অফিডিয়ান | পর্ব – ৭৬

22 Min Read

১০৫. হলরুমে পুরোপুরি স্তব্ধতা বিরাজ করছে। ইশতিয়াক আহমেদ ঘুমিয়ে ছিলেন, তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। বাচ্চা রা সব শাফিনের রুমে ঘুমাচ্ছে। হলরুমে শুধু বড়রাই আছে এখন। খুব জরুরি পারিবারিক মিটিংয়ে শামিল হয়েছে তারা সবাই।

পুলিশ দুজন চলে গেছেন খানিকক্ষন আগেই। দুজনের ভেতর প্রৌঢ় জন যশোর থানার পুলিশ সুপার। বারো তেরো বছর আগে সাফওয়ানকে যখন হারবার্টের লোক তুলে নিয়ে গেছিলো সেই সময়ে সাফওয়ান রুমাইশার কেস তার হাতেই ছিলো। সেসময় তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ সুপার ছিলেন। এখন তার পদন্নতি হয়েছে৷ তিনি বেশ ভালোভাবেই জানতেন যে সাফওয়ানের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী প্রমাণ নেই, শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে দাকে দোষী সাব্যস্ত করে জনগন আবেগের ঠেলায় সেসময়ে আন্দোলন শুরু করেছিলো। আর সাফওয়ান কে আবার তার নিজের পরিচয়ে ফিরিয়ে আনতে জনগনের এই আবেগকেই কাজে লাগাতে চান তিনি। জনগন চাইলে সবই সম্ভব৷

সাফওয়ান কে পুলিশ সুপার আর অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ সুপার কবির হোসেন এই প্রস্তাবই দিয়ে গেছেন। কিন্তু সাফওয়ান এখনো তাদের ডিসিশন দেয়নি যে সে কি চায়। পরিবারের সবার সাথে আলোচনা করে তবেই সে এই ব্যাপারে কথা বলতে চায়। এবং তার কথা মনে রেখে পুলিশ সুপার যে তাকে এত বড় একটা উপকার করতে চেয়েছেন, তার জন্য পুলিশ সুপারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে সাফওয়ান৷

পুলিশ সুপার সাফওয়ানকে তার ফোন নম্বর দিয়ে গেছেন। সাফওয়ান যে ডিসিশনই নিক সেটা মেনে নেবেন পুলিশ সুপার এবং সেই অনুযায়ীই নিজেদের কাজ আগাবেন। তবে সাফওয়ান কে সেটা আজ রাতের ভেতরেই জানাতে হবে। সাংবাদিকদের কে পুলিশ সুপার সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন। সকালের ভেতরেই কেস টা পুরোপুরি সাজিয়ে ফেলতে হবে, নইলে পরবর্তীতে তাকেই সমস্যায় পড়তে হবে।

এতক্ষন ধরে সাফওয়ান সম্পুর্ন বিষয় টা রুনিয়া, ইশতিয়াক সহ পরিবারের সবাইকেই বুঝিয়ে বলল। আর তারপর তাদের মতামত চাইলো এই বিষয়ে৷

রুমাইশা সাফওয়ানের পাশে বসে আছে, সাফওয়ানের ডান হাত টা নিজের দু হাতের মুঠিতে ভরে শক্ত করে চেপে ধরে সাফওয়ানের গায়ে নিজের শরীর ঠেকিয়ে বসে আছে ও। চোখমুখ ওর ছলছল করছে৷ কোথায় যেন একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে ও নিজের পরিবার, পরিজন আত্মীয় স্বজন সবাইকে আবার নিজের করে পাওয়ার জন্য। নিজের পরিচয়ে আবার পরিচিত হওয়ার জন্য। এই নকল পরিচয়ে পরিচিত হতে হতে সে ক্লান্ত!

সাফওয়ান তার বাবা আর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা যেটা বলবেন, তারা যেটা চান, সেটাই করবে সাফওয়ান৷ কারণ এই সিদ্ধান্ত একা নিতে তার বুক কেপে উঠছে। জনগন তাকে মেনে নিবে কিনা এই দ্বিধায় সে দ্বিধান্বিত! তার নিজের কোনো ক্ষতি হলে সেটা তার মেনে নিতে কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু জনগন যদি পরিস্থিতি টা সম্পুর্ন ঘুরিয়ে ফেলে তার পরিবারের ওপর কোনো রকম আঘাত হানে তবে সেটা সে কোনোমতেই মেনে নিতে পারবে না। আর তার স্ত্রী সন্তানের যদি কিছু হয় তবে পুরো পৃথিবীবাসির বিরুদ্ধেই হয়তো যুদ্ধে চলে যাবে ও!

