ইট পাটকেল | পর্ব – ১০

8 Min Read

অফিসে নূরের ত্রিশ জনের টিম সহ নূর কে প্রবেশ করতে দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বিশাল বিল্ডিংয়ের আট তলায় রাফসান শিকদারের অফিস। প্রতি তলায় তাদের ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির অফিস থাকলেও আট তলায় হেড অফিস। সব কোম্পানি এখান থেকেই পরিচালনা করা হয়।নূর সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে কনফারেন্স রুমে চলে গেলো। অমি ও বাকি ত্রিশ জন নূরের সাথে কনফারেন্স রুমে গিয়ে নিজেদের জায়গায় বসে পরলো। নূর রাফসান শিকদারের চেহারের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। পাথরের চোখ ফেটে অশ্রু আজ বেরিয়ে আসতে চাইছে।চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে ফেললো নূর।এখনো অনেক পথ বাকি।এভাবে ভেঙে পরলে পরের দুর্গম পথ পাড়ি দেয়া কঠিন হয়ে পরবে।
নূর নিজের বাবার চেয়ারে বসে অমি কে উদ্দেশ্য করে বললো,
— সব ফ্লোরে প্রজেক্টের সেট করে দাও অমি। কামিনী চৌধুরী কে আগামী সাত মিনিটের মধ্যে অফিসে হাযির হতে বলো।সাথে এটা ও বলে দাও,যদি সে সময় মতো এখানে উপস্থিত হতে না পারে তাহলে পরবর্তীতে আমার সিদ্ধান্তই হবে শেষ সিদ্ধান্ত। তার কোন এক্সপ্লেইনেশন গ্রহণযোগ্য হবে না।
অমি “ইয়েস ম্যাম” বলে দ্রুত নিজের কাজ কমপ্লিট করতে চলে গেলো। নূর রাফসান শিকদারের চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। রাফসান শিকদার খু*ন হওয়ার পর এই চেয়ারে এখন পর্যন্ত আর কেউ বসে নি। এমন কি আশমিন ও না।নূরের মনে হচ্ছে চেয়ারে নয় বাবার কোলে চড়ে বসে আছে সে। বাবা আদুরে হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে বাবার গায়ের গন্ধ এখনো এই চেয়ারে লেগে আছে। নূরের চোখের কোণ বেয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। নূর সন্তপর্ণে তা মুছে নিলো কেউ দেখার আগে।আশমিন গাড়ি তে বসেই নূর কে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। সে ও আজ অফিসে যাচ্ছে। মিটিংয়ে থাকতে হবে তাকে। কোন প্রস্তুতি ছাড়াই বাঘিনীর সামনে যাচ্ছে সে। দেখা যাক তার তেজীনি কিভাবে তাকে কুপকাত করে।
নূর সোজা হয়ে বসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো।তার টিম মেম্বার নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে। এখানকার সবাই আমজাদ চৌধুরীর অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে।ছোট বেলা থেকেই নূরের তাদের সাথে সখ্যতা। কামিনী চৌধুরীর তিক্ত কথা থেকে বাচাতে আমজাদ চৌধুরী নূর কে প্রতিদিন বিকেলে অনাথ আশ্রমে নিয়ে যেতেন। ছোট বলে সবাই নূর কে স্নেহ করত।নূর ও খুব সহজেই মিশে গেছে তাদের সাথে। চার বছর আগে নূর দেশ ছাড়ার আগে কৌশলে এই ত্রিশ জনের টিম কে তাদের কোম্পানির বিভিন্ন ব্রাঞ্চে উচ্চ পদে জয়েন করিয়ে দিয়ে যায়।এটা অবশ্য আমজাদ চৌধুরীর বুদ্ধি ছিল।তিনিই এই টিম মেম্বারদের নূরের জন্য তৈরি করে দেন।এরা প্রত্যেকে নূরের এক কথায় নিজের জীবন দিয়ে দিবে বিনা প্রশ্নে। নূর তাদের থেকে চোখ সরিয়ে কনফারেন্স রুমের বা পাশের বিশাল থাই গ্লাসের সামনে গিয়ে দাড়ালো। পকেটে দুই হাত গুজে চোখ মুখ শক্ত করে বিরবির করে বললো,
— তোমার খু*নের বদলা আমি নিবো আব্বু।তোমার নূর কখনোই নরম মনের মেয়ে ছিল না।শুধু শান্তিতে জীবন কাটানোর জন্য সব চুপচাপ মেনে নিতাম।আমার নীরবতা আমার দুর্বলতা ছিল না।কিন্তু তারা সেটাকেই আমার অস্তিত্ব ভেবে জীবনের চরম ভুল করে বসলো। যে রাফসান শিকদারের মেয়ে তেহজিব নূর শিকদার।যার নামে পুরো শহর কাপতো তার মেয়ে এতো নরম মনের হবে এটা যারা ভাবে তারা এখনো বোকার স্বর্গে বাস করছে। প্রত্যেকটা কে গর্ত থেকে টেনে বের করে তাদের বুক থেকে কলিজা বের করে আনবো আমি। আমি মেয়ে বলে আমি দুর্বল নই আব্বু।নির্মমতা আমার রক্তে মিশে আছে। আমার ভালোবাসা থেকে আমার হিংস্রতা তীব্র। একটা কেউ বাচিয়ে রাখবো না। সব কয়টা কে পিপড়ার মতো পিষে মা*র*বো।
