ফ্লোরেনসিয়া – ৪৫

18 Min Read

খারকিভ, ওয়াভেল কোট।

অচেতন অবস্থায় বিছানায় কাত হয়ে পড়ে ছিলো সিয়া। কতক্ষণ সময় গড়িয়ে গেছে কে জানে। সহসা চোখ পিট পিট করে তাকায় ও। ওর হাত দু’টো পেছনে শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা। মুখটাও কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছে ওরা। সুদীর্ঘ বাদামী চুলগুলো বিছানার উপর অবিন্যস্ত হয়ে ছড়ানো ছিটানো ছিলো। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাতেই মুখ আর হাত দু’টো বাঁধা অবস্থায় পেল। সিয়া চমকাল। খানিকটা হতবাক হলো। একাডেমিতে ছিলো, হঠাৎ করে এ কোথায় এসে পৌঁছালো? ওকে এভাবে বেঁধেই বা রেখেছে কে? নিজের অজ্ঞাতেই ওর ভয়াবহ গলা শুকিয়ে গেলো।

সিয়া সামনের দিকে তাকাল। প্রথমেই ওর চোখ পড়লো এদুয়ার্দোর বিশালাকৃতির তৈলচিত্রের দিকে। কালো রঙের লেদার জ্যাকেট গায়ে। কালো প্যান্টের সাথে কালো রঙের বুট জুতো পরেছিলো সে। সিয়া তৈলচিত্রের নিচের দিক থেকে আস্তে আস্তে উপরের দিকে তাকাল। মুহূর্তেই যেন ওর শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়াল আতংকের শীতল স্রোত গড়িয়ে গেল। তৈলচিত্রে থাকা এদুয়ার্দোর পিঠের পেছনে ছিলো কালো কুচকুচে দু’টো ডানা। ভয়ংকর রক্তলাল চোখ, হা করে থাকা মুখের দু’পাশে দু’টো তীক্ষ্ণ ধারালো শ্বদন্ত দেখা যাচ্ছিলো। কী ভীষণ হিংস্রতা মুখখানায়। শরীরের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে যায়। যেন তৈলচিত্র থেকে বেরিয়ে এসে এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে সিয়ার উপর। শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে খাবে ওর।

কামরার চারদিকে ছোট ছোট অসংখ্য মোমবাতি জ্বলছিলো। তবুও যেন অন্ধকার ঘুচেনি একটুও। মাথার উপরে বৃহৎ ঝাড়বাতি। মোম জ্বালানো হয়নি। রঙহীন পাথুরে দেয়ালের উপর কতগুলো তৈলচিত্র টানানো ছিলো। সবগুলো ছবির ফ্রেম, লবি এমনকি সিলিংও চকচকে সোনায় মোড়ানো। কামরাটা ঝকঝকে পরিষ্কার। বেশ গোছানো। ওক কাঠের ভারী চারকোণা টেবিলটায় রঙ বেরঙের বই সাজিয়ে রাখা ছিলো। সামনে একটি চেয়ার বসানো। কামরার একপাশে রয়্যাল কিং সাইজের ডাবল বিছানা। চাদর আর বালিশগুলোও ধবধবে সাদা রঙের ছিলো ।

সিয়ার রাগ হয়। ওকে যে এদুয়ার্দোই অপহরণ করে নিয়ে এসেছে এখানে, তা নিয়ে সিয়ার মনে কোনো সংশয় থাকে না। সিয়া মনে মনে স্পেল আওড়ায়। দু’হাতের বাঁধন খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্ত অসফল হয়। হাত নাড়ানোর ক্ষমতা নেই, ইশারা করবে কিভাবে? সিয়ার নতুন অভিজ্ঞতা হয়। অর্থাৎ ও বুঝতে পারে শুধু স্পেল পড়লেই হবে না। মুখ দিয়ে স্পেল আওড়ানোর সাথে হাত দিয়ে ইশারা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

