সালমা চৌধুরী
সালমা চৌধুরী

প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | ভালোবাসার স্বীকৃতি

সমাপ্ত

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | সিজন ১ | পর্ব - ৭৬

৮২ ভিউ
০ মন্তব্য
১ মিনিট

(রোমান্টিক এলার্ট)


বেলা বাজে ১০ টা ৪৫, আবির বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ফোনে কিছু করছে। অভিমানী মেঘ ঠোঁট ফুলিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ সেই ভোরবেলা থেকে সমুদ্রে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে কিন্তু আবির তার কথা কানেই তুলছে না। মেঘ হঠাৎ ই পুরু কন্ঠে বলে উঠল,


"আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না?"


আবির ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই আস্তে করে বলল,

" বিয়ের পর থেকে কানে একটু কম শুনছি।"


"কেনো?"


" সারাক্ষণ যেভাবে আপনি আপনি করেন এসব শুনার থেকে কানে কম শোনাও ভালো।"


মেঘ মন খারাপ করে বলল,

" চলুন না সমুদ্রে যায়।"


আবির হঠাৎ ই চোখ তুলে তাকালো, মেঘের কুঁচকান কপাল আর উল্টানো ওষ্ঠ দেখে আবিরের অধরের কোণে মৃদু হাসি ফুটল। নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,

" ইশশ, তুমি তাকালেই আমার হৃদয়ে শোণিতের ঢেউ বয়ে যায়। এই ঢেউয়ের নিকট সমুদ্রের ঢেউ কিছুই না। "


মেঘ ভেঙচি কেটে বিড়বিড় করল,

" আপনি একটা অস..."


মেঘ সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখ চেপে ধরেছে। আবির প্রশস্ত আঁখিতে চেয়ে অদম্য কন্ঠে বলল,


"বলো বলো, বউয়ের কাছে সভ্য সেজে বিশ্বরেকর্ড করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই৷ আমি নষ্ট পুরুষ হলে আমার বউয়ের কাছে হব, পরনারীর চোখে না হয় সাধু পুরুষই হব।"


মেঘ চোখভরা আকুতি নিয়ে ফের প্রশ্ন করল,

" আপনি যদি সমুদ্রে নাই নিবেন তাহলে ঘুমের মধ্যে আমাকে হা*ইজ্যা*ক করে এনেছিলেন কেনো?"


মেঘের মুখে এমন কথা শুনে আবির ফিক করে হেসে উঠল। কন্ঠস্বরে কোমলতা মিশিয়ে বলল,

" বিয়ে করা বউকে হানিমুনে এনেছি তারজন্য এত বড় কথা! আজই বউয়ের মুখে হা*ইজ্যা*কার শুনতে হচ্ছে, এ জীবন রেখে কি হবে?"


মেঘ ভ্রু কুঁচকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে, আবির এক মনে হেসেই যাচ্ছে। মেঘ কিছু না বলেই উঠে বারান্দায় চলে গেল। আবির বেশ কয়েকবার ডেকেছে কিন্তু মেঘ রুমে আসার নাম ই নিচ্ছে না। আবির বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে মেঘের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। মেঘের চুলের শক্ত বাঁধন খুলে চুলগুলো উন্মুক্ত করে দিল, মেঘের সুদীর্ঘ কেশরাশি বাতাসে এলোমেলো ভাবে উড়ছে। মেঘ চোখ ঘুরিয়ে আবিরের দিকে তাকালো তবে কিছুই বলল না৷ আবির মুচকি হেসে আস্তে করে বলল,


"হৃদয়ে প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে

অভিমানে কেনো যেতে চাও অন্তরালে?"


মেঘের নিরবতা দেখে আবির মোলায়েম কন্ঠে ফের বলল,


"রাগ করে না জানু, বিকেলে ঘুরতে নিয়ে যাব।"


"আপনি রুমে যান, আপনার সাথে কোনো কথা নেই।"


"সত্যি তো?"


"হ্যাঁ।"


"ঠিক আছে।"


আবির ভাব নিয়ে রুমে চলে আসছে ঠিকই কিন্তু মেঘ আর আসছে না। ৫ মিনিট পেরিয়ে ১০ মিনিট হতে চলল, মেঘের রুমে আসার কোনো নামই নেই। আবির ফোন হাতে নিয়ে রাকিবের নাম্বারে কল দিল। রাকিব কল রিসিভ করেই গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল,


"খুব সুখে আছিস না? দরকারে কল দিলেও রিসিভ করার প্রয়োজন মনে করিস না। বউ পেলে আগেই তো সব ভুলে যেতিস এখন আর কি বলব। শুধু একটা কথায় বলি, বউ কিন্তু আমারও আছে।"


আবির রাকিবের কথার প্রতিত্তোরে কিছু না বলে হঠাৎ ই উচ্চস্বরে বলতে শুরু করল,


" রাকিব রে, তুই ঠিকই বলেছিলি। "


রাকিব থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল,

" আমি আবার কি বলেছিলাম?"


আবির দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করল,

" চুপ থাক।"


আবির প্রগাঢ় কন্ঠে ফের বলল,

" বিয়ে তো করেছি। কিন্তু এখন বুঝতেছি, তুই যা বলেছিলি একদম ঠিক বলেছিলি। ভেবেছিলাম বিয়ে করলে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। এই দু'দিনেই আমি আমার গার্লফ্রেন্ডের শূন্যতা উপলব্ধি করতে পারছি।"


ওপাশ থেকে রাকিব চাপা স্বরে বলছে,

" কত নাটক করে বিয়ে টা করলি, এখন আবার গার্লফ্রেন্ড খুঁজিস। হারামি কোথাকার "


আবির কন্ঠ তিনগুণ শৃঙ্গে তুলে আবারও বলে উঠল,


"রাকিব, তুই তাকে বলে দিস, আমি খুব মিস করছি তাকে।"


মেঘ রুমে আসতেই আবির ফিসফিস করে বলে উঠল,

" কাজ হয়ে গেছে, রাখি এখন।"


মেঘ রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিল,

"আপনি কাকে মিস করছেন?"


আবির অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল,

"আমার গার্লফ্রেন্ড কে।"


"কে সে?"


"ছিল কোনো এক মায়াবতী।"


" একদম ফাজলামো করবেন না, আমি কিন্তু সিরিয়াস।"


"আমিও সিরিয়াস। তুমি বিশ্বাস করবে না সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। আমাকে দেখার জন্য দিনরাত ছটফট করতো। আমার সাথে কথা বলার জন্য, ঘুরতে যাওয়ার জন্য দিওয়ানা ছিল। অথচ তুমি!"


সামান্য কথাতেই মেঘের দু-চোখ টলমল করছে, একরাশ মন খারাপে মুহুর্তেই মনের উঠোনে অন্ধকার নেমেছে, বুকের বাম পাশে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। মেঘের মন বলছে,


" আবির মেঘ ব্যতীত অন্য কাউকে ভালোবাসতেই পারে না।"


কিন্তু মস্তিষ্ক যেন মনের কথা বুঝতেই চাইছে না, তিক্ততায় বিষিয়ে দিচ্ছে মেঘের কোমল মনটাকে। আবির মুড নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, আচমকা নাক টানার শব্দে আবির দৃষ্টি ফেরাল। মেঘের চোখ মুখ দেখে আতঙ্কে বিছানা থেকে নেমে মেঘের দু বাহু চেপে ধরে আদুরে কন্ঠে শুধালো,


" এই, কি হয়েছে তোমার?"


মেঘের নিস্তব্ধতা দেখে আবির ভীতিকর কন্ঠে বলতে শুরু করল,

" আগেই বলে দিচ্ছি, একদম কাঁদবে না। তোমার বাপের কলিজার টুকরাটাকে আমি নিয়ে আসছি। যত্নে না রাখতে পারলে আমাকে সোজা জে*লে*র ভা*ত খাওয়াবে।"


মেঘ শীতল চোখে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে জানতে চাইল,

" আপনার কি সত্যি গার্লফ্রেন্ড আছে? "


আবির নিঃশব্দে হেসে মেঘের কাঁধের উপর আলতোভাবে হাত রেখে মোলায়েম কন্ঠে বলল,

" হ্যাঁ আছে তো, এইযে আমার সামনে। আগে আবিরের নাম শুনলেই যার বুকে তোলপাড় চলতো ৷ আবিরকে দেখার জন্য রাতের পর রাত ব্যালকনিতে অপেক্ষা করতো, না খেয়ে বসে থাকতো। সময়ে অসময়ে আবিরকে দেখার জন্য কারণ ছাড়ায় আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। অভিমানে গাল ফুলাতো, সেই অভিমান ভুলে আবারও আবিরের প্রণয়ে আসক্ত হতো। সে প্রেমিকা না হলে আর কি বলো?"


