রাতে আমার ঘুম হলো না। সারাদিনে আমার অতোটা ভয় লাগে নি যেটা এখন লাগছে। কেমন যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। ঠিক বোঝানো যায় না। সকাল শুরু হলো টুংটাং আওয়াজে। এই বাড়িতে আজও ভোর থাকতে থাকতে চুলায় রান্না চাপানো হয়েছে। আমাকে বিয়ে করা রাজপুত্তুর এখনো ঘুমিয়ে আছে। আমি বিছানা ছাড়লাম। এলোমেলো শাড়ির খসখস আওয়াজ আর হাতভর্তি চুড়ির টুংটুং শব্দে রাজপুত্তুরের কপালে ভাজ পড়লো। ভোরের আলোয় ভালো করে দেখা হলো। গায়ের রঙ অনেক ফর্সা না। শ্যামলা চেহারা, মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল, ডানদিকের ভ্রু’র কোনায় কাটা দাগ। খুব বেশী রোগা না। চলনে-বলনে খানিকটা সিনেমার নায়কদের মতো। পরী আপা সেই কারণে বোধহয় রাজপুত্তুর বলেছে। আমার কাছে তো কোনোদিক দিয়েই রাজপুত্তুর লাগছিল না। ওনার নাম নাবিদ। চার ভাইবোনের মধ্যে উনি মেজ। এরপর দুজন ছোট বোন আছে। মনি, মুক্তা ওদের নাম। দুজনের সঙ্গে কাল আলাপ হয়েছে। বয়সে আমার থেকে খানিকটা ছোট।
দরজা খোলা দেখে পরী আপা আমাকে ডাকলো।
“জরী, উঠছস?”
আমি শব্দহীন ভাবে বাইরে গেলাম। আপা চোখ কপালে তুলে বললেন,
“আরে বেকুব, এই শাড়ি পরে ঘুমাইছস!”
আমি স্মিত হাসলাম। পরী আপাকে আর বলিনি যে আমি ঘুমাই নি।
আপা নতুন শাড়ি বের করে দিলেন। একরঙা খয়েরী সুতি শাড়ি। আপা বললেন,
“ব্যটা মানুষ বিয়ের বাজার করছে বুঝছস। রঙচঙ ভালো বুঝেনা। ”
মা এলেন আমার কাছে। তাকে বেশ নির্ভার লাগছে। খুশি হয়েছেন নাকি বেজার হয়েছেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মা জিজ্ঞেস করলেন,
“কী খাবি?”
“কিছু না।”
“একী কথা, কিছু খাবি না ক্যান! ”
পরী আপা আমার হয়ে বলে,
“তুমিও না মা! ও তো কিছু খাইতে চাবে না! জানো না, টেনশন হইলে ও কিছু খাইতে পারে না। ”
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বলেন,
“জামাই ঘুমাইতেছে?”
“হু।”
“সহজ হইতে একটু সময় লাগবে। ঢাকার বড় কলেজে পড়ছে। আমাগো মতন তো না। ”
আমি চুপ করে রইলাম। মা আবারও বলেন,
“ওই বাড়িতে গিয়ে মানায়ে নিস। কারোর মুখের উপর কথা বলবি না, শ্বশুর শাশুড়ী যেমন বলবেন তেমন চলবি। বাড়ির যেন বদনাম না হয়। কেউ যেন আঙুল তুলতে না পারে। তোর চাচাজানের মান যেন না যায়।”
মায়ের গলা শুনে মনে হচ্ছে আমাকে বোঝাচ্ছে না, ভয় দেখাচ্ছে। আমি চুপ করে রইলাম। পরী আপা আমার ব্যাগপত্র গুছিয়ে দিচ্ছেন। যেকটা ভালো জামাকাপড় ছিলো সেগুলো ব্যাগে গুছিয়ে দিচ্ছেন। মা আপার উদ্দেশ্যে বললেন,
“বেগুনি রঙের জামা টা ব্যাগে রাখিস না। অরুর জন্য রাখ। ওর ওই জামা টা পছন্দ। ”
পরী আপা বলেন,
“অরুরে তুমি এই রঙের জামা কিনে দিও মা। এইটা জরীর থাকুক।”
মা আর কিছু বলেন না।
**
আমার যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। পলাশবাড়ী ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো কিছুক্ষনের মধ্যেই। দাদার আমলে তৈরী করা এই ঘরে আমার নিজের বলে তেমন কিছু ছিলো না। রুম, পড়ার টেবিল থেকে শুরু করে সবকিছুই অরু কিংবা নিরু আপার সঙ্গে ভাগ করতে হতো। এখন যেখানে যাচ্ছি সেখানেও একজনের সঙ্গে ভাগ করতে হবে। তার সঙ্গে আমার ভালো করে আলাপও হয় নি।
আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছেন পরী আপা। সঙ্গে গোল হয়ে বসে আছে অরু আর ফুপুর মেয়েরা। মা, চাচিমা ব্যস্ত আছেন মিষ্টি, পিঠেগুলো গোছাতে। পরী আপা অতি যত্নে চোখে কাজল পরিয়ে দিচ্ছেন। পলক ফেলে তাকাতেই দেখি আপার চোখে পানি। আপা আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন,
“আজ রাতে নাবিদ যদি তোরে জিজ্ঞেস করে কী চাস তাইলে বলবি যে তুই আরও পড়তে চাস। তোর আরও পড়ার ইচ্ছা।”