পায়ে জুতো নেই। জুতো খোলার কাজটাও কি এদুয়ার্দো করেছিলো? ভাবতেই ওর মুখখানা কেমন আত্ম অহমিকায় ভরে উঠলো। লোমহীন ধবধবে ফর্সা পা দু’টো তুলে বিছানার উপর বসার চেষ্টা করলো। পরিধেয় শর্ট গাউন হাঁটুর বেশ খানিকটা উপরে উঠে যাওয়ায় শর্টস নজরে আসে ওর। উন্মুক্ত ঊরুর অর্ধেকাংশ দেখা যাচ্ছিলো। সিয়া তীব্র লজ্জায় মিইয়ে গেলো। পরমুহূর্তেই ঘৃণা হলো। শ’য়তানটা ওকে এই অবস্থায় দেখে ফেলেনি তো?

সিয়া ধীরে ধীরে উঠে বসে। কামরার চারদিকে আরও একবার নজর বুলিয়ে নেয়। মোচড়ামুচড়ি করে হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করে। পালাতে হবে এখান থেকে। এদুয়ার্দোর নিশ্চয়ই কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্য কিছুতেই পূরণ হতে দিবে না সিয়া। সহসা নব ঘোরানোর শব্দ শুনতে পায় ও। দরজা খুলে কেউ একজন কামরায় প্রবেশ করে। সিয়া চকিতে তাকাল দরজার দিকে। একজন ভদ্রমহোদয়া খাবারের ট্রলি ঠেলে এগিয়ে যান বিছানার কাছে। সিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখে।মহোদয়ার মুখখানা অত্যাধিক ফ্যাকাশে। সাদামাটা লম্বা গাউন পরনে, মাথার চুলগুলো একপাশে খোঁপা বেঁধে রেখেছিলো সে। বিছানার পাশে ট্রলি রেখে পায়ে পায়ে সিয়ার দিকে এগিয়ে যান তিনি। নিষ্প্রাণ কন্ঠে সিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন,,,,

– দেখো মেয়ে। আমি তোমার হাত আর মুখের বাঁধন খুলে দিচ্ছি। শান্ত বেড়ালের মতো খাবার খেয়ে নিবে। কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করবে না। করেও লাভ নেই, পালাতে পারবে না। বরঞ্চ অনারেবল ওভারলর্ড জানতে পারলে তোমার সাথে আমাকেও শাস্তি পেতে হবে।

সিয়া নড়চড় না করে স্থির হয়ে ঠায় বসে থাকে। চেয়েও কথা বলতে পারে না ও। মহোদয়া ওর মুখের বাঁধন খুলে দিতেই শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,

– আপনি কে? আপনিও কি এদুয়ার্দোর মতো র’ক্তপিপাসু?

মহোদয়া বোধহয় রেগে গেলেন। সিয়ার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,,,,

– তুমি মহারাজের নাম ধরে ডাকছো? তিনি জানতে পারলে তোমার মৃ’ত্যুদন্ড দিবেন।

– তাকে পাঠিয়ে দিন আমার কাছে। আমিও দেখতে চাই সে কিভাবে আমাকে মৃ’ত্যুদন্ড দেয়।____রাগান্বিত কন্ঠে উচ্চস্বরে কথাটা বলে উঠে সিয়া। তরতরিয়ে ওর রাগ বেড়ে যায়। নিজের জন্য নয়। ইনায়ার জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তা হয়। কে জানে ও কেমন আছে।

ত্বরিত বিছানা থেকে নেমে দাড়ায় সিয়া। থমথমে পায়ে কামরায় প্রবেশ করে এদুয়ার্দো। সিয়ার গা জ্বলে যায়। এদুয়ার্দোর গলা চেপে ধরতে ইচ্ছে করে ওর। মহোদয়া দু’পা ভাঁজ করে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানিয়ে বলেন,,,,

– অনারেবল ওভারলর্ড।

– আপনি যান।____এদুয়ার্দো থমথমে ভরাট কন্ঠে বলে। তার হাতে ছোট খাটো রক্তের গ্লাস। মহোদয়া কয়েক পা পিছিয়ে পুনরায় তাকে সম্মান জানায়। অতঃপর ধীরপায়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়। এদুয়ার্দো গ্লাসে ঠোঁট ছুঁইয়ে রক্ত পান করে। সিয়া রাগমিশ্রিত কন্ঠস্বরে বলে,,

– তুমি এতটাই নির্লজ্জ! আমাকে অপহরণ করে নিজের বেডরুমে নিয়ে এসেছ?

