ফ্লোরেনসিয়া – ২১

28 Min Read

প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা আর অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া প্রকৃতি। চারপাশটায় ভয়াবহ গা ছমছমে ভাব। এতটাই নীরবতা বিরাজ করছিল, যেন দূর থেকে বহুদূর পর্যন্ত কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই। বুকের গভীর থেকে ধীরে ধীরে সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে নিল এদুয়ার্দো। শিরশিরে বাতাস বইছিল। আকাশে ঘন-কালো মেঘ। থেকে থেকে গগণ চিরে মৃদু আওয়াজে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। এদুয়ার্দো তার লাল টুকটুকে শুষ্ক ঠোঁটজোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিল। পেছন ফিরে মায়ের দিকে তাকাল। যেন তার দম আঁটকে এলো। মনে মনে ভাবল, কিভাবে কথাগুলো জিজ্ঞেস করবে নিজের মাকে? কয়েকপল সময় গড়িয়ে গেল। এদুয়ার্দো নিজেকে শক্ত করে নিল। গলা ঝেড়ে থমথমে-ভরাট কন্ঠে ডাকল,

– মা।

– হুম।

– ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলের বেশ কিছু গ্রাম থেকে কম বয়সী সুন্দরী যুবতীরা নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। আপনি কি সে খবর জানেন?

পিদর্কা স্যাভেরিন বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকালেন। যেন এরকম অপ্রত্যাশিত খবর শুনে তিনি বেশ আশ্চর্য হয়েছেন। তার ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

– তাই?

– হুম।

– কই? আমি তো কিছু জানিনা।

এদুয়ার্দো স্বস্তি পেল। ভারি ভারি পা ফেলে ছাদের কিনারায় গিয়ে বুকের উপর দু’হাত বেঁধে দাঁড়াল। পিদর্কা স্যাভেরিনের ভীষণ গলা শুকিয়ে এলো। কিজানি এদুয়ার্দো ঠিক কি কি প্রশ্ন করবে তাকে। কতটুকু জানতে পেরেছে সে!

এদুয়ার্দো সেভেরোদোনেৎস্ক শহরে ঘটে যাওয়া সেদিনকার ঘটনাটুকু সময় নিয়ে বলল। অতঃপর সেনাধ্যক্ষ থমাস কিম্বার্লির শিরশ্ছেদ সম্পর্কে জানাল। পিদর্কা স্যাভেরিন নিজের অজ্ঞাতেই মৃদু মৃদু কাঁপতে শুরু করলেন। আতঙ্কের আধিক্যে একপা পিছিয়ে গেলেন। এদুয়ার্দো হিংস্রাত্মক শীতল কন্ঠে বলল,

– আমার সংবিধানে বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ক্ষমা নেই মা। কিম্বার্লি বলেছিলো আপনার নির্দেশে মেয়েগুলোকে স্যাভেরিন ক্যাসলে নিয়ে আসা হয়।

মুহূর্তেই পিদর্কার দু’চোখে ভয়াল আতংকের বিদ্যুৎ খেলে গেল। এই বুঝি এদুয়ার্দো তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়! যদি তার করা বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ভয়াবহ শাস্তি নির্ধারণ করে? এদুয়ার্দো কতটা হিংস্র তার থেকে বেশি আর কে জানে? শরীরের সাথে সাথে পিদর্কা স্যাভেরিনের সমস্ত শিরা-উপশিরায় কম্পন সৃষ্টি হলো। তিনি শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

– তুমি কি বিশ্বাস করেছো ওর কথা?

এদুয়ার্দো উত্তর দিল না। পেছন ফিরে নিজের মায়ের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। তার চোখ দু’টো ভীষণ শান্ত। যেন ঝড় আসার পূর্বক্ষণ। পিদর্কা স্যাভেরিন অস্থির হয়ে উঠলেন। কেমন হাঁসফাঁস করতে শুরু করলেন। জোর গলায় দৃঢ়কণ্ঠে বললেন,

– আমি এসবের কিছুই জানিনা।

– আপনার বলা প্রতিটা শব্দ আমার কাছে ধ্রুব সত্য।___এদুয়ার্দো কঠোর গলায় বলল। পিদর্কা স্যাভরিন তার দু’চোখে অসামান্য শ্রদ্ধা দেখতে পেলেন। কন্ঠস্বরে অনুভূত হলো মায়ের প্রতি অসম্ভব বিশ্বাস।

– আমি বুঝতে পারছি। তবুও তুমি ওর কথায় আমাকে সন্দেহ করেছো।

– অসম্ভব। নিজেকে সন্দেহ করতে পারি, কিন্তু আপনাকে না। আমি’তো নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি নিজের মাকে।

একজন হিংস্র শক্তিধর রক্তপিপাসু নিজের মায়ের কাছে ঠিক কতটা দূর্বল হতে পারে এই মুহূর্তে এদুয়ার্দোকে না দেখলে সেকথা কেউ বিশ্বাস করবে না। ছেলেটার রক্তের পিপাসা ছিলো বেশ তীব্র। এদুয়ার্দো যখন সতেরো বছরের তাগড়া যুবক, তখন প্রতিনিয়ত স্যাভেরিন ক্যাসলের বেসমেন্টের গুপ্ত কামরাগুলো থেকে মানুষের বীভৎস আর্তনাদ শোনা যেত। ক্যাসলের বাইরে, ভিতরে প্রতিদিন একাধিক রক্ত মাংসের নারী-পুরুষ তার হিঃস্রতার শিকার হতো।