আবির ভ্রু গুটিয়ে ধীর কন্ঠে ফের বলল,

" বউ, তুমি প্রেমিকা হিসেবেই ভালো ছিলে কারণ তখন তুমি আমার জন্য উন্মাদ ছিলে। মনে হচ্ছে বিয়ের পর তুমি সুস্থ হয়ে গেছ তাই আমার প্রতি তোমার পাগলামিও কমে এসেছে।"


মেঘ আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে আনমনে হাসলো। আবির কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেঘ নিচু হয়ে নিজের কাঁধে থাকা আবিরের হাত ছাড়িয়ে বিছানার উপর উঠে দাঁড়িয়েছে। তৎক্ষনাৎ আবিরের শার্টের কলার চেপে আবিরকে নিজের দিকে ঘুরালো। আবির বিপুল চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘের গাল আর নাকের ডগা লাল টকটকে হয়ে আছে তবে তার গভীর চোখে উৎকন্ঠার রেশ মাত্র নেই। আবিরের কপালে পড়ে থাকা অগোছালো চুলগুলো খুব যত্নসহকারে গুছিয়ে কিছুটা ঝুঁকে মেঘ অকস্মাৎ আবিরের কপালে নিগূঢ় চুমু দিল। আবিরের প্রশস্ত দুচোখ সহসা দ্বিগুণ প্রশস্ত হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস আঁটকে গেছে । মেঘ কিছুটা সরতেই আবিরের বিমোহিত চাহনির মুখোমুখি হলো। আবিরের চাহনি দেখে মেঘ ভেতরে ভেতরে লজ্জায় আড়ষ্ট হচ্ছে ঠিকই তবে বাহিরে প্রকাশ করলো না। মেঘ ঢোক গিলে সঙ্গে সঙ্গে আবিরের অধরে নিজের অধর চেপে ধরেছে। আবির তড়িৎ বেগে মেঘের পেটে বরাবর ধরে মেঘকে বিছানা থেকে নামিয়ে নিজের সঙ্গে চেপে ধরেছে । মেঘের পা আবিরের পায়ের উপর, দুইটা দেহ একসঙ্গে লেপ্টে আছে, মেঘের পাতলা অধর আবিরের নিয়ন্ত্রণে। আবিরের নিখাঁদ ভালোবাসায় মেঘ আবারও ধরা দিতে বাধ্য হলো, দুচোখ বন্ধ করে শার্টের উপর দিয়ে আবিরের পিঠ থামছে ধরেছে।



২৪ ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে, তানভিরের সাথে বন্যার কোনো কথায় হচ্ছে না। বন্যা বেশকয়েকবার ফোন হাতে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু সাহস করে তানভিরের নাম্বারে কল দিতে পারছে না। অনেক ভাবনাচিন্তার পর বন্যা তানভিরের নাম্বারে কল দিল কিন্তু তানভিরের নাম্বার বন্ধ। বন্যা ভ্রু কুঁচকে নাম্বারটা চেক করে আবারও কল দিল। তানভিরের নাম্বার বন্ধ পেয়ে বন্যার বুক কাঁপছে, ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। চোখের সামনে আয়েশার থা*প্পড়ের ঘটনাটা বার বার মনে পড়ছে। বন্যার কপাল চাপড়ে রাশভারি কন্ঠে বলল,


"সবসময় রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিস তাহলে কাল কোনো পারলি না, বন্যা? ওনাকে কিছু না বললে কি হচ্ছিলো না তোর?"


তানভির ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ কোথাও এক্টিভ নেই, ভয়ে বন্যার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। মেঘের নাম্বারে কল দিতে গিয়েও আঁটকে গেছে। দিশাবিশা না পেয়ে আইরিনের দেয়া একটা নাম্বারে কল দিল। মূলত ফোনটা মাহমুদা খানের। আইরিন কল রিসিভ করে ফিসফিস করে বলল,

" ভাবি, কোথায় তুমি?"


"বাসায়, কেনো?"


"তানভির ভাইয়া গতকাল সন্ধ্যার পর বাসায় এসে একটু পর সেই যে বের হয়েছিল, এখনও বাসায় আসে নি। বাসার সবাই খুব টেনশন করছে। তোমার সাথে কি কথা হয়েছে?"


"না। কিন্তু ওনি কোথায়?"


"জানি না। ফোন বন্ধ, ভাইয়ার বন্ধুরাও কিছু জানে না। এখন রাখছি, কেউ দেখে ফেললে আবার বকা খেতে হবে। "


"শুনো.."


আইরিন কল কেটে দিয়েছে, বন্যা দু'হাতে মাথা চেপে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। তানভিরের রাগ আর জেদ সম্পর্কে বন্যার খুব ভালোই ধারণা আছে। জেনে বুঝে এত বড় ভুল কিভাবে করল সেসব ভেবেই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। বন্যার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সেটাও পারছে না কারণ বাসার কেউ টের পেলে এই নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি হবে৷


খান বাড়িতে তুলকালাম কান্ড চলছে। তানভিরের কি হয়েছে সেটা জানতে সবাই উঠেপড়ে লেগেছে কিন্তু কেউ ই কিছু বলতে পারছে না। এক পর্যায়ে আলী আহমদ খান আবিরের নাম্বারে কল দিল। মেঘ তখন ওয়াশরুমে, আবির কল রিসিভ করে বারান্দায় চলে গেছে।


আলী আহমদ খান গম্ভীর গলায় বললেন,

" তোমার ভাইয়ের কি হয়েছে?"


আবির ভ্রু কুঁচকে বলল,

" জানি না, আমার সাথে কথা হয় নি। "


"ওর ফোন বন্ধ, গতরাত থেকে বাসায় নেই। কি শুরু করেছো তোমরা? কিছু হওয়ার আগেই তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাও, তোমার দেখাদেখি তানভিরও শুরু করেছে। ওর যদি কাউকে পছন্দ থাকে তাহলে বলো, বিয়ের ব্যবস্থা করি। কিন্তু এভাবে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কি মানে?"


আবির ঢোক গিলে শান্ত কন্ঠে বলল,

" তেমন সিরিয়াস কিছু তো আমি জানি না, এখানে আসার পর ওর সাথে আমার কোনোরকম কথায় হয় নি। আমার ওর সাথে আগে কথা বলতে হবে।"


"ঠিক আছে, দেখো কোনোভাবে যোগাযোগ করতে পারো কি না। আর যাই হোক, পছন্দ থাকলে আগেভাগেই জানিয়ো।"


"জ্বি আব্বু।"


আলী আহমদ খান ফের বললেন,

" খোঁজ নিও, তোমার মতো আবার গোপনে বিয়ে করে ফেলেছে কিনা!"


আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করল,

" মানে?"


"এখন আর মানে মানে করতে হবে না। তুমি যে আরও তিনবছর আগেই কাবিনের কাজ সেরে ফেলেছো এটা আমি খুব ভালোভাবেই জানি। শুধু আমি না, এখন বাসার সবাই জানে।"


" আপনাকে কে বলেছে?"


"কে আবার বলবে, তোমার প্রাণপ্রিয় ভাই তানভির। তোমার বিয়েতে আমি যেন কোনো প্রকার বাঁধা সৃষ্টি না করি তারজন্য আমার পায়ে ধরা শুধু বাকি রেখেছে। আমি মানছিলাম না বলে এক পর্যায়ে নিজের ঘাড়ে তোমাদের বিয়ের সব দায় নিয়ে বহুবার রিকুয়েষ্ট করে আমাকে রাজি করিয়েছে। ভেবো না তোমার বিয়েতে আমি এমনি এমনি রাজি হয়ে গিয়েছি। আমি শুধু তানভিরের অসহায় মুখটা দেখে রাজি হয়েছি। আমি যদি সেদিন রাজি না হতাম তাহলে তোমাদের ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক নষ্ট হতো যেটা আমি কোনোদিনও চাই না। আমি যেমন আমার ভাইদের সবসময় আগলে রেখেছি আমি চাই তোমাদের সম্পর্কটাও এরকম থাকুক। তাই আবারও বলছি, তানভিরের সম্পর্কে এমন কিছু জানলে আগেই জানিয়ে দাও।"


আবির তপ্ত স্বরে জানাল,

" আমি তানভিরের সাথে যোগাযোগ করে তারপর আপনার সাথে কথা বলবো। আপনার চিন্তা করতে হবে না।"


"ঠিক আছে। তানভিরের সাথে কথা হলে, বাসায় আসতে বলো।"


"জ্বি আচ্ছা।"

আবির প্রভূত আঁখিতে দূরের আকাশে চেয়ে আছে। 'মেঘকে না পেলে আবির ম*রে যাবে' এই কথা আলী আহমদ খানকে বলায় আবির তানভিরের উপর নিজের রাগ ঝেড়েছিল অথচ তাদের বিয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়া সম্পন্ন হবার পেছনে তানভিরের হাত ছিল এটা জেনে আজ আবিরের খুব খারাপ লাগছে। তানভিরকে জড়িয়ে ধরতে হাজার বার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। আবির সঙ্গে সঙ্গে তানভিরের নাম্বারে কল দিল, সবার মতো আবিরও নাম্বার বন্ধই পেল।


আবির কল দিতে দিতে আনমনে রুমে ঢুকতেই মেঘের লম্বা চুল আবিরের চোখে মুখে লাগে। মেঘের ভেজা চুলের পানিতে আবির মুখ সহ গলা পর্যন্ত ভিজে গেছে। মেঘ পেছনে ঘুরে আবিরকে দেখেই ভীত কন্ঠে বলতে শুরু করল,


"সরি, সরি। আমি সত্যি আপনাকে দেখি নি।"


আবির মুচকি হেসে বলল,

" বিয়ের পর বউয়ের ভেজা চুল চোখে মুখে না লাগলে বিয়ের ফিল ই আসে না। যাক অবশেষে নিজেকে সর্বাঙ্গীণ স্বামী মনে হচ্ছে। "


মেঘ চিবুক নামিয়ে কয়েক কদম পেছাতেই আবির আশ্চর্য নয়নে তাকালো। মেঘের পড়নে আবিরের একটা সাদা শার্ট সঙ্গে প্লাজু, গলায় একটা স্কার্ফ ওড়না পেচানো। আবির বিস্তীর্ণ আঁখিতে তাকিয়ে আছে। মেঘ চোখ তুলে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বলল,


"এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? সুন্দর লাগছে না?"