আমি হাসি। আপা বলেন,
“একবার বইলা দেখিস। এই সংসারে তো চুপ কইরাই থাকলি। ওইখানে গিয়া অন্তত মুখ ফুঁটে নিজের শখ, আহ্লাদ গুলো বলিস।”
আমি আবারও হাসলাম। আমার এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে গত সপ্তাহে। প্রিন্সিপাল স্যার বাড়িতে মিষ্টি পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে চাচাজানকে বললেন,
“এই মেয়েকে পড়ান, ও যতটুকু পড়তে চায়। ”
চাচাজান অতোটা গুরুত্ব দিলেন না। তার তাড়া ছিলো অতি জলদি আমার বিয়ে দেবার। ততদিনে আমিও বুঝে গেছি সুন্দর হবার খানিকটা জ্বালাও আছে।
***
মা হাপুস নয়নে কাঁদেন। পরী আপা অরু এরাও কাঁদে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম চাচিমাও কাঁদছেন। আমার দুই ননদ কে চাচিমা বলছেন,
“ওরে একটু দেইখো। ও তো এর আগে ঢাকায় শুধু বেড়াইতেই গেছে। ”
চাচাজান আমার মামাশ্বশুর কে বলেন,
“মেয়েটা ভারী লক্ষি। তবুও ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।”
আমি ভেবেছিলাম আমার খারাপ লাগবে না। কিন্তু ভীষণ খারাপ লাগছে। শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো। সবচেয়ে বেশী কষ্ট হলো বাবার চোখে পানি দেখে। এই মানুষ টা’কে সারাজীবন আমি নির্লিপ্ত মুখচোরা মানুষ হিসেবে জেনেছি। সংসারের মারপ্যাঁচ যে বোঝেনা। মেয়েদের সাথে বিশেষ কথাবার্তা বলে না। মাঝেমধ্যে লুকিয়ে এটা সেটা কিনে এনে নিশ্চুপে হাতে গুজে দিয়ে যায়।
জীবনে প্রথমবার আমি উপলব্ধি করলাম যে এই সংসারের মানুষজন আমায় ভালোবাসে। সারাজীবন তিনটি মেয়ে নিয়ে অভিযোগ করে গেছেন যে মা সেই মায়ের চোখের জল আমাকে বুঝিয়ে দিলো ভালোবাসা।
***
পলাশবাড়ী থেকে ঢাকার দূরত্ব আট, নয় ঘন্টার মতো। আমার মামা শ্বশুর জানালেন যে পৌছাতে বিকেল হবে।
আমাদের যাবার ব্যবস্থা হলো গাড়িতে। লক্কর ঝক্কর টাইপের গাড়ি। বিকট শব্দে মাথা ধরে যায়। অন্যরা অবশ্য ট্রেন ধরলো। গাড়িতে আমি, নাবিদ আর আমার মামাশ্বশুর।
২০১৩ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর আমি পলাশবাড়ী ছাড়লাম। সেই সঙ্গে ছেড়ে গেলাম জীবনের অসংখ্য ভালো, মন্দ স্মৃতি।
***
আমার শ্বশুর বিয়েতে যেতে পারে নি। বাড়িতে বিশাল অঘটন ঘটে গেছে। সেই অঘটনের খবর পেলাম পথেই। শাশুড়ী মা বরন করে ঘরে তুললেন। আত্মীয় স্বজন রা সবাই এসেছে বউ দেখতে। সেই সঙ্গে বাড়ি থেকে কী দিলো, না দিলো সেসব নিয়েও গুঞ্জন হলো খানিকক্ষণ। শাশুড়ী মা চাপা গলায় বললেন,
“আমাদের কিছুর দরকার নাই। নাবু’র জন্য আমার দরকার ছিলো সুন্দর বউয়ের। আর কিছু লাগবে না। এমনিতেই বড় ঘরের মেয়ে একবার এনে কম জ্বলতেছি না। ”
আমার দুই ননদ কে বাড়িতে বসে তেমন দেখার সুযোগ পাই নি। এখন সঙ্গেই আছে। দুজন পিঠেপিঠি। আমাকে এটা সেটা এগিয়ে দিলো। বলল, কিছু লাগলে যেন ডাকি।
বাড়িতে ঢোকার পর নাবিদ কোথায় যেন গেল। গাড়িতে বসে আমার সঙ্গে ভালোভাবেই কথা বলেছে। গতকালের মতো কঠিন গলায় কিছু বলে নি। স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি ঠিক আছ?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
“গাড়িতে উঠলে তোমার মাথা ঘুরে?”
আমি চুপ করে রইলাম। আমি গাড়িতে জার্নি করতে পারি না। অল্প কিছুক্ষনের পথ হলেও খারাপ লাগে।
“জরী তোমার কী খারাপ লাগছে? ”
আমি এবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
নাবিদ মামাকে ডেকে বললেন,
“মামা পানির বোতল টা দেন তো। জরীর খারাপ লাগছে, গাড়িটাও একটু আস্তে চালাতে বলেন।”
এই বাক্য দুটো আমি কোনোদিন ভুলে যেতে চাই না। সারাজীবন মনে রাখতে চাই।
চলবে….