ছোটবেলা থেকেই এদুয়ার্দো ছিলো অসীম শক্তিধর। চালচলন আর মুখাবয়বে ছিলো রাজা বাদশাদের প্রতিমূর্তি। তার দু’চোখের এমারেল্ড সবুজ চোখজোড়ায় সর্বদা ভেসে বেড়াতো সমগ্র ভ্যাম্পায়ার সাম্রাজ্য শাসন করার দুর্দমনীয় স্বপ্ন। একরাশ আকাঙ্ক্ষা আর প্রতীয়মান নিবিড় ইচ্ছেশক্তি। কারন সে জানতো তার বাবা ছিলেন অপরাজেয় শাসক। নিজের বাবার মতো একজন অজেয় শাসক হওয়ার ইচ্ছে থেকেই দিনের পর দিন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আরও শক্তিশালী হতে থাকে এদুয়ার্দো। একদিন পিদর্কা স্যাভেরিন এদুয়ার্দোকে কাছে ডাকলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

– এদুয়ার্দো, আমার সাহসী বাবা। কখনো কোনো নিরীহ মানুষকে হত্যা করো না।

এদুয়ার্দো অনিমেষ তাকিয়ে রইল। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

– কিন্তু কেনো মা? মানুষের রক্ত আমাদের খাদ্য। আমরা কি প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যেতে পারি?

পিদর্কা স্যাভেরিন ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলেন। সহজ সরল কন্ঠে বলা তার ছেলের কথাগুলো মনযোগ সহকারে শুনলেন। কপালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বললেন,

– আমরাতো অন্যান্য সব প্রাণীগুলোর রক্ত খেয়েও জীবনধারণ করতে পারি, তাইনা?

এদুয়ার্দো সহাস্যে মাথা নাড়াল। অকস্মাৎ তার মুখখানা বিষণ্ণ হয়ে গেল। রাশভারী কন্ঠে বলল,

– কিন্তু মানুষের র’ক্ত ভীষণ সুস্বাদু। ওদের র’ক্ত খেয়ে যতটা স্বাদ আর শান্তি পাওয়া যায়। অন্যকোনো প্রাণীর র’ক্তে সেই স্বাদ বা সুগন্ধ নেই। মানুষের র’ক্ত যেন অমৃতের মতো। ওদের র’ক্ত আমাকে চুম্বকের মতে আকর্ষণ করে। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনা।

পিদর্কা স্যাভেরিন একহাতে ছেলেকে জড়িয়ে নিলেন। অন্যহাতে এদুয়ার্দোর একহাত মুঠোবন্দি করে ধরলেন। নরম গলায় আদুরে স্বরে বললেন,

– পৃথিবীতে যেমন ভালো মানুষ আছে। তেমনই অসংখ্য, অগনিত খারাপ মানুষও আছে। তুমি চাইলেই তাদের র’ক্ত পান করতে পারো। এতে করে তোমার র’ক্ত পিপাসাও মিটবে। সাথে ঐ খারাপ মানুষগুলো নিজেদের যোগ্য শাস্তিও পাবে।

এদুয়ার্দো মায়ের বাধ্য ছেলে। নিঃসংকোচে মায়ের উপদেশ মেনে নিয়েছিল। নিরীহ মানুষগুলোকে নৃশংসভাবে হত্যা করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তার মা যদি চায়, সে হেসে হেসে নিজের জীবন দিয়ে দিতে পারে। অনায়াসেই মৃ’ত্যুকে বরণ করে নিতে পারে।

মায়ের কথা নিঃসন্দেহে মেনে নেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রুড গোত্রের ভ্যাম্পায়ার, সেই অবুঝ এদুয়ার্দো সত্যিই ভ্যাম্পায়ার সাম্রাজ্যের বর্তমান শাসক। ক্লাচ, ব্রুড, কোভেন, প্যাক, ক্ল্যান এবং সমগ্র ভ্যাম্পায়ার গোত্রের অনারেবল ওভারলর্ড। পিদর্কা স্যাভেরিনের একগুয়ে, রগচটা, জেদি আর আদরের সন্তান ক্লীভল্যান্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন। কয়েক বছরের ব্যবধানে যে গড়ে তুলেছে নিজের শক্তিশালী ভ্যাম্পায়ার সাম্রাজ্য। সেই এদুয়ার্দো যখন সব সত্যি জানতে পারবে তখন পিদর্কা স্যাভেরিনের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

– জ্যাসনকে ক্যাসলে কেনো ডেকে পাঠিয়েছেন?

এদুয়ার্দোর করা প্রশ্ন শুনতে পেয়ে পিদর্কা স্যাভেরিন নিজের ভাবনার ইতি টানলেন। সহজ সাবলীল কন্ঠস্বরে বললেন,

– ভিক্টোরিয়া সবসময়ই মন খারাপ করে থাকতো। ওর মুখের দিকে তাকানো যেতোনা। আমিতো মা। সন্তানের সব দুঃখ কষ্ট বুঝতে পারি। তাই জ্যাসনকে ডেকে পাঠিয়েছি ওর সাথে দেখা করে যাওয়ার জন্য।

– আপনার ছোট ছেলে? ও কি স্লোভাকিয়ায় ফিরে যাবে না? ওর এই ভবঘুরে চলাফেরা আমার একদমই পছন্দ হচ্ছে না। ওকে নিজের দায়িত্ব বুঝে নিতে বলুন। আমার কথার অবাধ্য হওয়ার মতো দুঃসাহস দেখায় কি করে? ও কি মনে করে, সহোদর বলে ওর এই আস্পর্ধা আমি ক্ষমা করে দিবো?