শাফিন বসে আছে সোফার এক কোণায় সানিয়ার পাশে। তার প্রাণপ্রিয় ভাই, আর রুমি আপুর জন্য তার এই মুহুর্তে যে চিন্তা হচ্ছে সেটা যদি সে কাউকে সামান্য হলেও বোঝাতে পারতো! কিন্তু সেটা ও বোঝাতে পারছে না কাউকে। জনগনের প্রতিক্রিয়া পজিটিভ বা নেগেটিভ, দুইটার যেকোনোটাই আসতে পারে, ফিফটি ফিফটি চান্স! জনগন যে তার ভাইকে মেনে নেবে এই আশা করে বসে থাকা বোকামি ছাড়া কিছুই না! কিন্তু জনগন মেনে নেবে না এইটা ভেবে সামনে না আগানোও উচিত হবে না। যে কোনো কিছু হতে পারে, সেটা সম্পুর্ন পরম করুণাময় আল্লাহপাকের হাতে!

রুনিয়ার চোখের কোণে পানি, তার ছেলেকে আর লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতে হবে না তাকে, মানুষের সামনে অন্য কেউ বলে পরিচয় দেওয়া লাগবে না, নিজের সন্তানতুল্য বউমা কে আর পর পর করে দেখানো লাগবে না। তার পরিবার টা আবার পূর্ণ হবে, এর থেকে খুশির খবর আর কি হতে পারে! বয়স হয়ে গেছে তার এখন, যেকোনো সময় ওপর থেকে ডাক চলে আসবে তার। মৃত্যুর আগে নিজের পরিবার কে পরিপূর্ণ রূপে দেখে যেতে পারার মতো শান্তি আর কোনো কিছুতেই হবে না তার।

ইশতিয়াক আহমেদ বসে আছেন রুনিয়ার পাশে। সোফার গায়ে হেলান দিয়ে রাখা তার বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন একটা লাঠি, যা ছাড়া এখন আর চলতে ফিরতে পারেন না তিনি। চোখের জ্যোতি ও আগের থেকে হ্রাস পেয়েছে৷ ঝাপসা দৃষ্টিতে তিনি তার বড় ছেলের দিকে তাকালেন। তার প্রথম সন্তান, তার আর রুনিয়ার ভালোবাসার ফসল, তার সাফওয়ান, যার জন্মের পর তিনিই প্রথম কোলে তুলে নিয়েছিলেন, যার আকাশ কাপানো চিৎকারে মুখোরিত হয়েছিলো হাসপাতালের সম্পুর্ন এলাকাটা, যার আগমনে হাসি ফুটে উঠেছিলো হাসপাতালের বিবর্ণ বিছানায় শুয়ে থাকা তার মৃতপ্রায় স্ত্রীর মুখে, সে সন্তান আজ তার সামনে বসে আছে পরিপূর্ণ রূপে। বাবা হয়েছে এখন সেও, পেয়েছে রুনিয়ার চাইতেও প্রেমময়ী স্ত্রী, যে কিনা কোনো অবস্থাতেই স্বামীর হাত ছাড়েনি! জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে সুখী মানুষের তালিকায় নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছে সে অনেক আগেই!

ইশতিয়াক আহমেদ প্রাণভরে দেখলেন সাফওয়ান কে। এমনভাবে কতদিন নিজের ছেলেকে তিনি দেখননি সেটা তার মনে পড়ে না৷ সাফওয়ান তাকিয়ে আছে বাবার দিকে, বাবা কি বলে সেটাই শোনার জন্য।
ইশতিয়াক আহমেদ গলা খাকারি দিলেন, তারপর আস্তে ধীরে বললেন,
— সাফওয়ান, বাবা, আমার এখন বয়স হয়েছে, ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা আমার আর আগের মতো নেই৷ চাইলেও আর হবে না। তুমি বুঝদার মানুষ, তোমার জ্ঞান, গরিমা অবশ্যই আমার থেকে, বা আমাদের সবার থেকে কিছুটা হলেও বেশি৷ তাই এ সিদ্ধান্ত তুমিই নাও। তবে আমি চাই, আমার সন্তান তার নিজের পরিচয়ে, সসম্মানে আমার কাছে ফিরে আসুক। এর থেকে আনন্দের হয়তো আর কিছুই হবে না!

