কেটে গেছে একটা বছর।বিহানের ইন্টার্নশীপ শেষ হয়ে গিয়েছে।আমার ও এইস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্ট বেরিয়েছে।রিয়া আর আমি দুজনেই জিপিএ ফাইভ পেয়েছি।মেডিকেল কোচিং চলছে দুজনের।বিভোর ভাই এর একটা ব্যাংকে জব হয়েছে।বিভোর ভাই ও এখন ঢাকায় থাকেন।বিহান আর বিভোর ভাই ঢাকায় এক ই ফ্ল্যাটে থাকে।আবির ভাইয়ার এখনো জব হয় নি,তবে চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছে।ভাইয়ার ইচ্ছা সে ইউরোপ কান্ট্রিতে যাবে।তবে আম্মুর আপত্তির জন্য যেতে পারছে না,আম্মু বলেছে আমার অনেক টাকা লাগবে না।একটা ছেলে আমার চোখের সামনে থাকুক।একটা মেয়ে বিয়ে দিয়েছি আর যা আছে আমার ছেলের ভালোই চলবে।মেহু আপু তোহা আপু অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে লেখাপড়া করছে।তিয়াস ভাইয়া ফাইনাল ইয়ারে পড়ে।এরই মাঝে রুশা আপুর একটা ছেলে ও হয়েছে।বিভা আপুও প্রেগন্যান্ট।বিভা আপুকে শ্বশুর বাড়িতে আনতে যেতে হবে।বিভা আপুর বিয়ের পর এখনো কেউ বিভা আপুর শ্বশুর বাড়িতে কেউ যায় নি।শুধু মাত্র বাবা আর দুই মামা আর বিহান, বিভোর ভাই,আর ভাইয়া গিয়েছে।এবার তারা দাওয়াত দিয়েছে সবাইকেই যেতে হবে।বিহান আসলে তবেই যাওয়া হবে।বিহান আসছে আমাকে আর রিয়াকে ঢাকায় নিয়ে যেতে।আমাদের এডমিশন পরীক্ষা সামনেই।
গত তিন মাস বিহান নড়াইলে আসে নি।গত এক বছরে অনেক ব্যাস্ততায় কেটেছে বিহানের।তবুও ব্যাস্ততার মাঝে আমাকে গাইড করে গিয়েছে ঠিকভাবে।আমার লেখাপড়ার সম্পূর্ণ খেয়াল রেখেছে।বিহানের জন্যই মনে হয় আমার লেখাপড়ার এতটা উন্নতি হয়েছে।দিনে দিনে বিহানের সাথে সম্পর্ক আমার এমন হয়েছে বিহান ছাড়া সব কিছুই অচল আমার।আমার যাবতীয় সব কাজ বিহান ই করে দেয়।এডমিশনের সব ফরম বিহান ই পূরণ করেছে।প্রতিটা পদে পদে বিহান কে অনুভব করি এখন,সব জায়গা বিহান কে প্রয়োজন আমার।বই এর মলাট,খাতা বেঁধে দেওয়া, ডজন ডজন পেন কিনে ঘরে রাখা সব কিছুই বিহানের খেয়াল থাকে।আমার যে ড্রেস পরতে ভাল লাগে সেটাই পরতে বলবে। আমার গায়ের রং উজ্জল না তাই অনেক সময় হয়তো সব কালারে আমাকে মানায় না কিন্তু বিহান আমার খারাপ হওয়া মন ভালো করেছে আমাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারী বলে।বিহানের চোখে আমিই শ্রেষ্ঠ সুন্দর নারী,আমাকে সব কালারেই ভালো লাগে তার কাছে।আমি নিজেও বুঝি আমাকে অনেক সময় মানাচ্ছে না কিন্তু সে আমায় বুঝাবে আমি তার চোখে এতটায় সুন্দর খারাপ কিছু তার কল্পনাতেও আসে না।শুধু একটায় সমস্যা আমি কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে পারবো না,পারবো না মানে না।এই জিনিস টা সে মেনে নিতে পারে নাহ।এমন কিছু হলেই বেরিয়ে আসে তার ভয়ংকর রুপ।আমার ও পৃথিবীর কারো সাথে কথা বলে মানসিক শান্তি আসেনা।দুজন দুজনের জন্য ভীষণ পরিপূরক আমরা।আমার অবস্থা এখন এমন হয়েছে বিহান আমার সাথে ঠিকভাবে কথা না বললে আমার দম বন্ধ হয়ে যায়।ফোন ওয়েটিং দেখলে বুক কাঁপে,অনেক টাইম কথা না হলে মাথা ঘুরায় খাওয়া অফ হয়ে যায়।আর বিহান সেই আগের মতোই আছে।এই আমাকে রাগাচ্ছে, ক্ষেপাচ্ছে ধমক দিচ্ছে আবার কাছে টেনে নিচ্ছে।
বিহানের ছবির দিকে তাকিয়ে ভেবে যাচ্ছি ওর কথা।আমি ওর ফোনে ফোন দিচ্ছি কিন্তু এক ঘন্টা ধরে ওয়েটিং ওর ফোন।এত সময় তো ওর ফোন ওয়েটিং থাকে না খুব একটা।কোনো পেশেন্ট কি কল দিয়েছে,কেউ কি ইমারজেন্সি সমস্যার কথা জানিয়ে ফোন দিয়েছে।
এরই মাঝে আমার নাম্বারে আননাউন নাম্বার থেকে ফোন এসছে।ফোন টা তুলতেই ফোনের ওপাশে কোনো মেয়ের কন্ঠ ভেষে এলো।আমি নম্রতার সাথে সালাম দিলাম।
ওপাশ থেকে বিষন্ন কোনো কন্ঠস্বর বললো "দিয়া"
"জ্বী! বাট আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।"
"বিহান তোমার কি হয়?"
