কলারের থেকে হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে পুলক পকেট থেকে ফোন বের করে একটা ভিডিও প্লে করে দিলো।ভিডিও তে সেই মেয়েটি স্বীকারোক্তি দিচ্ছে।মেয়েটি কাঁদছে আর কথাগুলো বলছে।আর তার পাশেই ওই সর্দারনী।মাথায় ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে সেও স্বীকারোক্তি দিচ্ছে।
বোঝাই যাচ্ছে বেঢপ মার দেওয়া হয়েছে তাদের।শ্রুতি বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।কাকে বিশ্বাস করবে সে? মন তো চাইছে পুলককে বিশ্বাস করতে।কিন্তু পুলক যদি নিরাপরাধ হয়ে থাকে তাহলে এই তিন বছরের মধ্যে কেনো ওকে জানালোনা? ও কিছু ভাবতে পারছেনা।
-‘ বোকা পেয়েছিস? তুই যে ওদের মারধোর করে স্বীকারোক্তি নিয়েছিস তা তো বোঝাই যাচ্ছে।’
-‘ ওয়েল।তাহলে প্রত্যক্ষদর্শী নিয়ে আসি।’ ঠান্ডা গলায় বললো পুলক।
পুলকের ফোন পেয়ে রিয়া আর ধ্রুব এসে হাজির হলো ওদের মাঝে।তারপর ধ্রুব বলতে শুরু করলো,-‘ এতকিছু তো পুলক একা করতে পারে নি।ওকে সাহায্য করেছি আমরা।ও তো মরেই যাচ্ছিলো শ্রুতি ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর।কতভাবে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে! তারপর ওর থেকে সবটা শুনে আমি আর রিয়া উদ্যোগ নিলাম সত্যিটা কী আর এর পেছনে আসল ঘটনাটা কী তা জানার জন্য।কিন্তু পুলক এতটায় ডিপ্রেশনে ভুগছিলো ওকে আগে সুস্থ করার প্রয়োজন বোধ করলাম।মাস ছয়েকের মধ্যে ওকে নিয়ে স্কটল্যান্ড চলে এলাম।আমার আর আমার বাবার সাথে ওকে শেয়ারে নিয়ে নিলাম আমাদের ব্যবসায়ে।শুধু ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য।তার ভেতর রিয়াকে শ্রুতির ব্যাপারে সব খোঁজ নিতে বললাম।পুলক অস্থির হয়ে থাকতো ওর খবর জানার জন্য।আস্তে আস্তে ডিসিশন নিলো ও আর কোনোদিনও শ্রুতির সামনে আসবেনা।ওকে বলবে না ও নির্দোষ।কিন্তু আমি বললাম,-‘ তোর জানা উচিত ওই মেয়েটা কেনো মিথ্যে বলেছিলো।শ্রুতির কাছে নিরাপরাধ সাজার জন্য নয়।সত্যটা জানা তোর প্রয়োজন।’ তার মধ্যেই রিয়া খবর জানালো ঈশাণ শ্রুতিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।ব্যাপারটা আমার কাছে খটকা লাগলেও পুলক নিশ্চিত হয়ে গেলো যে ওই ঘটনার সাথে ঈশাণ জড়িত কোনোভাবে।দেশে ফিরে এলাম ওকে নিয়ে।বহুকষ্টে ওই মেয়েটাকে খুঁজে বের করলাম। মেয়েটির সন্ধান পাওয়ার জন্য সর্দারনীকে কম ধোলাই খেতে হয়নি।আর যখন মেয়েটাকে খুঁজে পেলাম তখন তো সবটা রেকর্ড করেই রেখেছি।এরপরই পুলক আমি আর রিয়া প্ল্যান করলাম ইভেন্টের।নতুন করে আগমন ঘটালাম পুলকের। পুলক আমার ছোটবেলার বন্ধু।ওকে আমি চিনি ওর অতীতটা আমি জানি।তাই আমি বিশ্বাস রেখেছিলাম যে পুলক কখনো শ্রুতিকে ছাড়া পৃথিবীর সর্বত্তোম সর্বশ্রেষ্ঠা সুন্দরী মেয়ের দিকেও তাকাবেনা।আমি ওর বন্ধু হয়ে ওর প্রতি এমন বিশ্বাস রেখেছিলাম।আর শ্রুতি তুই ওর ভালোবাসার মানুষটা হয়ে ওর প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারলিনা?মেরেই তো ফেলেছিলি ওকে।’
