দীর্ঘদিন পর নড়াইলের সূর্যদয় দেখলাম।সূর্য মাত্রই মাথা উচু করেছে পূর্ব আকাশে।শুরু হয়েছে আরেক টি পবিত্র দিনের।সূর্যর কিরণ মাত্রই ছড়াতে শুরু করেছে।সূর্যর মিষ্টি আলো বারান্দায় এসে পড়েছে।বারান্দায় প্রথম আলো এসে পড়ে বড় তালগাছটার উপর হতে এসে। কতদিন পর এই দৃশ্য টা দেখলাম।উঠানের কোনায় লাউ কুমড়ার টাল এবার ও দেওয়া হয়েছে।
শিউলি গাছটা আগের মতোই আছে।ফুলে ফুলে মুড়ে গিয়েছে শিউলি তলা।উঠানের কোনা দিয়ে লাল হলুদ গাদা ফুল ফুটেছে থোকায় থোকায়।সময় টা শীতকাল।আজ কতদিন পর মেয়েকে নিয়ে নড়াইল এসছি।দীর্ঘ সময় পরে আবার সব কাজিন রা এক জায়গা হয়েছি।আমার আর বিহানের আষ্টম বিবাহবার্ষিকী এবার কাজিন দের সাথে সেলিব্রেশন করবো।সকালের এখনো দু'বছর হয় নি।তবে গুটি গুটি পায়ে হাঁটা শিখেছে,গাল ভরে হাসতে শিখেছে।নিচে মারুফা খালা এসে ডাকা ডাকি করছে।পাশেই এক বাড়ি এখনো ঢেঁকির প্রচলন আছে ও বাড়ির চাচা ঢেঁকিতে কোটা চাল ছাড়া পিঠা খায় না।মারুফা খালা ও বাড়ি থেকে ডাল ছেঁচে এনে এখন বিলিন্ডারে ভালো ভাবে বিলিন্ড করছে।কুমড়া বড়ি বানানোর জন্য।ওদিকে চাল ভেজানো হয়ে গিয়েছে ঢেঁকিতে কুটতে যাবে।ঢেঁকিতে কোটা চালেই মামি পিঠাপুলি বানায়।মেশিনে খুব একটা চাল কোটে না।
--আমি ব্রাশ করে ওয়াশ রুম থেকে বের হলাম।বিহান কম্বল মুড়ি দিয়ে সুয়ে আছে কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে।আমি ওয়াশ রুমে গেছিলাম এসে দেখি সকাল নেই।কম্বল উঁচু করে দেখি সকাল বিহানের কাছেও নেই।খাটের নিচে তাকিয়ে দেখলাম ফ্লোরে পড়ে গেলো কিনা।নিচেও নেই।
বিহান এর গায়ে হাত দিয়ে ডাকছি,
"শুনছো।"
ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,
"হুম।"
"সকাল কই।"
"আছে দেখো।"
"নেই তো।"
"উহু ডিস্টার্ব করোনা,ঘুমোতে দাও।"
"মেয়ে কই সেদিকে হুঁশ নেই আর উনি ঘুমোচ্ছে।সকাল কোথায়।"
আমার কথার উত্তর দিচ্ছে না দেখে গায়ের কম্বল সম্পূর্ণ টেনে ফেলে দিয়ে বললাম,
"এইবার ঘুমোও।অসহ্য মানুষ একটা এই লোক।মেয়ে কোথায় জানেনা।।"
বিহান চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে কপালের চামড়া কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
"তোমার গায়ের শীতের কাপড় কই,ঠান্ডা লেগে যাবে।আর পায়ে মোজা কই।"
"আগে বলুন মেয়ে কই।"
"ওর মামা নিয়ে গেছে।"
"ভাইয়া কখন এলো।"
"এসছে,পড়ে পড়ে ঘুমোলে কখন দেখবে এসছে।"
"আমি না আপনি ঘুমোচ্ছেন তা দেখাই যাচ্ছে।"
"সারারাত কে ঘুমিয়েছে ষ্টুপিড মহিলা।"
"এই দেখুন এখন আমার বয়স হয়েছে, আর আমার মেয়ের সামনে কখনো আমাকে মহিলা টহিলা বলবেন না বাদ্দিক নিষেধ করলাম।"
উনি ভ্রু কুচকে তাকালেন।
"হোয়াট মিন্স বাদ্দিক।সেটা আবার কি?"
