ফযরের পরের ক্ষণ-
হাফসার কোলে মাথা রেখে বেঘোরে ঘুমুচ্ছেন আরহাম।সারারাত জাগনা থেকে সবার রাগ ভাঙ্গানোর পর নামাজ পরে এখানে আসছেন তিনি।একমাএ এই মানুষটাই যেকোনো পরিস্থিতিতে আরহামকে যত্নে বেঁধে রাখে।অন্যায় করলে, কষ্ট দিলে যে কোনো অভিযোগ জমা করে রাখে না।কাছে এলেই হাসিমুখে ভালোবাসে।উনার কোনো চাওয়া নে, রাগ নেই।শুধু আছে ধৈর্য, আর নৈসর্গিক ভালোবাসা!দিনশেষে এই শান্তির জায়গাটাই খুঁজেন আরহাম।যেখানে আসলে দুনিয়ার সব ব্যথা,ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তা কে নির্বাসন দিয়ে শান্তিতে চোখ বুজতে পারেন।
পরদিন~
আজকে আদওয়ার রিপোর্ট আনার কথা।রিপোর্ট দিয়ে উনাকে বসতে বললেন।আরহাম অপেক্ষা করলেন।ডক্টর আরো কিছু পেশেন্টকে সামলে ফিরে এলেন।
সামনের চেয়ারে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পেশেন্ট আপনার স্ত্রী তাই না?’
‘জ্বি।’
‘বিয়ের কতদিন?’
‘একমাসের কাছাকাছি।’
‘উনার অসুস্থতা কত দিনের?’
‘এই প্রবলেমগুলো অনেকদিন থেকে।তিন বছরের মতো বললেন তো।’
‘ আপনার কি মনে হয় তিন বছরে একটা রোগ শরীরে নিজের স্বাধীনতামতো জায়গা করতে পারে না?’
আরহাম অস্থির হয়ে গেলেন।রন্ধ্রে রন্ধ্রে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়লো।আরহামের অস্বস্তি বুঝে পানি এগিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাকে চিনি।মিডিয়া পারসন।’
‘উনার কি হয়েছে ক্লিয়ারলি বলুন প্লিজ।’
‘রিপোর্ট বলছে, কঠিন রোগ বাসা বেঁধে…
‘আমার সরাসরি বলুন এত প্যাঁচিয়ে কথা বলবেন না।’
‘সি ইজ এ্যা পেশেন্ট অব লাং ক্যান্সার!’
আরহামের ভেতরটা যেনো চুরমার হয়ে গেলো।অসহ্য রকম যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন ভেতর ভেতর।এত বড় সত্যির জন্য যে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না।’লাং ক্যান্সার’ শব্দটা কর্ণে দ্রীম দ্রীম আওয়াজ তুলতে থাকলো।বক্ষে কেউ পাথর চাপা দিয়েছে এমন যন্ত্রণা হলো।বাক্যগুলো হারিয়ে গেলো যেনো কন্ঠনালী থেকে।অপ্রস্ততের মতো এলোমেলো বাক্যে বলতে লাগলেন,
‘মা মানে…আমি উ্ উনাকে..
‘নার্ভাস হবেন না।বি স্ট্রং।’
‘আ আমি উনাকে সুস্থ দেখতে চাই এট এনি কস্ট্।কি করতে হবে বলুন আমায়?’
‘সিরিয়াস স্টেজে কি ট্রিটমেন্ট দিবো?মেডিসিনে কোনো এফেক্ট হওয়ার মতো অবস্থায় নেই।তবুও আমি কিছু সাজেস্ট করছি।কয়দিন অপেক্ষা করে দেখুন ইমপ্রুভ হয় কি না।’
******
অলস ঘুম ছেড়ে উঠে বসলো হাফসা।বিশেষ এই টাইমে ঘুমটা প্রচুর বেড়েছে তাঁর।আর বেশী বেশী খিদে পাওয়া।কিন্তু খেতে গেলেই ওয়াক।
এলো চুলগুলো খোঁপা করে ফোনটা হাতে নিলো।উনি নিশ্চয়ই কল, টেক্সট দিয়েছেন।রিপ্লাই না পেয়ে রেগে বোম হয়ে আছেন মনে হয়।
মনে মনে হেসে ফোনটা হাতে নিলো অবাক হলো বটে।মনও খারাপ হলো।ফোন তো দূর,একটা টেক্সট ও নেই।
রাগ ছাড়িয়ে নিজেই কল দিলো।কিন্তু ওপাশ থেকে ফোনটা উঠালেন না।
বিছানায় আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো।বিছানায় থাকলে,আরো ঘুমাতে মন চাইবে।কড়া করে লুকিয়ে এক কাপ চা খেতে হবে।
******
আদওয়ার রিপোর্ট নিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরলেন আরহাম।গত একঘন্টায় কয়েক বছরের বয়সের ছাপ যেনো উনার চোখেমুখে লেপ্টে রয়েছে।এলোমেলো পা ফেলে ড্রয়িংরুমে আসতেই এক পুরুষ অবয়বে চমকালেন।এলোমেলো হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কের ছক,চেনা মানুষ কেও যেনো অচেনা করিয়ে দিচ্ছে।আরহাম সরু চোখে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলেন।কিন্তু চোখের সামনে ভেসে উঠলো,আদওয়ার ঘোলাটে রিপোর্ট টা!