-‘ এই তোরা চুপ কর।সবগুলো গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছিস? নাটক করতে শিখে গেছিস না?’ চিৎকার করে বলছিলো ইশাণ।
হঠাৎ করেই ঈশাণের গালে শ্রুতির পাঁচ আঙুল বসে গেলো। ঈশাণ থম মেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো ওর দিকে চেয়ে।
-‘ সবাই তোর শত্রু তাই না?সবাই তোর বিরুদ্ধে নাটক সাজিয়েছে তাই না? কেনো এমনটা করলি তুই? কীভাবে পারলি আমাদের সাজানো সংসার টা ভেঙ্গে দিতে? কী ক্ষতি করেছিলাম আমরা তোর? বল?’
আরো কয়েকটা থাপ্পর পড়ল ঈশাণের গালে।হঠাৎ করে ঈশাণ শ্রুতিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।তারপর হুংকার দিয়ে উঠল।
-‘ ক্ষতি তুই করিসনি।ক্ষতি করেছে ও।’ পুলকের দিকে তাকিয়ে বললো।
আবার বলতে শুরু করলো,-‘ পুলক আমাদের বন্ধুমহলে আসার আগেই আমি তোকে পছন্দ করতাম। ভালোবাসি কথাটা বলতে গিয়েও কখনো বলতে পারি নি। হঠাৎ করেই পুলক কোথা থেকে উড়ে এসে তোর মনে জায়গা করে নিলো।আমি বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারলাম না। দেখলাম তুই অনেক হ্যাপি তোদের রিলেশনশিপে।আস্তে আস্তে তোদের থেকে দূরে সরে গেলাম।সহ্য হতোনা তোদের একসঙ্গে দেখলে।ভেতরটা পুড়ে জ্বলে যেতো।তোদের বিবাহবার্ষিকী তে তোকে ওইভাবে নতুন বউয়ের সাজে দেখে আমার সেই পুরোনো ঘা টা আবার তাজা হয়ে গেলো।তাও বহুকষ্টে নিজেকে সামলিয়েছি এই ভেবে তুই এখন অন্য কারো।তারপরও নিজেকে বেঁধে রাখতে পারি নি।তোকে আরো একবার দেখার লোভটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতো। চলে এলাম অন্য একদিন তোর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু সেদিন পুলকের ব্যবহার আর আমাকে দেখিয়ে তোর সঙ্গে পুলকের ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে খাওয়া আমাকে একরকম পাগল করে দিচ্ছিলো।ভেতরে ভেতরে পুলককে খুন করে ফেলার একটা ঝোঁক কাজ করছিলো।কিন্তু সেই ঝোঁকটাও সামলে উঠলাম।নিজেকে একদম নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে শুরু করলাম।ভুলে যেতে চাইলাম পুলকের সেদিনকার ব্যবহার। তারপর যেদিন তোর বাসায় এসে তোর কাছ থেকে পুলকের অবহেলার কথাগুলো জানলাম মনে মনে খুব খুশি হচ্ছিলাম। ভাবতে থাকলাম এভাবে যদি তোদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায় তারপরই আমি তোকে আমার প্রতি কনভিন্স করার চেষ্টা করবো।আর রবিন যখন পুলকের ব্যাপারে ওই ঘটনাগুলো বললো প্রথমে আমার বিশ্বাস না হলেও আমি এতটায় খুশি হয়েছিলাম যে তখন আমি সব ভেবে নিলাম খুব বেশি সময় লাগবেনা তোদের সম্পর্কটা নষ্ট হতে।’
-‘ এরপরই তুই প্ল্যানগুলো করে ফেললি তাইনা?’ পুলক বললো।
-‘ তিনটা বছর নষ্ট করলি আমাদের জীবনের।কতোটুকু উপকার পেলি এগুলো করে?