আপনি কে আপু?
"আমার উত্তর টা প্লিজ।"
"আমি মিসেস বিহান।"
"ইম্পসিবল! এটা হতে পারেনা।তুমি মিথ্যা বলছো।"
"আপনাকে মিথ্যা বলে আমার লাভ কী?আপনি হয়তো জানেন না তাই।"
"বিহান তো কখনো বলেনি ও বিবাহিত।"
"উনিতো নিজে থেকে কাউকে কিছু বলেনা তেমন।কেউ জানতে চাইলে বলে না চাইলে বলেনা।"
"আমি সিওর তুমি মিথ্যা বলছো।বিহানের সাথে মাত্রই ফোনে কথা হলো আমার,সব সময় কথা হয়,মেসেজ হয়,সরাসরি দেখা হয় আমাকে তো কোনদিন বলেনি তোমার কথা।"
"কেনো বলে নি জানিনা?আপনি উনার কাছেই জিজ্ঞেস করুন কেনো বলেনি।উনি বলে নি তাহলে আপনি কিভাবে জেনেছেন আমার কথা।"
"যে যাকে ভালবাসে তার সব খবর ই সে রাখে দিয়া।"
"ভালবাসেন কাকে বিহান কে?"
"এত আশ্চর্য হচ্ছো ক্যানো দিয়া।"
"না মানে আপু কি বলবো বুঝতে পারছি না।"
"তোমাদের কি লাভ ম্যারেজ নাকি এরেঞ্জ ম্যারেজ।"
"এরেঞ্জ ম্যারেজ।তবে লাভ,,,"
"থাক আর বলতে হবেনা বুঝেছি তোমার মা ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে নিজের মেয়েকে ভাতিজার ঘাড়ে উঠিয়ে দিয়েছে।"
"এসব কি বলছেন আপনি,আমি বুঝতে পারছি এক তরফা ভালবাসায় কষ্ট হয়।আমি আপনার কষ্ট টা বুঝতে পারছি। কিন্তু আম্মুকে নিয়ে কিছু বলবেন না প্লিজ।"
"এক তরফা নয় দিয়া।তোমার এখন আবেগের বয়স।না চাইতেই নিজের যোগ্যতার থেকে ভাল কাউকে পেয়ে গিয়েছো।ভালবাসার কি বুঝো তুমি।তুমি আমাকে আর যায় হোক ভালবাসা নিয়ে বুঝাতে এসো না।"
"ভালবাসা যতটুকু বুঝি বিহানের জন্য এনাফ।ভালবাসায় এত যোগ্যতা দিয়ে কি হবে। "
"ভালবাসা বুঝো,কখনো রাতের পর রাত কাউকে ভালবেসে অবহেলা পেয়েছো।কাউকে ভালবেসে পাগলের মতো তার পিছে ছুটেছো।প্রিয়জন কে অন্যর হতে দেখেছো।তুমি তো না চেয়েই পেয়ে গিয়েছো বিহান কে।যা তুমি ডিজার্ভ ই করোনা।"
"আমি বুঝছি না,আপনি এত খারাপ ব্যবহার করছেন কেনো?"
