অপেক্ষা – মাহা আরাত | পর্ব – ২৫

14 Min Read

‘হয়েছে কি হোমাপাখি!তালিম চলাকালীন একটাবারও আপনি আমার দিকে তাকাননি।কেন?’

হাফসা তাও নিরুত্তর।

আরহাম এবার হাফসার গালে আলতো হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বললেন, ‘উমায়ের,আমার দিকে তাকান তো।’

হাফসা তাকালো।তবে ওর দৃষ্টি ছিলো নিরস।

আরহাম হাফসার চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘আচ্ছা আমি কি কোনো ভুল করেছি!আপনি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন কেন?’

‘কিছু না ঘুমাবো।’

‘আই আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যা ল্যাঙ্গুয়েজ ওফ ইউর আইস।আমার ওপর রাগ,অভিমান কেনো হুম?’

হাফসা বললো না।আরহাম ওকে লাগাতার জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছেন কিন্তু হাফসা চুপ হয়ে আছে।ব্যর্থ হয়ে আরহাম ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রইলেন।ভাবতে থাকলেন, কীভাবে কষ্ট দিয়েছেন উমায়ের কে।মনে তো পরছে না কিছু।উমায়ের কখনো এমন একরোখা রাগ করে থাকেননি এর আগে!দেট মিনস সামথিং সিরিয়াস!

বেশ সময় কাটলো নিরবতায়।এতক্ষণে হাফসা চোখ তুলে তাকালো আরহামের দিকে।সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো দূজনের।
হাফসা মলিন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘এ রুমে ঘুমাবেন?’

আরহাম কিছু বললেন না।শুধু চেয়ে রইলেন।হাফসা চোখ নামিয়ে নিলো।বিছানা গুছাতে যেতে চাইলেই হঠাৎ আরহাম এসেই জড়িয়ে ধরলেন হাফসাকে।একেবারে মিশিয়ে নিলেন বুকের মাঝে।মাথায় ওরনার ওপর আলতো চুমু খেয়ে বললেন, ‘উমায়ের।বলুন কেন কেঁদেছেন আপনি?

হাফসা চমকালো।কান্নার চাপ্টার তো অনেকক্ষন আগেই ক্লোজ করে দিয়েছে।চোখও শুকনো।আগ্রহ ভরা গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি বুঝলেন কী করে?’

‘চোখ দেখে বুঝেছি।কেনো কেঁদেছেন?’

‘এমনিই।’

‘আমি যে কিছু একটা ভুল করেছি সেটা তো বুঝতে পারছি।আপনি বলুন কি করেছি আমি?হাউ ডিড ইউ সাফার?’

‘আমার মা-বাবা নেই।কিন্তু কাকামণি তো আছেন।উনিই তো আমার বাবা।’

বুকচাপা কষ্ট নিয়ে কথাটা বলতেই হু হু করে কান্না চলে আসে হাফসার।আরহাম জিভ কাটলেন।ঠিকই তো!ভুলটা তো উনার মস্ত বড়ো।আরহাম এবার ওকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বললেন, ‘আই এম সরি ভেরী সরি।’

অতপর হাফসার চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কাল-ই যাই?’

হাফসা খুশি হয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ। কিন্তু আরহাম কে অভিমানের সুরেই বলল, ‘দরকার নেই।বাবার বাড়ি ভুলে গেছি আমি।’

আরহাম ওর মুখ তুলে অপরাধী সুরে বললেন, ‘এই যে কানে ধরলাম।বুল হয়েচে আমার।খমা করে দিন।’

আরহামের এমন মশকরায় হাফসা ফিক করে হেসে ফেললো।জিজ্ঞেস করলেন,

‘আচার খাবেন।খাইয়ে দিবো?’

‘কাল খাবো।’

‘ওকে।’

ড্রিম লাইট দিয়ে দূজনে ঘুমাতে গেলেন।আরহামের বুকে হাফসার মাথা।হাফসার সিল্কি চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে তিনি বললেন, ‘আপনাকে কাল বাড়ি দিয়ে আসি।আমাকে তো তারাবিহ পড়াতে হবে না তাই না?’

