
Chapters
ভয়ে কাঁপতে থাকা প্রানেশা পাত্রের দিকে তাকিয়ে লজ্জা ভুলে হা করে তাকিয়ে থাকলো৷ সকাল থেকে তার মায়ের বকাবকির কারণে পাত্রপক্ষের সামনে বসেছিলো সে। নার্ভাসনেসের জন্য নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ফ্লোরে ঘষছিলো৷ পাত্রের দিকে ভূলেও তাকায়নি৷ হঠাৎ নাম জিজ্ঞেস করায় প্রানেশার মনে হলো অতি পরিচিত কেউ।
প্রানেশা ধপ করে নিচে বসে পড়লো৷ কী করে সম্ভব এটা? যদি রেয়ান সিঙ্গাপুরেই থাকে তাহলে দুইদিন আগেও এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো সে কে? প্রশ্নে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নাহ,আর চুপ করে থাকা যাবে না। নাহলে ভালোবাসা চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলবে প্রানেশা।
হালকা হালকা আলোর মাঝে চুপ হয়ে বসে আছে প্রানেশা। মনের অসংখ্য প্রশ্নগুলোকে দমিয়ে অপেক্ষা করছে রেয়ানের মতো দেখতে বহুরূপীর। এক ঘন্টা হলো প্রানেশাকে রুমে এনে বসানো হয়েছে। পরিবেশ ঠান্ডা হলেও ভারি শাড়ি পড়ে শ্বাস ছাড়তেও নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে প্রানেশার। খট করে আওয়াজ হতেই প্রানেশা দরজার দিকে তাকালো।
প্রানেশার গাল ছেড়ে সুফিয়ান উঠে দাঁড়ালো৷ প্রানেশা পাথরের মতোন শক্ত হয়ে বসে আছে। সুফিয়ান এক গ্লাস পানি পান করে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে বিছানায় শুয়ে প্রানেশাকে টেনে নিজের বুকের উপর শোয়ালো।
সদর দরজার দিকে সবার দৃষ্টি গেলো। ট্রলি হাতে দাঁড়িয়ে আছে রেয়ান। প্রানেশা উঠে দাড়িয়ে রেয়ানের কাছাকাছি যেতে নিলে সুফিয়ান হাত ধরে ফেললো৷ প্রানেশা দেখলো সুফিয়ানের মাঝে কোনো প্রকার অবাকের ছাপ নেই৷
ঘুমের ইনজেকশনের কারণে সারা রাত ঘুমিয়ে ছিলো প্রানেশা। সকাল আটটায় ঘুম ভেঙে গেলো। শরীর বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে। আড়মোড়া ভেঙে বসতেই রাতের কথা মনে পড়লো তার।
সুফিয়ান ডাকতে নিয়েও আর ডাকেনি। চাদর মুড়ে দিয়ে প্রানেশাকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলো। কিন্তু নিজে ঘুমায়নি, শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো। ভোরের দিকে ঘুম ভাব ধরা দিলো। তখন প্রানেশাকে কোলে শুইয়ে দিলো নাহলে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে।
প্রানেশা আজ সকাল বেলা উঠেছে। ছয়টায় উঠে সবার জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করে টেবিলে পরিবেশন করছে। মিসেস অদিতি, মিস্টার রাহাত নিচে নেমে এসব দেখতেই অবাক হলেন। মিসেস অদিতি প্রানেশাকে বললেন- ‘আরে! এসব কী করছো তুমি? এত কষ্টের কেনো করতে গেলে? ‘ প্রানেশা মুচকি হেসে হাতের পায়েসের বাটিটা টেবিলের উপর রাখলো।
প্রতিদিনের তুলনায় আজ একটু দ্রুতই ফিরে এলো বাড়িতে সুফিয়ান। মিসেস অদিতি ড্রইংরুমে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। সুফিয়ানকে বাসায় তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। মনে মনে ভয় পাচ্ছেন তিনি, সুফিয়ানকে প্রানেশা বলে দেয়নি তো? সে ভেবেছিলো এসে তাকে সবার প্রথমে ধরবে সুফিয়ান।
সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সকাল সাতটায় রওনা হলো সুফিয়ান ও প্রানেশা। ঘুরতে যাওয়ার আগের দিন রাতে কখনোই প্রানেশার ঘুম আসে না। দুইটার দিকে সুফিয়ান বকে ঘুম পাড়িয়েছে৷
