বিছানায় কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে আছে স্বাক্ষর। বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। রাতের সাড়ে বারোটা বাজতে চলল। স্বাক্ষর বিছানায় শুয়েই এপাশ ওপাশ করছে। ঘুম আসছে না। বউয়ের সাথে সাথে ঘুমও আজ পালিয়েছে। কই বিয়ে করেছে বউ নিয়ে থাকবে বলে। তা না করে দুজনে আলাদা আলাদা ঘরে অবস্থান করছে। মি. ইলিয়াস মাহমুদ কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এই শুক্রবার ওদের রিসেপশন আয়োজন করা হবে। তার আগে দুজনকে আলাদাই থাকতে হবে। হাতে মাত্র একদিন। গ্রামে মিজান তালুকদারকে জানানো হয়েছে রাতেই। অসুস্থতার জন্য লম্বা জার্নি করতে পারবেন না তিনি। উনার বড় ছেলে আর মেঝো ছেলে কাজের সুত্রে বাইরে গেছেন। খালি বাড়ি আর অসুস্থ মিজান তালুকদারকে একা ফেলে‚ ছেলের বউরা আসতে পারবেন না। উনার ছোট ছেলে যাবেন আর নাতি নাতনিদের পাঠাবেন বলে দিয়েছেন। স্বাক্ষর তার কোলবালিশ আঁকড়ে ধরে বলল‚
“বুঝলি টুনটুনি‚ না জানিয়ে বিয়ে করার শাস্তি দিচ্ছে আব্বু আমাকে। বিয়ে করেছি বউ নিয়ে থাকার জন্য কিন্তু এখন দেখছি আরও একটা দিন আর দুটো রাত অপেক্ষা করতে হবে। তবে চিন্তা করিস না‚ তারপর থেকে তোকে আর আমার প্রয়োজন হবে না। আমি আবার দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে পারি না। কোলবালিশ আমার চাই না। আমার বউ-ই লাগবে।”
তুলিকে জড়িয়ে ধরে তন্দ্রা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ড্রিম লাইটের আলো আর বাইরের ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় পুরো ঘরে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে৷ বিছানার কোণায় তন্দ্রার লম্বা বেনী ঝুলে আছে। বালিশের পাশে থাকা মোবাইলটা দুবার বেজে কে’টে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ঘরের দরজাটা খুলে গেল। এমনিতেই তন্দ্রা এ ঘরের দরজা লাগিয়ে ঘুমায় না। ড্রিম লাইটের আলোতে তন্দ্রার মুখশ্রী স্পষ্ট দেখতে পেল স্বাক্ষর। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় প্রেয়সীর কাছে। এতোক্ষণ তার অভাবই অনুভব হচ্ছিল। ডান হাত দিয়ে তন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কারো স্পর্শে গভীর ঘুমটা যেন আগের থেকে বেশ অনেকটা হাল্কা হয়ে এসেছে৷ তন্দ্রা চোখ মেলে তাকিয়ে আবছা আলোয় কারো অবয়ব দেখতে পায়। প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে আর অবয়বের কাছ থেকে দূরে সরে এলো। তন্দ্রাকে এমন সরে যেতে দেখে স্বাক্ষর আস্তে করে বলল‚
“আরে বউ আমি। ভয় পেও না।”
“তুমি এত রাতে এখানে কেন?”
“বউ ছাড়া ঘুম আসছিল না। তাইতো ভাবলাম একটু বউ বিলাস করে আসি।”
“সকালে বউ বিলাস কোরো‚ এখন আমার ঘুম আসছে। ঘুমাব আমি।”
“তুমি ঘুমাও। আমি না-হয় তোমায় দেখতে দেখতে সারা রাত পাড় করে দিব।”
“কি অবলীলায় না‚ কথাটা বলে দিলে। কেউ যদি এভাবে আমাদেরকে দেখে ফেলে‚ কী ভাববে ভেবে দেখেছ?”