আয়মান,মাইমুনার ভাই।সালাম বিনিময় শেষে আরহামের অসাড় হয়ে যাওয়া হাতজোড়ায় করমর্দন শেষে তখনও উনাকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে চিনতে পারেন নি মে বি।আমি আয়মান।মাইমুনার ছোটভাই।’
ঠনক পড়ে আরহামের।সৌজনমূলক কুশলাদি বিনিময় করতেই রুমে চোখ পড়তে দেখলেন মাইমুনা রেডি।আয়মানের সাথে কুশলাদির এখানেই সমাপ্তি টেনে রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘বাবার বাড়িতে।আপনাকে অনেক টেক্সট দিয়েছি শাহ।আপনি মে বি বিজি….
‘আমি এখনও বাসায় না ফিরলে আপনি চলে যেতেন। তাই না?’
‘ন নাহ্ মানে…
‘ইউ আর ফুলি চেন্জড মাইমুনা।’
মাইমুনা একটু চটে গিয়ে বললেন, ‘আপনাকে আমি একদিন থেকে বলছি?কতদিন থেকে বলছি,বাবার বাড়ি যাবো।আপনি তো পাত্তা দিচ্ছিলেন না।ভাইয়াও দেশে এসছে।বাবাও অসুস্থ। তবুও আমি যাবো না।আমাকে কি একদম কিনে নিয়ে এসছেন শাহ?’
‘যান।’
দূই শব্দের জবাব দিয়ে আরহাম চুপচাপ চলে গেলেন।মাইমুনা উনার যাওয়ার দিকে ক্লান্তির শ্বাস ফেলে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নতুন এক উদ্দেশ্যের যাএায়!
******
ফ্রেশ না হয়েই অনেকদিন পর নিজের রুমে আসলেন।দরজা বন্ধ করতেই শক্তপোক্ত মনটা ভেঙে গুড়িয়ে গেলো।তীব্র যন্ত্রণায় বুকের ভিতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।কার কাঁধে একটু মাথা লাগিয়ে স্বান্তনার বাণী শুনবেন।কে একটু সাহস জুগাবে!কে একটু ভরসা দিবে!
80★
(১২০)
স্ত্রীদের প্রতি সর্বদা মনটা ঠুনকো তুলোর মতো।তাদের বিষয়ে কখনো স্ট্রং হতে পারেন না।এত ভারী যন্ত্রণা টা কীভাবে বয়ে বেড়াবেন!
এলোমেলো পায়ে বিছানায় বসতেই ভেতর থেকে উগড়ে সব যন্ত্রণা যেনো ঝরনা হয়ে বেরিয়ে এলো।চোখ ফেঁটে বাঁধ নামলো।উনার ছটফটে চঞ্চল শ্যামাপাখিটা এত কঠিন রোগ বয়ে বেড়াচ্ছে নীরবে!সে সুস্থ হবে তো!কখনো চোখের আড়াল হলে যে,আরহামের দূনিয়া টা কেঁপে উঠবে।শ্যামাপাখি নামক অস্তিত্ব ছাড়া কীভাবে থাকবেন তিনি!
নিঃশব্দে ভারী বর্ষন ছুঁয়ে গেলো উনার শুভ্র গ্রীবা বেয়ে।ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপতে থাকলো!এলোমেলো হৃদয় নিয়েই রবের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন।তিনি চাইলে কি না সম্ভব!
একসাথে বের হলেন এশার জামাআতের উদ্দেশ্যে।হাফসাকে ড্রয়িং রুমে একা চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে মন খারাপ?’
‘আপনার কি হয়েছে?’