– রেগে যেও না। মাথা ঠান্ডা রাখো। তুমিতো জানো ও এরকমই অবাধ্য। নিজের মর্জি মতো চলে। স্বাধীন জীবনযাপন করতে পছন্দ করে। আমি ওর কাছে পত্র পাঠিয়েছি। আশা করি খুব দ্রুত স্লোভাকিয়ায় ফিরে যাবে। তুমি এ নিয়ে একদমই ভেবো না।

– ঠিক আছে। আমার আর কিছু বলার নেই। আমি এখন আসি মা।

– হুম।___ভাবলেশহীন কন্ঠে অনুমতি দিলেন পিদর্কা স্যাভেরিন।

এদুয়ার্দো কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেলো। পিদর্কা স্যাভেরিন ভাবান্তর ভঙ্গিতে নিশ্চল দেহে ছাদে দাঁড়িয়ে রইলেন।

_______★★_______

কাস্ত্রোরুজ থর্প।

ভয়াল রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে চারপাশে ভোরের আবছা আলো ফুটে উঠে। ঈষৎ আলো ঈষৎ অন্ধকারে ক্রিস্তিয়ান পা চালিয়ে হাঁটে। পিঠের পেছনে ঝুলে দু’হাতের শক্ত বাঁধনে তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে আর্নি। দু’পায়ে আঁকড়ে ধরে ছিলো ক্রিস্তিয়ানের পেট।

দুশ্চিন্তায় চোখের সামনে ছেলেটা সবকিছু অন্ধকার দেখছিল। পাশের ঝোপঝাড়গুলো থেকে এখনো ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল। মন প্রাণ উড়ার করে দেওয়া সুশীতল হাওয়া বইছিলো। অথচ ক্রিস্তিয়ান ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছিল। একহাতে লন্ঠন ধরে অন্যহাতটা আর্নির পিঠের উপর রেখেছিল। অন্ধকার থাকতে থাকতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল ওরা।

ভোর রাতের দিকে এলোমেলো দুঃস্বপ্ন দেখে ক্রিস্তিয়ানের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। দুঃস্বপ্নে দেখা ঘটনাটুকু সম্পূর্ণ অস্পষ্ট ছিল। শুধু স্পষ্ট মনে আছে সিয়ার হৃদয়বিদারক কান্না। স্বপ্নটা দেখার পর ক্রিস্তিয়ানের শরীর দিয়ে দরদরিয়ে ঘাম ছুটে যায়। সিয়া কাঁদছিলো। কেনো কাঁদছিলো সিয়া? ভাবতে ভাবতেই সদর দরজার দিকে তার নজর পড়ল। দরজাটা তখনো ভেতর থেকে লাগানো।

– এখনো ফিরে আসেনি বাবা-বাবা?

অস্ফুট স্বরে ক্রিস্তিয়ান কথাটা বলল। চট করে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সে সময় দেখে নিল। তিনটে বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। অজানা আতঙ্কে তার হৃদয় মুষড়ে উঠল।

– ও বাড়ির কারো কোনো বিপদ হয়নি তো? দুঃস্বপ্নে সিয়া কেনো কাঁদছিলো?

ক্রিস্তিয়ান তড়িঘড়ি করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। বিছানার কাছে গিয়ে ব্যতিব্যস্ত স্বরে ডাকল,

– আর্নি? আর্নি উঠ।

ঘুম থেকে চমকে জেগে উঠল আর্নি। শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

– কি হয়েছে?

– বাবা-মা এখনো ফিরে আসেনি। সিয়াদের বাড়িতে যেতে হবে।

– তারা কোনো বিপদে পড়ে যায়নি তো? এর আগে এরকম কোনোদিনও হয়নি।

বিচলিত স্বরে কথাটা বলে আর্নি উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু আহত জায়গাগুলোতে ব্যথা অনুভব করল। মুখখানা কেমন করুণ হয়ে গেল ওর। দু’চোখ ছাপিয়ে অশ্রুকণা টলমলিয়ে উঠল।

– আমি বোধহয় হেঁটে যেতে পারবো না। তুমি দ্রুত যাও। খবর নিয়ে আবার দ্রুত ফিরে এসো।

– তোকে একা রেখে কিভাবো যাবো?

আর্নি কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। ওর মনটাও অস্থির হয়ে আছে। দুশ্চিন্তা হলো নিজের বাবা মায়ের জন্যে। বাড়িতে একা থাকা সম্ভব হবে না ওর পক্ষে। আতঙ্কে দমবন্ধ হয়ে মা’রা যেতে পারে। ক্রিস্তিয়ান সবটাই বুঝল। অতঃপর আর্নিকে সাথে নিয়েই রওনা দিল সিয়ারদের বাড়ির দিকে। নিজের হাত দু’টো খুব সাবধানে রেখেছে সে। যেন আর্নি ব্যথা না পায় ওর ক্ষতস্থানগুলোতে।

হাঁটতে হাঁটতে ক্রিস্তিয়ান সিয়াদের বাড়ির কাছাকাছি চলে আসে। ততক্ষণে ঝলমলে ভোরের আলো ফুটেছে চারপাশে। লন্ঠনের কোনো প্রয়োজন নেই। তবুও শক্তহাতে লন্ঠনটা ধরে রাখে সে। দুরুদুরু বুক কাঁপে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে সবকিছুই যেন ঠিক থাকে। আর্নির গলা শুকিয়ে আসে। পেট মোচড়াতে শুরু করে। রাতের বেলা খাবার খাওয়া হয়নি কারো। ভয় আর শঙ্কায় খুব জোর ক্ষুধা লেগে গেছে। পেটে যেন ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।