“ভাববে আমি আমার বউকে ছাড়া থাকতে পারিনি‚ তাই তার ঘরে অবধি চলে এসেছি। ব্যাপারটা কিউট না?”
স্বাক্ষরের যেন এ ব্যাপারে কোনো ভাবান্তর নেই। সে এখনো তন্দ্রার মুখ পানে তাকিয়ে আছে। তন্দ্রা একটু নড়েচড়ে বসে বলল‚
“কিউট না ছাঁই। সবাই নির্লজ্জ বলবে। তোমাকে তো বলবে বলবেই আমাকেও বলবে।”
“বউ হাইপার হইও না। একটু পরেই আমি চলে যাচ্ছি। সবাই তো বাগান বিলাস‚ জোছনা বিলাস‚ বৃষ্টি বিলাস করে। আমি একটু তুমি বিলাস করতে এসেছি৷ অশান্ত মনটাকে তো একটু প্রশান্তি দেওয়া দরকার। তাই-না?”
তন্দ্রা প্রত্যুত্তরে কিছুই বলল না। তুলি এখনো আরাম করে ঘুমোচ্ছে৷ স্বাক্ষর তন্দ্রার হাত ধরে নিয়ে যায় বেলকনির কাছে। দু’জনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বেলকনিতে আবছা ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলো প্রবেশ করছে। দুজন কপোত-কপোতীর অবয়ব একটু আধটু বুঝা যাচ্ছেও বটে। স্বাক্ষর তন্দ্রার মাথাটা নিজের কাধে রাখে। তন্দ্রার চুলের থেকে শ্যাম্পুর মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছে। তন্দ্রার কোমল বাম হাত খানা নিজের পুরুষালি হাতের মাঝে নিয়ে নেয়। স্বাক্ষরের হৃদস্পন্দন তন্দ্রা নিশ্চুপ থেকে শুনতে পারছে।
“বউ তোমার জন্য দুটো উপহার আছে।”
তন্দ্রার দৃষ্টিতে প্রশ্নাত্মক চাহুনি। সে স্বাক্ষরের কাঁধ থেকে সন্তপর্ণে নিজের মাথা সরিয়ে নিল। আগ্রহী দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে রইল। স্বাক্ষর তার প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট দুটো বক্স বের করে। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটটা অন করে তন্দ্রার ডান হাতে ধরিয়ে দিল। প্রথম বক্সটা খুলে সে। সাদা স্টোনের একটা সোনার আংটি। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটে জ্বলজ্বল করছে। আংটিটা তন্দার অনামিকায় পড়িয়ে দিল। একদম ফিট হয়ে বসেছে আঙ্গুলে। দ্বিতীয় বক্সটা তন্দ্রার দিকে এগিয়ে দিল সে।
”এটা পরে কোনো সময় পড়ে নিও।”
তন্দ্রা বক্সটা খুলে সেখানে একটা নোসপিন দেখতে পায়। কিন্তু তার তো নাক ফোটা নেই। মনে মনে কিছু একটা ভেবে নেয়। স্বাক্ষর ঘোর জড়ানো কন্ঠে তন্দ্রাকে বলে‚
“তোমাকে কী জড়িয়ে ধরতে পারি বউ?”
আজ তন্দ্রার সারা সময় নীরব থাকতেই ইচ্ছে করছে। স্বাক্ষরের ঘোর জড়ানো কণ্ঠ তার মনে এক অন্যরকম অনুভূতির জানান দিচ্ছে।
“তোমার নীরবতাকে কী আমি বরাবরের মতোই সম্মতি মনে করে নিব?”
