গ্রামের রাস্তা এখন পুরোপুরি ফাকা। সেই ফাকা রাস্তাতেই বুলেটের গতিতে নিজের মার্সিডিজ বেঞ্জ টা হাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সাফওয়ান।
শাফিন বসে আছে ভাইয়ের পাশের সিটে চুপচাপ। ওর মাথায় ঘুরছে একটু আগের সাফওয়ান আর রাফসান ভাইয়ের ভেতর কার আক্রমনাত্মক সংলাপ গুলো।
সাফওয়ান ভাইয়া রুমি আপুকে বিয়ে করতে যাচ্ছে শুনেই রাফসান ভড়কে যায় অনেক। সাফওয়ানের এই ভয়ঙ্কর জীবনের সাথে রুমি আপুকে না জড়ানোর জন্য মিনতি করে ও। নইলে সাফওয়ান কে খুজতে থাকা লোকজন দের জানিয়ে দেবে যে সাফওয়ান ঠিক কোথায় আছে। কিন্তু রাফসানের কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কল কেটে দেয় সাফওয়ান৷
সাফওয়ান ভাইয়া যে রুমি আপুকে বিয়ে করতে যাচ্ছে এটা ভেবে ওর ভালো লাগছে অনেক। ফাইনালি গুলুমুলু রুমি আপুকে নিজেদের কাছে স্থায়ী ভাবে রেখে দিতে পারবে৷ কিন্তু রাফসান ভাইয়ার কথা গুলো শাফিন কে ভাবাচ্ছে অনেক। সাফওয়ান ভাইয়া কি করেছে? ওকে সিঙ্গাপুরের লোকজন ই বা খুজছে কেন! কি এমন কাজ করতো ভাইয়া সিঙ্গাপুরে! কয়েক বার মনে হলো ভাইয়া কে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু সাফওয়ানের ইস্পাত কঠিন মুখ টার দিকে তাকিয়ে আর সাহস হলো না কিছু জিজ্ঞেস করার। চুপচাপ রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো ও
.
নিজের বিছানায় চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে রুমাইশা। চোখ থেকে মাঝে মাঝেই ফোটায় ফোটায় পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ শাড়ি পরেনি ও। ওকে জোর জবরদস্তি করেও আয়েশা বা জুলেখা কেউই শাড়ি পরাতে পারেনি। আগে যে পোশাক পরা ছিলো তাই-ই পরে আছে ও এখন।
বিছানার চাদর টা দুই হাতে খামছে ধরে রেখেছে গায়ের জোরে। অনড় হয়ে আছে একদম। আয়েশা আর জুলেখা দুজন ওর দুদিকে বসে আছেন৷ জুবায়ের একটু দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে ওর সোজাসুজি।
চোখ দুইটা লাল হয়ে ফুলে আছে ওর। বাম পাশের চোয়াল টা আয়েশার হাতের চড় খেতে খেতেই যেন ফুলে গেছে। চড়ের দাগ গুলো স্পষ্ট হয়ে আছে মুখের ওপর।
শামসুল বাইরে থেকে আয়েশার উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
— ইমাম সাহেব রওনা দিয়েছে। পৌছে যাবে খানিক পর। হেটে আসছে তাই সময় লাগবে একটু।
আয়েশা সেটা শুনে রুমাইশার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ইমাম সাহেব ও চলে আসছে। তুই শাড়ি পরিসনি বলে কি তোর বিয়ে আটকে থাকবে? কখনোই না। বিয়ে তোর আজকে হবেই। তুই মরলেও আজ তোর বিয়ে হবে৷ কত বড় সাহস তোর! নিজের বাবা মায়ের কথা না ভেবে তুই কোথাকার কোন জংলির কথা ভাবিস! বিয়ে না করে তুই আজ কোথায় যাস আমি দেখবো।
রুমাইশা বাঘিনীর ন্যায় গর্জে উঠলো,
— আমার প্রাণ থাকতে আমি সাফওয়ান ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না। আর তোমার এই অসভ্য বেয়াদব জুবায়ের কে তো কোনো ভাবেই না! এই বাড়ি থেকে কিছু বের হলে আমার লাশ বের হবে, জেনে রাখো তুমি! আমি বেচে থাকতে তুমি আমার বিয়ে কিভাবে দাও আমিও দেখবো! আমাকে জোর করলে আত্মহত্যা করবো আমি! রাস্তায় গিয়ে গাড়ির নিচে পড়বো। তবুও একে বিয়ে করবো না, শুনে রাখো তুমি!
মেয়ের কথায় আয়েশা কিছুক্ষণ শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঠাস করে একটা চড় মারলেন ওর বাম গালে।
.