বাড়ির ভেতর থেকে ইনায়ার কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে যায় আর্নি। ক্রিস্তিয়ানের দম বন্ধ হয়ে আসে। অস্থির হয়ে উঠে চিত্ত। অবরুদ্ধ হয় পথ চলার গতি। ভয় পায় ক্রিস্তিয়ান। ভীষণ ভয় পায়। অবশ হয়ে আসা পায়ে পশ্চাদ্ভাগের উঠোন পেরিয়ে সিয়াদের বাড়িতে প্রবেশ করে। দু’পা এগিয়ে বারান্দার দিকে তাকায়। এক নিমেষে স্তব্ধ হয়ে যায় তার দু’চোখের দৃষ্টি।

চারপাশে নজর বুলায় আর্নি। সব জিনিস ছড়ানো ছিটানো ছিল। একপাশে কিছু জ্বালিয়ে দেওয়ার ছাই পড়ে আছে। আর্নি হতবাক হয়। গলা উচিয়ে ক্রিস্তিয়ানের কাঁধের উপর দিয়ে বারান্দার দিকে তাকায়। মুহূর্তেই ভয়াবহ চমকায়। বারান্দার মেঝেতে শুয়ে আছে তিনজন মহিলা। তাদের মধ্যে একজন সাসোলি কুরী। ইনায়া কাঁদছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে প্রস্তর মূর্তির ন্যায় ক্রিসক্রিংগল বসে আছে। সিয়া যেন কাঠপুতুলী। ইলহামা অ্যালিয়েভের বুকের উপর মাথা রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

আহত শরীরে নেমে দাঁড়ায় আর্নি। একপা দু’পা করে এগিয়ে যায় যন্ত্রমানবীর মতো। ওর বুক কাঁপছে অজানা আশংকায়। মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটাই প্রশ্ন,

– এরা এভাবে মেঝেতে শুয়ে আছে কেনো?

ক্রিস্তিয়ানের পা যেন চলতে চায় না। এই বুঝি দুঃস্বপ্নটা সত্যি হয়ে যায়!

আর্নি যেন এক মুহূর্তেই শরীরের সমস্ত ব্যথা বেদনা ভুলে গেছে। কয়েকপল সময় লাগিয়ে বারান্দায় পৌঁছে যায়। দেখতে পায় তিন তিনটে ফ্যাকাসে মুখশ্রী। ও অস্পষ্ট স্বরে ডাকে,

– মা।

বারকয়েক ডাকে। ওর ডাক শুনে ইনায়ার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। চোখ বুজে বসে আছেন ক্রিসক্রিংগল। তার চোখে মুখে লেপ্টে আছে অশ্রুজল। এতক্ষণে তা শুকিয়েও গেছে। সিয়া ভয়াবহ নিশ্চুপ, নির্বাক। নিজের অজান্তেই ক্রিস্তিয়ান পা বাড়ায় বারান্দার দিকে। শরীর ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে দপ করে বসে পড়ে আর্নি। সাসোলি কুরীর শরীর ঝাঁকিয়ে ডাকে,

– মা, কি হয়েছে তোমার?

ক্রিস্তিয়ান এসে আর্নির পাশে দাঁড়ায়। কালচে বর্ণ ঠোঁট আর ফ্যাকাশে তিনটে মুখশ্রী দেখে সে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়। তিনজনের ঘাড়ের পাশে দু’টো স্পষ্ট দাঁতের চিহ্ন দেখতে পায়। যেখানে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। থরথরিয়ে কেঁপে উঠে ক্রিস্তিয়ানের সর্বাঙ্গ। হৃদপিণ্ডের মাঝে যেন কেউ নিষ্ঠুরভাবে লোহার পেরেক ঠুকে দিয়ে হাতুরি পেটাচ্ছে। আর্নির গলা কাঁপতে শুরু করে। দু’চোখের কার্নিশ বেয়ে অবাধ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে। আকুল হয়ে শব্দ করে কাঁদে। স্তব্ধ হয়ে থাকা সিয়ার দু’হাত আঁকড়ে ধরে বলে,

– সবাই এভাবে মেঝেতে শুয়ে আছে কেনো? আমার ডাকে মা সাড়া দিচ্ছে না কেনো?

সিয়া নড়চড় করে না। কোনো উত্তর দেয় না। যেন কিছুই শুনতে পায়নি ও। ইনায়া ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।

– ইনায়া। তুমি অন্তত বলো ওদের কি হয়েছে?

ইনায়ার গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না। এখনো যেন কোনো দুঃস্বপ্নের মাঝে আছে। ঘুম ভেঙ্গে গেলে সবকিছুই আগের মত ঠিক হয়ে যাবে। কারো কাছে উত্তর না পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে আর্নি। উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে,

– কেউ কোনো উত্তর দিচ্ছো না কেনো?

