও রাজি।


পর্ব - ৫২ (২)

মেঘ মীমের সঙ্গে উপরে চলে গেছে। মীম কোমড়ের সাথে সাথে পায়েও অল্প ব্যথা পেয়েছে৷ আগে বুঝতে না পারলেও এখন মীমের পা জ্বলছে। কাটা স্থান থেকে রক্ত বেড়িয়ে পড়নের সেলোয়ারে দাগ হয়ে গেছে। মেঘ আগে ভেবেছিল সামান্য ব্যথা পেয়েছে তাই এত গুরুত্ব দেয় নি। মীমের অবস্থা দেখে এখন মেঘ নিজেই ভয় পেয়ে গেছে। বাসার কাউকে জানালে তুলকালাম কান্ড হয়ে যাবে।


মীম পায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে আর আরিফকে অনর্গল বকেই যাচ্ছে। মেঘ বুঝিয়ে শুনিয়ে মীমকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। মেঘ কাটা স্থান জীবাণু মুক্ত করে একটা মলম লাগিয়ে ব্যথার ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। বেশকিছুক্ষণ বুঝানোর পর মীম কিছুটা শান্ত হয়েছে।মীম অন্য একটা ড্রেস পরেছে। কিছুক্ষণ পর দুইবোন একই সঙ্গে নিচে আসছে। পায়ে আর কোমড়ে ব্যথার জন্য মীম ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না৷ ওরা নিচে আসতেই দেখল আলী আহমদ খানের রুমের সামনে ভিড়, মেঘ মীমকে সোফায় বসিয়ে এগিয়ে গেল বড় আব্বুর রুমের দিকে।


রুমের বাহিরে মোজাম্মেল খান, ইকবাল খান, মালিহা খান, হালিমা খান, আকলিমা খান দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ আম্মু আর কাকিয়ার পাশ কেটে দরজা পর্যন্ত আসতেই মেঘের পা যুগল থমকে গেছে সেই সাথে হৃদস্পন্দনও হঠাৎ থেমে গেল। মাহমুদা খান এবং ওনার হাসবেন্ড দুজনে আলী আহমদ খানের দু পা আঁকড়ে ধরে অবিচ্ছেদ্য ভাবে কেঁদেই চলেছেন৷ ব্যগ্র স্বরে নিজের ভুল স্বীকার করছেন আর আলী আহমদ খানের কাছে মাফ চাচ্ছেন। আলী আহমদ খান বোনকে অনেকদিন আগেই ক্ষমা করে দিয়েছেন, তবে আজ বোনের হাসবেন্ড কে সামনাসামনি দেখার পর নিজেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।


পাথুরে মানবের ন্যায় আলী আহমদ খান বিছানার এক পাশে বসে আছেন৷ মোজাম্মেল খান ব্যতীত দরজার সামনে দাঁড়ানো প্রতিটা মানুষের চোখ টলমল করছে। মেঘ কাতর বদনে ফুপ্পির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, মেঘের বুকের ভেতর অসহনীয় যন্ত্রনা হচ্ছে, হৃদয় খুঁড়ে আসা আর্তনাদ গুলো অবিক্ষিপ্ত গতিতে দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে। ক্ষণিকের জন্য মেঘ নিজেকে ফুপ্পির জায়গায় কল্পনা করতেই মেঘের চারপাশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকার সর্বশক্তি মুহুর্তেই বিলীন হয়ে গেছে। মেঘ দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো। মীমের পাশে সোফায় গিয়ে বসে চোখ বন্ধ রেখে ঘনঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। মেঘের অস্থিরতা দেখে মীম অবাক চোখে চাইলো। আশপাশে চোখ বুলিয়ে মীম সন্ধিহান কন্ঠে শুধালো,


“আপু কি হয়েছে তোমার? এভাবে হাঁপাচ্ছো কেন?” মেঘ নিজেকে সামলে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “কিছু হয় নি।” অন্যদিকে আবিরের রুমে আসিফ, জান্নাত, তানভির, আরিফ, আইরিন সবাই খুনসুটিতে মেতে আছে। বেশকিছুক্ষণ খুশগল্প করার পর আসিফ হঠাৎ ই গম্ভীর কণ্ঠে আবিরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “শুনলাম তুই নাকি মেঘের জন্য এক্সিডেন্ট করেছিস?” “মোটেই না৷ তোমরা শুধু শুধু আমার ওনাকে দোষারোপ করছো। ওনার কোনো দোষ ই নাই। ভাগ্যে ছিল তাই এক্সিডেন্ট করেছি। আসিফ কিঞ্চিৎ হেসে বললো,


” এখনি তার পক্ষ নিচ্ছিস? বিয়ের পর কি করবি তাহলে?” আবির জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে, ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে মৃদুস্বরে বলল, “পরে বউ ভক্ত জামাই হবো। ও যা বলবে, যেভাবে বলবে আমি সেভাবেই চলবো। বাস্তবে কেন, স্বপ্নেও কোনোদিন ওকে আমার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ তুলতে দিব না৷ ইনশাআল্লাহ। ” জান্নাত, আসিফ আর তানভির একসঙ্গে “ইনশাআল্লাহ” বলে উঠল। আইরিন হাসিমুখে শুধালো,


