অপেক্ষা – মাহা আরাত | পর্ব – ২৯

16 Min Read

আরহামের ব্রাউন কালার শার্ট ভিজে চিপকে আছে শরীরের সাথে।চুলে ভ্রু ঢাকা পড়েছে।চুল বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গালে বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ছে।উনি একদৃষ্টিতে দেখছেন হাফসার খুশি,আনন্দ, ছটফটানি!

আকাশের দিকে চোখ বুজে তাকিয়ে হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি ছিটাচ্ছে।

ওর শুভ্র পা জোড়া দিয়ে বৃষ্টির জমা পানি এলোমেলো করছে।ঘুরছে,হাতে পানি জমিয়ে ছিটাচ্ছে, কখনো বা জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি অনুভব করছে।

এসব কিছুর মধ্যে আরহামের দিকে চোখ পড়তে কিছুক্ষণের জন্য তব্দা খেয়ে যায়।উনাকে এত স্নিগ্ধ লাগছে!সুঠামদেহী শরীরের ভাঁজগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।ইচ্ছে করলো,চুলগুলো সুন্দর করে সরিয়ে উনার কপালটা উন্মুক্ত করতে।তবে না করে আবার সে বৃষ্টির ফোঁটা অনুভব করতে লাগলো।

মিনিট পনেরো হবো,ঝুমঝানি বৃষ্টি হচ্ছে।হাফসার খিলখিল করা হাসির শব্দ সাথে আনন্দ টা দেখতে দেখতে হঠাৎ লক্ষ্য করলেন ও মৃদু কাঁপছে।

কোমরে হঠাৎ কারো উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে তাঁর হৃদপিণ্ড ধ্বক করে উঠলো।আরহামের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলেও ফেলার জো নেই।আরহাম একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন ওর ভেজা ঠোঁটে।
গাল বেয়ে পানি গলিয়ে গলিয়ে পড়ছে ঠোঁট থেকে।আরহাম চোখ সরিয়ে নিলেন, আর একটু সময় তাকিয়ে থাকলে উল্টাপাল্টা কিছু একট হয়ে যাবে নিশ্চিত।

ওকে সোজা পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে আসতে জিজ্ঞেস করলো, ”নিয়ে যাচ্ছেন কেন?আরেকটু ভিজতাম।’

‘আপনার বাবা আমাকে ‘জামাই’ থেকে বরখাস্ত করে দিবেন।আমি আবার অসহায় হয়ে যাবো।’

হাফসার হাসি শুনতে শুনতে রুমে পৌঁছলেন।ঘড়িতে ১ টার চেয়ে একটু বেশী বাজছে।

ড্রেস চেইন্জ করে হাফসার ভেজা চুল থেকে পানি তুলে দিচ্ছেন আরহাম।

‘আমাদের যখন বাচ্চা হবে,তাঁরা যেনো আপনার স্বভাব না পায়।কারণ গাল ফুলিয়ে সব অবাধ্য আবদার করবে,আর আমিও ফিরিয়ে দিতে পারবো না।’

হাফসাকে আবারো গাল ফুলাতে দেখলে আরহাম ওর গালে ঠোকা দিয়ে বললেন, ‘ইউর চিক্ ইজ লাইক এ স্ট্রবেরী।এবার ঘোর লেগে যাচ্ছে।’

ঘুমাতে গিয়েও উনার শান্তি নেই।একটু পরপর হাফসার জ্বর আসলো কি না চেক করছেন।এত গরমের মধ্যেও কাঁথা এনে গায়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন।বারবার এসি অফ করছেন।হাফসা উঠে আবার অন করছে উনি আবার অফ করছেন।

এবার এসি অফ করে হাফসাকে আর উঠতে দিলেন না।ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখে বললেন, ‘অনুরোধ, এবার আর অন করবেন না।অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছেন।জ্বর আসলে কত কষ্ট হবে আপনার!’

হাফসার চোখ ছলছল করে উঠলো।এ মানুষটা এত কেয়ার কেন করে!
এখন আবার আরেক সমস্যা একটু পর পর গালে চুমু দিচ্ছেন, কপালে চুমু দিচ্ছেন,হাতে চুমু দিচ্ছেন।

হাফসা হাত দিয়ে উনার ঠোঁট চেপে ধরে রাখলো।আরহাম এসে সেই হাতে চুমু দিলে অসহায় নজরে তাকায় সে!এবার আর ছাড় নেই!

