অঙ্গনের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতেই সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল প্রেরণার৷ সত্বর গতিতে আঁচলের নিচে চিঠি’টা লুকিয়ে ফেলল। ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল মুছে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ছেলের দিকে। উৎকণ্ঠিত হয়ে অঙ্গন বলল,
-‘ কী লুকাচ্ছেন? আপনি কী লুকাচ্ছেন? আমার কাছে কিছু লুকাবেন না আম্মা, সত্যি বলুন, সত্যিটা আমাকে বলুন। ‘
চোখমুখের রঙ বিকৃত হয়ে গেল প্রেরণার। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল মানুষ’টা। অঙ্গন অসহনীয় কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠল। প্রেরণার ভয়ের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে ওঠল। সচেতন দৃষ্টিতে দ্বারের বাইরে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
-‘ ওরে সর্বনাশা আস্তে কথা বল, আস্তে কথা বল। ‘
তীব্র উত্তেজনায় কাঁপছে অঙ্গন। মা’য়ের কথা শুনে তার উত্তেজনার মাত্রা কিছুটা কমে এলো। দু পা পিছিয়ে গিয়ে কক্ষের দ্বার বন্ধ করে পুনরায় প্রশ্ন করল,
-‘ তার মানে আপনি জানেন সেজো ভাই, নতুন ভাবি কোথায় আছে? ‘
আঁচলের কোণা দিয়ে আবারও ঘেমে ওঠা মুখমণ্ডল মুছে নিলো প্রেরণা। বারকয়েক ঢোক গিলে শুষ্ক গলাটা ভেজাল। অঙ্গন ধীরপায়ে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। লুকিয়ে রাখা চিঠিটা আরেকটু লুকিয়ে নিলো সে। ছেলের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কম্পিত স্বরে বলল,
-‘ তুই তো এমন ছিলি না বাপ, তোর এই অচেনা রূপ আমি আর সহ্য করতে পারছি না। এত অস্থিরতা, এত মেজাজ, অল্পতে মাথা গরম, তুই কবে স্বাভাবিক হবি, কবে আবার সেই আমার আগের অঙ্গনে ফিরে যাবি? ‘
উগ্রকণ্ঠে অঙ্গন জবাব দিলো,
-‘ কথা ঘুরাবেন না আম্মা। আপনার সেই অঙ্গন মরে গেছে। যার নিজের বাবার মৃত্যুর স্মৃতিটুকুই মনে পড়েনি সে কীভাবে স্বাভাবিক থাকে বলুন ? যার পুরো পৃথিবীটাই হারিয়ে গেছে তার মাথা কতটুকু ঠিক থাকবে বলুন? অতো কথা বুঝি না৷ আপনার লুকিয়ে রাখা কথা গুলো আমি জানতে চাই৷ নয়তো তাণ্ডব চলবে এখন। আমার মাথা ঠিক নেই, আমার মনে শান্তি নেই। আমার জীবনে আর কোন স্থিরতা নেই। শুধু আছে লক্ষ্য! ‘
ডাক্তার বলেছে, অঙ্গন’কে কোনকিছু নিয়ে উত্তেজিত করা যাবে না। যতটা সম্ভব তাকে স্বাধীন চলাফেরা করতে দিতে হবে। তার মর্জি অনুযায়ী সব করতে হবে৷ নয়তো সে ভয়ংকর রেগে যাবে, উত্তেজিত হয়ে নিজের বা যে কোন ব্যক্তির ভয়াবহ ক্ষতি করে দেবে। কোন কিছু নিয়ে জোরজবরদস্তি বা তার মস্তিষ্কে কোন কিছু নিয়ে কোন প্রকারে চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। এতেই সে স্বাভাবিক এবং সুস্থ থাকবে। পাশাপাশি ওষুধ গুলো নিয়ম অনুযায়ী সারাজীবন চলবে। কোন কারণে, যদি আবার তার মনে বা মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং ওষুধ খাওয়ানো বন্ধ হয় তাহলে একেবারে ভারসাম্যহীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৯৯%। কারণ তার অতীতের এমনও অনেক স্মৃতি রয়েছে যা সর্বক্ষণ তার মস্তিষ্কে বিচরণ করে। যার ফলে তার মানসিক বিপর্যয় ঘটে। আর এটা থেকেই মেজাজ সব সময় উগ্র হয়ে থাকে। এই উগ্রতার মাত্রা অত্যাধিক বেড়ে গেলে তার পক্ষে যা কিছু ঘটিয়ে ফেলা সম্ভব! এসব কথা স্মরণ হতেই ডুকরে ওঠল প্রেরণা। ভয়ে ভয়ে চিঠি’টা অঙ্গনের সামনে ধরে ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