– ওরা কেউ বেঁচে নেই। সবাই ম’রে গেছে। মে’রে ফেলেছে ঐ র’ক্তপি’পাসুগুলো।____নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলে উঠে সিয়া।

ক্রিস্তিয়ানের দু’চোখ থেকে অঝোর ধারায় নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। মৃত্যু পথযাত্রীর মতো হা করে শ্বাস টানতে শুরু করে। এই বুঝি নিঃশ্বাস থমকে যায় চিরতরে। দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। সবকিছুই কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয় তার কাছে। মস্তিস্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আর্নি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন এই অপ্রিয়, অপ্রত্যাশিত বিষাক্ত সত্যি মেনে নিতে চায় না ও। সবকিছু মিথ্যে। সবটাই দুঃস্বপ্ন। কোনোকিছু সত্যি না। সত্যি হতে পারে না।

– তুই মজা করছিস তাইনা? নতুবা এটা দুঃস্বপ্ন। মা ম’রে যেতে পারে না। আমি বিশ্বাস করিনা তোর কথা। বাবা কোথায়? বাবা?

আর্নির বিচলিত চঞ্চল চোখজোড়া অস্থির হয়ে স্ট্রিকল্যান্ড কুরীকে খোঁজে। ইনায়া হাত দিয়ে একটা কামরার দিকে উদ্দ্যেশ করে, ব্যথাতুর করুন কন্ঠে বলে,

– তিনি জীবিত। তার পরম সৌভাগ্য। ঈশ্বর তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। স্নায়ু দূর্বল। ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছেন।

কথাটা বলতে না বলতেই ঢুলুঢুলু দূর্বল শরীরে আধবোজা চোখে স্ট্রিকল্যান্ড কুরী কামরার দরজায় এসে দাঁড়ান। একহাতে দরজা ধরে আছেন। যেন বহু কষ্টে নিজেকে দু’পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষীণস্বরে ডাকেন,

– সাসোলি।

ক্রিস্তিয়ান ছুটে গিয়ে দু’হাতে আগলে নেয় তাকে। আর্নি অসহায় কাতর দৃষ্টিতে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে।

বাড়ির পেছন দিকে বিশালাকৃতির কাঠের খোঁয়াড়ের দরজাটা আট করে খোলা রাখা ছিল। ক্রিসক্রিংগলের পোষা কুকুরগুলো সব মৃ’ত। খামার থেকে মেষ আর ভেড়ারগুলোর কোনো সাড়াশব্দ শোনা যায় না। র’ক্তপিপাসুগুলো বাড়ির একটা প্রাণীকেও জীবিত রেখে যায়নি। অথচ কিচ! এখন পর্যন্ত কেউ কিচের খোঁজ নেয়নি।

_______★★_______

ওডেসা, দুভিল কোট।

শৌখিন চিত্তের একজন ভ্যাম্পায়ার আব্রাহাম। ফুল ভীষণ ভালবাসে সে। তাই সুবিশাল দুর্গের সাথে লাগোয়া বারান্দায় বিস্তৃত বাগান গড়ে তুলেছে। বাগানের চারপাশটা ছিল সাদা কালো পাথরের মজবুত গোলাকৃতির পিলার দিয়ে ঘেরা। মাথার উপরে দানবীয় ছাদ। বহু বছরের প্রাচীন দেয়ালগুলো এখনো ঝকঝকে পরিষ্কার। বিন্দুমাত্র দাগ লাগতে দেয়না। বাগানের সঠিক পরিচর্যায় কতগুলো মালি রেখেছে। পিলার আর সাদা রঙের পাথুরে দেয়ালগুলোতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে গোলাপী রঙের বোগেনভিলিয়া(Bougainvillea) ফুলের সমাহার। কতগুলো বেতের ঝুড়িতে দুলছে ফিলোডেনড্রন, জ্যাকসন অ্যান্ড পার্কিন্স রোজ।

বাগান করা আর ফুলের প্রতি দূর্বলতা ছাড়াও বেশ কিছু অদ্ভুত অনুভূতির জন্য আব্রাহাম মনে করে, কোনো এক সময় হয়তো সে মানুষ ছিলো। তাই তার বুকের অভ্যন্তরে থাকা হৃদপিণ্ডটা এখনো সম্পূর্ণ পি’শাচ হৃদয়ে রুপান্তরিত হয়নি। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এদুয়ার্দো তার সহোদর ভাই নয়। কারন ওভারলর্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন সত্যিকার অর্থেই একজন রক্তচোষা পি’শাচ। বিন্দুমাত্র মায়া দয়া নেই তার মনে। আর না আছে কোনো করুণা বা অনুভূতি। তবে ইজাবেলকে নিজের সহোদর আপন বোন বলেই মনে হয় আব্রাহামের। দেখলেই কেমন বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করে। সবসময়ই নিজের কাছে, নিজের সাথে রাখতে ইচ্ছে করে।

ইজাবেলের প্রতি যেমন টান অনুভব হয়, অন্যান্য বোনদের প্রতি তেমন টান অনুভব করে না আব্রাহাম। হয়তো তারা বয়সে বড় বলে। বয়সে বড় বলে? আদৌও কি এটা কোনো যুক্তি হতে পারে? উত্তর খুঁজে না পেয়ে আব্রাহাম বোকা বোকা হাসে। ছোট বোনকে সাথে রাখা নিয়ে ইতোমধ্যে কম ঝগড়া হয়নি দুই ভাইয়ের মাঝে। কিন্তু অষ্টাদশী ইজাবেল এদুয়ার্দো অন্ত প্রাণ। কে জানে সে কি এমন মুগ্ধতা খুঁজে পায় বড় ভাই এদুয়ার্দোর মাঝে। এ নিয়ে প্রায়ই আব্রাহামের মন খারাপ হয়।

বাগানের মাঝখানে সাদা রঙের গোলাকার টেবিলের উপর পিস লিলি ফুলের টব। একটি রেড ওয়াইনের বোতল, দু’টো ক্রিস্টাল গ্লাস আর বেতের ঝুড়িভর্তি কতগুলো শুভ্র সতেজ ফুল। টেবিলের দু’পাশে দু’টো চেয়ার।