“ভাইয়া তুমি বিয়েটা কবে করবা? আমরা কি বিয়ে খাবো না?” আবির ঠাট্টার স্বরে বলল, “তোকে বিয়ে দিয়ে তারপর ই করবো।” আইরিন মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমার কি বিয়ের বয়স হয়ছে? মাত্র ১৬ বছর বয়স আমার। আমি এখনও শিশু।” তানভির হেসে বলল,


” এখনও কত কত গ্রামে ১২-১৪ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। সেখানে তুই তো তাদের থেকে ২ বছরের বড়৷ তোকে দিতে সমস্যা কি?” আইরিন গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে বলল, “তোমার বোন যে আমার থেকে আরও ৩ বছরের বড় সে বেলায়? তাকে বিয়ে দাও না কেন?” তানভির সত্বর জবাব দিল, “আমার বোনের জামাই ফিক্সড তাই কোনো টেনশন নাই কিন্তু তোর জন্য তো ছেলে খোঁজতে হবে এজন্য সবার টেনশন। ”


আইরিন ভ্রু নাকের গুঁড়ায় টেনে রাশভারি কন্ঠে বলল, “আমি বিয়েই করবো না। ” আইরিনের কথা শুনে সবাই উঁচু স্বরে হাসতে শুরু করেছে। আইরিন রাগে কটকট করতে করতে সবার দিকে তাকাচ্ছে। জান্নাত ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল,


” তোমরা সবসময় আমার ননদিনী টাকে রাগাও। আমার ননদিনীকে বিয়েই দিব না, সারাজীবন আমাদের কাছে রেখে দিব। তাহলে আম্মুকেও মেয়ের জন্য কান্নাকাটি করতে হবে না। ” আইরিনের গাল ফুলানো দেখে আরিফ আইরিনের মাথায় গাট্টা মেরে বলল, “তুই এত বেক্কল কেন রে? মজাও বুঝিস না?”


আইরিন মাথায় ঘষতে ঘষতে অসহায় মুখ করে আরিফের দিকে চেয়ে আছে। আরিফ সবার সাথে অন্য বিষয়ে কথা বলায় ব্যস্ত । এরমধ্যে আকলিমা খান দরজা থেকে ডেকে বললেন, “তানভির, ওদের নিয়ে বাসা টা একটু ঘুরে দেখা। আর পারলে আবিরকে ধরে রুমটা থেকে বের কর। এক রুমে বন্দি থাকতে কত ভালো লাগে?” তানভির ধীর কন্ঠে বলল, ” ঠিক আছে।তুমি যাও, আমি ভাইয়াকে নিয়ে যাচ্ছি। ”


আইরিন, আরিফ, জান্নাত আগে বেড়িয়ে গেছে।তানভির আর আসিফ দুপাশ থেকে আবিরকে ধরে আস্তেধীরে নিয়ে যাচ্ছে। আবিরের হাত মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে, পায়ে ব্যথা রয়েছে। বাড়ির নিরিবিলি পরিবেশ দেখে জান্নাত এগিয়ে গিয়ে আকলিমা খানকে শ্বাশুড়ির কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। মেঘ আর মীম দু’জন ই সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। সবাইকে বের হতে দেখে হালিমা খান এগিয়ে এসে মেঘকে ডেকে বললেন, “ওদের নিয়ে ছাদ থেকে ঘুরে আয়। আমরা খাবার রেডি করছি।” এদিকে ওদিক নজর বুলিয়ে মেঘ উঠে নিজের মনকে সামলে মুখে হাসি নিয়ে বলল,


“চলো।” মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কিরে তুই যেতে পারবি ?” মীম মেঘের দিকে এক পলকের জন্য তাকাতেই হঠাৎ আরিফের দিকে চোখ পরলো। ওমনি মীম রেগেমেগে আগুন হয়ে গেছে। রাগান্বিত কন্ঠে বলল, “আমি যাব না। তুমি যাদের নিয়ে যাচ্ছিলে তাদের নিয়েই যাও।” মেঘ যথারীতি আইরিন আর আরিফকে নিয়ে উপরে চলে গেছে। এক এক করে মীম,তানভির, মেঘ, আবির সবার রুম ঘুরিয়ে ছাদে নিয়ে গেল। ছাদ ভর্তি এত এত গাছ দেখে আইরিন খুশিতে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। আইরিনের উইশলিস্টের প্রায় অনেক গাছ অলরেডি মেঘদের ছাদে আছে। আইরিন আপন মনে বকবক করেই যাচ্ছে,


“এই গাছটা আমার আছে, ঐটা ছিল এখন নাই, এই গাছটা আমাদের বাসায় হয় না। তুমি আবার আমাদের বাসায় গেলে তোমাকে আমাদের বাসার ছাদে নিয়ে যাব। ” মেঘ মৃদু হেসে শুধু বলল, ” আচ্ছা ঠিক আছে। ” অনেকক্ষণ যাবৎ বকবক সহ্য করে অবশেষে আরিফ ক্ষুদ্ধ হয়ে বলল, “তোদের সাথে এসে আমার নিজেকে উন্মাদ মনে হচ্ছে। গাছগাছালি নিয়ে এত আলোচনা গবেষণাগারের গবেষকরাও বোধহয় করেন না। ” আইরিন ঠাট্টার স্বরে বলল, “তুই ভালো মানুষ ছিলি কবে?”


