বাইজি কন্যা | পর্ব – ৫৪

21 Min Read
বাইজি কন্যা

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। অন্ধকারে আচ্ছন্ন পাহাড়ি পথ। দু’জন প্রবীণ, প্রবীণা হারিকেন হাতে নিজেদের বাসস্থানে ফিরছিল। হঠাৎ সেগুন গাছের গোড়ায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা একজোড়া কপোত-কপোতী’কে দেখতে পেয়ে ভীষণ অবাক হলো তারা৷ প্রবীণা ব্যক্তিটি প্রবীণ ব্যক্তি’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ ও কুদ্দুসের বাপ, দুই’ডা মানুষ দেহা যায় না? ‘
খুকখুক করে ওঠল কুদ্দুসের বাপ। হারিকেন’টা কিঞ্চিৎ উঁচু করে ধরে সেগুন গাছের দিকে কয়েক পা আগাতে আগাতে বলল,
-‘ ও টুনটুনি দুই’ডা মেয়া,পোলাই তো দেহা যায়। ‘
টুনটুনি’কে কথাটা বলেই সেগুন গাছের শেকড়ে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকা কপোত-কপোতীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ ও নাতি, ও নাতনি তুমরা কেরাগো? ‘
অতিরিক্ত দুর্বলতায় মাথা তুলতে পারলো না শাহিনুর৷ শীতের প্রকোপে জড়োসড়ো হয়ে প্রণয়ের বুকে পড়ে রইল। ক্ষিদের যন্ত্রণায় দুর্বল হয়ে আসা শরীরে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা লাগায় প্রণয়ের বিশাল দেহ অবিরত কাঁপছে। কাঁপতে থাকা মাথা তুলে বুজে আসা চোখ দু’টো জোর পূর্বল খুলল সে। হারিকেনের স্বল্প আলোয় দেখতে পেলো, দু’জন বুড়ো,বুড়িকে। মাথায় সাদা চুল, আর শরীরের কুঁচকানো চামড়া দেখে বুঝলো এদের বয়স আনুমানিক, আশির কাছাকাছি। কেন জানি এই দু’টো মানুষকে ভরসা করল সে। বলহীন কণ্ঠে বলল,
-‘ দাদা বড়ো বিপদে পড়ে গর্ভবতী বউ নিয়ে এই অচেনা জায়গায় এসে আশ্রয় নিয়েছি। সারাদিন অনাহারে বউয়ের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। একমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করতে পারবেন? ‘
বৃদ্ধা টুনটুনি ব্যথাহত কণ্ঠে বলল,
-‘ আহাগো, কুদ্দুসের বাপ এডিগোরে আমগো ঘরে নিয়া চলো। ও নাতি, নাত বউরে নিয়া আমগো সাথে আহো। ‘
কুদ্দুসের বাপও সম্মতি দিলো। প্রণয় আর অপেক্ষা করল না। শাহিনুরের মাথায় হাত বুলিয়ে ওঠে পড়ল। বলল,
-‘ কিছু হবে না নুর। সৃষ্টিকর্তা ঠিক আমাদের রক্ষা করবে।’

জঙ্গলের বেশ ভিতরে পাহাড়ি টিলায় একটি মাটির ঘরের সামনে উপস্থিত হলো ওরা। বৃদ্ধ কুদ্দুসের বাপ প্রণয়, শাহিনুর’কে তাদের ঘরের ভিতর নিয়ে ছালা পেতে বসতে দিলো। বৃদ্ধা টুনটুনি দুই বাটি পান্তা ভাত, দু’টো শুঁকনো মরিচ, লবণের বয়াম এনে ওদের সামনে দিলো। বলল,