এদুয়ার্দোর ঠোঁটের ভাঁজে রক্ত লেগে আছে। সে নেত্রপল্লব বুজে ঠোঁটের রক্তটুকু জিহ্বা দিয়ে চেটে নেয়। যেন রক্ত নয়, অমৃতের আস্বাদন গ্রহন করছে। সিয়ার গা গুলিয়ে উঠে। পেটের ভেতর থেকে সবকিছু যেন উগরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রচন্ড ঘৃণায় দু’চোখ বন্ধ করে ফেললো। অস্পষ্ট স্বরে বললো,,,

-ছিঃ!

এদুয়ার্দো কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সিয়া ক্রুদ্ধ কন্ঠে রাগের বহিঃপ্রকাশ করে বললো,,,

– আমাকে কি সস্তা মেয়ে মানুষ বলে মনে হয়? নাকি কোনো কাঠের পুতুল? তোমার ঐ অপবিত্র হাতে আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহস কিভাবে পাও?

এদুয়ার্দো কোনো প্রত্যুত্তর দেয় না। টেবিলের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বুকের কাছে দু’হাত বেঁধে দাড়ায়। সিয়ার রাগান্বিত মুখখানা শান্ত চোখে দেখে। ওর ঔদ্ধত্য দেখে মনে মনে ক্রোধিত হয় সে। কিন্তু বাইরে থেকে তা বুঝতে দেয় না। আব্রাহামের সাথে ইনায়া যা করেছিলো, তার শাস্তি হিসাবে সিয়াকে তুলে আনার পরিকল্পনা এদুয়ার্দো আগেই করে রেখেছিলো। সিয়াকে নিজের কাছে আটকে রেখে ইনায়াকে ভোগাতে চেয়েছিলো। কিন্তু পরে যখন জানতে পারে, দোষ আব্রাহামের ছিলো। এদুয়ার্দোর মত পরিবর্তন হয়। আজ নেহাতই ভিন্ন এক লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে পূর্ব পরিকল্পনা অনুয়ায়ী সিয়াকে তুলে আনে সে।

-এদুয়ার্দো!!____সিয়া বজ্রধ্বনি তুলে ডাকে।

– মহামান্য মহারাজ বলো।_____এদুয়ার্দো হিংস্রাত্মক শীতল কন্ঠে বলে।

– তোমাকে মহারাজ ডাকবে তোমার পা চাটা জা’নোয়ারগুলো। আমি ভাঙ্গবো কিন্তু মচকাবো না। দেখি তুমি কি করতে পারো। আমাকে যেতে দাও। আমি ছাড়া আমার বোনকে দেখার মতো কেউ নেই। ওর নিরাপত্তা রক্ষায় অন্যকাউকে ভরসা করিনা । যদি ইনায়ার সামান্যতম ক্ষতি হয়৷ তোমার জীবনে সর্বনাশ বয়ে আনবো। ধ্বংস হবে তুমি,, ধ্বংস।

– তুমি ধ্বংস করবে আমাকে? ___এদুয়ার্দো ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে।

– হ্যাঁ।____ সিয়া দৃঢ়কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়।

– নির্বোধ। আমার বি’নাশ নেই। তাছাড়া তোমার মতো একটা দুর্বল চিত্তের সাধারণ মেয়ে আমার কিছুই করতে পারবেনা।

– সাধারণ! অথচ এই সাধারণ মেয়েটাকে মে’রে ফেলার জন্য কাস্ত্রোরুজ থর্পে গতকাল রাতে জোসোফাইনসহ নিজের আরও কিছু চা’মচা পাঠিয়েছিলে। নিকৃষ্ট কিছু বাদুড়কে দিয়ে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিলে। যখন ওরা আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তুলে আনতে ব্যর্থ হলো, তখন তুমি নিজে আমাকে ছলনার আশ্রয় নিয়ে এখানে তুলে আনলে। কেনো? আমাকে ভয় পাও? এই সাধারণ মেয়েটাকে নিয়ে তোমার এতো কিসের ভয়?