আরিফ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতেই আইরিন ভেঙচি কাটলো। মেঘ হেসে বলল, “আচ্ছা গাছ নিয়ে আর কথা বলব না। তোমার যে বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে সেই বিষয়েই বলো।” আরিফের রাগ মুহুর্তেই গায়ের হয়ে গেছে। সহসা অস্ফুট কন্ঠে বলল, “এই না হলে আমার ভা..” আইরিন সঙ্গে সঙ্গে আরিফের মুখ চেপে ধরে ফেলল। মেঘ আশ্চর্যান্বিত নয়নে তাকিয়ে আইরিনকে শুধালো, “আরিফের মুখ চেপে ধরেছো কেন?” পুনরায় আরিফকে শুধালো,


“কি বলতে চাইছিলে বলো, ভা মানে কি?” আরিফ ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে বলল, “ভালো বোন।” মেঘ ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালো, “সত্যি? তাহলে আইরিন মুখ চেপে ধরেছে কেন?” “আইরিন খুব হিংসুটে, ও নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালো বলতে দিবে না। তোমাকে ভালো বলে ফেলছি এটা ওর সহ্য হচ্ছে না। ” আইরিন বিপুল চোখে আরিফের দিকে তাকিয়ে আছে আর ভেতরে ভেতরে ফুঁসতেছে। বিড়বিড় করে বলল, “আগে বাসায় চল, তারপর তোকে বুঝাবো।”


মেঘ, আইরিন, আরিফ তাদের পড়াশোনা, ভার্সিটি লাইফ আর স্কুল লাইফ নিয়ে গল্প করছে। এদিকে আবির, তানভির, আসিফ সোফায় বসে বসে গল্প করছে। আবিরের ব্যবসা, তানভিরের রাজনীতি, আসিফের জব লাইফ নিয়েই নানান আলাপ আলোচনায় মগ্ন। জান্নাত, হালিমা খান ও আকলিমা খানের সাথে খাবার পরিবেশনে সাহায্য করছে৷ মাহমুদা খান, ওনার হাসবেন্ড এবং বাকিরা আলী আহমদ খানের রুমেই টুকটাক কথা বলছেন। মাহমুদা খানকে আলী আহমদ খান নতুন করে সবার পরিচয় দিচ্ছেন, যদিও মাহমুদা খান সবাইকে আগে থেকে চিনেন। আলী আহমদ খান হঠাৎ প্রশ্ন করলেন,


“তোর ছেলে মেয়ে কি তিনজন ই?” মাহমুদা খান মৃদুস্বরে বললেন, “নাহ। আমার আলহামদুলিল্লাহ দুই ছেলে আর দুই মেয়ে।” মোজাম্মেল খান শুধালেন, “আরেক মেয়ে কোথায়? নিয়ে আসলি না কেনো?” “বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে,কানাডা থাকে।” ইকবাল খান আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে বললেন, “আফা, তোমার এক মেয়েকেও বিয়ে দিয়ে ফেলছো? ” মাহমুদা খান মলিন হেসে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ একবছরের একজন নাতিও আছে। ”


মোজাম্মেল খান বোনের কথায় রীতিমতো ভীমড়ি খেলো। আলী আহমদ খান মালিহা খানের দিকে তাকিয়ে উদাসীন কন্ঠে শুধালেন, ” আমার ছেলেকে এবার বিয়ে করানো দরকার। নাকি বলো?” মালিহা খান কিছুটা তপ্ত স্বরে বললেন, “আবির ফেরার পর থেকে আপনার কাছে আমি এই কথা বলছি। কিন্তু আপনি তো আমার কথা গুরুত্বই দিচ্ছেন না। ” “এবার গুরুত্ব দিতেই হচ্ছে। আমার ছোট বোন নানি হয়ে গেছে আর আমি এখনও ছেলের বউ এর মুখে আব্বাজান ডাক ই শুনতে পারলাম না।”


মোজাম্মেল খান চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ” কোনো মেয়ে কি পছন্দ হয়েছে ভাইজান? দেখেছো কি?” “হ্যাঁ। মেয়ে আমার পছন্দ করায় আছে। আবির শুধু হ্যাঁ বললেই হবে৷ ” মালিহা খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন, “মেয়ে কে? কি করে?” আলী আহমদ খান ঠাট্টার স্বরে বললেন, “মেয়ে তুমিও দেখেছিলে এবার আমিও দেখেছি। এখন দেখি ছেলে কি করে। ” মোজাম্মেল খান আবারও প্রশ্ন করলেন,


“ভাইজান, তুমি কি শাকিল সাহেবের মেয়ের কথা ভাবতেছো?” মালিহা খান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, “শাকিল সাহেব কে?” ইকবাল খান উত্তর দিলেন, “ভাইজানের ব্যবসায়িক বন্ধু।” “মেয়ে দেখতে কেমন?”


