বলিষ্ঠ শরিরে শুভ্র পাঞ্জাবি জড়িয়ে নিজেকে পরিপাটি করছে আশমিন। পাঞ্জাবীর উপর কটি পরে শেষ বারের মতো নিজেকে দেখে নিলো সে। আজ নির্বাচন।সারাদিন ব্যস্ত থাকবে সে। ড্রেসিং টেবিলে থেকে চোখ সরিয়ে মেয়েদের দিকে তাকালো আশমিন। সুখ পাখি তার দিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করছে। আশমিন হালকা হাসলো। মেয়েদের কাছে গিয়ে তাদের কপালে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিলো।
দুই মেয়েই বাবার কোলে উঠে বুকে মাথা মিলিয়ে চুপটি করে আছে। আশমিন তাদের মন ভরে আদর করে মায়া মায়া নজরে তাকালো। মেয়ে দুটো কে দেখলে তার বুকটা প্রশান্তি তে ভরে যায়। আশমিন সারাজীবন ই ভালবাসার কাঙাল। ছোট থেকেই সবার সাথে দূরত্ব তার। মায়ের ভালবাসা আর এই জীবনে পাওয়া হবে না। এখন তার একমাত্র ভালো থাকার উপায় এই রাজকন্যারা। আজকাল নূর কে বুঝতে পারে না আশমিন। নূরের ভালবাসার গভিরতা বোঝার ক্ষমতা হয়তো তার হয়নি। কিন্তু নূরের নির্লিপ্ততা ভীষণ কষ্ট দেয় আশমিন কে। তার ভালবাসায় তো কোন কমতি নেই। তবে কেন এত অবহেলা!
মেয়েদের মেড এর কাছে রেখে আশমিন বেরিয়ে গেল। বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করবে আজ।
নূর নিজ হাতে রান্না করছে আশমিনের জন্য। আশমিনের জন্য আজ গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। নূর নিজেদের সমস্ত গার্ড কে আশমিনের সিকিউরিটির জন্য নিযুক্ত করেছে। আশমিন এই সম্পর্কে কিছু জানে না। নূর ই তাকে কিছু জানায় নি। তাদের সুরক্ষায় নিযুক্ত থাকা গার্ড আজ তাদের সাথে থাকবে না জানলে শত্রুরা যেকোন সময় আক্রমণ করতে পারে। আশমিন জানলে কখনো ই রাজি হবে না। উল্টো নূরের উপর রেগে যাবে।
আশমিন নিচে নেমে নূর কে কোমড় বেধে রাধতে দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো। আজকে আবার কার জন্য রান্না করছে! সার্ভেন্ট একটা ও নেই আশে পাশে। আশমিন চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ধীর পায়ে নূরের পিছনে গিয়ে দাড়ালো। নূরের ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— এতো আয়োজন কার জন্য?
নূর চমকে কেপে উঠলো। পাশে আশমিনের অস্তিত্ব অনুভব করে মৃদু হেসে ফিচলে গলায় বলল,
— আছে স্পেশাল কেউ। আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সে। যাকে এই পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসি।(লাজুক গলায়)
আশমিন জ্বলে উঠলো। কটমট করে তাকালো নূরের দিকে। হেচকা টান দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কোমড় খামচে ধরলো। নূরের মুখ থেকে হালকা আর্তনাদ করে উঠলো। আশমিন সেদিকে পাত্তা দিলো না। সে ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে ক্রুর হাসলো। নূর কে নিজের সাথে আরেকটু চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বললো,
— তাই নাকি সোনা? তা তোমার সেই ভালবাসার মানুষ টিকে আমাকেও একটু দেখাও। আমিও দেখি আমার বউয়ের মনে কে ডায়নাসরের মতো উড়ে বেরাচ্ছে। তার পাখনার সাথে আমার বউয়ের পাখনা গুলো ও তো ভাঙতে হবে তাই না। স্বামী হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না? আমি খুবই কর্তব্যপরায়ণ মানুষ। আমি জানি কিভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে হয়। বউ বেশি ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়লে তাকে কিভাবে খপ করে মুঠোয় ভরতে হয় তা ও আমি ভালো করেই জানি। বেশি উড়ো না ময়না। তাহলে ময়না থেকে কাকাতুয়া বানাতে আমার বেশি সময় লাগবে না। মনে রাখবে,একটি ভুল নয় মাসের কান্না হতে পারে।
শেষের কথা টা গম্ভীর গলায় বলল আশমিন। নূর বাকা হেসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কোমড়ের পাশটা মনে হয় নখ দেবে রক্তাক্ত হয়ে গেছে। জ্বলছে খুব। নূর বাকা হাসি প্রসারিত করে আশমিনের গলা জরিয়ে ধরলো। গা জ্বালানি হাসি দিয়ে লাজুক গলায় বলল,
— সে তো আছে আমার মনে বাবুর আব্বু। তার কথা ভাবলেই তো আমার লজ্জা লাগছে। দেখুন আমার গাল দুটো লাল হয়ে আছে। ইসস,,সে যে কি সব দুষ্টু দুষ্টু কাজ করেনা! আমি তো মুখেই আনতে পারবো না। আপনি প্লিজ তার কথা জানতে চেয়ে আমার লুকানো ভালবাসা জাগিয়ে দিবেন না।
কথা গুলো বলেই দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেললো নূর। আশমিন ভেবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কোমড়ে খামচে রাখা হাত টি ও শিথিল হয়ে এলো। কপালে ভাজ ফেলে গমগমে গলায় বলল,,
— সকাল সকাল নেশা করেছো কেন? তুমি তো এমন ছিলে না!তোমার লজ্জা করলো না দুই বাচ্চার মা হয়ে সকাল সকাল মাতলামি করতে। ইটস ইঞ্জুরিয়াস ফর হেলথ নূর। মেয়েরা কি শিখবে তোমার কাছ থেকে? সকাল সকাল মাতলামি? আমি এখন বের হবো এটা তো মাথায় রাখতে পারতে। বউ মাতলামি করছে আর আমি তার ফায়দা লুটে নিতে পারছি না! তুমি কতো নিষ্ঠুর!