দক্ষ হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরাচ্ছে সাফওয়ান। চোখ মুখ ওর ভয়ানক রকমের শক্ত। শাফিন মাঝে মাঝেই ভাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখিছে। ভাইয়ের মুখভঙ্গি হঠাৎ হঠাৎ করেই যেন চেঞ্জ হচ্ছে। কিন্তু অভিব্যক্তি গুলো মোটেও ভালোর দিকে যাচ্ছে না, উলটো খারাপের দিকে যাচ্ছে।
খানিক পর এক হাতে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে নিজের মাস্ক আর গগলস পরে নিলো ও। রুমি দের বাড়ির প্রায় কাছা কাছি চলে এসেছে ওরা। আরও কিছুদুর যেতেই একজন হুজুর কে হেটে যেতে দেখলো রাস্তায়। হুজুর কে ক্রস করেই ব্রেক কষলো সাফওয়ান।
এতরাতে এমন দামি গাড়িকে নিজের সামনে দাড়াতে দেখে ভড়কে গেলেন লোক টা। সাফওয়ান জানালার কাচ নামিয়ে হুজুরের দিকে দেখলো।
এরকম কালো পোশাক, চোখ মুখ ঢাকা, বিশালদেহী সাফওয়ান কে দেখে হুজুর ভয় পেলেন অনেক। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলেন তিনি সাফওয়ানের দিকে।
সাফওয়ান হুজুর কে ভয় পেতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাচ্ছেন চাচা?
হুজুর প্রথমে কোনো কথাই বলল না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শুধু। হুজুরের নিরবতা দেখে সাফওয়ান আবার চাচা বলে ডাক দিলে লোক টার হুস ফিরলো যেন।
আমতা আমতা করে বললেন,
— শা-শামসুল কাদেরের বাড়িতে যাচ্ছিলাম।
সাফওয়ান গমগমে গলায় বলল,
— উঠে আসুন, আমরাও যাচ্ছি। বিয়েতে।
বিয়ের কথা শুনে হুজুর বিশ্বাস করলেন ওদের। মুখে ওনার আলতো হাসি ফুটে উঠলো। সাফওয়ান শাফিন কে ইশারা করলে শাফিন গাড়ির দরজা খুলে নেমে দাড়ালো, তারপর হুজুর কে সাফওয়ানের পাশের সিটে বসতে দিলো। হুজুর উঠে বসলে দরজা টা বন্ধ করে দিয়ে নিজে গিয়ে বসল পেছনের সিটে৷
শাফিন উঠলে সাফওয়ান আবার ড্রাইভিং শুরু করলো। হুজুর একবার পেছন ফিরে শাফিনের দিকে তাকালেন, তারপর আবার সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন,
— আপনারা কোন পক্ষ? ছেলে পক্ষ না মেয়ে পক্ষ?
পেছন থেকে শাফিন বলে উঠলো,
— আমরা ছেলে পক্ষ।
হুজুর মনে মনে খুশি হলেন অনেক। ছেলে পক্ষ তো বেশ বড় ঘরের মনে হচ্ছে। তাহলে তো আজ বেশ ভালোই একটা অ্যামাউন্ট ইনকাম হবে ওনার৷ হুজুরের খুশি টা চোখে মুখে ফুটে উঠলো। নিজের সিট থেকে একটু খানি সাফওয়ানের দিকে সরে এসে বসলেন তিনি। তারপর আগের মতোই মুখে হাসি এনে জিজ্ঞেস করলেন,
— আপনি জামাইয়ের কি হন?
সাফওয়ান সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই উত্তর করলো,
— আমিই জামাই।
হুজুর থতমত খেলো, হাসি হাসি মুখ টা হুট করেই নিভে গেলো। অপ্রতিভ হয়ে অবিশ্বাস্য চোখে একবার পেছনে বসা শাফিনের দিকে তাকালেন তিনি। হুজুরের চেহারার অবস্থা দেখে শাফিন মুখ টিপে হাসলো।
হুজুর আবার সাফওয়ানের দিকে একবার তাকালেন। এমন দানবাকার কেউ একজন রুমির মতো পাঁচ ফুট মেয়ের জামাই হবে ভেবেই তাজ্জব বনে গেলেন তিনি। হুজুরের এমন হতভম্ব চেহারা খেয়াল করে সাফওয়ান বলল,
— চিন্তা করবেন না, আপনাকে খুশি করে দেওয়া হবে৷ শুধু মুখ বন্ধ রাখবেন। আপনি এখন আমার শ্বশুর মশাইকে একটা কল দিয়ে বলুন গেইট খুলে রেডি থাকতে৷
পাত্র নিজে ফোন না দিয়ে তাকে দিয়ে ফোন দেওয়াচ্ছে দেখে বেজার হলেন ইমাম সাহেব। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন টা বের করে কল দিলেন শামসুলের কাছে৷ শামসুল কল রিসিভ করলে হুজুর বলে উঠলেন,
— ভাইজান গেইট খুলেন, গাড়ি করে আসছি। তাড়াতাড়ি।
বলেই শামসুল কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলেন। শামসুল ভাবনায় পড়ে গেলেন। খানিক আগেই তো বলল যে হেটে আসছে, এখন আবার বলছে যে গাড়িতে আসছে! গাড়ি পেলো কই?
ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে বাইরে থেকে আয়েশার উদ্দ্যেশ্যে উচ্চস্বরে বললেন যে ইমান সাহেব পৌছে গেছেন প্রায়৷
আয়েশা রুমাইশার পাশেই বসে ছিলেন। অন্য পাশে জুলেখা বসেছিলেন এতক্ষণ। ইমামের আসার কথা শুনে তিনি রুমির পাশ থেকে উঠে গিয়ে জুবাইয়ের কে বসতে দিলেন৷ আয়েশা ও উঠে দাড়ালেন। তারপর দেওয়ালের কাছে গিয়ে জুলেখার পাশে দাড়ালেন।
জুবায়ের একবার চোরা চোখে রুমাইশার কান্নারত চেহারার দিকে তাকিয়ে ওর হাত টা ধরতে গেলো। হাতে স্পর্শ করা মাত্রই রুমাইশা এক ঝটকায় ওর হাত সরিয়ে দিয়ে গর্জে উঠে বলল,
— মোটেই আমাকে ছোবেন না আপনি। আমাকে বিয়ে করার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন, এখনো সময় আছে। নইলে আমার সাফওয়ান যদি একবার জানতে পারে তাহলে আপনি আমাকে ছোয়ার চেষ্টা করেছে, তাহলে আপনাকে মেরে মাটিতে পুতে ফেলতে ওর দু মিনিট ও লাগবে না। সাবধান হয়ে যান৷
রুমাইশার এমন কথায় আয়েশা ফুসে উঠে বললেন,
— সে জংলি জানতে পারলে তো! তোর ফোন তো তুই আর ফেরত ই পাবি না! বিয়ের পর পর ই তোর পাসপোর্ট ভিসার ব্যাবস্থা করা হবে। আর একবার ইতালি চলে গেলে এই জীবনে আর সাফওয়ানের মুখ দেখতে পাবিনা৷ জুবায়েরের সাথেই তোর থাকা লাগবে সারাজীবন। আর, পালাবি তুই বিয়ের পর! সেটাও হবে না, শিকল দিয়ে বেধে রাখতে বলবো তোকে। মানুষের সাথে ওনার বিয়ে দিচ্ছি তাতে ওনার হচ্ছে না, ওনার জানোয়ার লাগবে! বেয়াদব কোথাকার!
রুমাইশা মায়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে কান্নারত অবস্থায় উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
— তোমার মতো মা যেন আর কারো না হয়! আমি নাকি তোমার কত আদরের মেয়ে! আর সেই আদরের মেয়ের সাথে তুমি এইরকম করছো! যেদিন আমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবা সেদিন বুঝবা তুমি! সেদিন আমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার মূল্য দিবা তুমি! এই জুবায়ের যদি আমাকে ছোয় তবে আমি ওকে খুন করবো বলে দিলাম।
আয়েশা দাঁতে দাঁত চেপে আবার ও সপাটে চড় মারলেন রুমির গালে। ফুপিয়ে কেদে উঠলো ও!
শামসুল বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রাস্তার দিকে তাকিয়ে। সেই মুহুর্তে রাস্তার ওপর থেকে বাড়ির দিকে একটা কালো গাড়িকে মোড় ঘুরতে দেখলেন তিনি। ঝাপসা আলোয় চোখ কুচকে বোঝার চেষ্টা করলেন সেটা কার গাড়ি। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই গাড়ি টাকে চিনে ফেললেন তিনি! আর চেনা মাত্রই গলা শুকিয়ে গেলো তার। চোখের পলক পড়লোনা যেন আর৷
সাফওয়ান এত রাতে এখানে কেন? ও কে কি কেউ জানিয়ে দিলো রুমির বিয়ের ব্যাপারে! জানালেও কে জানাবে? রুমির কাছে তো ফোন নেই। তাহলে কে জানালো!
