গত কয়েক দিন এনজিওতে আসতে না পারায় অর্কের অনেক কাজ জমে গেছে।হাতে থাকা ঘড়িটায় বারবার তাকাচ্ছে আর ফাইলে কিছু লিখছে।অনেকটা রাত হয়ে গেছে তাই অয়নকে দিয়ে তনিমা আর কলিকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।দিহাদ অর্ককে ছাড়া বাসায় ফিরবে না।তাই দিহাদও অর্ককে সাহায্য করছে যাতে করে হাতের কাজ গুলো একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে বাসায় ফিরতে পারে।অর্ক কয়েকবারই দিহাদকে চলে যেতে বলেছে কিন্তু ও যায় নি।হাতের কাজ প্রায় শেষই হয়ে এসেছে।আর একটা ফাইল বাকি।অর্ক ফাইলের উপর দৃষ্টি রেখেই বললো,
– তোকে যে কাজটা দিয়েছিলাম সেটা করেছিলি?
দিহাদ আমতা-আমতা করে বলে,
– আসলে আমি কিরণ চৌধুরীর ঠিকানা জোগাড় করতে পারি নি।
দিহাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে অর্ক ধীর কন্ঠে বলল,
– আমাকে আগে বললি না কেন?
– তোকে বললে তো তুই অসুস্থ শরীর নিয়েই ওকে খুঁজতে চলে যেতি।
– তো?
ভাবলেশহীন ভাবে বললো অর্ক।দিহাদ কপালে চিন্তার ছাপ ফেলে বললো,
– আচ্ছা আমাকে একটা কথা বল তো অর্ক।
– বল!
– তুই ওই কিরণ চৌধুরীর পরিচয় নিয়ে কেন পড়ে আসিস?ওই মেয়ে তো এই দেশে থাকে না অব্দি।কয়েকদিন হলো এসেছে আবার কয়েকদিন পরে হয়তো চলেও যাবে।
– একজন সেলিব্রিটির সম্পর্কে হালকা পাতলা খুঁজ খবর নেওয়া খারাপ না তো।
– এই মেয়ে আদৌ কোনো মানুষ তো রে ভাই?নাকি কোনো জ্বিন পরী?না জানি চেহেরা দেখতে কেমন।আমার তো মনে হয় ওই মেয়ের চেহারাই ভালো না!হয়তো কুৎসিত বলেই নিজেকে ওমন সবার থেকে আড়াল করে রাখে সব সময়।কিন্তু মেয়ের কন্ঠ মাশাল্লাহ।শখের বসেই হয়তো গানটা করে।হবে হয়তো কোনো ধনীর দুলালি!শুনেছি শো-কনসার্ট থেকে উপার্জিত অর্থের দুই ভাগই নাকি ডোনেশন দিয়ে দেয়!আমি নিশ্চিত এই মেয়ে কোনো মানুষ না!নির্ঘাত কোনো জ্বিন পরী বা অশরীরী আত্মা!মানুষ বেশে ঘুরে বেড়ায়।নয়তো কোনো ভ্যাম্পায়ার?তা না হলে এই মেয়ে রাত বেরাতে শো-কনসার্ট করে বেড়ায় কেন?আরে ভাই তুই মেয়ে মানুষ,তোর কেন এত সাহস থাকবে?তুই দিনে কনসার্ট কর।দিনে স্টেজ শো কর।সন্ধ্যার আগে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে যা!তা না তুই রাতের বেলা টইটই করে ঘুরে বেড়াস আর হাজারো ছেলের মাথা চিবিয়ে খাস!
দিহাদ শেষের কথাটা অর্কের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলে।অর্ক এতক্ষণ চুপচাপ দিহাদের কথা শুনছিল আর ওর কাজ করছিল।হাতে থাকা ফাইল সহ টেবিলের উপর রাখা সব গুলো ফাইল সুন্দর মতো করে ঘুচিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
– শুনেছি চাঁদেরো নাকি কলঙ্ক আছে!কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি সূর্যের কিরণের কোনো কলঙ্ক নেই!
অর্কের কথা বোধগম্য হলো না দিহাদের।কিন্তু অর্ককে বুঝতে না দিয়ে অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে বললো,
– ওইহই সূর্য মশাই কি প্রেমে পড়লো নাকি শেষ পর্যন্ত?