নূর ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আশমিন থেকে। ভুনা খিচুড়ি নাড়তে নাড়তে নিজেকেই কয়েকদফা গালি দিলো। এমন ইতর লোকের সাথে সংসার করার চেয়ে বনভাসে গিয়ে বাঘকে গান শোনানো সহজ।অসহ্য মানুষ একটা!
নূরের রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে এক ভ্রু উচু করে বাকা হাসলো আশমিন। হুহ তাকে জ্বালাতে আসে। বাচ্চা কাচ্চার মা যত্তসব।
নূর ভুনা খিচুড়ির সাথে গরুর কালো ভুনা আর ইলিশ মাছ ভাজা রাখে টেবিলে। আশমিন নিজের প্লেটে খাবার নিয়ে নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। নূর তার পাশের চেয়ারেই মুখ ফুলিয়ে বসে। আশমিন আড় চোখে একবার তাকিয়ে নূর কে ও খাইয়ে দিতে লাগলো। নূর কিছু না বলে নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। দুজনের খাওয়া শেষ হতেই আশমিন হাত ধুতে বেসিনে চলে গেলো। নূর অপেক্ষা করছে আশমিনের ফিরে আসার। টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে আশমিন নূরের সামনে এসে দাড়ালো। টেবিল থেকে আরেক গ্লাস পানি খেয়ে আফসোসের স্বরে বললো,,
— আহা!তোমার ভালবাসার মানুষের খাবার তো সব তুমি ই খেয়ে ফেললে। কি পেটুক তুমি! এখন ওই বেচারি কি খাবে?
আশমিনের অভিনয় দেখে গা জ্বলে গেলো নূরের। দাতে দাত চেপে মুখটা,হাসি হাসি করে এগিয়ে গেলো আশমিনের কাছে। খুলে রাখা পাঞ্জাবীর অতিরিক্ত বোতাম টা লাগিয়ে মুচিকি হেসে মায়া মায়া চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। হুট করেই বুকের বা পাশে দাত বসিয়ে দিল নূর। আশমিন মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে। মেয়ে টা কি সব পাগলামি করে! নুর কামড় দেয়া শেষ হতেই আশমিন মুখটা গম্ভীর করে ফেললো। শান্ত গলায় বললো,
— একটা কামড় ও ঠিক করে দিতে পারো না বউ। আজ রাতে আমি তোমাকে কামড়ের প্রকারভেদ শিখাবো। উদাহরণ সহ। তৈরি থেকো সোনা।
আশমিন নূর কে জরিয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল। নূর হতাশ চোখে আশমিনের যাওয়া দেখলো। আজ তার কপালে দুঃখ আছে।
আমজাদ চৌধুরী অনেক আগেই পার্টি অফিসে চলে এসেছেন।ছেলের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ দিনে এভাবে বসে থাকতে পারে না সে। তাই সকাল সকাল ই দলের ছেলেদের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। আশমিন আসতেই সানভি তার কাছে এসে দাড়ালো। আশমিন চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
— সব কিছু ঠিক আছে তো সান?কোন কেন্দ্রে সমস্যা হয় নি তো?
সানভি হড়বড় করে বললো,
— কেন্দ্র গুলো তে বিরোধী দলের লোকেরা ওঁৎ পেতে আছে স্যার। আজ ওরা ঝামেলা করবেই।আমাদের ছেলেরা ও,আছে। কোন ঝামেলা করতে আসলে সব কয়টা কে সাইজ করে দিবে। আর একটা কথা, (কিছুটা আমতা আমতা করে) তারা আজ আপনার উপর হামলা করার পরিকল্পনা করে রেখেছে স্যার। যে কোন সময় আক্রমণ করতে পারে। আমি সব কিছু আগে থেকেই সেট করে রেখেছি। আমাদের যে কেন্দ্র থেকে পরিদর্শন শুরু করার কথা আমরা তা না করে দুরের কেন্দ্র গুলো থেকে শুরু করবো। এটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না স্যার। আমরা এখুনি বের হবো। অমি আছে ওখানে।বাহাদুর আমাদের সাথে থাকছে।
আশমিন মনোযোগ দিয়ে শুনলো।আজ কোন রিস্ক নেয়া যাবে না। একবার ক্ষমতা হাতে চলে এলে তখন সব-কয়টা কে বাদর নাচ করানো যাবে। আশমিন আমজাদ চৌধুরীর সাথে দেখা করে তাকে অফিসেই থাকতে বললো। কিছু কথা বুঝিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে পারল সানভির সাথে। গাড়ি তে বসে সানভির চিন্তিত চেহারা দেখে গম্ভীর গলায় বলল,,
— চিন্তা করো না সান,তোমার স্যার উপরে আল্লাহ তারপর নিচে বউ ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। বিসমিল্লাহ বলে যাত্রা শুরু কর।
Leave a comment