স্টাডি রুমে বিধ্বস্ত হয়ে বসে আছে নূর। অনুভূতিহীন চোখে এক মনে তাকিয়ে আছে আশমিনের ডায়েরির দিকে।একটি মাত্র ডায়েরি জীবনের অনেক অসমাপ্ত গল্পের সমাপ্তি টেনে দিয়েছে।দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোর খামচে ধরে বসে আছে নূর। কান্না আটকানোর জন্য ঠোঁট কামড়ে ধরায় ঠোঁট কেটে র*ক্ত বেরিয়ে গেছে।ডায়েরি থেকে নজর সরিয়ে রক্তাক্ত চোখে তাকালো দেয়ালে টাঙ্গানো আশমিনের বিশাল ফ্রেমের ছবির দিকে। নিজেকে টেনে হিচড়ে দাড় করালো নূর। ডায়েরি টা জায়গা মতো রেখে আশমিনের ছবির সামনে এসে দাড়ালো।
— ধোকা! এত বড় ধোকা! (ছবিতে হাত বুলিয়ে) আপনাকে কি শাস্তি দেই বলুন তো মন্ত্রী সাহেব? কি নিখুঁত অভিনয় আপনার! আপনি তো নিজের পারফরম্যান্স দেখিয়ে দিলেন।এবার আমার টা দেখানোর পালা। অভিনয় করতে ভালো লাগে তাই না? তো চলুন,এক দফা টক্কর আমাদের মাঝেও হয়ে যাক(দাতে দাত চেপে)। আপনার চালে যদি আপনাকে মাত না দিয়েছি তো আমার নাম ও তেহজিব নূর শিকদার নয়।
আশমিন আসার পর থেকে নূর কে একবার ও দেখে নি। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে কপাল কুচকে চারিদিকে চোখ বুলালো সে।হাতের তাওয়াল টা বারান্দায় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মায়া রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। আশমিন নিচে এসে অস্থির গলায় বলল,
— নূর কোথায় আন্টি?
— বউমা তো অনেকক্ষণ আগে স্টাডি রুমে গিয়েছে। দুপুরের খাবার টাও ওখানেই খেয়েছে। নিচে তো আসতে দেখিনি।
আশমিন ভয়ার্ত চোখে তাকালো মায়া বেগমের দিকে। হুশ ফিরতেই এক প্রকার দৌড়ে গেল স্টাডি রুমের দিকে। মায়া বেগম প্রথমে অবাক হলেও পরে মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিলো। শুধু বাড়ির লোক ই না, চেনা জানা সবাই জানে আশমিন নূর কে চোখে হারায়।শাজাহানের মতো নূরের জন্য নূরমহল বানিয়ে ফেললেও কেউ অবাক হবে না।সেফ কে নিজের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রুমের দিকে গেলেন মায়া বেগম। শরীর টা আজ খুব একটা ভালো না।জ্বর আসবে হয়তো। আমজাদ চৌধুরী তার দিকে ফিরেও তাকায় না।তাতে অবশ্য তার কষ্ট হয় না। বরং এমন নিখাত ভালবাসা দেখে মনে মনে তৃপ্তি পায় সে।
হুড়মুড় করে স্টাডি রুমে ঢুকতেই নূর আশমিনের দিকে চোখ তুলে তাকালো। নূরের হাতে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটি। আশমিন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। নূর মুচকি হেসে বই রেখে উঠে দাড়ালো। ধীর পায়ে কাছে এসে আশমিনের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। আশমিন ও আগলে নিলো নূর কে।হৃদপিণ্ডের তীব্র ধুকপুকানি নূরের কানে এসে বারি খাচ্ছে। নূর বাকা হাসলো, ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল,
— ভয় পেয়েছেন নাকি মন্ত্রী সাহেব? এভাবে বুক কাপছে কেন?এভাবে তো অপরাধীর বুক কাপে। করেছেন নাকি কোন বড়সড় অপরাধ?