-‘ তোকে আমার কসম বাপ, এই কথা আর কারো কছে প্রকাশ করবি না৷ তোর বড়ো আম্মার কাছেও না। ‘
অঙ্গন চট করে চিঠি’টা নিয়ে পড়ল,
” আম্মা আমার সন্তান আমাকে তার অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ আম্মা, আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ। দোয়া করবেন তার জন্য, দোয়া রাখবেন আমাদের জন্য। ”
মুহূর্তেই সমস্ত উগ্রতা ভুলে গেল অঙ্গন। তার চোখে, মুখে উৎফুল্লতা স্পষ্ট হয়ে ওঠল। বির বির করে বলল,
-‘ তোমাদের সুখের নিশ্চয়তা শিঘ্রই আসবে ভাই। তোমাদের সুখী পরিবার দেখার আশায় রইলাম। ‘
_
সখিনার ছেলে হয়েছে আজ চারদিন। চৌধুরী বংশের প্রদীপ এখন সখিনার ছেলে। অলিওরের প্রয়াত পুত্র রঙ্গনের ঔরসজাত সন্তান। অথচ পুরো দুনিয়ায় তার বাবার পরিচয় বহন করছে তারই চাচা অঙ্গন!বলাবাহুল্য সখিনার প্রতি ঘৃণা থাকলেও তার সন্তানের প্রতি বিন্দুমাত্র ঘৃণাও প্রকাশ করেনি অঙ্গন। দাইয়ের সহায়তায় পাঁচফোড়ন গৃহেই সন্তান জন্ম দিয়েছে সখিনা। যেহেতু সবাই জানে এই সন্তান অঙ্গন এবং সখিনার সেহেতু সর্বপ্রথম অঙ্গনের কোলেই দেওয়া হয়েছে, জমিদার পরিবারের নবপুত্র’কে। সে পুত্রকে বিনা স্বার্থে, বিনা শর্তে নিজ পুত্র হিসেবে গ্রহণ করে বুকে স্থান দিয়েছে অঙ্গন। নাম দিয়েছে, স্বপ্ন। যার অর্থ কল্পনা, মিথ্যা সর্বপরি আশা! অঙ্গন পুত্র স্বপ্ন চৌধুরী। স্বপ্নের কথা চিন্তা করে বড়ো আম্মা, অরুণা অঙ্গনের কাছে অনুরোধ করল,
-‘ এবার নিজের ঘরে ঠাঁই দে মেয়েটাকে।’
জবাবে অঙ্গন বলল,
-‘ যা দিয়েছি এই কি ঢেরবেশি না? আমি চাই স্বপ্ন তার মা’য়ের সঙ্গে রঙ্গনের ঘরে থাকুক, বেড়ে ওঠুক সেখানেই। যার সন্তান তার নাম তো বিলীন হয়ে গেল। ঐ ঘরে ওর অধিকার আছে অদৃশ্য সেই অধিকারেই না হয় বেড়ে ওঠুক। ‘
অরুণা বলল,
-‘ বড়ো হয়ে স্বপ্ন যখন জিজ্ঞেস করবে তার বাবা, মা একসঙ্গে থাকে না কেন? কী উত্তর দেবো আমরা? ‘
-‘ আমার ছেলের প্রশ্নের জবাব আমিই দেবো। আপনারা চিন্তা করবেন না। ‘
বলেই গটগট করতে করতে চলে গেল অঙ্গন। কিন্তু তার বলে যাওয়া বাক্যটা উপস্থিত সকলের কর্ণে কর্ণে বারেবারে প্রতিধ্বনি হতে শুরু করল। আর কী চাই? স্বপ্ন এবং তার মা সখিনা এই ঋণই কোনদিন শোধ করতে পারবে না। সবশেষে একটা কথা সবার মনে রাখা উচিৎ, রঙ্গন স্বপ্নের জন্মদাতা, পিতা হলেও অঙ্গন তার পিতৃব্য। যত রাগ থাকুক, সখিনা, রঙ্গনের প্রতি যত ঘৃণা থাকুক স্বপ্নের প্রতি অঙ্গনের স্নেহ, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ সারাজীবন অনড় থাকবে৷