আজ দ্বিতীয় বারের মতো তন্দ্রা আবারও স্বাক্ষরকে নিজে থেকে আলিঙ্গন করল। উতলা হৃদয় মুহূর্তেই শীতল হয়ে উঠল। নিজেকে প্রচণ্ড সুখী মনে হচ্ছে। তন্দ্রা তার আঙ্গুল দ্বারা স্বাক্ষরের বুকে আঁকিবুঁকি করছে। এখানেই যেন শান্তির দেখা মেলে। আবেশে চোখ বন্ধ করে বলল‚
“তোমার বক্ষস্থলে উষ্ণ আলিঙ্গনে মনের সকল গ্লানি কোথাও একটা হারিয়ে যায়।
তন্দ্রার কথার পিঠে কোনো উত্তর দিল না স্বাক্ষর। দু’হাত দ্বারা আবারও তন্দ্রাকে নিজের সাথে আগলে নিল। তন্দ্রার ঘন দীঘল কৃষ্ণগুচ্ছ কেশে স্বাক্ষর ওষ্ঠদ্বয় ছোঁয়াল। গাঢ় আলিঙ্গনে দুজন কপোত-কপোতী একে অপরের সাথে লেপ্টে রইল বেশ কিছু সময়। আর সাক্ষী হয়ে রইল কিছু সুন্দর প্রহর। বেশ কিছু সময় পর স্বাক্ষর তন্দ্রার কাছ থেকে সরে এলো। তন্দ্রা তার দিকে একবার তাকাল। হুট করে স্বাক্ষর তন্দ্রার ললাটে নিজের উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় ডুবিয়ে দিল। আবেশে নেত্রযুগল বন্ধ করে নিল তন্দ্রা। কানের কাছে গরম নিশ্বাস অনুভব করল। ঘোর জড়ানো কণ্ঠে স্বাক্ষর আবারও তাকে বলল‚
“আওয়ার ফার্স্ট নাইট।”
স্বাক্ষরের কথায় তন্দ্রা কিছুটা লজ্জা পেল। সে স্বাক্ষরের দিকে তাকাল না। ওই চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না তার। বুকের ভেতর যেন দ্রিমদ্রিম করে ঢোল বাজাচ্ছে। দু’জনে বেলকনি ছেড়ে ঘরে চলে এলো।
“আসছি বউ।”
কথাটা বলেই স্বাক্ষর ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তন্দ্রা তার যাওয়ার পানে বেশ অনেক সময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বিছানায় তুলির পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সকালে খুব দেরিতে ঘুম ভাঙল তন্দ্রার। আড়মোড়া ভেঙে কালো রঙা দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সকালে সাড়ে দশটার বেশি বাযে। তুলি অনেক আগেই উঠে পড়েছে। তন্দ্রা ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমে এসে দেখে তুলি টিভি দেখছে। স্কুল থেকে তিনদিনের ছুটি নেওয়া হয়েছে। স্বাক্ষর বাদে সবাই এখানে উপস্থিত। হয়তো হসপিটালে গিয়েছে। দুপুরে সবাই মিলে শপিং এ যাবেন। তন্দ্রা আর স্বাক্ষরের জন্য কেনাকাটা করার আছে। এই বিষয়েই উনারা আলোচনা করছেন। তন্দ্রা ডাইনিং টেবিলে তার জন্য রাখা নাস্তাটুকু খেয়ে নিল। এতক্ষণে বেশ ক্ষিধেই পেয়েছিল তার। কোনো মতে খাবার টুকু খেয়ে ঘরে চলে আসে। চার্জে লাগান ফোনটা হাতে নিল। ইলোরার নাম্বারে কল করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলল। এরপর নিজেও তৈরি হয়ে নিল। ইলোরার আসলেই বেরিয়ে যাবে। সবটা স্বাক্ষরকে না জানিয়েই করতে চাইছে সে।
দুপুরে তন্দ্রাকে নিয়ে সবাই শপিং মলে এসেছে। সবাই বলতে মিসেস সাহেরা এবং মিসেস তাহেরা আর ইলোরাও আছে সাথে। তন্দ্রাকে মাস্ক পড়ে থাকতে দেখে মিসেস তাহেরা কিছুটা বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন‚
“এই গরমে মাস্ক লাগিয়েছিস কেন?”
