পরিজান

হারিকেনের টিমটিম আলোতে পরীর চোখে প্রকাশিত পাচ্ছে ক্ষোভ। শায়ের চুপ করে আছে পরীর ধমকে। পরী উঠে দাঁড়াল শায়েরের সামনে। আশেপাশে তাকিয়ে শায়ের দেখলো কেউ আছে কি না? যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে পরীকে কিছু বলবে না কিন্ত শায়ের কে অনেক কিছুই শুনতে হবে তার। সে বলল,’কেউ দেখলে খারাপ ভাববে। তাছাড়া আপনার সামনে বিয়ে। একটু ভেবে কাজ করবেন।’

-‘আমাকে নিয়ে ভাবতে আপনাকে হবে না।’
-‘আপনাকে নিয়ে ভাবছি না আমি। নিজেকে নিয়ে ভাবছি। কেউ দেখে ফেললে আমারই বিপদ।’

-‘ওসব কথা থাক। বিন্দুকে কারা মেরেছে?’
-‘আমি সত্যিই জানি না। আমাকে জানার অধিকার আপনার বাবা দেয়নি।’
বিষ্মিত হলো পরী। বলে,’মানে?ভাল করে বলুন।’

-‘আমাকে এই ব্যাপার থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। দেখুন আমাকে ঠিক যতটা বলা হয় ঠিক ততটুকুই করি। আপনি কেন ভুলে যাচ্ছেন যে আমি আপনার বাবার গোলাম মাত্র। আমাকে তিনি যা বলেন আমি তাই করি। প্রশ্ন করার অধিকার আমার নেই। বিন্দুর মৃত্যুর কথা জানলেও কাউকে বলতে আমি পারবো না। আপনার বাবাই সবাইকে বলবেন।পুলিশ এখনও কাউকে ধরতে পারেনি।’

-‘আমার বিশ্বাস হয় না আপনার কথা। আপনি মিথ্যা বলছেন। বলুন না বিন্দুকে কারা মেরেছে?’

শেষ কথাটাতে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। পরীর চোখের পানি স্পষ্ট দেখতে পেল শায়ের। খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই শায়েরের। একটু ভেবে শায়ের হাত বাড়িয়ে দিলো পরীর দিকে বলল,’বিশ্বাস না হলে শাস্তি দিতে পারেন। হারিকেনটা ওখানে আছে।’

পরী একপলক হারিকেনের দিকে তাকিয়ে আবার শায়েরের দিকে তাকালো। এই মুহূর্তে সে কিছুই বিশ্বাস করতে চাইছে না। তবে শায়েরের কথা শুনে মনে হলো সে মিথ্যা বলছে না। তাহলে সত্যিটা কি?বিয়ের পর তো এখানে আসতে পারবে না পরী। তাহলে সত্য উদঘাটন করবে কীভাবে?ছোট্ট মস্তিষ্কে আর চাপ নিতে পারছে না পরী। তাই বিনা বাক্যে প্রস্থান করলো।

বিন্দুর চলে যাওয়ার আজ বাইশ দিন। পুলিশ এখনও কোন হদিস পায়নি। তাদের ধারণা আসামীরা
গা ঢাকা দিয়ে আছে। এখন ওদের ধরা অসম্ভব। তাই কেসটা এমনভাবে সাজাতে হবে যেন সবাই ভুলে গেছে বিন্দুর কথা। তবে ওত পাতাই থাকবে। এখন শুধু আসামীদের বের হওয়ার পালা। সন্দেহ তাদেরই করা হয়েছে যারা যাত্রাপালায় ছিল কিন্ত বিন্দুর মৃত্যুর পর তাদের কোন খবর নেই।
কুসুম এসে কথাগুলো পরীর কানে তুললো। পরী কিছু বলল না। কুসুমের খারাপ লাগছে পরীকে এভাবে দেখে। যে মেয়েটা সারা অন্দর ঘুরে বেড়াতো সেই মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। কুসুম হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে,’আচ্ছা আপা আপনে যে খুন করলেন আপনের ডর করে নাই?’

