রোমানা মেয়েটাকে চিনতে ভুল করেনি প্রণয়৷ ভুল করেনি তার ভালোবাসাময় ঐ চোখের ভাষাটুকু বুঝতে৷ যে ভাষায় ভালোবাসা না হোক সম্মান দিয়েছে সে। নিজের ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী হিসেবে যার স্থান দিয়েছে সে এই রোমানাই। হয়তো ভালোবাসা নামক অনুভূতিটুকু রোমানা জীবনে আসার অনেক পর অন্যকারো প্রতি জন্মেছে। তাই বলে সে তার দায়িত্ব-কর্তব্য,প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়নি৷ এতোগুলো বছর ধরে যে মেয়েটা’কে চোখের সামনে বড়ো হতে দেখেছে। এতোগুলা বছর ধরে যে মেয়েটা মন,প্রাণ উজার করে তাকে ভালোবেসে আসছে, তার ভালোবাসা কামনা করছে সে মেয়েটা কখনোই এতো বড়ো স্পর্ধা দেখাতে পারে না৷ এছাড়া রোমানা এতো বছরে প্রণয়ের পছন্দ, অপছন্দ সম্পর্কে বেশ অবগত হয়েছে। সেই সাথে প্রণয়’কে সে খুব মানেও। তাই নেশা করে মাতাল হয়ে প্রণয়ের সামনে যাওয়া তো দূরের কথা, নেশা করার কথা ভাবতেও রোমানার রুহ কেঁপে ওঠবে৷ এটুকু স্মরণে আসতেই রাগ কিছুটা কমে গেলো প্রণয়ের৷ মাত্র কয়েকদিন আগে যে মেয়েটার সাথে বাগ্দান সেরেছে সেই মেয়েটার প্রতি এতো সহজে অবিশ্বাস আনতে পারলো না। তাই পুরো ঘটনা কি ঘটেছে সেটা বোঝার জন্য ত্বরান্বিত হয়ে ছাদ থেকে নিচে গেলো। ড্রয়িংরুমে কাউকে দেখতে না পেয়ে অবাকান্বিত ভঙ্গিতে ধীরেধীরে নিজের রুম চেক করলো। চারপাশ কেমন শুনশান নীরবতা। কিছু সেকেণ্ডের মধ্যে সেই নীরবতা ভেঙে কেমন যেনো কন্ঠস্বর ভেসে এলো। কেমন অস্পষ্ট ধ্বনি। সে ধ্বনি নিশানা করে তার বিব্রত চরণদ্বয় পাশের রুমের দ্বারের সম্মুখে গিয়েই থেমে গেলো। আচমকা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। এক নিমিষেই যেনো তার সমস্ত পৃথিবী ঘুরপাক খেতে শুরু করলো। সমস্ত শরীর ঘাম ছেড়ে শিরায় শিরায় অগ্নি জ্বলে ওঠলো৷ এই শরীর অবশ অনুভূত হলো, এই শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ওঠলো। ক্রোধে শরীর দিয়ে ঘাম ঝড়তে শুরু করলো। ছোট ছোট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়া অকস্মাৎ ভয়াবহ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো৷ ক্রমাগত চোয়ালজোড়া দৃঢ় থেকেও দৃঢ়তর হলো। ক্রোধে,ঘৃণায় কোনক্রমে নিজের বিশাল দেহটি সরিয়ে নিলো। কিন্তু বারংবার বজ্রপাতের ন্যায় দু’চোখে ভাসতে থাকলো ছোট ভাইয়ের সঙ্গে নিজের বাগদত্তার মিলিত হওয়ার দৃশ্যটুকু৷ ড্রয়িংরুমের সোফায় নিস্পন্দ হয়ে কতোসময় পাড় করলো জানা নেই। কিন্তু যখন ওঠে দাঁড়ালো তখন চেনা সেই প্রণয় চৌধুরী ছিলোনা। সে এক অন্য প্রণয় চৌধুরী। যার প্রখর দৃষ্টির দিকে একবার তাকালে কারো সচল হৃদপিণ্ডও মূহুর্তে অচল হয়ে যাবে! বিশাল দেহটিকে সটান করে দাঁড় করালো। তারপর দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে গেলো নিজের বেডরুমে। কয়েক পল থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে গেলো বহুবছর পূর্বে। তার পিতামহ আজহার চৌধুরী’র দেওয়া তাকে প্রথম এবং শেষ উপহারটুকুর মুখ্য ব্যবহারের সময় এসেছে আজ। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো প্রণয়ের। মারাত্মক ক্রোধে আবিষ্ট হয়ে পরিহিত কালো ব্লেজার একটানে খুলে মেঝেতে আছড়ে ফেললো। বড়ো বড়ো দম ফেলে কয়েক কদম পায়চারি করলো রুমজুড়ে। একেক জনের বৈশিষ্ট্য যেমন একেক রকম তেমনি রাগান্বিত অবস্থায় একেকজন একেক ভাবেও তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ঠিক তেমনি প্রণয়ও করলো। পুরো রুমজুড়ে এলোমেলো ঘুরাঘুরি করে পরিহিত শার্টটাও একসময় টেনেটুনে খুলে মেঝেতে ফেলে দিলো৷ বলিষ্ঠ দেহের শেষ সম্বল রইলো একটি সেন্ডো গেঞ্জি এবং প্যান্ট। শরীরে অতিরিক্ত ঘাম নিঃসৃত হওয়ার ফলে সুঠাম বুক,পিঠে গেঞ্জি লেপ্টে রয়েছে। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামও এবার টপাটপ ঝড়তে শুরু করেছে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমাগত ভারী হচ্ছে। রাতের প্রায় পুরোটাই এমন বিক্ষিপ্তভাবে পাড় করলো প্রণয়৷ কিন্তু চারদিক থেকে যখন ফজরের আজান ধ্বনি ভেসে এলো ধাতস্থ হয়ে হাঁটু গেড়ে বিছানার সম্মুখে বসে পড়লো৷ খাট থেকে কিঞ্চিৎ মাথা নিচু করে বলিষ্ঠ হাতটা বাড়িয়ে দিলো খাটের তলার গভীরে। বেশ পুরানো একটি সুটকেস টেনে বের করে কপাট খুলে পুরোনো কাপড়চোপড় সরিয়ে ভিতর থেকে নিমিষেই একটি তলোয়ার বের করে আনলো। তারপর ত্বরিতবেগে সুটকেস লাগিয়ে আবার যথাস্থানে রেখে ওঠে দাঁড়ালো। ডানহাতের শক্ত মুঠোয় তলোয়ারটি ধরে এপাশ,ওপাশ কাত করে ভালোভাবে দৃষ্টি বুলালো। মূহর্তেই আবার ভয়াবহ হিংস্ররূপ ধারণ করে বাম দিক ডান দিক কৌশলে ঘাড় বাঁকিয়ে, চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে, ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
-‘ আমার সম্মানে আঘাতকারী একটা প্রাণী’কেও বাঁচিয়ে রাখবো না। স্বয়ং নিজের ভাই’কেও না! ‘
নিজের হিংস্ররূপটা নিয়ে আবার ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসলো প্রণয়৷ অপেক্ষায় থাকলো তার চোখে দেখা সবচেয়ে নিকৃষ্ট দু’টি প্রাণের জন্য।
চারদিকের ঘন অন্ধকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো। ধরণীর বুকে সূর্য তার সকল উজ্জ্বলতা নিয়ে ঝলমলিয়ে পদার্পণ করলো। দু’টি দেহ একে অপরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বিভোর ঘুমে অচেতন হয়ে ছিলো। রাতের আধাঁরে করা পাপগুলো দিনের আলোয় সূর্যের তীর্যক আলোকরশ্মিতে উন্মোচিত হলো। বদ্ধ চোখে সূর্যের আলো পড়তেই চোখ কুঁচকে কিঞ্চিৎ নড়ার চেষ্টা করলো রোমানা। চৈতন্য ফিরতেই অনুভব করলো তার ওপর ভারী কোন বস্তু রয়েছে। শুধু তাই নয় কারো গভীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, কারো শরীরের নিবিড় উষ্ণতার পুরোটুকুই মিশে যাচ্ছে তার শরীরে। সহসা ভীতিগ্রস্ত হয়ে চোখ খুলে তাকালো রোমানা। নিজের ওপর ঘুমন্ত, পরিশ্রান্ত অঙ্গন’কে দেখে আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেলো অঙ্গনের। জোর পূর্বক চোখ টেনে তুলতেই ভেসে ওঠলো রোমানার ভীতিগ্রস্ত ক্রন্দনরত মুখশ্রী। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুত সরে গেলো অঙ্গন৷ রোমানার নগ্ন বুকে দৃষ্টি পড়তেই মস্তিষ্কে মারাত্মক চাপ পড়লো। পুরো শরীর ভয়ে শিউরে ওঠলো,দৃষ্টিজোড়া আবদ্ধ করে ফেললো নিমিষেই। লজ্জায়,ঘৃণায় মূর্ছা ধরে গায়ে চাদর টেনে মুখ লুকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো রোমানা।