প্রিয়তমার মৌণ সম্মতিতেই তাকে ভুবনভুলানো ভালোবাসায় সিক্ত করলেন। আরহামের উষ্ণ আঁচের ভালোবাসায় হাফসার সব লুকানো মন খারাপ উবে গেল।অজানা এক ভালোলাগা তাকে ঘিরে নিলো।উনার প্রতিটি স্পর্শ ছিল স্নিগ্ধতার,ভালোবাসার!

****
শাওয়ার নিয়ে এসে কমলের ভেতর ঢুকে একনাগাড়ে হাঁচি দিয়েই চলেছে সে।আরহাম ওর সামনে টিস্যুর প্যাকেট নিয়ে বসে আছেন।চোখমুখ লাল হয়ে আছে,হালকা জ্বর আছে।

সাহরি খাওয়ার জন্য মামণির ডাকে আরহাম ওকে স্লিপার এগিয়ে দিলেন।সাহরির টেবিলে বসে খাচ্ছে,আর টিস্যু দিয়ে নাক মুছছে।কিছুক্ষণ পরপর চোখ তুলে দেখছে,আরহামের ওর দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে আছেন।ও বুঝে গেলো,এ জীবনে ওর আর মনখুলে বৃষ্টিতে ভেজার শখ আজই মাটিচাপা হয়ে গেছে।

****
সকালে সাতটায় আম্মুরা রেডি চলে যাওয়ার জন্য।দূদিন পর ঈদ।সবারই বাড়িডে ঝামেলা আছে।আরহাম আর হাফসা ফিরবে বিকেলে।সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আম্মু হাফসার কাছে আসলে দেখেন, ও কমল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে।

কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে আরহাম বললেন, ‘জ্বর এসছে।’

উনি ঘুমন্ত হাফসার কপালে হাত রেখে টেম্পারেচার দেখে বললেন, ‘ঠান্ডা লাগলো কীভাবে?’

‘বৃষ্টিতে ভিজেছেন।’

‘কখন?’

‘রাতে।’

‘দোষ তো তোমার। তুমি ওকে ভিজতে দিলে কেন?’

হাফসা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনছিলো তাদের কথোপকথন। যা একটু জেগে মাকে বিদায় দিবে,আর চোখও খুললো না পর্যন্ত।চোখ খুললেই আরহামের রাগে ‘খাই খাই’ নজরে পড়তে হবে তাঁর।

আম্মু কিছুক্ষণ পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলেন।ভাবলেন, ঘুমিয়ে আছে তাই ডাকলেন না।

আরহাম মায়ের সাথে বাইরে বেরোলে এই সুযোগে ওয়াশরুম গিয়ে, এসে আবারও ঘুমিয়ে থাকার ভান ধরে রইলো।

****
দুপুরের দিকে লম্বা ঘুম শেষে উঠে নামাজ পড়ে বাইরে বেরোলো হাফসা।জ্বর নেমেছে।একটু স্বস্তিবোধ হচ্ছে।
বাগানের দিকটায় যেতে দেখল, কাকা মণি আর আরহামও ওখানে।

হাফসা দেখলো,কাকামণি পুরো বাগান এড়িয়া,ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন আরহামকে।আর তিনিও বাধ্য ছেলের মতো কাকামণির পিছু পিছু হাঁটছেন।শ্বশুরবাড়ি তাঁর প্রথম এসে থাকা বলে কথা!

দূর থেকে উমায়েরকে দেখে তীক্ষ্ণ নজরে তাকালেন আরহাম।এই সকালেই জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিলো।একটু কমতেই আবার উড়ু উড়ু করতে বেরিয়ে গেছেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ হাফসার তীক্ষ্ণ আওয়াজ শুনে পিছন ফিরলেন আরহাম।চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন, উমায়ের কোথাও নেই।উনার মনে হলো ভুল শুনেছেন হয়তো।উমায়ের কোথাও নেই তাহলে ওর আওয়াজ আসবে কোথা থেকে।

বাবার সাথে আরও বেশ কিছুক্ষণ থাকা হলো বাইরে।কিন্তু আরহামের মনে শান্তি পেলেন না।কোনো একটা অজুহাতে উপরে রুমে আসলেন।
উমায়েরকে খুঁজেও পেলেন না।রুম, ওয়াশরুম, বেলকনি খুঁজলেন কোথাও নেই।হন্তদন্ত হয়ে নেমে কিচেনে গিয়ে মামণিকে জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন, ‘উমায়ের কে উনি ভেতরে আসতে দেখেন নি।’

আরহাম দ্রুত বাইরে বেরিয়ে বললেন, ‘বাবা উমায়ের কোথায়?’

