আমজাদ চৌধুরী কে যখন হসপিটালে নেয়ার তোড়জোড় চলছে ঠিক সেই মূহুর্তে তাদের সামনে হাজির হলো নূর। আশমিন চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সানভি আমতা আমতা করে বললো,
— সরে দাড়ান ম্যাম।স্যার কে এখনি হসপিটালাইজ করতে হবে। নাহলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
নূর বাকা হেসে আমজাদ চৌধুরীর কাছে গিয়ে দাড়ালো। কামিনী চৌধুরী তাকে ধরে বিলাপ করে যাচ্ছে। লারা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে পাশেই দাড়িয়ে। নূর আশমিনের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
— সবাই শান্ত হন।কেউ অস্থির হবেন না প্লিজ। আংকেলের গ্যাস্টিকের ব্যথা হয়েছে।ছেলের বিয়ে বলে কথা, হেভি খাবার খাওয়ায় এই অবস্থা। নাথিং এলস।আশমিনের সামনে গ্যাস্টিকের মেডিসিন এগিয়ে দিয়ে বললো,
— নিন,এটা আংকেল কে খাইয়ে দিন।দশ মিনিটে ঠিক হয়ে যাবে। আপনি বরং ভালো ছেলের মতো বিয়ে টা করে নিন।সুন্দরী সুশীল বউ অপেক্ষা করছে তো।বিয়ে টা আপনাকে করতেই হবে মন্ত্রী সাহেব। নাহলে আমার শূন্যতা অনুভব করবেন কিভাবে।আমাকে ফিরে পাওয়ার বিন্দু মাত্র আশার স্বস্তি আমি আপনার ভিতর অবশিষ্ট রাখবো না। নূর তার কথার খেলাপ করে না।
শেষের কথা গুলো ফিসফিস করে বললো নূর।আশমিন তার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে। ভিতরে রাগে ফেটে পরলেও ভাইরে সে একদম শান্ত।নূরের দিকে তাকিয়ে বাকা হাসলো সে।নূরের দিকে ঝুকে ফিসফিস করে বললো,
— আমি একজন মন্ত্রী নূর।তোমার মতো হাজার হাজার কুটিল বুদ্ধি পিছনে ফেলে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি।তুমি এতদূর করতে পেরেছো কারণ আমি চেয়েছি।উড়ে বেড়াও,যতো খুশি উড়ে বেড়াও।কিন্তু এটা ভুলে যেও না তোমার নাটাই এই আশমিন জায়িনের হাতে।উড়বে,গোত্তা খাবে সমস্যা নেই।কিন্তু যখন সুতা টান দিবো তখন আমার কাছেই আসতে হবে। তখন কি হবে নূর! তোমার মন্ত্রী সাহেব কিন্তু খুব নিষ্ঠুর। তার নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে পারবে তো! ভেবে চিন্তে কদম ফেলো নূর।তোমার পায়ে শিকল লাগাতে আমি মোটেও সময় নিবো না। (দাতে দাত চেপে)
— একি মন্ত্রী সাহেব! নাটাই থেকে সুতো ছিড়ে কবেই উড়ে গেছে আর আপনি তো দেখছি খবর ও রাখেন না।এতো বেখেয়ালি হলে চলে!(বাকা হেসে)
— দেখা যাক।
নূরের থেকে দূরে সরে চারিদিকে চোখ বুলালো আশমিন।সবাই আমজাদ সাহেব কে ঘিরে ধরে আছে। সেদিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে উঠলো সে,
— সবাই এভাবে ভীড় করে আছেন কেন।সরে দাড়ান। গাড়ি বের করো সানভি।আর মিস.তেহজিব নূর,আপনি নিশ্চয়ই ডাক্তার নন।আপনার দূরদর্শী খমতার বলে আব্বুর বুকের ব্যথা গ্যাস্টিক মনে হতেই পারে।তাই বলে ছেলে হিসেবে তো আমি তা ধরে বসে থাকতে পারি না।কারোর খামখেয়ালি ধারণা নিয়ে তো আর বাবা কে হারাতে পারি না।আপনার কাছে হয়তো বাবার মূল্য তুচ্ছ্য।তবে আমার কাছে সব কিছুর চেয়ে বাবার মূল্য বেশি।আশা করি বোঝাতে পেরেছি।
সানভি গাড়ি নিয়ে আসতেই আমজাদ সাহেব কে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো আশমিন। নূর কে ইচ্ছে করেই এতো তিক্ত কথা শুনিয়েছে সে।নিজের করা ভুল গুলো সেও নাহয় একটু উপলব্ধি করুক।গর্ত থেকে যখন টেনে বের করে এনেছে তখন ঘাড়ের বাকা রগ গুলোও ঠিক সোজা করে দিবে। কামিনী চৌধুরী সাথে আসতে চাইলে সাথে সাথে মানা করে দিলো আশমিন। এমনিতেই মেজাজ পুরো খিচে আছে।মায়ের ফেচফেচ কান্না এখন টোটাল সহ্য করতে পারবে না সে।এর মধ্যেই বিভিন্ন চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ চলছে,
“ছেলের বিয়েতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরলেন মন্ত্রী আশমিন জায়িনের বাবা আমজাদ চৌধুরী”
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। পিছনে গার্ড আর মিডিয়ার প্রায় পঞ্চাশ টার মতো গাড়ি তাদের ফলো করছে।আমজাদ চৌধুরী রাগী চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে।আশমিনের তাতে কোন হেলদোল নেই।সে একমনে ফোন ঘেটে যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরী এবার মেজাজ হারালেন। কর্কশ গলায় বললেন,
