প্রেমাতাল | পর্ব – ৫৩

6 Min Read

এলার্ম বেজে উঠতেই তিতির হাত বাড়িয়ে সেটাকে বন্ধ করলো। রাতে ঘুম আসেনা, ইনসমনিয়া হয়ে গিয়েছে বোধহয়। ঘুমাতে ঘুমাতেই ২/৩ টা বেজে যায়। তাই এলার্ম দিয়ে রেখেছিল, যাতে ভোর ৫ টায় উঠতে কোন প্রব্লেম না হয়।
তিতির আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। বাইরে তাকিয়ে দেখলো এখনো আলো ফোটেনি। এম্নিতেই তো শীতের দিনে সকাল কে ভোর মনে হয় আর ভোরকে রাত। কম্বলটা সরিয়ে বিছানা থেকে নামলো। লাইট জ্বালিয়ে চুলগুলো হাতখোপা করতে করতে ঘরের দরজা খুলে বের হলো। রান্নাঘরে ঢুকে
পানি গরম দিয়ে তিতির একটা বাটিতে দুটো ডিম ভেঙে ভালভাবে ফেটে নিল। তারপর অন্য একটা বড় বাটিতে ময়দা, বেকিং সোডা, চিনি, লবণ একসঙ্গে চেলে নিল। এরপর তাতে ফাটানো ডিমের মিশ্রণটা ঢেলে দিল, সঙ্গে একটু বাটারমিল্ক দিয়ে পুরোটা একসাথে ব্লেন্ড করে নিল। এরপর এতে লাল রঙ (ফুড কালার) এবং ভ্যানিলা এসেন্স দিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে নিল। তারপর গতকাল কিনে আনা হার্টশেপ মাঝারি সাইজের কেক প্যানটায় মিশ্রণটি ঢেলে ছড়িয়ে দিল। ৩৫০ ডিগ্রি প্রি হিটেড ওভেনে ২০ মিনিট বেক করতে দিয়ে দিল। চুলা জ্বালিয়ে গোসলের পানি গরম দিল, গোসল না করলে শীত লাগে বেশি। রান্নাঘরটা যতটুকু নোংরা হয়েছিল পরিস্কার করলো, যেকটা জিনিস মেখেছিল ধুয়ে রাখলো। কেক ডেকোরেশনের জন্য ফ্রেশ ক্রিম, চিজ, বাটার, চিনি, ভ্যানিলা ইত্যাদি ফ্রিজ থেকে বের করে পরিমাণমত একটা বাটিতে নিয়ে আবার ফ্রিজে রেখে দিল। বাটিটা ওর ঘরে রেখে আবার রান্নাঘরে ফিরে এল। রান্নাঘরের লাইট বন্ধ করে চোরের মত অপেক্ষা করতে লাগলো কেকটা বেক হবার জন্য। আর আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলো যাতে মা এত তাড়াতাড়ি না ওঠে। যদিও মা ভোরে উঠে নামাজ পড়লেও ৬ টার আগে নিজের ঘর থেকে বের হন না। তবু ভয় ভয় করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর পায়ের আওয়াজ পেতেই বুক কেপে উঠলো তিতিরের। মা? যদি মা হয় কি বলবে ও এখন? ফ্ল্যাটের মেইন দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তিতির বুঝলো মা না, বাবা নামাজ পড়তে যাচ্ছে। ২০ মিনিট পর ওভেন থেকে কেকটা নামিয়ে কেকের মাঝখানে টুথপিক ঢুকিয়ে দেখলো বেক হয়েছে কিনা। হয়নি, আবার দিল ৫ মিনিটের জন্য। ৫ মিনিট পর একইভাবে চেক করে দেখলো বেক হয়ে গিয়েছে। ওভেন বন্ধ করে কেকটা নামিয়ে নিল। তারপর কেকটা হাতে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। দরজা লাগিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক মা ওঠার আগে সব করতে পেরেছে। ফ্যান ছেড়ে কেকটা ঠান্ডা হতে দিয়ে গরম পানি নিয়ে গোসলে ঢুকলো তিতির।