উত্তাল বাতাসের ধাক্কায় জামা কাপড় তাল মিলিয়ে উড়ছে। চুলগুলো মুখ ঢেকে দিচ্ছে বারংবার, তিন চার সরিয়ে দিয়েছিলো প্রানেশা। এখন আর বলছেনা, নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে টানটান হয়ে তাকিয়ে আছে সে। সকাল বাজে আটটা। দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ায় চোখের পাতা থেকে নিদ্রা বিদায় নিয়েছে। হাত মুখটা ধুয়ে এক ড্রেসেই জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
এক হাতে প্রানেশাকে জড়িয়ে আরেক হাত পকেটে গুঁজে হাঁটছে সুফিয়ান। প্রানেশা বেজায় খুশি। এক্সাইটমেন্টে তার হাত পা কাপছে। অনলাইন, ম্যাগাজিন, টিভি নিউজে বিভিন্ন জায়গায় নুসা লেম্বগান আইসল্যান্ডের সৌন্দর্যের বিস্তারিত শুনেছে। বিশ্বাসই হচ্ছেনা তার, যে আজ সেও এই জায়গা ঘুরবে, হাত দিয়ে ছুয়ে দেবে।
প্রানেশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে সুফিয়ান। এই পনেরো মিনিট যাবৎ অনবরত হিচকি তুলে কান্না করেছে প্রানেশা। এখন মনে মনে নিজেকেই বকছে সুফিয়ান। প্রানেশার ওয়াটার ফোবিয়া আছে৷ এই কথাটা সুফিয়ানের মনে ছিলো না। নিজের প্রতি এত রাগ কখনো লাগেনি যতটা আজ লাগছে।
মেঘ জমতে জমতে ঘন এক আস্তরণ ফেলেছে আকাশের বুকে ৷ হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নিকষ কালো আধার জাপটে ধরেছে আলোকে ৷ যেনো কোনোভাবেই আলোকে পৃথিবীর বুকে যেতে দেবেনা। আলো প্রাণপণে চেষ্টা করছে বিধায় এখন অব্দি হালকা আলোর রেশ দেখা যাচ্ছে।
আপন মানুষের হঠাৎ বদলে যাওয়া আমরা কখনোই মেনে নিতে পারিনা। আমরা ভরকাই, চমকে যাই, হতবাক হই। আর তা যদি নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষ ‘স্বামী ‘ নামক মানুষটি৷ তাহলে, আঘাতের পরিমাণ হয় আরও দগদগে।
‘প্রাণ, যদি শোনো। আমি একজন খুনী, তাহলে তুমি কী আমায় ঘৃণা করবে!’ কথাটা ভীষণভাবে আকুতিভরা টলটলে শোনালো প্রানেশার কানে৷ প্রানেশা সুফিয়ানের ঠিক বাম পাশে হাঁটুতে মাথা দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে ছিলো। খুনের কথা শুনে প্রানেশার হয়তো এই মূহুর্তে আতংকিত হয়ে চেচামেচি করে ওঠার কথা অথচ সুফিয়ানের মায়া চোখের উপর
সেসময়টা ছিলো খুব প্রাণবন্ত, জীবন্ত । আমরা সবাই মিলে ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। ফায়েজ বললো সিঙ্গাপুরের কথা, জয় বললো লন্ডন, কিন্তু আমি আর ইভানান ঠিক করলাম দেশের ভেতরে কোথাও ঘুরার। ফায়েজ বললো ওর নানা বাড়িটা খুব সুন্দর। সেখানে পুরনো জমিদার বাড়ি, একটা লেক, একটা পার্ক আর জিন বাড়ি
কোকিলপুর ‘ গ্রামের থেকে সুফিয়ান ফিরেছে আজ এক মাস। এই এক মাসে সুফিয়ান প্রতিটি নিঃশ্বাস নেয়ার সময় প্রানেশাকে মনে করেছে। গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছে ওই অচেনা মেয়েটাকে ছাড়া শান্তিমতোন নিঃশ্বাস নেয়া সম্ভব না। মেয়েটার ওই ভেজা ঠান্ডা পবিত্র মুখটা প্রতি রাতেই সুফিয়ান স্বপ্ন দেখে।
‘এমন হাসছিস কেনো তুই? ‘ প্রানেশার মা মিসেস আরা খাবার বাড়তে বাড়তে প্রশ্ন করলো প্রানেশাকে ৷ প্রানেশা তখন মগ্ন তার মনের মানুষের চিন্তায়। আজ ছয়মাস যাবৎ সেই অজানা লোকটার সাথে কথা বলছে সে৷ কিছুক্ষণ আগেই ফোন দিয়ে পাগলামো কথাবার্তা বলে প্রানেশাকে হাসালো৷ প্রাণেশার এখন একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে যেনো।
লাইব্রেরির একটা কোণায় বই হাতে বসেছিলো রেয়ান। মন দিয়ে প্রতিটা লাইনে ডুবে আছে। টেবিলের সামনে দুই জোড়া জুতোআলা পা দাঁড়াতেই উপরে মাথা তুললো রেয়ান। দেখা গেলো নীল চোখের পুরুষকে, অর্থাৎ ইভানান। চোখে প্রতিদিনের মতোন চশমা নেই।
এক্সিডেন্ট হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা পর ডাক্তাররা সুফিয়ানের পরিবারকে জানালো, আল্লাহর রহমতে সুফিয়ান বেঁচে থাকলেও গলায় জখম হওয়ায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই, সুফিয়ানের গলা রিকোভার করতে কয়েক মাস সময় লাগবে।