অঙ্গনের মাথাটা ঝিম ধরে গেলো, কন্ঠরোধ হয়ে নিঃশ্বাসও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। অনেকটা সময় হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর অঙ্গন চাপা একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মনে করার চেষ্টা করলো গতরাতের কথা। ঝাপসা কিছু কিছু মনে পড়তেই নিরুপায় হয়ে মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়লো। নির্বাক হয়ে আশপাশে কাতর দৃষ্টি বলালো। চিৎকার করে ডাকার চেষ্টা করলো ছোট ভাই রঙ্গন’কে, বড়ো ভাই প্রণয়’কে। কিন্তু পারলো না। আকস্মিক বিপর্যয়ের গন্ধ পেতেই কেমন যেনো মিইয়ে গেলো। নিশ্চল দৃষ্টি মেলে একবার বিছানায় তাকালো পরোক্ষণেই মাথা নিচু করে বিরবির করে বললো,
-‘ ছিঃ। ‘
আবার ভয়ে সংবিৎ ফিরে পাওয়ার ভণিতায় বললো,
-‘ আমি এতো নিকৃষ্ট, এতো জঘন্য, এতো বড়ো অন্যায়, এতো বড়ো পাপ কি করে করলাম আমি! ‘
কোন মুখে রোমানার সামনে দাঁড়াবে, কোন মুখে প্রণয়ের সামনে দাঁড়াবে সে। নিজের মন’কেই বা আজকের পর থেকে কি করে স্বান্তনা দেবে? রোমানা’কে সে প্রচণ্ড ভালোবেসেছিলো কিন্তু কখনো ভোগ করার কথা ভাবতেও পারেনি। জোর করে পাওয়ার প্রত্যাশাও করেনি তবে এ’কি হয়ে গেলো!
কীভাবে কি হলো? রোমানা কি করে তার কাছে এলো? এতো বড়ো অঘটন কি করে ঘটলো? রঙ্গন কোথায়, কোথায় বড়ো ভাই প্রণয়? সবশেষে একটু আশার আলো নিয়ে বের হলো অঙ্গন। সঙ্গে সঙ্গে প্রণয়কে বিক্ষিপ্তভাবে নজরে পড়লো তার। দু-চোখ ভরে অশ্রুপাত শুরু হলো অঙ্গনের। নিজের প্রতি রাগে,ঘৃণায় ত্বরিতগতিতে প্রণয়ের সম্মুখে বসে প্রণয়ের ডানহাতটা চেপে ধরে নিজ গণ্ডস্থলে তলোয়ার ঠেকালো অঙ্গন। বললো,
-‘ ভাই এই মূহুর্তে আমার প্রাণ নিয়ে তুমি আমাকে মুক্তি দাও। ‘
হিংস্রতার শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েও নিভে গেলো প্রণয়। এক ধাক্কায় অঙ্গনকে সরিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ ডোন্ট টাচ মি অঙ্গন। ‘
-‘ আমি এতোবড়ো অন্যায় কি করে করলাম ভাই? রোমানা কি করে আমার কাছে এলো কি থেকে কি হয়ে গেলো। ‘
দু’হাতে নিজের চুল খামচে ধরে চিৎকার করে কথাগুলো বললো অঙ্গন। এ পর্যায়ে প্রণয় বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ তুই কাল নেশা করেছিলি? ‘
অঙ্গন মাথা নিচু করেই হ্যাঁ সূচকে মাথা নাড়ালো। আকস্মাৎ চোখ বুজে অধর কামড়ে ধরলো প্রণয়। এবার যেনো পুরোটাই সুস্পষ্ট তার কাছে। যা ঘটেছে ইচ্ছে কৃত নয় কিন্তু প্রশ্ন তো রয়েই গেছে… প্রণয় বললো,
-‘ রোমানা’কে ড্রিংক করিয়েছে কে? ‘
অঙ্গন চমকে ওঠলে এক পলক প্রণয়’কে দেখলো। আবারো মাথা নিচু করে বললো,
-‘ আমি জানি না ভাই। ‘
এবার প্রণয় বললো,
-‘ আমার সামনে থেকে যা। ‘
প্রণয়ের আদেশ পেয়ে অত্যন্ত লজ্জিত মুখে চলে গেলো অঙ্গন। কোথায় যাবে, আজকের পর কোথায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সে? সবচেয়ে বড়ো কথা রোমানা। এ জীবনে হয়তো রোমানার সামনে এসে দাঁড়াতে পারবেনা। এ জীবনে হয়তো রোমানা আর তার সুখ,দুঃখের গল্প বলতে অঙ্গন’কে খুঁজবে না। হাসির ছলে,কথার ছলে বলবেনা ‘ তোমার মতো বন্ধুটি পাশে থাকলে আমার সব স্বপ্ন পূরণ না হয়ে পারে? ‘
