পরিজান | পর্ব – ৫৪

11 Min Read

স্বামী স্ত্রীর একান্ত সময়ে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ নিষেধ। সেকথা ভেবে নাঈম ও গেল না। তবে সে খুব করে চাইছে সত্য জানতে। পরী আর শায়েরের তো সুখে সংসার করার কথা তাহলে ওদের পরিণতি এমন কেন হলো? প্রশ্নগুলো মাথায় জট পাকিয়ে দিচ্ছে যার ফলে অস্থির লাগছে নাঈমের। পরী আর শায়েরের ঘরের কাছে গিয়েও সে ফিরে আসে। তার কোন অধিকার নেই। তবুও একটা টান অনুভব করছে সে।
পরী শায়েরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসে আছে। শায়ের চুপচাপ জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত শহরটাকে দেখে যাচ্ছে এক মনে। বাইরের মানুষ গুলোর কত ব্যস্ততা!! বহু লোকজনের সমাগম রাস্তায়। জীবিকা নির্বাহের জন্য একেকজন একেক দিকে ছুটছে। শায়ের ভাবছে তারও তো কিছু করতে হবে তার পরীজানের জন্য। শহরে তার বেশ পরিচিত লোক আছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করলে সে ভাল একটা কাজ পেয়ে যাবে। এসব চিন্তাই করছে সে।
-‘আপনি কি এতো চিন্তা করছেন?’

শায়ের ফিরে তাকাল পরীর দিকে,’আমার সব চিন্তাতে শুধু আপনি পরীজান। কীভাবে আপনার সাথে আমি থাকতে পারব এসব নিয়েই আমার সব ভাবনা।’
পরী হাসল ওর এই হাসিটা দেখতে কুৎসিত হলেও শায়েরের মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল যেন,’আমাদের দূরত্ব বোধহয় খুব শীঘ্রই বাড়বে মালি সাহেব। আল্লাহ আপনাকে আমাকে তাড়াতাড়ি আলাদা করে দেবেন।’
শায়ের পরীর পাশে গিয়ে বসল,’যদি কখনো আমাদের শরীর আলাদা হয়ে যায় আমাদের মন কিন্তু আলাদা হবে না পরীজান। রাখাল পাগল হয়েও তার ভালোবাসা ভোলেনি। আর আমি তো সুস্থ মানুষ।’
একটু চুপ থেকে কিছু ভেবে শায়ের বলল,’যারা আল্লাহ্‌র প্রিয় থাকে তাদের পরকাল সুন্দর হয়। আপনার পরকাল ও সুন্দর হবে। কিন্ত আমার পরকাল সুন্দর হবে না পরীজান। সেখানেও তিনি আমাদের আলাদা করে রাখবেন।’
পরী শায়েরের চোখে চোখ রাখে। পরীর সান্নিধ্য চায় শায়ের তা ওই চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। শায়ের শুধুমাত্র একটা জিনিস চায় কিন্তু মনে হয় সে সারা দুনিয়ার থেকেও বেশি কিছু চাইছে যা পাওয়া দুষ্কর।
পরী কিছু বলছে না। তাই শায়ের বলে উঠল,’আমি এখনও বলছি আমি আপনার যোগ্য নই তবুও আমি বিনা আপনি কারো নন। আপনার শেষ ঠিকানা আমার বক্ষস্থল।’

-‘আমার জন্য আপনি তো কত কিছুই করলেন। শেষ একটা কাজ করবেন। যেটা করলে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আমাকে আপনার হাতে তুলে দিবেন।’

শায়ের চমকালো,’শত যুগ অপেক্ষার বিনিময়ে আল্লাহ যদি আপনাকে আমাকে দিয়ে দেন তো আমি আপনার জন্য শত যুগ অপেক্ষা করতে রাজি আছি।’