হাফসা ভাবতে থাকলো।এরই মধ্যে আরহাম নিজের মতামত পাল্টে বললেন, ‘না না। হবে না।আলাদা থাকা যাবে না।আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আপনাকে না দেখলে আমি অস্থির হয়ে যাই,সেখানে দূরে থাকা অসম্ভব।নেভার।’

‘তাহলে আমি যাবো না?’

‘আপনি যাবেন।আর আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।দুটোর সমাধান একসাথে দিন।’

‘আপনি আমার সাথে থাকবেন।’

‘উহু,হুট করে সব ফেলে যাওয়া ও সম্ভব নয়,আর নামাজ তো পড়াতে হবে।’

হাফসা গভীর ভাবে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, ‘আমি জানি না।আমিও আমার বাড়ি যাবো।আপনিও আমার সাথে থাকবেন।নামাজও পড়াবেন।এখন কীভাবে কি করবেন আমি জানি না।’

আরহাম মুচকি হাসলেন,
‘এই কারণে কান্না করতে করতে চোখ মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন।আমাকে একবার বলা যেতো না?’

‘আমাকে কেন বলতে হবে?আপনি বুঝেন না?আপনার দায়িত্ব না?
আরহাম প্রত্যুত্তুর করলেন না।কথার ভান্ডার যে শূন্য এ পর্যায়ে!

38★

৭২
ভোরের আলো যখন আস্তে আস্তে ফুটতে শুরু করছে তখন হাফসা বেঘোর ঘুমে।আরহাম মুচকি হেসে বিছানার পাশের টুলটা থেকে উঠলেন।পর্দা সরানোর জন্য হালকা রোদের ঝলক এসে ঠিক হাফসার নাকে আর গালে পড়ছিলো,কি মায়া লাগছিলো তাকে দেখতে।নামাজ পড়েই ঘুমিয়ে গিয়েছে সে।আর এতক্ষণ চোখ জুড়িয়ে তাকে দেখছিলেন।এত ঘুম যে কোথা থেকে আসে!

টেবিল থেকে ফোন আর ঘড়িটা হাতে নিয়ে আরহাম দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে আসলেন।নিচে নামতে শোনলেন,মাইমুনা তিলাওয়াত করছেন।আরহাম নিজের রুম থেকে ল্যাপটপ আর কিচেন থেকে এককাপ চা বানিয়ে ড্রয়িং এ বসলেন।এ মাসে কিছু নতুন প্ল্যান আছে উনার।নতুন একটা ম্যাপ ডিজাইন করা হয়েছে।শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা মসজিদ বানানোর কাজ শুরু করবেন।গ্রামটা খুব নিম্নমানের।সেখানের মসজিদ গুলো ছন পাতা,আর সুপারির কাঠ দিয়ে।এ গ্রাম নিয়ে আরও প্ল্যান থাকলেও আপাতত মসজিদের কাজটা শুরু করতে চাচ্ছেন আরহাম।

হঠাৎ টেবিলে শব্দ শুনতে পেয়ে তাকালে দেখলেন মাইমুনা পানি খাচ্ছে।আরহাম কিছু একটা বলতে গেয়েও থেমে গেলেন।

মাইমুনা যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন ডাক দিলেন, ‘বাগানে যাবেন?’