‘আ্ আমার কি হবে?’
‘আজকে এতো চুপচাপ কেন?আপু ফিরে আসবেন তো।চিন্তা করবেন না।’
আরহাম হালকা হাসলেন।বললেন, ‘আচ্ছা।নামাজ পড়ে নিন।’
হাফসা তাকিয়ে রইলো উনার যাওয়ার দিকে।মিথ্যে হাসির আড়ালে উনার মলিন চেহারা দেখলে সারাটাদিন মন খারাপে কাটে ওর।কিছু কি হয়েছে!এত নীরব হয়ে গেলেন কেন হঠাৎ?চোখগুলোও লাল!কেনো!আপুর জন্য কি কেঁদেছেন!
******
নামাজ থেকে ফিরতে দেখলেন, আদওয়ার হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছেন উমায়ের।আরহাম কে নামতে দেখেই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, কি অবস্থা!
আরহাম হালকা হেসে তাদের পাশে বসলেন।মেহেদী দেখে প্রশংসার সুরে বললেন, ‘দারুণ সুন্দর।’
আদওয়া খুশিতে আটখানা হয়ে বলল, ‘বুঝতে হবে না ডিজাইনার কে!’
‘হুমম।’
আদওয়া অন্যহাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো মেহেদীর ডিজাইন চোজ করতে।আরহাম পাশ থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আদওয়ার দিকে।ইচ্ছে করলো, শক্ত করে অনেকক্ষণ বুকের সাথে চেপে ধরে রাখতে।তাঁর ছোঁয়ায় ভাঙ্গাচোরা হৃদয় টার যদি একটু স্বস্তি হয়!
এতক্ষণে আদওয়া কখন উনার দিকে তাকালো সেদিকে খেয়ালই ছিলো না।হুষ ফিরতে স্বাভাবিক হলে আদওয়া ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে?
আরহাম চোখের ইশারায় বুঝালেন, খুব সুন্দর লাগছিলো।মুর্হুতেই তাঁর মুখের আদলে লাজ ফুটতে থাকে।
*****
ডিনারের আগে আব্বু বাসায় ফিরলেন।বিকেলে বাসায় ছিলেন না তিনি।বাসায় এসে কোনো প্রয়োজনে মাইমুনাকে খুঁজলেন।না পেয়ে আরহামকে জিজ্ঞেস করলে আরহাম বললেন, ‘উনি চলে গেছেন আব্বু।’
‘হুট করে?কোনো সমস্যা?’
‘উনার ভাই এসেছিলেন।নিয়ে গেলেন।’
‘তুমি কিছু বললে না?’
আরহাম বাবার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন।উত্তর না পেয়ে আব্বু পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনো সমস্যা আরহাম?’
‘আমি জানি না।আমি কল দিয়েছি,তুলেন নি।’
‘রোববার আমি চলে যাবো তো।তার বাসা থেকে নাহয় বিদায় নিয়ে আসবো।’
‘প্রয়োজন নেই।ওখানে গেলে আপনাকে আমার আর আদওয়ার বিষয়টা নিয়ে কথা শুনতে হবে।’
‘তুমার আর মাইমুনার বন্ডিং ঠিক নেই?সে তোমার অমতে চলে গেল?’
আরহাম কিছুক্ষণ চুপ থেকে হতাশামিশ্রিত কন্ঠে বললেন, ‘আই রিয়েলি ডোন্ট নো হুয়াট সি ওয়ান্টস!সি ইজ চেন্জিং এ্যা লট আব্বু।সি ওয়াজন্ট লাইক দ্যাট বিফর।’
আব্বু চুপচাপ রুমে ফিরে গেলেন।আরহাম ধপ করে বসে পড়লেন সোফায়।হাফসা তখন ড্রয়িং রুমে আসছিলো ওয়াটার পটে পানি নেওয়ার জন্য।আরহামকে দুহাতে মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে থাকতে খারাপ লাগলো ওর।
পাশে গিয়ে বলল, ‘আমি টেনশন করবো বলে আমাকে শেয়ার করেন না।কিন্তু আপনাকে এরকম দেখলে আমার আরও বেশী টেনশন হয়।’
মাথা তুলে হাফসাকে পাশে বসিয়ে ওর কোলে মাথা গুজে রইলেন চুপচাপ।হাফসার এত কথা,এত প্রশ্নের জবাবে একটা শব্দ ও বিনিময় করলেন না!