গোসল করে বেড়িয়ে মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে তিতির কেকটা ডেকোরেশন করতে বসলো। কেকের মাঝ থেকে কেটে তিনটা ভাগ করে নিল। একটি বাটিতে ফ্রেশ ক্রিম, চিজ, বাটার, চিনি, ভ্যানিলা দিয়ে বিট করে নিল। এরপর মিশ্রণটি কেকের নিচের অংশে খানিকটা দিয়ে কেকের আরেকটা অংশ দিয়ে চাপা দিল স্যান্ডউইচের মতো করে। তারপর আবার একইভাবে ক্রিমের মিশ্রণটি ঢেলে কেকের আরেকটা অংশ দিল। এবার কেকের উপরে চকলেট চিপস ও সুইট বল দিয়ে হালকা ডেকোরেশন করলো। ব্যাস রেড ভেলভেট চিজ কেক রেডি। কেকটাকে যত্ন করে বক্সে ঢুকিয়ে সরাসরি ব্যাগে চালান করে দিল তিতির।
আলমারি খুলে মুগ্ধর দেয়া চিকন সিলভার পাড়ের গাঢ় নীল শাড়িটা বের করলো তিতির। শাড়িটা শুধু একবারই পড়েছিল। শাড়িটা ওর খুব পছন্দের যাতে নষ্ট না হয়ে যায় তাই বেশি পড়ত না ও। শাড়িটা পড়ার সময় কুচি দিতে দিতে আয়নায় একবার তাকালো। বাহ বেশ লাগছে তো! শাড়ি পড়া শেষ করে কানে সিলভার একটা ঝুমকা পড়লো। গাঢ় করে কাজলে চোখ আঁকলো। তারপর কপালে বড় একটা নীল টিপ পড়লো। হাতে কয়েকটা চুড়ি পড়লো। চুলগুলো খোলাই রাখলো। সাজ কমপ্লিট! এবার আয়নায় নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখলো, সব ঠিকঠাক আছে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে ৭ টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে কি করবে! আধাঘন্টা শুয়ে রইলো। ৮ টা বাজতেই ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং এ গেল তিতির। টেবিলে বাবা, মা, ভাবী। ভাল হয়েছে ভাইয়া নেই, ও বোধহয় অফিসের জন্য বেড়িয়ে গিয়েছে, ৮ টায়ই বের হয় প্রতিদিন। ওকে দেখেই মা বলল,
-“বাহ, সুন্দর লাগছে তো তোকে। লিপস্টিক পড়িসনি কেন?”
-“লিপস্টিক ভাল্লাগেনা মা।”
-“তুই না একদম কেমন জানি!”
বাবা বলল,
-“কি দরকার? আমার মেয়ে তো এমনিতেই সুন্দর।”
তিতির খাওয়া শুরু করলো। ভাবী বলল,
-“সত্যি তিতির, তোমাকে কিন্তু সত্যি অনেক সুন্দর লাগছে।”
মা বলল,
-“কি রে? আজ এত সাজগোজ? আবার শাড়িও পড়েছিস দেখছি।”
-“সব ভুলে যাও নাকি? তোমাকে বলেছিলাম না সেদিন আজ অফিসের পিকনিক। সব কলিগরা শাড়ি পড়বে, আমাকেও ধরলো। কি আর করা, পড়লাম।”
-“মাঝে মাঝে শাড়ি পড়বি, ভাল লাগে দেখতে।”
তিতির হেসে বলল,
-“আচ্ছা।”
নাস্তাটা শেষ করেই তিতির বেড়িয়ে পড়লো। ব্যাগটা খুব সাবধানে নিচ্ছিল ও, যাতে কেকটা নষ্ট না হয়, যদিও কিছু হবে না কারন কেকটা বক্সেই আছে তবু সাবধানের মার নেই। সুহাসের সাথে এঙ্গেজমেন্ট হওয়ার ৪/৫ মাস হলো! এঙ্গেজমেন্টের পর থেকে মা কত ভাল ব্যাবহার করে! আবার আগের মত। আসলে বাবা-মায়েরা সবসময় সন্তানের ভাল চান। কিন্তু ভাল চাইতে গিয়েই অনেক সময় কষ্ট দিয়ে বসে, বুঝে উঠতে পারেনা সন্তানের আসল ভালটা কোথায়! জেনারেশন গ্যাপের কারনেই এটা হয়। কিন্তু সন্তানরাও তো বাবা-মাকে তার চেয়েও বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলে মাঝে মাঝে, বুঝে দিক আর না বুঝে দিক তিতিরও কম কষ্ট দেয়নি বাবা-মা কে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত থেকে আংটিটা খুলে টিস্যুতে পেঁচিয়ে ব্যাগের পকেটে রাখলো তিতির। রাতে বাসায় ফেরার সময় আবার পড়তে হবে।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।