"মানে আর কখনো না।"
"ভাষা পরিবর্তন আর জীবনেও হলো না।
সারারাত নাক ডেকে ঘুমিয়েছো।সকাল আগলা ছিলো আর সারারাত জেগেছিলো।আধাঘন্টা পরে পরে উঠেছে আর কেঁদেছে।তুমি সারাদিন হাবিজাবি খাবার খেয়ে আরামে নাক ডাকো আর আমার প্রিন্সেস টা কষ্ট পায়।সকালের মনে হয় পেটে ব্যাথা করছিলো কাল সারারাত।আজ থেকে যদি হাবিজাবি খাবার খাও হাবিজাবি মহিলা খবর আছে তোমার।"
"কি বললেন আমি হাবিজাবি মহিলা।আর আমি নাক ডাকি।"
"হো ইদুরের মতো।"
"ইদুর নাক ডাকে।"
"হ্যাঁ তোমার মতো।"
"আমি নাক ডাকি।"
"সন্দেহ আছে।"
"আমাকে যদি আর একটা বাজে কথা বলেন সত্যি খবর আছে।"
"সকাল সকাল রোমান্টিক খবর দাও।তুমি কি আবার মা হতে চলেছো?বাট আমি তো... "
"আমি আবার মা হতে চলেছি মানে।বাচ্চা কি চান্দের দেশ থেকে আসবে।"
"না মানে আমি ফ্যামিলি প্লানের সব রুলস মেইনটেইন করেছি দিয়া।তাহলে কি বাচ্চা তুমি দারাজে অর্ডার করলে।"
"এইবার একটা বর অর্ডার করবো বুঝলেন।তাহলে বর ও পাবো বাচ্চা ও পাবো।"
"ওই হ্যালো ব্রিটিস মহিলা,শ্বশুরের একমাত্র জামাই চাইলে সারাজীবন তোমাকে প্রেগন্যান্ট রাখতে পারবে।শ্বশুরের মেয়েকে খালি পেটে রাখবে না।আমাকে বদনাম করে অন্যর কাছে যেও না।মানুষ আমাকে অন্য কিছু ভাববে।ভাববে আমার মাঝে অন্য প্রব্লেম।"
"ভাবুক তো আমার কি।"
বাইরে ভাইয়ার কোলে সকাল খিলখিল করে হাসছে।ভাইয়া রোদে নিয়ে দাঁড়িয়েছে সকাল কে।ভাইয়া কাতুকুতু দিচ্ছে আর সকাল হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে।সকাল কে মামা বলে বলে ডাকছে।সেখানে মামা এসে দাঁড়িয়ে সকালে কে দাদু দাদু করছে।
বিহান ঠান্ডায় কাঁপা ঠোঁটে বললো,
"মিসেস বিহান কাম হেয়ার বউ।"
গায়ে শীতের কাপড় পরতে পরতে বিহানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
"বলুন মিষ্টার বিহান বাবু।"
বিহান আমাকে এক টানে ওর বুকের উপর নিয়ে বললো,
"শোনো না বাবুর আম্মু।"
এইভাবে বিহানের বুকে পড়ে বেশ লজ্জা পেলাম।আমি যে লজ্জামাখা চাহনি তে তাকিয়েছি বিহান বেশ বুঝতে পারলো।
বিহানের ভয়েজে কেমন নমনীয়তা।আধো আধো কন্ঠে কথা বলছে।যে কন্ঠে জড়ানো প্রেমময় নেশা।হাত দিয়ে আমার মুখের উপর পড়া চুল কানের নিচে গুজে দিতে দিতে বললো,
"এইভাবে বিহান বাবু বলে ডেকে নিজের বিপদ বাড়িওনা বাবুর আম্মু।"
"তাহলে কি বলে ডাকবো।"
বিহান আমার সোয়াটারের বোতাম খুলে সোয়েটারের ভেতরে নিজের হাত ঢুকিয়ে আমার পিঠ জড়িয়ে ধরলো দুই হাত দিয়ে।অতঃপর বললো,
"আমার গায়ের কম্বল টেনে ফেলেছো।এখন আমার কম্বল হয়ে যাও বউ।"
"ওই কেউ এসে যাবে।ছাড়ুন বলছি।"
"নো ছাড়াছাড়ি, আমার ঠান্ডা লাগছে।"