শেষের কথা টা বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো তার৷ হয়তো আর ও কিছু বলতে চাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু জড়তার কারণে আর কোনো শব্দ বের হলো না ওনার মুখ থেকে৷

সাফওয়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা সঙ্গোপনে। তার বাবা চিরকালই এমন। কখনো তার সাথে মন খুলে কোনো কথা বলেনি, মন খুলে কথা বলার সুযোগই হয়নি তার। ছোটবেলার সেই বিচ্ছেদের কারণেই হয়তো বাবার সাথে তার সম্পর্ক টা আজ ও সহজ হয়ে উঠেনি।

সাফওয়ান বাবার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রুনিয়ার দিকে তাকালো,
— তুমি আমাকে কি করতে বলো মা? তোমরা যেটা চাইবে আমি সেটাই করবো। আমি জানি কাজটার নেগেটিভ দিকও পজিটিভ দিকের সাথে সমানে সমানে এগিয়ে আছে৷ কিন্তু তোমরা যদি বলো রিস্ক নিতে তবেই আমি রিস্ক নিবো মা! তুমি আমার মা, তোমার নেওয়া সিদ্ধান্তে আল্লাহ তা’য়ালা অবশ্যই ভালো কিছু দিবেন।

সাফওয়ান থেমে থেমে বলল কথা গুলো। রুনিয়া ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। তার এই সন্তান কে গর্ভে ধরে তিনি যত কষ্ট করেছিলেন, যতটা ভুগেছিলেন, যতটা ব্যাথা পেয়েছিলেন, সব এক নিমিষেই উবে গিয়েছিলো তার সন্তানের চাঁদের মতো মুখ খানা দেখে! সেই প্রথম মা হওয়ার অনুভুতি, সেই ছোট্ট ছোট্ট হাত, কুটি কুটি পা, একটুখানি একটা নাক, বুকের ভেতরের ছোট্ট হৃদপিণ্ড টার লাফালাফি সবকিছুই যেন এখনো চোখের সামনে ভাসছে তার, যেন সেগুলো সেদিনেরই ঘটনা। অতীত মনে পড়ে যেতেই আচলের খুট দিয়ে চোখের কোণ টা মুছে নিলেন তিনি। তারপর বললেন,
— আমি জানিনা কোনটা করলে ভালো হবে, আর কোনটা করলে খারাপ, তবে আমি আমার বড় ছেলেকে আবার আমার কাছে ফেরত চাই, আবার আগের মতো করে এই বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় দেখতে চাই আমি! আমার রুমির খিলখিল হাসি শুনতে চাই আমি, তোমার সাথে ওর খুনশুটি দেখতে চায় চোখ ভরে, নাতিপুতি গুলোকে নিজের চোখের সামনে দেখতে চাই সারাক্ষণ, তাদের কে আদর করতে চাই মন ভরে। তার জন্য যেটা করা লাগে সেটাই করো তুমি!

বলতে বলতে রুনিয়ার চোখ জোড়া পূর্ণ হয়ে গেলো লোনা পানিতে৷ সাফওয়ান দেখলো সেটা। নিরব হয়ে রইলো ও। চকিতে পাশ ফিরে একবার তার গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা রুমাইশার দিকে তাকালো।
পুলিশ সুপারের অফার টা শোনার পর থেকেই রুমাইশা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে৷ কোনো এক অজানা শঙ্কায় তার বুকের ভেতর টা কেপে উঠছে বার বার। মন বলে উঠছে সব কিছু ভালো হবে তো! আবার বিচ্ছেদ তাদের কে আলাদা করে দিবে না তো!