“মাশাআল্লাহ ভাবি। মেয়ে দেখার মতো। আপনি দেখলে চোখ ফেরাতে পারবেন না যাকে বলে আগুন সুন্দরী। তারউপর বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে বলে কথা। ” মালিহা খান ঠান্ডা কন্ঠে জানালেন, “নাহ। আমার ছেলের বউ হবে আমাদের মতো সাধারণ, অবশ্যই মিশুক হতে হবে। যে আগুনের আশেপাশে ভিড়তেই পারবো না সে আগুনে আমার ছেলেকে পুড়তে দিব না। ” আলী আহমদ খান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,


“তোমার ছেলে বিয়ের জন্য রাজি হলে তারপর অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে। ” এদিকে মাহমুদা খানের বুকের ভেতর থাকা হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠেছে। ওনি এতদিনে আবিরকে যতটুকু চিনেছেন, আবির মেঘকে না পেলে আবিরও বাঁ-চবে না। যেকোনো একটা বড় ধরনের এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলবে। মাহমুদা খান আলী আহমদ খানের সামনে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না, আবার চুপচাপ কথাগুলো হজমও করতে পারছেন না।


অন্যদিকে মীম সোফায় বসে ছিল, আবির রা সােফায় এসে বসতেই, মীম কিছু একটা ভেবে তড়িঘড়ি করে উঠে পায়ে ব্যথা নিয়েই দৌড়ে রান্নাঘরে গেল। উত্তেজিত কন্ঠে শুধালো, “আম্মু, বাসায় কলা আছে?” “হ্যাঁ৷ কেনো?” “আমায় একটা কলা দাও। ” ” ভাত খাওয়ার সময় কলা দিয়ে কি করবি?” “খাবো৷ এখনি দাও। একটা না দুটা কলা দিও ” আকলিমা খান কপাল কুঁচকে মীমের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে দুটা কলা বের করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে হালিমা খান মীমকে বললেন,


” মীম, ছাদ থেকে ওদের ডেকে নিয়ে আয় তো মা।” মীম ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল, “অবশ্যই । এখনি যাচ্ছি।” মীম কলা খেতে খেতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। মুহুর্তেই যেন পায়ের ব্যথার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। ছাদের দরজা থেকে ডাকলো, “আপু, মামনি তোমাদের ডাকছে। ” মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “আচ্ছা যাচ্ছি। কিন্তু তুই এখানে আসলি কিভাবে?” “এভাবেই৷ ”


মেঘ আর আইরিন গল্প করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে৷ আরিফ মীমের শারীরিক অবস্থা বুঝার জন্য এক পলক মীমের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। মীম যদি বুঝতে পারে আরিফ ইচ্ছেকৃত মীমের দিকে তাকিয়েছে তাহলে এবার সিডর, আইলার মতো তান্ডব শুরু করে দিবে। আরিফ ফোনের দিকে মনোযোগ দিয়ে মীমকে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। আরিফ ৪-৫ সিঁড়ি নামতেই হঠাৎ স্লিপ কেটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কয়েক সিঁড়ি নেমে সামনে থাকা আইরিনের দু কাঁধে ধরার চেষ্টা করে।


আরিফের ভর আইরিন নিতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়তে নেয়, মেঘ তাড়াতাড়ি আইরিনকে ধরে ফেলে, ততক্ষণে আরিফ ও নিজের শক্তি দিয়ে কোনোরকমে স্থির হয়েছে। পায়ের ২-৩ জায়গায় ঘষা খাওয়ায় আরিফের পা জ্বলছে, সেদিকে না তাকিয়ে আরিফ পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল একটা সিঁড়িতে কলার বাকল অক্ষত অবস্থায় পরে আছে, এর আগের সিঁড়িটাতেই আরিফের পা পরেছিল। মীম দুটা কলা খেয়ে পরপর দুই সিঁড়িতে বাকল ফেলেছে, যেন যেকোনো একটাতে আরিফ স্লিপ খায়।


মেঘ আর আইরিন আগে নেমে যাওয়ায় এবং আরিফের মনোযোগ ফোনে থাকায় মীমের কাজে বেশ সুবিধা হয়েছে। আরিফ চোখ তুলে মীমের দিকে তাকাতেই মীম নিজের দুহাত ঝেড়ে এমন ভাব নিলো যেন সে বিশাল কিছু করে ফেলেছে। আরিফের রাগ হলেও সে প্রকাশ করল না, আইরিন নিজের মতো করে আরিফকে বকছে, আইরিন ভেবেছে আরিফ ইচ্ছে করে আইরিনকে ধাক্কা দিয়েছে। আরিফ সেসবে পাত্তা না দিয়ে মেঘদের পাশ কাটিয়ে নিচে চলে গেছে। মীম নেমে এসে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,


