ঘড়িতে রাত ১২:৫৬ । অনেকক্ষণ যাবৎ ফোনটা বেজেই চলেছে, তিতিরের হাত পা কাঁপছে। ফোন ধরার সাহস হচ্ছেনা। অবশেষে থাকতে না পেরে ধরেই ফেলল,
– হ্যালো
– যাক, অবশেষে দয়া হলো ফোনটা ধরার।
– আসলে আমি ফোনের কাছে ছিলাম না। তাই ধরতে পারিনি।
– আর সেদিন যে সারারাত কল দিলাম, সেদিন ধরোনি কেন?
– ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
– মিথ্যে বলোনা, অন্তত আমার কাছে।
– আসলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তা নাহলে তো পরদিন সকালের ফোনটাও ধরতাম না।
– সকালে ধরে তো লাভ নেই, অফিসে থাকলে কি কথা বলা সম্ভব?
– হুম বুঝেছি, বলো কি বলবে?
– কাল কি তুমি আমাদের এদিকে এসেছিলে?
চমকে উঠল তিতির, হ্যাঁ তিতির গিয়েছিল শুধু দূর থেকে মুগ্ধকে একবার দেখার জন্য। কিন্তু মুগ্ধ তো ওকে দেখেনি। তাহলে?
– কই না তো। কেন জিজ্ঞেস করছো?
– না মানে কাল সকালে যখন বেড়িয়েছি, কেন যেন মনে হচ্ছিল তুমি ওখানে ছিলে!
– নাহ আমি বাসাতেই ছিলাম।
– ও, আমি অবশ্য চারপাশ দেখেছি, কোথাও তোমাকে দেখতে পাইনি। তবু মানুষের মন তো, অনেকসময় অনেক কিছু ভেবে ফেলে। তাছাড়া ইদানীং তোমাকে বড্ড বেশি মিস করি!
তিতির মনে মনে ভাবতে লাগলো, মুগ্ধ কিভাবে বুঝলো। এটা কি ওর ভালবাসার জোড়? নাকি টেলিপ্যাথি? তবু বলল,
– এটা তোমার আমাকে কল দেয়ার একটা ছুতো মাত্র।
– তোমাকে কল করতে আমার কোন ছুতো লাগেনা, মন চাইলেও কল করিনা কারন আমি জানি ফোন রাখার পরই প্রতিবার কেঁদে সমুদ্র বানিয়ে ফেল তুমি।
– হুহ, আজাইরা কারনে কাঁদিনা আমি, ওকে?? চোখের জল এত সস্তা না আমার।
– চোখের জল বাজারে বেচা-কেনা হয়না যে তা সস্তা আর দামি বলে বিচার করবে! সে যাই হোক তুমি কি কি কারনে কি কি সিচুয়েশনে কত কত কাঁদতে পারো তা অন্তত আমার চেয়ে ভাল আর কেউ জানেনা।
বলেই হাসলো মুগ্ধ। রাগে তিতিরের শরীর জ্বলে গেল। বলল,
– পুরোনো কথা তুলছো কেন?
– পুরোনো কথা কোথায় তুললাম? পুরোনো কথা তুললে তো তোমাকে মনে করিয়ে দিতাম তুমি আমাকে কিভাবে কিভাবে আদর করতে। আদর করতে করতেও কতবার কেঁদেছো।
– তুমি টপিক চেঞ্জ না করলে আমি ফোনটা রাখতে বাধ্য হবো।
– তুমি চাইলেও এখন ফোন রাখতে পারবে না। কারন তোমার ভেতরে যে আরেক তিতির বাস করে সে চাইবে না।
রাগে অভিমানে কান্না পেল তিতিরের। কেন যে মুগ্ধ এমন করে। তিতির কান্না চাপানোর চেষ্টা করলো। মুগ্ধ বলল,
– তুমি কি কাঁদতে বসলা নাকি? এখন কাঁদলে কিন্তু চলে যাবো তোমার বাসায়, দুই গালে দুইটা চর মেরে আসবো।
– আমার অত ঠেকা পড়ে নাই যে আমি তোমার জন্য বসে বসে কাঁদবো। নিজেকে কি মনে করো তুমি?
– নিজেকে রাজপুত্র মনে করি, তুমি আরেক রাজ্যের রাজকন্য। কথা ছিল যুদ্ধে জয়ী হতে পারলে রাজকন্যা কে পাবো। যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিদের হারিয়ে জয়লাভ করার পরও পূর্ব শত্রুতার রেশ ধরে রাজকন্যার ভ্রাতা রাজামশাইয়ের মন বিষিয়ে দিয়েছেন। এখন এই রাজপুত্রের হাতে আর কিছুই নেই।
– এত বেহায়াপনা করতে কি তোমার একটুও লজ্জা লাগেনা?