বহুদিন, বহু মাস পর পাঁচফোড়ন গৃহের পরিবেশ রমরমা হয়ে ওঠেছে। অনেক হারানোর পর একটুখানি প্রাপ্তি’তে সকলের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটেছে। সন্তানহীন পল্লবের সুখের কমতি নেই আজ। শবনমের ভাষ্যে সকলের মনের আশা পূরণ হবে বংশ প্রদীপ স্বপ্নের দ্বারা। নিঃসন্তান পল্লবও তার মুখে বড়ো বাবা ডাক শুনতে আগ্রহী। নিঃসন্তান জেবাও তার মুখে মেজো মা শুনতে আগ্রহী। শবনম, সে তো বড়ো মা হয়েই আছে। অরুণা, প্রেরণা তাদের সবচেয়ে আদুরে বাচ্চা রঙ্গন শোক কাটাচ্ছে এই বাচ্চার মুখপানে তাকিয়ে। সকলের সম্মতিতে নতুন অতিথীর আগমনে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয়েছে৷ এই আয়োজনে উপস্থিত হয়েছে মুনতাহাও। বৈঠকখানায় সকলের সঙ্গে বসে থাকলেও তার চোখ শুধু গৃহের অন্দরের দিকে। খেয়াল করে শবনম বলল,
-‘ মেজো বউ তোমার ঘরে যাবা? ‘
মলিন হেসে মুনতাহা বলল,
-‘ এ বাড়িতে আমার ঘর নেই বড়ো ভাবি। ‘
-‘ এ বাড়িতে তোমার স্থান আগের মতোই আছে মেজো বউ। তোমার ঘরও আছে। যেভাবে রেখে গেছিলে সেভাবেই আছে। ‘
-‘ ঘর দিয়ে কী করব? বর তো নেই!’
দু’চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠতে নিমিষেই দৃষ্টি নত করে ফেলল মুনতাহা। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে শবনম ভাবল,
-‘ কী দিয়ে গড়া এই মেয়ে? অমন পিশাচের জন্যও এত দুঃখ! এত শূন্যতা!’
দীর্ঘসময় নিশ্চুপ বসে থাকার পর হঠাৎ ওঠে দাঁড়ালো মুনতাহা। শবনম’কে বলল,
-‘ আমি সখিনা আর বাচ্চাটাকে দেখতে চাই। ‘
শবনম স্মিত হেসে মুনতাহাকে নিয়ে রঙ্গনের ঘরে গেল। মুনতাহা অবাক হলো রঙ্গনের ঘরে সখিনাকে দেখে। কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু বলল না। স্বপ্ন’কে কোলে নিয়ে আদর করল। অনেক সময় তাকিয়ে রইল পুচকোটার দিকে। স্বপ্ন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুনতাহার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল। মুনতাহা চুমু খেলো ওর কপালে। শবনমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ বাবার মতোই হয়েছে। শুনেছি রঙ্গন হওয়ার পর এমনই ধবধবে ফর্সা, এমনই পাতলা ছিল, মাথায়, কপালে নীল বর্ণীয় রগ গুলোও ভেসে থাকত। ‘
সখিনার মুখটা ছোটো হয়ে গেল৷ শবনমও নিশ্চুপ হয়ে গেল। মুনতাহা আরো কিছুক্ষণ স্বপ্নকে আদর করে ওঠে পড়ল। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, বুক ভার ভার লাগছে। মনে পড়ছে হসপিটালে থাকা সেই মুহূর্তটুকুর কথা, যে মুহূর্তে তার খারাপ স্বামী’টা এসে তার দুটো পা ধরে মাফ চেয়েছিল। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কথা দিয়েছিল, আবারও বাচ্চা নেবে তারা। মানুষ’টা তো ভালো হতে চেয়েছিল, মানুষ’টা ক্ষমা চেয়েছিল তার কাছে। কথা দিয়েছিল আবারও বাচ্চা নেবে, ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে তাকে। সহ্য হলো না তার সুখ, সহ্য হলো না কারো! ক্রমেই চোখ, মুখের রঙ পরিবর্তন হতে শুরু করল মুনতাহার। বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে রঙ্গনের কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেল রান্নাঘরে। সেখানে গিয়ে ভৃত্য রহিমা’কে খুঁজে বের করল। এ গৃহে প্রতিটি বউদের জন্যই একজন করে ভৃত্য নিয়োজিত থাকে। যেমন’টা শাহিনুরের জন্য রাখা হয়েছিল ময়নাকে৷ ঠিক তেমনি মুনতাহার জন্য ছিল রহিমাকে। মুনতাহা চলে যাওয়ার পর থেকে প্রেরণার দেখভাল করে সে৷