মাইমুনা চমকে ফিরে তাকালো।ও ঠিক শুনেছে তো!যেখানে এক ঘরে থেকেও আরহাম প্রয়োজন ব্যাতীত কথা বলতেন না সেখানে একথা বললেন উনি?মাইমুনা যখন চমকে একধ্যানে তাকিয়েই ছিলো আরহামের দিকে তখন আরহাম এসে কোলে উঠান তাকে।সেই অসম্ভব সুন্দর আঁতরের সুগন্ধি টা নাকে ভাসলো মাইমুনার।

বাগানে ব্রেন্চে নিয়ে বসিয়ে আবার চুপচাপ বসে থাকলেন।

দূজনেই চুপচাপ।আরহাম হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘সামন দেখেন,একটা ছোট্ট গাছ।সবে কলি ফুটেছে। মাএ দূটো কলি।’

‘হুম।’

‘গাছটা কিন্তু তাঁর শাখা দিয়ে যত্নে রেখেছে সদ্য ফোঁটা অসম্পূর্ণ ফুল দূটাকে।দূটো ডালই কিন্তু কাছাকাছি।মাঝে মাঝে সংঘর্ষের ফলে দূটোতে আঘাত লাগে,কেউ সজীব থাকে।কেউ নেতিয়ে পড়ে।’

মাইমুনা নিরুত্তর।

‘গাছটা আবার অক্সিরাইব করে,নিডেড ইলিমেন্টস দিয়ে আবার দূজনকে সারিয়ে তুলে।আবার ওই পাশের ডালটা অন্য ছোট ডালটাকে আঘাত করে,সে প্রত্যুত্তর করে না,সে নড়ে না।দূর্বল হয়।অথচ তাঁরও ক্ষমতা আছে ডালটাকে আঘাত করার।বাতাসের দমকা কিন্তু এদিকেই আসে।কিন্তু সে সরে যায়।অত:পর কিছুসময় চুপ থেকে বললেন, ‘অথচ তাঁরা কিন্তু মিলেমিশে থাকতে পারতো।’

মাইমুনা মাথা নত করলেন।এরচেয়ে লজ্জার কি হতে পারে স্বামীর কাছে?দূটো ফুলির কলি দিয়ে যে আরহাম মাইমুনা-হাফসাকে বুঝিয়েছেন তা আর মাইমুনার বুঝতে বাকি নেই।আর উনার শেষ কথাটা অসহনীয় আক্ষেপের!প্রতিদিন তালিমে ওয়াহিদা-মাসনার প্রতি কেমন ব্যবহার করতে হয়,কেমন বিরোধিতা করলে কেমন শাস্তি এই টপিকটা আরহাম প্রতিদিনই রাখেন।এই বিষয়ে কথা বলার সময় উনার দীর্ঘক্ষনের দৃষ্টি মাইমুনার ওপরই নিবন্ধ থাকে।মাইমুনা বুঝে,আরহামের এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য সে নিজেই।

আরহাম এখন অন্যমনষ্ক।কাঠগোলাপের গাছটা তাদের পাশেই।দমকা হাওয়ায় একটা কাঠগোলাপ গাছ থেকে মাটিতে পড়ার আগেই তা ক্যাচ করে নেন আরহাম।হাতে নিয়েই মাইমুনার হাতে দিলেন।

আবারো কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভেতরে যাবেন?’

‘পরে যাব।’

‘আচ্ছা, কিছুক্ষণ পর এসে নিয়ে যাব।’

বলে আরহাম চলে গেলেন।ঘরে উঠার আগে যেতে যেতে কাজলকে বললেন, মাইমুনার পাশে থাকতে।

মাইমুনার চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরতেই তা সাথে সাথে মুছে নেয় সে।কই প্রতিটা সকাল আরহাম মাইমুনার সাথে কাটাতেন।কত দুষ্টুমি, কত খুনসুটি ভালোবাসা ছিলো।হাফসা আসার পরও আরহাম ঠিকই মাইমুনাকে সময় দিতেন।অথচ এখন উনি পুরোপুরি চেইন্জ।এই চেইন্জ হওয়ার কারনও মাইমুনা বুঝে।তাঁর লজ্জিত কৃতকর্ম।

কল্পনায় সে দেখলো,’আরহাম যতনে কাঠগোলাপ গুজে দিচ্ছেন মাইমুনার চুলের ভাঁজে।কপালে চুমু দিচ্ছেন। হাতে হাত রেখে রেখে কথা বলছেন,মাইমুনার কোলে মাথা রেখে আয়েশা (রা:),খাদিজা (রা:) এর সাথে নবীজির (সা:) খুনশুটির কাহিনি শোনাচ্ছেন।কত কি!হ্যাঁ আরহাম সত্যিই এমন করতেন।এখন তো এসব মুহুর্ত স্বপ্ন বটে!

