ক্লান্ত পায়ে বাড়িতে ঢুকলো আশমিন।ড্রয়িং রুমে কামিনী চৌধুরী আর আমজাদ চৌধুরী বসে আছে। নিজেদের মধ্যে হয়তো কিছু আলোচনা করছে।আশমিন কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে চিন্তিত চোখে তাকালো আমজাদ চৌধুরী।কামিনী চৌধুরীর কপালে ও ভাজ পরেছে।আশমিন কারোর দিকে না তাকিয়ে সোজা নূরের রুমে চলে গেলো। নূর নিজের ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলো। হুট করে আশমিন কে দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো। আশমিন নূরের কাছে গিয়ে মুখোমুখি দাড়ালো। নূর ল্যাপটপ ছেড়ে আশমিনের সামনে দাড়াতেই আশমিন মলিন হাসলো। ক্লান্ত গলায় বলল,
— আমাকে একটু জরিয়ে ধরবে নূর?
আশমিনের এমন গলা শুনে হালকা কেপে উঠলো নূর। জহুরি চোখে পর্যবেক্ষণ করল আশমিন কে।রাগী গম্ভীর লোকটা কে আজ ভঙ্গুর লাগছে।নূর এগিয়ে গিয়ে আশমিন কে হালকা হাতে জরিয়ে ধরলো। আশমিন তাদের মধ্যকার ফাকা টুকু ঘুচিয়ে নূর কে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। নূরের দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবুও কিছু না বলে আশমিন কে শান্ত হতে সময় দিলো।আশমিনের বুকের কাপনি স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে।কপালে কয়েকটা ভাজ পরলেও খুব একটা পাত্তা দিল না।কয়েক মিনিট এভাবে কাটার পর নূর নিজের মুখ খুললো।
— খারাপ সময়ে এভাবে জরিয়ে ধরার জন্য একজন মানুষ দরকার।যে হবে একান্ত ব্যক্তিগত। সে দিক থেকে আপনি আমার চেয়ে লাকি মন্ত্রী সাহেব। আমি আবার খারাপ সময়ে মানুষ কে দুরছাই করতে পারি না।
নূর কে ছেড়ে দূরত্ব বজায় রেখে দাড়ালো আশমিন।নূরের সুক্ষ্ম খোচা সে বুঝতে পেরেছে। নির্লিপ্ত চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। নূর গভীর মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো পুরোটা। আশমিন বরাবরের মতো শান্ত গলায় বললো,
— তুমি আমার থেকেও ভাগ্যবান নূর। আমি আগেও বলেছি এখন ও বলছি,কখনো এমন কোন কাজ করবে না যার জন্য পরে অপরাধবোধে ভোগো।ধনুক থেকে বেরিয়ে যাওয়া তীর আর মানুষের মুখের কথা কখনো ফেরত আসে না। তোমাকে বলা আমার কথাগুলো ও কিন্তু আমি ফিরিয়ে নিতে পারিনি। আমার তখনকার অপারগতা ও ওই কথাগুলো কে মলিন করতে পারে নি। একই ভুল তুমি করলে আমার খারাপ লাগবে।
কথা গুলো বলে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গেলো আশমিন। নূর শান্ত চোখে তাকিয়ে দেখলো আশমিনের চলে যাওয়া।কিছুতো একটা হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে তা বুঝতে পারছে না নূর।
