সাফওয়ান বিছানা থেকে নেমে দাড়ানোর পর রুমাইশা সহাস্যে ওর থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে দাড়ালো। আর এরপর নিজের ডান দিকে চোখ পড়তেই চমকে গেলো রুমাইশা। হাস্যজ্বল মুখখানায় অমানিশা নেমে এলো ওর মুহুর্তেই। হতবাক হয়ে ও তাকিয়ে রইলো ওর ডান দিকের দেয়ালে ঠেকিয়ে রাখা ফুল ভিউ মিররের দিকে
বিস্মিত নয়নে সেদিকে আরও একটু এগিয়ে গেলো রুমাইশা, নিজেকে আরও খুটিয়ে দেখার জন্য। আয়নার একদম কাছে গিয়ে দাড়ালো ও।
রুমাইশা কে এইভাবে নিজেকে দেখতে দেখে সাফওয়ান ধীর পায়ে এসে দাড়ালো ওর পেছনে। চোখে মুখে ওর অপরাধবোধ ফুটে উঠেছে স্পষ্ট ভাবে। থমথমে মুখে রুমাইশার আয়নায় ফুটে ওঠা প্রতিচ্ছবি টা দেখতে লাগলো ও।
রুমাইশা হতবিহ্বল হয়ে একবার নিজেকে দেখলো তো আর একবার সাফওয়ান কে। সাফওয়ান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো, কি বলে রিমু কে ও স্বান্তনা দিবে সেটা ও নিজেও জানে না! রিমু কে স্বান্তনা দেওয়ার মতো মুখ নেই ওর। সেদিন নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ না হারালে আজ এই দিন টা দেখতে হতো না। যা হচ্ছে সবকিছুর জন্য ও নিজেই দায়ী, সেই প্রথম থেকেই!
আয়নার দিক থেকে রুমাইশা ঘুরে দাড়ালো সাফওয়ানের দিকে। মুখ টা উচু করে সাফওয়ানের দিকে দেখলো ও। ওর সম্মোহনী দৃষ্টি পড়লো সাফওয়ানের মুখের ওপর। সাফওয়ান তাকাতে পারলো না রুমাইশার ওই চোখের দিকে৷ অপরাধবোধ ছেকে ধরেছে ওকে। রিমুকে ও কি জবাব দিবে!
কিন্তু সাফওয়ান কে অবাক করে দিয়ে রুমাইশা আজ অন্যান্য দিনের মতো ভেঙে পড়লো না। ওর চোখ দুইটাও আজ আর লোনা পানিতে টইটম্বুর হলো না। পায়ের গোড়ালি উচু করে, ওর থেকে প্রায় দেড় ফুট অধিক উচ্চতার সাফওয়ানের কাধে নিজের হাত দুইটা উঠিয়ে দিয়ে, সাফওয়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো ও। তারপর আদুরে গলায় বলল,
— আপনার গগলসের মতো একটা গগলস আমার জন্যও বানিয়ে দিন! তারপর দুজনে মিলে একইরকম গেটাপে বের হবো বাইরে। কাপল ড্রেস! কেমন হবে বলুন তো?
কিন্তু রুমাইশার এই আদুরে কথাতে সাফওয়ানের মুখের অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হলো না। আগের চাইতে যেন আর ও বেশি আঁধার নামলো ওর চোখে মুখে৷ ওর মাথার ভেতর শুধু একটা কথাই ঘুরছে, নিজের অভিশপ্ত জীবনে রিমু কে টেনে এনে ও চরম ভুল করেছে। সেদিন যদি রাফসানের কথা শুনে আর না আগাতো তাহলেই ভালো হতো। আজকের এইদিন টা আর দেখতে হতো না।
সাফওয়ানের মন টা যেন ভেঙে গেলো। রিমুর ওই কাজল কালো চোখ দুইটার কথা মনে পড়লেই ওর সমস্ত বুক জুড়ে হাহাকার বয়ে যাচ্ছে৷ ভাগ্যের পরিহাসে আজ সবকিছু স্রোতের বিপরীতে চলছে৷ রুমাইশা ছিলো ওর সব সমস্যার সমাধান৷ ওর সমস্ত অসুখের একমাত্র আরোগ্য স্থল।
কিন্তু সেদিনের ল্যাবের ঘটনার পর থেকে রুমাইশার সাথে একবার ও ইন্টিমেট হয়নি ও৷ তাই ও জানে না রুমাইশার শরীরে ওর জন্য আর একটুও মেডিসিন বাকি আছে কিনা! নাকি সবই চেঞ্জ হয়ে গেছে!