কুসুম ভেবেছিল পরী রাগ করবে ওর কথায়। কিন্ত পরী তা করলো না। বলল,’মানুষ যখন কোন খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তখন কোন ভয় থাকে না তার। আমার ও তাই হয়েছিল। তখন কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই রাগের বশে খুন করে ফেললাম।
পরে অবশ্য আমি নিজেও ভয় পেয়েছিলাম। কিন্ত আপাকে বুঝতে দেইনি।’
-‘আপনের অনেক সাহস আপা। আমি তো মুরগি জবাই দেখতে ভয় পাই। আর আপনের মানুষ জবাই করলেন!!’
-‘জানোয়ার জবাই করতে ভয় কিসের??’

কুসুম দাঁত বের করে হাসলো। সবসময় সঠিক জবাব পায় সে পরীর থেকে। মালাকে আসতে দেখে কুসুম হাসি বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেলো। মালা পরীর মুখোমুখি বসলো। হাতে একটা কাপড়ের তৈরি ব্যাগ। ব্যাগ থেকে বেশ কিছু গয়না বের করে বলল,’দেখ তো পছন্দ হয়?’
পরী গয়না গুলোর দিকে তাকালো না। মালার দিকে তাকিয়ে রইল। কুসুম উঁকি দিয়ে বলে,’একদম খাঁটি সোনা আপা। একবার দেখেন?’
হেসে পরী বলে,’আমি খাঁটি সোনা’ই দেখতাছি কুসুম।’
মালা অবাক হয়ে তাকালো পরীর পানে। কাঁদছে পরী। মালার নিজের চোখেও অশ্রুরা ভিড় করলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’কান্দোস ক্যান?’
-‘আপনাকে রেখে আমি যাবো না আম্মা।’
মালাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে পরী। কাঁদতে কাঁদতে বলে,’আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না আম্মা। আমি আপনার কাছে থাকতে চাই।’
মালাও কাঁদছে। পরীকে যতটুকু শাসন করেছে তার দ্বিগুণ ভালোবেসেছে। পরীকে বুঝতে দেয়নি। পরীর সুরক্ষার জন্য কসম দিয়ে ঘরবন্দি করে রেখেছিলেন মালা। তিনি চাননি সোনালী আর রুপালির মতো কাউকে পছন্দ করে ঠকুক তার ছোট মেয়ে। কষ্ট পাক,তাছাড়া সকল খারাপ দৃষ্টি থেকে আগলে রেখেছে পরীকে। না জানি পরীর স্বামী তাকে কতটা সুরক্ষা দেবে? কিন্ত মালা তার পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তার এখন কোন আফসোস নেই। উপরওয়ালার কাছে সে সম্মানের সহিত ছোট মেয়ের কথা বলতে পারবে। এটাই তার প্রশান্তি।

পরীকে শান্তনা দিয়ে মালা বললেন,’সব মাইয়া গো একদিন পরের ঘরে যাইতে হয় রে। দোয়া করি তুই যেন সুখি হোস। শহরে তুই ভালো থাকবি। ওইখানে ভালো স্কুল কলেজ আছে তুই পড়ালেখা করবি।’

পড়ার কথা শুনে মালাকে ছেড়ে দিল পরী। কান্নাও বন্ধ হয়ে গেল। পড়ার প্রতি মনই টানে না পরীর। যেদিন প্রথম পড়ার জন্য স্কুলে মার খেলো সেদিনই শাপলা বিলে এসে পরী ওর বইগুলো ছুঁড়ে ফেলে বিলের পানিতে। মাছ,ব্যাঙ আর সাপ দের খাওয়ার জন্যই দেয় বই গুলো। এজন্য মালার কম মার খায়নি পরী। কিন্ত পরী তবুও পড়াশোনায় মন দিতে পারেনি। মাধ্যমিক দেওয়ার পর সে পড়াই বাদ দিয়েছে। গ্রামে তো কোন কলেজ নেই এটাই মূল কারণ। এতে পরী ভিশন খুশি ছিল। যাক আর পড়তে হবে না। কিন্ত মালা এখন আবার কি বলল!! মাথা ঘুরছে পরীর।
মালা এটাই চেয়েছিলেন। পরী যাতে কান্না বন্ধ করে। সেজন্যই পড়ার প্রসঙ্গ তুলেছেন।

