পরিজান

নিজের পায়ের দিকে তাকাতেই চোখ জলে ভরে ওঠে পরীর। আরেকটা নূপুর গেল কোথায়?কখন খুলে পড়ে গেছে তা টেরই পায়নি পরী। নূপুর জোড়া যে সোনালীর। যাওয়ার আগে পরীকে দিয়ে গেছে। কিন্ত পরী তার মূল্য দিতে পারেনি। হারিয়ে ফেলল সেটা!!চোখ মুছে পরী মেঝেতে বসে পড়ল। সোনালীর এই একটা স্মৃতিই পরীর কাছে ছিল। কিন্ত তার প্রতি হেয়ালিপনা কিভাবে করতে পারলো পরী?মনটা খারাপ করে ওখানেই বসে রইল সে। কুসুম কাছে এসে বলে,’কি হইছে আপা?নূপুর খানা পড়লো কই?’

-‘জানি না কুসুম। আমি এখন কোথায় খুজবো??’
জুম্মান পরীর পাশে বসে বলল,’তুমি চিন্তা কইরো না আপা। তুমি তো অন্দর ছাড়া কোন খানে যাও না। পুরা অন্দর খুঁজলেই পাওয়া যাইবো।’

পরী ভেবে দেখলো কথাটা ঠিকই বলেছে জুম্মান। কিন্ত সে তো বৈঠক ঘরেও গিয়েছিল। তাই পরী বলল,’তুই আর কুসুম বৈঠকে গিয়ে খোঁজ। আমি অন্দরে দেখতাছি।’

কুসুম আর জুম্মান তাই করে। বৈঠক ঘরের আনাচে কানাচে খুঁজতে লাগলো দুজনে। শায়ের নিজের ঘর থেকে বের হয়ে দেখলো ওরা উকিঝুকি দিচ্ছে। শায়ের কিছু বলতে চাইলো কিন্ত পারলো না। নওশাদ ভেজা কাপড়ে এসেছে। কুসুম কে দেখে ওর রাগ হলো। সে রাগন্বিত কন্ঠে বলল,’এই মেয়ে তুমি আবার এসেছো!!আমার গায়ে গোবর,পানি দিয়ে মন ভরেনি তোমার?’
জুম্মান নওশাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,’আরে ভাই পরী আপার এক পায়ের নূপুর হারাইয়া গেছে। তাই খুঁজতে আইছি।’
-‘পরীর নূপুর এইদিকে পড়েছে?কই দেখি।’
নওশাদ এগিয়ে নিজেও খুজতে লাগল। কুসুম জুম্মান কে চোখ মেরে বলল,’পরী আপার কত শখের নূপুর টা। যে পাইয়া দিব তারে পরী আপা মনে হয় পুরস্কার দিবো। চল জুম্মান ভাল কইরা খুঁজি।’

পরীর মন পাওয়ার লোভে নওশাদ বলল,’তোমরা যাও পরীর নূপুর আমি খুঁজে দিব।’
-‘দেইখেন কিন্ত হবু দুলাভাই। তাইলে পরী আপা আপনের উপর খুব খুশি হইবো।’

নওশাদের পাগলামো দেখে শায়ের হেসেই যাচ্ছে। কি নাকানি চুবানি দিচ্ছে ওরা। হঠাৎই শায়েরের খেয়াল হলো সকাল থেকে সে একটু বেশিই হাসছে। আগে তো হাসতোই না। হলো কি ওর?এসব ভাবতে ভাবতে শায়ের নিজ গন্তব্যে চলে গেল।
শায়ের যখন ফিরল তখন বেলা সাড়ে দশটার বেশি বাজে। এসে দেখলো নওশাদ এখনও সেই হারানো নূপুর খুঁজে যাচ্ছে। শায়ের হাসি চেপে এগিয়ে গিয়ে বলল,’আপনি এখনও সেই নূপুর খুঁজে যাচ্ছেন?’