*****
ডিনারে বসে খাবারগুলো গলা দিয়ে নামলো না।অল্প খেয়েই উঠে গেলেন।রুমে আসার আগে আরো কয়েকবার মাইমুনার নাম্বারে কল দিলেন।প্রথম দূইবার না তুললেও তৃতীয়বার ফোন তুলেই বললেন, ‘আমি হারিয়ে যাচ্ছি না শাহ।বাবার বাড়িই আছি।’
‘আমার অজান্তে কোনো ভুল করেছি আমি?’
‘অজান্তে কেন করবেন?প্রকাশ্যেই করেছেন।’
আরহাম অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনিও।আই এম রিয়েলি শকড্ মাইমুনা।আপনি তো অনুমতি দিয়েছিলেন তাহলে এখন এমন বলছেন কেন?এমনকি তার সাথেও তো সুন্দরমতো মানিয়ে নিয়েছিলেন।হুট করে আপনি অন্য চিন্তায় গেলেন কেন?’
মাইমুনা ক্লান্তির নি:শ্বাস ফেলে বলল, ‘সবার এত প্যারা আমার সহ্য হয় না।আই ওয়ান্ট টু লিভ এলোন।’
‘প্লিজ আপনি আসুন প্লিজ।আগের মতো থাকি আমরা?’
‘আমি তো….প্ পরে কথা বলছি।’
বলেই ফোনটা কেটে গেলো।আরহাম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আদৌ কি শান্তির দেখা মিলবে!
*****
আদওয়া রুমে আসলে আরহাম পাশে ডাকেন।কাছে আসতেই গালে আলতো হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন?’
‘ভালো।’
‘আলহামদুলিল্লাহ বলতে হয়।সবসময় শুকরিয়া আদায় করবেন যেমনই থাকুন না কেন!’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’
‘সুস্থ আছেন তো?আর কোনো সমস্যা হয়েছিলো?’
‘উহু।’
‘সত্যি তো?’
‘জ্বি।একদম সুস্থ হয়ে গেছি।’
‘আমাকে বললেন না কেন?আমি দেখায়ই না জানলাম।লুকোলেন কেন?’
‘আপনি টেনশন করবেন তাই।’
আরহাম নিঃশব্দে ওর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে রইলেন।আদওয়াও পড়ে রইলো আরহামের প্রশস্ত বুকে।অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার রিপোর্ট আনার কথা ছিলো না?’
‘হুম।’
‘এনেছেন?’
‘হুমম।’
আদওয়া তড়িৎ মাথা তুললো।ওর মুখটা ফ্যাকাশে আর চিন্তিত দেখালো।সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘দেখে কি বললেন ডক্টর?’
‘আপনি খুব বেখেয়াল নিজের প্রতি।’
‘এটা বলেছে ডক্টর?আমি কত যত্নশীল নিজের প্রতি।এমন কথার পিঠে কয়েকটা ঝাড়ি দিতে পারলেন না ডক্টরকে?’
আরহাম হাসার চেষ্টা করলেন।নাহলে তাঁর নিঁখুত চোখে ধরা পড়ে যাবেন।বললেন, ‘তাই?’
‘হ্যাঁ অবশ্যই ঝাড়ি দিতেন।’
আরহাম বুঝানোর ভঙ্গিতে বললেন, ‘আঘাত দিয়ে কাউকে কথা বলতে নেই শ্যামাপাখি।কথার আঘাত ধনুকের চেয়েও তীক্ষ্ণ।একটা মানুষ চুপ থাকবে, চোখের সামনে হাসবে,অথচ কথাটা তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বইয়ে দিবে।বুঝতেই পারবেন না।’
‘তাই তো।এভাবে তো কখনো ভেবে দেখি নি।আপনার চিন্তাধারা দারুণ।’
‘কখনো নীরব হয়ে যাবেন না আদওয়া।’
‘কেন?কেন বললেন একথা?’
‘আপনার চঞ্চলতা, ছটফটানি আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে।চুপচাপ থাকলে মানতে পারবো না।’
আদওয়া ফিক করে হেসে ফেললো।অনুরোধের সুরে বলল, ‘বলেছিলেন না বাবার বাড়ি নিয়ে যাবেন।যাবেন না?’
‘হুমম।’
‘বড় আপুও তে বেড়াতে।ছোট আপুর বাবুটা আসার সময় হয়ে যাবে।তখন তো যাওয়া যাবে না।এখনই গিয়ে কদিন থেকে আসা যায় না?বিশ্বাস করুন, মা বাবাকে ভাইকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।’
‘কালকে নিয়ে যাবো।’
‘মানে?সত্যি?সত্যি বলছেন?’