সাফওয়ান তার স্ত্রীর এই নিরবতার কারণ টের পাচ্ছে বেশ ভালোভাবেই৷ নিজের ডান হাত টা এখনো রুমাইশার দখলে। দু হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে আছে রুমাইশা। সাফওয়ান রুমাইশার ভেতরের অস্থিরতা টা কমানোর জন্য নিজের বা হাত টা রুমাইশার হাতের ওপর রাখলো। তার নানা চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠা স্ত্রীকে ভরসা দিলো নিজের হাতের স্পর্শে৷

কিছুক্ষণ আবার নিরবতা চলল সবার মাঝে৷ অতঃপর নিরবতা ভেঙে শাফিন বলে উঠলো,
— ভাইয়া! আমার মনে হয় আমাদের একবার চেষ্টা করা উচিত শেষ বারের মতো। কি হবে সেটা একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। তাই সম্পুর্ন টা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। তিনি যা করবেন সেটাই ভালো হবে সবার জন্য। তুমি পুলিশ সুপার কে জানিয়ে দাও যে তুমি রিস্ক নিতে প্রস্তুত৷

সাফওয়ান শাফিনের দিকে তাকালো। তারপর তাকালো রুমাইশার দিকে। রুমাইশা মাথা নাড়িয়ে চোখের ইশারায় শাফিনের কথায় সম্মতি দিলো। সাফওয়ান বসে থাকলো কিছুক্ষণ। তাকে এখন যেকোনো একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে, তারপর পুলিশ সুপার কে জানাতে হবে।

সাফওয়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা। তারপর রুমাইশার দিকে একবার তাকিয়ে রুমাইশার নরম হাতের ভাজ থেকে নিজের হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে ও বসা থেকে উঠে দাড়ালো। তারপর রুমাইশা কে বলল,
— চলো আমার সাথে৷

রুমাইশা যন্ত্রের ন্যায় উঠে দাড়ালো। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলো না যে সাফওয়ান তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, কেন নিয়ে যাবে! সাফওয়ান ইশতিয়াক আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমি রিমু কে নিয়ে একটু বেরোচ্ছি বাবা, খুব দ্রুতই ফিরে আসবো, তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। জেগে থেকো না আর, আর আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি সঠিক সিদ্ধান্তই নেবো আশা করি। আমাকে তোমাদের দুয়ায় রেখো শুধু৷

এরপর রুনিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে রুমাইশার ডান হাতটা নিজের মুঠিতে নিয়ে পায়ে হেটে মেইন ডোর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো ও।

মেইন ডোর দিয়ে বেরিয়ে রুমাইশা কে গেইটের কাছে দাড়াতে বলে সাফওয়ান গ্যারাজের দিকে গেলো। গ্যারাজ ওপেন করে গাড়ি নিলো ও। ল্যামবরগিনি টা নিলো না, নিলো ওর মার্সিডিজ বেঞ্জ টা, যেটাতে জড়িয়ে আছে ওর আর রিমুর হাজার খানেক স্মৃতি!

গ্যারাজ থেকে গাড়িটা বের করে রুমাইশার সামনে এসে দাড়ালো ও৷ রুমাইশা ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসার জন্য দরজা খুলতে গেলো, কিন্তু খুলতে পারলো না। কয়েকবার টানাটানি করেও দরজা টা খুললো না। এই গাড়িটার দরজার সাথে ওর হয়তো কোনো শত্রুতা আছে।

রুমাইশা হাল ছেড়ে দিয়ে সাফওয়ানের দিকে ভ্রু তুলে তাকালো। হাসি ফুটে উঠলো সাফওয়ানের মুখে। পুরোনো স্মৃতি গুলো তাজা হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এলো ও। তারপর রুমাইশার পাশের দরজা খুলে দিলো। রুমাইশা উঠে বসলো ভেতরে।
এরপর সাফওয়ান দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ঘুরে এসে আবার গিয়ে নিজের সিটে বসলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট করলো। দারোয়ান টা মেইন গেইট খুলে দিলো ওদের যাওয়ার জন্য। সাফওয়ান গাড়ি নিয়ে চলল পূর্ব দিকের রাস্তাতে।

.

সাফওয়ান এক মনে ড্রাইভ করছে। রুমাইশা জানালার দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে৷ এই যে তাকে নিয়ে হুটহাট করে বেরোনো, এটা রুমাইশার অনেক অনেক ভালো লাগে। দূরে কোথাও দুজনে মিলে ঘুরতে যাওয়ার চাইতে এইযে হঠাৎ করে সাফওয়ানের তাকে নিয়ে ছোটখাটো কার ট্রিপ দেওয়ার ব্যাপার টা, এর চাইতে মিষ্টি কোনো ব্যাপার হয়তো আর হয় না!

জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে রুমাইশা বুঝতে পারলো যে সাফওয়ান আসলেই কোথায় চলেছে! চমকে উঠে ও জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে সাফওয়ানের দিকে তাকালো৷ সাফওয়ান ড্রাইভিং রত অবস্থাতেই রুমাইশার দিকে ফিরে তাকালো। রুমাইশার ওই অবাক হওয়া দৃষ্টির বিপরীতে ও ফিরিয়ে দিলো এক চিলতে হাসি। তারপর নিজের ডান হাত টা সযত্নে রুমাইশার উরুর ওপর রাখলো, আর বা হাতে স্টিয়ারিং ধরে রইলো।

রুমাইশা সাফওয়ানের থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে রাস্তার দিকে তাকালো। আর সাফওয়ান আদর আদর করে রুমাইশার উরুর ওপর নিজের ডান হাত টা বুলিয়ে দিতে লাগলো আলতো হাতে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা এসে পৌছালো সেই কাঙ্খিত স্থান টিতে। হরিণার বিলের পাড়ে, যেখানে প্রথম বারের মতো প্রণয়ের সূচনা হয়েছিলো ওদের দুজনের! সাফওয়ান বিলের পাড়ের ফাকা জায়গাটাতে গাড়িটা পার্ক করলো। আজ আর সেদিনের মতো বৃষ্টি নেই। মাটি খটখটে শুকনো। আকাশে ফকফকা চাঁদ। চাঁদের আলোতে চারপাশ টা আলোকিত হয়ে আছে৷

গাড়ি থামিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করলো সাফওয়ান। তারপর রুমাইশার দিকে ফিরে তাকালো। রুমাইশা এখন জানালা দিয়ে বাইরের চাঁদের আলোতে সিক্ত প্রকৃতি দেখতে ব্যাস্ত। সাফওয়ান কিছুক্ষণ ওকে দেখে নিয়ে নিজের দুহাত বাড়িয়ে রুমাইশার পেছন থেকে ওর কোমর টা জড়িয়ে ধরে নিজের কোলের ভেতর টেনে নিলো। তারপর রুমাইশা কে নিজের কোলে বসিয়ে রুমাইশার মুখপানে তাকালো ও। তারপর রুমাইশার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের চোখ থেকে লেন্স আর মুখের ভেতর থেকে আর্টিফিশিয়াল টাং টা খুলে নির্দিষ্ট স্থানে রাখলো। অন্ধকারের ভেতর ঝলমলিয়ে উঠলো ওর উজ্জ্বল ধুসর সবুজ রঙা চোখ জোড়া। রুমাইশা অপলকে দেখতে থাকলো সাফওয়ানের ওই চোখ ধাধানো সৌন্দর্য।

নিজের লেন্স জোড়া খুলে ফেলে সাফওয়ান এরপর রুমাইশা কেও চোখ থেকে লেন্স দুটো খুলে ফেলতে বলল৷ কোনো বাক্যব্যয় না করেই রুমাইশা নিজের চোখ থেকে লেন্স জোড়া খুলে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিলো। ওর সবুজাভ হলুদ চোখ জোড়া দ্যুতি ছড়াতে লাগলো গাড়ির ভেতর।

রুমাইশার ওই চোখ জোড়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সাফওয়ান নিজের দুহাতে আকড়ে ধরলো রুমাইশার কোমর। তারপর রুমাইশার সুডৌল বুকের ওপর নিজের মাথা টা ঠেকিয়ে পরম আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো ওর সমস্ত শরীর, মন।
রুমাইশা সাফওয়ানের ওই ঝাকড়া চুলের ভেতর দিয়ে আলতো করে নিজের হাত টা চালনা করে দিলো। আঙুলের ফাকে ফাকে সাফওয়ানের চুল গুলো নিয়ে আলতো করে টেনে দিতে থাকলো ও৷

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাফওয়ান ওইভাবে চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
— রিমু, তুমি আমাকে কি করতে বলো! কি করবো আমি? আমি আহনাফ হাসান কে কি জানাবো! আমি যদি একা হতাম, তুমি যদি না থাকতে, বাচ্চারা যদি না থাকতো তাহলে আমি কোনো কিছুরই পরোয়া করতাম না! কিন্তু আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তোমার কি হবে! কি করবে তুমি! আমার বাচ্চা গুলোর কি হবে! আমি কিভাবে থাকবো তোমাদের ছাড়া!