-‘কি করবো বলুন পরীর নূপুর বলে কথা।’
-‘আচ্ছা আপনি কি ছোট কন্যাকে কখনো এখানে আসতে দেখেছেন?’
-‘না তো।’
-‘তাহলে তার নূপুর এখানে আসবে কিভাবে?’
বোকা বনে গেল নওশাদ। তাই তো!!পরী তো কখনোই বৈঠক ঘরে আসেনা তাহলে নূপুর আসবে কোথা থেকে? তাহলে কি ওই কুসুম ওকে বোকা বানালো? রাগে গজ গজ করতে করতে নওশাদ নিজের ঘরে চলে গেল। শায়ের মুচকি হেসে নিজের ঘরে চলে গেলো।

হতাশ হয়ে নিজের ঘরে বসে আছে পরী। খালি পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সারা অন্দর খুঁজেও নূপুর টা পাওয়া গেল না। তারপর থেকেই পরীর মনটা একটু বেশিই খারাপ। পালঙ্ক থেকে উঠে গিয়ে সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। একঝাক মুক্ত বাতাস এসে ছুঁয়ে দিলো পরীকে। চোখদুটো বন্ধ করে ফেলে পরী। চোখের সামনে ভেসে উঠল সোনালীর হাস্যজ্বল মুখটা। দেখতে বড়ই ভালো লাগছে পরীর। মনে হচ্ছে সোনালী ওর কাছেই আছে। কিন্ত এই ভালোলাগার স্থায়ীত্ব বেশিক্ষণ হলো না। দরজার ক্যাচ ক্যাচ শব্দে ফিরে তাকালো সে। রুপালি এসেছে,সে পরীর কাছে এসে দাঁড়াল। শান্ত গলায় বলল,’রাগ করে আছিস আমার উপর?’
পরী মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,’নাহ।’

-‘পরী আমি সিরাজ কে ভালোবেসেছি আর বড় আপা রাখালকে। বড় আপার ভাগ্যে তার ভালোবাসা থাকলেও আমার ভাগ্যে নেই। কষ্ট হলেও আমি মানিয়ে নিচ্ছি পরী। তুই কেন পারবি না?তুই তো কাউকে ভালোবাসিস না। তোর তো কোন কষ্ট হবে না পরী। আমার মতো তো অতীতের স্মৃতি নিয়ে তোকে বাঁচতে হবে না।’

-‘ভালোবাসার মানুষ কে যেমন ভোলা যায় না তেমনি ঘৃণা করা মানুষ কে ভালোবাসা যায় না।’

-‘এভাবে বলিস না পরী। নওশাদ কে আমি চিনি। ও খুবই ভাল ছেলে।’
-‘নিজের স্বামীকে এতোদিনে চিনতে পারলে না। আর তুমি চিনবে তোমার দেওরকে?হাসালে আপা তুমি।’

কথার জালে বারবার রুপালিকে পেঁচিয়ে ফেলছে পরী। আর কিছুই বলার নেই রুপালির। যা করার এখন নওশাদ কেই করতে হবে। পরীকে বোঝাতে হবে যে নওশাদ খুবই ভালো ছেলে। রুপালি আস্তে করে পরীর ঘর থেকে বের হয়ে এলো। পরী আবার জানালার ধারে গিয়ে আকাশ পানে তাকালো। আজ আকাশে মেঘ নেই ঝকঝকে রোদ উঠেছে। অথচ পরীর মনে রোদ নেই। মেঘে ঢাকা পড়েছে তার মনের সূর্যটা। পরী গোমড়া মুখে আকাশটাকে দেখে চলছে।

মালা মুখ কালো করে বসে আছে। পাশেই রুপালি বসে। মালা সায় দিচ্ছে না পরীর বিয়েতে। সে তো নওশাদ কে ভালোভাবে চেনে না। আর তাছাড়া নওশাদের পরিবার কেমন তাও জানে না। সোনালী তো চলেই গিয়েছে। রুপালি অনেক কষ্টে নিজের সুখ খুজে পেয়েছে। কিন্ত পরীর ব্যপারে মালা খুব সচেতন তাই মালার মনের ভেতর নাড়া দিচ্ছে ভয়। রুপালি বারবার মালাকে বুঝিয়েও মানাতে পারছে না।

জুম্মান ঘাটে গেল পানি কতটুকু কমেছে তা দেখার জন্য। লাঠিটা উঠিয়ে সে দেখলো অনেক পানি কমে গেছে। যাদের বাড়িঘর একটু উঁচুতে ছিল তাদের ঘর জেগেছে। দুএক পরিবার ঘর ঠিক করে সেখানে থাকছে। বন্যা এসেছে আজ ছাব্বিশ দিন চলছে। জুম্মান সব হিসেব করে রেখেছে। হিসেবের দিক দিয়ে জুম্মান খুবই সচেতন। সে লাঠিটা আবার পুঁতে দিলো। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো নওশাদ দাঁড়িয়ে আছে।
-‘মিথ্যে বললে কেন আমাকে?’