– কিরণ সূর্যেরই হয়!সূর্য ছাড়া কিরণের কোনো অস্তিত্ব নেই!কিরণকে কিরণ নিতে হলে এই সূর্যের কাছেই আসতে হবে।
দিহাদ হা করে অর্কের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
– কিন্তু এই সূর্যটা আবার কে?
– আমি?
অর্কের ঝটপট উত্তরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় দিহাদ।বুঝতে না পেরে বললো,
– মানে?
অর্ক শক্ত হাতে দিহাদের গাল টিপে আহ্লাদী গলায় টেনে টেনে বললো,
– আরে গাধা,অর্ক নামের অর্থই হলো সূর্য!
দিহাদ অর্কের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,
– তাহলে এর মানে কি দাঁড়ালো?
অর্ক দিহাদের কথায় মুচকি হেসে বলে,
– তোর এত মানে বুঝে কাজ নেই।চল বাসায় চল।
_________________
প্রতিদিনের মতো অর্ক আজো বাড়ি ফিরে সোজা ওর রুমে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে ঘড়ির কাঁটা একটার উপরে।সেই যে সকালে মেহেনূরদের বাড়ি থেকে খেয়ে বেড়িয়েছিল এর পর থেকে আর কিচ্ছু খাওয়া হয় নি।এখন ঠিকই প্রচন্ডরকম খিদে পেয়েছে কিন্তু খেতে মন চাইছে না।যে ছেলেকে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে না দিলে আয়েশা বেগমের মন শান্ত হতো না এখন সেই ছেলেকে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দেওয়া তো দূর ভালো করে কথা বলেন না।ছেলে কি আদৌ খেলো নাকি খেলো না এটা নিয়েও উনার বিন্দুমাত্র কোনো মাথা ব্যাথা নেই।পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে অর্ক না খেয়েই শুয়ে পড়ে।পরক্ষণেই হুড়মুড় করে উঠে বসে।ওর রুমে আসার সময় ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে কাউকে বসে থাকতে দেখেছিল।রুমের লাইট অফ ছিল বলে বেশি খেয়াল করে নি।চোখ ছলছল করে উঠে অর্কের।মনে পড়ে যায় রাত জেগে অপেক্ষারত মায়ের কথা!ছেলের জন্য রোজ না খেয়ে বসে থাকতেন আয়েশা বেগম।ছেলেকে খাইয়ে তারপর উনি খেতেন।এ কদিনে এই অভ্যাসটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল মা ছেলে দুজনেই।বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অর্ক।দ্রুত পায়ে ডাইনিং রুমে চলে যায়।মায়ের অবয়ব দেখে হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে একটা চিনচিন ব্যাথা অনুভব হয় অর্কের।অভিমানের পাহাড় গলে পানি হয়ে যায় নিমিষেই। অর্ক সুইচ টিপে লাইট অন করতেই চমকে উঠেন আয়েশা বেগম।হুট করেই মাথা তুলে পাশে তাকিয়ে আধখোলা চোখে বলেন,
– খোকা এসেছিস?
অর্কের বুকের ভেতর ধুক করে উঠে।মায়ের মুখের কত সুন্দর কত মুধর এই শব্দ।লাস্ট কবে মা ওকে এই শব্দে সম্মোধন করেছে ওর মনেই নেই।হয়তো দুজনের মধ্যে এই দূরত্বের কারণটা ঔ।ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মায়ের মাথা আলতো হাত রেখে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে,
– তুমি এখনো জেগে আছো কেন?
– ছেলে বাইরে থাকলে মায়ের চোখে বুঝি ঘুম আসে?
অভিমানী সুরে কথাটা বললেন আয়েশা বেগম।অর্ক মায়ের মাথাটা ওর বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।ছেলের এই ব্যবহারে আয়েশা বেগম মোটেও অবাক হন নি।আকাশে মেঘ করলে এক সময় না এক সময় বর্ষণ হবেই।তাই প্রস্তুত ছিলেন।মনে মনে ছেলের কান্নাকাটি করাটা সহ্য করতে না পারলেও মুখে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
– হয়েছে থাম এবার।কান্নাকাটি করার অনেক সময় পাবি!এখন খেয়ে নে তো।
মায়ের কথায় চোখ মুখ মুছে আয়েশা বেগমের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে অর্ক।কান্না করার ফলে হেচকি উঠে গেছে।আয়েশা বেগম ভাত মেখে একেক লোকমা ছেলের মুখে তুলে দিচ্ছেন আর অর্ক পরম তৃপ্তিতে খাচ্ছে।ক্ষনে ক্ষনে ফুলিয়ে উঠছে অর্ক।ছেলের এই অবস্থা দেখে আয়েশা বেগম মুখ টিপে হেসে বলেন,
– ছোটবেলার ছাপটাই তো এখনো যায় নি আর এই ছেলে কিনা করবে সংসার!