আরহাম আয়নায় যখন পাগড়ি ঠিক করছেন ঠিক তখনই হাফসার ঘুম ভাঙ্গে।আয়নায় হাফসাকে দেখে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘুম ভাঙ্গলো আপনার?’

হাফসা তড়িঘড়ি করে উঠে বলে, ‘ক টা বাজে?’

‘সাড়ে দশটা।’

সে অবাক হয়ে বলে, ‘এতক্ষণ ঘুমালাম আমি?কীভাবে? এত তো ঘুমাই না।’

‘ঘুম ভালো হয়েছে তো?’

‘আলসেমি লাগছে।’

আরহাম ফিরে এসে হাফসার দূগাল দু’হাতের আজলায় নিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললেন, ‘একটা রিকুয়েষ্ট রাখবেন?’

‘বলুন।’

‘যাস্ট ফর ওয়ান টাইম,প্লিজ সে ❝ইউ লাভ মি।❞

আরহামের হঠাৎ এমন আবদারে হাফসা চমকালো।লজ্জা এসে ভর করলো ওর মাঝে।হাফসা আরহামের হাত ছাড়িয়ে নেয়,ওর নিজেকে গুটিয়ে নিতে দেখে আরহাম হাসেন।

বললেন, ‘আচ্ছা,আমার এত সৌভাগ্য নেই।যেতে হবে।’

‘আজ এত দেরি?’

‘আপনার ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষায় ছিলাম।’

‘ডাকলে পারতেন।’

‘রাতে মাথাব্যাথার ওষুধ খেয়েছিলেন,এজন্য ঘুমাচ্ছিলেন।তাই ডাকিনি।’

‘আম্মু কি কিছু বলেছেন? ‘

‘কখনো কি বলেন কিছু?’

‘জ্বী না আমি ওভাবে বলিনি।’

‘আচ্ছা, আসি।’

হাফসাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে বিদায় নিয়ে একটু তাড়াহুড়োয় যখন বের হচ্ছিলেন,তখনি ড্রয়িং রুমের উপস্থিত ব্যক্তিটাকে দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছলেন আরহাম।

অদ্ভুত ‘সে’ চশমার আড়াল থেকে আরহামকে দেখে ফিচেল হাসলো।অধৈর্য সেই মেয়েটি তো এই যুবকের প্রহর গুনছিলো এতক্ষণ!

39★

৭৩
আদওয়া এক আকাশ ক্ষোভ নিয়ে তাকালো আরহামের দিকে।নিজেকে কি মনে করেন উনি।আমার সামনেই আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরোলেন,অথচ আমার দিকে দ্বিতীয় বার ফিরেও তাকালেন না।

‘তুমি বসো।’

‘জ্বী।’

‘আমার একজনই ছেলে আরহাম।এই যে গেলো।’

‘মেয়ে নেই?’

‘আছে তিনজন।’

‘কোথায় উনারা?’

‘একজম ইংল্যান্ড, বাকি দূজন ঘরে।তুমি একটু বসো।আমি আসছি।’

মিসেস আফসানা গিয়ে নাস্তা বানিয়ে তাকে নিজের রুমে নিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করার একপর্যায়ে বললেন, ‘তুমার বাসায় কে কে আছেন?’