- Advertisement -

-‘শত যুগ অপেক্ষা করতে হবে না আপনাকে। আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমা চান। আল্লাহ বলেছেন তার বান্দা তার কাছে চোখের জল ফেলে ক্ষমা চাইলে তিনি কাউকে ফিরিয়ে দেন না। খারাপ মানুষদেরও ক্ষমা করে দেন। আমার জন্য আপনি ক্ষমা চাইতে পারবেন না?’
জবাব না দিয়ে হাসল শায়ের। সে তার পরীজান কে পাওয়ার উপায় পেয়ে গেছে। এখন সে আর পিছু ফিরে তাকাবে না। শায়ের ভেবে নিয়েছে সে আর নূরনগর কিছুতেই ফিরে যাবে না। সেখানে পরীর জীবন সংকট রয়েছে। বাকি জীবনটুকু সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকবে।

শায়ের তার এক বন্ধুর কাছে কাজের উদ্দেশ্যে গেছে। আর নাঈম বাসায় রয়েছে। সে জানে শায়ের তাকে কিছুই বলবে নাহ। তাই নাঈম পরীকেই সব জিজ্ঞেস করবে। দ্বিধাবোধ হলেও পরীর ঘরের দরজার কড়া নাড়ে নাঈম,’আমি কি আসতে পারি?’
অপ্রস্তুত ছিল পরী। ওড়া দ্বারা মুখ মণ্ডল ঢেকে প্রস্তুত হয়ে নাঈম কে ভেতরে আসতে দিল সে। নাঈম চেয়ার টেনে বেশ দূরত্বে বসে। পরীকে বলে,’এখন কেমন লাগছে আপনার? খুব বেশি খারাপ লাগলে বলবেন।’
-‘আমি ঠিক আছি। একটুও খারাপ লাগছে না আমার।’
-‘আপনার এরকম অবস্থা হল কি করে? কোন মিথ্যা আমি শুনতে চাই না। আশা করি সত্য টাই বলবেন।’

-‘আমি নিজ হাতে তিনটা খু*ন করেছি ডাক্তারবাবু। আরও দুটো খু*ন আমি করব। ওদেরকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না। সব বলব আপনাকে। তার আগে আপনি বলুন আপনি জেল থেকে ছাড়ার পেলেন কীভাবে?’
কিছুক্ষণের জন্য বাক শক্তি লোপ পেল নাঈমের। পরীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। তিনটা খু*ন
করেছে পরী! আর তা এত স্থির ভাবে বলছে যেন হ*ত্যা করা পুতুল খেলার মত! নাঈম কে চুপ থাকতে দেখে পরী বলে,’আমি সব বলব তার আগে আপনি বলুন আপনি কীভাবে ছাড়া পেলেন?’
-‘আমাকে শেখর ছাড়িয়ে ছিল। পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর শেখর আমার সাথে দেখা করতে যায়। আমি ওকে সব বুঝিয়ে বলি। বন্ধু তো,বিশ্বাস আমাকে করতেই হবে ওকে। শেখর ই সব বলে আমাকে ছাড়ায়।’

-‘তাহলে সে যখন আমাদের গ্রামে গেল তখন আপনার নাম বলল কেন?’
-‘এরপর বোধহয় সেখান থেকে এসে ও আমার সাথে দেখা করে।’
-‘ভুল শেখর সেদিন জীবিত ফেরেনি নূরনগর থেকে।
তার মানে শেখর আগেই আপনাকে ছাড়িয়েছে। সত্যি বলুন।’
-‘আপনি কীভাবে জানলেন শেখর মা*রা গেছে?’

- Advertisement -

-‘তাকে হ*ত্যা করা হয়েছে।’
নাঈম আরও চমকালো,’কি বলছেন আপনি এসব? শেখর তো এক্সিডেন্ট করে মা*রা গেছে।’

-‘ভুল! আপনার কথা শুনে এটা বুঝলাম যে শেখর আগেই জানত আপনি নির্দোষ তবুও সে নূরনগর গিয়ে মিথ্যা বলেছিল। কারণ টা হলো সে আগেই আন্দাজ করেছিল যে আমার আব্বাই কিছু করেছে। কিন্ত তাতেও কোন লাভ হলো না।’

-‘শেখর কে আপনার বাবা হ*ত্যা করেছিল! কিন্ত কেন?’
-‘জমিদার বাড়ি সম্পর্কে আপনি কতটুকু সত্য জানেন? যা দেখেছেন তা আপনার চোখের ভ্রম মাত্র। আপনি কি জানেন পালক কেও হত্যা করা হয়েছে!’