ওর নিজের শরীরের অবস্থাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন৷ নরম হয়ে যাওয়া চামড়া গুলো আবার খসখসে হতে শুরু করেছে৷ দাঁত গুলোর ভেতর কেমন যেন শিরশির করছে সারাটাক্ষন। আবার আগের মতো নৃশংস হতে ইচ্ছা করছে ওর৷
গতকাল রাতে ওই ছেলে গুলোকে মেরে ও যে মানসিক তৃপ্তি পেয়েছে সেটা ধারণার বাইরে৷
রুমাইশার শারিরীক অবস্থা বুঝতে হলে রিমুর সাথে ওর একান্তে সময় কাটাতে হবে, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। আর আজ আবার রাফসান আসবে বিকেলে, এসে নিয়ে যাবে ওকে! আবার কবে ওদের দেখা হবে সেটার ও কোনো নিশ্চয়তা নেই। রুমাইশা এসব কিছুই জানে না। ও যদি জানে সাফওয়ান ওকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাবার বাড়তে পাঠিয়ে দিচ্ছে তাহলে রিমু কখনোই যেতে চাইবে না।
সাফওয়ান এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ওর ঠান্ডা নিঃশ্বাস পড়লো রুমাইশার মুখের ওপর৷ বুকের ভেতর ওর অদ্ভুত রকমের সুক্ষ্ম একটা যন্ত্রনা তরঙ্গের মতো প্রবাহিত হচ্ছে সমস্ত হৃদয় জুড়ে৷ ধীর গতিতে নিজের হাত দুইটা দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে রাখা রুমাইশার হাত দুইটা ধরে নিচে নামিয়ে দিলো সাফওয়ান৷ তারপর খুব জোর করে মুখ ফুটে বলল,
— আমি রাফসান কে এখনি ফোন দিয়ে আসতে বলছি। তুই রেডি হয়ে থাক। ও আসলে ওর সাথে বাড়িতে চলে যাস৷ সময় মতো আমি গিয়ে আনবো আবার। আমার কাছে বেশিক্ষন থাকার দরকার নেই। এতে হয়তো উপকারের থেকে ক্ষতিটাই বেশি হবে৷
হঠাৎ অজানা ব্যাথায় সাফওয়ানের চোখের কোণ ভারি হয়ে এলো৷ সাথে সাথেই রুমাইশার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে বিছানার দিকে এগোলো ও। ওর আর ভালো লাগছে না কিছু৷ এমন জীবন ও নিজে চ্যুজ করেনি! ও একা ছিলো সেটাই ভালো ছিলো।
ওর এসব ভালোবাসা, সংসার, স্ত্রী, সন্তানের স্বপ্ন দেখাই উচিত না। এসব ওর জন্য না৷ ওর নিজের জীবন টা তো নষ্ট হয়েই গেছে, এখন ওর রিমুর জীবন টাও ওর হাতেই ধ্বংসের পথে চলেছে।
সাফওয়ান মনে মনে স্থীর করে নিলো লুকাসের কাছে ও ধরা দিবে নিজে থেকেই। তাতেই হয়তো সবার ভালো হবে৷ ও নিজেও এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে৷ আর ও কাছাকাছি না থাকলে হয়তো রিমুও সুস্থ হয়ে যাবে৷
সাফওয়ান এখানে থাকা মানেই সবার জন্যই বিপদ। কি প্রয়োজন তার? এত গুলো মানুষের জীবন সঙ্কটাপন্ন না করে নিজেই লুকাসের কাছে ধরা দিবে, তারপর লুকাস ওকে যেখানে নিয়ে যায় যাক, যা ইচ্ছা করুক; ওর আর কিছু যায় আসেনা৷
রাফসান আসলে ওকে বলে দিবে আমাজন যাওয়া ক্যানসেল। ও একাই যাবে, রিমু কে এখানেই রেখে যাবে৷
সাফওয়ান কে এইভাবে মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে দেখে রুমাইশা বুঝলো সাফওয়ানের খারাপ লাগছে ওকে এইভাবে দেখে৷ কিন্তু ওর মন তো এক মিলি সেকেন্ডের জন্যও সাফওয়ান কে অপরাধী করেনি৷ সাফওয়ান যা করেছে সব তো ওকে বাচানোর তাগিদে! সাফওয়ান তো নিজের স্বার্থের জন্য কিছুই করেনি! তাহলে কেন সাফওয়ান এইভাবে অপরাধীদের ন্যায় চোখ নামিয়ে আছে, কেন মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে ওর থেকে! আবার বলছে রাফসান ভাইয়া কে এখনি আসতে বলবে, কেন? এইভাবে ওকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সাফওয়ান কি ভালো থাকবে খুব!