“আইরিন আপু, তুমি কি ব্যথা পেয়েছো?” মেঘ সন্দেহের দৃষ্টিতে মীমকে দেখেও কিছু বললো না। নিচে নামতেই দেখল সবাই খাবার টেবিলে বসা। আজ ডাইনিং এ আরও ৫ টা চেয়ার এড করায় জায়গা তুলনামূলক কম। ফুপ্পিদের পাশে দুটা চেয়ার ফাঁকা, আবিরের পাশের একটা চেয়ারও ফাঁকা৷ আইরিন তার মায়ের পাশে গিয়ে বসলো, মীম ফুপ্পিদের পাশের চেয়ারে বসতে বসতে মেঘকে চোখে ইশারা করল, যেন আবিরের পাশে গিয়ে বসে। মেঘ কয়েক মুহুর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এরমধ্যে আবির দুবার তাকিয়েছে, কিন্তু মেঘের নজর অন্যদিকে। তানভির আবিরের পাশের চেয়ারটা ইশারা করে মোলায়েম কন্ঠে মেঘকে বলল,


“বনু, এখানে এসে বস। ” সঙ্গে সঙ্গে আলী আহমদ খানও বললেন, “বসো বসো, খাওয়া শুরু করি।” মেঘ আগপাছ না ভেবে আবিরের পাশে গিয়ে বসলো। অজানা এক অনুভূতিতে মেঘের মন শিউরে উঠছে। তিরতির করে কাঁপছে মেঘের হাত, আবির মেঘের হাতের দিকে নজর বুলায়। আড়চোখে মেঘকে কয়েক মুহুর্ত পর্যবেক্ষণ করে। মেঘের কাঁপা কাঁপি দেখে আবির ব্যান্ডেজ করা হাত নিয়ে নিজেই মেঘের প্লেটে খাবার তুলে দিল৷ আচমকা মেঘের সঙ্গে হাতের স্পর্শ লাগতেই মেঘ কারেন্টে শক খাওয়ার মতো আঁতকে উঠে। মুহুর্তেই হাত ছিঁটকে সরিয়ে নিয়েছে। অকস্মাৎ মেঘের এরকম আচরণে আবির কপাল গুটিয়ে অবাক চোখে তাকালো কিন্তু কোনো কথা বলল না। খাওয়ার মাঝে প্রয়োজনের বাহিরে কেউই কোনো কথা বলে নি। মীমের সাথে দু একবার আরিফের চোখাচোখি হয়েছে, মীম প্রতিবার ই ভেংচি কেটে সহসা অন্যদিকে তাকিয়ে পরেছে। আলী আহমদ খান খাবার শেষ করে গলা খাঁকারি দিয়ে ধীর কন্ঠে বললেন,


“আমি খান বাড়ির সবার উপস্থিতিতে আমার ছেলের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি৷ আমার ছেলের সম্মতি থাকলে আমি সামনের ঈদ নাগাদ ছেলের বউ ঘরে তুলতে চাই। ” আলী আহমদ খানের কথাগুলো আবিরের মনে সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হয়েছে৷ আবিরের চোখ মুখে অন্ধকার নেমেছে, কপালে কয়েক স্তর ভাঁজ পরে গেছে। এদিকে মেঘের নিঃশ্বাস গলায় আঁটকে গেছে, অবিরত ঢোক গিলে নিঃশ্বাস নেয়ার প্রবল চেষ্টা করছে। তানভির, আসিফ, আরিফ, জান্নাত, আইরিন, মীম সকলেই আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে আছে। সবার মনে উত্তেজনা আর ভয় একসঙ্গে কাজ করছে। আলী আহমদ খান পুনরায় শুধালেন,


” আবির, এখন বিয়ে করতে তোমার কোনো আপত্তি আছে?” শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে আবিরের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে, মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করা পরিকল্পনা গুলো এলোপাতাড়ি ছুটছে। পিঞ্জরে আবদ্ধ হৃদপিণ্ডটা দপদপ করে কাঁপছে। আব্বু, চাচ্চু সহ খান বাড়ির প্রায় সব সদস্য আজ এখানে উপস্থিত। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে আবির ফুপ্পিকে প্রথমবারের মতো বাসায় আনতে সফল হয়েছে, আবির যতটা চেষ্টা প্রকাশ্যে করেছে তার থেকে অনেক বেশি চেষ্টা গোপনে করেছে। ফুপ্পির সাথে প্রথমবার দেখা হওয়ার পর থেকে, মালিহা খানকে দিয়ে আবির যথাসাধ্য আলী আহমদ খানকে বুঝানোর চেষ্টা করে আসছে।


এতদিনে ভাই বোনের সম্পর্ক মোটামুটি ঠিক হতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় আবির কোনোভাবেই নতুন কোনো ঝামেলা চাচ্ছে না। বর্তমানে আবিরের অবস্থান অনুসারে, মেঘের কথা বাসায় জানানো বা আব্বু, চাচ্চুর কাছে মেঘকে চাওয়ার মতো মিনিমাম যোগ্যতাও আবিরের নেই। আর যাই হোক, আবির মেঘের ব্যাপারে “নাহ” শব্দ শুনতে নারাজ। এদিকে টেনশনে মেঘের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবির বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে আর যে কোনো ক্রমে অন্য মেয়ের সাথে আবিরের বিয়ের কথা হলে মেঘের কি হবে সেটা ভেবেই মেঘ ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। পাশাপাশি বসায় আবিরের দিকে ঠিকমতো তাকাতে পারছে না,আবিরের রিয়াকশন ও বুঝতে পারছে না। কিছু মুহুর্তের জন্য খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা চললো৷ অবশেষে আবির ছোট করে শ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,