-‘ ও নাতি পেঁপে দিয়া পুঁটি মাছ রানছি, পোয়াতিগো পেঁপে খাওন মানা আছে। তুমারে দিলে ওর আবার জিবে পানি আবো। পোলাপানের মুখ দিয়াও লালা পড়ব। আইজকার মতো এডিই খাও। ‘
সারাদিন অনাহারে কাটিয়ে হঠাৎ সামনে খাবার পেয়ে শাহিনুর অস্থির হয়ে গেল। কারো দিকে তাকাল না, হাতটাও ধোয়ার প্রয়োজন মনে করল না। বাটির দিকে মাথা নিচু করে গপাগপ পান্তা ভাত মুখে দিয়ে গিলতে শুরু করল। না লবণ, না মরিচ কোনটাই খেলো না সে। এক নিমিষে নিজের বাটির পান্তা শেষ করে প্রণয়ের বাটিতে হাত দিতেই সহসা হুঁশ ফিরলো তার। লজ্জায় শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে হাত পা কাঁপতে শুরু করল। চরম লজ্জিত হয়ে ছলছল দৃষ্টিতে একবার টুনটুনি, কুদ্দুসের বাপ তো আরেকবার প্রণয়ের পানে তাকালো। প্রণয়ের অসহায় দৃষ্টিজোড়া তার দিকেই স্থির। নিমিষেই সে স্থির দৃষ্টিজোড়া ঝাপসা হয়ে ওঠল। শাহিনুর আলগোছে পান্তাভাতের বাটি প্রণয়ের দিকে ঠেলে দিলো, ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
-‘ খেয়ে নিন। ‘
এক ঢোক গিলল প্রণয়৷ এগিয়ে দেওয়া বাটিটা শাহিনুরের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,
-‘ তোমার পেট ভরেনি নুর৷ আমার থেকেও তোমার পেট ভরানো বেশি প্রয়োজন। ‘
ওদের কথোপকথন শুনে টুনটুনি, কুদ্দুসের বাপ দু’জনই মুচকি হাসলো। কুদ্দুসের বাপ বলল,
-‘ আ টুনটুনি, পান্তার পাতিলডা নিয়া আহোছে দেহি।’
পান্তা ভাতের পাতিল নিয়ে এলো টুনটুনি। বলল,
-‘ ও নাত বউ শরম পাইয়ো না৷ এক পাতিল পান্তা আছে তুমি খাও। এই বাটিরডিও শেষ করো। নাতিন’রে আমি দিতাছি। ‘
কুদ্দুসের বাপ বলল,
-‘ শরম পাইয়ো না তুমরা৷ আমি আর টুনটুনি রাইত আর সকালে পান্তাই খাই। তাই দুপুরে বেশি কইরা পাক করে টুনটুনি। আইজকার পান্তা ভাত রাইতেই শেষ হউক। অসুবিধা নাই। ‘

প্রাণশূন্য দেহে হঠাৎ যেন প্রাণ দান করল কেউ। এমন অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে খাওয়া শেষে প্রণয় কুদ্দুসের বাপের দু’টি হাত চেপে ধরল। বলল,

-‘ আপনাদের এই উপকার কোনদিন ভুলবো না। কোন কিছুর বিনিময়েই এই ঋণ শোধ করতে পারবো না দাদা।’
টুনটুনি বলল,
– ‘ ও কুদ্দুসের বাপ নাতি’রে কও দাদা বইলা যহন ডাকছে ঋণ শোধের কথা আহে ক্যান? ‘
টুনটুনির দিকে ফিরে প্রণয় বলল,
-‘ দাদি মৃত্যু পথ থেকে ফিরিয়ে আনলেন আজ। ‘
– ‘অতো কথা কইয়ো না। বিছনাত ওইঠা নাতবউরে নিয়া শুইয়া পড়ো। ‘
দাদা শাহিনুরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘ সকালডা হইক আলাপ করমুনি এহন তোমরা শুইয়া পড়ো বউডার শইল সুবিধার না। আমরাও চাইরডা খাইয়া শুইগা। ‘
[৯৮]
