বাইজি কন্যা

বাইজি শারমিন শায়লা নিজ কন্যা’কে বাইজি গৃহ থেকে সরানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জমিদার অলিওর চৌধুরী’র সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, অতি শিঘ্রই সব ব্যবস্থা করবে। কিন্তু শর্ত একটাই, শাহিনুর’কে একাই ত্যাগ করতে হবে এই গৃহ। শারমিন কোনদিন এক মূহুর্তের জন্যও মেয়ের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করতে পারবেনা। বড়োজোর চিঠি আদান-প্রদান হতে পারে এর বেশী কিছু নয়। শাহিনুর তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেবল শারমিনের মেয়ে বলে একটু দয়া করছে অলিওর চৌধুরী। তাই বলে শারমিন’কে সে মুক্তি দেবেনা। মৃত্যুর আগ মূহুর্ত অবদি শারমিন’কে নিজের বন্দিনী হিসেবেই দেখতে চায় সে। কতোটুকু পেয়েছে সেই হিসাব সে করতে চায় না শুধু জানে শারমিন তার অধিন্যস্ত। অলিওরের বক্তব্য শুনে হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠেছিলো শারমিনের। কলিজা যেনো ছিঁড়ে যেতে শুরু করেছে তখন থেকেই। কি করে থাকবে সে? কি করে থাকবে তার মেয়েটা? একটা সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় এতো বড়ো ত্যাগ যে মা, মেয়ে’কে মেনে নিতেই হবে। কিন্তু শাহিনুর ভুল বুঝবে না তো তাকে? শাহিনুর সহ্য করতে পারবে তো মায়ের থেকে তার বিচ্ছেদ’টাকে। সহ্য করতে পারবে তার জীবনের সত্যি’টাকে? সকাল থেকেই বেশ মনমরা হয়ে ঘরে বসে আছে শারমিন। মান্নাত এসে দেখলো খাটে আধশোয়া হয়ে বসে এক ধ্যানে দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে শারমিন। গতকাল রাতে অলিওর চৌধুরী এসেছিলো। সবসময় অলিওরের সঙ্গে শারমিনের সাক্ষাৎ হওয়ার পর মূহুর্তে শারমিন’কে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নারী মনে হয়। তার চাহনি, তার কন্ঠস্বর, সবকিছুতেই যেনো অদৃশ্য এক শক্তির আভাস পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে মান্নাতের ভয় হয়। কে জানে শারমিনের এই শক্তির পিছনে গভীর দূর্বলতা’কে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে কিনা! কিন্তু আজ যেনো সবটাই ব্যতিক্রম। আজ শক্তিশালী কোন নারী নয় বরং ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া, প্রচণ্ড দুর্বল, অসহায় এক মা’কে দেখতে পাচ্ছে মান্নাত। ধীরপায়ে শারমিনের দিকে এগিয়ে গেলো সে। কাছে গিয়ে বসে কাঁধে ভরসার হাত রাখলো৷ বললো,
-‘ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে ওঠে দাঁড়াতে হয় সখী। আমরা শুধু পড়তেই জানি ওঠতে জানি না তাইনা। ‘
মান্নাতের দিকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকালো শারমিন। মান্নাত শারমিনের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে ভরসার সুরে বললো,
-‘ আজ আমি আর কোন প্রশ্ন করবোন না। শুধু বলবো তুমি ভেঙে পড়োনা, তুমি ভেঙে পড়লে আমাদের কি হবে বলোতো? সবচেয়ে বড়ো কথা নুরের কি হবে? ‘
অশ্রুসিক্ত নয়নে মান্নাতের মাথায় হাত রাখলো শারমিন। বললো,
