--হসপিটাল থেকে বিহান আমাকে বাসায় নিয়ে এসছে।বাসায় রেখে নিজেই সেবাযত্ন করবে।হসপিটালের থেকে বাসায় রেখেই নাকি বেষ্ট ট্রিটমেন্ট করতে পারবে।হসপিটালে প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট দেখার পর থেকে বিহান আর একটুও হাসে নি।মনে হলো পৃথিবীর সব থেকে খারাপ কোনো সংবাদ বিহানের কানে গিয়েছে।এমন টা তো হওয়ার কথা নয়।বিহান বাবা হবে এর থেকে খুশির খবর আর কি হতে পারে ওর কাছে।হসপিটাল থেকে রাত আটটার দিকে বিহান,বিভোর ভাই আর রিয়া আমাকে বাসায় নিয়ে এলো।বিহান আমাকে কোলে তুকে নিয়ে বেডে সুইয়ে একটা স্যালাইন ধরিয়ে দিয়ে রিয়াকে বললো,
"দিয়ার পাশে বসো আমি একটু আসছি।কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে কিন্তু।আমার ইমারজেন্সি কাজ আছে আমি এক্ষুণি আসছি।রিয়া কোথাও কিন্তু যেও না ওর কাছ থেকে।"
রিয়া মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে আমার পাশে এসে বসলো।
--আমার মনের মাঝে তুমুল অশান্তি হচ্ছে।আমাদের বেবি হওয়ার নিউজ শুনে যেখানে বিহানের সব থেকে বেশী খুশী হওয়ার কথা সেখানে বিহান এর মুড পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।বিহানের মাঝে কোনো আনন্দ,উল্লাস কিছুই নেই।কিন্তু কেনো, এমন বিহ্যাভ করছে।মনের মাঝে বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।রিয়া আর বিভোর ভাই আমার পাশে বসে আমাদের বেবি নিয়ে বিভিন্ন গল্প করে যাচ্ছে।বেবির নাম কি রাখবে,বেবিকে নিয়ে কি কি করবে বিভিন্ন প্লান করে যাচ্ছে।।আম্মু,মামা-মামি সবাই ফোন দিয়েছিলো।তাদের মাঝে আনন্দের শেষ নেই।তারা যেনো এক্ষুণি ছুটে আসতে পারলে খুশি হয়।দুটো পরিবারের সবাই যেখানে খুশি সেখানে বিহানের মুখে হাসি নেই কেনো।বিহানের চিন্তা মাথা থেকে যেতেই চাইছে না।নিজের আনন্দ ও ঠিক ভাবে উপভোগ করতে পারছি না।স্যালাইন শেষ প্রায় তখন বিহান প্রবেশ করলো রুমে।ঠিক ঠিক টাইমে বিহান কিভাবে প্রবেশ করলো রুমে।সময় নিয়ে এত সতর্ক কিভাবে হতে পারে।বিহান আসলে রিয়া আর বিভোর ভাই বেরিয়ে গেলো।বিহানের মুখ এখনো ভারী হয়ে আছে।হাতের স্যালাইন খুলে হাতে একটা টেপ মেরে বললো,
"ঘুমিয়ে যাও,রেস্টের প্রয়োজন তোমার।"
বিহানের চোখে মুখে মলিনতা দেখে বললাম,
"আপনি কি খুশী নন।"
বিহান গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
"কোন ব্যাপারে।"
"আমরা মা বাবা হতে যাচ্ছি এত বড় খুশির খবর আপনার কোনো ফিলিংস ই নেই।মনে হচ্ছে আপনি জানেন ই না।আবার জিজ্ঞেস করছেন কোন ব্যাপারে।"
বিহান মুড অফ করে খানিক টা বিরক্ত ভাবেই বললো,
"তুমি এক্সিডেন্ট করেছো আর আমি আনন্দ করে বেড়াবো।এই মুহুর্তে তুমি ছাড়া আমার কাছে কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয় দিয়া।হোক সেটা বেবি বা অন্য কোনো দামী জিনিস।তোমার থেকে দামী তো আর কোনো কিছু নয় তাইনা?তুমি আমাকে এখন ফিলিংস এর কথা বলছো।তুমি জানো কতটা স্ট্রেস গিয়েছে আমার উপর দিয়ে।এতটা ষ্টুপিড আর কেয়ারলেস তুমি।কখনো আমার কথা ভাবোই না।বারবার বলেছি তাড়াহুড়ো নয় সাবধানে রাস্তা ক্রস করবা।তোমার তো সেদিকে খেয়াল ই থাকে না।মন সারাক্ষণ এদিক সেদিক বেড়ায় তোমার।আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো আমার কি হতো।"
মাথা নিচু করে বললাম,
"আপনি কি আমায় বকছেন।"
বিহান আমার মন খারাপ দেখে চিন্তায় মাথার চুলে হাত চালিয়ে বললো,