এদুয়ার্দো বিস্মিত হয়। সিয়া জোসেফাইনের নাম কিভাবে জানে? সেদিন তার মায়ের সাথে জোসেফাইন ছিলেন না। তাহলে কি সিয়া অন্য কোনো ভাবে জোসেফাইনকে চিনে?

এদুয়ার্দোর নির্দেশে সেদিন বনিফেসিও পাহাড়ের গুহায় সিয়ার উপর কতগুলো বাদুড় আক্রমণ করেছিলো। ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলো সিয়ার মুখশ্রী আর দেহ। এদুয়ার্দোর কাছে মনে হয়েছিলো এই দাগগুলো যেন চাঁদের গায়ে লাগা অসংখ্য কলঙ্কের মতো। করুনা হয়েছিলো? নাকি মায়া? র’ক্তচোষা পিশাচদের মায়া হয়? সে যাই হোক। অতশত ভাবেনি এদুয়ার্দো। নিজের শক্তি ব্যবহার করে চেতনাহীন সিয়ার ক্ষতবিক্ষত দেহ সম্পূর্ণ সারিয়ে তুলেছিলো। অথচ সিয়া জানতে পারেনি সেই ক্ষতগুলো কিভাবে সেরে গিয়েছিলো। ভাবেনি একবারও। ডিয়েটসকে তুলে নিয়ে যাওয়ার শোকে কোনো কিছু ভাবার মতো পরিস্থিতি ছিলো না তখন।

– তোমার জন্য বিষয়টা খুবই লজ্জাজনক। আমার পেছনে একপাল কুকুরের মতো নিজের ভ্যাম্পায়ার সেনা লেলিয়ে দিয়েছ।____সিয়ার বিদ্রুপাত্মক কন্ঠ।

– আমাকে বোকা পেয়েছ! গতকাল রাতে যদি তোমাকে সত্যিই কোনো বাদুড় আক্রমণ করে থাকে, তাহলে তোমার শরীরে কোনো ক্ষত চিহ্ন নেই কেনো? নির্বোধ। তুমি যা বলবে, আমি তাই বিশ্বাস করবো? সত্যি করে বলো, তুমি জোসেফাইনকে কিভাবে চিনো?

গতকাল রাতে বাদুড়গুলোর দ্বারা হওয়া আঘাতের চিহ্ন নিয়ে সিয়া বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো। বাড়ির সবাই ওর ক্ষতগুলো নিয়ে প্রশ্ন করবে ভেবে, থ্যাসোর গলা জড়িয়ে ধরে ওর কাছে নিজের সমস্যার কথা জানিয়েছিলো। সহসা সিয়াকে হতবাক করে দিয়ে থ্যাসোর শরীর থেকে একধরনের অদ্ভুত আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়েছিলো। যা সিয়ার শরীরে আছড়ে পড়তেই ওর সমস্ত ক্ষত পুরোপুরি মিলিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সেকথা সিয়া এদুয়ার্দোকে কেনো বলবে? কোনো যেচে বিপদ ডেকে আনবে? স্বইচ্ছায় থ্যাসোর কথা ও কাউকে বলবে না। কাউকে না৷ এদুয়ার্দোকে তো নয়ই।

সিয়া কথা ঘোরায়। রাগমিশ্রিত কন্ঠে উচ্চস্বরে বলে,,,,

– অ’সভ্য। আমার চোখের সামনে থেকে দুর হয়ে যাও।

এদুয়ার্দো তার হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর নিঃশব্দে রেখে দিলো। সোজা হয়ে দাড়িয়ে ফোল্ড করে রাখা শার্টের ভাঁজ খুলতে লাগলো। থমথমে মুখাবয়বে ভরাট কন্ঠে বললো,,,

– অসভ্যতামি দেখতে চাও?

