পরিজান

“আব্বা যেদিন দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে ফিরল তখন আমার বয়স দশ বছর। রুপার বয়স ছিল পাঁচ বছর আর পরীর বয়স মাত্র দেড় বছর। ছোট্ট পরীকে বুকে নিয়ে আম্মা সেদিন নিরবে চোখের জল ফেলেছিলেন। মুখে টু শব্দটি করেননি প্রতিবাদ তো দূরের কথা। আর আমি সেদিন দরজার আড়াল থেকে আব্বার দ্বিতীয় বউয়ের মুখ দেখেছিলাম। আব্বার দ্বিতীয় বউ আমার আম্মার নখের যোগ্য ও না। কালো একটা মহিলাকে বিয়ে করেছেন আব্বা। যেখানে আমার আম্মা তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি সুন্দরী। তারপরও আব্বা ওই মহিলাকেই বিয়ে করেছিলেন। কারণ একটাই,আব্বার একটা পুত্র সন্তান চাই। নাহলে তার এতো সব সম্পত্তি কে দেখবে? তার জমিদারি কে সামলাবে? যেদিন পরীর জন্ম হলো সেদিন আব্বা বাড়িতে ফেরেনি কিন্তু তার কাছে ঠিকই খবর পৌঁছেছিল যে তার মেয়ে হয়েছে সেজন্যই আব্বা রাগ করে বাড়িতে আসেনি। তার ঠিক দু’দিন পর আব্বা বাড়িতে এসেছিল কিন্তু কারো সাথে কোন কথা বলেনি। পরপর তিনটা মেয়ে জন্ম দেওয়ার জন্য আম্মাকে অনেক কথা শোনায় দাদি। আম্মা নাকি ছেলে জন্ম দিতে পারবে না। তার সাথে আরো একটি কথা দাদি বলেছিল তা হলো,’যেই মাইয়ার রূপ বেশি,হেয় পোলা পয়দা করতে পারে না কোনদিন।’ এই কথাটা শুনে সেদিন আমার অনেক কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু আম্মা কিছুই বলেনি চুপচাপ নিজের কাজ করছিল। পরীকে কোলে রাখতো রুপা আর আমি স্কুল থেকে ফিরে এসে পরীকে কোলে নিতাম। ও যখন ছোট ছোট হাত পা গুলো নাড়াতো তখন আমার খুব ভালো লাগতো। আম্মা বলে আমার আর রুপার থেকেও পরী বেশি সুন্দর। গালে একটু ছোঁয়া পড়তেই ওর গাল দুটো লাল হয়ে যেতো মনে হতো রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। সেই ভয়ে পরীকে বেশি কোলে নিতাম না। পাছে যদি ব্যথা পায়!! কিন্তু রুপা ছোট্ট পরীকে কোলে নেওয়ার জন্য সবসময় আঁকুপাঁকু করতো। পরীকে কোলে নিয়ে বারান্দার দাওয়ায় বসে বৃষ্টি দেখতো। আর আমি তার পাশে মোড়া পেতে বই নিয়ে বসে থাকতাম। পরীর যখন ছোট ছোট পা ফেলে হাটতো তখন দেখতে বেশ লাগতো ঠিক মোমের পুতুলের মতো।
আমাদের দ্বিতীয় আম্মাকে দেখে আমি মুখ ফিরিয়ে নেই কিন্তু রুপা আর পরী তো বোঝে না। ছোট তো,ওরা দুজনেই ওই মহিলার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। পরীকে যখন উনি কোলে নিতো আমিই দৌড়ে গিয়ে ওনার কোল থেকে ছিনিয়ে আনতাম পরীকে। কিছু না বললেও মনে মনে কষ্ট পেতেন উনি। এতে আমি খুব খুশি হতাম। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি যখন ওই মহিলার ও একটা মেয়ে হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ওনার মেয়েটা মারা যায়। এরপর আরো একটি মেয়ে জন্ম দেন কিন্তু সেটাও মারা যায়, তারপর যখন,,,,”