অঙ্গন বেরিয়ে যাওয়ার পর আরেকদফা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো প্রণয়৷ অপেক্ষা করতে লাগলো রোমানার জন্য৷ যা ঘটেছে খুব খারাপ ঘটেছে। এটাই যদি ঘটার ছিলো, কপালে যদি এটাই লিখা ছিলো তাহলে সেদিন তাদের বাগ্দান কেন হলো? এতো বছর ধরে যে মেয়েটা তার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মতো বসে ছিলো চোখের পলকেই সে মেয়ে তার ভাইকে সমস্তটা বিলিয়ে কি করে দিলো। ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছেয় হোক যা ঘটেছে তা তো বদলানো সম্ভব নয়৷ তীব্র অস্বস্তি নিয়ে বসে বসে এসবই ভাবছে প্রণয়। ঘরের ভিতর থেকে শুনতে পাচ্ছে রোমানার গগনবিদারী চিৎকার। কি করবে, কি বলবে, কি করা উচিৎ বোধগম্য হলো না প্রণয়ের৷ তবুও একটা সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হবে। মেঝেতে পড়ে থাকা তলোয়ারের দিকে দৃষ্টি পড়তেই সেটা তুলে যথা স্থানে রেখে এলো। তারপর ড্রয়িংরুম থেকেই হাঁক ছাড়লো,
-‘ রোমানা আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। ‘
প্রণয়ের ডাক শোনার পর প্রায় ত্রিশ মিনিট পর বিক্ষিপ্ত চেহেরায় বেরিয়ে এলো রোমানা৷ পরনের শাড়িটাও ঠিকঠাক ভাবে পরতে পারেনি। এলোমেলো চুল,রক্তিম বর্ণ চোখ ঠোঁটের এক কোণায় রক্তজমাট চিহ্ন সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত রোমানা’কে দেখে আবারো দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করলো প্রণয়৷ বললো,
-‘ আমি জানি গতরাতে যা ঘটেছে পুরোটাই একটা এক্সিডেন্ট। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তুমি কেন ড্রিংক করলে। ‘
ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো রোমানা। ভয়ে,লজ্জায়,ঘৃণায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দিলো,
-‘ সফট ড্রিংক মনে করে খেয়েছিলাম আমি জানতাম না ওটা মদ ছিলো। ‘
নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে প্রণয় বললো,
-‘ আমি অতোটা দয়ালু নই যতোটা দয়ালু হলে এ মূহুর্তে তোমাকে কিছু স্বান্তনা বাণী শোনানো যায়। আমি অতোটা নির্মল প্রকৃতির মানুষ নই যতোটা নির্মল হলে তোমার চোখের ভারী বর্ষণ দেখে ব্যথিত হওয়া যায়। আমি অতোটাও শুদ্ধ পুরুষ নই যে এ মূহর্তে, এমন পরিস্থিতিতে বলবো – তুমি অন্য পুরুষ দ্বারা তোমার সতীত্ব হারিয়েছো এতে আমার জায় আসে না! রোমানা, যা কিছু ঘটেছে এতে তোমার হাত নেই আবার আছেও কিন্তু যা হয়েছে এর জন্য আমি ভুক্তভোগী হতে পারি না৷ যেহেতু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা নেই সেহেতু আমি তোমাকে একটি সাজেশন দিতে চাই – তুমি অঙ্গন’কে বিয়ে করে নাও। যা হয়েছে এরপর এর থেকে সঠিক আর কোন পথই নেই। আর যদি তুমি অঙ্গন’কে গ্রহন করতে না পারো তবে আমার স্ত্রী’র মর্যাদা পাবে কিন্তু আমাকে পাওয়ার সম্ভাবনা কাল অবদি থাকলেও আজ আর নেই! ‘
[২৫]