সেদিন রাতে এভাবে নূরের লাগানো আ*গুন নিভিয়ে দিয়ে নূরকে অনেকটা কাছে টেনে নিয়েছিল আশমিন।দীর্ঘ ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে এত কাছাকাছি আসা হয়নি তাদের।আশমিন অনেকটা ডুবে গিয়েছিল নূরের মাঝে ভেজা দুটো শরীর একসাথে লেপ্টে ছিল অনেকটা সময়। আশমিন অবাধ বিচরণ করেছে নূরের উপর। দুজনের নিশ্বাস পাল্লা দিয়ে ভারী হচ্ছিল। আশমিন নূরের বুক থেকে মুখ তুলে আশমিনের ওষ্ঠদ্বয় দখল করে নিতেই নূর আশমিন কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। হুট করেই আশমিন কে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। নূর চোখ বন্ধ করে হাপাচ্ছে।উপর থেকে পানি পরা বন্ধ হয়নি এখনো। নূরের শরীরে পরা পানির বিন্দু গুলো এক একটা মুক্তোর দানা মনে হচ্ছে আশমিনের কাছে।গায়ে লেপ্টে থাকা সাদা শার্ট টা খুলে ফ্লোরে ছুড়ে দিয়ে নূর কে কোলে তুলে নিলো আশমিন। ততক্ষনে ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছে নূর।আশমিনের কোল থেকে নামার জন্য মোচড়া মুচড়ি করতেই আশমিন বাকা হাসলো। নূরের রক্তিম নাকে হালকা কামড় দিয়ে ভরাট গলায় বলল,
— মোচড়া মুচড়ি করে লাভ নেই। বাসর করতেই তো এসেছো।এখন তোমাকে কিছু না করেই ছেড়ে দিলে তুমি আমার সম্পর্কে ভুলভাল ভাবতে পারো।তবে আমি এভাবে বাসার করতে চাই না বুঝলে।তাই আজ শুধু হতে হতে ও হইলো না টাইপ বাসর হবে। আগুনের ভেজা বাসর।
নূর হতভম্ব হয়ে কথা বলতেই ভুলে গেলো। হাজার কিল ঘুসি দিয়েও আশমিনের হাত থেকে মুক্তি পেলো না। নিজের নখ রাক্ষুসিদের মতো না রাখার জন্য নিজেকেই ভৎসনা করতে লাগলো। তাহলে অন্তত খামচে খামচে এই অসভ্য লোকের চেহারার নকশা বদলে ফেলা যেতো। সেদিন এক অন্য আশমিন কে আবিষ্কার করেছিল নূর।যাকে ভাবলে মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই আসে।আর তা হলো, অসভ্য অসভ্য অসভ্য।
পরের দিন থেকেই দুজন ঠান্ডা জ্বর লাগিয়ে কেলেঙ্কারির বাধিয়ে ফেললো। আশমিন কে দেখে সানভির মনে হলো তার সামনে একটা পাকা টমেটো ঝুলে আছে।বাসর করতে গিয়ে এভাবে জ্বর বাধানোর কি হলো আজব!এমন হলে তো সে মোটেও বাসর টাসর করবে না। আশমিন জ্বর নিয়ে পরপর কয়েক টা মিটিং করে ফেললো। এদিকে নূর শুধু বিছানায় শুয়ে শুয়ে আশমিন কে বকে গেলো। কয়েক হাজার অভিশাপ দিয়ে ও খান্ত হলো না। আশমিনের কাবার্ডের সমস্ত সাদা শার্ট গুলো জ্বালিয়ে দিলো।এই সাদা শার্ট পরা দেখেই সে পিছলে গিয়েছিল। দুই দিন রুমের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইলো। এই অবস্থায় বাইরে গিয়ে লোক হাসানোর মানেই হয় না। অথচ আশমিন নির্দিধায় নিজের কাজ করে গেলো।একবেলায় জ্বর ছেড়ে গেলেও ঠান্ডা তাকে কুপকাত করে ফেললো। আশমিন কয়েক বার বিরবির করে বলে ও ফেললো, বউয়ের অভিশাপ বউয়ের অভিশাপ।
তার পর থেকে টানা সতের দিন দুজনের দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। নূর আশমিন কে এড়িয়ে চলেছে এ কয়দিন।আশমিন ও সেদিকে পাত্তা দেয় নি। আজ হুট করেই আশমিন এভাবে সামনে চলে এসে বিভ্রান্ত করে দিয়ে গেলো নূর কে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো নূর। আকাশের মস্তো বড় চাদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো নিজের অগোছালো জীবন নিয়ে।সব কিছু স্বাভাবিক থাকতে পারতো।অন্য সব মেয়েদের মতো সে ও একটা সাজানো গোছানো সংসার করতে পারতো।কয়েকজন মানুষের লোভ তাদের জীবন টা এলো মেলো করে দিয়েছে।ফোনের শব্দে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো নূর।