‘কেন ঘরে নেই?’

‘জ্বী না।’

48★

৮২
আধো আধো চোখ খুলতে মাথার মধ্যে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলো হাফসা।রুমে হালকা আলোর লাইট।চারিপাশের কোনো জানালা নেই।

হাতে টান পড়তেই অনুভব করলো হাত বাঁধা। পাও বাঁধা।
দূর্বল হাতে কয়েকবার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।মোটা একটা চেয়ারের সাথে বাঁধা রয়েছে ও।মুখ দিয়ে কিছু বলতে চেয়েও পারলো না।

একটু সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছেলেকে বেদূম থাপড়াচ্ছিলো রুদ্র।লাঠি দিয়ে মাথা ও ফাটিয়ে দিয়েছে।কলার ধরে আরও কয়েকটা ঘুষি দিতেই ওপাশের রুমে শব্দ শুনে ওদিকে ফিরলো সে।

চেয়ার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাফসাকে ছটফট করতে দেখে তাঁর অধর প্রসারিত হয়।সেন্স ফিরেছে তবে।
একজন এসে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলে মুখের মাস্ক সরিয়ে হাফসার একেবারে মুখোমুখি গিয়ে বসে পড়ে।

আচানক কাউকে দেখামাএই চোখ তুলে তাকায় হাফসা।মুহুর্তেই লাইট অন হয়ে যায় ঘরের। লাইটের তীব্র আলো চোখে পড়তেই চোখ খিঁচে নেয় ও।উম উমম শব্দ করে মুখ দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করতেই রুদ্র ওর মুখের ট্যাপ খুলে দেয়।অস্পষ্ট চোখে সামনের ব্যাক্তিকে দেখে ভয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেকে।

কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘ক্ ক্ কে আপনি?আমি এখানে কেন?’

রুদ্র হেসে ওর দিকে ঝুঁকে বলে, ‘এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলে বিউটিফুল!লুক।আমি রুদ্র।তোমার অলিখিত প্রেমিক।আর তুমি এখন আমার একান্ত জগতে আছো।’

রুদ্রর নাম শুনেই তাঁর হৃদপিণ্ড ধ্বক করে উঠে।এই লোককে ও ভীষণ ভয় পেত।এই লোকটা কোথা থেকে এলো?

‘আরে আরে কাঁপছো কেন বিউটিফুল?’

‘আ্ আম আমি এখানে কেন?ক্ ক্ কেন এনেছেন?উ্ উনি কোথায়?’

রুদ্র কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘উফফ উনি উনি করবে না।উনি এখানে নেই।তোমাকে আমার কাছে নিয়ে এসছি।নিজ থেকে আসতে চাওনি,জোর করে এনেছি।এই যাহ,আর কিছু না।’

‘কাকামণি কোথায়?’উ্ উনি কোথায়?’

‘উফফফ আবারো।আরহাম আছে।ওকে আমি রাখতাম না,শুধু তুমি আঘাত পাবে,কাঁদবে এজন্য ওকে ছুঁই নি পর্যন্ত।কোনো ক্ষতি করি নি তাঁর।’

কিছুক্ষণ নীরব থেকে নিজের অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করলো সে।মাথায় তীব্র ব্যাথা হচ্ছে।আশপাশের অবস্থা দেখে যখন নিশ্চিত হলো ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে তখন হাফসা এবার কান্নারত সুরে ভাঙ্গা গলায় বলল,’আ আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।আম আমি তো কোনো ক্ষতি করিনি আপনার।’

‘করেছো বিউটিফুল।আমার হৃদয়ে তোমার রাজত্ব করো।আমার মন,হৃদয় সব তুমি তুমি শুধু তুমি দখল করে নিয়েছো।এটা কি ক্ষতি নয়?’