প্রণয়ের ড্রাইভার মেরাজুল হক রোমানা’কে পাঁচফোড়ন গৃহে পৌঁছে দিয়ে আবার কোয়ার্টারে ফিরে এসেছে৷ রোমানা বাড়ি ফিরে সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়ির একটি কাকপক্ষীও টের পায়নি রোমানা ফিরেছে। দুপুর পেরিয়ে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সকাল থেকে প্রেরণা উন্মুখ হয়ে বসে আছে প্রণয়,অঙ্গন, রঙ্গন আর রোমানার জন্য। যখন সূর্য অস্তমান হলো চারদিক থেকে ভেসে এলো আজান ধ্বনি তখনি চৈতন্য ফিরলো প্রেরণার। বড়ো বউ বলে এক হাঁক ছাড়লো। শবনম রান্না ঘর থেকে ছুটে শাশুড়ির রুমে প্রবেশ করলো৷ প্রেরণা তাকে আদেশ করলো প্রণয়’কে ফোন করতে আর খবর নিতে তারা কখন বাড়ি ফিরবে৷ যদি তারা ফিরতে না চায় অন্তত রোমানা’কে যেনো রেখে যায়। শাশুড়ির আদেশ পেয়ে শবনম প্রণয়’কে ফোন করে জানতে পারলো সবাই বাড়ি ফিরে গেছে। তবুও শবনমের কল পেয়ে প্রণয় কিছুটা বিচলিত হয়ে বললো,
-‘ আপনি রোমানার ঘরে গিয়ে একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন৷ বাকিদের আমি দেখছি। ‘
শবনম কথা শেষ করে ভাবলো জেবা’কে রোমানার কক্ষে পাঠিয়ে দেবে। আর সে গিয়ে শাশুড়ি’কে শান্ত করবে বলবে রোমানা ফিরেছে। শবনম জেবাকে রোমানার কক্ষে পাঠিয়ে শাশুড়ি’র কাছে গেলো। এদিকে জেবা তার লম্বা বিনুনির শেষপ্রান্ত একহাতে নাড়াতে নাড়াতে হেলিয়েদুলিয়ে পা বাড়ালো রোমানার কক্ষে। কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় দশমিনিটের মতো রোমানা’কে ডাকলো জেবা। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পেলো না৷ তাই বললো,
-‘ কি গো ননদিনী ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নে আমার দেবরের সোহাগ নিচ্ছো? যেমনটা আমি তোমার বড়ো ভাই’য়ের স্বপ্ন সোহাগ নেই। ‘
শেষটুকু কিঞ্চিৎ লাজুক ভঙ্গিতেই বললো জেবা। তখনি পাশ থেকে মুনতাহা বললো,
-‘ ছোটো ভাবি, আপনাকে বড়ো ভাবি কি জন্য পাঠিয়েছে আর আপনি কি করছেন? ‘
-‘ দেখোনা ননদিনী ডাকছি কিন্তু দরজা খুলছেই না। ‘
-‘ হয়তো ঘুমাচ্ছে তাই বলে এতো ডাকতে হবে? আপনার ডাকে আমি কক্ষে থাকতে পারলাম না। ‘
এটুকু বলে থমকে গেলো রোমানা। কপালে ভাঁজ পড়লো তার মনে মনে ভাবলো,
-‘ কি ব্যাপার ছোটো ভাবির ডাকে অতোদূরের কক্ষ থেকে আমি বেরিয়ে এলাম অথচ রোমানা আপা বের হলোনা৷ কি করে আপা ঘুমায় নাকি…’
এটুকু ভেবে মুনতাহা ধীর পায়ে কিছুটা এগিয়ে রোমানার কক্ষের জানালার সামনে দাঁড়ালো। জানালা লাগানো নাকি খোলা বোঝার জন্য মৃদু ধাক্কা দিতেই জানালা খুলে গেলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে মুনতাহা ঘাড় এগিয়ে কক্ষে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সঙ্গে সঙ্গে অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠলো তার৷ চোখজোড়া বড়ো বড়ো করে বুকে হাত চেপে, রোমানা আপা বলে এক চিৎকার দিলো। মূহুর্তেই মাথা ঘুরে জ্ঞানও হারালো মুনতাহা। জেবা দৌড়ে এসে জানালা দিয়ে কক্ষে তাকাতেই দেখলো, ফ্যানের সাথে শাড়ি ঝুলিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছে রোমানা। পরনে শুধুমাত্র ব্লাউজ,পেটিকোট। খোলা চুলে এক জিব বেরিয়ে দু’টো চোখ উল্টে আছে তার। এহেন দৃশ্য দেখে ভয়ে ‘ওমাগো’ বলে ধপ করে বসে বমি করে দিলো জেবা।