-‘ কিন্তু আজ তুই সব উত্তর পাবি মান্নাত। ‘
মান্নাতের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলো শারমিন। মান্নাত অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শারমিনের দিকে। আর শারমিন নিজের মানসিক শক্তি সঞ্চয় করার জন্য দৃষ্টিজোড়া বদ্ধ রেখে বারকয়েক ঘনঘন নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। বাইজি গৃহের এই একটা মেয়ে ‘মান্নাত’ যে কিনা সব সময় তাকে বোঝার চেষ্টা করে। হাজারোবার প্রশ্ন করে উৎসুক হয়ে জানতে চায় তাকে, বুঝতে চায়। অথচ কোন প্রশ্নের উত্তর পায় না,কোন কিছুই জানতে পারে না,বুঝতে পারে না। তবুও বিনা স্বার্থে সারাক্ষণ পাশে থাকে। নিজের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণাগুলো’কে বিনা দ্বিধায় ব্যক্ত করে। কি অদ্ভুত সম্পর্ক তার মেয়েটার সঙ্গে। দুঃখের গল্প দিয়েই শুরু হয়েছিল তাদের সম্পর্ক। মেয়েটি বলেছিলো জমিদার অলিওর চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্রের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। তারপর থেকেই মেয়েটির দুঃখের সঙ্গী সে। নিজের দুর্বলতাগুলো’কে কখনো কারো কাছে প্রকাশ করেনি শারমিন। কিন্তু মান্নাত, বয়সে মেয়েটা অনেক ছোট হলেও তার মতোই বিশাল দুঃখ লালন করছে বুকে। দু’টো দুঃখী বুক সখী’তে রূপ নিয়েছে বহু আগেই। মান্নাতের জীবনের আগাগোড়া শারমিন জানলেও শারমিনের জীবনের কোন কিছুই জানেনা মান্নাত। কিন্তু আজ আর শারমিন সহ্য করতে পারছেনা। পুরোনো ক্ষতগুলোয় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তার বক্ষঃস্থলের হাহাকার গুলোকে বিন্দু স্বান্তনা দেওয়ার জন্য মান্নাত ছাড়া আর কাউকেই খুঁজে পেলো না। তাই বললো,
-‘ মান্নাত’রে পৃথিবী’টা যতোটা সুন্দর পৃথিবীর মানুষগুলো ঠিক ততোটাই কুৎসিত। ‘
কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠলো শারমিনের। বক্ষঃস্থল মুচড়ে গেলো মান্নাতের। শারমিনের দু’টো হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
-‘ বলো সখী বলো তুমি, থেমো না আজ তুমি, থেমো না। তোমার সত্যিটা আমাকে জানাও। ‘
অতীতঃ
-‘ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলাম আমি। আব্বা পাটের ব্যবসা করতেন। আব্বার স্বপ্ন ছিলো আমাদের দু’ভাই বোন’কে অনেক পড়াশোনা করাবে। ভাই চাকুরি করবে। আমি শিক্ষিত হলে মস্ত বড়ো এক ডাক্তার পাত্র জোগাড় করে আমার বিয়ে দেবে। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। দেখতে সুন্দরী ছিলাম বলে গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বারের বখাটে ছেলেরা বিয়ে করার জন্য ওঠে পড়ে লাগে৷ কিন্তু আব্বা কোনমতেই আমাকে বখাটে ছেলের কাছে বিয়ে দেবে না৷ সে বছর নির্বাচনের সময় চেয়ারম্যানের সকল আত্মীয় স্বজনরাই গ্রামে আসে। সে আত্মীয়দের মাঝে চেয়ারম্যানের বড়ো বোনের ছেলে অলিওর আর ছোট বোনের ছেলে শাহিনের নজরে পড়ে যাই আমি। দু’দিনের ভিতরে আব্বার কাছে প্রস্তাব আসে। চেয়ারম্যানের ছোট বোনের ছেলে ডাক্তার শাহিন আহমেদ আমাকে বিয়ে