” আমি আপাতত বিয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত না। ” ” আমি কি তোমাকে এখনই বিয়ে করতে বলছি নাকি? ঈদ পর্যন্ত সময় নাও, মানসিক ভাবে প্রস্তুত হও।” আবির আগপাছ না ভেবে বলে উঠল, “সরি আব্বু ৷ ঈদ নাগাদ সময়ে আমি নিজেকে গুছাতে পারবো না। আমার আরও সময় লাগবে।” “কতদিন? ” “আগামী ১ বছর আমি বিয়ে নিয়ে ভাবছি না।”


” আরও একবছর? তুমি বাড়িতে আসছো প্রায় ১ বছর হতে চললো। তাছাড়া তোমার বিয়ের বয়সও হয়েছে, তোমার আম্মু অনেকদিন যাবৎ ই আমাকে বলছিল। আমার উচিত বাবা হিসেবে নিজের দায়িত্ব স্বীয় ভাবে পালন করা। ” ” কিন্তু আব্বু আমি এখন কোনো অবস্থাতেই বিয়ে করতে পারবো না৷ বিয়ে করার মতো যোগ্যতা আমার এখনও হয় নি৷ ”


“কেন হবে না? যদি ইনকামের কথাও চিন্তা করি, তুমি প্রায় ৮-৯ মাস যাবৎ আমাদের পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি নিজস্ব ব্যবসা সামলাচ্ছো। তোমার পার্সোনাল ইনকাম বাদ দিলাম, আমাদের কোম্পানি থেকে প্রতিমাসে তোমাকে যে স্যালারিটা দেয়া হয় আমি আশাবাদী তা দিয়ে তুমি তোমার বউ নিয়ে দিব্যি চলতে পারবে। প্রয়োজনে বিয়ের পর তোমার স্যালারি বাড়ানো হবে। ব্যবসার দায়িত্ব এখন তোমার কাছ, তোমার যা প্রয়োজন তার সবটায় তুমি নিতে পারো। এরপরও যদি সমস্যা মনে হয় তাহলে আমি তো আছিই। বিয়ের সম্পূর্ণ খরচ না হয় আমিই দিলাম। ”


আবির মলিন হেসে বলল, ” আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। প্রয়োজনে ১ বছরের জায়গায় দুই বছর পর বিয়ে করবো তবুও বিয়ের জন্য আমি কারো কাছ থেকে এক পয়সাও নিব না। ” মোজাম্মেল খান রাশভারি কন্ঠে বলে উঠল, ” যদি টাকার জন্য ই বিয়ে করতে সমস্যা হয় তাহলে তোমার আব্বুর বা আমার একাউন্ট থেকে চাইলে তুমি তোমার প্রয়োজনীয় এমাউন্ট ধার নিতে পারো। তারপর ধীরে ধীরে পরিশোধ করে দিও। তোমার আব্বু তোমাকে বিয়ে করাতে চাইছেন, তোমার রাজি হওয়া উচিত। ”


মোজাম্মেল খান একটু থেমে পুনরায় বললেন, ” আর মেয়েটা তোমার অপরিচিত কেউ না!” মোজাম্মেল খানের কথায় আবির আঁতকে উঠল। মুহুর্তেই মাথায় চিন্তারা ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। সহসা হৃৎস্পন্দন জোড়ালো হয়ে গেছে। মনের গহীনে একটা চিন্তা বার বার উঁকি দিচ্ছে, “আব্বু- চাচ্চু কি কোনোভাবে মেঘের কথা বলতে চাচ্ছেন?” অন্যমনস্কতায় আবিরের ওষ্ঠ যুগল কিছুটা প্রশস্ত হলো।নিপুন কৌশলে আবির নিজের অল্পবিস্তর হাসিটাকে আড়াল করে গুরুতর কন্ঠে শুধালো,


“কে সে?” মোজাম্মেল খান অবলীলায় বলতে শুরু করলেন, ” শাকিল সাহেবকে তো তুমি চিনোই । ওনার মেয়ে সারা কেও নিশ্চয়ই দেখেছো, মাঝে মাঝে অফিসেও আসে। গতকাল তোমার অসুস্থতার কথা শুনে শাকিল সাহেব অফিসে আসছিলেন, তারপর নিজে থেকেই সারা র সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধের কথা বলেছেন। যদিও ভাইজান তেমন কিছু বলে নি, বাসায় আলোচনা না করে ওনাকে কিছু জানানো ঠিক হবে না। বাসার সবার ও তোমার মতামত থাকলে ওনাদের বাসায় দাওয়াত করা হবে। মেয়ে অপছন্দ হওয়ার মতো কিছু নেই, তারা আসলে এনগেজমেন্ট টাও না হয় করে নেয়া যাবে। ”