সাফওয়ানের গাড়িটা এগিয়ে এসে গেইটের কাছে হর্ণ দিতেই যন্ত্রের মতো গিয়ে গেইট টা খুলে দিলেন শামসুল। সাফওয়ান গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকলো৷ গাড়িটা একপাশে পার্ক করে দরজা খুলে বের হলো সাফওয়ান। তারপর ই পেছন থেকে শাফিন নেমে এসে হুজুরের পাশের দরজা খুলে দিলে হুজুর নামলো।
সাফওয়ান ধীর পায়ে হেটে শামসুলের সামনে গিয়ে দাড়ালেন। নিজের থেকে হাফ ফিট উচু সাফওয়ানের দিকে মুখ উচু করে তাকালেন তিনি। একবার ঢোক গিললেন শব্দ করে৷ সাফওয়ান শামসুলের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল,
— আমাকে না জানিয়ে আমারই হবু বউ কে অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছেন, বিষয় টা আমি মোটেও ভালো চোখে দেখছিনা মামা!
শামসুল সাফওয়ানের থেকে চোখ নামিয়ে নিলেন। অনুশোচনা হচ্ছে ওনার৷ স্ত্রী সন্তানের কথায় মেয়েটাকে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন তিনি৷ দোটানায় পড়ে স্রোতের সাথে তাল মেলানোর সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মন সায় দিচ্ছিলো না তার। আর এখন সাফওয়ান চলে আসায় পরিস্থিতি বেকায়দা হয়ে গেছে আর ও।
শামসুল কে এইভাবে চুপ থাকতে দেখে সাফওয়ান আবার ও বলে উঠলো,
— রিমু কোথায় ?
শামসুল মুখ দিয়ে কোনো কথা বললেন না, বাইরে থেকে শুধু রুমির রুমের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিলেন৷
সাফওয়ান শাফিন আর ইমাম সাহেব কে ইশারায় আসতে বলে নিজেও ভেতরে চলে গেলো।
রুমাইশার গা ঘেষে বসে আছে জুবায়ের৷ বার বার রুমির দিকে তাকাচ্ছে ও৷ একবার শুধু বিয়ে টা হয়ে যাক। এই মেয়ে কে কি করে টাইট করতে হয় তা ওর জানা আছে। এমনিতেই রাত অর্ধেকের বেশি শেষ হয়ে গেছে। আর অল্প কয়েক ঘন্টা বাকি আছে৷ ওই সুন্দর দেহ টা উপভোগ না করা পর্যন্ত ওর মাথা ঠান্ডা হবে না৷ কিন্তু এ যেভাবে চিৎকার চেচামেচি করছে, রুমের ভেতর ও তো উদ্ধার করে ফেলবে। জুবায়ের মনে মনে হাসলো, বেধে ফেলবে ওর মুখ হাত পা সব। তারপর ইচ্ছে মতো উপভোগ করবে ও৷ রুমাইশা চিৎকার নড়াচড়া, ছোড়াছুড়ি কিছুই করতে পারবে না৷ উফ, ভাবতেই ওর গায়ের ভেতর শিরশির করছে।
রুমাইশা নাক টানছে থেকে থেকে। ফুপিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। মায়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে, যেন মায়ের ওর ওপর একটি বারের জন্য হলেও একটু দয়া হয়, আর এই বিয়ে থামিয়ে দেয়!
কিন্তু আয়েশার চোখ মুখের কোনো পরিবর্তন নেই। আগের মতোই কর্কশ মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। বাইরে কতক গুলো পায়ের শব্দ শুনে আয়েশা বুঝে গেলেন ইমাম সাহেব এসে গেছে। পায়ের শব্দ রুমাইশা ও শুনলো।
মায়ের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে উচ্চস্বরে কেদে উঠলো ও এইবার। বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়লো, তারপর কান্নারত অবস্থাতেই মিনতি করলো,
— আমার এমন সর্বনাশ করোনা মা, আমাকে বিয়ে দিও না তুমি ওই লুইচ্চার সাথে মা! দয়া করো! আমি মরে যাবো সাফওয়ান কে ছাড়া, মা, দয়া করো আমাকে! আমাকে বিয়ে দিও না ওর সাথে, মা গো!
আয়েশার মন গলল না মেয়ের কথায়। তীর্যক চাহনি দিয়ে তিনি বললেন,
— কান্নাকাটি বাদ দিয়ে শান্ত হয়ে বস। সাফওয়ানের নাম ও মুখে নিবি না তুই। বিয়ে তোর জুবায়েরকেই করা লাগবে, যে কোনো মূল্যে, নইলে তোর কপালে দুঃখ আছে৷
ঠিক এমন সময় দরজার কাছ থেকে গমগমে একটা কণ্ঠস্বর এসে পুরো রুমের ভেতর ছড়িয়ে পড়লো,
— দুঃখ তো আপনার কপালে আছে মামি!