করতে চায়। ছেলে যেহেতু ডাক্তার সেহেতু বউ’কেও পড়াশোনা করাবে। ডাক্তার পাত্র কোনমতেই হাতছাড়া করতে চায়নি আব্বা তাই প্রস্তাবটি সাদরে গ্রহণ করে নেন। সেদিনই নাকফুল পড়িয়ে বিয়ের পাকা কথা হয়ে যায়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে পরেরদিন সকালবেলা। কারণ চেয়ারম্যানের বড়ো বোনের একমাত্র ছেলে অলিওরও নাকি আমাকে বিয়ে করতে চায়। এই নিয়ে তাদের ভাই,বোনদের মাঝে বেশ ঝামেলা হয়েছে। ঝামেলা হয়েছে অলিওর এবং শাহিন আহমেদের মাঝেও। সব ঝামেলা’কে একদিকে ঠেলে রেখে অলিওর তার মা’কে নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের বাড়িতে। জমিদার গিন্নি হওয়াতে বেশ দাপুটে ভণিতায়ই আমার আব্বা’কে প্রস্তাব দেন অলিওরের মা। কিন্তু আব্বা রাজি হননি। এর পিছনে বড়ো দু’টো কারণ হিসেবে আব্বা উল্লেখ করেছিলেন, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এবং আব্বা তার মেয়ে’কে সতীনের ঘরে দিতে ইচ্ছুক নয়। আব্বার এহেন জবাবে জমিদার গিন্নি বেশ অপমান বোধ করে। ধন,সম্পদ এবং ক্ষমতায় ছোট বোনের থেকে তার ঢের বেশী তবুও কেন আব্বা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলো? এই আক্রোশ মনে পুষেই সেদিন ছেলে’কে নিয়ে বেরিয়ে যায় সে। আমার আব্বা বেশ বিব্রত হয়ে পড়ে। নানারকম দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায়। আমাকে বিয়ে করার জন্য ভাই,বোনের সম্পর্ক খারাপ হলো। বোনে, বোনে,ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতা তৈরি হলো। এমন পরিস্থিতে বিয়ে দিলে আমি সুখী হবো তো? ভবিষ্যৎে সকলের আক্রোশের স্বীকার হবোনা তো? সকল দ্বিধা কাটিয়ে নিজের কথা রক্ষার্থে আব্বা শাহিন আহমেদের হাতে তুলে দেন আমাকে। বিয়ে হয়ে যায় আমার এবং শাহিনের। আমি হয়ে যাই কারো ঘরনি, কারো অর্ধাঙ্গিনী। বিয়ের অনুষ্ঠানে অলিওরের পরিবারের কাউকে দেখা যায়নি। কিন্তু বউ ভাতের অনুষ্ঠানে অলিওর আসে আমার শ্বশুর বাড়িতে। শাহিনের সামনে আমাকে উঁচু গলায় বলে,
-‘ আমি আমার পাঁচ পুত্রের মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছি আমি তোমাকে আমার করবোই। আমি আমার পাঁচ পুত্রের কসম করে বলছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার পুত্রগণের মা’য়ের থেকেও অধিক ভালোবাসি তোমাকে। ‘
ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম সেদিন আমি৷ সারারাত যে মানুষটার ভালোবাসায় সিক্ত ছিলাম, সারারাত যার বক্ষঃস্থলে মাথা রেখে অজস্র স্বপ্ন বুনেছি, সে মানুষটার সম্মুখে একজন পরপুরুষ এসে ভালোবাসার কথা বলছে আমাকে! আমার ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখে অলিওর পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছিলো। ঠিক সে মূহুর্তেই শাহিন চোখ, মুখ শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে। আমার কম্পিত হাতে শাহিনের ভরসার হাত মিলিত হতেই অলিওর বিদ্রুপের সুরে বলে,
-‘ আজ এখানে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করছি ঐ মিলিত হাত দু’টো আমি আলাদা করবোই। ‘