‘হ্যাঁ।’
খুশিতে লাফাতে লাফাতে ডিগি দিয়ে আরহামের গালে আলতো স্পর্শ এঁকে বেরিয়ে গেলো।আরহামের ভেতরে উথাল-পাতাল ঝড় বইছে।আদওয়ার সংলগ্নে থাকা প্রতিটা সেকেন্ডে হৃদপিণ্ডের অবিরাম কাঁপুনি অনুভব করেছন।এই ভয়ানক অনুভবের কবে সমাপ্তি ঘটবে!
সকালবেলা~
হাফসা উঠে বেলকনিতে হাটলো কিছুক্ষণ।ঘুম ছেড়ে রুমে আসতেই দেখে আরহাম নাস্তা নিয়ে হাজির।আজকে আর একটুও বাড়াবাড়ি করলো না,ঠিকমতো খেয়ে নিতে লাগলো।
হাফসা জিজ্ঞেস করলো, ‘কালকে কি নিয়ে টেনশন করেছিলেন?’
‘তেমন কিছু না।’
‘বলা লাগবে না।সমাধান হয়েছে কি না বলুন।’
‘হু আপনি সুস্থ তো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
‘ডক্টরে যাওয়ার ডেট জানি কবে?’
‘উমমম.. চার দিন পর।’
‘আদওয়ার বাসায় যাচ্ছি।বাবাটার যত্ন নিবেন।’
‘হুমম।’
‘মিস করবো দূজনকে।’
‘আমরাও করবো।’
‘আম্মুর কথা শুনবেন।উল্টাপাল্টা কিছু খাবেন না।’
‘আচ্ছা।’
আরহাম বেরিয়ে যেতেই আদওয়া হাজির।সাদা রঙ্গের ড্রেসে কি মায়া লাগছে ওকে!এসেই দূম করে হাফসার পেটে ফ্লায়িং ছুঁড়ে বলে, ‘এই বাবুটা যে কবে আসবে?আমার আর সহ্য হচ্ছে না।’
হাফসা হেসে ফেললো ওর বোকা বোকা কথায়।
সে সেইম এক্সপেকটেশন রেখে বলল, ‘এতটুক এতটুক হাত পা হবে।ছুটো ছুটো গাল থাকবে।আমি যে কত কিস করবো!আমি গোসল করিয়ে দিবো,আমি খাইয়ে দিবে।আপনি শুধু শুধু রেস্ট করবেন।ও সারাদিন আমার সাথে থাকবে।’
‘আচ্ছা।কবে আসবে বেড়ানো থেকে?আমি একা হয়ে গেলাম।আব্বুও চলে যাবেন।’
‘হুমম তাড়াতাড়ি চলে আসবো।’
‘আচ্ছা।’
‘আপনি ইদানীং আরও সুন্দর হয়ে যাচ্ছেন আপু।’উনার’ পছন্দ সেই।’
হাফসা হেসে বলল, ‘আমাকে তো বিয়ের আগে দেখেন নি।বিয়ের দিন দেখেছেন।’
‘তাই?তারপর তারপর?কিভাবে?প্রথম থেকে বলুন প্লিজ!’
‘ফিরে আসো বাড়ি থেকে।তখন বলবো।’
‘না শুনলে শান্তি পাবো না।’
‘আমি কোথাও চলে যাচ্ছি না।শান্তিমতো থেকে আসো।সব বলবো।’
‘আচ্ছা।অপেক্ষায় থাকলাম।’
******
আদওয়ার বাড়ি গিয়েও বেশীক্ষণ থাকলেন না আরহাম।এই সপ্তাহ শেষে আব্বু চলে যাবেন।শেষ জুমআ টা একসাথে আদায় করে বেরোলেন।আজকে বেশ দূরের যাএা।দূরবর্তী গ্রামের সেই মসজিদটার বেশীরভাগ ভাগ কাজ শেষ।আব্বু সেটা দেখতেই আজকের ভ্রমণ!
আদওয়ার দূপুরের খাবারে ছিলো জাল বেশি।তরকারীর ঝোল মাথায় উঠে বিষম উঠে গেলো।রুমে এসে ওয়াশরুম গিয়ে হরহর করে বমি করে দিলো।আবারও চমকালো!