ভোর সকালে ঘুম ভেঙে গেল প্রণয়ের। আশপাশে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাতেই মনে পড়ে গেল গতরাতের কথা। চকিতে পাশে তাকিয়ে দেখলো, দু’টো কাঁথা গায়ে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে শাহিনুর। স্মরণে এলো টুনটুনি দাদি রাতে দু’টো কাঁথা নিয়ে এসে বলল,
-‘ ও নাতি একটা কম্বল আর দুইডা খেতা দিয়া আমরা বুড়া,বুড়ি পইড়া থাকি। সেইখান থিকা দুইডা খেতা তুমাগোরে দিলাম। দুইজনে জড়াজড়ি কইরা ঘুমাইয়ো শীত করবো না। ‘
কৃতজ্ঞতায় আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে সে বলল,
-‘ খাবার, পানি দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। মাথাগোঁজার জায়গা দিয়েছেন। আর কিছু লাগবে না দাদি। আপনাদের বয়স হয়েছে, আমাদের জন্য শীতে কষ্ট করবেন না। ‘
টুনটুনি দাদি কথা শুনলো না। বড়ো অভিমান করে বলল,
-‘ এই বুড়ির ভালোবাসার দাম নাই নাহি? ‘
মৃদু হেসে প্রণয় বলল,
-‘ মাফ করুন দাদি। আপনার ভালোবাসার কথা শেষ নিঃশ্বাস অবধি ভুলব না। ‘
এই বলে কাঁথা দু’টো নিয়ে সারা রাতের শীত নিবারণ করেছে স্বামী-স্ত্রী। সকাল হতেই সে কথা স্মরণ হলো। শ্রদ্ধায় বুকটা ভরে গেল বৃদ্ধ, বৃদ্ধার জন্য। মনে মনে ভাবলো,
-‘ রাতে আলাপ করার সুযোগ হয়নি। নুর ঘুমাতে থাকুক, আমি বরং উনাদের সঙ্গে কথা বলে আসি।’

পাহাড়ি মাটির রঙ লালাভ,বাদামি। রাঙা মাটিও বলা যায়। সেই রাঙা মাটিতে তৈরি ছোট্ট একটি ঘর৷ সেই ছোট্ট ঘরে আবার দু’টো ছোটো ছোটো রুম৷ যার একটিতে প্রণয়, শাহিনুর’কে ঘুমাতে দেওয়া হয়েছিল। প্রণয় চৌকি থেকে নেমে পাশের রুমের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘ দাদি আছেন? ‘
ঘরের বাইরে থেকে টুনটুনি খুনখুনে কণ্ঠে বলল,
-‘ আ নাতি, ওঠছো? আহো আমার বুগুলে আহো। ‘
ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় টুনটুনি দাদিকে দেখে সৌজন্যের হাসি দিলো প্রণয়। দাদি ছালা পেতে বলল,
-‘ এইহানে বহো নাতি, ঘুম ভালা হইছে? ‘
-‘ আলহামদুলিল্লাহ। ‘
-‘ নাতবউডা ওঠে নাই? ‘
প্রণয় মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। বলল,
-‘ দাদাকে দেখছি না যে। ‘
-‘ হেয় কচু কাটবার গেছে। তুমগোরে তো খাওন দিতে হবো। ‘
চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করল প্রণয়। বলল,
-‘ আমার নাম প্রণয় চৌধুরী ভাগ্যদোষে বউ সহ ফেরারি হয়েছি। আপনার ছেলে,মেয়ে নাই দাদি? ‘
টুনটুনি মুচকি হাসলো। বৃদ্ধার সে হাসির দিকে তাকিয়ে মনের সকল বিষণ্নতা কোথায় যেন পালিয়ে গেল। কিছু সময় চুপ থেকে সে বলল,
-‘ আমার পোলার নাম কুদ্দুস। একটাই পোলা আমার। হের ঘরে আবার দুই মাইয়া। একটা বিয়াইত্তা আরেকটা কুমারী। ‘