‘আম্মু,আব্বু,আমি ভাই।’

আদওয়া ঠোঁট উল্টে চেয়ে রইলো কাবার্ডের ওপরে রাখা ছবির এলবামটায়।আরহাম দূপাশে উনার আব্বু আম্মুকে জড়িয়ে সেই হাসিমাখা একটা ছবি।যার জন্য আসা তাকে তো দেখা যাবে না।

আদওয়ার সাথে স্কুল ব্যাগ।সে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলাতে ঝুলাতে বলল,’আচ্ছা আজকে আসি আন্টি।আমার ক্লাস আছে।’

‘উহু,যাবে কেন?ইফতার করে যাবে।’

সে থাকলো না।নানান বাহানায় বলল,তাঁর স্কুৃলটা এদিকেই।সময় পেলেই আসবে মাঝে মাঝে।

******
দুপুরবেলা নানা দ্বিধা দন্দে পড়তে পড়তে আরহামের ফোনে কল দিয়েই দিলেন মাইমুনা।প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস প্রয়োজন।আরহামের কড়া আদেশ,বাসার বাহির ছাড়া একা কোথাও বের হওয়া যাবে না।সব দরকারি জিনিস থেকে সপিং টা পর্যন্ত ভার্চুয়ালেই করতে হয় তাদের।

দূবার রিং হলো,কিন্তু ফোন তুললেন না।একরাশ হতাশা আর বারকয়েক দীর্ঘশ্বাসের পর মাইমুনা যখন বেলকনিতে উনাদের আগের সুন্দর মুহুর্ত স্মৃতিচারণ করছিলেন,তখনি কল বেজে উঠে।অধরে হাসি ফুটিয়ে রুমে এসে যখন ফোন তুললেন, দেখলেন রুদ্রের কল।

কল ধরতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে ভুলে গেলি?’

‘না,তুমিই তো নিঁখোজ মামা।’

‘হাফসা বাসায়?’

‘হ্যাঁ,কেন?’

‘দেখতে মন চাইছে।তিনদিন পর চলে যাচ্ছি আমি।’

‘কোথায়?’

‘যেখান থেকে আসছি সেখানেই।’

‘এত তাড়াতাড়ি?’

‘আচ্ছা হাফসা কি ইন্টারমিডিয়েট শেষ করবে না?’

‘ভর্তি আছে তো।কিন্তু বাইরে যায় না’

‘কোনো প্রয়োজনেও না?’

‘না,সানডে হয়তো যাবে গতদিন বলছিলো।’

ফোনে ভাইব্রেশন শুনে মাইমুনা ফোন তুলে দেখলো আরহামের কল।মামার সাথে কথার বিরতি টানতে না টানতেই কলটা কেটে গেল।

এরপরে তিন-চার মিনিট পরে আরহাম কল দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার সাথে কথা বলছিলেন?’

‘ম্ ম মামা।’

‘কেনো?’

আরহামের এমন কাটাকাট প্রশ্নে বিব্রতবোধ করলো মাইমুনা।মামা শুনতেই উনার গলার স্বর কেমন কঠিন হয়ে গেলো।

উত্তর না পেয়ে আরহাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হলো কথা বলুন?আমাকে কি শুনতে পাচ্ছেন না?’

‘প প পাচ্ছি।’

আরহাম ফোন হঠাৎ ই কেটে দিলেন।মাইমুনা আরো বারকয়েক কল দিলো আরহাম তুললেন না।ভয় আর আতঙ্কে সে শব্দযোগে কেঁদে ফেললো।বলা বাহুল্য গত তিন বছরেও আরহামের এতটা কঠিন হোন নি, মাইমুনার সাথে, যতটুক এখন হয়েছেন।

তখুনি দরজায় শব্দ পেয়ে দ্রুত চোখ মুছে নিলো।হাফসা এসে মাইমুনার হাতে একবাটি স্পেশাল চিকেন স্যুপ ধরিয়ে বলল, ‘আপু খেয়ে বলুন তো কেমন হয়েছে,এটা বানাতে হাত পুড়িয়ে আম্মুর গালি খেয়ে আসছি।’

মাইমুনা অগোচরে চোখ মুছে একচামচ মুখে নিয়ে বললেন, ‘ভালো হয়েছে।’

‘সব ঠিক আছে?’

‘হুমম।’

হাফসার থেকে ভেজা চোখ লুকাতে যখন দৃষ্টি এদিক ওদিক লুকাচ্ছিলেন,তখন হঠাৎ দেখলেন হাফসা ব্যাথিত চেহারায় উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উনার দিকে।মাইমুনা চোখ নামিয়ে নিলেন।

‘আ্ আপু মন খারাপ আপনার?কেঁদেছেন?’