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলো সাফওয়ান। আয়েশা চমকে তাকালেন সেদিকে। মাথা ছাড়া আপাদমস্তক কালো পোশাকে আবৃত সাফওয়ান যেন তার একটা কথা দিয়ে পুরো রুমের পরিবেশ টাই বরফ শীতল করে ফেললো।
এমন দানবাকার কাউকে এইভাবে ঘরের ভেতর দেখে জুবায়ের ভড়কে গেলো। বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো ও৷ আয়েশা সাফওয়ানকে চিনতে পারা মাত্রই দেয়াল ছেড়ে দ্রুত পায়ে রুমাইশার খাটের পেছেনের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বোনকে এইভাবে ভয় পেয়ে সরে যেতে দেখে জুলেখাও তাড়াতাড়ি বোনের কাছে গিয়ে দাড়ালেন৷ জুবায়ের খালার এমন ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। বুঝে উঠতে পারলোনা কি হচ্ছে।
এমন অসহায় একটা মুহুর্তে দিশেহারা রুমাইশা সাফওয়ানের হঠাৎ আগমনে যেন প্রাণ ফিরে পেলো। মেঝে থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে হাউমাউ করে জড়িয়ে ধরলো ও সাফওয়ান কে৷
সাফওয়ানের বক্ষপাজরের নিম্নাংশে গিয়ে ঠেকলো ওর মাথা টা। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাফওয়ান কে জড়িয়ে ধরেছে ও, যেন ছেড়ে দিলেই জীবনের শেষ অবলম্বন টা হারিয়ে ফেলবে ও৷
সাফওয়ান ও রুমাইশাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো একেবারে। রুমাইশা ফুপিয়ে উঠে বলল,
— আল্লাহ আমার দুয়া কবুল করেছে, আপনি এসেছেন! আমাকে নিয়ে যান এখান থেকে। এরা আমার সাথে অমানুষের মতো আচরণ করছে! আমাকে ওই অসভ্যটার সাথে বিয়ে দিতে চাইছে ওরা! আমি বাচবোনা আপনাকে ছাড়া। নিয়ে যান আপনি আমাকে এখান থেকে! নিয়ে যান।
সাফওয়ান রুমাইশার মুখ টা উঠিয়ে চোখ থেকে পানি মুছে দিতে দিতে নরম গলায় বলল,
— শশস, কান্না থামা, আমি এসে গেছি। এখন কারো বাপের ক্ষমতা নেই তোর গায়ে একটা ফুলের টোকা দেওয়ার। তোর গায়ে করা প্রতিটা আঘাতের পাই টু পাই হিসাব নেবো আমি।
চোখের পানি মোছা শেষ হলে রুমাইশার বাম গালে চোখ পড়লো সাফওয়ানের। গাল টা লাল হয়ে আছে, কয়েকটা আঙুলের দাগ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে গালে৷
হটাৎ করেই টান দিয়ে নিজের চোখের গগলস টা খুলে ফেললো সাফওয়ান। ফোপাতে থাকা রুমাইশার বাম গাল টা খুব মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো ও কিছুক্ষণ, আর তারপর আয়েশার দিকে তাকালো।
আয়েশা সাফওয়ানের এমন ধ্বংসাত্মক দৃষ্টি দেখে জমে গেলেন একেবারে। আয়েশার পাশে থাকা জুলেখা আর বিছানার অন্য প্রান্তে দাঁড়ানো জুবায়ের সাফওয়ানের ধুসর সবুজ রঙা জ্বলজ্বলে চোখ দুইটা দেখেই স্থীর হয়ে গেলেন।
সাফওয়ান আয়েশার চোখের দিকে দৃষ্টি রেখেই মুখের মাস্ক খুলে রুমাইশার বাম গালে চুমু খেলো। একটা বারের জন্য ও আয়েশার দিক থেকে চোখ ফেরালোনা ও৷
সন্ধ্যা থেকে এইপর্যন্ত বারংবার অত্যাচারিত হওয়া বাম গালে সাফওয়ানের এমন ভালোবাসার পরশ পেয়ে ফুপিয়ে কান্না করে উঠলো রুমাইশা৷
সাফওয়ান রুমাইশার হাত টা ধরে আয়েশার দিকে আর একবার কঠিন দৃষ্টি দিয়ে মাস্ক টা মুখে দিয়ে চোখে গগলস টা লাগিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
শামসুল এতক্ষন সোফাতেই বসে ছিলেন। তার দুই পাশে শাফিন আর ইমাম সাহেব বসা। শাফিন মাঝে মাঝে মামার সাথে টুকটাক কথা বলছে। সাফওয়ান রুমাইশার হাত ধরে নিয়ে এসে বসে পড়লো শামসুলের বিপরীত পাশের সোফায়৷
তারপর শামসুল কে উদ্দ্যেশ্য করে কড়া গলায় বলল,
— মামা, আপনি কি করতে যাচ্ছিলেন সে সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে? খোজ খবর না নিয়ে, না জেনে শুনে রিমু কে আপনি ওই জুবায়ের নামক অসভ্য টার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন! এই আপনার পিতৃত্বের পরিচয়! তার ওপর রিমু আমার বাগদত্তা! হাউ ক্যান ইয়্যু ডু সাচ অ্যা রিডিক্যুলাস থিং! হাউ ক্যান ইয়্যু জাস্ট ইমাজিন ডুইং ইট! হাউ? আপনি জানেন জুবায়েরের সম্পর্কে কিছু? ধারনা আছে আপনার ওর সম্পর্কে কিছু? আপনি জানেন, ও বারে গিয়ে মদ খেয়ে পতিতাদের কোলে শুয়ে থাকে রোজ রাতে, জানেন আপনি? এইরকম চারিত্রিক পতন ঘটা কারো সাথে আপনি কিভাবে আপনার মেয়ের লাইফ জুড়ে দেওয়ার চিন্তা করেন! যেখানে সে অন্য কারো বাগদত্তা! ইটস্ অ্যা শেইম! টোটাল শেইম!