-‘ তারা কোথায় থাকে ? ‘
-‘ কুদ্দুস শশুর বাড়িত। ঘরজামাই থাকে। গরিব মানুষ তো গরিবের ঘরে মাইনসে মেয়ে দিবার চায় না। তাই পোলারেই নিয়া গেছে গা। ‘
টুনটুনির চোখে পানি চলে এলো। প্রণয় বুঝলো বড়ো দুর্বল জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছে। তাই অপরাধী স্বরে বলল,
-‘ ক্ষমা করবেন দাদি, বুঝতে পারিনি। ‘
দু’হাতে চোখের পানি মুছে টুনটুনি বলল,
-‘ ঐ যে কুদ্দুসের বাপ আইছে। তুমি যাও দেহি বউডারে ডাইকা তুলো। খাওন দাওন লাগবো তো নাহি? ‘
মাথা নাড়িয়ে শাহিনুর’কে ডাকতে গেল প্রণয়। টুনটুনি চুলায় ভাত বসিয়ে কচুর ডাটা কাটতে বসলো। শাহিনুর’কে ঘুম থেকে তুলে দু’জনে মিলে আবার বাইরে এলো। ওদের দেখে টুনটুনি বলল,
-‘ এই নেও দেহি কয়লা নেও দাঁত মাইজা আহো। ‘
কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতে হবে শুনেই প্রণয়ের শরীর ঘিনঘিন করে ওঠল। তবুও বাঁধ্য হয়ে কয়লা হাতে নিলো। কুদ্দুসের বাপ টুনটুনির পাশে ছালার ওপরে বসে আছে। মাটির চুলায় ভাত বসানো। টুনটুনি কচু কাটতে ব্যস্ত। কুদ্দুসের বাপ শুঁকনো পাতা চুলায় দিচ্ছে। আগুন নিভে গেলে আবার চুলার মুখে মুখ নিয়ে ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছে। দৃশ্যটি দেখে বড়ো ভালো লাগলো প্রণয়ের। শাহিনুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
-‘ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কখন পরিপূর্ণতা লাভ করে জানো? ‘
উৎসুক নয়নে প্রণয়ের পানে তাকাল শাহিনুর। প্রণয় প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘ স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তখনি সফল, যখন যৌবনের সঙ্গী বার্ধক্যেও পাশে থাকে। ‘
লাজুক হাসলো শাহিনুর। সমস্ত দুঃখ,কষ্ট ভুলে গিয়ে সীমাহীন ভালোবাসা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
-‘ আমি আপনার বার্ধক্যের সঙ্গী হতে চাই। ‘
হাত বাড়িয়ে শাহিনুরের মাথায় স্পর্শ করল প্রণয়। বলল,
-‘ দোয়া করি, তোমার দোয়া কবুল হোক। ‘

হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে ছালার ওপর বসলো দু’জন। শাহিনুর টুনটুনি দাদিকে দেখে ভীষণ লজ্জা পেলো। আড়চোখে প্রণয়কে দেখে নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘ দাদির কি লজ্জা নেই? ‘
হকচকিয়ে তাকাল প্রণয়। বলল,
-‘ মানে? ‘
শাহিনুর মাথা নিচু করে অস্বস্তি প্রকাশ করে বলল,
-‘ আমার খুব লজ্জা করছে। ‘
হতভম্ব হয়ে প্রণয় পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
-‘ মানে কী? ‘
রুদ্ধশ্বাসে সরল মনে শাহিনুর বলল,