রুমাইশার নিজের অবস্থা দেখে যা হয়নি তা ওর এখন হতে শুরু করলো। ও ভেবেছিলো ও কোনো নেগেটিভ রিয়্যক্ট না করলে হয়তো সাফওয়ানও ব্যাপার টা হালকা ভাবেই নিবে৷
কিন্তু সাফওয়ানের এইভাবে ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলো না রুমাইশা৷ চোখ দুইটা এইবার সত্যি সত্যিই ভরে উঠলো ওর৷ সেই সাথে রাগ হলো প্রচন্ড পরিমানে। পেছন থেকে উচ্চস্বরে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে সাফওয়ানের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
— এইভাবে আমাকে একা করে রেখে গেলে বুঝি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? এই জন্য বিয়ে করেছেন আপনি আমাকে? এইভাবে ফেলে দেওয়ার জন্য? আমি যেখানে আপনার সাথে প্রতিটা মুহুর্ত, প্রতিটা ক্ষণ থাকতে চাই; সেখানে আপনি আমাকে ফেলে একা একা চলার পায়তারা করছেন! এই আপনার ভালোবাসা!
সাফওয়ান যতটুকু গিয়েছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলো। ও প্রতিউত্তরে কি বলবে ভেবে পেলো না৷ গলা ধরে আসছে ওর। রুমাইশার সবেমাত্র কিছু সিম্পটমস দেখা যাচ্ছে, পরবর্তীতে আর ও কি কি হবে সেটা ও নিজেও জানে না৷ কিন্তু যদি রুমাইশার সমস্যা গুলো ওর মতোই প্রকট হয় তাহলে সেটা খুব বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে বাকিদের জন্য। সাফওয়ান কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না। রুমাইশা যদি ওর মতোই শারীরিক, মানসিক জটিলতার ভেতর দিয়ে যায়, আর কোনোভাবে নিজের ক্ষতি করে ফেলে তবে ও নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না। মরে গিয়েও শান্তি পাবে না ও৷ কি করবে এখন ও!
সাফওয়ান কে এইভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পেছন থেকে রুমাইশা ছুটে এলো এক প্রকার৷ সোজা হয়ে দাঁড়ানো বিশালদেহী সাফওয়ানের শক্ত পেশিবহুল পিঠের সাথে নিজেকে লেপ্টে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। তারপর নাক টেনে বলল,
— আপনার কোনো দোষ নেই সাফওয়ান! নিজেকে দায়ী ভাবা বন্ধ করুন, আপনি যা করেছেন আমার জীবন বাচানোর জন্যই। আপনার তো অন্য কোনো ইনটেনশন ছিলো না! এইভাবে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন না! আপনি এইরকম করলে আমি কিভাবে থাকবো বলুন! আপনাকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারিনা। আপনার ওই বিশাল বুকটার ওপর মাথা না রাখলে আমার ঘুম আসে না৷ আপনার গায়ের গন্ধ না পেলে আমি শান্তি পাই না! আপনার শরীরের সান্নিধ্য না পেলে আমার প্রাণ টা ছটফট করে! আর সেই আপনি আমাকে এইভাবে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছেন! আপনার কি একটুও কষ্ট হচ্ছে না? একটুও কি আমার জন্য মন পুড়ছে না? আমার এই অসহায় অবস্থায় আপনি আমাকে কিভাবে দূরে সরিয়ে দিতে চান! আপনি যদি এমন করেন তো আমি কোথায় যাবো? আপনিই তো বলেছিলেন এই পৃথিবীতে যদি আমার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য কেউ থেকে থাকে তবে সেটা আপনি! তাহলে আপনি কেন এমন করছেন! কেন, বলুন!