সামান্য একটু বিষম খাওয়ায় ব্লাড আসার কথা না। সাথে তালু জ্বলছে।চোখেমুখ লাল হয়ে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়েও স্বাভাবিক হতে পারলো না।দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাসের মতো বুকের ব্যাথাটাও বাড়তে থাকলো।কোনোমতে উঠে দরজা লক করে বিছানায় শুতেই ছটফটানি শুরু হলো! মাথাও কেমন ঘুরতে লাগলো!ভীষণ রকম কষ্ট হলো আদওয়ার।মনে হলো, এই বুঝি দম বেরিয়ে যাবে!টেবিলে ফোনটা রিং তুলে বাজছে।আদওয়া অচেতনের মতো পড়ে রইলো বিছানায়!অতঃপর একসময় চোখ বুজে আসলো!দরজার ওপাশের ডাক,আর ফোনকল কিছুই ওর ঘুম ভাঙ্গাতে পারলো না!
81★
(১২১)
ঘুম ভাঙ্গতে দেখলো, আসরের ক্ষণ!কবে ঘুমিয়েছিলো মনেই পড়লো না।দ্রুত উঠতে যাবে,তখন-ই আরহাম আসলেন ওয়াশরুম থেকে।
‘আ্ আপনি কখন আসলেন?’
টাওয়াল দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে উত্তর দিলেন ‘একটু আগে।’
‘আমি তো দরজা লক করে….
‘ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে খোলা হয়েছে।এভাবে ডোর লক করে ঘুমাবেন না আদওয়া।আমি আপনাকে বুঝাতে পারবো না,ফোনে না পেয়ে আমি কি পরিমাণ টেনশন নিয়ে ফিরেছি।’
‘আমি তো ঘুমে ছিলাম ফোন তুলবো কেমনে?’
‘আমি জানতাম না তো।আপনার আম্মুকে ফোন দিলে তিনি বললেন, তিনি একটু আগে দেখে গেলেন আপনি খাচ্ছিলেন আর অল্প সময়ের মধ্যেই খাবার শেষ করে এসে আবার ঘুমিয়েও গেলেন কীভাবে!উনি অনেকক্ষণ নক করেছেন ডোর,আপনি খুলছিলেন না।আমি্ আমি কিভাবে যে বাসা পর্যন্ত আসছি বুঝাতে পারবো না।’
‘আমি ঘুমাচ্ছিলাম রে বাবা!’
‘এত নকিং আপনার কানে আসলো না?এভাবে কানে তালা লাগিয়ে বেহুশের মতো কেউ ঘুমায়?
‘আমি ঘুমাই।’
‘আচ্ছা।আমি যখন বাসায় থাকবো না,আপনি ঘুমানোর আগে আমাকে মেসেজ করে ঘুমাবেন যে,বেহুঁশের মতো ঘুমোবেন এখন।তাহলে আমার টেনশন থাকবে না।’
আদওয়া হাসলো!উনার সামান্যতেই এতো টেনশন দেখে সেন্সলেস হওয়ার আগের কাহিনীগুলো বলার সাহস হলো না!
*****
দূ:খের দিনগুলো খুব স্থায়ী হয় এ যেনো আরহাম খুব করে অনুভব করলেন গত পাঁচটা দিনে।আদওয়াকে রেখে বাসায় ফিরে আসছিলেন।হাফসাকে কড়া হুকুমদারি না করলে,তিনি কথা শুনেন না।পুষ্ঠিকর খাবার তার মুখে বিষ যেনো,আর আনহাইজেনিক সব মজাদার।
দূ:খের অনলে পুড়তে পুড়তে হাসি যেনো মিলিয়ে গেছে আরহামের।আদওয়ার অসুস্থতা কমে নি।বরং বাড়ছে।কি করবেন, কি করা উচিত কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারছেন না।কাউকে শেয়ারও করেন নি।সারা দিন কাটে ব্যস্ততায়,চিন্তায় আর রাত অস্থিরতায়, নির্ঘুম!একান্তই এ দূ:সময়ে আব্বুর ও ফিরার তোড়জোড়।
আজ আব্বু চলে যাবেন।বিদায় নিয়েই বাড়িতে গিয়েছিলো আদওয়া।রাত দেড়টায় ফ্লাইট।মর্মান্তিক বিদায় মুহূর্ত শেষে আরহাম আর আব্বু এগোলেন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।
(এই পর্বটা আমার কাছে যতটুকু এলোমেলো, অগোছালো, খাপছাড়া মনে হয়েছে, অন্য কোনো পর্ব এমন মনে হয়নি🙁)