-‘ দাদি ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরে ঘরের বাইরে এসেছে। দাদা কিছু বলে না কেন? ‘
সহসা হেসে ফেলল প্রণয়। মৃদুস্বরে বলল,
-‘ আরে বোকা উনি বুড়ো হয়ে গেছে। তাছাড়া গ্রামের বৃদ্ধা মহিলারা এভাবেই শাড়ি পড়ে। তুমি কখনো দেখোনি তাই লজ্জা পাচ্ছো, অস্বস্তি হচ্ছে। ‘
-‘ আপনি আগেও দেখেছেন? ‘
ভারী অবাক কণ্ঠ শাহিনুরের। কিঞ্চিৎ অভিমানও স্পষ্ট৷ প্রণয় ঠোঁট টিপে হাসলো মাথা দুলিয়ে বলল,
-‘ অনেকক। ‘
থমথমে মুখে বসে রইল শাহিনুর। প্রণয় সম্মুখে থাকা বৃদ্ধ, বৃদ্ধার সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বিপদের সময় হঠাৎ ফেরেশতার মতো এসে সাহায্য করা মানুষ দু’টো অল্প সময়েই ভীষণ আপন হয়ে ওঠল। তারা যেন ওদের আপনজন। মানুষ দুটোকে এতটাই আপন লাগলো যে দাদা, দাদি সম্বোধন করেও ভীষণ শান্তি পেল। সেই সঙ্গে নিজেদের দুর্দশার কিছুমাত্র তাদের জানালো। পাতানো দাদা, দাদি দু’জনই বড়ো ব্যথিত হলো। বলল,
-‘ আমরা গরিব, দুঃখী দুই মানুষ। তুমগোরও দুঃখের কমতি নাই। যতদিন মন চায় এই বুড়া,বুড়ির সাথেই থাইকো। এই বুড়া, বুড়ি মরলে মাটি দেওয়ার মানুষ ডাকারও মানুষ নাই। তুমরা দুুইডা থাকলে অপকার হবো না উপকারী হবো। ‘
মাথাগোঁজার স্থান পেয়ে দাদা, দাদি আর সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ রইল না প্রণয়ের। শাহিনুরও ভীষণ শান্তি পেলো, নিশ্চিন্ত হলো। সকালের খাবারে কচুর তরকারি পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হলো শাহিনুর। অথচ ছোট্ট বেলা থেকেই কচুর প্রতি ভীষণ অরুচি প্রণয়ের। তবুও কষ্ট করে কচুর তরকারি দিয়ে গরম গরম ভাত খেলো সে। উপরওয়ালা কখন কাকে কোন হালে রাখবে তুচ্ছ মনুষ্য জাতির পক্ষে বোঝা বড়োই মুশকিল। আজ থেকে এক বছর আগে ড.প্রণয় চৌধুরী কি এক মুহূর্তের জন্যও ভেবেছিল, আভিজাত্যপূর্ণ বাড়ি ছেড়ে, ঘর ছেড়ে গতকাল সে একটি মাটির ঘরে রাত কাটাবে? কাঠের সুকারুকার্যের বিশাল পালঙ্ক ছেড়ে চার পায়া ছোট্ট চৌকিতে শরীর ছেড়ে ঘুমাবে? বড়ো, বড়ো মাছ, নানা পদের ভোজ ছেড়ে এক পদের স্বাদহীন কচুর তরকারি দিয়ে ভাত খাবে। হাহ! সবই ভবিতব্য!
[৯৯]
শাহিনুরের পরিহিত শাড়িটি ভীষণ নোংরা হয়েছে। কত পথ পারি দিয়ে, রাস্তার ধুলাবালি, জঙ্গলের ধুলাবালি গায়ে মেখে এই স্থানে আসা। গতকাল গোসল করা হয়নি, যেমন গা গুলাচ্ছে তেমন মাথা ব্যথা করছে। গর্ভবতী অবস্থায় এত ধকল৷ তার ওপর শরীরে নোংরা কাপড় ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ল প্রণয়। তার কাছে টাকা, পয়সা নেই। সঙ্গে করে কোন কাপড়চোপড়ও আনতে পারেনি। দাদা, দাদি দয়া করে অনেক কিছু দিয়েছেন। আরেকটু দয়া করে যদি শাহিনুর’কে একটা শাড়ি দেয় ভীষণ উপকার হবে। ভাবনা, চিন্তা করে ঘর থেকে বের হলো। ঘরের পেছনে তাদের কথা শোনা যাচ্ছে। তাই ঘরের পেছনে গেল। দেখলো মইয়ের নিচে টুনটুনি দাদি ধরে আছে। উপরে দাদা কাস্তে দিয়ে কলার ছড়ি কাটছে। লক্ষ করল বিচি কলা। টুনটুনি দাদি প্রণয়কে দেখে বলল,