"সরি দিয়া,সরি।আমার মাথা ঠিক নেই।তাই বকা দিয়ে ফেলছি।তুমি আগে সুস্থ হও পরে ভেবো বেবি নিয়ে।"
"এসব আপনি কোন ধরনের কথা বলছেন। বেবি গুরুত্বপূর্ণ না।"
"দিয়া প্লিজ টেক রেস্ট।আমি সাওয়ারে যাচ্ছি।"
বিহানের হাত টেনে ধরে বললাম,
"দাঁড়ান না প্লিজ।হঠাত কি হয়ে গেলো আপনার।বেবির ব্যাপার এড়িয়ে যেতে চাইছেন কেনো?বলুন না প্লিজ কি হয়েছে আপনার।"
"সাওয়ার নিয়ে আসছি।"
প্রায় দুই ঘন্টা কেটে গেছে,বিহান সাওয়ার ছেড়ে আসছেই না।কিছু তো সমস্যা হয়েছেই।ওয়াশ রুমে পানির টুপটাপ সাউন্ড হয়েই যাচ্ছে।প্রায় আড়াই ঘন্টা পরে বিহান কালো গেঞ্জি আর কালো ট্রাউজার পরে বেরিয়ে এলো টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে।চুল গুলো কপালে পড়েছে দলা পাকিয়ে পাকিয়ে ভীষণ সুন্দর লাগছে বিহান কে।বিহানের দিকে তাকিয়ে আছি আমি একভাবে।বিহানের চোখ আমার চোখে পড়তেই বিহান বললো,
"এখনো ঘুমোও নি।"
মাথা নাড়িয়ে বললাম,
" না ঘুম আসছে না।"
বিহান আমার পাশে এসে সুয়ে পড়লো।আমাকে টেনে বুকের সাথে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললো,
" এইবার ঘুমোও সোনা। "
"আচ্ছা আপনি কি বেবি নিয়ে খুশি নন।"
"সুস্থ হও আগে পরে এসব নিয়ে কথা হবে।"
সাতদিন পরে আমি পুরাপুরি সুস্থ তখন।বিহান একটা টুলে বসে টি-টেবিলে ল্যাপটপ রেখে কিছু একটা করছে।সাত দিনে বিহান কে হাসতে দেখিনি আমি।কি হয়ে গেলো বিহানের।আমি এক কাপ কফি নিয়ে বিহানের দিকে এগিয়ে দিলাম।বিহান কফিটা আমার হাত থেকে নিয়ে বললো,
"থ্যাংক ইউ ডিয়ার মিসেস বিহান।"
"বাহ মুড বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে।"
"তুমি সামনে আসলে আমার মুড অলওয়েজ ভেরি গুড হয়ে যায়।"
আমি ল্যাপটপ এর সাটার অফ করে বিহানের কোলে গিয়ে বসে বললাম,
" আচ্ছা তাই তাহলে এখন আর কাজ করতে হবে না।"
"তাহলে কি করবো?"
"বউ কে সময় দিন।গত সাত দিন দেখছি মুড অফ আপনার বাট হুয়াই।আপনার বেবি কিন্তু রাগ করছে তার পাপ্পা তাকে নিয়ে কোনো কথা বলে না কেনো?.."
"প্লিজ দিয়া!"
চিল্লাচিল্লি করে বললাম,
"কি সমস্যা আপনার।যখন ই আমাদের বেবির কথা বলি আপনি চুপ থাকেন কেনো?"
"দিয়া বিকজ আমি বেবি চাইছি না তাই।"
"হোয়াট কি বললেন আপনি বেবি চান না।"
"না চাই না।"
"বাট হুয়াই বিহান হুয়াই।"
"এখন কি তোমার বেবি নেওয়ার টাইম হলো।সামনে তোমার ফাইনাল ইয়ার বাকি।বেবি নিয়ে কিভাবে লেখাপড়া কমপ্লিট করবে।আগে লেখাপড়ার দিকে মন দাও পরে বেবি নিয়ে ভেবো।"
"আর যে এসেছে তাকে কি করবো।"
"নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি।"
"ছিঃআমি ভাবতে পারছি না। আপনি এসব বলতে পারেন।আমি ভেবেছিলাম খুশিতে পাগল হয়ে যাবেন আপনি।"
"দেখো দিয়া লেখাপড়া শেষ হোক তখন এসব নিয়ে ভেবো।"
"কি হবে লেখাপড়া দিয়ে,আমি বড় ডাক্তার হবো।কার জন্য ক্যারিয়ার গড়বো যদি আমার বেবি না থাকে।কি হবে টাকা দিয়ে ক্যারিয়ার দিয়ে।আই নিড বেবি।"
"আমি তো বলছি না আমাদের বেবি হবে না।তোমার লেখাপড়া শেষ হোক আগে।"
"আমার বেবি নিয়েই আমি লেখাপড়া শেষ করবো।"
সেদিন রাগারাগি করলাম খুব।আমার কাছে খুব আশ্চর্যের লাগছে ব্যাপার টা।বিহান তো সব সময় বলতো বেবি নিয়ে তার প্লান।তবে ঠিক সে সব সময় চেয়েছে আমার লেখাপড়া আগে শেষ হোক।কি লুকাচ্ছে বিহান। আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না কিছু।