সেদিন থেকেই আমার জীবন’টা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম আমি৷ শাহিন’কে ছাড়া এক মূহুর্তও থাকতে পারতাম না৷ আমার অবস্থা দেখে শাহিন আমাকে শহরে নিজের কাছে নিয়ে যায়৷ সেখানে আমরা দু’বছর সংসার করি। তিনবছরের মাথায় আমার গর্ভে আসে নুর। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন আমি। হাসপাতালে জরুরি প্রয়োজন বলে মাঝরাতেই বেরিয়ে যায় শাহিন। সকালবেলা দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় আমার। শাহিন এসেছে ভেবে দ্রুত ওঠে দরজা খুলে দেই কিন্তু দেখতে পাই অলিওর চৌধুরী’কে। আমি ভীতিগ্রস্ত হয়ে দরজা আঁটকে দিতে চেয়েও পারিনা। তার পূর্বেই অলিওর বলে,
-‘ শারমিন তাড়াতাড়ি চলো আমাদের থানায় যেতে হবে। ‘
আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। অলিওর আবার বলে,
-‘ শাহিন ওর হাসপাতালের এক রোগির সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় ধরা পড়েছে। হাসপাতাল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে ওকে। ও এখন থানায় পুলিশের হেফাজতে আছে। ‘
অকস্মাৎ কেঁপে ওঠি আমি৷ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাই অলিওরের দিকে৷ কম্পিত কন্ঠে বলি,
-‘ আপনি মিথ্যা বলছেন, উনার খবর আপনি পাবেন কোথায়? ‘
-‘ শারমিন তুমি বিশ্বাস করো। থানার ওসি নিজে আমার বাড়িতে গিয়ে সবটা জানিয়েছে। শাহিন আমার বাবা,মায়ের পরিচয় দেওয়াতে ওসি নিজে এসে সবটা জানিয়েছে। ‘
অলিওরের কথা শেষ হতেই ধপ করে বসে পড়ি আমি। পুরো শরীর অদ্ভুত ভাবে কাঁপতে থাকে আমার। অলিওর তখন আমার কাঁধে হাত রাখে। ভরসা দিয়ে বলে,
-‘ কিছু হবে না আমি আছিতো। ‘
সেদিন সত্যি অলিওর শাহিন’কে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে৷ ফিরিয়ে নিয়ে আসে শাহিন’কে। কিন্তু পূর্বের শাহিন, আমার স্বামী শাহিন আহমেদ আর সেদিনের শাহিন আহমেদের মাঝে ছিলো বিস্তর ফারাক। সে যেমন তার পেশা হারিয়েছে তেমনি হারিয়েছে নিজের সম্মান। আশ্চর্য হলেও সত্যি আমি নিজে থানার ওসি’কে কথা দিয়েছিলাম শাহিনের সঙ্গে তার সেই রোগির অর্থাৎ ‘লতার’ বিয়ে দেবো। শাহিন তাকে স্ত্রী’র মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলবে। বিয়ে দেওয়ার শর্ত দিয়েই শাহিন’কে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়৷ আমিও আমার কথা রাখি। নিজের স্বামী’কে তুলে দেই অন্য একটি নারী’র হাতে। একটা মেয়ের জীবনে কতোটুকু যন্ত্রণাদায়ক এটা শুধু একটা মেয়েই জানে৷ পাঁচ মাসের পেট নিয়ে সারাদিন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের স্বামী’কে বাসরে ঢুকিয়ে দিয়ে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি আমি। ফিরে যাই আব্বা, আম্মার কাছে। গর্ভবতী অবস্থায় আমার সাথে ঘটে যাওয়া করুণ কাহিনী শুনে সেই রাতেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায় আব্বা। পরেরদিন মা মুখ ফিরিয়ে নেয় আমার থেকে। ভাইও আব্বার মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী করে। একুল, ওকুল দুকুলই হারাই আমি। গ্রামের মানুষ ছিঃ ছিঃ করে৷ কেউ একটু ঠাঁই দেয়নি সেদিন আমাকে। স্কুলের বারান্দায় বসে আব্বার খাটিয়া নিয়ে যেতে দেখি। আব্বা’কে কবর দেওয়া হয়। আমার বুকের ভিতর ছটফট করতে থাকে,পেটে ব্যথায় অসহ্য লাগতে শুরু করে। চিৎকার করে বলতে থাকি, আব্বা তুমি আমাকে ছেড়ে কেন গেলা। আমার যে কেউ রইলো না। আব্বা গো কোন অভিশপ্ত জীবনে রেখে গেলা আমাকে। ও আব্বা কোন দোষে তোমার খুনি করলা আমারে,কোন দোষে মা,ভাইয়ের চোখের বিষ বানাইলা আমারে। কাঁদতে কাঁদতে আধমরা হয়ে পড়ে থাকি চেয়ে থাকি আব্বার কবরের দিকে। স্বামী’র বিশ্বাসঘাতকতায়,আব্বার মৃত্যু’তে আমি ভুলেই যাই আমার নুরের কথা। আমার ভিতর ছোট্ট একটি অংশ বেড়ে ওঠার কথা।অকস্মাৎ ক্ষিদের জ্বালায় পেটে ব্যথায় ছটফট করতে করতে মনে পড়ে যায় কোন এক বিশ্বাসঘাতকের কথা। মনে পড়ে যায় কারো ছলনায় আমার নিষ্পাপ ভালোবাসা মেশানোর কথা। পাগলের মতো স্কুলের টিউবওয়েলের কাছে ছুটে গিয়ে প্রাণভরে পানি পান করি। পেটে ব্যথায় গা গুলিয়ে বমি পায়,বমি করতে করতো কখন যে জ্ঞান হারাই নিজেও টের পাইনা৷ যখন জ্ঞান ফেরে তখন পাশে পাই অলিওর চৌধুরী’কে। আশেপাশে চেয়ে দেখি আমি হাসপাতালে ভর্তি। তিনদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর চতুর্থ দিন অলিওর আমাকে বুঝিয়ে, আমার বাচ্চা’কে বাঁচানোর লোভ দেখিয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায়। নিরুপায় আমি সকল লজ্জা ত্যাগ করে, আত্মসম্মান সব বিসর্জন দিয়ে অলিওরের সঙ্গে যাই। এ’কদিনে এটাও জানতে পারি শাহিন আমাকে বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজ পাঠিয়েছে। কিন্তু ভয়ে সেই কাগজ দেখার বা স্পর্শ করার সাহস পাইনি তখন৷ সবদিক দিয়ে যখন শূন্য হয়ে গেলাম তখন বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে অলিওর’কে বললাম, আমাকে যেনো তার বাড়িতে কাজের লোক করে রাখে। কিন্তু অলিওর তাতে নারাজ সে আমাকে বিয়ে করবে৷ সেই সিদ্ধান্ত জানিয়েই আমাকে হাজির করে তার মায়ের সামনে। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে অলিওরের মা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে বললেন,
-‘ যে মেয়ের বাবা আমাকে,এই জমিদার গিন্নি’কে অপমান করে, জমিদার গিন্নির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। সেই মেয়ে’কে আমি পেটসহ পুত্রবধূ করবো! অসম্ভব। ‘
অলিওর মায়ের সঙ্গে ঘোর বিরোধিতা করলেন,
-‘ না আম্মা না আপনি এমন কথা বলবেন না। আমি শারমিন’কে ভালোবাসি হোক সে গর্ভবতী, করুক তার বাবা আমাকে প্রত্যাখ্যান তবুও আমি তাকে ভালোবাসি। আর সেই ভালোবাসার টানেই আমি তাকে আজ এ মূহুর্তে বিয়ে করবো। ‘
মা,ছেলের মাঝে আমি বলি,
-‘ আমাকে মাফ করবেন। আমি এসবের কিছুই চাইনা শুধু একটু ঠাঁই চাই। আমাকে আপনাদের বাড়ির কাজের লোক করে রেখে দিন৷ ‘
জমিদার গিন্নি আমার চুল মুড়িয়ে ধরে তার পায়ের নিচে ফেলে বলেন,