গৌধুলি পেরিয়ে সন্ধ্যার ঘ্রাণ ঘনিয়ে আসছে। দিক দিগন্তের নানান মানুষ হালকা আনাগোনা শুরু করেছে, তাদের বেশীর ভাগই সদ্য বিবাহিত। তাই প্রেমও মাখোমাখো।
বাহিরে বোধহয় হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। সুফিয়ান বুকে গুটিয়ে থাকা যুবতীর দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো৷ ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে গেছে প্রাণেশা, গাঁয়ের সঙ্গে নিবিড় হয়ে লেপ্টে আছে। উপরে একটা কম্ফর্টার দেয়া আছে গায়ে, কিন্তু তারপরও প্রাণেশার ঠান্ডা কমছে না।
‘রেয়ান, তুমি বলেছিলে তোমার বড় ভাই আছে। মা বাবার ছবি দেখালেও ভাইয়ের ছবি তো দেখালে না! ‘ তখন সম্পর্কের বয়স চার বছর। এর মধ্যে প্রানেশার মনে নানারকম সন্দেহের উৎপাত হয়েছে। প্রানেশার শুধু মনে হতো রেয়ান কিছু লুকাচ্ছে।
অন্যান্য দিনের চেয়ে সেই সকালটা ছিলো অন্যরকম। আকাশ তখন হলদে রঙে সেজেগুজে হাজির হয়েছে। নারীর দেহে অলংকারের ন্যায় আকাশেরও হলদে রঙ বেশ শোভা ছড়াচ্ছে। না আছে রোদ আর না আছে কোনো মেঘলা ভাব। চমৎকার একটা পরিবেশ। এরকম একটা সময়ে ভালোবাসার মানুষের হাতটা যদি নিজের মুঠোয় থাকে তাহলে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে বেশি
আজ আনন্দরা দলবদ্ধ হয়ে যেনো ধরা দিয়েছে। কী সুন্দর অনুভূতি! পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর ঘটনা বুঝি এটিই? নাহলে সুফিয়ানের চোখের কোণে জল জমবে কেনো? ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহের ভিতর ভর করলো সজীবতা।
আজ আনন্দরা দলবদ্ধ হয়ে যেনো ধরা দিয়েছে। কী সুন্দর অনুভূতি! পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর ঘটনা বুঝি এটিই? নাহলে সুফিয়ানের চোখের কোণে জল জমবে কেনো? ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহের ভিতর ভর করলো সজীবতা। ক্লান্ত হয়ে ফিরে যে এত বড় সুসংবাদ পাবে ভাবতেই পারেনি সে৷ হাতে এখনো চিরকুট মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে।
বেঁচে থাকতে হলে সুখ দুঃখ দুটিরই স্বাদ সমানভাবে আস্বাদন করতে হবে। সব মিলিয়েই জীবন। সারাজীবন সুখ অথবা দুঃখ একাধারে পাওয়া সম্ভব না। প্রকৃতির এই বানানো নিয়মে জগৎ সংসার চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। তা-ই তো বলা হয় – ‘ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন ‘
সুফিয়ানের কথায় প্রতুত্তর করতে পারলো না প্রানেশা। এতক্ষণের সকল ক্ষোভ যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সুফিয়ান যেনো তার দোষ গুলো তার চোখের সামনে তুলে ধরলো ৷ ঠিকই তো বলেছে সুফিয়ান! না জেনেই হোক রেয়ানের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলো সে। প্রানেশা যেমন সত্যি জানতো না তেমন সুফিয়ানও ধোঁয়াশায় ছিলো। সে হিসেবে দুজনেই বরাবর অপরাধী৷
গমগমিয়ে বৃষ্টির আওয়াজ রোজকার মতো আজ আর স্নিগ্ধ মোহময় হয়ে ধ্বনিত হচ্ছে না। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো শোনাচ্ছে কোনো এক কিশোরীর আর্তনাদের ন্যায়। এমনটাই অনুভূত হচ্ছে কাঁচের তৈরি আবদ্ধ কক্ষে।
আকাশের রঙ আজ পরিষ্কার। গাছে গাছে নতুন ফুল ফুটেছে ৷ ফুটবেই তো আজ যে বসন্ত! বসন্তকাল জুড়েই তো নানা রঙের ফুল ফলালির ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে ওঠা। রাস্তায় লাল ফুল বিছিয়ে পড়ে আছে। প্রকৃতি নতুন রঙে সেজেগুজে নবাবী ভঙ্গিতে হাসলো যেনো। আহা! এই সুন্দর রূপে ডুবিয়েই ছাড়বে সবাইকে।