‘আ্ আ্ আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ। বাড়ি যাবো।’

রুদ্র হাফসার গালে হাত রাখতেই রাগে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।রুদ্র বলে, ‘বিউটিফুল! কাঁদছো কেন?ব্যাথা পাচ্ছো মাথায়?কষ্ট হচ্ছে?বিলিভ মি,ওই স্টুপিডটাকে বলেছিলাম, তোমাকে আলতো করে একটু ক্লোরোফোম শুকিয়ে নিয়ে আসে।কোনো ব্যথা যেন না দেয়।কিন্তু তুমি ছটফট করায় ও তুমাকে আঘাত করে অজ্ঞান করে দিলো।কত সাহস!ব্লাডি বি*চ।স্টুপিড রাবিশ।আমি ওকে মেরেছি।তোমার মাথায় যেখানটায় আঘাত করেছে, আমিও ঠিক ওই জায়গায় ওকে আঘাত করেছি।’

দুপুরের কথা মনে পড়লো হাফসার।গেটের পাশে একটা ফুলের গাছ দেখছিলো ও।আচমকা কেউ ওকে টান দিয়ে গেটের বাইরে টেনে নেয়।চিৎকার দেওয়ার আগেই মুখ চেপে ক্লোরোফোম শুকিয়ে দেয়। এরপর?
এরপর আর কিছু মনে পড়ছে না।বাড়ির কথা,আরহামের কথা মনে হতেই কেঁদে দেয় হাফসা।

রুদ্র আবার ওর দিকে এগিয়ে আসতে চেয়ারে জোর দিয়ে কিছুটা দূরে সরে যায় ও।কন্ঠে তেজ এনে বলে,’ছুবেন না আমায়।অনুরোধ করছি,প্লিজ টাচ করবেন না।আমাকে বাড়িতে যেতে দিন প্লিজ।’

রুদ্র ঠোঁট সরু করে চুকচুক শব্দ করে বলে, ‘এ আশা তোমার পূরণ হবে না সুইটহার্ট।না চাইলেও তোমাকে আমার সাথে থাকতে হবে।আর কখনো ওখানে ফিরে যেতে পারবে না।’

হাফসা হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো।হাত পা,মাথায় যেমন তীব্র ব্যাথা তেমনি কথা বলার শক্তিটুকুও নেই।রুদ্র ওকে নিঁখুতভাবে দেখে।কত সুন্দর ও!কত সুন্দর ওর গাল,কত সুন্দর ঠোঁট।কিন্তু মুখটা শুকনো লাগছে। কিছু একটা মনে পড়তেই রুদ্র দ্রুত বলে উঠলো, ‘তোমার খিদে লেগেছে বিউটিফুল?ইফতার তো করো নি।ওয়েট।’

অতঃপর কাউকে ডাক দিতেই থালাভর্তি খাবার নিয়ে আসে লোকটা।

রুদ্র ওকে মুখে পানি তুলে দিতে চাইলে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও।জোর করেও তাকে খাওয়ানো গেল না।একসময় রুদ্র তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে, ‘ওকে বুঝেছি।খাবে না আমার হাতে তাইতো?গার্ল সার্ভেন্টকে ডাকছি ওয়েট।’

কিছুক্ষণ পর একজন মেয়ে আসলো।

‘ওকে যত্ন করে খাইয়ে দাও।শক্তি প্রয়োজন ওর।কোনো অসুবিধা যেন না হয়।’

বলে বেরিয়ে গেলেন।

হাফসা দূর্বল চোখে তাকালো মেয়েটার দিকে।খিদেয় তার সব শক্তি ফুরিয়ে গেছে।

মেয়েটি ওর মুখে খাবার তুলে দিতে ও বলল, ‘কয়টা বাজে?’

‘দশটা।’

‘এগুলো কি?হালাল তো?’

‘জ্বী স্যার আপনার উদ্দেশ্যেই শেফ দিয়ে রান্না করিয়েছে।’
বাধ্য মেয়ের মত খেয়ে নিলো হাফসা।প্রচন্ড খিদে লেগেছিল।তাঁর চোখের পানি খাবার পাতে গিয়ে পড়ে।সময়টা রাত মনে হচ্ছে, বাড়িতে হয়তো হুলস্থুল বেঁধে গেছে।

মেয়েটি চলে যেতে নিলে হাফসা বলে, ‘আমার বাঁধন খুলে দিন।’

‘স্যারের হুকুম নেই।’

‘প্লিজ খুলে দিন।আমি বাড়ি যাব।’

মেয়েটি ভয়ার্ত নজরে আশপাশ তাকালো।কিছু বলতে নেওয়ার আগেই হাফসা মেয়েটির গালের দাগ দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার গালে কিসের দাগ?’

মেয়েটি নিচুস্বরে বলল, ‘স্যার মেরেছে।’

হাফসা ভয় পেয়ে বলে, ‘এই লোকটা মারে?’