ডুকরে কেদে উঠলো রুমাইশা। ফুপিয়ে কাদতে লাগলো ও৷ সাফওয়ানের পিঠের ওপরের আন্ডার শার্ট টার কিছু অংশ ভিজে উঠলো ওর চোখের পানিতে৷ সাফওয়ান দাঁড়িয়ে রইলো স্থীর হয়ে। ও দোটানায় আছে এখন। ওর রিমুকে নিয়ে ও কি করবে ও বুঝতে পারছে না এখন। ও যদি লুকাসের কাছে নিজেকে ধরা দেয় তাহলে ওর রিমুর কি হবে? ও তো একা হয়ে যাবে। কাউকে পাশে পাবে না ও৷ কেউ চাইবে না এমন জংলি কারো দায়িত্ব নিয়ে। ও নিজে ভুক্তভোগী। ও জানে এমন জীবনের পরিণতি কতটা ভয়াবহ। কতটা সাফার করতে হয়েছে ওকে এই জীবনের জন্য সেটা ও আর ওপর ওয়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না৷
কিছুক্ষণ পর রুমাইশা কান্না থামালো, নিজের চোখ মুছে নিলো হাত দিয়ে। তারপর আবার নাক টেনে বলল,
— কোথাও যাবো না আমি। আমি আপনার সাথেই থাকবো। তাই আমার যা হয় হবে৷ আপনাকে ছেড়ে আমি এক পা ও এগোবো না। আপনি যা ইচ্ছা করতে পারেন, আমি এখান থেকে কোথাও যাচ্ছিনা৷ আমি এখনি রাফসান ভাইয়া কে ফোন দিয়ে বলে দিবো যেন আমাকে নিতে না আসে৷ আমি যাবোনা ও বাড়িতে৷ আপনি যেখানে যাবেন আমিও সেখানে যাবো আপনার পেছন পেছন। আপনার কোনো কথা শুনবো না।
৫৩. দুপুর বেলা ইশতিয়াক বাড়িতে চলে আসলেন আজ৷ অফিসের কাজ গুলো দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ায় বস সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন৷ বাইরের পোশাক পালটে হলরুমের সোফায় গা এলিয়ে বসলেন তিনি। রুনিয়া রান্না ঘর থেকে ইশতিয়াকের জন্য খাবার গরম করে টেবিলে সাজাচ্ছেন। সাফওয়ান আর রুমাইশা বাড়িতে নেই৷ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর নিজের ফোনে সাফওয়ানের মেসেজ পেয়েছেন তিনি, যে ওরা একটু বেরোচ্ছে। কখন আসবে, আদৌও আজ ফিরবে কিনা সেসব কিছুই জানায়নি ওরা৷
খাবার টেবিলে খাবার গোছাতে গোছাতে শাফিন কে ডাকলেন তিনি। ওর পরীক্ষার আর মাত্র পনেরো দিন আছে। ধুমছে পড়াশোনা করছে ও৷ ঘর থেকেই বেরোচ্ছে না। মাএর ডাক শুনে পড়া রেখে বাইরে এলো ও৷
ইশতিয়াক আহমেদ টিভি ছাড়লেন। সকাল বেলা তাড়াহুড়োর জন্য নিউজ দেখতে পারেননি। তাই এখন টিভি ছেড়ে সব চ্যানেলে একটু একটু করে ঢু মারবেন তিনি।