কথাটা বলেই পুলক এসে ঈশাণের চোয়ালে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো।মার খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে ঈশাণ টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।রেগে উঠে দাঁড়িয়ে স্যুটের ভেতর পকেট থেকে পুলিশের লাইসেন্সকৃত পিস্তল পুলকের দিকে তাক করে ধরে বললো, -‘ এতকিছু করে যখন উপকার পাইনি তাহলে তোকে খুনই করি।’
শ্রুতি,রিয়া আর ধ্রুব তিনজনই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলো ভয়ে।পুলকের রাগ তখন আরো দ্বিগুণ হয়ে গেলো।পিস্তলকে তোয়াক্কা না করে ওর চোয়ালে আরো একটা ঘুষি মাড়ল।
-‘ আর কতো নিচে নামবি?আমাকে খুন করলে তুই নিজে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবি?পুরো জীবনটায় তোর শেষ হয়ে যাবে।’
ঈশাণ টেবিলের ওপর হুমড়ি দিয়ে পরে রইলো।প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে ওর।এভাবে কারো ক্ষতি করে নিজে কোনোদিন সুখী হওয়া যায় না।আর ভালোবাসা এ তো ঈশ্বর কতৃক দান। এই জিনিস ঈশ্বর যাকে দিবেন শুধু সেই তার অধিকার পাবে। জোর করে তা বা মিথ্যা দিয়ে তা কোনোদিনও অর্জন করা সম্ভব না। কাঁদতে কাঁদতে সে উঠে দাঁড়ালো।কোনো দিকে না তাকিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে গেলো শ্রুতির বাড়ি থেকে।
_______________________
-‘ কিছু বলছোনা যে? ক্ষমা করবেনা আমাকে?’
-‘ তুমি কী অপরাধ করেছো যে তোমাকে ক্ষমা করবো?’
-‘ এতটা অনুরাগ চেঁপে রেখোনা আমার প্রতি।মারতে ইচ্ছা করলে মারো, হাত পা বেঁধে যেমন খুশি তেমন শাস্তি দাও। তবুও মুখ ফিরিয়ে থেকো না।’
-‘ কী চাইছো তুমি?’
-‘ তুমি বুঝতে পারছোনা?’
-‘ বোঝার ক্ষমতা আজ কাল খুব কম।’
-‘ নিয়ে যাবেনা আমাকে তোমার সঙ্গে?’
-‘ গিয়ে কী করবে?’
শ্রুতি এতসময় পুলকের পাশে বসে ওর বাহু জড়িয়ে ধরে কথা বলছিলো।হুট করে ওর পাশ থেকে উঠে এসে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসল।
-‘ আমাকে একা ফেলে চলে যাবে?আমার ভুলের শাস্তি আমাকে এভাবে দেবে?’
কান্নার বেগ বেড়ে গেছে শ্রুতির।পুলক ওর দিকে না তাকিয়ে বললো, -‘ ভুলের শাস্তি তুমি আর পেলে কই?পেলাম তো আমি।আর ভবীষ্যতে যাতে না পেতে হয় তাই…..’
-‘ তাই কী?’
পুলক নিশ্চুপ।
-‘ বলো তাই কী?