মেয়েটি নিচু স্বরে জবাব দিল,’জ্বি।
কিন্তু আপনাকে মারবে না।আপনাকে উনি ভালোবাসেন।’

‘লোকটার মাথা ঠিক নেই।আমি বিবাহিত।’

‘স্যার তো জানে।’

‘আমাকে বের হতে সাহায্য করুন প্লিজ।আমার বাড়ির সবাই টেনশন করছেন।’

‘আমার কিছু করার নেই।আমাকে যেতে হবে,স্যার যেকোনো সময় চলে আসবে।’

‘যেয়ো না।আমার হাত খুলে দাও।যেয়ো না,ভয় করছে আমার।’

‘আমি আছি তো সুন্দরী।ভয় কিসের?’

দরজার দিকে তাকাতেই দেখে লোকটা আবার আসছে।ইচ্ছে হলো,অলৌকিক কোনো শক্তি দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে।

রুদ্র দূটো মেডিসিন এগিয়ে দিলে হাফসা মুখ বন্ধ করে নেয়।

‘আরে ব্যাথানাশক ওষুধ।তোমার মাথার ব্যাথা কমার জন্য দিচ্ছি। একটু তো বিশ্বাস করো।’

হাফসা হালকা ঢুক গিলে জিজ্ঞেস করে,’আপনি ক্ ক্ কেনো আমাকে কিডন্যাপ করেছেন?’

রুদ্র কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘যতো নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করবে, ততই ব্যাথা পাবে।আমার মোটেই ইচ্ছে হচ্ছে না,তোমাকে এভাবে বেঁধে রাখতে।কিন্তু তুমি তো জ্বলিত সূর্যের চেয়েও ভয়ানক।এত নীরব, অথচ এতো তেজ।ধরার সুযোগ অবধি দিচ্ছো না!’

*****
গাড়ির কাঁচে মাথা ঠেস লাগিয়ে রয়েছেন আরহাম।এইমাএ থানা থেকে ফিরেছেন।উমায়ের কোথায় হারালেন।বাহির থেকে শক্ত থাকলেও উমায়েরকে হারানোর ভয় আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে আরহামকে।এমুহূর্তে ধৈর্যহীন হয়ে খুব করে কান্না আসছে আরহামের।উমায়েরকে বাড়িতে কোথাও না পেয়ে দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,তিনি তখন গেটের পাশে ছিলেন না।ময়লা ফেলতে গেট থেকে দূরে ডাস্টবিনে গিয়েছিলেন।তাঁর কথামতো, সকাল থেকে একটা কালো মাইক্রো বাড়ির আশপাশে ঘুরাফেরা করছিলো,দুপুরের পর সেটা আর দেখা যায় নি।

গ্রাম্য এলাকা হওয়ায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা খুব একটা উন্নত নয়।তবে দূরে থাকা একটিমাত্র চেকপোস্টের সিসিটিভি চেক করে দেখা গেছে, একসাথে এই রোড দিয়ে চারটি মাইক্রো বের হয়েছে, সবগুলোর নাম্বার নেমপ্লেট হাইড ছিলো।

চব্বিশ ঘন্টার আগে পুলিশ কোনো স্টেপ নিতে রাজি নয়,এছাড়া তারা ভিক্টিমের ছবি চায়,বাকি ইনফরমেশন দিলেও আরহাম কোনোমতেই ছবি দিলেন না।বাধ্য হয়ে, বিকল্প পথ বেছে নিয়েছেন আরহাম।তবে,জানাজানি হলে,উপরমহল থেকে আরহামের ওপর কঠোর জোরদারি রয়েছে।

৮৩
ঘড়ির কাটা শব্দ তুলে তিনটায় পৌঁছায়।হাফসার হিজাবটি বুক থেকে তুলে রেখে বাইরে বের হলেন আরহাম। বাবাকে ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে।ভদ্রলোক একেবারেই ভেঙে পড়েছেন,হাউমাউ করে কাঁদছিলেন সারাটা দিন।প্রেশার লো হয়ে,বুকে ব্যাথা হয়ে অবস্থা খারাপ হওয়ায় উনাকে শান্ত করতে ডক্টর ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেছেন।

আহমাদের মাথার শিওরে বসে বেশ কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।তখনি টুং শব্দ করে নোটিফিকেশন আসলো।মেইল এসেছে।আরহাম বাইরে বেরিয়ে মেইল চেক করে কোনো নাম্বারে কল দিয়ে বললেন, ‘কোম্পানিতে খোঁজ করুন।উনার এটেনডেন্স চেক করুন এ্যাজ সুন এ্যাজ পসিবল।’

কল রেখে দিতেই আরেকটা কল আসলো।

ধরে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে উৎকন্ঠিত কন্ঠে কেউ বলে উঠলো, ‘হাফসার কি হয়েছে?কখন থেকে ও নিখোঁজ?কীভাবে কি হলো?আপনি ওর খেয়ালটুকু রাখতে পারলেন না?’