রুমাইশা অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। শামসুল নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়ের চোখে চোখ পড়ার ভয়ে মাথা তুলছেন না তিনি।
দোটানায় পড়ে খুব বড় ধরনের ভুল করেছেন তিনি৷ স্ত্রি সন্তানের ম্যানিপুলেশনে পড়ে তিনি পিতার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন অনেক৷ জুবায়ের চরিত্রহীন জানার পর ও মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। এরকম টা তো তিনি চাননি। রুমাইশার বলা প্রতিটা কথা এখনো তার কানে বাজছে৷ রুমাইশার সেই আকুতি ভরা চিৎকার গুলো মনে পড়লেই বুক টা ওনার কেপে উঠছে। সাফওয়ান আসাতে উনি যেন স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন।
শামসুলের এমন নিরবতা তে সাফওয়ান নিজের কঠিন গলা টা যথাসম্ভব নরম করে বলল,
— বিয়ের কাজ শুরু করার অনুমতি দিন মামা, আর বাকি দের ডাকুন। এই ঝামেলা আমি আজকেই শেষ করে দিতে চাই। আমার হবু স্ত্রী কে আমার ই অগোচরে অন্য কারো সাথে জোর করে বিয়ে দেওয়ার মূল্য বুঝিয়ে দিবো আমি সবাইকে৷ দ্রুত ডাকুন সবাইকে।
শামসুল ইমাম সাহেব কে বিয়ে পড়ানোর প্রস্তুতি নিতে ইশারা দিয়ে রুমাইশার রুমের দিকে এগোলেন আয়েশা সহ বাকি দের ডাকতে।
ইমাম সাহেব চুপসে গেছেন। শক্ত সামর্থ্য শামসুল কে এই দানবাকার ছেলেটার সামনে মিইয়ে যেতে দেখে তার বুঝতে বাকি রইলো না যে এ খুব কঠিন জিনিস! তিনি রেজিস্ট্রি খাতা টা বের করতে লাগলেন৷
শামসুল বাকি দের ডেকে ফিরে এসে আবার নিজের জায়গায় বসলেন। ওনার পেছন পেছন আয়েশা এলেন। শামসুলের পেছনে গিয়ে দাড়ালেন তিনি।
জুলেখা এলে সাফওয়ান রুমাইশার পাশে জুলেখা কে বসতে ইশারা করলো। জুলেখা যন্ত্রের মতো বসে পড়লেন রুমাইশার পাশে। জুবাইয়ের এদের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে রইলো সোফার পাশে।
ইমাম সাহেব সাফওয়ানের থেকে সাফওয়ানের পুরো নাম আর বাবার নাম নিলেন। তারপর শামসুলের থেকে রুমাইশার পুরো নাম আর শামসুলের পুরো নাম নিলেন৷ এরপর শামসুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন দেনমোহর কত হবে?
সাফওয়ান এপাশ থেকে গমগমে কণ্ঠে বলে উঠলো,
— গয়না সহ পঞ্চাশ লাখ। এই মুহুর্তে আমার কাছে সাড়ে পাঁচ লাখ আছে দেওয়ার মতো বাকি টা বউ নিয়ে বাসায় ফিরে পরিশোধ করবো।
ইমাম সাহেব চোখ বড়বড় করে একবার সাফওয়ানের দিকে তাকালেন, পরক্ষনেই শামসুলের দিকে আর একবার তাকালেন৷ পাশে বসে থাকা জুলেখার চিবুক নেমে গেলো। সোফার অপর প্রান্তে দাঁড়ানো জুবায়ের অবিশ্বাস্য চোখে দেখতে লাগলো সাফওয়ান কে। এ আবার কোথাকার কোন হরিদাস, ভাবতে লাগলো ও!