এদুয়ার্দোর থমথমে মুখখানা নিমেষেই বদলে যায়। ঠোঁটের কোণে ছড়িয়ে পড়ে পৈশাচিক হাসি। সে ধীরে ধীরে একপা দু’পা করে এগোয়। পরিধেয় শার্টের বুকের কাছের বোতাম খুলতে শুরু করে। সিয়া ত্বরিত নেত্রচ্ছদ বুজে নেয়। যতই সাহসী হোক, সতীত্ব হারানোর ভয় ওকে কাবু করে ফেলে। কেউ ওকে বাজে ভাবে স্পর্শ করার আগে নিজের আত্মার মৃ’ত্যু কামনা করে। চেঁচানো কন্ঠে শাসানোর স্বরে বলে,,

“খবরদার! শার্ট খুলবে না বলে দিচ্ছি। লম্পট র’ক্তচোষা পি’শাচ।

“কিছু না করে চরিত্রহীন উপাধি পাওয়ার চেয়ে, কিছু করে চরিত্রহীন হওয়াই ভালো। যেহেতু তোমার কাছে আমি লম্পট, অসভ্য। আমাকে তো কিছু করতেই হবে”

এদুয়ার্দো ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। চোখের পলকে সিয়ার সামনে গিয়ে দাড়ায়। সিয়া চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। কেমন জড়োসড়ো হয়ে গেছে। সামনে থেকে খুব কাছাকাছি এদুয়ার্দোর উপস্থিতি বুঝতে পেরে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। এদুয়ার্দো ওর কানের কাছে ঝুঁকে যায়। অনুচ্চস্বরে ফিসফিসিয়ে বলে,,,

– এই শেষবারের মতো সাবধান করছি। শেষবার।

নিজের কথা শেষ করতে পারে না। অসম্ভব মোহনীয় এক ধরনের মিষ্টি মধুর রক্তের সুবাশে এদুয়ার্দো আরও ঝুঁকতে শুরু করে। তার লাল টুকটুকে ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত বেরিয়ে আসে। সিয়ার কাঁধে থাকা ক্রুশ চিহ্ন জ্বলছে। ও নিজের ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। এদুয়ার্দোর চিবুক বরাবর সজোরে আঘাত করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। এদুয়ার্দো নেই। কামরার আশে পাশে কোথায়ও নেই। দরজাটা বাইরে থেকে আঁটকে রেখে গেছে।

______

প্রাসকোভিয়া, কেইভ অব জুপিটার।

প্রাসকোভিয়ার উত্তরে উপস্থিত সবগুলো গুহার মধ্যে এই গুহাটাই ছিলো সবচেয়ে বৃহত্তম। স্বর্গীয় দেবতাদের রাজা জিউসের নাম অনুসারে মার্টিন লরেন্স এই গুহাটির নাম দিয়েছিলেন কেইভ অব জুপিটার। বেশ কয়েকটা সুরঙ্গ এই গুহাটিকে যুক্ত করেছে আরও সাতটি গুহার সঙ্গে। ঈশ্বরের আরাধনা আর নিজের সৈন্যদের মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি গুহার ভিতর পাথুরে দেয়ালগুলোতে অসংখ্য চিত্রকর্ম এঁকেছিলেন তিনি। সবগুলো চিত্রকর্মের মধ্যে ম্যামথ, গুহাবাসী সিংহ, প্যান্থার, গুহাবাসী হায়েনা, ভাল্লুক, ইউনিকর্ন, গ্রীক পুরাণ এবং প্রাচীন গ্রিসের দেবদেবীদের চিত্রকর্মগুলো ছিলো অন্যতম। অসংখ্য সাংকেতিক চিহ্ন। হয়তো এই চিহ্নগুলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে সুরঙ্গ পথ চিনে নিতে সাহায্য করে। ক্রিসক্রিংগল এরকমই কিছু একটা ভাবলেন। মার্কসের সহযোগীতায় মার্টিনের কামরার সামনে গিয়ে দাড়ালেন। মার্কস দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রইলো, তিনি কামরার ভিতরে প্রবেশ করলেন। মার্টিন লরেন্স দরজার দিকে পিঠ রেখে উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পেছনে ক্রিসক্রিংগলের উপস্থিতি টের পেয়ে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,,,

– তুমি আমাকে কার বিরুদ্ধে লড়াই করতে বলছো? আমার এদুয়ার্দো!!