-‘ ও নাতি গাছ পাকা কলা, তুমার দাদার খুব পছন্দ। অর্ধেক আমরা খাই আর অর্ধেক হাঁটে বেচে দেয় কুদ্দুসের বাপ। ‘
স্মিত হেসে প্রণয় বলল,
-‘ আপনি এদিকে আসেন আমি মই ধরি। ‘
দাদি সরে এলো প্রণয় মই ধরলো। বলল,
-‘ দাদি আপনার নাতবউকে একটা শাড়ি দেওয়া যাবে। আসলে…’
বাকিটুকু বলতে হলো না। দাদি বুঝে গেল। বলল,
-‘ তুমি তাইলে দাদার সাথে থাকো। দুইডায় মিলা কলা পাইড়া খাও আমি নাতবউয়ের কাছে গেলাম। ‘

অনেক পুরোনো একটি ট্রাংক থেকে লাল খয়েরী রঙের একটি সূতি শাড়ি বের করে শাহিনুর’কে দিলো দাদি। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো ব্লাউজ নিয়ে। দাদির কোন ব্লাউজ নেই। পুরোনো যেগুলো ছিল সেগুলো একেতো ছেঁড়া আবার শাহিনুরের শরীরে ঢুকবেও না। দাদি বলল, ওগুলো তার বিয়ের সময়কার ব্লাউজ। শাহিনুর প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল। আহারের অভাব সহ্য করেছে এবার বুঝি বস্ত্রের অভাবে ভুগবে? আর কত পরীক্ষা দিতে হবে তাকে। আর কত যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে? হে সৃষ্টিকর্তা এই দুঃসময়ের কি অন্ত নেই? বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। টুনটুনি দাদি বলল,
-‘ আ নাতবউ চিন্তা করো কেরে? শায়া পিন্দা কাপড় পিন্দ। বেলাউজ লাগবো না। আমারে দেখ দেখি, আমিও তো পরিনাই। ‘
শাহিনুর লজ্জায় মাথা নত করে ফেললো। বলল,
-‘ আমি এভাবে পারবো না। ‘
-‘ শরম পাও কেরে? আইচ্ছা হুনো বুদ্ধি দেই, গোসল ধুইয়া কাপড় পিন্দ। তুমার দাদার সামনে যাইয়ো না তাই হবো। আইজকার বেলাডাই কাইল আবার এই কাপড় শুকাইলে এইডা পইড়ো। ‘
বুদ্ধি’টা মনে ধরলো। কিন্তু পরোক্ষণেই আবার লজ্জায় মুখটা আরক্ত হয়ে রইল। প্রণয় যতই তার স্বামী হোক এইরূপে ভীষণ লজ্জা লাগবে তার। দাদি তার আরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘ কী লো জামাইয়ের সামনেও লজ্জা পাবা নাকি? ‘
নতমুখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল শাহিনুর। দাদি পুনরায় খোঁচা দিয়ে বলল,
-‘ পোয়াতি হইয়া গেছে তার আবার জামাইরে একটু শইল দেখাইতে শরম ঢং। যাও গোসল সাইরা নেও। অতো লজ্জা পাইয়ো না। রাইতে যারে কাপড় খুলবার দেও দিনে তার সামনে খুললাম কাপড়ে অত শরম কিয়ের? ‘
.