এভাবেই বেশ কয়েকদিন অশান্তি চলছে।বিহান কিছুতেই বেবি রাখতে চাইছে না।বিহানের আজ নাইট ডিউটি বাসায় আসবে না।কলেজের এক ফ্রেন্ড কে ফোন দিয়ে বললাম আমার হাজবেন্ড বেবি রাখতে চাইছে না।ও তো এ ধরনের ছেলেই না। কি করবো বল তো।তাছাড়া ওর এমন করার কারণ কি।
সে আমাকে বললো,
"পুরুষ মানুষের যখন বাইরে রিলেশন থাকে তখন বেবি নিতে রাজি থাকে না।আমার জামাই এমন করেছিলো।আমি জানি তোর জামাই খুব ভালো।তবুও পুরুষ মানুষ চেঞ্জ হতে সময় লাগে না।"
ফ্রেন্ডের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো।তবে আমি জানি বিহান এমন কখনো করবে না।তবে ইদানিং বিহান ঠিক মতো বাড়িতে আসে না সারাক্ষণ ল্যাপটপ এ মন। আসলেই বিহান চেঞ্জ। এই চেঞ্জের কি কারণ।কখনো হাসে ও না।সারাক্ষণ চিন্তিত।সারারাত বাসায় আসে নি।বলেছে ইমারজেঞ্জি ওটি আছে।আমি পরের দিন সকাল ছয়টায় বিহানের জন্য খাবার নিয়ে হসপিটালে গেলাম।সারারাত কিছু খেয়েছে কিনা তার ঠিক নেই।রাত থাকতে উঠে বিহানের ফেভারিট খাবার রান্না করলাম।হসপিটাল এ রওনা হয়ে বিহান কে ফোন দিচ্ছি কিন্তু তোলে না।বিহানের কেবিনে গিয়ে দরজা নক করতেই ভেতর থেকে বললো কে পরে আসুন বিজি আছি।আমি সিওর বিহান অন্য কেউ ভেবেছে।তাই দরজা জোরে ধাক্কা দিলাম।দরজা খুলেই শকড হয়ে গেলাম আমি।আকাশ পাতাল যেনো এক হয়ে গেলো আমার।প্রেয়সীর হাত ধরে বসে আছে বিহান।সমস্ত শরীর কাঁপছে আমার।খাবারের বক্স নিচে পড়তেই বিহান আমার দিকে তাকালো।বিহান আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
'দিয়া তুমি এত সকালে।'
'চোখের পানি মুছে বললাম,আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি।'
বিহান টেবিলে থাবা মেরে বললো,ওহ শীট।
আমি এক দৌড়ে বাসার দিকে রওনা হলাম।বাসায় এসে রুমের সমস্ত জিনিস ছোড়াছুড়ি করছি।রুমের সমস্ত জিনিস ভেঙে গুড়িয়ে ফেললাম।বুকের মাঝে ভেঙে চুরে যাচ্ছে ব্যাথায়।
সাথে সাথেই বিহান চলে এলো বাসায়।আমাকে ফ্লোরে বসে কাঁন্নাকাটি করতে দেখে বিহান হাতের আঙুল মুঠো করে দরজায় জোরে ধাক্কা মেরে বললো,
"ওহ গড!দিয়া প্লিজ কুল।তুমি অসুস্থ। এমন করলে তুমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।"
বিহানের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
"ছিঃবিহান তুমি আমাকে এইভাবে ঠকাতে পারলে।"
"নো দিয়া,ভুল বুঝছো তুমি।"
"কিছু বোঝাতে হবে না আপনাকে।এইজন্য বেবি রাখতে চাইছেন না আপনি।আপনাকে আমি এত ভালবাসার পরেও অন্য মেয়ের হাত ধরতে বিবেক এ বাঁধলো না।কি কম আছে আমার মাঝে,আমি কি আপনাকে কম ভালবাসি,নাকি আমি ভালো বউ না। নাকি আপনি আমার সাথে খুশি না।আপনাকে আমি চোখ বুজে বিশ্বাস করি আর আপনি কিনা।ছিঃবিহান ছিঃ।"
"এসব কি বলছো তুমি দিয়া।তুমি যা দেখেছো তা ঠিক নয়।আমাকে বলার তো সুযোগ দাও।"
বিহান আমার কাছে আসতেই সেন্স লেস হয়ে গেলাম।
জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি বিছানায় সুয়ে আছি।বিহান কোথাও নেই আশেপাশে।বিছানা থেকে উঠেই ড্রায়ার থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে নড়াইল রওনা হলাম।বাসে উঠে বিহান কে মেসেজ করলাম।
"আমি নড়াইল আম্মুর কাছে ফিরে যাচ্ছি।আমাকে আমার বেবিকে কাউকে প্রয়োজন নেই আপনার।ডাক্তারি পড়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।ভালো থাকুন আপনি।"