পরিজান

ছোট্ট টিনের ঘরের চারিদিক দিয়ে বেড়া দেওয়া। কলপাড় রান্নাঘরের চারিদিকও ঢাকা। শায়েরের ঘরটা খুব বেশি জায়গায়া জুড়ে নয়। বেড়ার ধার ঘেষে বড় একটা নারকেল গাছ। বেশ বড়বড় নারকেল ধরেছে তাতে। ভর দুপুরে পলাশের ইচ্ছা করছে পিঠা খাবে। হেরোনার কাছে বায়না ধরতেই তিনি বললেন নারকেল পাড়ার জন্য। হুট করেই সে গাছে চেপে বসে আর বিপত্তি ঘটায়। শায়ের বুঝতে পেরেছে এই ছেলেটা যতদিন বাড়িতে থাকবে কাউকে শান্তিতে থাকতে দিবে না। খুসিনাও চলে এসেছে। তিনি হেরোনার ঘরের সামনে গিয়ে গলা ছেড়ে বলতে লাগলেন,’ও হেরো,,তোর বলদ দামড়া পোলা কি মানুষ হইবো না? এই ভর দুপুরে গাছে উইঠা কি করতাছে?’
হেরোনা ও তেড়ে এলেন ঘর থেকে,’তাতে তোমার কি? আমার পোলায় পিঠা খাইবো। তোমার এতো বাধে ক্যান?’
-‘ঘরের চালে নারকেল ফালাইছে। ঘরটা তো খাইবো। পোলা নামা।’
-‘নামবো না আমার পোলা। আমি দেখছি আমার পোলার ভালা তোমার সহ্য হয়না। তা দূরে যাও না। এইহানে আহো ক্যান??’

শায়ের ধমকে পলাশকে গাছ থেকে নামায়। চালের টিন দেবে গেছে কিছুটা। এটাকে ঠিক করতে হবে নয়তো বাদল দিনে বৃষ্টির পানি পড়বে। ঝামেলা ছাড়া এই ছেলে আর কিছুই করতে পারে না। বছর খানেক আগে যে ঘটনা ঘটিয়েছে তারপর এখন বাড়িতে এসেছে। বাইরের কেউ দেখলে আস্ত রাখবে না ওকে।
কয়েক দিন পরই চলে যাবে সে। তাই হেরোনা আদর যত্ন করছেন ছেলেকে।
এই মুহূর্তে হেরোনার সাথে ঝগড়ার কোন মানেই হয় না। খুসিনা যা বলার বলুক। তাই শায়ের আর সেদিকে এগোলো না। নিজ গন্তব্যে সে চলে গেল। কিন্ত নারকেল গাছটা আর সে রাখলো না। পরের দিন লোক দিয়ে কেটে ফেললো। হেরোনার রাগ হলেও কিছু বলতে পারলেন না। কেননা শায়েরের বাবার জমি শায়েরের চাচারা মিলে দখল করে রেখেছে। শায়েরের দাদা তার সমস্ত সম্পত্তি চার ছেলেকে ভাগ করে দিয়ে গিয়েছেন। একমাত্র ছেলে হওয়াতে বাবার সম্পত্তি শায়ের পেয়েছে। কম করে বিঘা দুয়েক কিংবা তার থেকে একটু কম হবে।
শায়ের কখনোই নিজের সম্পত্তি চায়নি।
এখন কিছু বললে শায়ের যদি তার সম্পত্তির অধিকার চেয়ে বসে? হেরোনা কিছুতেই তা হতে দেবে না। তাই তিনি আগ বাড়িয়ে কিছু বললেন না। বাকি দুই জা কেও চুপ থাকতে বললেন। তবে চিন্তা হেরোনার গেলো না। কেননা শায়ের এখন বিয়ে করেছে। বাচ্চা হলেই তো শায়ের নিজের ভাগ বুঝে নেবে। এজন্য বেশ চিন্তা হয় হেরোনার।

——-
জমিদার বাড়ির সামনে ভিড় জমিয়েছে গ্রামের শত শত মানুষ। মহিলারা আঁচলে মুখ ঢেকে অন্দরে যাচ্ছেন আবার বের হচ্ছেন। চোখের পানি ফেলছেন কেউ কেউ। বাইরের লোকজন বাঁশ কেটে এনে রাখছেন। কয়েক জন মিলে কবর খুড়ছেন জমিদার বাড়ির পাশে থাকা কবরস্থানে। গরুর গাড়িটি এসে থামতেই আগে নামলো শায়ের। তারপর পরী। ভিড় জমানো স্রোতারা রাস্তা দিলো পরীকে ভেতরে যাওয়ার। পরী ধীর পায়ে অন্দরে ঢুকল। অন্দরের উঠোনে আজ অনেক মহিলারা। সবাইকে এক নজর দেখে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে গেল সে। সারিবদ্ধ ঘরগুলো পেরোতে লাগলো সে। শেষের আগের ঘরটাতে ঢুকতেই পরিচিত মুখগুলো দেখতে পেল পরী। মালা জেসমিন মেঝেতে বসে আছে। রুপালি পালঙ্কের উপর বসে আছে। আবেরজানের পুরো শরীর চাদরে ঢাকা।
কাল রাতে পরলোকগমন করেন আবেরজান। পরীকে রাতেই খবর পাঠানো হয়। খবর পাওয়ার পর শায়ের দেরি করেনি। তখনই নূরনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় পরীকে নিয়ে। দীর্ঘ আটমাস পর পরী নিজ বাড়িতে পা রেখেছে। কাজের জন্য শায়ের সময় পাচ্ছিল না বিধায় আসতে পারে না। কিন্ত আবেরজানের মৃত্যুর খবর শুনে তো আর থাকা যায় না। ইলিয়াস কে না জানিয়েই আসতে হলো।