পাহাড়ি টিলার নিচে একটি ছোটো পুকুর রয়েছে। সেখানে গিয়ে দাদার সাথে গোসল করে দাদার দেওয়া একটি লুঙ্গি পরেছে প্রণয়। খালি গা’য়ে লুঙ্গি পরে দাদার সঙ্গে দুপুরে পান্তা ভাত খেলো। দাদির কাছে শুনলো, তাদের আসতে দেরি হচ্ছিলো বলে শাহিনুর তার সাথে খেয়ে নিয়েছে। ভেতরের খবর তখনও টের পেলো না প্রণয়৷ খাওয়া শেষে বিশ্রাম করার জন্য যখন ঘরের ভিতরে ঢুকলো শাহিনুর’কে কাঁথা গা’য়ে চৌকিতে শুয়ে থাকতে দেখলো। কিঞ্চিৎ অবাক হলো, এগিয়ে গিয়ে কপালে হাত রেখে বলল,
-‘ শরীর খারাপ লাগছে? ‘
কেমন সংকুচিত হয়ে গেল শাহিনুর, প্রণয় আলগোছে কাঁথার ভেতরে ঢুকে গিয়ে পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরতেই বিস্মিত হলো। বলল,
-‘ এ কী কাণ্ড! ‘
মুহূর্তে লজ্জায় বিছানা থেকে ওঠে পড়লো শাহিনুর। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে ভীষণ লজ্জিত হয়ে পিছমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একহাতে শাড়ির আঁচল টেনে ধবধবে ফর্সা কাঁধ ঢাকার বৃথা চেষ্টা করছে সে৷ তাজ্জব হয়ে বসে পড়ল প্রণয়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত শাহিনুর’কে দৃষ্টিপাত করল। বুকের ভিতর অদ্ভুতাকারে কেঁপে ওঠল। অপ্রত্যাশিত ভাবে শাহিনুর যে রূপে তার কাছে ধরা দিয়েছে। এই রূপ তার হৃদয়ের স্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অপলক দৃষ্টিতে শাহিনুরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। ধীরে ধীরে ওঠে দাঁড়ালো। শাহিনুর তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো জানালার কাছে। মাটির দেয়ালে চতুর্ভুজাকারে কাটা হয়েছে। তার সামনে গিয়ে এক হাত বাড়িরে ফাঁকা জায়গায় রাখলো। প্রণয় তাকিয়ে দেখলো শুভ্র দেহের এক কিশোরী কন্যা’কে। পা’য়ের গোড়ালি থেকে বেশ কয়েক ইঞ্চি উন্মুক্ত। বোধহয় শাড়ি’টা খাটো হয়েছে ওর। পেটিকোট দেখা যাচ্ছে টুনটুনি দাদি শাহিনুরের মতো লম্বা না৷ তাই খাটো হয়েছে। শাড়িটা পেঁচিয়ে পরার দরুণ উপরে ওঠে গেছে৷ মেয়েদের শাড়ি বারো হাত পান্না হয় জানে প্রণয়। কিন্তু শাহিনুর যে শাড়ি পরেছে এটা বোধহয় এক দুই হাত কম হবে। নয়তো আঁচল দিয়ে দিব্যি উন্মুক্ত কাঁধটা ঢাকা যেতো। ইস দাদির ব্লাউজ ছিল না, থাকলেও ওর গায়ে লাগেনি বোধহয়। কী আঁটসাঁট ভাবে বক্ষোজ ঢেকেছে। বড়ো আবেদনময়ী লাগছে ওকে। ভাবতে ভাবতেই একদম শাহিনুরের পশ্চাতে চলে এলো প্রণয়। শাহিনুরের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে ওঠল। মৃদু কণ্ঠে বলল,
-‘ আপনি আমায় একটুও লজ্জা দেবেন না আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করব। ‘