সারার কথা শুনে আবিরের মেজাজ চরম মাত্রায় খারাপ হয়ে গেছে। মনের কোণে যে একটুকরো সুখের আভাস উঁকি দিয়েছিল তা যেন মুহুর্তেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছে, গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটছে । মেঘ, তানভির দুই ভাই বোনই অসহায় মুখ করে আব্বুর অভিমুখে চেয়ে আছে। মেঘ পাশে তাকিয়ে একপলক আবির কে দেখছে পুনরায় একপলক আব্বুকে দেখছে। উপস্থিত সকলের মনে অস্থিরতা। এতক্ষণ যাবৎ একটুর জন্য হলেও মনে হয়েছিল, তারা আবিরের মতামত জানতে চাইবে৷ কিন্তু মোজাম্মেল খানের মুখে এনগেজমেন্টের কথা শুনে সকলেই থতমত খেয়ে গেছে।


ফুপ্পিরা সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। সবাই সবার দিকে তাকালেও আবিরের দৃষ্টি প্লেটের দিকে স্থির। রাগে আবির দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে, কপালের দুপাশের শিরা-উপশিরা গুলো দ্রুতগতিতে লাফাচ্ছে, গলার রগ গুলো ফুলে উঠেছে৷ সারা মেয়েটা ইদানীং ঘনঘন অফিসে আসছিল, ওনাদের সাথে কোনো মিটিং বা যেকোনো আলোচনাতেই সারা শাকিল সাহেবের সঙ্গে আসতো। প্রথম দিন ফরমালিটি করে আবির সারার সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেছিল, এক কাপ কফিও অফার করেছিল, মিটিং এ যাওয়ার আগে আবির কাউকে কফি দেয়ার কথা বলেও গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যস্ততার জন্য সারা র সঙ্গে আর কোনো কথা হয় নি।


সেই থেকে সারা প্রায় ই অফিসে আসতো, যেচে আবিরের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতো, আবির ব্যস্ততা দেখিয়ে সবসময় ইগ্নোর করতো। সারা বেশ কয়েকবার আবিরের নাম্বারও চেয়েছে, কিন্তু আবির দেয় নি। সেই মেয়ের সঙ্গে বাবা-চাচা আবিরের বিয়ের কথা ভাবছে এতেই আবিরের মেজাজ তুঙ্গে। আবির মুখ ফুলিয়ে শ্বাস টানলো, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শেষ চেষ্টা করল, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কন্ঠ চারগুণ ভারী করে বলল,


” আমি বিয়ে করবো না মানে করবোই না। আগামী এক বছর এই বাড়িতে কোনো প্রকার বিয়ের আলোচনা শুনতে চাই না। শাকিল সাহেবের মেয়েই হোক আর যে সাহেবের মেয়েই হোক, আজকের পর থেকে অফিসিয়াল কার্যক্রমের সদস্য ব্যতীত অফিসে যেন কোনো মেয়ে না আসে। আর অনুগ্রহ করে আমার বিয়ে নিয়ে আপনারা আলোচনা বন্ধ করুন।” আলী আহমদ খান রাশভারি কন্ঠে বললেন,


“তুমি কথা শেষ করতে তো দিবে। ” “আব্বু,আমি আর কোনো কথা শুনতে বা বলতে চাচ্ছি না। ” “তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।” আবির রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল, “আপনারা আপনাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে, এনগেজমেন্ট পর্যন্ত ফিক্সড করে ফেলছেন আর এখন আমার মতামত জানতে চাচ্ছেন। বাহ! অসাধারণ। ” মালিহা খান শান্ত স্বরে বললেন, “আবির, আব্বুর সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন? কথা বললেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। ওনারা তে তোর সিদ্ধান্ত জানতেই চাচ্ছেন। ”


“আম্মু এটাকে সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া বলে না। ওনারা ওনাদের মর্জি আমার উপর চাপালেই আমি ওনাদের সব সিদ্ধান্ত মানতে পারব না। আর যদি আমার সিদ্ধান্ত জানতেই চাও, তাহলে আমি আবারও বলছি আগামী এক বছর আমি বিয়ে করতে পারব না৷ এ ব্যাপারে আমার সামনে অথবা আড়ালে আর কোনো কথা যেন না হয়!” আলী আহমদ খান উঠে যেতে যেতে ভারী কন্ঠে বললেন, ” ঠিক আছে, তোমার বিয়ে নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। ” আবির গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল, “ধন্যবাদ।”


মোজাম্মেল খান গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললেন, “ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে নিজের মর্জিতে চলতে চায়, বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান হয়ে যায়, বড়দের সিদ্ধান্ত তখন তাদের কাছে মূল্যহীন মনে হয়। কাউকে পরোয়া করে না। ” আবির ঠোঁট বেঁকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,


“পারলে নিজের মেয়েকে আমার কাছে দেন বিয়ে, তারপর দেখুন আপনাদের সিদ্ধান্তের মূল্য দেয় কি না! নিজের মেয়ের কথা তো একবারও বললেন না! কোথাকার কোন মেয়েকে আমার ঘাড়ে গছিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন, তাতে রাজি হয় নি বলে আমি অবাধ্য সন্তান হয়ে গেছি। বাহ! শ্বশুর আব্বু, বাহ! আপনার মেয়েকে বিয়ে দিলে ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, আজ, এই মুহুর্তেই বিয়ে করে ফেলবো। ”