সকলের দৃষ্টির অগোচরে রহিমা মুনতাহাকে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেল। বিছানার তলা থেকে দু’ভাঁজ করা সাদা একটি কাগজ বের করে দিলো, মুনতাহা খপ করে কাগজটা নিয়ে বলল,
-‘ এটা কার, তুমি পেলে কোথায়? ‘
-‘ ছোটো গিন্নির ঘরে থিকা পাইছি। এই কাগজডাই থাইকা থাইকা পড়ে, আবার লুকাইয়াও থয়। আপনি কইছেন যা নিয়া সন্দেহ হবো তার দিকে নজর দিতে। আমিও নজর দিছি। আইজকা আপনে আসবেন হুইনা কাইলই এইডা চুরি করছি। ‘
মুনতাহা ত্বরিতগতিতে নিজের হাতব্যাগ থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট রহিমাকে দিলো। তারপর দ্রুত কাগজের লেখাগুলো পড়ল,
” আম্মা আমার সন্তান আমাকে তার অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ আম্মা, আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ। দোয়া করবেন তার জন্য, দোয়া রাখবেন আমাদের জন্য। ”
তাকে চিরদুঃখিনী করে কারা শ্রেষ্ঠ সুখ অনুভব করছে বুঝতে একটুও সময় লাগলো না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধু একঝাঁক অভিশাপ ছেড়ে বলল,
-‘ আমি নির্দোষ ছিলাম, আমার দুঃখের অন্ত ছিল না। তারপরও আমাকে চিরদুঃখিনী করা হলো! আর তোমরা সুখী শ্রেষ্ঠ সুখী? তিনি বেঁচে থাকলে আমি আবার মা হতাম, যে সুখ পেয়েও পেলাম না তা আবার ফিরে পেতাম৷ সহ্য হলো না তোমাদের, সহ্য হলোনা। কলঙ্কিত বাইজির কলঙ্কিত মেয়েটা আমার সব কিছু কেড়ে নিলো। ঐ সর্বনাশী আমার সর্বনাশ করে দিলো। জামাইকে তাবিজ করে কালনাগিনীটা, ভাই দিয়ে ভাই হত্যা করল! তুই মহাপাপী, তোর মহা সর্বনাশ হবে, দেখে নিস! ‘
[১০৫]
মনোহারীর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়। তার চোখদুটিতে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যায় সে এক সুখী মানুষ। পরনে লুঙ্গি আর চেক শার্ট। কাঁধে গামছা ঝুলছে। তার এক কোণায় গিঁট দিয়ে টাকা বেঁধেছে। আরেক কোণা দিয়ে থেকে থেকে কপালের ঘাম মুছছে। তাকে দেখলে সাধারণ ঘরের সাধারণ এক কৃষক ছেলে ব্যাতিত আর কিছু লাগছে না। তবে ব্যাতিক্রম হচ্ছে,
সে এক সুখী কৃষক। ভ্যাপসা গরমে এই সুখী মানুষ’টার শরীর ক্ষণে ক্ষণে উত্তপ্ত হয়ে ওঠছে। দেহ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে স্বেদজল। আষাঢ় মাস পড়ে গেছে। আকাশে গুমোট ভাব। যে কোন সময় অঝোর ধারায় বর্ষণ হবে। দাদার শরীর ভালো না। তাই আজ একাই হাঁটে এসেছিল সে। মঙ্গলবারের হাঁট। সবজি, আম, কাঁঠাল বিক্রি করে বেশ পয়সা এসেছে। এর থেকে অর্ধেক দাদাকে দিয়ে বাকি অর্ধেক সে নেবে। বেশি সময় নেই। তাদের সন্তান পৃথিবীতে আসার সময় অতি নিকটে। কতদিন কাজ করতে পারবে না, হাঁটে আসতে পারবে না বলা যায় না। তাই অগ্রিম বেশ কিছু টাকা হাতে রাখলো। ফেরার পথে নজরে পড়ল মনোহারীর