মাইমুনা ভাঙ্গা গলায় উত্তর দিলেন ‘না।’

হাফসা বুঝলো মাইমুনা একা থাকতে চাইছেন। অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে প্রবেশ অনুচিত ছিলো।হাফসা যখন চলে যাচ্ছিলো মাইমুনা ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলেন,

‘এ মেয়ে টাও ‘শাহ’ এর স্বভাব পেয়ে গেছে।শাহ ও কিছুক্ষণ চোখের দিকে তাকান প্রথমে,তারপর ব্যাথিতস্বরে জিজ্ঞেস করতেন, ‘আমার হানির মন খারাপ?কেঁদেছেন?’
ইসসসস..কতদিন উনার মুখে ‘হানি’ ডাকটা শোনা হয় না।

হাতে থাকা স্যুপের বাটিতে কিছুক্ষণ দৃষ্টি রেখে হালকা হাসলেন।মাইমুনার এই ব্রেক টাইমে মেয়েটা প্রচন্ড কেয়ার করে।সকাল সন্ধ্যা এটা সেটা বানিয়ে খাওয়ায়।কখন কি লাগবে নিজেই এসে জিজ্ঞেস করে।

আরহাম আজ সন্ধ্যার আগে আসলেন না।অথচ প্রতিদিন আসরের পরেই বাসায় ফিরেন।হাফসা কল দিলে উনি শুধু বললেন , ‘ইফতার বাইরে করবো।’

ব্যাসসস আর কোনো শব্দও উচ্চারণ করেন নি।

মোনাজাত শেষে আযান পড়লে হাফসা যখন খেজুর মুখে নিচ্ছিলো ঠিক এই মুহুর্ত টা আরহামকে ভীষণ মিস করছিলো,প্রতিদিন মানুষটা নিজে খাইয়ে দিতেন।

আরহাম ফিরলেন ঠিক সাড়ে ন’টায়।হাফসা মাএ তিলাওয়াত সেরে উঠছিলো।উনাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো।হাফসা নিচ থেকে এসে অরেন্জ বানিয়ে উনাকে দিলে,উনি বিনাবাক্যে খেয়ে বলেন,’আমার রুমে তো নামাজ পড়েন না।’

‘ওই রুমের লাইট ফিউজ।অন্ধকার ভয় করে তাই এখানে পড়ছি।’

‘ওহহ।’

হাফসা যখন হাত বাড়িয়ে উনার থেকে গ্লাস ফিরতি নিচ্ছিলো তখন হাফসার হাতে পোড়া দাগ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাতে কি হয়েছে?’

হাফসা হাত আড়াল করে বলে, ‘সামান্য একটু।আমি মেডিসিন লাগিয়েছি।’

‘কিচেনে একটা বেডের ব্যবস্থা করে দিই?’

হাফসা মাথা নিচু করলো।আরহাম সবসময়ই মানা করেন কিচেনের কাজ না করতে।কিন্তু আজ এত কঠিন স্বরে কেন কথা বলছেন?

দরজা পর্যন্ত গিয়েও আবার ফিরে আসলো হাফসা।আরহাম চোখ বন্ধ করে মুখের ওপর কনুই রেখে সোফায় হেলান দিয়ে আছেন।

‘আমি কি কিছু করেছি?আপনি কি রাগ আমার ওপর?’
হাফসার ভয়ে জড়ানো প্রশ্ন শুনে মুখ থেকে হাত সরিয়ে কিছুক্ষণ তাকালেন।বললেন ‘না।’

‘ওহহ।’

‘আর শুনুন ডিনার করবো না।’

‘কেনো?
ন্ ন্ না মানে আচ্ছা।’

হাফসা চলে যেতেই আরহাম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। একজনের রাগ আরেকজনের ওপর মিটানো কি ঠিক?

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।