— এদিকে তাকাও বেয়াদব ছেলে। বিয়ে যখন করবেই না তাহলে এতো নাটক করার কি দরকার ছিল।কেমন ছেলে তুমি?বিয়ে বন্ধ করার জন্য বাবা কে হার্ট এট্যাকের রুগি বানিয়ে দাও!দিন দিন অসভ্য হচ্ছো।
সানভি শুকনো ঢোক গিলে পিছু ফিরে আমজাদ চৌধুরী আর আশমিনের দিকে তাকালো। তা দেখে আমজাদ চৌধুরী ফুসে উঠলো,
— এভাবে তাকাচ্ছো কেন? ছেলে হয় আমার।চাইলে দু চার ঘা লাগিয়ে ও দিতে পারি।আর তোমাকে বলছি বেয়ারা ছেলে,আমি কিছুতেই হসপিটাল যাবো না।ফিনাইলের গন্ধ আমার একদম সহ্য হয় না।
— ঠিক আছে।তোমাকে নানা বাড়ি রেখে আসছি।সানভি,গাড়ি ঘোরাও।
আশমিনের শান্ত গলা। সানভি অসহায় চোখে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে।আমজাদ চৌধুরী মুখ কালো করে বসে আছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কটমট করে সানভিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললো। আমজাদ চৌধুরীর চুপসে যাওয়া মুখ দেখে সানভির প্রচন্ড দুঃখ হলো। এরকম একটা নিষ্ঠুর ছেলের পিতা হওয়া তার মোটেও উচিত হয় নি।
আশমিন তীক্ষ্ণ চোখে নূর কে দেখে যাচ্ছে। যে বর্তমানে রুমের এক কোনায় বিধ্বস্ত হয়ে বসে আছে। বিরবির করে কিছু বলছেও হয়তো।কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আশমিন বোঝার চেষ্টা ও করলো না।সে শুধু একমনে নূর কে দেখে গেল।
চোখ বন্ধ করে রুমের এককোনায় চুপ করে বসে আছে নূর।বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা চেপে ধরেছে তাকে।কিন্তু সে কাদছে না।সে জানে, আশমিনের বাজপাখির মতো নজর এখন তার উপরেই।তাই তার সামনে কোন ভাবেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করবেনা সে। চার বছর আগের আশমিনের একটা কথাই তার কানে বার বার বেজে যাচ্ছে,
— যে মেয়ে নিজের বাবার ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে না সে আমার ভালোবাসার মূল্য দিবে কিভাবে।বাবার মৃত্যু থেকে যার ক্যারিয়ার বড় সে মেয়েকে আমি আমার জীবনে চাই না। দেখা গেলো আমাকে মৃত্যু মুখে রেখে সে নিজের স্বপ্ন পুরন করতে চলে গেলো। এই নূর কে আমি ভালোবাসি নি।তাই এই নূরের জায়গা আমার জীবনে নেই। গো টু হেল উইথ ইয়োর ফা*কিং ড্রিম।
চোখ খুলে ফেললো নূর।বাবা নেই ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসলো তার।এই পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই।সে একা।মহাকাশের এক বিন্দুর মতো সে একদম একা।আশমিন পুরনো ঘা তাজা করে দিয়েছে তার।তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো নূর।যে তাকে তখন বোঝে নি সে আজ আর কি বুঝবে?ভালোবাসি বললেই হয় না। বিশ্বাস করতে হয়,ভরসা করতে হয়।শুধু ভালোবাসা কখনোই টিকে থাকে না। আশমিন সেদিন তার বিধ্বস্ততা দেখে নি।তার ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়া ভঙ্গ হৃদয় দেখে নি।সে শুধু তার ভুল দেখেছে।তাকে এতো বড় পৃথিবীতে সম্পুর্ন একা ছেড়ে দিয়েছে।সদ্য বাবা হারানো মেয়েটা কে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা দিয়েছে।আশমিন কে আর যাই হোক ক্ষমা করা যায় না।এবার আশমিন বুঝবে ভাঙ্গনের যন্ত্রণা কাকে বলে। আমি তোমাকে বোঝাবো নিঃসঙ্গতা কাকে বলে। ক্ষমতার খুব বড়াই না তোমার? দেখি কতো ক্ষমতা তোমার। কামিনী চৌধুরী এবার বুঝবে তেহজিব কি জিনিস।মায়ের কুৎসিত চেহারা সহ্য করতে পারবে তো আশমিন জায়িন। উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো নূর।
রুমের মধ্যে পায়চারি করে যাচ্ছে কামিনী চৌধুরী। নূর কে এখানে সে একদম সহ্য করতে পারছে না।ভাইয়ের মেয়ে হলে কি হবে।আস্তো বজ্জাত একটা। এতো বছরের সাজানো প্ল্যান কোন ভাবেই নষ্ট হতে দিবে না সে।আশমিনের মতিগতি ভালো ঠেকছে না।সে জানে,আমজাদ চৌধুরীর কিছু হয় নি।বিয়ে বন্ধ করতেই আশমিন এই নাটক করেছে।ছেলে কে হাড়ে হাড়ে চেনে সে।অনেক কষ্টে দুজনের মধ্যে দূরত্ব এনেছে। এখন কিছুতেই তাদের কাছাকাছি রাখা যাবে না। এই মেয়েকে যেভাবেই হোক বিদায় করতে হবে।
লাক্সারি কেবিনে শুয়ে আছে আমজাদ চৌধুরি।পাশেই সানভি দাঁড়িয়ে। আশমিন সোফায় বসে নূর কে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। নূরের হাসি বিষাদ কোনটাই চোখের আড়াল হয়নি তার।দুটোর মানেই সে বোঝে। সঠিক সময় আসলে নূর কেও বুঝিয়ে দিবে।