মালা মেয়ের হাত ধরে কাছে টেনে বলে,’শহর কেমন তা আমি জানি না। সাবধানে থাকবি একলা বাইর হবি না। জামাইরে নিয়া যাবি।’
জামাই শব্দটাতে যেন বিষম খেলো পরী। সে তো শেখরকে ঠিকমতো চেনেই না। কীভাবে মানিয়ে নেবে শেখরের সাথে পরী? চিন্তায় পড়েছে সে। মালা ততক্ষণে চলে গেছে কুসুমও গেছে। পরীর চেতনা ফিরতেই চোখের সামনে ছড়িয়ে রাখা গয়না গুলো দেখতে পেলো। তাতে হাত বুলিয়ে বলল,’এই গয়না কি সুখ দিতে পারে?টাকা পয়সা কি শান্তি দেয়? তাহলে এতো ঐশ্বর্য থাকতে আমি কেন এক টুকরো সুখ পাই না? অট্টলিকায় সুখ না থেকে যদি কুঁড়ে ঘরে সুখ থাকে তাহলে আমি ওই কুঁড়ে ঘরে যেতে চাই।’

পরীর ইচ্ছা গুলো রঙ ওঠা চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ রইলো। তারাও যেন বুঝে গেছে পরী কি চায়!!জীবনে যে ভালোবাসাই সব। ধন সম্পদ দিয়ে কি হবে যদি ভালোবাসা না থাকে। পরী ভাবছে শুধু। তার জীবনে কোন মানুষটা সঠিক হতে পারে?

দিন পেরিয়ে রাত,রাত পেরিয়ে দিন। প্রকৃতির নিয়ম মেনে সময় এগিয়ে যাচ্ছে। ঘনিয়ে আসছে জমিদার কন্যার বিয়ের দিন। উৎসবে মেতেছে পুরো গ্রাম। দলে দলে মেয়েরা অন্দরে ঢুকছে নববধু কে দেখার জন্য। বিদায় দেওয়ার পূর্বে পরীকে সবাইকেই দেখে নিচ্ছে। বয়স্করা পরীকে দোয়া দিচ্ছে। আর পরী চুপচাপ তা মাথা পেতে নিচ্ছে। নতুন সাজে সাজানো হচ্ছে জমিদার বাড়িকে। সবকিছুর তদারকি করছে শায়ের। দম ফেলানোর সুযোগ নেই তার। গায়ে হলুদের সব জিনিস পত্র গুনে গুনে অন্দরে পাঠাচ্ছে সে। একটু পরেই গায়ে হলুদ শুরু হবে।

হলুদ কাপড় পরিয়ে পিড়িতে বসানো হয়েছে পরীকে। রুপালিও এসেছে,ছেলেকে শেফালির কাছে রেখে এসেছে। হলুদ বাটছে একজন মহিলা। পরী অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। পিঠ ছড়ানো চুল গুলো,হাতে চুড়ি আর হলুদ রঙে পরী যেন ঝলমল করছে। এই পরীকে দেখে আজ যেন প্রকৃতি হিংসে করছে। তাইতো সূর্যকে আজ লুকিয়ে রেখেছে। রুপালি তাড়া দিয়ে বলে,’আপনারা তাড়াতাড়ি করুন। এই শীতের মধ্যে কতক্ষণ বসে থাকবে। এরপর গোসল করাতে হবে। কুসুম গরম পানি নিয়ে আয় না।’
সবাই খুব তাড়াতাড়ি সব করতে লাগল।
প্রথমে পরীকে মালা হলুদ ছোঁয়ালো। কপালে গাঢ় চুম্বন করে বলে,’সুখি হ।’
জেসমিন এই প্রথম পরীকে ছুঁয়ে দিলো। মন্দ লাগলো না পরীর। ওর মায়ের স্পর্শই যেন পেল। চোখ তুলে জেসমিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। জেসমিন ও কপালে চুমু এঁকে দিলো। পরীর সারা শরীরে হলুদ মেখে দিলো এক এক করে। আবেরজান তা দেখে বলে,’অতো হলদি মাখিস না। আমার নাতনি এমনেই সুন্দর। অহন গোসল দে।’
আরেকজন রসিকতা করে বলে,’নাত জামাইর যে চান কপাল। আমাগো পরীর মতো মাইয়া পাইছে।’

-‘হ,এই চান দেখলে তো আর ছাড়তে চাইবো না।’