-‘কি মিথ্যা কইছি আমি?’
-‘পরীর নূপুর সত্যিই হারিয়েছে?’
-‘সত্যিই তো। আপা সকাল থেকে মন খারাপ কইরা বইসা আছে।’
সন্দিহান চোখে জুম্মানের দিকে তাকিয়ে নওশাদ বলল,’তোমার আপা তো বৈঠক ঘরে আসে না তাহলে নূপুর টা বৈঠক ঘরে আসবে কিভাবে?’

জুম্মান মাথা চুলকে বলল,’সেটাও তো কথা। তাইলে আপা বৈঠক ঘরে আমাগো খুঁজতে কইলো ক্যান?’

নওশাদ বুঝলো যে ছোট্ট জুম্মান কিছুই জানে না। ওই কুসুম মেয়ে টাই কিছু করেছে। আসার পর থেকে ওর পিছনে লেগেই আছে মেয়েটা। এদিকে কবির ও নেই। দুই শ্বশুরের সাথে কোথায় যেন গিয়েছে।
জুম্মান ছোট নৌকায় উঠতে উঠতে বলল,’যাই আবার কতগুলা শাপলা নিয়া আসি। দেখি আপার মন ভালো করতে পারি নাকি!!’

নওশাদ শুনেই বলে উঠল,’এই আমি যাব আমি যাব।’
বলতে বলতে এক প্রকার লাফিয়ে নৌকায় চড়ে বসে নওশাদ।’
দুজনে মিলে শাপলা বিলে আসলো। বিলে গিয়ে দেখলো ছেলেমেয়েরা গোসলে নেমেছে। পানি অনেক কমে গিয়েছে বিধায় ওদের যেন সুবিধা হয়েছে। একপাশে বিন্দুর ভেলা দেখা গেল। সেও শাপলা তুলতে এসেছে। জুম্মান কে দেখে সে ভেলা নিয়ে এগিয়ে এলো।
-‘আরে জুম্মান যে। তা কি মনে কইরা?আর এই বেডা কেডা?’
-‘মেজো আপার দেওর গো। হের লগে আমাগো পরী আপার বিয়া হইবো।’
বিন্দু পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবলোকন করলো নওশাদের। দেখতে ছেলেটা ভারি সুন্দর। শার্ট প্যান্ট পড়ায় আরো সুন্দর লাগছে। এই গ্রামে খুব কম যুবকরা শার্ট প্যান্ট পড়ে থাকে। টাকার অভাবে অনেকে কিনতে পারে না। লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরেই থাকে সারাদিন। সম্পানও লুঙ্গি পরে। বিন্দু ভাবলো ইশশ সম্পান যদি এই রকম শার্ট প্যান্ট পড়তো কতই না সুন্দর লাগতো ওকে। নওশাদের মতো একজোড়া জুতো পড়লে একেবারে সাহেবদের মতো লাগবে। ভেবে মনে মনে হাসল বিন্দু।

-‘কি গো বিন্দু দিদি কইলা না আপার জামাই কেমন?’

-‘রাজ পুত্তুর রে জুম্মান। পরীর চান কপাল। যেমন সুন্দর পরী তেমন সুন্দর জামাই। পরীর লগে তো কথা কইতে হইবো। সই আমার বিয়া করব।’