মায়ের কথার মানে বুঝতে না পেরে বিস্মিত হয়ে তাকায় অর্ক।অর্কের প্রশ্নসূচক দৃষ্টি দেখে আয়েশা বেগম বললেন,
– তোমার জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে।তোমার বাবা চান এই বছরই বিয়েটা করে তুমি সেটেল্ড হও।
– কিন্তু মা…..
– তোমার বাবা এও বলেছেন,তোমার যদি কোনো পছন্দ থাকে তাহলে বলতে পারো।
অর্ককে বলতে না দিয়ে ওর মুখে খাবারের অবশিষ্ট লোকমাটা তুলে দিয়ে কথাটা বললেন আয়েশা বেগম।অর্ক কি বলবে বুঝতে পারছে না।মুখের খাবারটা শেষ করে পানি খেয়ে চুপচাপ বসে আছে।অনেক্ষন ছেলের কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে আয়েশা বেগম বলেন,
– কাউকে ভালোবাসি তুই?
অর্ক ওর মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে উঠে সোজা ওর রুমে চলে যায়।আয়েশা বেগম হতভম্ব হয়ে অর্কের চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন।ছেলের কাছ থেকে আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে যান আয়েশা বেগম।অর্ক রুমে পাইচারি করছে।মস্তিষ্কের নিউরনগুলোয় ঝংকার পড়েছিল এতদিন।ওর বাবা মা যে ওর বিয়ের কথা ভাবছে সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না ও!কিন্তু তাঁদেরও তো দোষ নেই।ছেলে বড় হয়েছে।ফরজ কাজটা সেড়ে ফেলা তাঁদের দায়িত্ব।উনারা তো ওর মতামতই জানতে চাইছে।
কিন্তু মায়ের প্রশ্নের উত্তরে ও কি বলবে?যাকে ও ভালোবাসে সেই তো জানে না!তাহলে ও ওর মা বাবাকে কি বলবে?এটা বলবে,আমি একজনকে ভালোবাসি কিন্তু সে জানে না যে,আমি তাকে ভালোবাসি!এটা বললে তো আমাকেই হাসির পাত্র হতে হবে।তাহলে কি আমি ওকে হারিয়ে ফেলবো?কথাটা ভাবতেই শিউরে উঠে অর্ক।না না এটা তো আর হতে দেওয়া যাবে না।ওর হৃদয় গহীনে যার বসবাস তার জায়গা ও কাউকে দিতে পারবে না,কাউকেই না!কিন্তু যাকে ও এতটা কাছে চায় সে তো ওর ধরা ছোঁয়ার বাইরে।কত চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই ওর লাগাল পাচ্ছে না।অর্ক হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে!নিজের মাথার সব চুল ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।চলে যায় ব্যালকনিতে।আজ যে নেশাক্ত জিনিসটা বড্ড টানছে ওকে।পুরো ব্যালকনিটা সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলি বানিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে।গলায় খুশখুশ করতেই ক্ষণে ক্ষনে কেশে উঠছে।চোখ লাল হয়ে গেছে।ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে তাও বেখেয়ালি মনে ধোঁয়া উড়িয়েই যাচ্ছে।রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে চোখে।চোখ টেনেও খুলে রাখতে পারছে না।আধখোলা চোখেই হতাশ কন্ঠে বললো,
নারী তুমি বড়ই রহস্যময়ী!
ধরা যদি নাই বা দেবে তুমি,
তবে কেন করলে আমার মন চুরি!
আমি হলাম আরেক বোকা,
চোর ধরা কি চাট্টিখানি কথা!
ভালো ছিলাম!ভালোই ছিলাম বুঝি?
তবে কেন তোমায় খুঁজি?
প্রশ্ন করি আমি!
আর কতকাল থাকবে শুনি,
এই অদমের অগোচরে তুমি!
চলবে…