অফিডিয়ান | পর্ব – ৩

9 Min Read

রুমের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। রুমাইশা উঠে ঘড়ি দেখলো, তিন টা বাজে। এই সময়ে কিসের শব্দ হলো, আর রুমের ভেতর এত অন্ধকার কেন? ঘুমানোর সময়ে তো রুমে আবছা আলো ছিল।

কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করার পর রুমাইশা অন্ধকারের কারণ বুঝতে পারলো। বাড়ির পেছন সাইডে, রুমাইশার রুমের জানালার কাছে একটা বাল্ব জ্বলছিলো, কিন্তু এখন আর সেটা জ্বলছে না তাহলে কি ফুপ্পি বন্ধ করে দিলো? কিন্তু ফুপ্পি তো নিচ তলায়, বাল্বের সুইচ তো রুমাইশার দরজার পাশে, ফুপ্পি তো এত রাতে লাইট বন্ধ করার জন্য আসবে না।
আর আজ বাইরেও বেশ অন্ধকার, চাঁদ ওঠেনি, তার ওপর পেছনে ঘন জঙ্গল।
তাহলে কি শাফিন বন্ধ করলো? শাফিন কে কি ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবে? কিন্তু এত রাতে একজন কে ফোন করে লাইট বন্ধ করেছে কেন জিজ্ঞেস করাটা রুমাইশার কাছে খুব আজগুবি ঠেকলো, তাই ভাবলো সকালে জিজ্ঞেস করবে।
লাইট মানুষ বন্ধ করতেই পারে, তাই আর সাত পাঁচ না ভেবে আবার শুয়ে পড়লো।

ভোরবেলা নামাজের পর রুমাইশা শাফিনের রুমের সামনে গেলো। একটু খোলা বাতাসে যেতে হবে ওর। ছাদের দিকে গেলে মন্দ হয়না। চিলেকোঠায় সাফওয়ান থাকে, ওর সাথে তো এখনো দেখা হয়নি একবার ও।
ফুপ্পা বলছিল ভাইয়া নাকি এখনো অপরাধবোধে ভুগছে, কিন্তু ও তো এসব মনেই রাখেনি! ভাইয়া তো কামড়েই দিছিল, তাতে কি এমন হয়েছিলো যে এইরকম মুখ দেখাদেখি বন্ধ হলো! তখন তো ওরা সবাই ছোট ছিলো, এরকম কামড়াকামড়ি, মারামারি হওয়া তো স্বাভাবিক!

শাফিন দরজার ছিটকিনি দেয়নি। একবার ভাবলো শাফিনের রুমে যাবে, কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো, যতই শাফিন তার থেকে দুবছরের ছোট হোক না কেন ও তো এখন বড় হয়ে গেছে, হুট করে এখন আর ওর রুমে ঢোকা যাবে না৷
রুমে ফিরে আসলো রুমাইশা, এসে শাফিনের ফোনে কল দিলো। শাফিন ঘুমের ঘোরে কে কল দিয়েছে না দেখেই ফোন ধরে রাগী রাগী কণ্ঠে বলল,
—কে রে? এত সকাল সকাল কল দিয়ে আমার ঘুমের তেরোটা বাজালি? কি বলবি তাড়াতাড়ি বল!

শাফিনের এমন কথাবার্তা শুনে রুমাইশার আক্কেলগুড়ুম! রুমাইশা ভ্রুকুটি করে বলল,
—এমনিতে তো খুব ভদ্র সাজিস, তোর ভদ্রতার নমুনা তো পেয়ে গেলাম!”

রুমাইশার গলা শুনে শাফিন তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসল। আমতা আমতা করে বলল,
—সরি সরি আপু, আসলে আমার বন্ধু অয়ন এরকম সকাল সকাল ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করে, আমি ভেবেছি ও হবে, তাই এরকম বলেছি। তুমি কিছু মনে কোরোনা আপু!”
তারপর অসহায় কণ্ঠে আবার বলল,
—আর মাকে যেন বলোনা, তোমার সাথে এইভাবে কথা বলেছি শুনলে মা আমাকে আর আস্ত রাখবে না।”

শাফিনের কথা শুনে রুমাইশা হেসে দিলো, বলল
—ঠিক আছে, বলবো না৷ এখন তুই আমার সাথে ছাদে চল।”