"কেউ এসে যাবে এবার সত্যি।"
"আসুক তো কি।বেডরুম আমার,বউ আমার,আমি যা ইচ্ছা তাই করবো।যে দেখবে সে লজ্জায় পিছিয়ে যাবে।আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাবো।"
"কি নির্লজ্জ হয়েছেন আপনি?ছি!ছাড়ুন আমায়।আমি কম্বল টেনে দিচ্ছি।"
"তোমাকে না বলেছি শাড়ি পরে ঘুরবে না আমার সামনে দিয়ে।এমনিতে সারারাত গেঞ্জি পরে ঘুমিয়ে আমার ফিলিংস এর দফারফা করো। আবার সকাল সকাল কোমর বের করে শাড়ি পরে ঘুরে আমাকে অসভ্যতে পরিণত করো।এসব দোষ কার।এসব দোষ তোমার।"
"হ্যাঁ ঘুরে ঘুরে সব দোষ আমার ই দিবেন বুঝেছেন।কম্বল নিয়ে আসি ছাড়ুন।"
"নো লাগবে না।তুমি থাকলেই হবে।"
"আমি তো সারাক্ষণ ই থাকি।"
"এই তোমার সমস্যা কি একবার তুমি বলো একবার আপনি বলো এর থেকে তো তুই করেও বলতে পারো।"
"তুই করে তো আপনি বলেন,আমি তো বলিনা।"
"তোকে তুই ডাকতে ভাল লাগে রে আমার পিচ্চি।আউ আমার পিচ্চিটা এখন কত্ত বড় হয়েছে।উম্মম্মম দিয়ায়ায়ায়ায়া একটু জোরে হাগ দাও না টাইট করে। খুব ইচ্ছা করছে প্লিজ প্লিজ প্লিজ।"
"কি পাগল হয়েছেন আপনি।"
বিহান কে টাইট হাগ দিয়ে উঠে এলাম।কম্বল টা গায়ে ভালো ভাবে জড়িয়ে দিয়ে এসে বললাম এবার ঘুমোন।
আমাদের বাসা থেকে দু'কিঃমি দূরে গাছিরা খেজুর গাছ কাটে।খাটি খেজুর রসের অর্ডার দিয়ে এসছিলো মামা।৮ টা ঠিলে তে করে রস দিয়ে গিয়েছে।মামা টাকা দিয়ে বিদায় করে দিলো রস রেখে।রস অর্ধেক বিভোর ভাই রা রাখলো।গ্রাম থেকে খাটি খেজুর পাটালি ও আনা হয়েছে।উঠানের এক কোনায় চুলা বানানো হয়েছে পিঠা বানানোর জন্য।
সবাই মিলে এক গ্লাস করে রস খেয়ে নিলাম।শীতের সকালে খেজুরের রস খাওয়ার ঐতিহ্য সত্যি সুন্দর। রস খাওয়া শেষে বাকি রস মামি জাল দেওয়া শুরু করলো।সকাল থেকে সেমাই পিঠা বানানো হচ্ছে।ডাব জাতীয় নারকেল এর সাথে রসে রানান সেমাই পিঠা খাওয়ার মতো টেস্টি জিনিস আর নেই।শিতকালে পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে গেলো।সন্ধায় ভাপা পিঠা সাথে রসে ভেজা দুধ চিতই ও বানানো হলো।আমরা কাজিন রা এক জায়গা জড় হয়ে পিঠা খাচ্ছি আর আনন্দ করছি।
ধীরে ধীরে সময় আরো এগোচ্ছে।রিয়ার একটা ছেলে হলো,ভাইয়ার একটা ছেলে হলো,তোহা আপুর বিয়ে হলো তিয়াস ভাইয়ার বিয়েতে মাগুরা বরযাত্রী গিয়ে অনেক আনন্দ করলাম।আমাদের কাজিন মহল ধীরে ধীরে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো যে যার সংসার জীবনে সন্তান নিয়ে।জীবন এমনি। সংসার জীবনে সবাই ভীষণ ব্যাস্ততার মাঝে ঢুকে পড়ে।এখন আর আগের মতো আড্ডা সব সময় হয় না।তবে দুই ঈদে আমাদের প্রতিবছর দেখা হয়।