"খুব।"


মেঘ মোলায়েম কন্ঠে বলল,

"ঘুরতে যখন নিয়েই যাবেন না তখন এত সুন্দর ড্রেস আর শাড়ি পড়ে কি হবে? তাই রাগ করে আপনার শার্ট পড়ে ফেলেছি। একবার বলুন ঘুরতে নিয়ে যাবেন, তাহলে এখনই সাজুগুজু করবো।"


আবির মৃদুস্বরে বলল,

"থাক না, এভাবেই ভালো লাগছে। কাছে আসো হাতাটা ঠিক করে দেই।"


মেঘ ভেঙচি কেটে বিড়বিড় করল,

" আমি আপনার নতুন শার্ট পড়ে নিয়েছি, আপনার কি রাগ লাগছে না?"


"যেখানে আমিই তোমার সেখানে শার্ট আর এমনকি। এদিকে আসো। "


মেঘ এগিয়ে আসলো। আবির মেঘের পড়নের শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ধীর কন্ঠে শুধালো,


"বন্যার সাথে ইদানীং কোনো কথা হয়েছে?"


"না, কেনো?"


"তানভিরের সাথে বন্যার মনে হয় কোনো ঝামেলা হয়েছে। সাকিব কাল মেসেজ দিয়ে শুধু বলেছিল, তানভির বন্যার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে যাচ্ছে। কিন্তু তারপর কি হয়েছে সে জানে না। তানভিরও নাকি কিছু বলে নি। একটু আগে আব্বু কল দিয়েছিল, বললেন রাত থেকে তানভির বাসায় নেই। "


মেঘ শীতল কন্ঠে শুধালো,

"বাসায় নেই মানে? কোথায় গেছে?"


"কেউ ই জানে না, তানভিরের ফোন বন্ধ। বন্যাকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করো কোনো সমস্যা কি না!"


"আচ্ছা। "


মেঘ সঙ্গে সঙ্গে বন্যার নাম্বারে কল দিল, বন্যা কল রিসিভ করে স্বাভাবিক কন্ঠে জানতে চাইল,

"কিরে, কেমন আছিস?"


মেঘ উত্তর না দিয়ে উল্টো গুরুভার কন্ঠে বলে উঠল,


" এই তার ছিঁড়া, বদের হাড্ডি। তুই আমার ভাইকে কি বলেছিস?"


আবির রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিল,

" এসব কি ধরনের ভাষা?"


মেঘ আড়চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে বেকুবের মতো হাসলো। আবির যে তার পাশে বসা এটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য মেঘ ভুলেই গিয়েছিল। মেঘ আস্তে করে ঢোক গিলে শান্ত কন্ঠে বলল,

" ভাবি, আপনি আমার ভাইকে কি বলেছিলেন?"


আবির মৃদু হাসল। বন্যা উষ্ণ স্বরে বলতে শুরু করল,


" আমার যা ঠিক মনে হয়েছে তাই বলেছি। ওনাকে আমার ভালো লাগে বলে এই না আমি আমার পরিবারের অমতে গিয়ে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিব। ওনি আমার কথা ঠিকমতো না বুঝেই ফোন বন্ধ করে ফেলেছেন, এতে আমি কি করব? ওনি ছেলে মানুষ তাই রাগ করে ফোন বন্ধ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারেন আর আমি মেয়ে বলে সেসব কিছুই করতে পারি না। তুই তোর ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে আমাকে বলতে আসছিস, আজ আমার পক্ষে কেউ নেই বলে তোদের কিছু বলতে পারে না। দিনশেষে তোদেরই সব আছে, আমি আর আমাদের কিছুই নেই।"


বন্যা কথা শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিয়েছে। মেঘ আবিরের দিকে অসহায় মুখ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোন রেখে দু'হাতে আবিরের হাত আঁকড়ে ধরে মাথা এলিয়ে দিয়ে আস্তে করে বলল,


" বন্যা পা*গল হয়ে গেছে।"


"এখন তোমার কি হয়েছে?"


"ওদের চিন্তায় আমার মাথা ঘুরছে।"


আবির কিছু না বলেই আসিফের নাম্বারে কল দিল। রিসিভ করতেই আবির একদমে বলতে শুরু করল,

" ভাইয়া, আমি তোমাদের বিয়ে, হানিমুন আটকিয়েছিলাম তারজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমার পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য স্পেশাল অফার, আগামীকাল থেকে ৩ দিন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের হানিমুন অফার। আইরিন, আরিফ, মীম, তানভির সবাইকে নিয়ে আসবে। ২-১ জন স্পেশাল গেস্ট আছে তাদেরকেও নিয়ে আসবে। বুঝতে পেরেছো?"


আসিফ ভারী কন্ঠে বলল,

" এটা কাপল হানিমুন অফার ছিল নাকি ফ্যামিলি প্যাকেজ ছিল ভাই?"


" আসবেই যখন একা আসবে কেন? এই সুযোগে সবার ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে। তোমার দায়িত্ব শুধু ওদের নিয়ে আসা, তারপর তোমাদের মুক্তি।"


"তানভিরকে কোথায় পাবো? ওর ফোন তো বন্ধ। "


"সেসব আমি দেখছি। তুমি কাল সবাইকে নিয়ে আসবে এটায় ফাইনাল।"


" আচ্ছা।"


ইবুক: বর্ণহীন প্রেমাসক্তি


ফাহিমকে ঢুকতে দেখে শান্তা আহ্লাদী কন্ঠে ডাকল,

'ফাহিম ভাইয়া '

'কি?'

'ভালো আছেন?'

'আলহামদুলিল্লাহ।'

'কফি খাবেন?'


ফাহিম অকস্মাৎ চক্ষু কপালে তুলে থমথমে কন্ঠে বলল,

' ভুলেও না। তোমার হাতের কফি খাওয়ার স্বাদ মিটে গেছে আমার।'


শান্তা মৃদুস্বরে বলল,

'আপনার জন্য স্পেশাল বুলেট কফি করে দেয়?'


'আপাতত মাফ করে দেও আমাকে।'



পর্ব - ৭৬ (২)

আকাশ জুড়ে রগরগে তারার মেলা, প্রকৃতি ছেয়ে আছে অদ্ভুত শীতলতায়। সমুদ্রের ঊর্মিল ঢেউ শরীরের সাথে সাথে মনকেও প্রাণবন্ত করে তুলছে। মেঘ আবিরের হাতে হাত রেখে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটছে, চোখে মুখে উজ্জ্বলতা৷ অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মন অশান্ত হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের পানি আপন বেগে এসে দু'জনের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। মেঘ সীমাহীন সমুদ্রের পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আচমকা আবিরের অভিমুখে তাকায়। আবির মেঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উদ্দীপ্ত কন্ঠে বলল,


" আমি যেদিন প্রথমবারের মতো কক্সবাজার এসেছিলাম, সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এরপর আসলে তোমাকে নিয়েই আসবো। তানভির অবশ্য আগেও কয়েকবার বলেছিল, তোমাদের সবাইকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু আমিই রাজি হয় নি।"


"কেনো?"