– আমার লজ্জাশরম আগেও ছিল না, এখনো নেই, বিন্দুমাত্র নেই। তুমি তো জানোই।
– মিনিমাম এতটুকু লজ্জা থাকা উচিত যতটুকু থাকলে মানুষ বেহায়া বলবেনা।
– একটু বেহায়া হয়েও যদি তোমাকে পাওয়া যায় তো সেটুকু বেহায়া আমি হাজার বার হতে পারবো তিতির।
চোখের জল মুছে পানি খেয়ে গলাটা স্বাভাবিক করল তিতির, মুগ্ধকে কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না। মুগ্ধ ডাকল,
– তিতির
– হ্যা বলো।
– তুমি আমার কাছে চলে আসো প্লিজ। আমার ফ্যামিলিতে তো কোন প্রবলেম নেই, সবাই তোমাকে পছন্দ করে। তুমি তো জানোই। একবার আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে তোমার ভাইয়া ঠিকই মেনে নেবে।
– আবার সেই পুরোনো কথা! তুমি কেন বোঝোনা সেটা সম্ভব হলে তো আরো অনেক আগেই করতাম।
– তুমি সম্ভব করলেই হবে।
– আচ্ছা একই কথা বলতে বলতে তুমি কি ক্লান্ত হওনা?
মনটা খারাপ হয়ে গেল মুগ্ধর। বলল,
– কেন তুমি অ্যাকটিং করছো? তুমিও তো আমাকে ছাড়া ভাল নেই।
– আমি মোটেই অ্যাকটিং করছিনা। অনেক ভাল আছি আমি।
– প্লিজ তিতির,এরকম করোনা। একা থাকতে থাকতে আমি বড্ড ক্লান্ত। তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না।
– আমার কিছু করার নেই। আমার ফ্যামিলির কথা আমাকে ভাবতেই হবে। তোমাকে আগেও বলেছি। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি যেতে পারবো না।
– আর কত ট্রাই করবো? তাদের রাজী করানোর সব চেষ্টাই তো করেছি। তারা যা বলেছে তাই করেছি। আর কি করতে হবে জিজ্ঞেস করো।
– তবু যখন মানছে না, তখন এত চেষ্টাই বা তুমি করছো কেন?
– কারন এখনো আমি তোমাকে ভালবাসি।
তিতিরের বুকের ভেতর ধ্ধক করে উঠল। মুখে বলল,
– এসব কথায় আজকাল আর আমার ভিতরে কিছু হয়না।
– কিছু হওয়ানোর জন্য বলিনি তিতির। একটু বোঝো আমাকে। তুমি না আমাকে সবচেয়ে বেশি বুঝতে!
– দিন বদলেছে তো। আজকাল অত কাউকেই বুঝিনা। বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি।
– এত কঠিন হওয়ার ভান করছো কেন?
– আমি ভান টান করিনা তুমি সেটা জানো। আমি কঠিনই হয়ে গিয়েছি।
– আমাদের একসাথে কাটানো সব সুইট সময়গুলো, সব স্মৃতিগুলো ভুলে গিয়েছো?
– ভুলিনি কিছুই তবে ভোলা উচিৎ, এসব মনে রেখে কোন লাভ তো নেই। তাই ভোলার চেষ্টা করছি।
– পারবে ভুলতে?
– না পারার কি হলো? মানুষ পারেনা এমন কোন কিছুই নেই পৃথিবীতে।
– তাই? তাহলে বিয়ে করছো না কেন?
– আমার এখনো বিয়ে করার বয়স হয়নি তাই, আগে তো পড়াশুনা শেষ হোক।
– ঠিকাছে, দেখা যাবে।
– শোন তোমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, এজন্যই তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বিয়ে করো, বউ আসলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
মুগ্ধ হেসে বলল,
– আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে তুমি সহ্য করতে পারবে? তাছাড়া আমার শরীরে তোমার যত খামচি আর কামড়ের দাগ আছে তা নিয়ে কি অন্য মেয়েকে বিয়ে করা যায়? করলেও এসব দাগ দেখলে আমাকে জুতোপেটা করে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।
তিতিরের বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– সেটা তোমার ব্যাপার তুমি কি করবে না করবে তুমি ভাল জানো। তোমার লাইফ, তোমার ডিসিশান।
– সেজন্যই এখনো অপেক্ষা করছি।
– অপেক্ষা করে কোন লাভ নেই। আমি কখনো পালাবো না।
– তাহলে তোমার ভাইয়াকে আরেকবার ধোলাই দেই কি বলো? এবার আর ৩ দিন না ৩০ দিন থাকার ব্যাবস্থা করে দেই হসপিটালে।
– হোয়াট?
চেঁচিয়ে বলল তিতির। মুগ্ধ বলল,
– হ্যাঁ, সেই অনেক বছর আগে ওর সাথে আমার কি একটা প্রবলেম হয়েছিল। সেটা ধরে এখনো বসে থাকবে কেন?
– তুমি হিরোগিরি দেখিয়ে ওকে মেরেছিলে কেন?
– ও আমার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বাজে কথা বলেছিল কেন?