সাফওয়ান রুমাইশার বুকের সাথে নিজেকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিলো। রুমাইশা সাফওয়ানের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিজের দুহাতে করে নিজের বুকে থাকা সাফওয়ানের চোয়ালদ্বয় ধরে উচু করে নিজের দিকে ফেরালো। তারপর সাফওয়ানের চোখে চোখ রেখে শান্ত, নরম গলায় বলল,
— কিচ্ছু হবে না সাফওয়ান, তুমি চিন্তা কোরো না৷ আমাদের সাথে ভালো কিছুই হবে! আমাদের এতদিনের ধৈর্যের ফল আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের দিবেন অবশ্যই! তিনি যা করবেন ভালোর জন্যই করবেন। আর তাছাড়া, ফুপ্পি ফুপ্পা, বাবা মা, সবার দুয়া আছে আমাদের সাথে! আহনাফ হাসান ও নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন আমাদের জন্য, তা যদি না হতো তাহলে উনি এত রাতে আমাদের কাছে ছুটে আসতেন্ননা, ব্যাপার টাকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। আর তোমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই কারো কাছে, কিন্তু তোমার স্বপক্ষে প্রমাণ আছে অনেক! তাই তোমার দুঃশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। তুমি পুলিশ সুপার কে বলে দাও, যে তুমি রিস্ক নিতে রাজি, তার উপকার গ্রহণ করতে রাজি। বাকিটা আল্লাহ ভরসা!

সাফওয়ান রুমাইশার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা শুধুমাত্র তার দিকে তাকিয়েই সবকিছু ছেড়েছে! পরিবার পরিজন, আত্মীয়স্বজন, আত্মপরিচয়, সব, সবকিছু! এই জ্বলজ্বলে চোখের, মেরুন রঙা চুল ওয়ালা উজ্জ্বল শ্যামলা রঙা মেয়েটা তার একমাত্র ভরসাস্থল! এই মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়েই অনন্তকাল কাটিয়ে দেওয়া যায়। তার শান্তি, তার সুখ, তার বন্ধু, তার আশ্রয়স্থল, তার মন খারাপের ওষুধ সব এই মেয়েটিই! একে সে কিভাবে নিরাশ করবে! কিভাবে এর চাওয়া সে উপেক্ষা করবে!

সাফওয়ান রুমাইশার মুখের ওপর থেকে চোখ সরালো। তারপর কারের ডেস্কের ওপর রাখা ফোন টা হাতে তুলে নিলো৷ এরপর ফোনটা অন করে পুলিশ সুপারের দিয়ে যাওয়া নম্বর টাতে ডায়াল করলো ও।
কয়েকবার রিং হতেই কল টা রিসিভ করলো পুলিশ সুপার। তারপর বলে উঠলো,
— যশোর থানার পুলিশ সুপার আহনাফ হাসান মিরাজ বলছি, বলুন আপনার কি সাহায্য করতে পারি?

সাফওয়ান রুমাইশার দিকে চকিতে একবার তাকালো তারপর ওর চিরাচরিত গম্ভীর স্বরে উত্তরে দিলো,
— সাফওয়ান আহমেদ বলছি।

আহনাফ হাসান চমকে উঠলেন যেন, কিছুটা উত্তেজিত হয়ে তিনি বললেন,
— সাফওয়ান আহমেদ! জ্বি বলুন, আপনার ফোন কলের অপেক্ষায় বসে আছি আমরা অনেক্ষন থেকেই। আপনার সিদ্ধান্ত শুনেই আমরা ফাইল রেডি করবো।

সাফওয়ান রুমাইশার দিকে তাকালো আবার ও। রুমাইশা ইশারায় ওকে সম্মতি দিতে বলল। সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাফওয়ান বলে উঠলো,
— আমি রিস্ক নিতে রাজি আছি। এখন আপনারা তার জন্য যা যা করা প্রয়োজন করতে পারেন। আর সাংবাদিকদের সামনে ব্রিফিং দেওয়ার আগে আমাকে আরও একবার ইনফর্ম করবেন।

আহনাফ হাসান বলে উঠলেন,
— জ্বি, অবশ্যই। আপনাকে ইনফর্ম করেই আমরা তাদের কে জানাবো, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আপনাকে আবারও এ দেশের মাটিতে স্বসম্মানে মাথা তুলে দাড়ানোর ব্যাবস্থা করাটা আমি আমার দায়িত্ব হিসেবে গ্রহন করেছি। আমি আমার এ দায়িত্ব পালন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন৷

সাফওয়ান কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল,
— আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, আহনাফ হাসান মিরাজ। আমি ভালো কিছুর প্রত্যাশায় রইলাম।

আহনাফ হাসান বললেন,
— ধন্যবাদ আপনার পাওনা সাফওয়ান আহমেদ। আপনার মাধ্যমেই ওপর ওয়ালা আমাদের পুলিশের টিম টাকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। আপনার এই ঋণ শোধ হবার নয়। ভাল থাকবেন। দেখা হচ্ছে খুব শিঘ্রই!