-‘ ওরে সর্বনাশী কাজের লোক হয়েও আমার ঘরে থাকতে রাজি। অলিওর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এই সর্বনাশী’কে বের কর।’
অলিওর মা’য়ের থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিজ বুকে চেপে ধরে। ঘৃণায় মূর্ছিত হয়ে যাই আমি। অলিওর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
-‘ আম্মা এই সর্বানাশী’কে না পেলে আপনার ছেলের সর্বনাশ ঘটে যাবে। কারণ এই সর্বনাশী’কে আমি খুব ভালোবাসি। ‘
জমিদার গিন্নি ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। চিৎকার করে বলে,
-‘ তুই যদি এই কালনাগিনী’কে বিয়ে করিস আমার মরা মুখ দেখবি। তোকে তোর মৃত বাবার কসম আর কোন পত্নী গ্রহণ করবি না তুই এটা তোর মায়ের আদেশ তোর বাবার কসম। ‘
মায়ের এমন আদেশে অলিওর চৌধুরী নিভে যায়। মর্মাহত হয়ে মা’কে প্রশ্ন করে,
-‘ আপনি কেমন মা যে ছেলের ব্যথা বুঝেন না? ‘
জমিদার গিন্নি যেনো বুকে আঘাত পায়৷ ছেলের অসহায় চোখে চোখ রেখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে। তারপর কুটিল হেসে বলে,
-‘ আমি আমার আব্বাসোনা’কে এতো কষ্ট দিতে পারি না৷ তাই এই মেয়ে’কে তোর অধিনে রাখার অনুমতি দিলাম। এই মেয়ে’কে আজীবনের জন্য বাইজি গৃহে বন্দি করে রাখার অনুমতি দিলাম। আমাকে করা অপমানের চরম জবাব দিলাম। তোর কামনা,বাসনাও পূরণ করলাম। এবার খুশিতো? ‘
-‘ আম্মা!’
অলিওর চৌধুরী কম্পিত গলায় মা’কে ডাকতেই জমিদার গিন্নি ধমকের সুরে বলেন,
-‘ চুপপ একদম চুপপ। তুই জমিদারের পুত্র। তোকে ভালোবাসা মানায় না৷ তোকে যা মানায় ঠিক তারই অনুমতি দিলাম। ভালোবাসার জন্য তোর দুটো স্ত্রী রয়েছে এই সর্বনাশী না হয় তোর ভোগের সামগ্রী হয়েই থাকবে। আর হ্যাঁ এই চারদেয়ালে হওয়া কথোপকথন একটা কাক পক্ষীও যেনো টের না পায়। ‘
সেদিন মায়ের আদেশে অলিওর চৌধুরী আমাকে বাইজি গৃহে বন্দি করতে বাধ্য হয়। ভাগ্যের নির্মমতায় আমি হয়ে যাই বাইজি গৃহের প্রধান বাইজি। জমিদার গিন্নির চরম প্রতিশোধের স্বীকার হই আমি। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি জমিদার অলিওর চৌধুরী আজ অবদি আমার শরীর স্পর্শ করেনি। আমাকে দিয়ে মনের খোরাক মেটানোর চেষ্টা করলেও কখনো দেহের খোরাক মেটানোর চেষ্টা করেনি৷ আজ অবদি অলিওর চৌধুরী একটা জায়গাতেই ভীষণ দুর্বল তা হলো বাইজি শারমিন শায়লা। ভালোবাসা এবং মায়ের আদেশ এই দুটো জিনিস আজো পুড়ায় তাকে,খুব পুড়ায়।
বর্তমানঃ
ক্রন্দনরত কন্ঠে মান্নাত বললো,
-‘ সখী নুরের বাবা কেন করলো এটা? ‘
-‘ সেই উত্তর আজো পাইনি। মানুষটা মরে গেলো, বলে গেলো না আমাকে জীবিত মেরে ফেলার কারণ। ‘
শারমিন’কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো মান্নাত। মৃদু হেসে শারমিন মান্নাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘ ইশ তুই’ই এতোটা আহত হলি? তাহলে এসব নুর কি করে সহ্য করবে বলতো? ওকে তো জানতে হবে সবটা। মায়ের ক্ষত সম্পর্কে সবটা না জানলে মেয়েটা আমার শক্ত হবে কি করে?’

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.