" বাড়িতে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে চলেছি বলে এই না যে আমি অনুভূতিহীন ছিলাম। বউয়ের সাথে বোনের মতো আচরণ করা কতটা শাস্তিস্বরূপ, এটা তুমি কি বুঝবে! তখন তোমাদের নিয়ে আসলে নিজেকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না।"


মেঘ আবিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।ঘন্টাখানেক ঘুরে ডিনার করে দু'জন একটু রাত করেই রিসোর্টে ফিরেছে। আবির মেঘের ফোন থেকে বন্যার নাম্বার বের করতে যাবে অকস্মাৎ আবিরের নাম্বার টা চোখে পড়ল। আবির মৃদু হেসে 'আমার আবির' এর পেছন থেকে ভাই শব্দটা ডিলিট করে দিয়েছে। বন্যার নাম্বার বের করে একটা মেসেজ লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে। মেঘ বিকেল থেকে বন্যার বোনকে কম করে হলেও ৫০ বার কল দিয়েছে, রিদকে বলামাত্রই কক্সবাজার আসতে রাজি হয়ে গেছে। বন্যার বোন শুরুতে রাজি না হলেও মেঘের তুমুল জোরাজোরিতে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে বন্যাকে পাঠাতে রাজি হয়েছে। মেঘ বলেছিল, বন্যার আপুও যেন তাদের সাথে আসে কিন্তু সময়ের অভাবে ওনি যেতে পারছেন না। বন্যার বাসার সবাই রাজি হলেও বন্যা কক্সবাজার যেতে একদম ই রাজি না। মেঘের অতিরিক্ত জোরাজোরির জন্য এক পর্যায়ে মেঘের কল রিসিভ করাও বন্ধ করে দিয়েছে। মেঘ শুয়ে শুয়ে অনর্গল তানভির আর বন্যার কথা বলেই চলেছে। আবির অনেকক্ষণ যাবৎ ট্রাই করতে করতে একসময় তানভিরের ফোনে কল ঢুকেছে। তানভির কল রিসিভ করে স্বাভাবিক কন্ঠে জানতে চাইল,

" তোমরা কেমন আছো?"


আবির উত্তর না দিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,

" আগামীকাল ভোরে আসিফ ভাইয়া, ভাবি, আইরিন, মীমরা সবাই কক্সবাজার আসছে। তোর ইচ্ছে হলে তাদের সাথে আসতে পারিস।"


তানভির শান্ত কন্ঠে বলল,

" আমার আপাতত ইচ্ছে নেই, তোমরা আনন্দ করো।"


আবির ভারী কন্ঠে বলে উঠল,

" সমস্যা নেই, তোর ইচ্ছে না থাকলে মনের বিরুদ্ধে আসতে হবে না। বন্যা আর তার ভাইও আসবে এই আর কি! ঠিক আছে। রাখি তাহলে।"


"বন্যা কক্সবাজার যাবে?"

"হ্যাঁ"

"আমাদের সাথে? মানে আসিফ ভাইয়া, মীম, আইরিন ওদের সাথে?"


"হ্যাঁ, তুই তো আসবি না। থাক তাহলে।"


তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে জানতে চাইল,

"কয়টায় রওনা দিবে?"

"আমি জানি না, আসিফ ভাইয়া জানে।"

"আমি আসিফ ভাইয়াকে কল দিচ্ছি।"

"তোর ইচ্ছা। "


আবির কল কেটে মেঘের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। মেঘ সহাস্যে বলে উঠল,

" আপনার মাথায় এত বুদ্ধি কোথা থেকে আসে?"


" এসব তো কিছুই না, আমার মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে।"


"কি?"

"এখন বলবো না, আগে ওদের অবস্থা টা বুঝি তারপর। "


"আপনি যে ভাইয়াকে বলে দিলেন, বন্যা আসবে। বন্যা যদি না আসে?"


"তোমার বান্ধবীকে এমন এক মেসেজ পাঠিয়েছি তার ইচ্ছে না থাকলেও আসতে বাধ্য। "


"কি মেসেজ?"


আবির মেঘের ফোন মেঘের হাতে দিয়ে বলল,

"দেখো।"


মেসেজে লেখা,

" শুরুতেই সরি বলে নিচ্ছি কারণ খুব সম্ভবত আমি আমার দেয়া কথা রাখতে পারবো না। আপনাকে ভাবি বানানোর ইচ্ছে অচিরেই ভুলে যেতে হবে। আপনি ভাইয়াকে কি বলেছেন আমি জানি না, কিন্তু তারপর থেকে ভাইয়ার মনের অবস্থা খুব খারাপ। ভাইয়ার অবস্থা দেখে বাসার সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভাইয়ার মন ভালো না হলে, ৭২ ঘন্টা পরে ভাইয়াকে বিয়ে করাবে। পাত্রীও রেডি আছে। আপনি সম্মতি না দিলে আমরা কিছুই করতে পারছি না। ভাইয়া রাগ করে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছে। তবে ৭২ ঘন্টার মধ্যে সঠিক সমাধানে না আসতে পারলে ৭২ ঘন্টা পর পরিবারের পছন্দকেই মেনে নিতে হবে৷ আপনি যদি আমার ভাইকে পছন্দ করেন তাহলে আগামীকাল তাদের সাথে কক্সবাজার আসবেন, আর যদি মনে করেন আপনার আমার ভাইয়াকে প্রয়োজন নেই তাহলে ৭২ ঘন্টা পর আপনার আমাদের বাসায় বিয়ের দাওয়াত রইল। আপন ভাবি হতে না পারলেও দূরসম্পর্কের ভাবির সমান মূল্যায়ন করবো। আপনার জীবন আপনার সিদ্ধান্ত। ভালো থাকবেন, আপন ভাবি বলতে পারছি না তাই আবারও সরি।"


মেঘ মেসেজ পড়ে হাসবে নাকি মন খারাপ করবে সেটাও বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ই প্রশ্ন করল,


" আপনি যে মেসেজ পাঠিয়েছেন, বন্যা যদি বুঝে যায়?"


"বুঝলে বুঝবে। আজ না হয় কাল সে আমাদের বাড়ির বউ হলে সবকিছুই জানবে। কিন্তু আপাতত তাদের মধ্যেকার ঝামেলা মেটানো প্রয়োজন। "


মেঘ অকস্মাৎ আহ্লাদী কন্ঠে বললে উঠল,

" বন্যাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাবি বানানোর ব্যবস্থা করুন, প্লিজ। আমার আর ভালো লাগছে না।"


আবির মোলায়েম কন্ঠে জানতে চাইল,

" তুমি তাই চাও?"


"হুমম।"


" ঠিক আছে, ম্যাডাম। তুমি যা চাইবে তাই হবে।"



বন্যা কাঁথা দিয়ে চোখমুখ ঢেকে শুয়ে আছে। সব কাজ শেষ করে বন্যার বোন রুমে আসছে। বন্যাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে শক্ত কন্ঠে বলল,

" কি হয়েছে তোর?"


বন্যা নাক বরাবর কাঁথা নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

" কিছু হয় নি।"


"ব্যাগ গুছিয়েছিস?"

"না।"

"কেনো?"

"আমি যাব না।"


বন্যার বোন বন্যার পাশে বসে কোমল কন্ঠে বলতে শুরু করল,

" ওদের বাসার কেউ কি তোর সাথে বাজে ব্যবহার করেছে? বিয়েতে কি কোনোরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে?"


"না "

"তাহলে মন খারাপ করে আছিস কেনো?"

" মন খারাপ না।"


"মেঘ, ওর হাসবেন্ড দু'জনেই খুব করে রিকুয়েষ্ট করছে। আব্বুর সাথে কথা বলে রাজিও করিয়েছে। তোর এখন কি হলো? আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি, রিদ আর তোর যত খরচ লাগে সব এখান থেকে করিস। উঠে প্যাকিং কর।"


বন্যার শীতল চোখে বোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বন্যার বোন ঠান্ডা কন্ঠে হুঙ্কার দিল,

"কি বললাম তোকে?"


বন্যা উঠে বসেছে। বন্যার বোন শান্ত কন্ঠে বলে উঠল,

"তুই মন খারাপ করে থাকলে আমার ভালো লাগে না, কোনো বুঝিস না তুই? তিনদিনের মধ্যে ঘুরেফিরে মন ভালো করে বাসায় আসবি। আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে জানিস তো? এই অবস্থাতেও তোকে ঘুরতে যেতে দিচ্ছি শুধুমাত্র তোর মন ভালো করার জন্য। তাই কোনোভাবেই মন খারাপ করে থাকা যাবে না, ওকে?"


বন্যা মলিন হেসে বলল,

"ওকে"


সকাল সকাল সবাই কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। মীম, আইরিন আর বন্যা পাশাপাশি বসেছে। তানভির, রিদ আর আরিফ বিপরীত পাশে। আসিফ আর জান্নাত আলাদা বসেছে। মীম, আইরিন, আরিফ মিলে রিদের সাথে টুকটাক দুষ্টামি করছে। রিদ বয়সে আইরিন আর মীমের মতোই। বন্যা কারো সাথে তেমন কোনো কথায় বলছে না, নির্বাক চোখে শুধু তানভিরকেই দেখছে। তানভির প্রায় পুরো রাস্তায় চোখ বন্ধ করে বসে ছিল। দু একটা কথা বললেও বন্যার সাথে না কোনো কথা বলেছে আর না একবারের জন্যও তাকিয়েছে। মেঘ আর আবির আগে থেকেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। মেঘ আজ সবুজ রঙের মোটামুটি গর্জিয়াছ একটা শাড়ি পড়েছে, যদিও শাড়িটা আবিরই পড়িয়ে দিয়েছে। মেঘের শাড়ির সাথে মোটামুটি ম্যাচিং করে আবিরও একটা সবুজ পাঞ্জাবি পড়েছে। মীম, আইরিনরা নেমেই ছুটে মেঘের কাছে চলে গেছে। তাদের সাথে সাথে রিদও মেঘের সাথে কথা বলতে চলে গেছে। তানভির নামতেই আবির এগিয়ে এসে তানভিরকে জড়িয়ে ধরল। তানভির জিজ্ঞেস করল,


"কি হয়েছে ভাইয়া?"

"তোকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে করছিলো।"


মনের ভেতরের চাপা কষ্টের জন্য মন খুলে হাসতেও পারছে না তবুও তানভির মলিন হাসার চেষ্টা করল। সবাই ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করেই ঘুরতে বেড়িয়েছে। আইরিন আর আরিফ দুই ভাই বোন এটা সেটা নিয়ে ফাজলামো করছে আবার বড় আপুকে ভিডিও কল দিয়ে সমুদ্র সৈকত দেখাচ্ছে। মীম আর রিদ টুকটাক কথা বলছে। রিদ এর আগে কোথায় কোথায় ঘুরতে গিয়েছিল, কার সাথে গিয়েছিল, এখানে কেন আসছে সেসব নিয়েই গল্প করছে। মেঘ আর বন্যা কিছুটা দূরে, মেঘ ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

" তোর আর ভাইয়ার মধ্যে কি হয়েছে? "

"কিছু না।"

"কিছু তো অবশ্যই হয়েছে। ভাইয়া কি তোর সাথে রাগারাগি করেছে?"

"না।"

"তাহলে?"

" আমি ওনার সাথে রাগ দেখিয়েছি।"

"কেনো?"

"জানি না।"


এদিকে আবিরও তানভিরকে বার বার জিজ্ঞেস করছে কিন্তু তানভির সরাসরি কোনো উত্তর ই দিচ্ছে না। তানভিরের নিস্তব্ধতায় আবিরের মেজাজ চরমভাবে খারাপ হচ্ছে। ঘুরাঘুরি শেষে যে যার মতো রুমে গেলেও আবির আর তানভির যায় নি। আবির তানভিরের কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর কন্ঠে জানতে চাইল,

" তুই কি ভেবেছিস, নিজের মধ্যে কষ্ট চাপিয়ে রাখলে সব ঠিক হয়ে যাবে?"


"ঠিক হবে না জানি তবুও আমি কারো সুখের সময়ে দুঃস্বপ্ন হতে চাই না।"


" কোন দুঃস্বপ্নের কথা বলছিস? তুই খুব ভালো করেই জানিস তুই না থাকলে আমার সুখের স্বপ্নগুলো এখনও দুঃস্বপ্ন হয়েই থাকতো। তুই আমার ভাই হয়ে আমাকে না জানিয়ে এত বড় কাজ করেছিলি বলে আমি অভিমান করে তোকে না জানিয়ে তোর বোনকে এখানে নিয়ে আসছিলাম। কিন্তু তোর দুঃখ ভুলে আমি সুখের সময় কাটাতে পারতাম না ভাই। তাই বাধ্য হয়ে তোদের জোর করে এখানে আনিয়েছি। এখন বল তোর কি হয়েছে?"


"আমি নিয়তির কাছে আবারও হেরে গেলাম ভাইয়া। বন্যার চোখে আমি তানভির অযোগ্য ই রয়ে গেলাম। আমি ভাই হিসেবে যথাযথ হলেও প্রেমিক হিসেবে পরিত্যক্ত। "


"বন্যা কি বলেছে?"

" আমাকে বাস্তবতার তিনপাতা অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি বুঝিয়ে।"


আবির মৃদু হেসে বলল,

" এটা আর এমন কি! প্রেমিকার চোখে নিজের প্রেমিক সবসময় নিষ্কর্মা আর অযোগ্যই থাকে৷ "


"ও ওর পরিবারের সিদ্ধান্তের বাহিরে কিছু করতে পারবে না।"


" পরিবারের সিদ্ধান্তের বাহিরে কিছু করতে বলেছে কে?"


তানভির মুখ ফুলিয়ে রাগী স্বরে বলল,

" ও আমাকে রিজেক্ট করেছে।"


আবির উচ্চ শব্দে হেসে বলল,

" রিজেক্ট তাকেই করা যায় যার অবস্থান মন আর মস্তিষ্ক কোথাও নেই। হৃদয়ে জায়গা দেয়া মানুষকে রিজেক্ট করা অসম্ভব। তুই তার উপর রাগ করে ফোন বন্ধ করেছিস আর সেই রাগ সে আমার বউয়ের উপর ঝেড়েছে। কারণ বন্যার প্রিয়মানুষ তুই আর তোর কাছের মানুষ মেঘ। অধিকারবোধ না থাকলে কেউ কারো উপর রাগ দেখায় না তানভির। তুই খুব ভালোভাবেই জানিস, বন্যা বাস্তববাদী একটা মেয়ে। সে তোকে বাস্তবতা নিয়েই জ্ঞান দিবে, এই নিয়ে মন খারাপ করে থাকার কোনো মানে হয় না। "


তানভির কিছু বলছে না দেখে আবির আবারও বলল,

" তুই বন্যার জন্য রাজনীতি ছেড়েছিস এটা কি সে জানে?"

"না।"

"তুই চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিস, এটা কি জানে?"

"না।"


আবির চোখ রাঙিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ই বলে উঠল,

" শুক্রবারে বন্যার বড় আপুর বিয়ে, জানিস কিছু?"


" হ্যাঁ, আপাতত শুধু কাবিন হবে। ৫ থেকে ৬ মাস পর অনুষ্ঠান হবে শুনেছি।"


"তোকে কে বলল?"

"রিদ।"

"বাহ! এখনই শালার সাথে এত মিল। "

"এত মিলের কিছু নেই। আসার সময় বলেছে তাই শুনেছি। "


আবির কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আচমকা ভারী কন্ঠে প্রশ্ন করল,

" তোকে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, তুই কি বন্যাকে ভালোবাসিস?"


তানভির আবিরের দিকে তাকিয়ে নিরেট কন্ঠে জবাব দিল,

" হ্যাঁ।"


" এক মুহুর্তের জন্য মেনে নিলাম তুই অযোগ্য কিন্তু তোর ভালোবাসা কি বিয়ের যোগ্য? নাকি এখনও মনে দুটানা আছে? মনের কোণে অভিশঙ্কা নিয়ে প্রেম হয় কিন্তু সারাজীবন পাশে থাকার সাহস হয় না। তোকে

নির্ভীক ভঙ্গিতে বলতে হবে, যেকোনো মূল্যেই হোক বন্যাকে তোর চাই। প্রেমিকা কোনো কারণে রাগ দেখালে প্রেমিকার উপর রাগ করে ফোন বন্ধ করাটা বোকামি বরং প্রেমিকার রাগের কারণ উদঘাটন করাটা একজন আদর্শ প্রেমিকের কর্তব্য। বন্যা তোকে ভালোবাসে তাই ওর রাগ অভিমান প্রকাশের একমাত্র জায়গা তুই। হয়তো মেঘের মতো ও সরাসরি কিছু বলতে পারে না কিন্তু তোর উচিত তার কথার সঠিক মানে বুঝা। ভাই, ভালোবাসার মূল্য ভালোবেসেই দিতে হয়।"


তানভির ঢোক গিলে অক্লিষ্ট কন্ঠে শুধালো,

" এখন আমার কি করা উচিত?"


আবির মেকি স্বরে বলল,

" সামনে সমুদ্র আছে, যা এক বালতি পানি খেয়ে আয়।"


"ফাজলামো করো না, প্লিজ।"


" সকালে বন্যার সাথে আমি কথা বলবো। তারপর তোর যা ইচ্ছে করিস।"


"যা ইচ্ছে? "


আবির আড়চোখে তাকিয়ে গুরুভার কন্ঠে বলল,

" রিলাক্স। "


তানভির নিঃশব্দে হাসল, সাথে আবিরও হাসল। দুই ভাইয়ের কথাবার্তা শেষ করে রিসোর্টে ফিরতে অনেকটায় দেরি হয়ে গেছে। মেঘ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, আবির রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়েছে। ঘুমন্ত মেঘের শান্ত আদলখানা আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে৷ আবির আবেশিত নয়নে মেঘকে দেখছে, এই দেখার কোনো অন্ত নেই। আবিরের হৃদয় জুড়ে যার অস্তিত্ব প্রতিনিয়ত ত*র্জনগ*র্জন দিয়ে উঠে তার সংস্পর্শ পেলেই আবিরের হৃদয়ে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়। দিনশেষে প্রতিটা মানুষ কারো না কারো কাছে দায়বদ্ধ, কারো ভালোবাসায় পরিতৃপ্ত। মেঘের পূর্ণতা যেমন আবির তেমনি আবিরের পূর্ণতাও মেঘ। সুদীর্ঘ সময়ের নিরীক্ষণ শেষে আবির আলতো হাতে মেঘের মসৃণ গাল স্পর্শ করল। মেঘ ঘুমের মধ্যেই আঁতকে উঠেছে। কুণ্ঠায় চোখ মেলতেই আবিরকে দেখতে পেল। আবির সস্নেহে প্রশ্ন করল,

" ভয় পেয়েছো?"