‘এটা প্রি প্ল্যান ছিলো।’

‘যা-ই হোক,হাফসা আমার হলে ওর কখনো ক্ষতি হতো না।আমি ওকে আগলে রাখতাম।’

রাদে’র কথার আর উত্তর দিতে পারলেন না আরহাম।আরও কিছুসময় উত্তেজিত কন্ঠে আরহামের ওপর রাগ ঝাড়লো।কিন্তু আরহাম নীরব।শুনে যাচ্ছেন সব।

একসময় রাদ শান্ত হয়ে বলে, ‘সরি।হাফসার নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে মাথা ঠিক ছিলো না।আমি হয়তো আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।ক্ষমা করবেন।’

‘আচ্ছা।’

‘কাউকে গেস করলেন?বাইরের পরিবেশে ও যায়ই নি।তাহলে শএু হবে কোত্থেকে? ‘

‘ভিতরের মধ্যেই কেউ।’

****
চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে সে।গাল বেয়ে এখনো শুকনো পানি।পাপড়িগুলো এখনো ভিজে আছে।ফর্সা হাতে-পায়ে রক্ত জমাট বেঁধে কালসে হয়ে আছে।অন্যহাত ছিলে গিয়েছে রশ্মির বাঁধনে।কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে।

রুদ্র আলতো করে ওর গালের পানিগুলো মুছে দিলো।
ব্যাথা পাওয়া জায়গায় মেডিসিন লাগিয়ে, মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দেখলো বেশ খানিক জায়গা কেটেছে।ওই ছেলেগুলোর প্রতি আবারও রাগ উঠলো, এমনিতেই ওদেরকে মারতে মারতে আধমরা করে রেখেছে।হাফসার মলিন চেহারা জুড়ে মায়ার শেষ নেই।সৃষ্টিকর্তা খুব যত্ন করে বানিয়েছেন, বাহ্যিকভাবে কোনো খাদ-এুটি যেনো নেই ওর মধ্যে।

আরহামের পছন্দ আছে, ওপস সরি আরহাম তো ওকে না দেখেই বিয়ে করেছে। এমনিতেও মানুষটা খারাপ না আরহাম।

রুদ্র চুপিসারে ওর গালে,কপালে, কয়েকটা চুমু খেয়ে নিলো।অসম্ভব সুন্দর এক অনুভূতি হলো রুদ্রের।ঘুমের মধ্যেও হাফসা কেমন কপাল কুঁজিত করছে। রুদ্র হাসলো।

চোখে পানির ছিটা পড়তেই চোখ মেললো হাফসা।মস্তিষ্ক সচল হতে বুঝলো,এটা স্বপ্ন,সত্যি না।অথচ ঘুমের মধ্যে সে দেখেছিলো,কেউ ওকে স্পর্শ করছে, চুমু দিচ্ছে।

‘সাহরির টাইম চলছে।তুমি যদি আমার হাতে না খাও,তাহলে সাহরি না খেয়েই রোজা রাখতে হবে।’

হাফসা মাথা নিচু করে আছে, কোনো উত্তর নেই।

‘কি হলো আমার হাতে খাবে তো?’

ওর কাঠকাঠ উত্তর ‘না।’

রুদ্র বিরক্ত হয়।এই মেয়ে এত শক্ত মনের, জানা ছিলো না।চোখ তুলে তাকায় না পর্যন্ত।

‘যত্ন করে খাইয়ে দিতে চাইলাম।না খেয়ে রোজা রাখতে পারবে না বিউটিফুল।একটু খেয়ে নাও।’

খাবার তুলে দিলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

রুদ্র হতাশ হয়ে বলে, ‘এত তেজ।আমাকে তো মেনেই নিতে হবে তোমার।বিষয়টা যত সহজ করতে চাইছি,তুমি ততই বিগড়ে যাচ্ছো।’

গার্ল সার্ভেন্ট এসে খাইয়ে দিলো।হাফসার ঠোঁট লাগানো গ্লাস থেকে রুদ্র পানি খেতে নিলে আচমকাই হাফসা চিৎকার করে উঠে,রুদ্রর হাত থেকে গ্লাস ফ্লোরে পড়ে ভেঙে যায়।

রুদ্র ব্যস্ত হয়ে বলে,’কি হলো?চিৎকার করলে কেন?’

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।