-‘তুমি পরীকে দেখেছো? কেমন দেখতে?’
হঠাৎই নওশাদ প্রশ্ন করে বসে। বিন্দু মৃদু হাসে নওশাদের আগ্রহ দেখে।
-‘এতো গরজ ক্যান গো বাবু?তর সয় না বুঝি?চান্দের লাহান মুখখান দেহার লাইগা তইয়ার হইয়া যান। জ্ঞান হারাইতে পারেন। তয় এইডা কইতে পারি আপনে ঠকবেন না।’
খিলখিল করে হেসে উঠল বিন্দু। তারপর নিজের কাজে মন দিলো। বিন্দুর কথা ও হাসির তোড় নওশাদের দুকান ভরে বাজে। সত্যিই এতো অপরূপা পরী?
জুম্মান হাল্কা ঝুঁকে শাপলা তুলতে গেল। কিন্ত নওশাদ তাতে বাধা দিলো। পরীর জন্য সে নিজেই শাপলা তুলবে। তাই সে ঝুকে কয়েক টা শাপলা তুলল। আরেকটু দূরে একটা পদ্ম দেখা যাচ্ছে। খুশিমনে নওশাদ পদ্ম তে হাত দিলো। পদ্মের বোটা একটু শক্ত বিধায় কসরত করতে হচ্ছে। এমন সময় জুম্মান হাতের বাঁশ টা দিয়ে নৌকাটা হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ভারসাম্য রাখতে না পেরে নওশাদ ধপাস করে পানিতে পড়ে গেল। আশেপাশের সবাই তা দেখে হেসে উঠল। জুম্মান নিজেও হাসতে লাগল। বিন্দু হাসি থামিয়ে বলল,’কিগো বাবু পরীর প্রেমে পড়ার আগেই জলে পড়লা।’
বিন্দুর হাসি আরো বাড়লো। এবার আর রাগ করলো না নওশাদ। সে নিজেও হাসলো বলল,’তোমাদের পরীর প্রেমই আমাকে পানিতে এনে ফেলেছে। কি করব বলো?’
-‘তুমি খুব রসিক গো বাবু। পরীর ভাগ্য ভালা।’

বিন্দুর প্রশংসায় নিজের প্রতি গর্ব হচ্ছে নওশাদের। সে সাবধানের সহিত পানি থেকে নৌকাতে উঠে আসে। তারপর ফিরে আসে জমিদার বাড়িতে। উঠোনের এক কোণে বাঁশের বেঞ্চি পাতা। শায়ের আর কবির সেখানে বসে কথা বলছে। নওশাদ কে ভেজা গায়ে আসতে দেখে কবির বলে উঠল,’তুই এভাবে ভিজলি কিভাবে?
-‘শাপলা তুলতে গিয়ে পানিতে পড়ে গেছি।’
-‘ইশশ শেষমেশ পঁচা পানিতে পড়লি!!যা যা কলপাড়ে। আমি তোর জামাকাপড় দিচ্ছি।’

কবির উঠে চলে গেল। জুম্মান শাপলাগুলো দূরের ফেলে দিয়ে এলো। শায়ের অবাক হয়ে বলে,’ফেললে কেন?’
-‘তো কি করমু ওই বেডার ফুল আপারে দিমু? আপা তো আমারে মাইরা ফালাইবো। আমার ভাল লাগে না হ্যারে।’
-‘তাহলে কাকে ভাল লাগে?’
-‘আপনেরে।’
বলেই হাসলো জুম্মান। শায়ের বেশ অবাক হয়ে বলে,’আমার থেকেও তো তোমার নওশাদ ভাই বেশি সুন্দর।’
-‘তাও তারে আমার ভালো লাগে না। হের চেহারায় কোন মায়া নাই। কিন্ত আপনের আছে। আপনে অনেক ভাল মানুষ। আপনের কথাও ভাল লাগে।’

তাজ্জব বনে গেছে শায়ের। মাথা ঠিক আছে তো জুম্মানের?কোথায় নওশাদ আর কোথায় সে!! আকাশ পাতাল তফাত। তার সাথে তো নওশাদের তুলনা হয়ই না। জুম্মান চলে যেতে নিচ্ছিল কিন্ত আবার শায়েরের সামনে এসে বলে,’একখান কথা কই সুন্দর ভাই? পরী আপার লগে আপনেরে কিন্ত খুব মানাইবো।’
কথা শেষ করে জুম্মান আর দাঁড়াল না। দৌড়ে অন্দরের ভেতর চলে গেল। শায়ের স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। পরে ভাবল ছোট্ট ছেলে। মনে যা এসেছে তাই বলেছে। বুঝলে একথা বলতো না। কোথায় রাজকুমারি আর কোথায় সামান্য মালি।

ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাত্রি অনেক তা বোঝাই যাচ্ছে।মধ্যরাতের বেশি তো হবেই। জমিদার বাড়ির চাকররা পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্দরের দরজা খুলে বৈঠকে প্রবেশ করে কেউ। তার হাতে হারিকেন। মুখটা সপ্তবর্ণে ঢেকে কিছু একটা খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্ত পাচ্ছে না তবুও সে হাল ছাড়ছে না। তখনই একটা ভারি পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে আসে,’আপনি আবার বৈঠকে এসেছেন!!’

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.