অফিডিয়ান

ক্রন্দনরত রুমাইশা কে নিজের বুকের মাঝে আগলে নিলো সাফওয়ান। খানিক ফুপিয়ে কেদে অবশেষে থামলো রুমাইশা। সাফওয়ান কি হচ্ছে কিছু না বুঝে এতক্ষন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। রুমাইশা কান্না থামিয়ে সাফওয়ানের বুক থেকে উঠে সাফওয়ানের মুখোমুখি বসে চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছিলো আপনার? আপনি এখানে কেন এসেছিলেন?

সাফওয়ান সোজা হয়ে বসে গলা খাকারি দিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— সে কথা পরে বলছি, আগে বল তুই আমার ল্যাবের খোজ পেলি কিভাবে, আর ল্যাবের ভেতরে প্রবেশ করলি কিভাবে?

রুমাইশা ঠোঁট উলটে একে একে ওর আর শাফিনের করা সমস্ত কাজের বিবরণ দিলো সাফওয়ান কে৷ শুধু মাত্র ওর আঘাতের কথা গুলো এড়িয়ে গেলো ও।
রুমাইশা আর শাফিনের কার্যকলাপের ডিটেইলস শুনে সাফওয়ান যারপরনাই অবাক হলো। সবচেয়ে বেশি অবাক হলো রুমাইশার ল্যাবের পাসওয়ার্ড ব্রেক করার ঘটনায়।

কিন্তু তারপরমুহুর্তেই ওর মনে পড়লো রুমের বাউন্ডারিতে তো লেজার সেটাপ করা আছে, আর এই লেজারে যে কাউকে বার্ন করার ক্ষমতা রাখে। বিষয় টা মনে পড়তেই খপ করে রুমাইশার হাত ধরে ও ওর সমস্ত শরীর পরখ করতে করতে বলল,
— লেজারে কোথায় কোথায় পুড়েছে, কতখানি পুড়েছে, দেখা আমাকে, দ্রুত!

রুমাইশার বলতে চাইলো না সাফওয়ান কে ওর শরীরের পুড়ে যাওয়া অংশ গুলোর কথা। তখন লেজার লেগে রুমাইশার শরীরের ডান দিকের বেশ কিছু জায়গায় বার্নের কারণে কালো বর্ণ ধারন করেছে, কিছু কিছু জায়গায় ফোস্কা পরে লাল লাল হয়ে গেছে।

কিন্তু সাফওয়ানের এমন টানা হ্যাচড়া তে এক পর্যায়ে রুমাইশা কোনো কথা না বলে একে একে দেখালো সব পোড়া জায়গা গুলো।
সাফওয়ান আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত উঠে বিছানা থেকে নামতে গেলো; বেডরুম থেকে ওর ল্যাবে গিয়ে বার্ন ক্রিম আনার জন্য।
সাফওয়ান কে এমন তড়িঘড়ি করে নামতে দেখে রুমাইশা তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলো,
— উঠবেন না, উঠবেন না, আপনার গায়ে কিছু নেই, মানে নিচে কিছু নেই!

সাফওয়ান যে অঙ্গভঙ্গি করে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সেইরকম ভাবেই ফ্রিজ হয়ে গেলো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে রুমাইশার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে নির্বিকার কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— তো?

সাফওয়ানের এমন প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেলো রুমাইশা৷ দমে গিয়ে এদিক ওদিক কিছুক্ষণ চোরা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— তো’ মানে কি? জলজ্যান্ত একটা মেয়ে মানুষ বসে আছে এইখানে আর আপনি বলছেন ‘তো’? লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছেন নাকি!