আর পড়তে পারলো না পরী তার আগেই ডাক পরলো আবেরজান বেগমের। সাথে সাথে বিষাদের ছায়া নেমে এলো পরীর মুখে। সবেমাত্র খাতাটা খুলে পড়তে বসেছিল সে। একটু পড়তে না পড়তেই ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে। চোখ মুখ কুঁচকে সে পড়ার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালো। শব্দ করে ঠেলে চেয়ার টা কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়ে দিলো। সিমেন্টের মলাটে আবরিত খাতাটা বন্ধ করে সযত্নে বইয়ের ভাঁজে রেখে দিয়ে ছুটলো দাদির ঘরে।
সেখানে যেতেই চোখ গেল পালঙ্কের উপর বসে থাকা আবেরজান বেগমের দিকে। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছেন তিনি।পরী বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল। পালঙ্কের হাতল ধরে জোর গলায় বলে উঠলো,’কি হইছে?’
আবেরজান ঘাড় ঘুরিয়ে পরীর দিকে তাকালো তারপর বললেন,’মাইয়া মানুষ এতো ধুপধাপ শব্দ করে হাটোস ক্যান?আস্তে হাঁটতে পারস না?’
দাদির জ্ঞানমূলক কথাবার্তা কোনকালেই পছন্দ নয় পরীর। যখনই সামনে আসবে তখনই একটা না একটা জ্ঞানের সহিত কথা বলবেই। পরী দাদির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,’তুমি কি কইবা তাড়াতাড়ি কও আমার মেলা কাম আছে!!’
আবেরজান হাতের ইশারায় নিজের পানদানি দেখিয়ে বললেন,’একখান পান দে।’
আগের ন্যায় ধুপধাপ পা ফেলে জলচৌকির দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে পান বানিয়ে এনে দাদির হাতে দিতেই তিনি পানটা মুখে পুরে নিলেন। পরী কৌটা থেকে কিছুটা চুন দাদির তর্জনী আঙ্গুল মেখে দিয়ে কৌটাটা আগের স্থানে রেখে দিল। বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আবার ফিরে তাকালো দাদির পানে। সেই লেখা গুলোর কথা মনে পড়ে গেল ওর। পরী এগিয়ে গেল দাদির কাছে। তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো,দাদির গায়ের রং বেশ চাপা কিন্তু অতোটা কালো নয়। হাত পা ও মুখের চামড়া ঝুলে গিয়েছে। বয়স হয়েছে তো!পরী হুট করেই বলে উঠলো,’যেই মাইয়ার রুপ বেশি,হেয় পোলা পয়দা করতে পারে না তাই না দাদি?’

পরীর কথা শুনে চমকে তাকালো আবেরজান বেগম। এই কথা পরী শুনলো কোথা থেকে?দাদিকে বলতে না দিয়ে পরী আবার বলে, ‘তোমার তো রুপ নাই। তাই তো দুইটা পোলা পয়দা করছো। কিন্তু একটারেও তো মানুষ করতে পারো নাই। দুইটা অমানুষ পয়দা করছো। বুড়ি কোহানকার, আমার আম্মাজান তিনটা সোনা জন্ম দিছে আর তুমি কি করছো?এক পোলায় দুইডা বিয়া করছে আরেক পোলার বিয়ার খবর নাই। পরের মাইয়া দেইখা দেইখা দিন পার করে।’

কথাগুলো বলে পরী একদন্ড দেরি না করে দৌড়ে বাইরে চলে গেল। আবেরজান বেগমকে কিছু বলতেই দিলো না। নিজের নাতনির উপর ক্ষুব্ধ হলেন আবেরজান। মেয়েটা বেশ চটপটে,আর উড়নচন্ডি স্বভাবের। মুখের বুলিতে সবসময় তেজ মিশ্রিত থাকে যা ওনার আর দুই নাতনি দের মধ্যে কোন ক্ষণেই দেখেননি। পরীর এরকম কথা শুনতে তিনি অভ্যস্ত তাই বেশি না ভেবে তিনি পান খাওয়ায় মন দিলেন।
দাদির ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে নিজের শয়নকক্ষের দিকে পা বাড়াতেই আবার ডাক পড়লো। এবারের ডাকটা দিয়েছেন পরীর মা মালা বেগম। মায়ের ডাক শুনে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হলো পরীর। সোনালী আপুর খাতাটা আজকে বোধহয় আর পড়া হবে না। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার টেবিলের দিকে তাকালো সে। বইয়ের সাজানো স্তুপের মধ্যে আসামির ন্যায় পড়ে আছে খাতাটা। হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন পরীকে কিন্তু সময়ের অভাবে পরী আসতে পারছে না। অসহায় নয়নে শুধু খাতাটা দেখতে লাগল সে। এরমধ্যে দ্বিতীয় বারের মতো ডেকে উঠল মালা। পরী দৌড় লাগালো। পরনের ঘাগড়া টা দুহাতে হালকা উঁচু করে ধরে সিঁড়ি ভেঙে নেমে দৌড় দিল রন্ধনশালার দিকে। সেখানে বসেই ডাকছিলেন মালা। পরী ওখানে গিয়ে দাড়াতেই জেসমিনের দিকে চোখ পড়লো সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিল। বড় একটা গামলায় কুঁচো চিংড়ি বোঝাই করা। সেগুলো বাছাই করছে দুজনে মিলে। মালা পরীকে খেয়াল করেনি,তিনি চিংড়ির হাত পা খোসা ছাড়াচ্ছেন আর কাশছেন। পরী দু’পা ভাঁজ করে মায়ের পাশে বসে হাত ধরে বলল, ‘আম্মাজান আপনে অসুখ নিয়া কাম করতে আইছেন ক্যান। পানি ধরলে তো আপনার কাশি আরো বাড়বে।’
কথাটা শেষ করে পরী গরম চাহনিতে একবার জেসমিনের দিকে তাকালো তারপর আবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’ঘরের কেউ কি দেহে না যে আম্মার অসুখ?? তারপরেও আম্মারে কামে ডাকে কোন সাহসে? আমার আম্মার কিছু হইলে আমি কিন্তু কাউরে ছাইড়া দিমু না কইয়া দিলাম।’