কিন্তু টিভি ছেড়েই তিনি হতবাক হয়ে গেলেন৷ প্রতিটা চ্যানেলে একই সংবাদ৷ ঝিকরগাছা ছাড়িয়ে পূবালির জঙ্গলের ভেতর পাওয়া গেছে প্রায় বিশখানা লাশ৷ যাদের অধিকাংশেরই শরীর টা আস্ত নেই। নাড়ি ভুড়ি ছিড়ে, এদিক ওদিক হয়ে আছে। কারো কারো শরীরের কোনো কোনো অংশ পাওয়া যাচ্ছে না৷ সেগুলো পুরোপুরি মিসিং। যারা খুন করেছে তারা এদের কে গাড়ির চাকায় পিষ্ট করে দিয়ে গেছে।
আর সবথেকে গুরুতর বিষয় হচ্ছে খুন গুলো কে বা কারা করেছে, কিভাবে করেছে সেসব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সেখানে কয়েক টা ছুরি চাকু আর কতকগুলো হকিস্টিক পাওয়া গেছে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে সব গুলোর হাতের ছাপই গায়েব৷ পিচ ঢালা রাস্তা হওয়ায় কারো পায়ের, কারো জুতার, গাড়ির চাকার, এমনকি অন্য কোনো কিছুরই চিহ্ন নেই। রক্ত গুলোও বৃষ্টির তোড়ে ভেসে গিয়ে আশে পাশের গাছপালার গোড়ায় গোড়ায় জমে আছে৷
ইশতিয়াক আহমেদ হা হয়ে তাকিয়ে রইলেন টিভির দিকে। ডাইনিং টেবিল থেকে রুনিয়া আর শাফিন দুজনেই নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে রইলো। গা শিউরে উঠলো রুনিয়ার।
নিউজে মঈনুদ্দিন সহ আরও বেশ কয়েক জনের ফটোগ্রাফ দেখানো হচ্ছে৷ শাফিন মঈনুদ্দিন কে দেখেই বলে উঠলো,
— আরে, একে তো আমি চিনি। খড়কির ওইদিকে বাসা৷ সারা এলাকা মাস্তানি করে বেড়াতো এ আর এর ভাই। একে কে মারলো?
ইশতিয়াক শাফিনের কথায় কান দিলেন না। তার সমস্ত মনোযোগ এখন টিভির স্ক্রিনে। ইশতিয়াকের থেকে আশানুরূপ মনোযোগ না পেয়ে শাফিন এবার বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
— শালাটা মরেছে। সাথে চ্যালাব্যালা গুলোরেও নিয়ে মরেছে। কি দাপটই না দেখাতো! যে ওকে মেরেছে তার বুকের পাটা আছে বলতে হবে। কিন্তু এই অসাধ্য সাধন করলো কে! তার চেহারা টা দেখতে পেলে আমি একটা চুম্মা খাইতাম।
রুনিয়া শাফিন কে ফিসফিস করতে দেখে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। ইশতিয়াকের মতো তিনিও বেশ মনোযোগ দিয়েই দেখছেন। চোখ বড় বড় হয়ে আছে রুনিয়ার৷ এমন নৃশংস ভাবে যে কেউ হত্যা করতে পারে তা ওনার ধারণার ও বাইরে৷ লাশ গুলোর বর্ণনা শুনলে ওনার গায়ের পশম খাড়া হয়ে যাচ্ছে৷ খুন গুলো যে করেছে তার কি একটুও হাত কাপেনি!