মোজাম্মেল খান বিড়বিড় করতে করতে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেছেন। আবির একপলক চাচ্চুর দিকে তাকালো, বিড়বিড় করে বলা কথার কিছুই আবির বুঝবো না। চোখ ঘুরাতেই তানভিরকে চোখে পরলো, আবির তানভিরকে দেখেই সিম্পলি স্মাইল দিল, তানভিরের মুখে গাম্ভীর্যতা লেগেই আছে। আবির ফুপ্পিদের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “তোমরা খাচ্ছো না কেনো? খাও খাও।”


সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে, শুধু আশপাশে চোখ বুলাচ্ছে। ইকবাল খান, মালিহা খান, আকলিমা খান উপস্থিত আছে বিধায় কেউ কিছু বলতে পারছে না। সবার মনমরা ভাব দেখে আবির ঠাট্টার স্বরে বলল, “সামনের বছর আমার বিয়ে। তোমাদের সবার দাওয়াত, এখন থেকেই বিয়ের প্রিপারেশন শুরু করো। বিয়ে আমার ধুমধাম করেই হবে। ”


আইরিন আর মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তোরা ডান্স শেখা শুরু কর, আমার বিয়েতে ঠিকমতো নাচতে না পারলে তোদের খবরই আছে।” আবিরের কথা শুনে সবাই না চাইতেও হেসে ফেললো। নিজের বিয়ের দাওয়াত নিজেই দিচ্ছে, আবার নাচার জন্য বোনদের রীতিমতো থ্রেট দিচ্ছে। এমন কান্ড একমাত্র আবিরই করতে পারে। আরিফ মজা করে বলল, “ভাইয়া আমরা কি দোষ করেছি? ছেলে বলে কি আমরা নাচতে পারবো না?” আবির হেসে বলল,


” অবশ্যই নাচবি৷ তোদের বেশকিছু লুঙ্গি কিনে দিব। তখন সবগুলো মিলে লুঙ্গি ডান্স দিস। ” মালিহা খান তপ্ত স্বরে বললেন, ” আবির, তোর আব্বুর কথা…” আবির গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বলল, “আম্মু…!” মালিহা খান ঠান্ডা কন্ঠে বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি আর কিছুই বলবো না। ” “এইতো আমার লক্ষ্মী আম্মু।”


আলী আহমদ খান কিছুক্ষণ আগেই রুমে গেছেন, আলী আহমদ খানকে দেখতে মালিহা খানও এবার নিজের রুমে চলে গেছেন। আবির আড়চোখে নিজের প্রেয়সীর দিকে এক নজর তাকালো। মেঘ মাথা নিচু করে ভাতের প্লেটে আঙুল বুলাচ্ছে। বাকিদের মুখে হাসি থাকলেও মেঘের মনে কালবৈশাখী ঝড় বইছে। আব্বু আর বড় আব্বু যেভাবে বিয়ের কথা বলছিল, আবির ভাই রাজি হলেই বিয়ে হয়ে যেত। এদিকে আবির ভাইয়ের মনে মেঘ আছে কি না এ বিষয়েও মেঘের মনে সন্দেহ আছে। মেঘের প্রতি আবিরের মনে ভালোবাসা নাকি ভালো লাগা,এক বছর পর আদো আবির কি মেঘকে বিয়ে করবে? নাকি অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবে সেসব ভেবেই মেঘের মন আরও বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেঘের বার বার শুধু মনে হয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পেছনে ছুটছে সে। আবিরের মনের কথা জানতে করা এক কর্মকান্ডে আবিরের এই অবস্থা হয়েছে। এখন সে কি করবে!


মেঘের হাবভাব দেখে আবির মেঘের দিকে সরাসরি তাকালো। কন্ঠ খাদে নামিয়ে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো, ” ভাতের প্লেটে আবার কি চাষ করবি?” মেঘ বিস্ময় সমেত চোখ তুলে তাকালো। মোহনীয় সেই দৃষ্টি। ফুপ্পিরা আসবে শুনে মেঘ সকাল সকাল গোসল করে সাজুগুজু করেছিল, এখন সেই সাজ অনেকটায় বিনত হয়ে গেছে তবুও আবির মেঘের চোখের গভীরে অক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আশপাশ থেকে অন্যদের কন্ঠস্বর কানে আসতেই আবির নড়েচড়ে বসল, চোখে চোখ রেখেই শান্ত স্বরে বলল,


” পারিপার্শ্বিক ব্যাপারে কান না দিয়ে, চুপচাপ খাবার শেষ কর।” মেঘ অসহায় দৃষ্টিতে আবিরকে পরখ করলো৷ মনে মনে নিজেকে আওড়ালো, “মানুষটা এমন কেন? এত কিছুর পরেও একটা মানুষ এতটা স্বাভাবিক কিভাবে থাকতে পারে?”


মেঘ পুনরায় মাথা নিচু করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। খাবার টেবিলে তেমন কোনো কথা হলো না। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফুপ্পিরা কিছুক্ষণ গল্প করে বিকেলের দিকে বাসায় চলে গেছেন। যাওয়ার সময় আলী আহমদ খান গিফটের পরিবর্তে সবাইকে টাকা দিয়ে দিয়েছেন। সন্ধ্যার পর পর মেঘ ঘুমিয়েছিল, সেই ঘুম ভেঙেছে রাত ১১.৩০ নাগাদ।