ছাদে যাওয়ার কথা শুনে শাফিন আঁতকে উঠল। বলল,
—’ওরে বাবা! বাঘের খাচায় যেতে বলছ তুমি আমাকে, নিজে তো মরবে, সাথে আমাকেও মারবে! তুমি তো জানোই ভাইয়া কেমন। ছাদে মা ছাড়া আর কোনো জনমানবের যাওয়া সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। ভাইয়া দেখলে আকাশে তুলে একটা আছাড় মারবে৷

— কেন? ও আছাড় মারবে কেন? ছাদ কি ওর একার? আর আমরা তো আর ওর রুমে যাচ্ছিনা, যাচ্ছি ছাদে। আর কতক্ষণই বা থাকবো? ১০ মিনিট না হয় সর্বোচ্চ, তারপর তো চলেই আসবো!

কিন্তু রুমাইশার এত কথা শাফিনের মন গলাতে পারলোনা। ও বলল,
—না আপু, আমি যাবো না! ভাইয়া যখন থাকবে না তখন যেও ছাদে, আমিও তখন তোমার সাথে যাবো!

— ও নাকি বের হয় না রুম থেকে, তা কোথায় যাবে? আর কখন যাবে সেটাও বা বুঝবো কি করে? এই তুই তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আমার রুমে আয়, ফোনে বক বক করতে ভালো লাগছে না৷

শাফিন ও পাশ থেকে বলল,
—যথা আজ্ঞা মহারাণী, আমি পাঁচ মিনিটের ভেতর আপনার রুমে চলে আসছি। রুমাইশা আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলো।

৪. মিনিট সাতেক পর শাফিন এলো রুমাইশার ঘরে। রুমাইশা একটা বালিশ কোলের ওপর নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বাবু দিয়ে বসে আছে। শাফিন এসে রুমাইশার সামনে বাম পাশ ঘেসে বসলো।

—কাল রাতে কি তুই বাইরের লাইট অফ করেছিলি?” জানালার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো রুমাইশা।

— কই না তো, আমি লাইট অফ করিনি। এই লাইট মাঝে মাঝে আমিও দেখি শেষ রাতের দিকে অফ থাকে, আম্মু কে জিজ্ঞেস করেছিলাম আম্মু করে কিনা, বলল যে করে না। তবে আম্মু বলছিলো সাফওয়ান ভাইয়া করতে পারে৷”

সাফওয়ান এর কথা উঠতেই রুমাইশা বলল,
—ওহ হ্যা, বল এইবার, সাফওয়ান ভাইয়া কোথায় যায়, আর কখন যায় ? আর বাড়িতে কি হচ্ছে সেগুলো ও বল। ফুপ্পি ফুপ্পা, আব্বু সবার কথা বার্তা আমার কাছে মোটেও সুবিধা লাগছে না। তখন ফুপ্পাকে বলেতে শুনেছিলাম যে ও ঘর থেকে বের হয় না সেই কামড়ে দেওয়ার ঘটনার পর থেকে, ফুপ্পি ছাড়া কারো সামনে যায় না, তাহলে?”

উত্তরে শাফিন বলল,
—আমিও জানিনা আপু, ভাইয়া কে আমিও ভালো ভাবে দেখিনি কতকাল তার ঠিক নেই, আম্মু তো আমাকে সাফ সাফ মানাকরে দিয়েছে ছাদে যেতে, আর একবার গেছিলাম মানা করা সত্বেও, ভাইয়া সেই আকারে ধমক দিয়েছিলো, আর পরে আম্মু কেলানি দিয়েছিলো, তাই তার পর থেকে আর যাই না৷ ভাইয়া বাসায় না থাকলে যাই।

— কিন্তু সাফওয়ান ভাইয়া যায় কোথায়?

— ওহ, তুমি তো জানোই না! ভাইয়া তো এম এম কলেজের বোটানি বিভাগের লেকচারার। কিন্তু ভাইয়া বাসায় বসে অনলাইনেই ক্লাস নেয়। ভাইয়া কলেজে গিয়ে ক্লাস নেয় না, খুব প্রয়োজন হলে তখন ভাইয়া কলেজে যায়, সানগ্লাস চোখে দিয়ে, মুখে মাস্ক পরে, হাতে গ্লাভস পরে।”

এরপর ভাব নিয়ে শাফিন বলল,
—তাতেই আমার ভাইয়ের ওপর মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে, চেহারা না দেখেও, আর চেহারা দেখলে তো অজ্ঞান হয়ে পড়তো! জানোই তো আনম্যারিড টিচার থাকলে মেয়েরা কি করে!”