নাঈম এবার অস্থির হয়ে গেল। পরীর মাথা ঠিক আছে তো? শেখর কে হ*ত্যা করা হয়েছে এটা মানা যায় কিন্ত পালককে হ*ত্যা!! এটা সে মানতে পারছে না। কৌতুহল হয়ে পরীর ঢেকে রাখা মুখের পানে তাকিয়ে রইল সে। পরী এখনও স্থির হয়ে বসে আছে।
তবে পরী শায়েরের কথাটা গোপন রেখেছে। পালক আর শেখর কে যে শায়ের মে*রেছে সেটা জানতে পারলে নাঈম চুপ করে বসে থাকবে না তাই পরী সেসব তথ্য গোপন রেখেছে।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কথাই নাঈম কে পরী বলে দিল। ওর জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার স্বাক্ষী হিসেবে সে নাঈম কে রাখতে চায়। তাই সব সত্য একমাত্র নাঈম কে জানিয়ে দিল পরী। সব শুনে নাঈম বলল,’শায়ের আপনাকে অনেক ভালোবাসে তাই না?’

- Advertisement -

-‘তার ভালোবাসার গভীরতা আজও আমি মাপতে পারিনি।’
-‘আমি আপনাদের সাথে থাকব সবসময়। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারেন।’
-‘আমার একটা কথা রাখবেন?’
-‘বলুন।’
-‘আমার সন্তান কে আমি আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। আমার কাজ শেষ হওয়ার পর আমি ফিরে আসব। ততদিন আপনি ওকে মানুষ করবেন।’
-‘শায়ের কি আপনাকে আবার নূরনগর যেতে দিবে? আমার মনে হয় না?’

-‘আমার সোনা আপা আর বিন্দুর হ*ত্যা*কারীদের শাস্তি আমি দেবোই। ওরা শুধু মানুষ হ*ত্যা করেনি হ*ত্যা করেছে আমার সুন্দর জীবন,আমার আম্মার মন। তাহলে ওদের ছাড়ি কীভাবে?’

-‘পুলিশ কে সব বলি আমি? আইন ওদের শা*স্তি দেবে।’
-‘তাতে আমার মন ভরবে না। আপনি সাহায্য না করলে কোন সমস্যা নেই। আমি অন্য পথ খুঁজে নেব।’
নাঈম ওখানে আর বসল না। বাইরে বের হয়ে এলো।
অবিশ্বাস্য লাগছে ওর কাছে সব!! তাহলে তো খুবই খারাপ লোক পরীর বাবা। কিন্ত পরীকে একবার যখন নূরনগর থেকে এখানে আনা হয়েছে তাই পরীকে আটকে রাখতে হবে। নাহলে বিপদ শুধু পরীর নয়। রুপালি,পিকুল আর জুম্মানের ও ঘোর বিপদ।
নাঈম পায়চারি করছে। সে শায়েরের অপেক্ষা করছে। পরীর বিষয়ে কথা শায়েরের সাথে বলতে হবে। শায়েরের ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দরজা নাঈম ই খুলে দিল। শায়ের কে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস নিলো সে। শায়ের জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন?’