ক্রিসক্রিংগল চমকালেন। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালেন। মার্টিন রাশভারী কন্ঠে বললেন,,,

– তুমি কি ভেবেছ, আমি কিছুই জানি না? আমি সব জানি। তুমি আমাকে কেনো ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছো? কোথায় ফিরে যেতে বলছো? ওয়াভেল কোটে? যেই দুর্গটা কিনা এখন এদুয়ার্দোর দখলে।

– বাবার কাছে গচ্ছিত রাখা তোমার আমানতগুলো ফিরিয়ে দিতে চাই।____ক্রিসক্রিংগল শীর্ণ কন্ঠে বলেন।

– কি হবে ওসব দিয়ে? যে পারতো সবকিছু ঠিক করে দিতে। সে নিজেই বেঁচে নেই।

ক্রিসক্রিংগল অকপটে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। তার বুক কাঁপতে শুরু করে। কথাগুলো কন্ঠনালীতে এসে আঁটকে যায়। মুহূর্তেই স্বার্থপর হয়ে উঠেন। এইটুকু স্বার্থপর কি হওয়া যায় না? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন। ক্ষণকাল নিশ্চুপ থেকে ব্যথাতুর কন্ঠে বলেন,,,,

– যে কাজটা প্রিন্সেস ক্লারেসিয়া করতে পারতো। সেটা তুমিও পারবে। অন্তত একবার চেষ্টা করে দেখো।

– তুমি খুব ভালো করেই জানো। আমি এরকম কিছুই করবো না। এদুয়ার্দোর প্রাণসংশয় আছে। মা’রা যেতে পারে ও।

– আমার একমাত্র আদরের মেয়ে। তুমি জানো? ওর বয়স কত ছিলো?

– শুনেছিলাম, ওর এক বছর পূর্ন হয়নি তখনো। কিন্তু ও অন্যসব শিশুদের চেয়ে আলাদা ছিলো বলে, দ্রুত বেড়ে উঠেছিলো।

– ভুল শুনেছ। ওর বয়স ছিলো তখন দেড় বছর। আমার আর ফোসিয়ার অনেক বছরের আরাধনার ফল। ঈশ্বরের প্রতিভাধর শিশু। সকল স্বর্গীয় দেবতাদের রাজা মহান দেবতা জিউসের দয়ায় জন্ম নিয়েছিলো ও। ক্লারেসিয়া। ও ছিলো দেবী আর্টেমিসের অংশ। বিশ বছর পূর্ণ হওয়ার পর ওর ঐশ্বরিক সত্তা জাগ্রত হওয়ার কথা ছিলো। তুমি কি জানো? আর কয়েকদিন পরই ওর বিশ বছর পূর্ণ হতো। কিন্তু ওর মৃ’ত্যু ঝুঁকি ছিলো। আমি ভেবেছিলাম ঈশ্বর ওকে বাঁচিয়ে রাখবেন। মৃ’ত্যু ঝুঁকি কাটিয়ে ও বাঁচবে। পুনরায় ওর দ্বারা ইউক্রেন পি’শাচ মুক্ত হবে। কিন্তু আমার ভাবনা মিথ্যা ছিলো। সত্যিতো এটাই আমার ক্লারেসিয়া আর বেঁচে নেই।

ক্রিসক্রিংগল নিজের মনকে শক্ত করে নেন। সিয়াকে বাঁচাতে হলে মার্টিন লরেন্সকে প্রয়োজন।

– ওর চোখ জুড়ে ছিলো অপার সৌন্দর্য। কতশত বিস্ময়। ও যখন হেসে উঠতো আমার কাছে তখন পৃথিবীটাকেই স্বর্গ মনে হতো। আমি এখনো ওর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি এই আশায়, যদি ও পুনর্জন্ম নেয়। তখন আমাকে ওর প্রয়োজন।