— বলো অমি।
— ম্যাম, মতি মিয়ার খোজ পাওয়া গেছে।আজ সকালে আশমিন স্যারের লোকেরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।কিছুক্ষণ আগে থেকেই তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরিবার ও কয়েক ঘন্টার মধ্যে উধাও।
— তাদের খোজা বন্ধ করো অমি।আপাতত তোমার স্যারের উপর নজর রাখো।সে যেন বুঝতে না পারে কিছু।
— ওকে ম্যাম।
অমি ফোন রাখতেই নূর চাঁদ দেখায় মনোযোগ দিল।
— এই খেলার শেষ ধাপে আপনি ই আমাকে নিয়ে যাবেন মন্ত্রী সাহেব। আজ থেকে আমার কাজ গুলো আপনার। (বাকা হেসে)
সকালের নাস্তার টেবিলে আশমিন কে সবার আগে উপস্থিত হতে দেখা গেলো। নিজের মতো করে গুন গুন করছে সে।নূর রেডি হয়ে এসে বসলো তার চেয়ারে।আশমিনের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। আমজাদ চৌধুরীর ছেলের মতিগতি ভালো ঠেকছে না। কামিনী চৌধুরীর সেদিকে ধ্যান নেই। সে নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। একজন গার্ড এসে একটা খাম কামিনী চৌধুরীর দিকে এগিয়ে দিলো। রেজিস্ট্রার করা এনভেলাপ। কামিনী চৌধুরী ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো।
— এখানে আপনার সাইন লাগবে ম্যাম।
গার্ডের কথায় রেজিস্ট্রার খাতায় সাইন করে খামটি হাতে নিল সে।ভিতর থেকে বের হওয়া ডকুমেন্ট পড়তেই মাথা ঘুরে গেল তার।হাত পা কাপতে লাগলো। নূর বাকা হেসে নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরী সন্দিহান গলায় বলল,
— এটা কিসের কাগজ কামিনী?
কামিনী চৌধুরী কিছু বলতে পারলো না। অতিরিক্ত শকে কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে। নূর সেদিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বললো,
— কোর্ট থেকে নোটিশ এসেছে।কোম্পানি থেকে সারে তিন শ কোটি টাকা হেরফের করার জন্য তাকে কোম্পানি কে চার শ কোটি টাকা ফেরত দিতে হবে। তা ও আগামি দুই মাসের মধ্যে।
আমজাদ চৌধুরী হতভম্ব হয়ে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালো। আশমিন একটা পেপার আমজাদ চৌধুরীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
— এসব বাদ দাও আব্বু।এখানে একটা সাইন লাগবে। তারাতাড়ি করে দাও তো।
আমজাদ চৌধুরী হতভম্ব চোখে পেপারের দিকে এক পলক তাকালো। কয়েক পলক সেদিকে তাকিয়ে থেকে নির্লিপ্ত ভাবে সাইন করে দিলো পেপারে।
— ধন্যবাদ আব্বু।ওহ,আরেকটা কথা। আমি ভেবেছি তোমাকে আবার বিয়ে করাবো।মিসেস চৌধুরী ও থাকবে।তবে নূরের নাকি একটা ননদ লাগবে।তাই তোমার একটা বিয়ে করা দরকার। সানভি কিছু ছবি দিবে। দেখে পছন্দ করে রেখো।
নূরের বিষম লেগে পানি তালুতে উঠে গেলো। কামিনী চৌধুরী চোখ বড় বড় তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। আমজাদ চৌধুরী ছেলেকে ধমক দিতে ও ভুলে গেলো।
আশমিন নূরের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
Leave a comment