জেসমিন এবার মুখ খুলল,’আমি আপারে মানা করছিলাম পরী কিন্তু সে শোনে নাই।’

পরী আবারো রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘হইছে আপনারে আর অজুহাত দিতে হইবো না। যা করার,,,’
পরবর্তী শব্দ উচ্চারণ করার আগেই মালা কষে চড় মারেন পরীর গালে। এতে পরীর কোন ভাবান্তর হলো না। প্রতিদিন দুচারটে চড় না খেলে তার পেটের ভাত হজম হয় না তাও মায়ের হাতের। মুখে আঁচল দিয়ে কাঁশতে কাঁশতে মালা বলল,’কতবার কইছি মুখে মুখে তর্ক করবি না। তোর ছোট আম্মা হয়।’

পরী মাথা নিচু করে নিলো তবে রাগ ওর মধ্যে এখনও বিদ্যমান। মাথা নিচু করেই সে বলে, ‘ছোট আম্মা কিন্তু আম্মা না।’
মালা ফের কিছু বলতে উদ্যত হলে জেসমিন থামিয়ে দিয়ে বলল,’থাক আপা পরীরে কিছু বইলেন না ছোট মানুষ।’ এরপর পরীর দিকে তাকিয়ে বলল,’পরী তুমি জুম্মানরে নিয়া শাপলা বিলে যাও। ঘরে একটা মানুষ ও নাই তাই তোমারে বলতাছি, কতগুলো শাপলা নিয়া আসো। চিংড়ি দিয়া রান্না হইবো। আজকে ঘরে মেহমান আসবে।’

কপালে দৃঢ় ভাঁজ পড়লো পরীর। অবাক করা কন্ঠে বলে,’এই বন্যার ভিতরে মেহমান আইবে কই থাইকা?’
পরমুহূর্তে কিছু ভেবেই পরীর মুখে হাসি ফুটে উঠল,’রুপা আপা আইবো??’
মালা দিলেন এক ধমক,’এতো কথা কস ক্যান তাড়াতাড়ি যা। আর শোন মুখটা ভালো করে ঢাইকা যাবি কেউ যানি না দেখে। নৌকার ছইয়ের মধ্যি থাইকা বাইর হবি না। জুম্মানরে নিয়া এহন যা। তোর বাপে আর তার লোকজন থাকলে তোরে পাঠাইতাম না। এমন সময়ডাতে বাড়ি খালি।’
মৃদু রাগ দেখা গেল মালার মুখে। কিন্তু পরী বেজায় খুশি আজকে অনেক দিন পর বাইরে বের হবে সে। দৌড়ে নিজের কক্ষে চলে গেল। ওড়না দিয়ে নিজের মুখ ভালো করে বেঁধে নিলো। শুধু চোখদুটো খোলা রাখলো। দাদির ঘরে পেরিয়ে আসার সময় উঁকি দিলো পরী। আবেরজান আয়েশ করে বসে বসে সুপারি কাটছে। পরী হাঁক ছাড়লো,’ও বুড়ি!!’
সুপারি কাঁটা রেখে পরীর দিকে তাকালেন তিনি। পরীকে এই সাজে দেখে তিনি বুঝে ফেললেন যে আজকে পরী ঘরের বাইরে বের হবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,’কই যাস?’