মেঘ শুকনো ঢোক গিলে কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করল। কোনো কথা না বলে আচমকা আবিরের চত্তড়া বক্ষস্থলে নিজের জায়গা করে নিল। আবির মুচকি হেসে মেঘকে জড়িয়ে ধরে মেঘের চুলে হাত বুলাতে লাগলো। কিছু সময় নিরবতায় কেটে গেল। মেঘ হঠাৎ ই আবিরের উন্মুক্ত বুকে নখ দিয়ে আঁচড় দিতে দিতে ডাকল,

" শুনছেন..!"


আবির শক্ত কন্ঠে বলল,

" তুমি ডাক শুনার যোগ্যতা কি আমার নেই?"


" আছে, কিন্তু "


"কিন্তু কি? আমি যদি তুই থেকে তুমিতে আসতে পারি তুমি কেনো আপনি থেকে তুমিতে নামতে পারছো না?"

মেঘ মোলায়েম কন্ঠে বলে উঠল,

" তুমি তুমি তুমি। হয়েছে? "

"হুমমমমম। এখন বলো আবির "


"আবির ভাই।"


আবির মেঘের মাথায় আস্তে করে গাট্টা দিয়ে ভারী কন্ঠে বলল,

" আবিরের সাথে ভাইয়ের সম্পর্ক ম*রে গেছে। এখন শুধু আবির আছে। বলো আবির"


মেঘ কিছুই বলছে না, তর্জনী আঙুলের নখ দিয়ে আবিরের বুকের উপর A+ M লেখায় ব্যস্ত। মেঘের লেখা শেষ হতেই আবির মেঘের হাত চেপে ধরে মোলায়েম কন্ঠে বলল,


" বুকের উপর A + M লিখতে হবে না, ম্যাডাম। এই নাম হৃদয়ে স্থায়ীভাবে লেখা হয়ে গেছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই নাম অক্ষত থাকবে। আপনাকে যেটা বলেছি সেটা বলুন ।"


মেঘ বলল,

"কি বলব?"


" আবির।"

" আ.. আবির। "

"গুড গার্ল, আবার বলো।"


"ইশশ, আর পারবো না। আমি কি স্কুলে পড়তে আসছি নাকি?"


"হ্যাঁ, তুমি আবিরের স্কুলে ভালোবাসার ট্রেনিং করতে আসছো, বলো।"

"আবির"

"এখন পুরোটা বলো"


মেঘ শীতল কন্ঠে বলল,

"আবির শুনছো?"


আবির নিঃশব্দে হেসে বলল,

" উফফ! তুমি এভাবে ডাকলে আমি বিনাশের দোরগোড়া থেকেও ফিরে আসতে সক্ষম হবো।"


মেঘ অতর্কিতে আবিরের বুকে চিমটি কাটল। আবির মৃদুস্বরে ফের বলল,

" কি বলতে চেয়েছিলে, বলো।"


"আমি একবার আপনার অফিসে গিয়েছিলাম। আপনার রুমের দেয়ালে D লেখা ছিল। তখন আপনি আমাকে D এর মানে বলেন নি। আপনার বেশকিছু ফেসবুক পোস্টেও D লেখা দেখেছি। এই D এর মানে কি?"


"দিলশা।"

"দিলশা মানে কি?"


"হৃদয়ের রাণী। ছোটবেলা স্কুলে কারো মুখে এই নামটা আমি প্রথম শুনেছিলাম। নামের অর্থ জিজ্ঞেস করায় সে এই অর্থটায় বলেছিল। বাসায় এসে আমার সে কি বায়না, তোমার নাম যেন দিলশা রাখে। এমন আজগুবি নাম শুনে বাসার মানুষ আমার কথা কানেই তুলে নি। তখন মনেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম, আমার হৃদয়ের রাণীকে শুধু আমিই দিলশা ডাকব। নামটা সুন্দর না?"


মেঘ অনুষ্ণ কন্ঠে বলল,

" হ্যাঁ, খুব সুন্দর। "

"তোমাকে দিলশা ডাকলে রাগ করবে না তো?"

"একদম ই না। আপনার যা ইচ্ছে তাই ডাকতে পারেন। আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে।"


"কি?"

"বাসায় যখন আমার বিয়ের আলোচনা চলছিল তখন কাউকে কিছু না জানিয়ে আপনি প্রথম বিয়েটা ভেঙেছিলেন, দ্বিতীয়বার মীম আপনাকে জানিয়েছিলো। কিন্তু তৃতীয় বার তো মীম বাসায় ছিল না আর আমার কাছেও ফোন ছিল না। আমার জানামতে বাসার কেউই আপনাকে জানায় নি।তখন আপনাকে কি বাহিরের কেউ বলেছিল?"


" বাহিরের মানুষ শুধু বাহিরের নিউজ দিতে পারে। বাড়ির ভেতর কি চলে এটা কিন্তু তারা জানে না।"


"তাহলে আপনি কিভাবে জেনেছিলেন?"

"তোমার আব্বু আমাকে মেসেজ দিয়েছিলেন।"

"আব্বু?"

"হ্যাঁ"


"কিন্তু তখন তো আব্বু খুব রাগারাগি করছিলেন৷ আমাকে ছেলের সামনে যেতে জোরাজোরি করছিলেন।"


" সেসব ওনার প্ল্যান ছিল, আমি বাসায় পৌঁছানোর আগে তোমাকে ছেলেপক্ষের সামনে আনতে পারলে আমি কিভাবে রিয়েক্ট করি সেটায় দেখতে চেয়েছিলেন। সেদিন শুনোনি সবই ওনার পরিকল্পনা ছিল।"

"আব্বু মেসেজ দিয়েছে জানার পরও আপনি এত ভীত ছিলেন কেনো?"


"মেসেজ যে তোমার আব্বু দিয়েছেন সেটা আমি প্রথমে জানতাম না। অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ আসছিল। আমি দেশ ছাড়ার আগের দিন তোমাকে বাসার কাছে নামিয়ে দিয়ে রাকিবদের সাথে বসেছিলাম সেখানেই এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা। ওনি এই সেক্টরে জব করেন। নরমাললি ফেসবুকে এড হয়েছিলাম। বাহিরে থাকাকালীন হঠাৎ আমার ঐ নাম্বারটার কথা মনে পড়ে, কৌতূহল বশত নাম্বার টা ভাইকে পাঠিয়ে বলেছিলেন ডিটেইলস সংগ্রহ করে দিতে পারবে কি না। একদিনের মধ্যে ওনি ডিটেইলস সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। সিমটা তোমার আব্বু মানে আমার শ্বশুরের নামে রেজিষ্ট্রেশন করা ছিল। আমি সেদিন বেশ অবাক হয়েছিলাম। ৫০% সিউর ছিলাম ওনি আমাদের কথা জানেন আবার ৫০% সন্দেহও ছিল। তাই তখন বিষয়টাকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় নি।"


" ভাইয়ার ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন?"

"সকালে তোমার বান্ধবীর সাথে কথা বলব তারপর যা হোক একটা সিদ্ধান্ত নিব। তুমি আমার সাথে থাকবে।"

"আচ্ছা। "

"এখন ঘুমাও, ভোরবেলা সূর্যোদয় দেখতে হবে তো?"

"হ্যাঁ, শুভ রাত্রি। "

"শুভ রাত্রি।"


সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও পাশাপাশি দুটা রুমে দুই কপোত-কপোতীর চোখে ঘুম নেই। বন্যা, মীম, আইরিনের জন্য একটা রুম নেয়া হয়েছে। মীম, আইরিন ঘুমে তলিয়ে আছে। বন্যা সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে আর বার বার ফোন হাতে নিচ্ছে। তানভিরের নাম্বার বের করে দু একবার কল দেয়ার চেষ্টা করেছে আবার ফোন রেখে দিয়েছে। পাশের রুমে থাকা তানভিরও একইভাবে ছটফট করছে।


ভোরে আলো ফোটার আগেই সবাই সমুদ্র সৈকতে পৌঁছে গেছে। তবে জান্নাত আর আসিফকে কেউ ই ডাকে নি। আবির আগেই বলেছিল তাদের বিরক্ত করবে না তাই ইচ্ছে করেই ডাকে নি। তানভির কিছুক্ষণ দাঁড়ালো, মেঘ আর আবিরকে একসঙ্গে কয়েকটা ছবি তুলে দিয়ে চুপচাপ চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই আসিফ আর জান্নাত আসছে। আবিরের উদ্দেশ্যে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

" আমাদের ডাকলি না কেনো?"


