৮. আজ ও রুমের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরের আলোটা কেউ অফ করে দিয়েছে, শাফিন বলেছিল সাফওয়ান ভাইয়া বন্ধ করতে পারে। কিন্তু ও তো থাকে চিলেকোঠায়৷ ও কেন এত রাতে এসে লাইট বন্ধ করবে?
রুমাইশা উঠলো। কৌতুহল বশত জানালার কাছে গিয়ে পর্দা উচু করলো। গ্লাস খুললো না। শব্দ টা এদিক থেকেই আসে। আজ চাঁদের আলো আছে অল্প। জঙ্গলের দিকে তাকাতেই কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে৷
হটাৎ রুমাইশার চোখ গেলো একটা অবয়বের দিকে। কেউ একজন হেটে হেটে জঙ্গলের দিকে এগোচ্ছে। রুমাইশা খেয়াল করে দেখতেই অবয়ব টা জঙ্গলের ভেতর মিলিয়ে গেলো। রুমাইশা খুব ভয় পেলো। রাত এখন প্রায় সাড়ে তিনটা, এই সময়ে কে যাবে জঙ্গলের দিকে, আর কেনই বা যাবে! যেখানে দিনের বেলা যেতেও ভয় লাগে সেখানে এত রাতে কেউ জঙ্গলে যাবে কেন? ওটা মানুষই তো, নাকি আমি ঘুমের ঘরে ভুলভাল দেখলাম! রুমাইশা এইসব ভাবতে ভাবতে পর্দা টেনে দিয়ে আবার বেডে এসে বসলো। এত রাতে কেউ কেন জঙ্গলে যাবে সেটা কিছুতেই ওর মাথায় আসলো না৷
রুমাইশা ভাবলো উঠেছেই যখন, আযান দিতে তো বেশি দেরি নেই, তাহলে একটু পড়াশোনা করে, নামাজ পড়ে তারপর ঘুমাবে। বেড থেকে নেমে রুমাইশা পড়ার টেবিলে গেলো।
.
সকালে রুনিয়া খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে আসলে দেখেন রুমাইশা এখনো দরজা খোলেনি। দু একবার আস্তে করে নক করলেন তিনি দরজায়, কিন্তু রুমাইশার কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেলো না৷ অগত্যা তিনি শাফিন কে ডাকতে গেলেন। শাফিন তখন ফ্রেস হয়ে বের হলো।
রুনিয়া কে দেখে শাফিন বলল, রুমি আপু কে ডেকো না মা, আপু ভোরবেলা আমাকে মেসেজ দিয়েছে যে আপু ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে, আপুকে যেন না ডাকা হয়, আপু একেবারে দুপুরের খাবার খাবে৷
রুনিয়া আচ্ছা বলে শাফিন কে নিচে যেতে বলে নিজেও চলে গেলো।
দুপুরে খাওয়ার সময় রুমাইশা শাফিন কে বলল,
—শাফিন, খাওয়া শেষ করে আমার রুমে আসবি। তোর সাথে কথা আছে।
শাফিন মাথা নাড়িয়ে বোঝালো যে যাবে৷ রুমাইশা আগে আগে খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে গেলো। শাফিন কিছুক্ষন পর রুমাইশার রুমে এলো।
চেয়ার টেনে বসে বলল,
—বল আপু, কিছু হয়েছে?
রুমাইশা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, আমি কাল রাতে কাউকে দেখেছি, জঙ্গলের ভেতর যেতে, প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে। লোক টা অনেক লম্বা ছিলো, ছেলে কি মেয়ে জানিনা, তবে ছেলেই হবে৷ এরকম লম্বা মেয়ে তো সচরাচর দেখা যায় না৷
রুমাইশার কথা শুনে শাফিন বসা থেকে লাফিয়ে উঠে দাড়ালো!
— সিরিয়াসলি তুমি কাউকে জঙ্গলে যেতে দেখেছো? তাও আবার অতো রাতে!