বাগানের বামদিকে কোমর পর্যন্ত উঁচু করে বানানো প্রাচীর। প্রাচীরের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালে পিলে চমকে যায়। গভীর সুরঙ্গের নিচে নীল জলের সুবিশাল সমুদ্র দৃষ্টিগোচর হয়। প্রাচীরের সামনে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে আব্রাহাম। তার দু’চোখের দৃষ্টি সমুদ্রের স্বচ্ছ নীলাভ জলের দিকে স্থির। কর্ণকুহরে বেজে উঠে ইনায়ার তেজী গলার কঠিন কন্ঠস্বর। আব্রাহাম আনমনে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসে। চোখের পলক ফেলে বিরবিরিয়ে বলে,

– ইনায়া ইবতিসাম।

– ইনায়া কে?

পেছন থেকে কারো কন্ঠস্বর ভেসে আসে। আব্রাহাম সম্বিত ফিরে পায়। পেছন ফিরে দেখে হ্যারিয়েট দাঁড়িয়ে আছে। হালকা সোনালী রঙের শর্ট গাউন পরেছে সে। চুলগুলো পনিটেল করে বাঁধা।

– ওহ হ্যারিয়েট। তুমি এখানে? এই ভোরবেলায়?

হ্যারিয়েট চেয়ার টেনে টেবিলের সামনে বসে। ওয়াইনের বোতল তুলে নেয় হাতে। ছিপি খুলে গ্লাস পরিপূর্ণ করে। নাকের কাছে গ্লাস ধরে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বলে,

– রক্তটা সতেজ। দেখে বেশ ভালো লাগছে।

আব্রাহাম দ্রুতপায়ে টেবিলের কাছে চলে আসে। ভ্রু কুঞ্চিত করে হ্যারিয়েটের দিকে তাকায়।

– বসো। তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিলো। এমনিতে তোমার দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু ভোরবেলা তুমি এখানেই থাকবে সেটা বেশ ভালো করেই জানতাম।

অন্য চেয়ারটাতে বসে পড়ল আব্রাহাম। মনোযোগী শ্রোতার মতো অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইল হ্যারিয়েটের দিকে।

– প্রথমে বলো, ইনায়া কে?

– কেউ না। তুমি কি গরম কফি খাবে?

কিঞ্চিৎ নাক সিঁটকায় হ্যারিয়েট। মুখ বিকৃত করে বলে,

– ওসব তুমিই খাও। আমি খেতে পারিনা।

– হ্যাঁ। এটাই তো প্রশ্ন। আমি খেতে পারি। ম্যাক্সিমিলিয়ান, নিলসোন, ইজাবেল আরও অনেকে খেতে পারে। এমনকি অনারেবল ওভারলর্ডও খেতে পারে। তোমরা কেনো খেতে পারো না আমি ঠিক বুঝি না। আমার কি মনে হয় জানো? আমরা মানুষ থেকে রুপান্তরিত হওয়া রক্তপিপাসু। তাই আমরা অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার বা হালকা খাবারও খেতে পারি। মাঝে মাঝেই আমার মনে একটা প্রশ্নের উদয় হয়।

– কি প্রশ্ন?__সরু চোখে তাকিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করে হ্যারিয়েট।

– আমরা সবাই কি একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান?

– বাজে বকো না। আমরা সবাই একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান। সহোদর ভাই বোন। জন্মসূত্রে ভ্যাম্পায়ার। তোমরা মানুষের সাথে চলা ফেরা, উঠা বসা করো তাই ওদের কিছু কিছু খাবার খেতে পারো। দ্যাট’স ইট। এর বাইরে কিছুনা।____রাগমিশ্রিত কন্ঠে কথাগুলো বলে হ্যারিয়েট।

– আরেহ! রেগে যাচ্ছো কেনো? আমিতো মজা করছিলাম। ছাড়ো এসব। তোমার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলো।

আব্রাহাম চেয়েছিলো ইনায়ার বিষয়টা এড়িয়ে যেতে। তাই এমন উদ্ভট বিষয়ে কথা তুলে সে। অবশ্য সফলও হয়েছে। হ্যারিয়েট ইনায়ার বিষয়টা বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোনিবেশ করে।

– গতকাল মা তোমাকে একটা পত্র পাঠিয়েছিলেন। তুমি দুর্গে ছিলে না। তাই সেটা আমি গ্রহন করেছিলাম।

– কি লেখা ছিলো?

– তোমাকে এক দু’দিনের মধ্যেই স্লোভাকিয়ায় ফিরে যেতে বলেছেন।

আব্রাহাম চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। দু’হাত ঘাড়ের পেছনে বেঁধে শান্ত কন্ঠে বলে,

– কিন্তু আমিতো যাচ্ছিনা।

– এটা মায়ের আদেশ। অমান্য করলে ওভারলর্ডের রোষানল থেকে মা’ও তোমাকে বাঁচাতে পারবেন না।

– আমি আমার মৃত্যু নিয়ে ভাবিনা। তুমিও ভেবো না। পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে স্বাধীনভাবে ম’রে যাওয়া ভালো।

– তোমার এই স্বাধীনচেতা মনোভাব বদলাও। দিন দিন অপদার্থ হয়ে যাচ্ছো। সবাই মনে করে তুমি একটা ভ্যাম্পায়ার নামের কলঙ্ক।