৫৪. ল্যাবের ভেতরকার রুমে সাদা জমিনের ওপর গাঢ় নীল রঙা কুচি ফুলের ছাপার বিছানার ওপর রুমাইশা কে জড়িয়ে শুয়ে আছে সাফওয়ান৷ আর ওর বুকের ভেতর গুটিশুটি মেরে শুয়ে বুকের পশম গুলো আঙুলে জড়িয়ে টানাটানি করছে রুমাইশা৷
কয়েক ঘন্টা আগের সেই কষ্ট মাখা মুহুর্ত গুলোর সমাধান হিসেবে আর কোনো উপায় দেখেনি রুমাইশা। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে আজকের দিন টাও রুমাইশা এখানেই থাকবে। রাফসান কে ইতিমধ্যে ফোন দিয়ে আসতে মানা করা হয়ে গেছে ওর৷
আর সাফওয়ান কে শর্ত দেওয়া হয়েছে সাফওয়ান মোটেই কোনো রকমের মন খারাপ করবেনা৷ ও যেখানেই যাবে ওর রিমুকেও ওর সাথে সেখানেই নিতে হবে৷ রুমাইশার এ অবস্থার জন্য মোটেও নিজেকে দায়ী ভাবা যাবে না, আর আগের থেকেও বেশি বেশি রুমাইশাকে ভালোবাসতে হবে, অকারণে ধমকানো যাবে না, রাগ অভিমানের গুরুত্ব দিতে হবে।
সাফওয়ান ও রিমুর আদরের লোভে সব শর্ত মেনে নিয়েছে। এটা ছাড়া ওর কাছে আর এমনিতেও কোনো অপশন নেই। কারণ রুমাইশার এই কন্ডিশনে ওকে এইখানে একা ফেলে যাওয়া মানে মৃত্যুর মুখে ফেলে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই না৷
আর ও কিছুক্ষন একে অপরের সাথে লেপ্টে শুয়ে থেকে রুমাইশা বলল,
— কিচেন তো দেখিয়ে দিলেন না৷ আপনার শক্তি বর্ধক খাদ্য রান্না করবো কিভাবে?
সাফওয়ান চোখ বুজে রুমাইশার চুলের ভেতর মুখ ডুবিয়ে ছিলো। রুমাইশার কথায় হাসলো ও। তারপির বলল,
— হুম, দেখাবো। উঠ আমার ওপর থেকে।
রুমাইশা তেতে উঠে বলল,
— চোখে দেখেন না, নাকি? আমি আপনার পাশে শুয়ে আছি। আপনার ওপরে না। কানা কোথাকার৷
বলেই সাফওয়ানের আলিঙ্গলের ভেতর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসলো ও৷
এমন আরামদায়ক শোয়ার পজিশনের ব্যাঘাত ঘটায় সাফওয়ান সেই আকারে বিরক্ত হলো। ভ্রু কুচকে বলল,
— দুম দাম করে উঠে যাবি না, ওঠার আগে আমার অনুমতি নিবি৷ আমি অনুমতি দিলে তবেই উঠবি।
রুমাইশা ওকে এমন লুক দিলো যাতে মনে হলো ওর চোখ দুইটা বলছে,
— অ্যাহ! অটোম্যান সাম্রাজ্যের সুলতান সুলেমান আইছে! অনুমতি ছাড়া উঠা যাবে না! কত ঢং!
তারপর মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
— আপনি যা বলবেন জাহাপনা, আপনার দাসী সদা প্রস্তুত!
তারপর মুখ বেকিয়ে সাফওয়ানের থেকে চোখ ফিরিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো ও৷ এরপর বলল,
— কিচেন দেখিয়ে দিয়ে গরুর মাংস নিয়ে আসবেন, একদম তাজা তাজা৷ মশলা পাতি কিছু আছে নাকি?
সাফওয়ানের দিকে আবার ফিরে প্রশ্ন করলো রুমাইশা৷ সাফওয়ান ইশারায় বুঝালো সব আছে। উত্তর পেয়ে রুমাইশা সাফওয়ান কে টেনে উঠালো বিছানা থেকে।
সাফওয়ান উঠে ওর রুমের কাবার্ডের দরজা টা খুলল, তারপর জামা কাপড় গুলো দুপাশে সরিয়ে দিয়ে কাবার্ডের মজাখানে চাপ দিতেই শব্দ করে কাবার্ডের পেছন দিক টা দেয়ালের বাম দিকে সরে গেলো।
আর সেখানেই দেখা গেলো সাদার ওপর সোনালি রঙা টাইলসের রান্না ঘর। একটু নোংরা হয়ে আছে, কিন্তু সেসব রুমাইশা সামলে নিতে পারবে৷
কিচেন দেখা হলে সাফওয়ান কে ঠেলে ঠুলে মাংস কিনতে পাঠিয়ে দিলো রুমাইশা৷ সাফওয়ান চলে গেলে কিচেন পরিষ্কারে লেগে গেলো ও। আর তখনি ওর নজর গেলো সাফওয়ানের স্টাডি টেবিলের ওপর রাখা কালো মলাটের মোটা নোটবুক টার দিকে।
( তাড়াহুড়ো করে লিখছি, রিচেক করিনাই, ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)