শাফিন এবার হেসে দিলো, বলল,
—আপু, তোমার মাথা টা গেছে। কাল অনেক রাত জেগে পড়েছো, আর ঘুম কম হয়েছে বলে তুমি এরকম ভুলভাল দেখেছো৷ নইলে কারো বুকের এত পাটা হয়নি যে উত্তরের জঙ্গলে একা একা যাবে, তাও রাত তিনটেই! তোমাকে আমি একটা ভালো বুদ্ধি দিই, তুমি আজ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাবে, এগারোটার পরপরই৷ সারারাত ঘুমাবে, তাহলে কাল সকালে দেখবে তোমার মাথা ঠিক হয়ে গেছে!
বলে শাফিন খিক খিক করে হাসলো! রুমাইশা বিরক্ত হয়ে শাফিনের মাথায় একটা গাট্টা দিলো। বলল,
—বিশ্বাস তো করিস না আমার কথা, আমি না হয় কয়দিন পর চলে যাবো, তোরা তো এখানেই থাকবি, কবে দেখিস তোকে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে, আর তোর ভাই তো চিলেকোঠায় একা একা থাকে, ওকে আগে নিবে!
বলে রুমাইশা মুখ বেকালো, রুমাইশার কথার ভঙ্গি আর মুখ বাকানো দেখে শাফিন শব্দ করে হেসে দিলো। তারপর গলা নামিয়ে বত্রিশ পাটি দাত বের করে বলল,
—আমার ভাইকে নিয়ে যাবে তো তোমার কি? খুব চিন্তা করো তো দেখি আমার ভাইকে নিয়ে! আম্মু বলেছে আমাকে, ভাইয়া তোমার জন্য কি কি করতো ছোটবেলায়, আর তুমি ভাইয়া কে ছাড়া কিছু নাকি বুঝতে না! এখনো কি সেরকম কিছু আছে নাকি? হুম , হুম?
দুই ভ্রু নাচালো শাফিন৷ লজ্জায় কান গরম হয়ে গেলো রুমাইশার, হাতের কাছের বালিশ টা ফেলে শাফিন কে মারলো আর চেচিয়ে বলল,
—অসভ্য, এক্ষুনি আমার রুম থেকে বেরিয়ে যা! আর আসবি না কখনো।
শাফিন হাসতে হাসতে দৌড় দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো৷
রুনিয়া রহমান শাফিন আর রুমাইশার চিল্লাচিল্লি, হাসাহাসি শুনছিলেন এতক্ষন রান্নাঘর থেকে৷ অজান্তেই এক ফোটা পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়লো রুনিয়ার চোখ থেকে! আজ সাফওয়ান স্বাভাবিক থাকলে সেও কত মজা করতো এদের সাথে! হাসি আড্ডা দিয়ে মাতিয়ে রাখতো বাড়িটাকে! কিন্তু এক নরপশুর জন্য আজ তার ছেলের জীবনে কোনো আনন্দ নেই! যা আছে শুধু একবুক কষ্ট আর হতাশা।
রুনিয়া ভেবে পায় না, কি এমন পাপ করেছিলো যে তার ছেলের জীবন টা এমন হলো! ছেলেটাকে চোখের দেখা দেখতএ পারে না, ছুয়ে দেখতে পারেনা! একজন মায়ের নিজের সন্তান কে দেখতে না পারা, ছুতে না পারার কষ্টের চাইতে আর বেশি কিছু কিই বা হতে পারে! শাড়ির আচল দিয়ে আবারও নিজের চোখ মুছে নিলেন রুনিয়া।
৯.আজ রুমাইশা সত্যিই সকাল সকাল ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিলো। শাফিনের কথা মতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়লো। ভোর বেলা তাড়াতাড়ি উঠে নামাজ শেষ করে তারপর পড়বে ভাবলো। দুইটার দিকে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলো ওর, গা ঘেমে গেছে! জোরে জোরে নিঃশ্বাস ওঠানামা করছে ওর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পড়ার টেবিলে ওর পানির বোতল থাকে, উঠে গিয়ে পানির বোতল টা হাতে নিলো রুমাইশা। কিন্তু বতল তো খালি, রাতে পানি খেয়ে বোতলে পানি ভরতেই ভুলে গেছে ও।
একবার ভাবলো, থাক, সকালে খাবে, কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে প্রচণ্ড, না খেলেই নয়। বোতল টা নিয়ে ধীরে ধীরে সিড়ি দিয়ে নামলো রুমাইশা।
হলরুমে আলো নেই, রুনিয়া রহমান ঘুমানোর সময় আলো বন্ধ করে দিয়ে যায়, অন্ধকার হলেও পুরোপুরি অন্ধকার না, আবছা আবছা আলোতে মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু। তাই রুমাইশা আর আলো জ্বালালো না। হলরুমের একপাশে ডাইনিং টেবিল, ডাইনিং টেবিলের পেছনে রান্না ঘর। রুমাইশা গিয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা জগ উচু করলো বোতলে পানি নেওয়ার জন্য। তখনই রান্না ঘরের ভেতর থেকে কীসের একটা শব্দ হলো।
রুমাইশা চকিতে তাকালো রান্না ঘরের দিকে। বোতল টা আস্তে করে নামিয়ে রাখলো টেবিলের ওপর। রান্নাঘরে কেউ একজন আছে। তার বিভিন্ন মুভমেন্টের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে৷ কিন্তু আলো বন্ধ কেন? রান্নাঘরে তো হলরুমের মতো আবছা আলো নেই, পুরাই অন্ধকার। দিনের বেলাতেও রান্না ঘরে আলো জ্বালাতে হয়, নয়তো দেখা যায় না তেমন৷ এত রাতে রান্না ঘরে কে থাকতে পারে।
রুমাইশা এসে ডাইনিং টেবিলের বাম পাশের দেয়াল ঘেসে দাড়ালো, এখান থেকে রান্না ঘরের ভেতরে কিছুটা দেখা যায়। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
এমন সময় রান্না ঘরে থাকা ফ্রিজের দরজা কেউ খুলল, ফ্রিজের আলো এসে সেই কেউ একজনের মুখে পড়ে চেহারার সামনের অংশ টা আলোকিত করে ফেললো। কিন্তু রুমাইশা লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু লোকটার উচ্চতা দেখে রুমাইশার চোখ কপালে উঠার উপক্রম!
‘ও রে বাবা! এতো ফ্রিজের থেকেও লম্বা মনে হচ্ছে! মানুষ তো! জ্বীন ফিন নয় তো আবার, রাতের বেলা হয়তো খিদে লেগেছে তাই খেতে এসেছে।’
নিজের আজগুবি চিন্তায় নিজেই নিজের মাথায় একটা গাট্টা মারলো রুমাইশা! তারপর ভাবলো, সাফওয়ান ভাইয়া নয়তো! ভাইয়ার খিদে লাগতে পারে! কিন্তু ভাইয়া এত লম্বা হবে!
লোকটা ঠান্ডা পানির বোতল বের করলো ফ্রিজ থেকে, তারপর বোতলের মুখ খুলে বোতল উঁচু করে ঢকঢক করে পানি খেলো। এরপর ঝুকে দাঁড়িয়ে ডিপ ফ্রিজএর দরজা খুলল, তারপর সেখান থেকে ভ্যানিলা আইসক্রিম এর বক্স টা বের করলো নিঃশব্দে।
বক্সের মুখ খুলে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে কিছু একটা খুজতএ লাগলো সে, রুমাইশা বুঝলো চামচ খুজছে। কিছুক্ষণের ভেতর চামচ পেয়েও গেলো।
কিন্তু হঠাৎই সে লোকটার সিক্সথ সেন্স ধারে কাছেই কারো উপস্থিতি টের পেলো। আর সাথে সাথেই সে ধাম করে নিজের সামনে থাকা ফ্রিজের মুখটা বন্ধ করে দিয়ে তড়িৎ গতিতে তার আন্ডার শার্টের বুকের কাছে থাকা কালো রঙা মোটা গ্লাসের ডার্ক গগলস টা চোখে পরে নিলো সে।
আবারও ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে গেলো রান্নাঘর টা। চারদিক এখন পিনপতন নিরাবতা! রুমাইশা ভেবে পেলোনা কি করবে ও এখন! লোকটা কি ওকে দেখে ফেলেছে? কিন্তু ও তো মিশমিশে অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে, যেন ওকে দেখা না যায়! তাহলে লোকটা ওকে দেখবে কিভাবে?
রুমাইশার এই ভাবনার ভেতরেই রান্নাঘর থেকে ভেসে আসলো একটা কঠিন, গমগমে কণ্ঠস্বর,
— রিমু!