"তোমাদের হানিমুনের সুযোগ দিলাম।"


"বিয়ে হয়েছে প্রায় দেড় বছর হতে চলল। এখন আর আমাদের সেই সুযোগ দরকার নেই ভাই। তোরা নবদম্পতি, এখন সুযোগ তোদের লাগবে।"


আবির মেকি স্বরে বলল,

"আমাদের সুযোগ করে দিতে হবে না, নিজেরায় করে নিতে পারব।"

" এই জন্যই তো বাসর রাতে বউ নিয়ে পালাইছিস।"


আবির শব্দ করে হাসল। সাথে আসিফও। মেঘ, মীম, বন্যা, আইরিন, জান্নাত সবাই সমুদ্রে পা ভেজাচ্ছে। ঢেউয়ের গতিতে ছুটোছুটি করছে। আরিফ আর রিদও তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। আবির আর আসিফ তানভিরের বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলল। একসময় আসিফ সবাইকে নিয়ে নাস্তা করতে চলে গেছে। বন্যা তাদের সঙ্গে যেতে নিলে আবির গম্ভীর কন্ঠে ডাকে,

"বন্যা,দাঁড়াও"

"জ্বি ভাইয়া।"

"তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।"


মেঘ চুপচাপ আবিরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আবির এক পলক মেঘের দিকে তাকালো। মেঘ চোখের ইশারায় বলতে বলল। আবির ঠান্ডা কন্ঠে বলতে শুরু করল,

"তোমার তানভিরের সাথে কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে আমি জানি না আর জানতেও চাই না। আজ আমি তানভিরের ভাই না বন্ধু হয়ে কয়েকটা কথা বলব। তুমি ইতোমধ্যে জানো তানভিরের জীবনে কেউ একজন ছিল, তুমি তাকে দেখেওছো। সেসব কৈশোরের আবেগ ছিল। এখন সে আগের থেকে অনেক বেশি ম্যাচিউর হয়েছে। তোমাকে তানভির ছোট থেকে চিনলেও কখনো তোমাকে নিয়ে সেভাবে ভাবে নি। যেদিন প্রথমবারের মতো ও তোমাকে নিয়ে ভেবেছিল সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত ও শুধু নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টায় আছে। ওর লাইফস্টাইল বরাবরই ছন্নছাড়া, শুধু তোমার জন্য সেই লাইফস্টাইলে পরিবর্তন এনেছে। আমি এখন পর্যন্ত তানভিরকে কম করে হলেও ৫০ টা ঘড়ি কিনে দিয়েছি কিন্তু ও কোনোদিন ভুলেও একটা ঘড়ি পড়ে নি। অথচ তুমি একবার তাকে একটা ঘড়ি দিয়েছিলে, সে ঐ ঘড়িটা ঠিকই পড়েছে। এমন ছোটখাটো হাজারো পরিবর্তন ওর মধ্যে এসেছে। প্রথম প্রথম আমি ও কে বলে বলে সব কাজ করাতাম, এখন সে আমার থেকেও বেশি বুঝে। আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা ও একা হাতে সামলিয়েছে। তানভিরের জেদ সম্পর্কে তোমার কিছুটা হলেও ধারণা হয়তো আছে। তোমার মুখ থেকে কোনো একদিন শুনেছিল, তোমার আব্বু তোমাদের সরকারি চাকরিজীবী ছেলের কাছে বিয়ে দিবে, সেদিনই রাজনীতি ছেড়ে চাকরি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বই কিনে পড়াশোনাও শুরু করে দিয়েছে। তুমি যেমন বাস্তববাদী তানভিরও নিজেকে সেভাবেই উপস্থাপন করতে চেয়েছে। তবে প্রতিটা মানুষের আবেগ, অনুভূতি ভিন্নরকম। হয়তো ওর মনে হয়েছিল তোমাকে তার অনুভূতি জানিয়ে রাখবে তাই তোমার সামনে নিজের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করতে চেয়েছিল। তোমাকে আমি ছোট করে কথা বলছি না কিংবা দোষারোপও করছি না, শুধু তানভির অবস্থান টা বুঝানোর চেষ্টা করছি। তানভির যদি একবার বলে সে চাকরি, ব্যবসা কিছুই করবে না তবুও তাকে কেউ কিছু বলবে না অন্ততপক্ষে আমি তো নয় ই। ও চাইলে আমি ওকে সারাজীবন বসিয়ে খাওয়াতে পারব। আমার টাকায় নয় বরং ওর নিজের টাকায় বসে খেতে পারবে। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা, তানভিরের ব্যাংক ব্যালেন্স বাদ দিলাম। সবাই জানে আমার ছোটখাটো বিজনেসের ৭০% শেয়ার আমার নামে। কিন্তু তারা কেউ এটা জানে না এই ৭০% শেয়ারের মধ্যে ২০% শেয়ার তানভিরের, ২০% মেঘের, ২০% আমার আর বাকি ১০% মীম আর আদির। এই কথা তানভির পর্যন্ত জানে না। আমি কোনোদিন ও কে জানানোর প্রয়োজনও মনে করি নি। আমি তানভিরকে সবসময় সুযোগ দিয়েছি, ও যখন যা চেয়েছে তাই দেয়ার চেষ্টা করেছি। তানভির ব্যবসায় অমনোযোগী বলে চাচ্চু প্রায় প্রায়ই রাগারাগি করেন। কিন্তু মেঘ, আমি আমরা দু'জনেই তানভিরকে পুরোপুরি সাপোর্ট করছি যেন পড়াশোনা করে একটা জব নিতে পারে। তোমার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতেই তানভির সবকিছু ছেড়েছে, সেই তুমিই যদি তার হাত ছেড়ে দেও। ও কি করবে বলো?"


বন্যা ঢোক গিলে শান্ত কন্ঠে বলল,

" ওনি আমার কথাতে এতটা কষ্ট পাবেন আমি বুঝতে পারি নি। ওনি আমার জন্য রাজনীতি ছেড়েছেন, চাকরির চেষ্টা করছেন এগুলোর কিছুই আমি জানতাম না৷ আমার আব্বু রাজনীতি পছন্দ করেন না, এমন অগোছালো জীবনযাপনও পছন্দ করেন না। আমি আমার পরিবারের সম্মতি ছাড়া কিছু করতে পারবো না এমনটায় বুঝিয়েছিলাম।"


"তোমার পরিবারের সম্মতি থাকলে তো তোমার কোনো সমস্যা নেই?"


" না।"

"ঠিক আছে। তুমি এখানে অপেক্ষা করো, তানভিরকে পাঠাচ্ছি। যত দ্রুত সম্ভব মনোমালিন্য ভেঙে মন হালকা করো।"


আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল,

"বউ, চলো।"


বন্যা শক্ত কন্ঠে বলে উঠল,

" মেঘ এখানে থাকুক।"


আবির ভ্রু কুঁচকে মেঘের দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা দিল, মেঘ সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাথা চেপে ধরে বলতে শুরু করল,

" আমার মাথাটা জানি কেমন করে ঘুরছে, চোখে ঝাপসা দেখছি। প্রেশারটা মনে হয় ২০ এ নেমে গেছে। "


আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

" হায় আল্লাহ! এখন কি হবে? তাড়াতাড়ি রুমে চলো। এখানে আর থাকা যাবে না। তোমাকে কি কোলে নিতে হবে?"


মেঘ কিছু বলার আগেই আবির মেঘকে কোলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। বন্যা থ হয়ে তাকিয়ে আছে।আশেপাশে অনেক মানুষের ভিড়, বন্যা একা একা হাঁটছে আর মনে মনে ভাবছে। মেঘ গতকাল কতগুলো ফুল কিনেছিল সেগুলো যত্ন করে পানির বোতলে ভিজিয়ে রেখেছিল। মেঘ দ্রুত রুম থেকে সেই ফুলগুলো নিয়ে আসছে। তানভিরের হাত ফুলগুলো দিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

" ঠিকমতো প্রপোজ করতে না পারলে আজকের পর আমার ভাবির দিকে ভুলেও তাকাতে পারবে না এই আমি বলে রাখলাম। এইযে আমার ওনি সাক্ষী। "


আবির নিরেট কন্ঠে বলল,

" একদম ঠিক, আজকেই তোর জন্য লাস্ট চান্স। আজকের পর আমরা কেউ তোর সাথে নেই। "


তানভির মলিন হেসে বলে উঠল,

" আজ আবার কোন যুদ্ধ হতে চলেছে কে জানে"


মেঘ ফের বলল,

"এক্সেপ্ট না করা পর্যন্ত ফিরে আসবে না। খিদায় বেহুশ হয়ে গেলেও না৷ "


"ঠিক আছে বোন আমার। আপনি যা বলবেন তাই হবে।"


তানভির ফুলগুলো হাতে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে আসলো। এত এত মানুষের ভিড়ে বন্যাকে খোঁজে পেতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো। বন্যা সমুদ্রের পাড়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তানভির বন্যার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই বন্যা চমকে উঠে কিছুটা সরে দাঁড়ালো। এক পলক তাকিয়ে তানভিরকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। তানভির বন্যার কান্ড দেখে মৃদু হেসে বলতে শুরু করল,

"নিষ্করুণ এই পৃথিবীতে অপ্রিয় কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবে শরীর ছুঁয়ে গেলেও একটা মেয়ে যেভাবে রিয়েক্ট করে, সেই রিয়েক্ট টা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া মানুষটার সাথে কখনোই করতে পারে না। হৃদয়টাকে আজীবন বেঁধে রাখবে বলা মেয়েটাও একটা সময় কারোর প্রতি অস্বাভাবিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে৷ তাই না বন্যা?"