"কারণ তুমি আমার ভাল থাকার জীবনে বাঁধা হয়ে এসেছো।আজ তুমি না থাকলে আমার জীবন টা হয়তো অনেক সুন্দর হতো।ছয়টা বছর পাগলের মতো ভালবেসেছি বিহান কে।বিহান আমাকে ভালবাসতো শুধু মাত্র তোমার জন্য তোমাদের ইমোশনাল ব্লাক মেইলের জন্য বিহান বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে তোমাকে।না হলে আমার সাথেই আজ বিহানের বিয়ে হতো।আমার জীবনে সব হাসি আনন্দ ফিরে আসতো।"
"দেখুন আপু আপনি কিন্তু বাজে কথা বলছেন।নেক্সট টাইম আমাকে প্লিজ আর কল করবেন না।বিহান আমাকে বকবে আপনার সাথে কথা বলেছি জানলে।"
"আমার নাম প্রেয়সী,তোমার মতো মেয়েকে কল দিয়েছি এটাই তোমার ভাগ্যর ব্যাপার।তুমি আমার স্টাটাস জানোনা তাই।বিহানের থেকে জেনে নিও।আমাকে ভাল কথা আর বাজে কথা শিখাচ্ছো,হাউ ডেয়ার ইউ।লজ্জা করে না তোমার, বিহানের যোগ্যতার পাশে কি আদেও মানায় তোমায়।দুদিন পর সবাই যখন তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে বিহান নিজেই ছেড়ে দিবে তোমায়।তার থেকে বেটার তুমি বিহান কে ছেড়ে দাও।আমি পৃথিবীতে সব সহ্য করতে পারি শুধু বিহানের পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারি না।আমি অভিশাপ দিচ্ছি তোমায় ধ্বংস হয়ে যাও তুমি।মরে যাও,বিহানের জীবন থেকে দূর হয়ে যাও প্লিজ।"
"ওহ! আপনি সেই প্রেয়সী।"
"আমাকে চিনো নাকি।"
"আপনার নাম অনেক বার দেখেছি,অসংখ্য কল মেসেজ দেখেছি কেননা বিহান বাড়িতে থাকলে ওর ফোন আমার কাছেই থাকে।বিহান আমাকে সব কিছু শেয়ার করে।ভুলে যাবেন না আমি ওর ওয়াইফ।বিবাহিত জীবনে কোনো তৃতীয় পক্ষের ঢোকা উচিত নয় বলে মনে করি।শুনেছি আপনি খারাপ তবে কতটুকু খারাপ আজ বুঝলাম।"
রাগে দুঃখে ফোন কেটে দিলাম আমি।রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে আমার।কষ্টে কাঁন্না পাচ্ছে।বিহান এক ঘন্টা প্রেয়সীর সাথে কথা বলছিলো ফোনে।বিবাহিত এটা মানুষ কে বলে না।বাহ! এই হলো আপনার চরিত্র।বিহান ফোনের উপর ফোন দিয়েই যাচ্ছে আমি কেটে দিচ্ছি।একবার ও ফোন রিসিভ করিনি।ফোন রিসিভ করছি না কেনো?কার সাথে কথা বলছি জানার জন্য মেসেজ করেই যাচ্ছে।আমি রুমে সুয়ে সুয়ে কেঁদে যাচ্ছি।একটা মেয়ে আরেক টা মেয়েকে এত খারাপ কথা কিভাবে বলতে পারে।যে মেয়ে বিহান কে পছন্দ করে তার সাথে এক ঘন্টা ফোনে কি কথা বলেছে বিহান।সারাদিন গড়িয়ে সন্ধ্যা পার হলো।দুপুর থেকে বিহানের কয়েক 'শ বার মেসেজ আর কল এসছে।একটা বার ও কল ধরিনি আমি।কেনো ধরবো ওর কল।একটা মেসেজ করে দিয়েছি আমাকে আর কোনদিন কল না দিলেই খুশী হবো।যার সাথে ফোনে বিজি ছিলেন তার সাথে বাকি জীবন কাটান, দোয়া করি সুখি হন।তারপর আর কল আসেনি বিহানের।মামি আর আমি রাতে বসে দুজনে টিভি দেখছি।কিন্তু আমার মন ভীষণ বিষন্ন।টিভিতে মন নেই।রাত আটটার দিকে ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম আমি।সেই ঢাকা থেকে বাইক চালিয়ে বিহান বাড়িতে চলে এসেছে সাথে বিভোর ভাই ও আছে।কিন্তু এখন উনি কেনো?উনার তো আসার কথা নয়।উনার না আগামিকাল আসার কথা।এখন না বলে কয়ে চলে এলো যে।