নূরের রক্তলাল টলটলে চোখের দিকে তাকিয়ে আশমিন ঠোঁট কামড়ে হাসলো। এদিকে নূরের এই রুপ দেখে পাশে বসে থাকা সানভির ঘাম ছুটে গেছে।কাপা কাপা হাতে টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছে আশমিনের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকালো। আশমিন সানভির অবস্থা বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে ফেললো। সানভি চোখ বড় বড় করে তাকালো আশমিনের দিকে। চার বছরে এই প্রথমবার আশমিন কে এভাবে হাসতে দেখছে সে।যার হাসি এতো সুন্দর সেই মানুষ টা একদম ই হাসে না।আর যখন হাসে তখন তার সেই বাকা হাসিতে সামনের মানুষটার কাপড় নষ্ট হয়ে যায় ভয়ে।সানভির নিজের ও কয়েক বার হতে হতে বেচেছে।
— আমি আবার ও প্রেমে পরেছি সান।
ফোনে চোখ রেখেই মুচকি হেসে বললো আশমিন। সানভি কনফিউজড হয়ে গেলো তার কি রিয়াকশন দেয়া,উচিত এটা ভেবে।তার এখন নূরের তেজী রুপ দেখে ভয় লাগছে,আবার আশমিনের প্রানবন্ত হাসি দেখে খুশি ও লাগছে,আশমিনের প্রেমে পড়ার বিষয় টা নিয়ে চিন্তা ও হচ্ছে। নূরের যা রুপ দেখা যাচ্ছে, প্রেমে পরার কথা জানলে না জানি কোথায় কোথায় আগু*ন লাগিয়ে নিজের হাত সেকতে বসে যায়।পরে দেখা গেলো টক্কর দেয়ার আশমিন নিজেই খুজে খুঁজে তার প্রেমে পাগল কয়েকটা কে ধরে এনে আগু*নে নিক্ষেপ করলো। বিশ্বাস নেই,এখন এই কলি যুগে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।সানভি ডিপ্রেশনে চলে গেলো টেনশনে।
মিটিং শুরু হওয়ার দশ সেকেন্ড আগে আশমিন নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারে এসে বসে পরলো। কামিনী চৌধুর এসে পৌছালো ঠিক তিন মিনিট পরে।তাই তাকে আর ভিতরে ঢুকতে দেয়া হলো না।কনফারেন্স রুমের বাইরে বিশাল এলইডি স্ক্রিনে নূরের বক্তব্য শুনতে লাগলো সে।
— আমি রাফসান শিকদারের একমাত্র মেয়ে তেহজিব নূর শিকদার আজ থেকে কোম্পানি হ্যান্ড ওভার করে নিচ্ছি।আজ থেকে আশমিন জায়িন চৌধুরী বা কামিনী চৌধুরী কেউ কোম্পানির দায়িত্বে থাকবে না।সমস্ত কোম্পানি আমি পরিচালনা করবো। আপনারা যারা এখানে কর্মরত আছেন তারা আগামী এক মাসে বিগত চার বছরের সমস্ত হিসাব আমার টিম কে বুঝিয়ে দিবেন।আর অবশ্যই নিজেদের জন্য অন্য জায়গায় চাকরির ব্যবস্থা করে নিবেন। কয়েক জনের চাকরির ব্যবস্থা আমি করে দিবো। বাকি যারা বাদ পরেছেন তারা ঝামেলা করতে চাইলে সরাসরি কোর্টে দেখা হবে।আমার কাছে উপযুক্ত রিজন আছে আপনাদের চাকরি থেকে অব্যবহিত দেয়ার।আশা করি সবাই আমার কথা বুঝতে পেরেছেন।কাজে কোন রকম গাফিলতি আমি বরদাস্ত করবো না। তাই বিকেয়ারফুল।
কামিনী চৌধুরী রাগে ফুসছে।একেও এর বাবার মতোই মরতে হবে। খুব বার বেড়েছে। নূরের দিকে তাকিয়ে ফোসফাস করতে করতে মনে মনে বললো,
— আমিও শিকদার বংশের মেয়ে নূর।তোর আগে জন্ম আমার।আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো। তোর অবস্থা রাস্তার কুকুরের মতো না করে আমি কামিনী চৌধুরী স্বস্তির নিশ্বাস নিবো না।
আশমিন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে কামিনী চৌধুরীর দিকে। সে যে আবার কোন খিচুড়ি পাকাচ্ছ তা তার চেহারায় স্পষ্ট। আশমিন পাশের চেয়ারে বিমুর্ষ মুখে বসে থাকা আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকালো। সে ও কামিনী চৌধুরীর দিকেই তাকিয়ে। আশমিন তার বাবার হাতে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বললো,
— সামনে আমাদের খুব কঠিন সময় আসছে আব্বু। শিকদার দের দুই রমনীর যু*দ্ধে কে পরাজিত হয় বলা যায় না।এক জনের বিনাশ নিশ্চিত। আমি আমার বউয়ের পাশে আছি।তাই তার কোন ভয় নেই।মিনিষ্টার আশমিন জায়িনের বউ কে সে কিভাবে প্রোটেক্ট করবে বুঝতেই তো পারছো।কিন্তু তোমার কি হবে? তোমার উচিত অন্য অপশন হাতে রাখা।আমার জানাশোনা অনেক মেয়ে আছে।দেখবো নাকি?
আমজাদ চৌধুরী বজ্রাহত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। সে এখন সিরিয়াস মুখে নূরের দিকে তাকিয়ে। আমজাদ চৌধুরীর বুকের ব্যথা টা আবার বাড়তে লাগলো।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।