অফিডিয়ান | পর্ব – ৯

10 Min Read

রুমাইশা শোয়া থেকে উঠে বসল। চোখ দুটো মুছে নিলো ভালোভাবে৷ এই অসময়ে কে আসবে? ফুপ্পি? না শাফিন! ভাবতে ভাবতে উঠে দরজা খুলে দিলো রুমাইশা। কিন্তু কাউকেই সামনে পেলো না৷ মনে মনে শাফিনের ওপর খুব বিরক্ত হলো। নিশ্চই এটা ওর কাজ, দরজায় নক দিয়ে দৌড় দিয়েছে৷ নিজের শোকবিলাস করার সময়ে এইরকম ডিস্টার্বেন্স তার মোটেই পছন্দ হলো না। মনে মনে শাফিনকে খুব করে বকা দিয়ে ভ্রুকুটি করে দরজা আবার বন্ধ করতে গেলো রুমাইশা৷

— রিমু!

হঠাৎ কারো গম্ভীর, শান্ত কণ্ঠে নিজের নাম শুনে চমকে লাফিয়ে উঠলো রুমাইশা। মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসলো ওর।
`সাফওয়ান ভাইয়া! ভাইয়া এইখানে! এত রাতে!’
বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা শুরু হলো রুমাইশার৷ ভয়ে কুকড়ে গেলো ও।

দরজার পাশের আবছা অন্ধকার জায়গাটাতে ছাই রঙা আন্ডার শার্ট আর কালোর ওপর ছাই রঙা স্ট্রাইপ দেওয়া ট্রাউজার পরে মুখে মাস্ক আর চোখে ডার্ক গগলস পরে দাঁড়িয়ে আছে সাফওয়ান৷ দুই হাত ট্রাউজারের পকেটে রাখা৷
রুমাইশা বাইরে বের হলো না, ঈষৎ ফাকা রাখা দরজার এপাশেই রইলো৷ তারপর ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলল,
—জ্ব-জ্বী ভাইয়া। কিছু বলবেন!

রুমাইশার কণ্ঠ শুনে দরজার দিকে কিছুটা এগিয়ে এলো সাফওয়ান৷ তারপর ধীর স্থীর কণ্ঠে বলল,
—আমি জানিনা ঠিক, কোথায় কি প্রবলেম হয়েছে, আর সেটা কতোটা গুরুতর। তবে এইভাবে মন খারাপ করে থাকলে কোনো কিছুর সমাধান হবে না৷ মন খারাপের কারণ আমাকে বলতে হবে। যদি এখন বলতে না পারিস, কাল বলবি ; যদি মুখে বলতে না পারিস তাহলে শাফিনের থেকে আমার ফোন নম্বর নিয়ে টেক্সট করবি। যেভাবেই হোক, আই ওয়্যানা নো অ্যাবাউট ইয়্যোর পেইন। আর সেটা কালকের মধ্যেই। কোনো অজুহাত চাই না৷ নাও ইয়্যু ক্যান স্লিপ৷’
বলে যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে গেলো সাফওয়ান৷

রুমাইশা তাজ্জব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
`সাফওয়ান ভাইয়া ওর মন খারাপের কথা কিভাবে জানলো! ভাইয়া ওর মন খারাপের কারণ জানতে এত রাতে এখানে এসেছে! কে জানিয়েছে ভাইয়াকে? শাফিন? কিন্তু আমার এ মন খারাপের কারণ আমি কিভাবে বলবো! কিভাবে বলব আমি যা দেখেছি! কিভাবে!’

দরজার কাছ থেকে সরে আবার বিছানায় এসে বসলো রুমাইশা। চোখ থেকে গড়িয়ে দুই ফোটা পানি পড়লো ওর। হ্যা, ওর মন খারাপ, অনেক। খুব দরকার ওর কাউকে, যার সাথে ও ওর মনের সব কথা বলতে পারবে, যে ওর সহায় হবে। কিন্তু কাকে বলবে ও!
শাফিনকে বলা যাবে না, ওকে বললে ওর মন টাও রুমাইশার মনের মতোই ভেঙে যাবে। রুনিয়া ফুপ্পি! কিন্তু যারা চায়না রুমাইশা কখনো সাফওয়ানের ব্যাপারে জানুক, তাদেরকে এ কথা কিভাবে বলবে ও! অসহায় হয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রুমাইশা৷

১৬. কাক ডাকা ভোরে প্রকৃতি হালকা ঝাপসা কুয়াশা তে আচ্ছন্ন। ঘাসের ওপর মুক্তোর দানার মতো শিশির দানা পড়ে আছে। পাখির কিচির মিচির ধ্বনি তে সদ্য ঘুম ভাঙা রুমাইশা বিছানায় শুয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। যত রাত্রেই ঘুমাক না কেন, রোজ এমন সময়েই ঘুম ভাঙে ওর৷

বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেস হয়ে ও নিচে এলো। তারপর মেইন ডোর পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ সাদা সালওয়ার এর সাথে গাঢ় সবুজ জমিনের ওপর ধুসর ফুলের ছাপার কামিজ পরনে ওর, হাতে সাদা রঙা ওড়না নিয়ে, মাথার বেণী উন্মুক্ত করে দিয়ে ভোর সকালে বাড়ির ডান পাশে থাকা ফুলের বাগানে গেলো রুমাইশা। এ ফুল বাগান রুনিয়ার হাতে তৈরি। অনেক আগে যখন এ বাড়িতে আসতো তখন রুমাইশা, সাফওয়ান আর রাফসান মিলে এখানে হুটোপুটি করতো বেশিরভাগ সময়। অনেক গুলো গাছ রুমাইশারা নিজের হাতে করেও লাগিয়েছে। সে গুলো হয়তো এখন আর নেই, তবে সেসব স্মৃতিগুলো এখনো তরতাজা। পায়ের জুতা খুলে খালি পায়ে বাগানের ভেতর দিয়ে হেটে চলল রুমাইশা। নরম মাটির ওপরের প্রতিটা নির্মল ঘাস কে নিজের ছোট ছোট চরণ যুগল দ্বারা অনুভব করে চলল ও।

বিরাট এরিয়া জুড়ে ফুলের বাগান, অনেক অনেক রকমের ফুল, তবে গোলাপ বেশি। বাগানের ভেতর হাজারো ফুলের মাঝখানে সাদা রঙা ওড়নার বদৌলতে শুভ্রতার প্রতীকের মতো জ্বলজ্বল করছে রুমাইশা। ফুল গুলো কে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে, ফুলগুলোও যেন ওর স্পর্শ পেয়ে নিজেদের কে আর ও বেশি মেলে ধরছে।

সমস্ত বাগানে ঘুরে ঘুরে সবগুলো ফুলকে একটু একটু করে ছুঁয়ে দিয়ে ঘরে ফিরলো রুমাইশা৷ নিজের কামরায় ফিরেই ওর মনে পড়লো সাফওয়ান বলেছিলো ওর সমস্যার কথা সাফওয়ান কে বলতে, কিন্তু কি বলবে ও? বিছানায় বসে ভাবতে থাকে কি বলা যায়! কি বললে ভাইয়া সন্দেহ করবে না যে ও সব জেনে গেছে!

উপরের দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট টা কামড়াতে কামড়াতে ভাবতে থাকলো রুমাইশা৷ কিছুক্ষণ ভাবার পরেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো ওর। ঘটনাটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মন খারাপের একটা সুন্দর অজুহাত পেয়ে গেছে ও, যদিও মিথ্যা বলতে হবে বলে একটু কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। নিজের ফোন টা হাতে নিয়ে দুলতে দুলতে শাফিনের কামরার সামনে গিয়ে পৌছালো ও।

দরজার ওপর বার দুয়েক নক পড়তেই দরজা খুলল শাফিন। দরজার সামনে রুমাইশা কে মিষ্টি হেসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাফিন বলল,
—কি ব্যাপার? এত খুশি কেন? কিছু হয়েছে নাকি? ভেতরে এসে বস আপু।’

রুমাইশা ভেতরে গিয়ে শাফিনের পড়ার টেবিলের চেয়ার টা টেনে বসে পড়লো।

— কিছু বলবে আপু?’

শাফিন বিছানায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো।
রুমাইশা লজ্জায় লাল নীল হতে লাগলো। `সাফওয়ানের ফোন নম্বর শাফিনের কাছে ও কিভাবে চাইবে? যদি শাফিন কিছু মনে করে ওদের নিয়ে! এমনিতেই সুযোগ পেলেই খোচা দেয়৷ এখন ফোন নম্বর নিচ্ছে দেখে যদি খোচার পরিমাণ আর ও বেড়ে যায়! শাফিন যদি ফুপ্পি কে বলে দেয় যে আমি সাফওয়ান ভাইয়ার ফোন নম্বর নিয়েছি তখন! আমি যদি শাফিনকে বলি যে, সাফওয়ানের ফোন নম্বর নিচ্ছি এটা যেন ফুপ্পি না জানে, তখন তো শাফিন আর ও বেশি সন্দেহ করবে! কি করবো! কি করবো!’
এইসব বিভিন্ন চিন্তা রুমাইশার মাথায় ঘুরতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে মাথা ক্রমশ নিচের দিকে চলে যেতে লাগলো ওর

রুমাইশাকে এইভাবে চুপচাপ লাল হয়ে যেতে দেখে শাফিন বলে উঠলো,
— আপু! চুপ করে আছো যে! কি বলতে চাও বলো?’

শাফিন মনে মনে ভাবলো, ‘নিশ্চই ভাইয়ার সাথে কিছু হয়েছে, মেইবি ভাইয়া কিছু বলেছে ওকে মন খারাপের বিষয় নিয়ে। আপুকে তো একটু খুশি খুশি ও লাগছে কিন্তু তার সাথে আমার কি সম্পর্ক সেটাই তো বুঝতে পারছিনা!’
কিন্তু শাফিন একটুও টের পেলোনা যে এই হাসি তার রুমি আপুর মন খারাপের ছদ্মবেশ।

—হুম্মম্মম! নিশ্চই কিছু হয়েছে। আমার ভাই কে নিয়ে নাকি?’
থুতনিতে হাত রেখে এক ভ্রু উচু করে চোখ ছোট ছোট করে ভাব নিয়ে বলল শাফিন৷

শাফিন উলটো দিকে হাটছে দেখে রুমাইশা তাড়াতাড়ি ওকে থামিয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
—তোর কাছে একটা জিনিস চাইবো, কিন্তু কাউকে বলতে পারবি না৷ একটা দরকারে চাচ্ছি। অন্য কোনো ইনটেনশন নিয়ে না৷’

— হ্যা, বলো, কি জিনিস চাই তোমার? তাও আবার আমার কাছে?

দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল শাফিন। রুমাইশা সিরিয়াস মুখ করে বলল,
—চাইবো তার আগে তোর এই খচ্চর মার্কা ফেস চেঞ্জ করে স্বাভাবিক হ।

শাফিনের মুখের চারপাশ আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখালো রুমাইশা৷ শাফিনের হাসি মুখ সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেলো, মুখ খানা কালো করে ও বলল,
—তুমি আমাকে খচ্চরের সাথে তুলনা করলে আপু!’

—তুই খচ্চর কি খচ্চর না সেই ডিবেট পরে করা যাবে, তার আগে আমি যা চাইছি তাই দে৷’

—হ্যা বলো কি চাই তোমার?’
প্যাঁচার মতো মুখ করে বলল শাফিন।

—চাইবো, তার আগে প্রমিস কর যে তুই এই বিষয় নিয়ে কোনো রিয়্যাক্ট করবিনা, প্লাস কারোরে বলবিনা, প্লাস এই বিষয় নিয়ে হাসি তামাশা করবি না, প্লাস পরবর্তীতে এই বিষয় নিয়ে আমারে খোচাবি না।’

ডান হাতটা শাফিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল রুমাইশা।
শাফিন চোখ ছোট ছোট করে সন্দেহের দৃষ্টি তে তাকালো রুমাইশার দিকে, তারপর রুমাইশার হাতের ওপর ডান হাত রেখে বলল,
—ঠিক আছে প্রমিস করলাম, এখন বল কি চাও।’

— সাফওয়ান ভাইয়ার ফোন নম্বর।

শাফিন চোখ বড় বড় করে রুমাইশার দিকে তাকালো, তারপর এক্সাইটমেন্টে ভ্রু দুইটা উচু করে দুষ্টু হাসি দিয়ে মুখ গোল করে চিল্লাতে যাবে তখনই রুমাইশা তাড়াতাড়ি তার দুই হাতের তালু উচু করে ওর মুখের সামনে রেখে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
—প্রমিস করেছিস তুই কোনো রিয়্যাক্ট করবিনা। এখন সাফওয়ান ভাইয়ার ফোন নম্বর দে৷’

শাফিন অতি কষ্টে নিজের উত্তেজনা দাঁত দিয়ে নইজের ভেতরে চেপে রেখে নিজের ফোন টা বের করলো, কিন্তু চোখ মুখ ওর এই ব্যাপার টা একটু খানি সেলিব্রেট করার জন্য যুদ্ধ করছে যেন! ফোন থেকে সাফওয়ানের ফোন নম্বর টা কপি করে রুমাইশা কে দিয়ে বলল,
—হোয়াটসঅ্যাপে দিয়েছি দেখো৷’

আচ্ছা’ বলে ফোন নম্বর নিয়ে রুমাইশা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো, যাওয়ার আগে শাফিনকে আর একবার চোখ দিয়ে শাসিয়ে গেলো যেন এই বিষয়ে কাউকে ও কিছু না বলে৷ রুমাইশা চলে যেতেই শাফিন লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নিচে নেমে দাঁড়িয়ে খানিক নাচানাচি করলো। ও ভেবে নিলো, নিশ্চই সাফওয়ান আর রুমাইশার ভেতর কিছু চলছে।

এদিকে নিজের ঘরে ফিরে এসে সাফওয়ানের উদ্দ্যেশ্যে মেসেজ লিখতে বসল রুমাইশা……..

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।