বাকি তথ্যাদি লিখে ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
— সাক্ষী কারা হবেন?
কারো উত্তর দেওয়ার আগেই সাফওয়ান ইমাম সাহেবের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
— আমার পক্ষে সাক্ষী দিবেন আপনি আর আমার ভাই। আর রিমুর পক্ষ থেকে দিবে জুলেখা খালা আর জুবায়ের,
বলে জুবায়েরের দিকে একবার তাকালো ও৷
সাফওয়ানের মুখে নিজের নাম শুনে জুলেখা কেপে উঠলেন। জুবায়ের মনে মনে ক্ষেপে গেলো ভিষন। যেখানে ওর বিয়ে করার কথা ছিলো সেখানে ও এখন মেয়ে পক্ষ থেকে সাক্ষী দিবে! ওর ক্ষমতা থাকলে এখনি এই ছেলেকে দু চার ঘা বসিয়ে দিতো ও। কিন্তু ওর ওই চোখ জোড়ার কথা মনে করে আর আয়েশা খালার চুপ হয়ে যাওয়া দেখে আগানোর সাহস হলো না ওর। চুপ চাপ যা হচ্ছে দেখে যেতে থাকলো।
ইমাম সাহেব এবার উঠে এসে রুমাইশার বিপরীতে রাখা সোফায় বসলেন। তারপর বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন,
— হাজিরান মজলিশে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দেনমোহরে (নগদ/বাকি) যশোর জেলার সদর থানার হৈবতপুর নিবাসী ইশতিয়াক আহমেদ এর বড় ছেলে সাফওয়ান আহমেদের সহিত তোমার বিবাহ দেওয়া হচ্ছে, তুমি কবুল? কবুল থাকলে বলো, আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
উষ্কখুষ্ক চুলে, মুখে চড়ের দাগ নিয়ে, ন্যাতানো একটা সালওয়ার কামিজ পরিহিতা রুমাইশা তার সন্ধ্যা রাত থেকে কান্না করা ফোলা চোখ নিয়ে এখন কবুল বলে কারো বৈধ সম্পত্তি হতে চলেছে।
এই মুহুর্তে পুরোটাই ওর কাছে স্বপ্ন মনে হলো যেন! চারপাশ টা কেমন যেন নতুন লাগলো সম্পুর্ন। হৃদযন্ত্র টা সাধারণের তুলনায় দ্রুত ধড়াস ধড়াস করছে। কান মাথা গরম হতে শুরু করেছে। পা দুইটা কেপে উঠছে মাঝে মাঝে। দুই হাত দিয়ে নিজের কামিজের হাটুর ওপরে থাকা অংশ টা খামছি দিয়ে ধরে রাখলো ও৷ চোখ দুইটা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে ও!
রুমাইশার গায়ের সাথে লেপ্টে বসা সাফওয়ান প্রিয়তমার এমন অস্থিরতা টের পেতেই নিজের হাত টা রুমাইশার হাতের ওপর রাখলো। সাফওয়ানের এমন ভরসার ছোয়া পেয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে গেলো রুমাইশা৷ ইমাম সাহেব আর ও একবার বললেন,
— বলো মা, আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
রুমাইশা সবার অগোচরে বড় করে নিঃশ্বাস নিলো, তারপর মৃদু স্বরে বলল,
— আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
রুমাইশার মুখে কবুল শুনে সাফওয়ান, শামসুল দুজনেই চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন, সম্পুর্ন দুজনের অগোচরে। পর পর আর ও দুবার কবুল বলল রুমাইশা৷
আর তারপরই দুই চোখ থেকে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো ওর কোলের ওপর। এটা আনন্দাশ্রু নাকি পরিজন কে ছেড়ে যাবার কান্না সেটা বুঝলো না রুমাইশা নিজেও৷ ইমাম সাহেব রেজিস্ট্রি পেপার টা এগিয়ে দিলেন ওর দিকে স্বাক্ষর করার জন্য।
সাক্ষর করা হয়ে গেলে ইমাম সাহেব এবার সাফওয়ানের দিকে ফিরে একই ভাবে জিজ্ঞেস করলেন। ইমাম সাহেবের জিজ্ঞেস করা শেষ হতে না হতেই সাফওয়ান কবুল বলে দিলো তিন বার ই৷
ইমাম সাহেব হাসলেন মনে মনে৷ ছেলে গুলো বরাবর এরকমই হয়। কবুল বলতে দেরি করে না একটু ও৷