রুমাইশা বিরক্ত হয়ে বলল,
—আজাইরা কথা বাদ দে, কাজের কথা বল। ভাইয়া তো শুনেছি সিঙ্গাপুরের NUS এ পড়ত, তা এখানে এলো কেন? ওখানেই তো জবরদস্ত একটা জব পেয়ে যেতো!”

শাফিন বলল,
—আমিও তো জানতাম তাই, ভাইয়াকে তো ওরা টিচার হিসেবে নিতে চেয়েছিলো, রিসার্চার ও হয়ে গেছিলো ভাইয়া, কিন্তু কি একটা ঝামেলা হওয়ার পর ওরা নাকি ভাইয়াকে নেবে না বলেছে, ইভেন ভাইয়ার নামে কি একটা কমপ্লেইন ও করেছে, যার কারণে অন্য কোনো ইউনিভার্সিটি থেকেও ভাইয়া কে নেয়নি। তাই আম্মু বলল দেশে চলে আসতে। দেশে এসেও ভাইয়াকে অনেক ভার্সিটি থেকে নিতে চেয়েছিলো, কিন্তু ভাইয়ার শর্তে তারা কেউ রাজি নয়। তাই আম্মু বলল এম এম কলেজে এপ্লাই করতে আর কথা বলে দেখতে, ভাইয়া কথা বলেছিলো। ভাইয়ার মতো ব্রিলিয়ান্ট কে ওরা হাতছাড়া করতে চায়নি তাই ভাইয়ার শর্তে ওরা রাজি হলো আর ভাইয়াকে নিয়েও নিলো। আর তাছাড়া ভাইয়া অনলাইনে এ্যাব্রোডের অনেক স্টুডেন্ট দের কে প্রাইভেটলি স্টাডি করায়। প্লাস, ওর রিসার্চ ল্যাব ও আছে, তবে কোথায় আছে সেটা বলতে পারিনা।”

রুমাইশা বলল,
—সাফওয়ান এম এম কলেজে জব নিলো আর তোরা আমাদের কাউকে বললি না!”

— তোমরাই তো কথা বল না, আম্মু তো ভাইয়া জবে ঢোকার পর তোমার আব্বুর কাছে ফোন দিছিল, গত অক্টোবরে, তোমার আব্বু ফোন ই তোলেনি, তাই আম্মুও আর পরে রাগের কারণে কিছু বলেনি।”

রুমাইশা বলল,
—আমি এম এম কলেজে থেকেও জানিনা যে আমারই ফুফাতো ভাই নাকি এইখানে জব করে।

শাফিন বেড থেকে নামতে নামতে বলল,
—সারাক্ষণ তো রুমেই থাকে, কলেজে গেলে না হয় জানতে পারতে। আর তুমি তো অন্য ডিপার্টমেন্টে, তাই জানার কথা ও না!”

শাফিন কে নামতে দেখে রুমাইশা ওর হাত খপ করে ধরে বলল,
—তুই কোথায় যাচ্ছিস? আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।”

শাফিন ধরা পড়ে গিয়ে আবার ওর আগের জায়গায় এসে বসে পড়লো, তারপর বলল
—হ্যা বল, আর কি প্রশ্ন আছে তোমার!”

— ভাইয়া কারো সামনে আসে না কেন? আর এমনে ঢেকে ঢুকেই বা যায় কেন? তোর সামনেও আসে না! এটা কোনো কথা? বাইরের মানুষের সামনে না হয় নাই গেলো, কিন্তু তুই? তুই তো ওর ভাই, তোর সামনে আসে না কেন?”

শাফিন এক হাত হাটুর ওপর ভর দিয়ে মুখে ঠেকিয়ে বলল, —সেটা আমিও জানিনা, মায়ের কাছে, বাবার কাছে কতদিন জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আমাকে কেউ কিছু বললই না, আর ভাইয়ার সাথে তো দেখাই হয় না৷ আমি আসলে এদের কেউ না, আমাকে এরা অনাথাশ্রম থেকে এনেছে৷”

রুমাইশা সিরিয়াস মুখ করে বলল,
—আমার ও তাই মনে হয়। আচ্ছা, তুই এখন যেতে পারিস। তোকে আর লাগবে না।”

— হ্যা, কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরালে পাজি!”
বলে শাফিন খাট থেকে নেমে হন হন করে বাইরে চলে গেলো।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।