সাফওয়ান ওভাবেই বসে রইলো রুমাইশার দিকে তাকিয়ে, ধীরে ধীরে ওর ডান ভ্রু উচু হয়ে গেলো, চোখের দৃষ্টি চোখা করে ও তাকিয়ে রইলো রুমাইশার দিকে।
সাফওয়ানের এমন লুচু দৃষ্টিতে রুমাইশা সাফওয়ানের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে দমে যাওয়া গলায় বলল,
— ওই ভাবে তাকানোর কি আছে? যা সত্যি তাই বলেছি।

সাফওয়ান ওভাবে তাকিয়ে থেকেই বিছানার চাদর টা কোমরের নিচে জড়াতে শুরু করলো, জড়াতে জড়াতে বলল,
— অনেক কিছুই বলতে পারতাম, কিন্তু আমি একটা অতি ভদ্র ছেলে, দিনের বেলা।

তারপর চাদরটা জড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে গটগট পায়ে হেটে সাফওয়ান ওর রুমের বুক শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে সেই নির্দিষ্ট বই টা টান দিলো। সাথে সাথেই বুকশেলফ টা ভাগ হয়ে সরে গেলো। সাফওয়ান ঢুকলো ল্যাবের ভেতর। কৌতুহলী রুমাইশা ও নেমে এলো বিছানা থেকে, সাফওয়ানের পেছন পেছন সে ও ঢুকলো। আর ঢুকেই অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ও৷

ল্যাবে ঢুকে ওর মনে হচ্ছে ও বাংলাদেশে নেই। লন্ডনের কোনো পরীক্ষাগারে ঢুকেছে! অদ্ভুত রকমের সাদা রঙা বিশালাকৃতির ল্যাবটা যেন সম্মোহনী ভঙ্গিতে ওকে নিজের দিকে টানছে। বিস্মিত নয়নে চার পাশ টা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো ও।
এত বিশাল এরিয়া নিয়ে তৈরি ল্যাব টার ভেতরের একাংশ জুড়ে রয়েছে প্রায় শ খানেক গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ, যার একটিকেও রুমাইশা এই জীবনে দেখেনি। কোনো কোনো গাছে ফুটে রয়েছে অদ্ভুত রকমের ফুল। আর সেসব থেকে অদ্ভুত রকমের বিদঘুটে গন্ধ আসছে।

ল্যাবের ডান পাশের সমস্ত দেয়াল জুড়ে মৌমাছির কুঠুরির মতো মাঝারি সাইজের কাচের দরজা লাগানো বক্স। প্রতিটা বক্সের ভেতর ভিন্ন ভিন্ন ম্যাটারিয়ালস রাখা। আর বাম পাশের দেয়াল টা জুড়ে ল্যাবের সবরকমের উন্নত মেশিনারিজ রাখা, দেয়ালের সাথে অদ্ভুত ভাবে লেগে আছে সেগুলো।

রুমাইশা কে এমন বড় বড় চোখ করে ল্যাব টা দেখতে দেখে সাফওয়ান ওর কাছে এসে ওর হাত ধরে ল্যাবের প্রতিটা জায়গা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো। প্রতিটা লিকুইড, প্রতিটা যন্ত্রাংশের কাজ বুঝিয়ে দিলো ওকে৷ রুমাইশা শুধু দেখেই গেলো, কিছু বুঝলো না।
কিন্তু হাটতে হাটতে রুমাইশা একসময় বুঝলো যে এই রুম টাই শেষ না, এমন আর ও রুম আছে।

সাফওয়ান হেটে হেটে সেই নাম না জানা গাছ গুলোর কাছে গিয়ে একটা গোলাকার লাল পাতার গাছ ধরে নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেলে ঘুরাতেই গাছের পেছনের দেয়ালের একাংশ শব্দ করে সরে গেলো ডান দিকের দেয়ালের ভেতর। আর এরপরই সাফওয়ান যেন ওকে নিয়ে ঢুকলো অন্য এক জগতে।
এই জায়গাটা দেখে মনেই হচ্ছে না যে এটা মাটির নিচে! মনে হচ্ছে পৃথিবীর বুকেই এক টুকরো জঙ্গল, যেখানে বৈচিত্র্যময় সরিসৃপ দের বসবাস। পায়ের নিচে কোনো শান বাধানো নেই, পুরোটাই মাটি। সেই মাটির ওপরে অজস্র গাছ পালা, আর সেখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অদ্ভুত দর্শন সব রেপটাইল। গাছের ডালে কত রকমের সাপ ঝুলে রয়েছে তার হিসাব নেই৷