বন্যা মাথা নিচু করে বলতে শুরু করল,

" সেদিন আপনার সাথে এভাবে রিয়েক্ট করা আমার একদমই উচিত হয় নি। আমি সত্যি দুঃখিত। মেঘের বিষয়, বাসার সব বিষয় নিয়ে সেদিন একটু বেশিই চিন্তিত ছিলাম। বার বার বলেছিলাম আমি কথা বলতে চাইছি না তবুও আপনি জোর করছিলেন তাই না চাইতেও রাগ দেখিয়ে ফেলেছিলাম। আমি শুধু আমার পরিস্থিতিটা বুঝাতে চেয়েছিলাম আপনি সেটা না বুঝেই রাগ করে ফোন বন্ধ করে দিলেন। আপনার কি একবারের জন্যও আমার কথা মনে হয় নি? একবারও আমার কথা ভাবলেন না৷ আমি সবসময় দেখে আসছি আপনি খুব দায়িত্বশীল একটা ছেলে, আপনার দায়িত্ববোধ আর অপ্রকাশিত যত্ন দেখে আমি বার বার মুগ্ধ হয়েছি সেই আপনি কি না আমার সাথে এমন কাজ করলেন? মেঘের বিয়ের আগেও ২-৩ দিন আমার কল রিসিভ করেন নি, নাম্বার ব্লক করে রেখেছিলেন, এখন একদম বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন৷ এই আপনার দায়িত্ববোধ?"


বন্যা শেষ কথাগুলো বলতে বলতে কান্না করে দিয়েছে। তানভির আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, বেশকয়েকজন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তানভির সহসা বন্যার কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

" কান্না করো না, প্লিজ। আমি সেদিন নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি। আর কখনো এমন হবে না, সরি। "


বন্যা কাঁদতে কাঁদতে ফের বলতে শুরু করল,

" আপনি একটা পাষাণ, নিষ্ঠুর। আমার উপর রাগ করে আমাকেই কষ্ট দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। আপনি বাড়ি থেকে না গেলে তো আপনার বিয়ে ঠিক হতো না। আপনি এমনটা কেনো করলেন? ভালো হয় বিয়ে করার আগে আমাকে এই সমুদ্রের পানিতে ডুবিয়ে মে*রে ফেলুন।"


বন্যার দুচোখ বেয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না তানভির সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে থেকে অকস্মাৎ একহাতে বন্যার চোখের পানি মুছতে মুছতে শঙ্কাজনক কন্ঠে বলতে শুরু করল,

"এই মেয়ে চুপ করো। কি সব বাজে কথা বলছো! আমার আবার কিসের বিয়ে? বিয়ে যদি করতেই হয় আমি তোমাকে বিয়ে করবো। তুমি রাজি হলেও তোমাকে করবো না হলেও তোমাকেই বিয়ে করবো। হয় হিরোর মতো বিয়ে করবো নয়তো ভিলেনের মতো করবো। তবুও তোমাকেই বিয়ে করবো। এই তানভির শুধু বন্যার, আজ এই মুহুর্ত থেকে তুমি শত রাগ করলেও আমি সব সহ্য করে নিব। আমি নিষ্ঠুর হলেও তোমারই থাকবো, পাষাণ হলেও তোমারই থাকবো। বুঝেছো মেয়ে?"


বন্যা শীতল চোখে তানভিরের দিকে তাকিয়ে আচমকা তানভিরকে জড়িয়ে ধরল। আকস্মিক ঘটনায় তানভির কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। আশেপাশে অবেক্ষণ করে কাঁপা কাঁপা হাতে বন্যার পিঠে হাত রাখলো। প্রথমবারের মতো তানভির বন্যার ঘনিষ্ঠতা উপলব্ধি করতে পারছে। তানভিরের হৃৎস্পন্দনের সাথে সাথে পেটের নাড়িগুলোর ধপধপ করে কাঁপছে। এক অদ্ভুত অনুভূতি সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগাচ্ছে। এই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ অসম্ভব। মেঘদের বন্ধুমহলের সবচেয়ে ম্যাচিউর মেয়েটা আজ বিবেক ভুলে আবেগের কাছে ধরা দিতে বাধ্য হলো। খোলা আকাশের নিচে, শত শত মানুষের মাঝে পরিপক্কতা ভুলে ছোট বাচ্চার মতো তানভিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। বেশ কিছুটা সময় তানভির নিজেও বন্যার আবেশে আবদ্ধ ছিল, সেই আবেশ কাটিয়ে বন্যার কানের কাছে ফিসফিস করল,

" এভাবে কেঁদো না প্লিজ, মানুষ উল্টাপাল্টা ভাববে । "


বন্যা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে হুঙ্কার দিল,

" ভাবুক। "

বন্যা তানভিরকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। যা হবে দেখা যাবে ভেবে তানভিরও বন্যাকে বলিষ্ঠ হাতে জড়িয়ে ধরল। তানভিরের হাতে থাকা ফুলগুলো বন্যার পিঠে লাগছে, ফুলে থাকা পানিতে বন্যার জামা ভিজে যাচ্ছে। বন্যা বুঝতে পেরে তানভির ছেড়ে পেছনে দেখার চেষ্টা করল। তানভির বন্যার পিঠ থেকে হাত সরাতেই ফুলগুলো দেখতে দেখতে পেল। বন্যা তানভিরের দিকে তাকিয়ে তপ্ত স্বরে বলল,

" এগুলো কার জন্য এনেছিলেন?"


"আসার সময় বনু দিল, তোমাকে দেয়ার জন্য। "


"দিচ্ছেন না কেনো? নাকি অন্য কাউকে দিতে চান?"


তানভির ঠোঁট বেঁকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

" তানভিরের জীবনে বন্যা এক এবং অনন্য নারী। দিলে তোমাকেই দিব। কিন্তু কথা হলো, হাঁটু গেড়ে না দিয়ে এমনি দিয়ে দিলে কি তুমি রাগ করবে? না মানে, আশেপাশে অনেক মানুষ আছে হাঁটু পানিতে হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করলে যদি হাসাহাসি শুরু করে তখন তো নিজেকে জোকার মনে হবে।"


বন্যা চারপাশে নজর বুলিয়ে নিঃশব্দে হেসে বলল,

" ঠিক আছে, এমনি দেন।"


তানভির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করল,

" তোমার নামটা বন্যা হলেও আমার জীবনে তোমার কর্মকাণ্ড পুরো অগ্নিকান্ডের মতন। তুমি আমার চোখে মুগ্ধতার আনন, হৃদয়ের উষ্ণ প্লাবন। আমার ছায়াবৃত জীবনের দীপ্তি তুমি, স্বপ্নহীন জীবনের স্বপ্ন। তুমি আমার ছন্নছাড়া জীবনের সুনিপুণ নাটাই। এই বিস্তৃত জলরাশিতে দাঁড়িতে বলতে চাই,

তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায় যার কোনো অন্ত নেই। আমাদের জীবনে যত ভাটায় আসুক না কেনো সব ভাটা উপেক্ষা করে আমার ভালোবাসা জোয়ারের মতো সীমাহীন গতিতে বাড়তেই থাকবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি বন্যা, খুব বেশি ভালোবাসি।"


বন্যা তানভিরের হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে মুচকি হেসে বলল,

" ওহ আচ্ছা। আপনি আমাকে এত ভালোবাসেন? আমি তো জানতাম ই না। যাই হোক, ফুল দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। "


তানভির হুঙ্কার দিল,

"ভালোবাসি বলো"


"না বললে কি করবেন?"

" এতক্ষণ হিরো ছিলাম এখন ভিলেন হয়ে যাবো। "

"মানে?"


তানভির ঠোঁট কামড়ে হেসে বন্যার কাছাকাছি এগিয়ে যাচ্ছে, বন্যা একপা দু'পা করে পেছাতে পেছাতে একপর্যায়ে আতঙ্কে উচ্চস্বরে বলে উঠল,

" আমিও আপনাকে ভালোবাসি।"