মৃদ্যু হেসে দুম করে শ্বাস ফেলল প্রণয়। তপ্ত বাতাস ছুঁয়ে দিলো শাহিনুরের উন্মুক্ত কাঁধ। শিউরে ওঠল সে। তার শিহরিত হওয়া শরীরটা প্রণয়ের দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ হয়ে ধরা দিলো। বিয়ের এতগুলো দিন পরেও এতটা লজ্জা? তার মানে সে কি তার বউয়ের লজ্জা হরণ করতে পারেনি? ছিঃ কী অপমানের কথা! যে মানুষটা তার এতকিছু হরণ করে নিলো সে মানুষ’টার লজ্জা হরণ করতে পারলো না? এমন অধর্ম কি সহ্য হয়? কখনোই না। দুম করে আরো একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করল প্রণয়৷ হাত বাড়িয়ে শাহিনুরের উদর স্পর্শ করল। কেঁপে ওঠল শাহিনুর। কম্পিত হাতে স্পর্শ করল উদের রাখা প্রণয়ের হাতটি। উন্মাদীয় স্বরে প্রণয় বলল,
– ‘ফের হৃদয় হরণ হলো! একই হৃদয় আর কতবার হরণ করবে? আমার ঝিমিয়ে পড়া হৃদয়ে তীব্র প্রেমের উদ্রেককারী’কে স্বাগতম। ‘
প্রণয় ধীরে ধীরে আরেকটু গভীর হলো। আরেকহাত কাঁধ স্পর্শ করে ক্ষিপ্র চিত্তে ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিলো কাঁধে। চোখ বুজে ঘুরে দাঁড়ালো শাহিনুর। তার রক্তিম মুখশ্রীতে মুগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
-‘ প্রথম দর্শনে আমার হৃদয়ে তোমাকে ঘিরে যে অনুভূতির জন্ম হয়েছিল, সে অনুভূতি’তে পরিতৃপ্ততা ছিল না৷ বিশ্বাস করো আজকের দর্শনে আবারও প্রেমে পড়ে গেছি। কী অদ্ভুত! একই মানুষে একই আমি অসংখ্যবার প্রেমে পড়ছি। হে অর্ধাঙ্গিনী
একটাই অনুরোধ, আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এক তুমি অজস্রবার আমার হৃদয়কে হরণ করে যেও। ‘
চোখ মেলে তাকাল শাহিনুর। দৃষ্টি টলমল সম্মুখের মানুষটা তাকে এত ভালো কেন বাসে। তার প্রতি এত মুগ্ধতা কেন এই চোখে? শাহিনুরের অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রণয় ফের বলল,
-‘ হে প্রিয়তমা, আমার প্রাণপ্রিয় অর্ধাঙ্গিনী, আমার হৃদয়ের অনন্ত প্রণয়ের এক মাত্র অধিকারিনী, প্রথম দিবসের ন্যায় আজো আমি তোমার হরিণাক্ষী নেত্রযুগলে আমার সর্বনাশ দেখতে পাই। ‘
চোখ বেয়ে সুখাশ্রু ঝড়তে শুরু করল শাহিনুরের। এত কষ্ট এত অসহায়ত্বেও মানুষটার মনে তার প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই, প্রেমের অন্ত নেই।
– ‘ কী গো সর্বনাশী? ‘
পুনরায় প্রণয়ের বাক্যে শাহিনুর তর্জনী দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরল তার। বলল,
-‘ আপনি ছাড়া আমার কোন অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে থাকবে না। বড়ো ভালোবাসি আপনাকে ডাক্তার সাহেব। আপনি পুরোটাই আমার জন্য বড়ো সুখকর।’
– ‘ এক তুমির অগণিত প্রার্থীদের এক আমিই পরাজিত করেছি। জয় করে নিয়েছি তোমাকে মনোহারিণী। তোমার গর্ভাশয়ে যে ছোট্ট অংশ বেড়ে ওঠছে সে আমারই অংশ। প্রকৃতির লীলাখেলা দেখেছো? প্রকৃতির দেওয়া দুঃখ যেমন অসহ্য, সুখটাও ভীষণ অসহনীয়। ‘
কথাগুলো শেষ করে মুহূর্তেই অধরচুম্বনে লিপ্ত হলো প্রণয়। সাড়া দিলো শাহিনুর। দু’হাতে প্রণয়কে আঁকড়ে ধরলো সে। বুঝিয়ে দিলো, তার প্রতি গভীর প্রেম, গভীর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা’কে। প্রেমের ধর্ম বড়ো মারাত্মক। মানব হৃদয়ের অগাধ প্রেমই চরম দরিদ্রতার শোক, তীব্র বিষাদ অনুভূতি এক নিমিষে নিঃশেষ করে দিতে পারে৷

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।