দোকানের কসমেটিকস গুলোর দিকে। শাহিনুরের হাত খালি, কান খালি, গলা খালি স্মরণ হতেই থেমে গেল। বেশি টাকা খরচ করা যাবে না তবুও দোকানের ভিতর ঢুকে এক ডজন লাল রেশমি চুড়ি কিনল। সোনালি রঙের একজোড়া ছোট্ট কানের দুল কিনল। তারপর হুট করে নজরে পড়ল আরো এক ডজন লাল চুড়ির দিকে। মনোযোগ সহকারে চেয়ে দেখল এই চুড়ি গুলো ছোট্ট বাচ্চাদের জন্য তৈরি। ওষ্ঠাধরে মৃদু হাসি লেপ্টে গেল তার। দুচোখের তারায় ভেসে ওঠল, ছোট্ট ছোট্ট আদুরে দু’টো হাতে লাল চুড়ি। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যেই সে চুড়িগুলোও কিনে ফেলল। কেনার পর হুট করেই বুকের ভিতর ধ্বক করে ওঠল।দোকান থেকে ফেরার পথে আর ভ্যান নিলো না সে। আজ বারতি খরচ হয়েছে তাই পায়ে হেঁটেই ঘরে ফিরবে। মনের সুখে হাঁটা ধরল। একটু পর পর ছোট্ট হাতের এক ডজন চুড়ি বের করে দেখতে লাগল। আনমনে হেসে ভাবলো,
-‘কে আসবে না জেনেই কিনে ফেললাম। অবচেতন মনে যখন মেয়ে বাচ্চার জিনিস কিনেছি আমি বোধহয় মেয়ের বাবাই হবো।’
সন্ধ্যার পরবর্তী সময়। মাগরিবের নামাজ পড়ে লোকজন বাড়ি ফিরেছে, কেউ মসজিদে বসে আছে এশার নামাজ পড়ে একেবারে বাড়ি যাবে বলে। কেউ মসজিদের কাছাকাছি দোকানে গিয়ে সময় অপচয় করছে। প্রণয় লোকালয় পেরিয়ে মেইন রাস্তা পেরিয়ে এবার কাঁচা রাস্তায় হাঁটা ধরেছে। মিনিট দুয়েক পরেই পাহাড়ি পথ তারপর জঙ্গল পেরোলেই তার গন্তব্যে পৌঁছাবে। জোৎস্নার রাত্রিটে অতিরিক্ত কোন আলোর প্রয়োজন নেই। নিজের ছায়া দেখতে দেখতেই অনায়াসে এগুচ্ছে সে। এমন সময় হঠাৎ একজোড়া পা’য়ের শব্দ পেতেই চমকে ওঠল। বুকের ভিতর অদ্ভুত এক ভয় জেঁকে বসল৷ পিছন ফিরে ঘুরে কেউ আছে কিনা দেখতেও সাহস পেলো না৷ হঠাৎ এত ভীতু কি করে হয়ে গেল সে? নিজের প্রতি বড়ো আশ্চর্য লাগলেও পিছু ঘুরল না। কয়েক পল অতিবাহিত হতেই নিজের ছায়ার সঙ্গে আরো একটি মানুষের ছায়া দেখতে পেলো। তার পেছনে আরো দু’টো মানুষ রয়েছে স্পষ্ট বুঝল। গলা শুকিয়ে নীরস হয়ে গেল, বুকের ভিতর অদ্ভুতকারে মোচড়ামুচড়ি শুরু হলো। পৃষ্ঠদেশে শীতল স্রোত বয়ে যেতে লাগল৷ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে জমতে তা চোয়াল বেয়ে ঝরতে শুরু করল। কী বিপদ! কান খাড়া রেখে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে পায়ের গতি ক্রমশ বাড়াতেই থাকল প্রণয়৷ তখনি শুনতে পেলো,
-‘ প্রণয় দাঁড়াও। ‘
প্রণয় দাঁড়ালো না বরং দৌড় দেওয়ার জন্য উদ্যত হলো। চোখ তার মাটিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠা ছায়াগুলোর দিকেই স্থির। তাই দেখতে পেলো পিছনের জন ধীরে ধীরে হাত বাড়াচ্ছে। সে হাত ঠিক তার কোথায় স্পর্শ করবে এটুকু বুঝতেই দ্রুত একটানে শার্টের প্রতিটি বোতাম খুলে ফেলল৷ পেছনের আগন্তুকও তার শার্টের কলার ধরে টান দিলো। সঙ্গে সঙ্গে আগন্তুক শার্ট সহ উল্টে মাটিতে পড়ে গেল। প্রণয়ও প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো সামনের দিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় ঝোপের আড়ালে মিলিয়েও গেল।