“সকালে ঠান্ডা পানি খেয়ে সর্দি লেগে গেছে মা৷ বারবার হাঁচি আসছে।”
“তোদের বারবার বারণ করি ঠান্ডা পানি না খেতে তারপরও আমার কথা শুনিস না। লাগিয়ে ফেললি তো গরম ঠান্ডা। আজ বাসায় চল‚ তোকে আমি ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখব।”
মিসেস তাহেরার কথায় ইলোরা মিটিমিটি করে হাসছে। তন্দ্রা তার দিকে বড়ো বড়ো চোখের শাসানো দৃষ্টিতে তাকাল। মিসেস সাহেরা বললেন‚
“আহা তাহু। রাগ করছিস কেন? ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। চল ভেতরে যাই।”
ভেতরে যাওয়ার আগেই সেখানে স্বাক্ষর চলে এলো। একবার সবার দিকে তাকিয়ে থেকে তন্দ্রার দিকে তাকাল। তন্দ্রাকে মাস্ক পড়তে দেখে তার কপাল কিছুটা কুচকে এলো।
“তন্দ্রাবতী মাস্ক পড়ে আছ কেন?”
স্বাক্ষরের কথার প্রত্যুত্তরে মিসেস তাহেরা বললেন‚ “আর বলিস না বাবা। ঠান্ডা পানি খেয়ে সর্দি লাগিয়ে ফেলেছে সে।”
“ঔষধ খেয়েছ?”
”হুম।”
স্বাক্ষর তন্দ্রার হাত ধরে শপিং মলের ভেতরে ঢুকল। সবাই একসাথে পছন্দ করে তন্দ্রা আর স্বাক্ষরের রিসেপশনের জন্য ম্যাচিং করে যাবতীয় যা যা লাগে সবই কেনাকাটা করল। অনেক গুলো দোকান ঘুরে তন্দ্রার ল্যাভেন্ডার কালার লেহেঙ্গা পছন্দ হয়েছে। তার পছন্দ অনুযায়ী লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করে স্বাক্ষরের পাঞ্জাবি কেনা হয়েছে। আরও কিছু কেনাকাটা করে ওরা বাসায় ফিরল। ওরা বাসায় আসতে আসতে বিকেল হয়ে যায়। ওরা বাসায় আসার কিছুক্ষণ পরেই তন্দ্রার নানু বাড়ির সবাই চলে আসে। সবাইকে দেখে তন্দ্রা বেশ খুশিই হয়। বিশেষ করে রুবি আর তার হাসব্যান্ডকে দেখে খুশি হয়েছে। রাতে ছোট্টো করে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হলো তন্দ্রা আর স্বাক্ষরের। হেনা সুন্দর করে তন্দ্রার দু’হাত ভরে মেহেন্দি পড়িয়ে দিল। দু’হাতের মাঝে ছোটো করে স্বাক্ষরের নামও লিখে দিল। শপিং মল থেকে আসার পর একবারের জন্যও স্বাক্ষর তন্দ্রার দেখা পেল না। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে। আজ স্বাক্ষরের সাথে তার ছোটো মামা শুয়েছে। স্বাক্ষরকে এভাবে ছটফট করতে দেখে তার ছোটো মামা বলেন‚
“ভাগ্নে একটা রাত তো সবুর কর।”
“হুহ! তোমার জন্য আমি একটা কম মামি পেয়েছি। তিন তিনটে মামির প্রয়োজন ছিল। তাহলেই না জামাই আদর জমত।”
“সে রাজি থাকলে এতদিনে বিয়েটা হয়েই যেত ভাগ্নে।”
“তুমি আমার মামা কম বন্ধু বেশি। শুধু বলেই দেখ। তুলে এনে বিয়ে করিয়ে দেব।”
“এসব কথা পরেও হবে৷ এখন ঘুমাও। অনেক রাত হচ্ছে।”