-‘কিছু বলার ছিল আপনাকে।’
-‘বলুন!!’
-‘পরীকে যথাসম্ভব আটকে রাখুন। ওকে নূরনগর যেতে দিয়েন না।’
-‘পরীজান আপনাকে সব বলেছে তাই না?’
নাঈম মাথা নিচু করে সায় দিল,’হুম বলেছে।’

- Advertisement -

-‘আমাদের এখন এসব বলার সময় নয়। আমি জানি পরীজান আপনাকে সমস্ত সত্য বলেনি। নাহলে এতক্ষণ আপনি স্বাভাবিক ভাবে আমার সাথে কথা বলতেন না। এসব ব্যাপারে পরে কথা বলব।’

শায়েরের কথায় নাঈম ও সায় দিল। শায়ের চলে গেল নিজ ঘরে। পরী তখন ঘুমাচ্ছিল। বেশ দূর্বল এখন পরীর শরীর। তার উপর এখন বমি হয়। তবে খুব বেশি বমি হয় না। অসুস্থ শরীরে সামান্য বমি হতেই পরী আরও দূর্বল হয়ে পড়ে। তাই শায়ের চায় পরীকে একটু বেশি সময় দিতে। পরীকে ঘুমাতে দেখে শায়ের নিঃশব্দে পরীর পাশে গিয়ে বসে। হাত,পা, গলার ক্ষতগুলো কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। ফর্সা শরীরে চন্দ্রকলঙ্কের ন্যায় ফুটে উঠেছে দাগ গুলো। শায়ের হাত বুলায় পরীর গলায়।

-‘আমি ভাগ্যবান আপনাকে পেয়ে। আপনার ভালোবাসা পেয়ে।’

-‘আপনি ভালোবাসেন বলেই আমি ভাগ্যবতী।’
পরী জেগে গেছে। পূর্ণ দৃষ্টিতে সে শায়েরের দিকে তাকিয়ে আছে,’আপনি যদি ভাল কাজ করতেন তাহলে আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতো।’

- Advertisement -

পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল শায়ের,’এরপর থেকে আমাদের জীবন সুন্দর করে গড়ার চেষ্টা করব। আপনি শুধু কথা দিন,নূরনগরে যাওয়ার চেষ্টা কখনোই করবেন না?’

কিছুক্ষণ শায়েরের দিকে চেয়ে থাকে পরী। তবে জবাব টা সে দিল না। পরীকে খাবার খাইয়ে দিলো শায়ের। গর্ভবতী থাকায় ওষুধ খেতে পারবে না পরী। যে ওষুধ গুলো খেতে পারবে সেগুলোই খেলো সে। এজন্য সেরে উঠতে বেশ দেরি হচ্ছে। তবে শায়েরের ধৈর্য দেখে নাঈম বিষ্মিত। ইশশ সে যদি এভাবে কাউকে ভালোবাসতে পারত কতই না ভাল হতো! প্রতিনিয়ত সে পরী আর শায়েরের ভালোবাসার সম্মুখীন হয়। নাঈমের তখন মনে হয় শায়েরের জন্যই বুঝি পরীর জন্ম। ভালোবাসতে অট্টলিকার প্রয়োজন হয়না তার প্রমাণ একমাত্র শায়ের। বাইরের দিক সামলে কীভাবে পরীকে সময় দেওয়া যায় সেটাই সবসময় শায়ের ভেবে চলে।
পাঁচমাস পার হয়ে গেছে। তবুও শায়ের একটুও ধৈর্যহীন হয়ে পড়েনি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে পরীকে সুস্থ করার। শায়েরের প্রতিটি মোনাজাতে কেবল পরী ছিল। আল্লাহ বোধহয় ওর কথা শুনেছে। আগের থেকে অনেক সুস্থ পরী। মুখের পোড়া চামড়া উঠে গেছে সব। কিন্ত ওর চেহারায় আগের মত মাধুর্য নেই। শায়ের বিনা আর কেউ বোধহয় কেউ পরীর দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকাবে না।

তবে এতদিনে পরীকে নূরনগরের কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল। প্রথম কয়েকদিন পরী শায়ের কে মালা, রুপালি,জুম্মানের কথা জিজ্ঞেস করলেও এখন আর করে না। নিজের শরীর আর অনাগত সন্তানের কথা ভেবেই দিন পার করেছে সে। কিন্ত এতদিন পর একটা চিঠিই পরীকে অস্থির করে তুলল। চিঠিটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল পরী।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।