আশমিন হাত আলগা করে নূর কে নিজের সামনে আনলো।নূরের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নূরের চোখ একেবারে শান্ত।হাসি হাসি মুখে সে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন নিজেকে শান্ত করলো। নূর কে নিজের সাথে চেপে ধরে আস্তে করে বললো,
— অপরাধ তো করেছি বউ।আজ সারাদিন বউয়ের খবর নিতে পারিনি।এটা তো গুরুতর অপরাধ। শাস্তি তো পেতেই হবে।
— হুম,আমি দিবো আপনাকে শাস্তি। আজ সারা রাত আমার সাথে বারান্দায় গল্প করে কাটাতে হবে। শাস্তি মঞ্জুর তো মন্ত্রী সাহেব?
আশমিন চোখে হাসলো। নূরের কপালে চুমু খেয়ে ঘোর লাগা গলায় বলল,
— এমন শাস্তি আমি সারাজীবন পেতে চাই বউ।
আশমিনের কাছে আসায় গা গুলিয়ে উঠলো নূরের। নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাড়ালো। আশমিন ভ্রু কুচকে ফেললো। নূরের ঠোঁটের দিকে চোখ যেতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার। দ্রুত পায়ে এসে নূরের গাল চেপে ধরলো।কাটা জায়গায় স্লাইড করতে করতে বললো,
— এভাবে কাটলো কিভাবে? ঠোঁট কামড়েছো কেন?এখন আমি চুমু খাবো কোথায়?
প্রথম কথা গুলো রাগ করে বললেও শেষ কথা টা দুঃখী দুঃখী গলায় বলল আশমিন। নূর শান্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। অভিনয়েও বুঝি ভালবাসা এতো নিখুঁত হয়!
— এই মেয়ে,কথা বলছো না কেন?
আশমিনের ধমকের পিঠে কিছু বলার আগেই মাথা ঘুরে উঠলো নূরের। ঝাপসা চোখে একবার আশমিনের দিকে তাকিয়ে ঢলে পরতেই আশমিন আগলে নিলো নূর কে। অস্থির গলায় ডাকতে লাগলো,, — বউ!কি হয়েছে তোমার? নূররর,,,,
নূর কে কোলে তুলে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতেই চিৎকার করে সবাই কে ডাকলো আশমিন।বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে অস্থির হয়ে ফোন করলো ডক্টর কে।ততক্ষণে বাড়ির সবাই এসে পড়েছে।লুবানা গিয়ে নূরের হাত পা মালিশ করতে লাগলো। মায়া বেগম চোখে পানি ছিটিয়ে দিলেও নূরের জ্ঞান ফিরলো না।আশমিন পাগলের মতো নূর কে ডেকে যাচ্ছে বারবার। লুবানার ছোট ভাই লিমন এক কোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে আশমিন কে ভয় পায়।এখন আশমিনের পাগলামি দেখে আরো ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছে।আমজাদ চৌধুরী চিন্তিত গলায় বলল,
— এভাবে বসে থেকো না। ওকে হসপিটাল নিয়ে যাও।
আশমিন আর এক মুহুর্ত দেড়ি করলো না।নূর কে কোলে তুলে রুম থেকে বেরুতেই সানভি হন্তদন্ত পায়ে প্রবেশ করলো ডক্টর নিয়ে।আশমিন আবার নূর কে রিমে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো।সবাই কে বেরিয়ে যেতে বলতেই আশমিনের ভয়ংকর দৃষ্টিতে দমে গেল ডক্টর। সবাই বেরিয়ে গেল ও আশমিম নূরের হাত ধরে তার পাশেই বসে রইলো। ডক্টর চেকআপ করে মুচকি হেসে আশমিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
— অভিনন্দন স্যার।সি ইজ প্রেগন্যান্ট। অতিরিক্ত চিন্তার জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।এখন ওনার রেস্ট প্রয়োজন। আমি ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছি। কাল সকালের আগে ঘুম ভাঙ্গবেনা।কাল হসপিটালে গিয়ে কিছু টেস্ট করিয়ে আনবেন।তাহলে ম্যামের কন্ডিশন ভালো ভাবে বোঝা যাবে।