পরী রুপালির পাশে গিয়ে বসতেই রুপালি ওকে ধরে কেঁদে উঠল বলল,’দাদি আর নেই রে পরী। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।’
পরী শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বোনকে। তবে ওর খারাপ লাগলেও চোখে পানি আসলো না। কারণ আবেরজানের জন্য মালার জীবনটা দূর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল। তার কটু কথাতে মালা কষ্ট পেতো। সেজন্য পরী দাদিকে খুব একটা পছন্দ করতো না। তাই তার মৃত্যুতে এতো শোক পালন করার কোন মানেই হয় না বলে পরীর ধারণা। তবে মুখ ফুটে সে কিছুই বলে না।
জেসমিন আর মালা গুনগুন করে কেঁদে যাচ্ছেন। শ্বাশুড়ি যেমনই হোক না কেন মা বলে ডেকেছেন এতোদিন। সম্মান দিয়েছেন,সেই মানুষটা আজকে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। কষ্ট তো হবেই।
মহিলারা ধরাধরি করে আবেরজান কে নিচে নামালো। গোসল করালো গরম পানি দিয়ে। তারপর সাদা কাফনে মুড়ে দিয়ে খাটিয়ায় শুইয়ে দিলো। আগরবাতি আর গোলাপজলের গন্ধে চারিদিক ভরে উঠেছে। আবেরজানকে নিয়ে যাওয়ার আগে শেষ দেখা দেখতে এলো সবাই। পরী খাটিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার স্থির দৃষ্টি আবেরজানের বন্ধ চোখে। একসময় কতোই না এই মহিলার মৃত্যু কামনা করেছে সে। তখন অতো কিছু বোঝেনি। কিন্ত এখন একটু হলেও কষ্ট হচ্ছে। নিজের রক্ত বলে কথা।
রুপালি হুট করেই আবেরজানের পা জড়িয়ে বসে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,’মাফ করে দিও দাদি। না জেনে অনেক কথা বলেছি তোমাকে। ভুল বুঝেছি, বেঁচে থাকতে বুঝতে পারিনি। মাফ করো তুমি।’

মালা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদেন। শেষ বিদায় সবাই চোখের পানিতেই দেয়। সে যত খারাপ মানুষ হোক না কেন? কেননা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষেরও আপনজন আছে। কারো না কারো ভালোবাসা সেও পায়। বিদায় নিয়ে চলে গেল আবেরজান।
পুরো অন্দর শান্ত এখন। ঘুর্ণিঝড়ের তান্ডব শেষ হওয়ার পর যেমন শান্ত হয় পরিবেশ। ঠিক তেমনি।
মানুষ জন একে একে চলে গেছে নিজ গৃহে। অন্দরের বারান্দায় বসে আছে সবাই। কুসুম আর শেফালি ভাত ডাল ঘরে নিচ্ছে। কেউ মারা গেলে সে বাড়িতে তিনদিনের মধ্যে চুলায় আগুন জ্বালানো নিষেধ। তাই প্রতিবেশীরা রান্না করে দিয়ে যাচ্ছে। যারা কবর খুড়ছেন এবং বাকি কাজ করেছেন তাদের খাইয়ে বিদায় করা হয়েছে।
ঘরের মহিলারা শুধু বাঁকি আছে। কুসুম কাউকে খেতে ডাকার সাহস পাচ্ছে না। কারো মন তো ভালো নেই। কেউ তো খাবে না বলে মনে হয়। কুসুম পরীর অভিব্যক্ত বুঝতে পেরে সেদিকে এগোয়। গিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কি হয়েছে কুসুম?’
কুসুম অত্যন্ত নিচু গলায় বলে,’কাইল রাইত থাইকা সবাই না খাওয়া আপা।’

-‘আচ্ছা চল রান্নাঘরে। সব গুছিয়ে আমি সবাইকে খেতে ডাকছি।’
কুসুম আর পরী রান্নাঘরে গেলো। সব কিছু এলোমেলো হয়ে আছে। পরী কুসুমের হাতে হাত লাগিয়ে সব গোছাতে লাগলো।

-‘গেরামে যে কি হইলো খালি মানুষ মরতেই থাহে। আল্লাহ কোন গজব ফালাইলো তা তিনিই ভালো জানে।’
-‘আল্লাহ যাদের পছন্দ করেন তাদের সবসময়ই পরীক্ষা করেন। কি জানি আমাদের উপর এতো পরীক্ষা কেন করছেন?’