বলেই কল কেটে দিলেন পুলিশ সুপার। সাফওয়ান ফোন টা ডেস্কের ওপর রেখে আবার ও মুখ তুলে তাকালো রুমাইশার দিকে। রুমাইশা প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সাফওয়ানের মাথাটা আলতো করে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এসে সাফওয়ানের প্রশস্ত ললাটে নিজের নরম ঠোঁট জোড়া ছোয়ালো রুমাইশা। তারপর সাফওয়ানের মাথার ওপর নিজের চোয়াল টা রেখে বলল,
— চিন্তা কোরো না! ভালো কিছুই হবে ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের নিরাশ করবেন না। আমরা আবার আগের মতো করেই বাচবো, সবাই মিলে, এক সাথে!

সাফওয়ান রুমাইশা কে আকড়ে ধরলো দুহাতে। শান্তি শান্তি লাগছে ওর অনেক! একটা বিরাট বোঝা নেমে গেছে যেন ওর মাথা থেকে। সাফওয়ান রুমাইশার বুকে মুখ লুকানো অবস্থাতেই বলল,
— তোমার মনে আছে, এই খানে তুমি প্রথম বারের মতো আমার কোলের ভেতরে বসেছিলে, তোমাকে আমি চুমু খেতে বলেছিলাম! তুমি অবাক হয়েছিলে সেদিন অনেক। আমি তোমাকে আমার মুখ দেখতে বলেছিলাম। আর আমার মুখ দেখে তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে, ভয়ে! সেদিন বৃষ্টি ছিলো, ঝুম বৃষ্টি!

রুমাইশা সাফওয়ানের চুলের ওপর দিয়ে ওর মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
— কেন মনে থাকবে না বলো! ওসব কি ভুলে যাওয়ার মতো কোনো স্মৃতি! তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে আছে এখনো। কিছুই ভুলবো না, কখনোই।

সাফওয়ান রুমাইশার বুক থেকে মুখ উঠিয়ে ওর চোখের দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— সেদিন তুমি জ্ঞান হারানোর পর আমি তোমাকে উদ্দ্যেশ্য করে গান গেয়েছিলাম দুকলি!

রুমাইশা অবাক হয়ে বলল,
— সত্যি নাকি! তুমি গান গেয়েছিলে! কই কখনো তো বলোনি! কি গান গেয়েছিলে?

সাফওয়ান ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলল,
— শুনতে চাও?

রুমাইশা চোখ বড় বড় করে, ভ্রু উচিয়ে, অতীব আগ্রহ ভরে মাথা নাড়ালো। সাফওয়ান ওর মুখের এমন চাহনী দেখে হেসে ফেললো শব্দ করে। তারপর বা হাতে গাড়ির দরজা টা খুলে দিলো যেন চাঁদের আলো টা ভালোভাবে গাড়ির ভেতরে আসে। তারপর রুমাইশাকে কোলে নিয়েই চাঁদের আলোর দিক্ব কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বসলো সাফওয়ান৷ আর এরপর রুমাইশার ওই উজ্জ্বল চোখে পরম প্রেম নিয়ে তাকিয়ে ও গেয়ে উঠলো,
—চাঁদনি রাইতে নদীর ওপারে
আকাশ থেইকা নামলো পরী
আমার চোখে চলে ঘোরগাড়ি,

আমি হাবলায় নদীর এ পারে
ঘুমের ঘোরে দেখি তারে
ছবির মতো ডাকে আমারে

দেখাও কতো রঙিন ছবি
ছবির আশায় হারাইলাম সবই
দয়াল, বানাও কতো মায়ার ছবি
ছবির নেশায় হারাইলাম সবই…….

( গায়ে জ্বর নিয়ে লিখলাম এতখানি, সুন্দর সুন্দর কমেন্ট না করলে মাইর দিবো 😒)

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।