হাসাহাসির রোল পড়ে গেল সবার মধ্যে। পরী আগের মতোই বসে আছে। কুসুম গরম পানি আনলো। গোসল করানো হলো পরীকে। গরম পানিতে গোসল করেও শীত লাগছে পরীর। ঠকঠক করে কাঁপছে। ঠোঁট দুটো নীল হয়ে আসছে। সারা শরীরে হলুদ মাখানোর ফলে হলদেটে হয়ে আছে ফর্সা দেহখানা। রুপালি আবার তাড়া দিতেই পরীকে ঘরে নিয়ে গেল। হলুদ শাড়ি পাল্টে লাল শাড়ি পরানো হলো। আর কিছুক্ষণ পরেই বর আসবে।

এরই মধ্যে মালা এলেন হাতে পায়েশের বাটি নিয়ে। নিয়ম অনুসারে পরীকে তিনবার খাইয়ে দিলো মালা। তারপর বাকিটুকু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেতে দিলেন। গায়ে হলুদের আগেই পরীকে ভাত খাইয়ে দিয়েছিল স্বয়ং জেসমিন। আজ পরী কাউকে না করেনি। জেসমিনের খুব ভাল লাগলো পরীর আচরণে। নিয়ম মতো পরী গায়ে হলুদের পর আর কিছুই খেতে পারবে না। শুধু ওই পায়েশ বাদে।
নিয়ম শেষে লাল বেনারশিতে সাজানো হলে পরীকে। বোনকে নিজ হাতে সাজালো রুপালি। সবশেষে লম্বা ঘোমটা টেনে দিয়ে বলল,’মাশাল্লাহ তোকে রাজকন্যার চেয়েও সুন্দর লাগছে পরী। বরের নজর ব্যতীত আর কারো নজর যেন না লাগে!!’
হাসলো রুপালি। পরী কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো রুপালির দিকে। এটা কেমন দোয়া?? বরের নজর পড়বে শুধু। পরীও হাসলো রুপালির দোয়া বুঝতে পেরে।
আছরের আযান পড়ে গেছে। এখন বরযাত্রী এসে পৌঁছায়নি। শহর থেকে আসছে বিধায় আরো দেরি হচ্ছে। ঘুম এসে গেছে পরীর। ওর পাশে বসে থাকা মেয়ে গুলোও ঝিমাচ্ছে। এই মুহূর্তে বিয়ে টাকে অসহ্য লাগছে পরীর। এতক্ষণ বসে থাকতে ভালো কার লাগে!!
সময় পার হতে হতে মাগরিবের আযান দিয়ে দিয়েছে। এখন পরীর বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে শাড়ি গয়না টেনে খুলে ফেলতে। রাগ প্রকাশ করতেও পারছে না। তখনই কয়েকজন মহিলা এসে পরীকে নিয়ে গেল বৈঠকে। পুরুষ নেই বৈঠকে। আফতাব, কাজি আর বর ই পুরুষ। মেঝেতে খেজুর পাতার তৈরি বড় পাটিতে বসানো হলো। সামনে টানানো হলো পাতলা চাদর। উসখুস করছে পরী। শুধু কবুল বললেই আজ সে এক পুরুষদের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে যাবে। তার উপর সমস্ত অধিকার পাবে পরী।
কাজী সাহেব উচ্চস্বরে বলতে লাগল,’নূরনগর গ্রামের জমিদার আফতাব উদ্দিনের কনিষ্ঠ কন্যা পরীকে বিশ হাজার এক টাকা দেনমোহর ধার্য করে বিবাহ করতে আপনি কি রাজি? রাজি থাকে বলুন কবুল!’

পরী মাথা নিচু করে শুনছে। এই মুহূর্তে ওর অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছে। পরী ভাবছে এরকম অনুভুতি কি সব মেয়েরই হয়? অপর পাশ থেকে বেশ দেরি করেই উত্তর এলো। শেখর কি মেয়েদের মতো লজ্জা পাচ্ছে নাকি? অসহ্য লাগলো ব্যাপারটা।
এরপর কাজি পরীকে উদ্দেশ্য করে বলে,’নবীনগর গ্রামের শাখাওয়াত সাহেবের একমাত্র পুত্র সেহরান শায়ের আপনাকে বিশ হাজার এক টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া বিবাহ করিতে ইচ্ছুক। আপনি কি রাজি? তাহলে বলুন কবুল!!’

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.