– কারন ও জানতো না তোমার গার্লফ্রেন্ড ওর বোন।
– মারার সময় আমিও জানতাম না যে ও তোমার বড় ভাই। যাই হোক ও নিজের বোন সম্পর্কে বলছে সেটা জানুক আর না জানুক, যে কোন মেয়েই কারো না কারো বোন। তাই যে কোন মেয়েকেই বোনের চোখে দেখলে কারো মুখ দিয়ে ওই বাজে কথাগুলো বের হয় না। বুঝলে?
তিতর বুঝল মুগ্ধ রেগে গেছে, তাই আরো রাগানোর জন্য বলল,
– আচ্ছা সেটা নাহয় বুঝলাম, আমার ভাই দোষ করেছিল। কিন্তু তোমরা ব্যাচেলর বাসায় মেয়ে নিয়ে এসেছিলে কেন?
অবাক হলো মুগ্ধ,
– মেয়ে!! ও তমালের গার্লফ্রেন্ড ছিল তিতির। যে কিনা এখন তমালের বউ। আর গার্লফ্রেন্ড কি বয়ফ্রেন্ডের বাসায় যেতে পারে না? এই ব্যাপারটা তোমরা দুই ভাইবোন সহজ ভাবে নিতে পারো না কেন বলো তো। এমনভাবে “মেয়ে নিয়ে এসেছিলে” কথাটা বলছো যেন আমরা সবাই মিলে একটা মেয়েকে ভাড়া করে এনেছিলাম।
– মুখে লাগাম দাও।
– তোমাদের ভাবনা লাগামছাড়া হলে কোন দোষ নেই, আর আমার মুখটা লাগামছাড়া হলেই দোষ! একেই বলে কৃষ্ণ করলে লীলা…
– শোন ফালতু কথা কম বলো।
হেসে ফেলল মুগ্ধ। বলল,
– আচ্ছা দোষ যারই হোক, আমি অনেক মেরেছিলাম তাই তোমার বড় ভাইয়া আমার চেয়ে ছোট হওয়া স্বত্তেও তো আমি ওর পায়ে ধরে মাফ চেয়েছি। আর কি করলে ওর রাগ ভাঙবে বলো।
– ওর রাগ আর জীবনেও ভাঙবে না। ওর ইগোতে লেগেছিল।
– আচ্ছা ওর কথা বাদ দাও, ওর ইগো নিয়ে ও থাক। আমাকে এটা বলো যে তুমিও তো কত আমার বাসায় এসেছো। তাহলে তো সেটাও দোষের তাইনা? সেই দোষ মোচন করার জন্য আমাকে বিয়েটা করে ফেল।
– আমি তোমার ব্যাচেলর বাসায় কখনো যাইনি। গিয়েছিলাম তোমার ফ্যামিলি বাসায়। এবং তখন বাসায় সবাই ছিল, গোপনে লুকিয়ে চুরিয়ে যাইনি। বুঝেছো?
– হুম বুঝেছি।
– এখন রাখছি, প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে।
হাসল মুগ্ধ। তিতির বলল,
– হাসছো কেন?
– এমনি।
– আচ্ছা, রাখছি গুড নাইট।
– গুড নাইট।
তারপরও কেউই ফোনটা কাটলনা। দুজনেই কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে ফোনটা ধরে রইল। অনেক সময় শুধু নিরবতাই পারে নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের অব্যক্ত কথাগুলো আরেকজনের কাছে পৌঁছে দিতে। অতঃপর মুগ্ধ বলল,
– রাখো।
ফোনটা রেখেই কান্নায় ভেঙে পড়লো তিতির। নিজের চুল ছিঁড়ল, হাত কামড়ালো, নিজের ওড়নাটাও ছিঁড়ে কুটিকুটি করলো। হঠাৎ একটা মেসেজ এল। হ্যাঁ মুগ্ধই পাঠিয়েছে,
” শান্ত হও, আমি এখনো মরে যাইনি যে তোমাকে এভাবে কাঁদতে হবে। আর তোমার হোয়াটস এ্যাপে একটা অডিও পাঠিয়েছিলাম, জানিনা কি কারনে সেটা এখনো ওপেন করোনি। আজ কি শুনবে একবার?”
তিতিরের দরকার হয়না বলে হোয়াটস এ্যাপ টা অনেক আগেই আনইন্সটল করে দিয়েছিল। তরিঘরি করে প্লে স্টোরে গিয়ে এ্যাপ টা ডাউনলোড করলো। আজ ডাউনলোড হতে যে কেন এত লেট হচ্ছে! উফফ!!!
অডিওটা প্লে করতেই প্রানটা জুড়িয়ে গেল তিতিরের। মুগ্ধ গাইছে,
“আমার ভিতরও বাহিরে অন্তরে অন্তরে,
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে..
ভাল আছি ভাল থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি
হোওওওও..
দিও তোমার মালাখানি
বাউলেরই মানটারে..
আমার ভিতরও বাহিরে অন্তরে অন্তরে,
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে..
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরনে মুক্তোর সুখ
তেমনি তোমার নিবিড় চলা
হোওওওও..”
Leave a comment