কথাটা শুনে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয় আব্রাহাম। খুব সহজে রেগে যায় না সে। কিন্তু যখন রেগে যায় তখন ভয়াবহ হিংস্রাত্মক হয়ে উঠে। এতক্ষণ হ্যারিয়েটের জায়গায় অন্য কেউ হলে আব্রাহামের পায়ের কাছে তার মৃতদেহ পড়ে থাকতো। নেহাত বড় বোন। তাই নিজেকে সংযত করে নিল। ক্রোধিত কন্ঠে বলল,

– আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাও।

হ্যারিয়েট প্রচন্ড অপমানবোধ করে। আঙ্গুল উঁচিয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। ক্রোধের আধিক্যে তার গলা কম্পিত হয়। হাতে থাকা ক্রিস্টাল গ্লাসটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দ্রুতপায়ে বাগান থেকে বেরিয়ে যায়। আব্রাহাম ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

_______★★________

কাস্ত্রোরুজ থর্প।

সিয়াদের বাড়িতে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। জায়গায় জায়গায় ছোট বড় বাচ্চা আর নারী পুরুষের ভীড়। প্রত্যেকের মুখে আতংকের রেশ। কেউ কেউ হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অভিশাপ নেমে এসেছে উইজার্ড পরিবারে। কে জানে এই অভিশাপ আরো কতজন মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিবে।

মাদুরের উপর শায়িত তিন তিনটে মৃ’তলাশ। ক্রিস্তিয়ান আর ক্রিসক্রিংগল কফিনের ব্যবস্থা করতে গেছেন। সাথে করে কিছু সাহায্যকারী লোক নিয়ে আসতে হবে। এখানে তাদের সাহায্য করার মতো কেউ নেই। নিজেরাই নিজেদের জন্য। বাকিরা শুধু উপরে উপরে দুঃখ প্রকাশ করতে জানে। কিন্তু ভেতরে ভয়ে জর্জরিত। কোনো সাধারণ মৃত্যু নয়। রক্তপিপাসুদের দ্বারা অস্বাভাবিক মৃত্যু। কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। ভয় পায়। যদি এই মৃতদেহগুলো তাদের জীবনেও অভিশাপ বয়ে আনে? অথচ সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কারো কারো মনে হয়, এই বুঝি মৃতলাশগুলো জীবিত হয়ে উঠবে।

স্ট্রিকল্যান্ড কুরীর অত্যাধিক শরীর দূর্বল। দু’পা হাঁটার শক্তিটুকুও নেই। সোফার উপর আধশোয়া হয়ে বসে থেকে মৃত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে চোখের অশ্রু ঝরিয়ে যাচ্ছেন। আপাতত এতটুকুই তার সাধ্য। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। হঠাৎই তার মনে হয় তিনি কেনো বেঁচে আছেন? সাসোলির সাথে ম’রে গেলেই ভালো হতো। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মন বলে, ছেলে মেয়ে দুটোর জন্য হলেও বাঁচতে হবে তাকে। সিয়া যেন অবিকল পাথরের মতো। ইনায়া আর আর্নি এখনো গুনগুনিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না বিধায় কান্নার শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসে। এরই মাঝে কয়েক জন লোক সাথে নিয়ে ক্রিস্তিয়ান আর ক্রিসক্রিংগল ফিরে আসেন। ভীড়ের মাঝখান থেকে একজন লোক বলে উঠেন,

– এই অভিশপ্ত মৃতদেহগুলো দ্রুত সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করুন। গোসল করানো বা যাবতীয় নিয়ম পালন করার কি দরকার? বরং লাশগুলো আগুনে জ্বালিয়ে দিন। সেটাই ভালো হবে।

ক্রিস্তিয়ানের মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠে। তেড়ে যায় লোকটার দিকে। ক্রিসক্রিংগল দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করে নেন। নিজের একহাতে ক্রিস্তিয়ানের একহাত মুঠোবন্দি করে ধরেন। মানুষগুলো কতটা অকৃতজ্ঞ। বরং তার চেয়েও বেশি নিষ্ঠুর। সহসা সিয়া দাঁড়িয়ে পড়ে। দৌড়ে যায় বারান্দার দিকে। বাকিরা বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সিয়া সোফার নিচ থেকে নিজের তলোয়ার বের করে আনে। সশব্দে তলোয়ারের খাপ খুলে ফেলে। সমবেত মানুষগুলো ভড়কে যায়। মেয়েটা কি করতে চাইছে? সিয়া ক্রুদ্ধ কন্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠে বলে,

– এই মুহূর্তে সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। কোনো একটা মানুষকে যেন বাড়ির আশে পাশেও না দেখা যায়। মজা পেয়েছেন আপনারা? মজা? সাহায্যের বদলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন আর বাজে বাজে মন্তব্য করছেন? আপনারা তো ঐ পিশাচগুলোর থেকেও ভয়ংকর। অকৃতজ্ঞ, অপদার্থ। বিন্দুমাত্র মায়া দয়া নেই আপনাদের মনে। আর না আছে কোনো সহানুভূতি। আমি ভয়ংকর কোনো কান্ড ঘটিয়ে ফেলার আগে এই বাড়ি থেকে বিদেয় হন এখুনি।

কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সম্পূর্ণ বাড়ি খালি হয়ে যায়। পুনরায় নিস্তব্ধতা নেমে আসে। মানুষগুলো চলে যাওয়ার সময় সিয়াকে বিরবিরিয়ে গালিগালাজ করে। সিয়া দপ করে মাটিতে বসে পড়ে। ইলহামার মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে ঠোঁট, গাল আর নাক ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। পুনরায় সিয়ার চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সিয়া কাঁদে। চুমু খায় ইলহামার কপালে আর দু’গালে। ক্রন্দনরত কম্পিত কন্ঠস্বরে বলে,

– মা, আপনি কি সত্যিই চিরকালের জন্য চলে যাচ্ছেন আমাদের ছেড়ে?