পরী একটু চুপ থেকে কুসুম কে জিজ্ঞেস করে,’বিন্দুর খুনিদের কি খবর কুসুম? আমি দূরে থাকি বিধায় কোন খবর পাই না। তুই জানিস?’

হঠাৎ করেই মনমরা হয়ে গেল কুসুম। মনে হচ্ছে রাজ্যের কষ্ট তার ভেতরে চাপা পড়েছে। সে বলে,’কি কমু আপা? বিন্দু তো গেলো লগে তার সম্পানরেও নিয়া গেলো।’
পরীর হাত থেমে গেলো। ডালের বাটিটা রেখে বলল,’সম্পান মাঝি!! কি বলছিস কুসুম? ভাল করে বল।’
-‘আপনে জানবেন কেমনে আপা?আপনে তো অনেক দূরে থাহেন। আপনে এই বাড়ি থাইকা যাওয়ার সাতদিন পর সম্পান গলায় দড়ি দিছে আপা। বিন্দুরে যেই গাছে ঝুলাইছিলো হেই ডালেই ফাঁসি দিছে। সম্পানের মা পাগল হইয়া গেছে আপা।’

পরী নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ। সম্পান যে এভাবে আত্মহুতি করবে তা ভাবেনি পরী। সম্পানের জন্য খারাপ লাগছে। বিন্দুকে ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন বলেই ছেলেটা নিজেকে শেষ করে দিলো!! ওদের ভালোবাসার পরিণতি এতোটা কঠিন না হলেও পারতো। কেন জানি আজ পরীর কষ্ট হলো না। কষ্ট পেতে পেতে সে হাঁপিয়ে গেছে।
পরী আর ভাবতে পারলো না সম্পান কে নিয়ে। সে বাটিতে ডাল তুলতে তুলতে বলল,’আর কিছু নেই কুসুম? শুধু ডাল?’

-‘হ আপা। আর কিছু নাই। সক্কাল সক্কাল সবাই তাড়াতাড়ি কইরা ডাল রান্না করছে।’

পরী চুপ থাকলো,ভাবলো শায়ের তো ডাল পছন্দ করে না। ও বাড়িতে শুধু পরী আর ফুপুই ডাল খেতো। কিন্ত আজকে শায়ের খেয়েছে তো? পরী চোখ তুলে কুসুমের দিকে তাকালো বলল,’উনি কি খেয়েছে কুসুম?’
-‘শায়ের ভাই? খাইছে তো।’

-‘তুই দেখেছিস?’
-‘আমি নিজে খাওয়াইছি তারে।’
-‘ওহ।’
আর কোন বাক্য ব্যায় করলো না কেউ। পরী সবকিছুই গুছিয়ে বাইরে এলো। প্রথমে কেউ খেতে না চাইলেও পরী জোর করেই সবাইকে নিয়ে গেল। তবে পেট ভরে কারো খাওয়া হলো না। সবাই কোনরকম খেয়ে নিজ ঘরে চলে গেল। পরী ও ঘরে গেল। শায়ের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। পরী একবার ওকে দেখে নিয়ে আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করলো। আলমারি খোলার শব্দে শায়ের ফিরে তাকালো। পরীর চোখে চোখ পড়তেই পরী সেদিকে এগিয়ে গেলো। বলল,’গোসল করেছেন?’

-‘হুম।’
-‘খেয়েছেন?’
-‘আপনি খেয়েছেন??’
-‘হ্যা খেয়েছি।’

শায়ের নিঃশব্দে হাসলো। পরীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,’আমি না খেলে কখনো খেয়েছেন আপনি? জেনেও প্রশ্ন করছেন?’
পরী প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,’আপনি কি জানেন সম্পান মাঝির কথা??’
-‘সম্পান!!না তো,কোথায় সম্পান?’
-‘সম্পান মাঝি আত্মহত্যা করেছে।’

চমকালো শায়ের। পরীর দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। পরী বলল,’আমিও আজকে শুনলাম। কুসুম বলেছে। আমার বিন্দুর জন্য নিজের জীবনটা দিয়ে দিলো সে।’

-‘জীবন উৎসর্গ করে কি ভালোবাসা প্রমাণ করা যায় পরীজান?’

-‘আমার থেকে তা আপনি ভালো জানেন। আপনার থেকেই তো ভালোবাসা শিখছি আমি। প্রতিদিন আপনার ভালোবাসার নতুন রূপের সাথে পরিচিত হই আমি। আপনিই বলুন।’

-‘আমি যদি আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গ করি তাহলে আপনাকে ভালোবাসবে কে পরীজান?’

SHARE:

Logo Light

হারিয়ে যান গল্পের দুনিয়ায়

Useful links

2024 © Golpo Hub. All rights reserved.