পরী ভেংচি কেটে বলল,’তা দিয়া তোমার কাম নাই। আমি এহন যাই, আসমান থাইকা যদি তোমার স্বোয়ামি ডাক দেয় তাইলে ভুলেও যাইও না কিন্তু। দ্যাশ বন্যার পানিতে ভাইসা গেছে তোমারে কবর দেওয়ার যায়গা পামু কই?’
পরী খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলে গেল। আবারও রাগ হলো আবেরজানের। তার ভাষ্যমতে মেয়েদের জোরে হাসতে নেই কাশতে নেই এমনকি কাঁদতেও নেই। মেয়ে মানুষ থাকবে মোমের মতো। আগুনের স্পর্শ পেলে নিরবে গলে যাবে। জ্বলবে পুড়বে ছাই হবে তবে মুখ থেকে শব্দ বের হবে না। কিন্তু পরীর স্বভাব তার ধারণার বাইরে। তাই তিনি ঠিক করলেন আজকে মালাকে বলে এই মেয়ের একটা ব্যবস্থা করবেই করবে।

গ্রামের নাম নূরনগর। পদ্মানদীর ধার ঘেঁষেই এই গ্রামের অবস্থান। পদ্মা যেন নূরনগরে নূরের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিটি ঋতুতে এই গ্রাম নানান বাহারে সজ্জিত হয়ে উঠে। কখনো গরমে উওপ্ত পথিকের আর্তনাদ, কখনো বর্ষার মেঘমালা থেকে সৃষ্টি বারিধারা, স্বচ্ছ নীলাম্বরে মেঘের ভেলা,ঘাসে জমে থাকা শিশির কণার রূপবত্তা তো কোকিলের মধুর কন্ঠ। সব মিলিয়ে গ্রামের এই সৌন্দর্য সবার মন কাড়ে। কিন্তু এখন আর এই গ্রামে সেই সৌন্দর্য নেই। পাঁচদিন ধরে এই রূপবান গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। টানা বর্ষণের ফলে পদ্মা উপচে জলস্রোত দ্রুত তলিয়ে দিয়ে গেছে এই গ্রামের সাথে সাথে আরো অনেক গ্রাম। গরিব অসহায় মানুষেরা আশ্রয় নিয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। কেউ কেউ নৌকা নিয়ে ভাসছে কিংবা কলা গাছের ভেলায়। দুর্ভিক্ষ নামিয়ে দিয়েছে সারাদেশে এই প্রলয়ংকারী সর্বনাশা বন্যা। ঠিক এইরকম বন্যা হয়েছিল আজ থেকে দশ বছর আগে ১৯৮৮ সালে। আর এখন ১৯৯৮ চলছে। এতগুলো বছর পর আবার সেই বন্যার মুখোমুখি সবাই। কেউই জানে না এই বন্যা কতদিন থাকবে? কতদিন মানুষ না খেয়ে অসহায় হয়ে পড়ে থাকবে? তারা কি বাঁচবে নাকি অসুখে অনাহারে অকালে প্রাণ হারাবে?

নৌকার ছইয়ের ভেতরে বসে আছে পরী। দুপাশে পর্দা টেনে দিয়েছে। এটা মায়ের কড়া হুকুম। আর জুম্মান নৌকা বাইছে। পরী ছইয়ের ভেতরে থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো,’হ্যা রে জুম্মান আজকে নাকি মেহমান আইবো?কারা আইবো জানস?’

বৈইঠা হাতে নৌকা ঘুরাতে ঘুরাতে জুম্মান জবাব দিলো,’শহর থাইকা ডাক্তার আইবো আপা। বন্যার পানিতে ভিজে অনেকের অসুখ হইছে। হের লাইগা আব্বা শহর থাইকা ডাক্তার আনতাছে। তারাই আইবো।’

‘তোরে কইছে কেডা??’