পুলক এবার ওর দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে তেজী গলায় বললো,-‘ এরপর যদি কেউ আবার এমন কোনো নাটক তৈরি করে আমার বিরুদ্ধে তখনও যে তোমার বিশ্বাস নড়বড়ে থাকবে না আমার প্রতি তার কী গ্যারান্টি? আমি পারবোনা এত বার বার ধাক্কা খেতে।আমার এত্ত এনার্জি নাই ধাক্কা সামলানোর।’
-‘ দিবোনা তো আর।’ কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো শ্রুতি।পুলক ধমকে প্রশ্ন করলো, -‘ কী দিবা না?’
-‘ ধাক্কা।’
-‘ আমার জায়গায় থাকলে তুমি কী করতে বলো তো?’
-‘ অনেস্টলি বলি?’
পুলক দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে তাকিয়ে আছে।
-‘ আনলিমিটেড থাপ্পড় লাগাতাম তোমার গালে।’
-‘ ব্যাস! আর কিছুই না?’
-‘ বাজে স্ল্যাং ইউজ করতাম।’
-‘ এটুকুই?’
-‘ অবশ্যি আরো একটা কাজ করতাম।কিন্তু সেটা বলবোনা।’
-‘ আমি তো শুনতে চাইছি।’
-‘ বলা রিস্ক।’
-‘ রাত ন’টা বাজে।আমাকে যেতে হবে।কাল সন্ধ্যে ফ্লাইট। অনেক গোছগাছ বাকি আছে।’ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে বললো।
-‘ না প্লিজ!’
-‘ না প্লিজ কী? আমাকে যেতে হবে না? তোমার রং তামাশা দেখবো বসে?’
-‘ আরে বললাম তো আমাকে যা শাস্তি দেওয়ার দাও।যা খুশি বলো, যা খুশি করো।তাও আমাকে ছেড়ে যেওনা।’
-‘ আমার আইডিয়া নেই কী করে শাস্তি দেওয়া যায়।’
-‘ আমি তো কিছু আইডিয়া দিলাম।’
-‘ শেষ একটা আইডিয়া দাওনি।’
মুখটা কাচুমাচু করে বসে আছে শ্রুতি।কী করে এমন একটা শাস্তির কথা বলবে সেটাই ভাবছে।তবুও ও তো বলেছে ও অনেস্টলি বলবে।মুখটা নিচু করে বললো, -‘ তোমাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সত্যি সত্যি কারো সাথে…..’
-‘ কারো সাথে কী? থেমে গেলে কেনো?’
পুলক বেশ এনজয় করছে শ্রুতির অবস্থাখানা।কথাটা ওর মুখ থেকে বের করে তবেই এখান থেকে যাবে ও।বললো, -‘ বলবে নাকি আমি উঠবো?’
-‘ না।সত্যি কারো সাথে প্রেম করে তোমার সামনে এসে দেখাতাম।’
-‘ তোমার আইডিয়া গুলো আমার পছন্দ হয়েছে।তার জন্য তোমাকে আমার সঙ্গে নিবো।তবে আমি শুধু প্রেম করবোনা। বিয়েও করবো তোমাকে চরম শিক্ষা দেওয়ার জন্য।’
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, -‘ চলো এখন।’
-‘ বিয়ে করতে মানে? আমি কী বিয়ে করতাম?কখনোই না।’
-‘ আজকে কী করছিলে?’
-‘ এটা আমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।’
-‘ আর এটা আমার সঠিক সিদ্ধান্ত।’
-‘ আমার সামনে তুমি অন্য একটা মেয়ের সাথে…..’
-‘ শোবো, ঘুমাবো।’
-‘ যাবোনা।যাও তুমি।’ উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো।
-‘ যেতে তোমাকে হবেই।আইডিয়া দিয়েছো শাস্তির।আর শাস্তি খাবে না? চলো……’
টানতে টানতে শ্রুতিকে নিয়ে চলে গেলো পুলক।হয়তো কিছু সময় বাদেই অনুরাগের পালা শেষ করে ভালোবাসার শাস্তির পালা শুরু হবে তাদের মাঝে।