কবুল বলেই সাফওয়ান নিজের পকেট থেকে গাড় নীল রঙা একটা বক্স বের করলো। তারপর বাম হাত টা দিয়ে রুমাইশার ডান হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বক্স থেকে বের করা স্নো ফ্লেক ডিজাইনের ডায়মন্ড রিং টা পরিয়ে দিলো ওর ডান হাতের অনামিকা তে।
রুমাইশা চকিতে একবার মুখ তুলে তাকালো সাফওয়ানের দিকে, সাফওয়ান ও সেই মুহুর্তেই তাকালো তার প্রেয়সীর দিকে। দুজনের চোখাচোখি হতেই রুমাইশা চোখ ফিরিয়ে নিলো।
এই মুহুর্ত থেকে ও সাফওয়ানের কাগজে কলমে লিখে নেওয়া সম্পত্তি, যার একচ্ছত্র আধিপতি সাফওয়ান নিজেই। হঠাৎ করেই নিজের ভেতর অদ্ভুত এক শক্তিশালী সত্তা কে অনুভব করলো রুমাইশা৷ কেউ আর চাইলেও ওর একটা পশমেও স্পর্শ করতে পারবে না! তার সাফওয়ান, তার স্বামী তার সামনে পাহাড়ের মতো ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে সর্বদাই৷
আংটি পরানো হয়ে গেলে ইমাম সাহেব বললেন,
— সাক্ষী রা এসে সই করুন এবার৷
জুবায়ের আর জুলেখা এসে রুমাইশার পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করলো। আর ইমাম সাহেব আর শাফিন সাফওয়ানের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করলো। স্বাক্ষর শেষে ইমাম সাহেব মোনাজাত ধরতে বললেন।
নিরবে সৃষ্টিকর্তার দরবারে মোনাজাত ধরলেন সবাই। পুরো বাড়িতে যেন হঠাৎ করেই অদ্ভুত রকমের একটা শান্তি শান্তি আবহাওয়া নেমে এলো। চারদিক নিরব হয়ে শীতল একটা পরিবেশের সৃষ্টি হলো।
মোনাজাত শেষ করে সাফওয়ান শাফিন এর হাতে ইমাম সাহেবের জন্য টাকা দিয়ে ইশারা করলো তাকে গেইটে এগিয়ে দিয়ে আসার জন্য। শাফিন ইমাম সাহেব কে নিয়ে মেইন ডোর পার হয়ে বাইরে যেতেই সাফওয়ান এক টান দিয়ে নিজের মাস্ক আর গগলস খুলে ফেললো। মাস্ক খুলতেই ওর ইস্পাত কঠিন মুখ টা সবার দৃষ্টি গোচর হলো।
এই অদ্ভুত দর্শনের অস্বাভাবিক সৌন্দর্যের অধিকারী সুপুরুষ টাকে দেখে জুলেখা বেশ অবাক ই হলেন। তখন তিনি দূর থেকে ভালো ভাবে খেয়াল করেননি, এখন কাছ থেকে দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন৷
সাফওয়ান রুমাইশার দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে তারপর জুবায়েরের দিকে তীর্যক চোখে তাকালো। এরপর বজ্র কণ্ঠে বলে উঠলো,
— শামসুল মামা আর জুলেখা খালা, আপনারা দুজন নিজেদের রুমে যান। বাইরে যাই-ই হয়ে যাক না কেন কেউ বের হবেন না। আয়েশা মামি আর জুবায়েরের সাথে আমার কিছু হিসাব নিকাশ বাকি আছে।
শামসুলের বুক কেপে উঠলো, চকিতে একবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আয়েশার দিকে দেখলেন তিনি। আয়েশার মুখটা পাংশু হয়ে আছে। অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে চোখে মুখে।
শামসুল আবার সাফওয়ানের দিকে একবার তাকালো। শামসুলের দৃঢ় বিশ্বাস সাফওয়ান জুবায়েরের সাথে যা-ই করুক আয়েশা কে কিছু করবে না৷
সাফওয়ানের দিকে আর ও একবার বিশ্বাসী দৃষ্টি দিয়ে শামসুল উঠলেন সোফা থেকে৷ স্বামী কে উঠে যেতে দেখে আয়েশা ভয় পেলেন অনেক। এখন উনি কি করবেন?
শামসুল কে উঠে যেতে দেখে জুলেখাও কয়েক বার জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে উঠলেন সোফা থেকে। তার পর রুমে গিয়ে দুজনেই দরজা দিয়ে দিলেন।
ওনারা চোখের আড়াল হতেই সাফওয়ান ধাম করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো……