পরিজান | পর্ব – ৪২

11 Min Read

পরী শান্ত মেজাজে কবিরের গলায় ছু*রি বসিয়েছে।
যা কারো মাথাতে আসেনি। এমনকি শায়েরের ও না। নওশাদ ভেবেছিল এতো কিছু জানার পর পরী ভেঙে পড়বে। কিন্ত তা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে পরী নিজেকে আরো শক্তিশালী করে দাড় করিয়েছে। যখন টেবিলের পাশ ঘেষে পরী দাঁড়িয়েছিল তখনই ছু*রিটা হাতে নিয়েছিল এবং সুযোগ বুঝেই কাজে লাগিয়েছে। কবিরকে আঘাত করে পরী আর এক মুহূর্তেও দেরি না করে পা বাড়ালো নওশাদের দিকে। তবে নওশাদ একটু দূরে থাকার কারণে সে সতর্ক হয়ে গেল। শায়ের নিজেও পরীকে ঝাপটে ধরে। টেনে সবার থেকে দূরে নিয়ে আসে। কিন্ত পরী হাত পা ছুটোছুটি করছে। শায়ের বলল,’ছুরিটা ফেলে দিন পরীজান আপনার লেগে যাবে। একটু শান্ত হন।’

-‘ছাড়ুন আমাকে,ওকে না মারতে পারলে আমার রক্ত ঠান্ডা হবে না।’

আফতাব চেঁচিয়ে বলে,’এখনও সময় আছে শায়ের, পরীকে শেষ করে দাও। নাহলে ও তোমাকেও ছাড়বে না।’
আফতাবের কথাতে পরী স্থির হয়ে গেল। হাত থেকে ছু*রিটা আপনাআপনি পড়ে গেল। সে বলল,’কেমন পিতা আপনি যে নিজ কন্যাকে হত্যা করতে চাইছেন? আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি তাহলে আমার উপর আপনার কিসের ক্ষোভ?’

-‘মেয়ে হয়ে যদি বাবাকে খুন করার ইচ্ছা পোষণ করো তাহলে আমি বাবা হয়ে কেন পারবো না?’

-‘আমি কবে আপনাকে খুন করতে চাইছি? আমি তো আপনাকে হত্যা করার কথা কখনও চিন্তাও করিনি।’

-‘এখন তো করতে চাইবে। সেটা আমি জানি। সোনালীর মতো তুমিও আমাকে মারতে চাইবে তাই তোমাকে আগেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।’

-‘সোনা আপা আপনাকে মারতে চেয়েছিল? কিন্ত কেন??’

আফতাব কথা বলল না। তবে নওশাদ বলে উঠল, ‘তোমার বাবার যে সাম্রাজ্যের লোভ পরী। তা পেতে সে নিজের আপনজনদের বিসর্জন দিতেও পিছপা হবে না।’

আফতাব রাগন্বিত চোখে নওশাদের দিকে তাকালো। নওশাদ সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘোরায়। পরী তো সব জেনেই গেছে, এটুকু জানলে ক্ষতি কি?

-‘কি এমন লোভ আপনার যে নিজের মেয়েদের হত্যা করতে হবে? অল্প কিছু নিয়ে কি সুখে থাকা যায় না?
যে লোভে এতো পাপ করছেন, পরকালে কি জবাব দিবেন?’

-‘ইহকালে সুখ পেলে পরকালেও পাবো আমাকে নিয়ে তুমি এতো ভেবো না।’

-‘মূর্খ পিতা আপনি। ইহকাল পরকালে আকাশ পাতাল তফাত। তবে একটা কথা শুনে রাখুন, যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে আপনি বাঁচবেন না। সাম্রাজ্যের লোভে আপনি, আর আমার প্রতিশোধের আক্রোশ। কার জয় হয় দেখা যাবে। আমি নিশ্চিত এই যুদ্ধে আমার প্রাণ হারাবো আমি। কিন্ত রক্তারক্তি ছাড়া আমি মরবো না। ভুলে যাবেন না আপনার রক্ত আমার শরীরে আছে। তাই আপনার মতো তলো*য়ার
আমিও চালাতে পারি। আর আমার লক্ষ্য কখনো বিফলে যাবে না।’

আফতাব গর্জে ওঠে। তার সামনেই মৃত্যুর হুমকি দিচ্ছে তার মেয়ে। আর তিনি শুনছেন। শায়ের কে সে বলে,’পরীকে রেখে চলে যাও শায়ের নাহলে আজ তোমাকেও শেষ করে দেবো।’

আফতাবের কথা শুনে শায়ের হাসলো। একহাতে পরীকে জড়িয়ে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনার কোন চামচার সাহস নেই আমাকে ছোঁয়ার।
এসব বলে নিজেকে হাসির পাত্র বানাবেন না। চলুন পরীজান। আমাদের যেতে হবে।’

শায়ের পরীর হাত ধরে সবার সামনে দিয়ে বাগান বাড়ি ত্যাগ করলো। সব রক্ষিরা শায়ের কে আটকানোর পরিবর্তে তাকে যাওয়ার রাস্তা করে দিলো। কিছুটা দূর এসে পরীর শক্তি যেন সব শেষ হয়ে গেল। সে মাটিতে বসে পড়ল। শায়ের পরীর হাত ছেড়ে দিলো। পরী চিৎকার করে কাঁদছে,বোরখার নেকাব টা টেনে খুলে ফেলেছে সে। জীবনের এতগুলো বছর সে ভুল মানুষদের সাথে কাটিয়েছে সেটা ভাবতেই ঘৃণা বাড়ছে ওর। মাটিতে বসে সে হাত পা ছুড়ছে আর কাঁদছে।

জ্যোৎস্নার আলোতে ভরে গেছে চারিদিক। চাঁদের আলো সবারই প্রিয় কিন্ত সময় যেন সবকিছুতে আজ বিষ ঢেলে দিয়েছে। নিঃশ্বাস ছাড়তেও কষ্ট হচ্ছে পরীর। কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থেকে উঠে ছুট লাগালো পরী। শায়ের পরীকে দাঁড়াতে বলছে আর ছুটছে। পরী ছুটে গেলো সোনালীর কবরের কাছে। কবরের মাটি আঁকড়ে ধরে মাথা রাখে মাটিতে। এই রাস্তা দিয়ে কতো চলাফেরা করেছে অথচ পরী জানতেও পারলো না এই কবরটা ওর প্রিয় মানুষটার। রাখাল কদম গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসেছিল। পরীকে এইভাবে কাঁদতে দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল। হামাগুড়ি দিয়ে এসে পরীর পাশে বসে ওকে দেখার চেষ্টা করে। পরী আগের মতোই কাঁদছে। রাখাল পরীকে মৃদু ধাক্কা দিতে দিতে বলে,’এই ওঠ, কান্দস ক্যান এতো। রানীর ঘুম ভাইঙা যাইবো।’

পরী মাথা তুলে রাখালের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে
ঠোঁট ভেঙে আবারো কেঁদে উঠল। সে বলল,’আপার ঘুম কখনোই ভাঙবে না। যদি কাঁদলে ঘুম ভাঙতো তাহলে বিশ্বাস করো আমি অনেক কাঁদতাম। তুমি কেন আপাকে বাঁচাতে পারলে না? আমার আপা কত কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছাড়লো।’

রাখাল পরীর কথার অর্থ বুঝলো না। বোঝার চেষ্টাও করলো না। সে আপন হস্তে সোনালীর কবরে হাত বুলাচ্ছে।

-‘কোন পাপের শাস্তি তুমি পেলে আপা? ওই পিশাচ গুলো তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আমি তোমার কবরের মাটি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত আমি ওদের শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করবো। আর যাই হোক না কেন নওশাদ কে না মারা পর্যন্ত আমি শান্ত হবো না। তোমার মৃ*ত্যুর প্রতিশোধ আমি নিবোই। মৃ*ত্যুর পরেও বিধাতার কাছে আর্জি জানাবো তোমার হ*ত্যাকারীর শাস্তির জন্য।’

চোখের পানি দুহাতে মুছে নিলো পরী। শক্ত কন্ঠে বলল,’দোয়া করো আপা,তোমার পরী যেন সব কাজে সফল হয়। তোমার ছোট্ট পরী আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। ভালো খারাপ আজ বুঝেছে। প্রতিশোধের মানে জানে। তোমার পরী কখনো ভেঙে পড়েনি আর ভাঙবে ও না। তোমার পরী হাসতে হাসতে মৃত্যুকে বরণ করে নেবে।’

আবার চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল পরী। পেছন ফিরতেই সে শায়ের কে দেখলো। শায়ের এতক্ষণ পরীর কথা শুনছিলো। পরীর চাহনি স্থির। শায়ের তা অন্ধকারে উপলব্ধি করতে পারলো না। তবে শায়ের এটা বুঝতে পারল যে আজকের পরী সম্পূর্ণ নতুন ভাবে তৈরি। শায়েরের জন্য তার মনে এটুকুও ভালোবাসা নেই। শায়ের পরীর দিকে এগোলো না পরী নিজেই আসলো। জমিদার বাড়ির দিকে যাচ্ছে পরী। শায়ের বলে উঠল,’ওখানে যাবেন না পরীজান। আমার সাথে ফিরে চলুন।’

ফিরে তাকালো পরী,’আপনার ভাবনা অসাধারণ। কিন্ত আমি ফিরে যাবো না। আমার প্রতিশোধ না নিয়ে আমি কোথাও যাবো না।’

-‘আপনি একা একটা মেয়ে হয়ে ওদের সাথে কিছুতেই পারবেন না।’
-‘সেটা আমি জানি তবুও প্রতিশোধ না নিয়ে আমি পিছপা হবো না। আপনি চলে যেতে পারেন।’

-‘আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না পরীজান।
চলুন আমরা অনেক দূরে চলে যাই!! আমরা ভালো থাকবো সেখানে।’

-‘বাহ!! কত সহজে কথাগুলো বলে দিলেন। আপনার মতো পাপিষ্টরা সব কিছুকে সহজ ভাবেই নেয়। কিন্ত আমার পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব না। আমার ভালোবাসা দেখেছেন কিন্ত এবার আমার ঘৃণা দেখবেন। আপনার পরীজান আপনাকে কতটা ঘৃণা করে তা এবার আপনি দেখবেন।’

শায়ের পরীর কাছে আসলো। পরীর হাতদুটো নিজের বুকে চেপে ধরে বলল,’আমি দোষী, আমি পাপী, আমি শাস্তির যোগ্য। আপনি আমাকে শাস্তি দিন। আমাকে জড়িয়ে ধরেই শাস্তি দিন। আমি সব মাথা পেতে নেবো। কিন্ত আমার থেকে দূরে সরে যাবেন না।’

পরী ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো শায়ের কে। চিৎকার করে বলল,’আপনার ছোঁয়া বিষাক্ত লাগছে আমার কাছে। আমি মানতে পারছি না আপনিও সবার মতো আমাকে মারতে চেয়েছিলেন। যদি আমাকে মারতেই চান তাহলে আগেই মেরে ফেলতেন। কেন আমার ভেতরে ভালোবাসার জন্ম দিলেন? আমার অনুভূতির সাথে নোংরামো করলেন?’

-‘অনুভূতি ভালোবাসা কখনো নোংরা হয় না পরীজান। নোংরা হয় মানুষ। আমার ভালোবাসা নোংরা না পরীজান।’
শায়েরের কথার পিঠে কথা না বলে পরী হেটে চলল।
শায়ের ও পরীর পিছু নিলো। অন্দরের উঠোনে এসেই বোরখা টা ছুড়ে ফেলে দিলো পরী। মালা এখনও বারান্দায় বসেছিল। পরীকে নিয়ে যাওয়ার পর মালা আর নিজ ঘরে যায়নি। পরীকে দেখে মালা ছুটে এলো। মেয়ের দুগালে হাত রেখে সারামুখে চুম্বন করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের উষ্ণতা পেয়ে পরী চোখের জলে বুক ভাসালো। মালা কেঁদে যাচ্ছেন পরীকে জড়িয়ে ধরে।
রুপালি নিজ ঘর থেকে দৌড়ে এসে মালাসহ পরীকে জড়িয়ে ধরে। তিনজন মিলে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। ভারি হয়ে উঠেছে সারা অন্দর। রুপালি নিজের চোখ মুছে বলে,’পরী তুই শায়েরের সাথে চলে যা ভালো থাকবি।’

-‘আমি যাবো না আপা। ওদের শাস্তি না দিয়ে যাবো না। কার সাথে যেতে বলছো আমাকে? যে কিনা আমাকে খুন করার জন্য বিয়ে করেছে।’

-‘আমি জানি সব। কিন্ত বিশ্বাস কর শায়ের তোকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলে তোকে বিয়ে করেছে। ও তোকে ভালোবাসে অনেক। তুই ওর সাথে ভলো থাকবি।’

পরী রুপালির কথার পিঠে কথা না বলে কুসুম কে ডাকলো। কলপাড়ে গিয়ে কুসুম কে বালতি ভরতে বলে নিজ কক্ষে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর পরী কলপাড়ে গিয়ে বসলো। কুসুম তখনও ছিল ওখানে। পরী কুসুমের দিকে তাকিয়ে বলল,’আমি না বলা পর্যন্ত তুই এখানেই থাকবি।’

কুসুম মাথা নাড়ে। পরীকে আজ ভয়ংকর সুন্দর লাগছে কুসুমের কাছে। ভেজা চুলগুলো লেপ্টে আছে ঘাড় গলা দিয়ে। ঠান্ডা পানি শরীরের পড়তেই কেঁপে কেঁপে উঠছে পরী। ঠোঁট দুটো নীল হয়ে আসছে। তবুও ইচ্ছামতো পানি ঢেলে শান্ত হলো পরী। ভেজা কাপড় ছেলে সিঁদূর রাঙা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ঘরে গেল। শায়ের এতক্ষণ পরীর আসার অপেক্ষায় ছিলো। পরীকে দেখে সে থমকে গেল। পরীর নুতন সৌন্দর্য প্রতিদিন আবিষ্কার করে সে। আজও করলো। তবে আজ যেন ভয়ানক সুন্দর লাগছে পরীকে। চুল মুছেনি,শাড়িটা ভিজে গেছে পানিতে। শায়ের গামছা এনে পরীর কাছে এগিয়ে আসতেই হাত উচিয়ে থামিয়ে দিলো পরী। বলল, ‘আমার থেকে দূরে থাকবেন। আমার সহ্য হয়না আপনাকে।’

-‘তবুও আমি আপনার কাছে আসবোই। আপনার কাছে আসা আটকাতে পারবেন না আপনি। যদি আমাকে মেরে ফেলেন তাহলে আমাদের দূরত্ব বাড়াতে পারবেন।’

-‘বলা বাহুল্য যে আপনাকে আমি ক্রোধের তাড়নায় মেরে ফেলতেও পারি। কিন্ত আমি নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখার চেষ্টা করব। আপনাকে বাঁচতে হবে। দুনিয়াতেই আপনি বেঁচে থাকার শাস্তি পাবেন। আমার আপনার দূরত্ব আপনাকে শাস্তি দিবে।’

শায়ের কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পরীর দিকে। কোন ভালোবাসা নেই আজকের পরীর মাঝে। পাপ সবকিছু দিয়ে আবার কেড়ে নেয়। শায়ের আজকে তার প্রমাণ পেলো। কাছে থেকেও আজ পরী যেন অনেক দূরে। শায়ের জানে না আদৌ কোনদিন এই দূরত্ব মিটবে কিনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়ের বলে,’আমি খু*ন করে যদি পাপী হই তাহলে আপনিও পাপী। শশীল কে হ*ত্যা করে আপনিও পাপী। মানতে পারবেন এটা?’

-‘একটা নরপিশাচ কে শাস্তি দেওয়া পাপ না। পৃথিবীর বুক থেকে একটা জানো*য়ার তো বিদায় হলো।’

-‘বিন্দুর ধ*র্ষ*ণ কারিদের হত্যা করে তাহলে আমিও পাপ করিনি তাহলে।’

-‘তাহলে পালক??এবার বলবেন এটাও পাপ নয়?’

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।