জুম্মান অকপটে স্বীকার করে বলে,’বড় আম্মায় কইছে?’
পরী আর জবাব দিলো না। শাপলা বিলে নৌকা আসতেই পরীর মনটা খুশিতে নেচে উঠল। যদিও শাপলা বিল আর আগের মতো নেই। পানিতে ভরে টুইটম্বুর,কোনটা বিল আর কোনটা ক্ষেত বোঝা মুশকিল। সুতো কাটা ঘুড়ির মতো নিজেকে এখন মুক্ত মনে হচ্ছে পরীর। আজকে তো সে বিলের পানিতে সাঁতার কাটবে তাতে মা বকলে বকুক মারলে মারুক। কিন্তু তখনই বিপত্তি ঘটে গেল। পরীর ইচ্ছা ইচ্ছাই রয়ে গেল জুম্মানের কথায়,’আপা আমাগো আরেক খান নৌকা আইতাছে এইদিকে।’

কৌতূহল হয়ে পরী প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,’নৌকায় কেডা দেখ তো?’
জুম্মান দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখে বলল, ‘লতিফ কাকা আর দেলোয়ার কাকা আর লগে মাঝি।’
সাথে সাথে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল পরীর। এটা নিশ্চয়ই ওর মায়ের কাজ। কাজের লোকগুলো বাড়িতে আসতেই পাঠিয়ে দিয়েছে। পরীর আর ভালো লাগে না এইরকম খাঁচায় বন্দী পাখি হয়ে থাকতে। একা খোলা আকাশে মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াতে চায় সে। কিন্তু ওর মায়ের জন্য তা আদৌও কখনো সম্ভব হবে কি? কথায় কথায় কসম দিয়ে পরীকে চুপ করিয়ে দেয় তিনি। পরী জড়োসড়ো হয়ে বসেই রইলো ছইয়ের ভেতরে।

_________

সম্পান মাঝি দাঁড় বাইছে সাথে আরো দুজন মাঝিও আছে। বিশালাকৃতির নৌকা খানি টেনে নেওয়া একটুখানি কথা না। তিন চারজন মাঝি তো লাগবেই। ঘাম ছুটে গেছে সবার। হঠাৎ করেই কেউ ডেকে উঠলো,’ও সম্পান মাঝি ওইদিকে কই যাও?খাড়াও দেহি একটুখানি।’
সম্পান বাঁশের সাহায্যে নৌকা থামিয়ে দিলো তৎক্ষণাৎ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নৌকা থেকে বিন্দু বের হয়ে এলো। পরনে অর্ধ নোংরা শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে দিয়ে শুধালো, ‘ওই দিকে কই যাও??’

সম্পান নৌকার ধার ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো বলল,’জমিদার বাড়ি যাই রে বিন্দু। ডাক্তার আনছি শহর থাইকা। হেগোরে দিতেই যাইতাছি।’
বিন্দু উঁকি দিলো নৌকার ছইয়ের ভেতর তারপর বলল,’ওইদিক দিয়া যাইও না মাঝি। সখারে দিয়া আমারে খবর দিলো পরীবানু আইজ শাপলা বিলে আইছে। ওর লগে দুই খাটাইশ ও আইছে। গেলে ভালা হইবো না।’

সম্পানের মুখে চিন্তার ছাপ দেখা দিলো। সে আড়ষ্ঠ কন্ঠে বলল,’কস কি?পরী আহার সময় পাইলো না। অন্যদিক দিয়া গেলে অনেক ঘুরা পড়বো। আমাগো তো জলদি যাইতে হইবো। এহন কি করি?’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সম্পান আবার বলে উঠলো,’তুই লগে আয় বিন্দু তাইলে আমাগো কিছু কইবে না। তুই পরীরে কইলেই পরী শুনবো।’
বিন্দু মৃদু রাগ নিয়ে বলল,’হ খালি তো আমারেই পাও। পরী খবর দিছে তাও যাইতে পারলাম না। চুলায় শাক চড়াইছি। রান্ধা শ্যাষ না হইলে যাইতাম না।’

সম্পান অপেক্ষা করলো বিন্দুর রান্না শেষ হওয়া অবধি। অগত্যা যেতেই হলো বিন্দুকে। এবার বোধহয় পরী তাকে বিলের পানিতে চুবাবে। বিন্দু নৌকায় বসতেই মাঝিরা নৌকা ছাড়লো। নৌকায় বসা সবাই এতক্ষণ বিন্দু ও সম্পানের কথা শুনছিল। কিন্তু কথাগুলো সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারেনি কেউ। তাই একটি মেয়ে কৌতুহল হয়ে জিজ্ঞেস করেই বসে,’পরী কে??’
বিন্দু ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো,’আমাগো গেরামের জমিদারের ছোড মাইয়া।’

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.