ইলহামার ফ্যাকাশে মুখখানা আরও ফ্যাকাশে হয়ে আছে। চোখ বুজে থাকা ইলহামার থেকে কোনো প্রত্ত্যুতর আসে না। সিয়া ভীষন অসহায় বোধ করে। ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে অসহনীয় যন্ত্রণা।

– ওরা আমার জীবন থেকে আপনাকে কেড়ে নিলো। আমি আপনার মায়া, মমতা, আদর, ভালবাসা আর স্নেহের ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। আপনি আর কখনো আমার ডাকে সাড়া দিবেন না। আমাকে সিয়া বলে ডেকে বুকে জড়িয়ে নিবেন না। আমি এই দুর্দমনীয় যন্ত্রণা কিভাবে সহ্য করবো? আমি আর কখনো আপনাকে দেখতে পাবোনা মা। এই অকল্পনীয় সত্যি আমি কিভাবে মেনে নিবো? বলুন মা। উত্তর দিন।

মা, ওরা কি করে পারলো সন্তানের থেকে তার মাকে ছিনিয়ে নিতে? ওদের কি মা-বাবা নেই? ওরা কি বুঝেনা মা না থাকার ব্যথা বেদনা?

কয়েকপল সময় গড়ায়। সিয়া কতশত কথা বলে নিজের মায়ের সাথে। ওর কতশত অভিযোগ। কিন্তু ইলহামা নিরুত্তর। ইনায়া শব্দ করে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ওর গলা বসে গেছে। চোখের জল শুকিয়ে এসেছে প্রায়। আর কত কাঁদলে নিজের মাকে জীবিত ফিরে যাওয়া যাবে? জীবনের বিনিময়েও যদি মৃত মানুষের দেহে পুনরায় প্রাণ ফিরিয়ে আনা যেতো তাহলে অবলীলায় নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দিতো ইনায়া। ইনায়া ভাবে। ভাবতে ভাবতেই ফের কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

আর্নি ফোলা ফোলা কান্না ভেঁজা চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে নিজের মায়ের মৃতলাশটার দিকে। ক্রিস্তিয়ান তীব্র শ্বাসকষ্ট অনুভব করে। তার যন্ত্রণার পরিমান যেন দ্বিগুন। ক্রিসক্রিংগল সিয়ার পাশে গিয়ে বসেন। কাঁপা কাঁপা হাতে সিয়ার কাঁধ স্পর্শ করেন। সিয়া রক্তচক্ষু মেলে তাকায়। অকস্মাৎ হিংস্র হয়ে উঠে। ক্রিসক্রিংগলের মুখের দিকে তাকিয়ে আক্রোশপ্রসূত কন্ঠস্বরে বলে,

– যারা আমার সব প্রিয়জনগুলোকে মে’রে ফেললো, আমি তাদের কাউকে ছাড়বো না বাবা। কাউকে না।

ক্রিসক্রিংগল কান্না আঁটকাতে দু’চোখের পাপড়ি বুজে নিলেন। সিয়া তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইলহামার দিকে তাকালো। ইলহামার একহাত নিজের দু’হাতের মাঝখানে নিয়ে শক্ত করে ধরল। ওর গাঢ় বাদামী চোখজোড়া থেকে ক্রোধের আগুন ঝরে পড়ল। ও দৃঢ় গলায় ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

আমি ফ্লোরেনসিয়া,

প্রতিজ্ঞা করছি, আমি হবো শীতল বরফের মতো কঠিন। ইস্পাতের মতো দৃঢ়। আমার দু’চোখ থেকে আর কখনো একফোঁটা অশ্রু গড়াবে না। ভয়কে জয় করে সমস্ত শত্রুদের বি’নাশ করবো। পৃথিবীর কোনো অশুভ শক্তি আমার প্রিয়জনদের আঘাত করার সুযোগ পাবো না। শক্তিশালী দুর্ভেদ্য ঢাল হয়ে আমি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবো।

এই আকাশ, বাতাস, পাহাড় পর্বত আর সমগ্র পৃথিবীকে স্বাক্ষী রেখে বলছি, আমি ফ্লোরেনসিয়া। আমি ঐ অসভ্য, বর্বর, নৃশংস নরপি’শাচগুলোর বিনাশক হবো। আমি হয়ে উঠবো প্রলয়ঙ্কারী ঝড়। সূর্যের ন্যায় প্রখর তেজস্বী। শত বাধা-বিপত্তি আর দুর্জ্ঞেয় রাস্তা পাড়ি দিয়ে নিজ হাতে সবগুলো শ’য়তানের মাথা কা’ট’বো। ওদের মৃ’ত্যু হবে ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর।

আমি ফ্লোরেনসিয়া, ঈশ্বরের নামে প্রতিজ্ঞা করে বলছি। এক এক করে প্রত্যেকটা ন’রপিশাচকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে জ্বালিয়ে মা’রবো। ওদের জীবনে ভয়াবহ ধ্বংস বয়ে আনবো। ইউক্রেনের মাটি থেকে সব জানোয়ারগুলোকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিবো। নরকে পাঠাবো ওদের, নরকে।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।