– ক্লারেসিয়া বেঁচে আছে। ওর তোমাকে প্রয়োজন। আমার সাথে ইম্যুভিলে ফিরে চলো।____ক্রিসক্রিংগল উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলেন।

এতক্ষণ নিজের মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে সীমাহিন যন্ত্রণায় জর্জরিত হওয়া মার্টিনের হৃদয় মুহূর্তেই ভয়াবহ কঠিন হয়ে উঠে। তিনি ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলেন,,,,,

– আমাকে ফিরিয়ে নিতে যেতে মিথ্যা বলছো? আমি আমার মেয়ের রক্তশূন্য মৃ’তদেহ দেখেছিলাম। ওর মুখখানা ছিলো ক্ষতবিক্ষত। আমি বাবা হয়েও চিনতে পারিনি ওকে। কিন্তু ওর মৃত লাশের কাঁধে থাকা ক্রুশচিহ্ন, সেটা কিভাবে ভুল হতে পারে?

কামরায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। মার্টিন অনুমতি দেন,,,,

– এসো।

কামরায় প্রবেশ করে একজন যুবক। শ্রদ্ধাভরে সম্মান জানিয়ে নির্জীব কন্ঠে বলে,,,,

– মহামান্য মাস্টার। আমাদের দলের একজন গুরুতর আহত। বাঁচবে না হয়তো। দয়া করে এখুনি আসুন আমার সাথে।

মার্টিন লরেন্স হন্তদন্ত পায়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যান। ক্রিসক্রিংগল হতভম্ব হয়ে প্রস্তর মূর্তির ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন।

________

ইম্যুভিল।

গোধুলী সন্ধ্যা। ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িটা ভয়াবহ নিস্তব্ধ। থেকে থেকে শোনা যাচ্ছিলো আর্নির ফুঁপিয়ে করা কান্নার শব্দ। বাকিদের মুখাবয়ব ফ্যাকাশে, দুশ্চিন্তা গ্রস্থ। মাদাম ল্যারির চোখ দু’টো ভেঁজা। ফ্রাঙ্গলিন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। স্ট্রিকল্যান্ড অস্থির ভঙ্গিমায় কামরা জুড়ে পায়চারি করছিলেন। ব্যতিব্যস্ত হাতে কাঠের বাক্সে থাকা জিনিসপত্রগুলো থেকে বই, তলোয়ার আর পাথরটা বের করে টেবিলের উপর রাখে ইনায়া। ওগুলো একটা লম্বা কাপড়ের ব্যাগে ভরে দরজার দিকে পা বাড়ায় ও। ফ্রাঙ্কলিন দ্বিধান্বিত কন্ঠে ইনায়াকে বলেন,,,

– আরও একবার ভেবে দেখো। আমার বিশ্বাস এদুয়ার্দো সিয়ার কোনো ক্ষতি করবে না।

ইনায়া দাড়াল। পেছন ফিরে তাকাল। ব্যথাতুর করুন কন্ঠে বললো,,,,

-দুঃখীত দাদু। ভাবার মতো কিছু নেই। আমার কাছে সিয়া সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ওর সুস্থতার কাছে বাকি সব তুচ্ছ। ওকে অক্ষত অবস্থায় বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি সবকিছু করতে পারবো।

– অধৈর্য হয়ো না ইনায়া। এদুয়ার্দো তোমাকে দু’দিন সময় দিয়েছিলো। প্রথমে এই দিনলিপিটা পড়ো। তারপর তোমার যা ভালো মনে হয়, তাই করো। আশা করি তুমি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবে না।_______কথাটা বলে ক্রিস্তিয়ান।

ইনায়া শুনতে চায় না। ওর মন কোনো প্রকার যুক্তিতর্ক মানতে চায় না। দাদু, দাদিন, মা সবাইকে হারিয়েছে ও। বাবা বাড়িতে নেই। কোথায় আছেন, কেমন অবস্থায় আছেন। কবে ফিরে আসবেন, ইনায়া সেসবের কিছুই জানেনা। ওর মন মস্তিষ্ক জুড়ে শুধুমাত্র একটাই লক্ষ্য। যেভাবেই হোক সিয়াকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।