কিন্তু সাফওয়ান সেখানে ঢুকতেই প্রানী গুলোর যেন কিছু একটা হলো, এতক্ষনের শান্ত পরিবেশ হঠাৎ করেই অশান্ত হয়ে উঠলো। প্রানী গুলো হুটোপুটি করে সাফওয়ানের দিকেই দ্রুত গতিতে ছুটে আসতে লাগলো চারদিক থেকে। প্রানীদের এমন আচরণে ভড়কে গেলো রুমাইশা। ও দ্রুত গিয়ে সাফওয়ানের পেছনে লুকালো।
আর সাফওয়ান নিজের চোখ দুইটা বন্ধ করে দুই হাত মেলে দিলো সেই সরিসৃপ দের উদ্দেশ্যে। আর এরপর চারদিক থেকে ছুটে আসা বিভিন্ন আকৃতির, বিভিন্ন বর্ণের সরিসৃপ গুলো সাফওয়ানের গা বেয়ে উঠে গেলো মুহুর্তেই, ওর সমস্ত শরীরে জড়িয়ে রইলো সেগুলো।

এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে রুমাইশা এক ঝটকায় সাফওয়ানের থেকে সরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পেছনে থাকা দেয়ালের সাথে লেগে গেলো। সাপ ও এমনিতেই খুব ভয় পায়, আর এক সাথে এত গুলো সাপ দেখে ওর গলা শুকিয়ে গেলো একেবারে। ঢোক গিলতে গিয়ে কিছুই পেলো না। চোখ দুইটা বড় বড় হয়ে গেলো ওর।

খানিকক্ষণ পর সাফওয়ান ধীরে ধীরে ঘুরলো রুমাইশার দিকে। আর আজ এই মুহুর্তে সাফওয়ান কে দেখার পর রুমাইশা সর্বোচ্চ ভয় পেলো! চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেলো ও। বুকের ভেতর টা ভয়ের চোটে প্রচন্ড দ্রুত গতিতে ওঠানামা করতে লাগলো।

সাফওয়ান রুমাইশার দিকে ফিরে অদ্ভুত রকমের একটা হাসি দিলো। রুমাইশার পিলে চমকে গেলো সাফওয়ানের হাসি দেখে৷
সাফওয়ানের জ্বলজ্বলে চোখ দুইটা এখন ধারণার চেয়েও বেশি জ্বল জ্বল করছে। চোখের ধুসর সবুজ রঙ টা গাঢ় হয়ে গেছে অনেক খানি। আর ওর চোখের গোলাকার পিউপিল টা তীর্যক হয়ে লম্বা আকার ধারন করেছে।
সাপেরা যেমন থেকে থেকে জিহবা বের করে চারপাশের স্মেল নেয়, ঠিক সেভাবেই থেকে থেকে কুচকুচে কালো দ্বিখণ্ডিত লকলকে জিহবা টা অর্ধেকেরও বেশি বের হয়ে আসছে সাফওয়ানের মুখ দিয়ে৷ গায়ের আঁশটে চামড়া টা গিরগিটির শরীরে মতো যেন রঙ বদলাচ্ছে থেকে থেকে! লাল, নীল, বেগুনি হয়ে রঙধনুর মতো শরীর ময় খেলা করে বেড়াচ্ছে যেন রঙগুলো।

সাফওয়ানের হাতের শিরা উপশিরা গুলো গাড় নীল রঙ ধারন করে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছে ওর হাতের ওপর অদ্ভুদ ভাবে। আর ওর তীক্ষ্ণ সুচালো ক্যানাইন দাঁত দ্বয় এই অদ্ভুত পরিবেশের স্বল্প আলোকে ঝকঝক করছে!

দেয়ালের সাথে ভয়ে লেপ্টে যাওয়া রুমাইশার দিকে তাকিয়ে সাফওয়ান ওর ঝকঝকা দাঁত মেলে মাতালের মতো জোরে জোরে হাসতে লাগলো, যেন ওর মারাত্মক নেশা হয়ে গেছে এই সাপ গুলোর স্পর্শ পেয়ে। আর রুমাইশা ভয়ে কাতর হয়ে অসহায় চোখে দেখতে লাগলো সাফওয়ানের এই সম্পুর্ন নতুন রূপ।

( কাজ বাকি আছে অনেক, তাই ছোট্ট পর্ব দিয়েছি, Don’t mind আপু গন)

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.