ডক্টরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আশমিন।তার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে,”সি ইজ প্রেগন্যান্ট “ডাক্তারের বাকি কথা তার কানে গেলো কি না বোঝা গেলো না।ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিতেই ডাক্তার মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল। আশমিন একমনে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূরের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আশমিনের হাতের মুঠোয় থাকা নূরের হাতটার কয়েকটা নখ ভেঙে গিয়েছে। আশমিন হালকা ঝুকে জরিয়ে ধরলো নূর কে।উত্তেজনায় তার পুরো শরীর কাপছে। মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারাবে।
নিচে লুবানার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সানভি ধমকেও তাকে থামাতে পারছেনা।
— এভাবে চিৎকার করছো কেন সাবানা?অসভ্যের মতো চিৎকার করা বন্ধ করো।ছিঃ, কি গলা।মনে হচ্ছে ফাটা বাসের ভিতর আটকে পরা ইদুর কিচমিচ করছে।
লুবানা সমস্ত আনন্দ ভুলে ফুসে উঠলো। কটমট করে তাকালো সানভির দিকে।
— ও হ্যালো,মি.কবরস্থানের বাসিন্দা। আমার নাম লুবানা।লু,,বা,,না।নট সাবানা। আর আমার গলা মোটেও ইদুরের মতো নয়।আপনার কানে সমস্যা।লক্কর ঝক্কর যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘুরে বেরাতে লজ্জা করে না আপনার?তাজ্জব ব্যাপার!
সানভি রাগী চোখে তাকিয়ে আছে লুবানার দিকে। মেয়ের সাহস দেখে অবাক হচ্ছে সে।আর এদিকে লিমন দুজনের ঝগড়া দেখছে আর হাই তুলছে।আমজাদ চৌধুরী আর মায়া বেগম নূরের রুমে গিয়েছে। না হলে ইজ্জত পানি পানি হয়ে যেতো এই মেয়ের জন্য।
— দেখো মেয়ে,, বেশি বারাবাড়ি করবে না। না হলে ছাদে তুলে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবো।বেয়াদবির একটা আদব থাকা দরকার।
— হুহ,,আসছে ধাক্কা দিতে।বলি হাড়গোড় সব ঠিক যায়গায় আছে তো?আগে চেক করে আসুন।দেখা গেলো চোখ কানের মতো হাড্ডি ও দুই একটা কবরে রেখে এসেছেন।
লুবানা মুখ বাকিয়ে চলে গেলো। সানভি কটমট করতে করতে লিমন কে বললো,
— দেখেছো? দেখেছো কেমন বেয়াদব?
লিমন হচকচিয়ে গেলো। জোর পুর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
— জ্বি ভাইয়া।ছোট বেলা থেকেই দেখছি।
আশমিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমজাদ চৌধুরী।ছলের খুশির পরিমাণ তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আশমিন আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দাম্ভিক হাসি দিলো।আমজাদ চৌধুরী ভ্রু কুচকে তাকালো ছেলের দিকে। নিশ্চিত এখন বেহায়া মার্কা কিছু বলবে।এখানে মায়া বেগম ও আছে।আমজাদ চৌধুরী আর লজ্জায় পরতে চাইলো না। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিতেই আশমিন তার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
— একা যাচ্ছো কেন? তোমার বউ নিয়ে যাও।একা গেলে সুখবর পাবো কিভাবে।ওষুধে তো কাজ করার কথা।খাচ্ছো তো ঠিকঠাক? মনের মধ্যে দুষ্টু আমজাদ চৌধুরী উকি দেয়নি এখনো? নাহ,, টিউবলাইট হয়ে যাও নি তো আবার?
আমজাদ চৌধুরী মনে মনে কয়েক ঘা লাগালেন ছেলের গালে। এরকম একটা বজ্জাত ছেলে তার ই কেন হতে হলো! দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করলেন তিনি।বাকি ইজ্জত টুকু এই ছেলের হাত থেকে বাচিয়ে রাখতে হবে।নিজেকে মাঝে মাঝে অসহায় রমনী মনে হয়।আর আশমিন কে রাস্তার বখাটে।
Leave a comment