“ভালোবাসি” শব্দটা উচ্চারন করার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাম গালে শক্তপোক্ত এক চ*ড় বসালেন ধূসর ভাই। কান,মাথা,গাল ঝিমঝিম করে উঠল আমার। ভোঁ ভোঁ করে ঘুরল সমগ্র পৃথিবী। হতবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। ধূসর ভাইয়ার র*ক্তাভ চোখদুটো আমাতেই নিবদ্ধ। ক্রো*ধে ফুঁ*সছে তার চোখা নাক। এই আঠের বছরের জীবনে কোনওদিন মা*র না খাওয়া আমি, আজ যেন কথা বলার
আ*হত হলাম। ধূসর ভাই খুঁজে খুঁজে ওষুধের একটা পাতা বের করলেন। সেখানে থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ” খা।”
সারাটা কলেজ আমি রবিনকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। ক্লাশেতো পাই-ইনি,এমনকি ফোনেও না। গত কাল ধরে লাগাতার ফোন দিয়েছি অথচ ছেলেটা ধরেনি। সেই যে শেষবার পালাতে বললাম তারপর আর না। ধূসর ভাই ওকে পেলেন কী না,ওর সাথে দেখা হলো কী না,কী কী বললেন, এসব জানার জন্যে আমার ভেতরটা আঁকুপাঁকু করছিল। ধূসর
”তুই?” এই সামান্য দুই শব্দের বাক্যটা ধূসর ভাই এমন ধ*মকে শুধালেন,আরেকটু হলেই প্রানপাখিটা উড়ে যাচ্ছিল প্রায়। গত তিনবছর ধরে ধূসর ভাইয়ের রামধম*ক খেয়ে পরে বেচে আছি। হিসেব মতো এ আমার কাছে ডালভাত হওয়ার কথা। অথচ প্রতিটা বার আমি ভ*য়ে আড়ষ্ট হই,লাফিয়ে উঠি শ*ঙ্কায়। এই যেমন এখন হলো! ওনার
সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ বাড়ি। অথচ বসার ঘর মানুষজনে ভর্তি। সামান্যতম জায়গা হয়ত ফাঁকা! রাত প্রায় দশটা বাজে। এক ঘর মানুষের মধ্যে গম্ভীর চোখমুখ নিয়ে বসে আছেন বাবা আর চাচ্চুরা। তাদের ঠোঁটে বিন্দুমাত্র হাসি নেই। মেজো চাচ্চুর হ*তাশ,বি*ধ্বস্ত মুখভঙ্গি। আমার বাবা যতটা গর*ম,শ্বশুর মশাই ঠিক ততটাই নরম আর শান্ত গোছের।
সূর্য ওঠে,আলো ফোটে,সকাল হয়। শুরু হয় পিউয়ের ব্যস্ততম জীবন। দশটা থেকে কলেজ,আর চারটা থেকে কোচিং। এরপরে আবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে প্রাইভেট টিউটরের এক গাদা পড়া। সামনে ধেঁয়ে আসছে এইচ- এস-সির তা*ন্ডব। ভালো রেজাল্ট চেয়ে বসে আছে সবাই। প্রত্যেকের এক কথা ‘এ -প্লাস চাই পিউ’।
আমজাদ সিকদারের মে*জাজ তুঙ্গে। ক্রমে ক্রমে ফুঁ*সছে পুরু নাকের পাটা। দাঁত কি*ড়মিড়িয়ে দোল খাচ্ছেন কেদারায়। তন্মধ্যে ঘরে ঢুকলেন মিনা বেগম। সন্তপর্ণে দোর চা*পিয়ে নরম পায়ে এগিয়ে এলেন। স্বামীর রা*গত মুখচোখে দেখে অ*তিষ্ঠ ভঙ্গিতে দুদিকে মাথা দোলালেন। সুস্থে ধীরে ডাকলেন, ” শুনছেন!” আমজাদ সিকদার তাকালেন না।
সাদিফ চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে। মেঝের দিকে ভ্রুঁ গুঁটিয়ে তাকানো। তার মুখমন্ডল জুড়ে ধূসরের সুক্ষ্ম চাউনীর বিচরন। ধূসর একই কথা আবার শুধাল, ” বললি না,কত টাকা দিয়ে নিয়েছিস?” সাদিফ যথোপযুক্ত উত্তর খুঁজে পেল না। চশমা ভা*ঙা নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলল কী? নাহলে ধূসর কোনও দিন এভাবে জিজ্ঞেস করতে আসতোনা
আজ শুক্রবার। সাদিফ ব্যাতীত বাকিদের অবসরের দিন। ছেলেটা ছুটি পায় কেবল রবিবার৷ যেখানে পুরো বাড়িটায় এই দিন সবাই হৈহৈ করে মাতায়,সেখানে সাদিফ খা*টুনি খাঁটে অফিসে। জবা বেগমের মন খা*রাপ হয় মাঝেমধ্যে। সন্ধ্যায় সবার চায়ের আড্ডায় এইদিন সবাই যোগ দেয় যেখানে,তিনি ভীষণ ভাবে মিস করেন ছেলেকে।
পুষ্পর একটি চি*ন্তাযুক্ত সকাল আজ। মিনা বেগম প্রত্যেক দিন নামাজ পড়তে উঠে দুই মেয়ের দরজা ধা*ক্কান,নামাজের জন্যে ডাকেন। পিউ ম*রার মত ঘুমায়। টের পায়না প্রায়সই। ডাক কানে গেলে উঠে যায় অবশ্য। কিন্তু এদিক থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে পুষ্প। ধা*ক্কাতে ধা*ক্কাতে হাত খুলে গেলেও সে ওঠেনা।
পিচঢালা রাস্তায় গাড়ি ছুটছে। ধূসর ড্রাইভার হিসেবে মন্দ নয়। ভালোই চালায়। পিউ বসেছে একদম বরাবর ওর পেছনে। ধূসরের গাল ছাড়া কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেনা। পিউ খুশখুশ করল কিছুক্ষন। ভিউ মিররের কথা মনে পড়তেই চট করে তাকাল সেদিকে। ওইতো স্পষ্ট প্রতিবিম্ব ভেসে আছে ধূসরের। পিউ মুচকি হেসে চেয়ে থাকে সেদিকে।
ইকবাল, গাড়ির দরজা খুলে রেখেছে আগেই। ধূসর,পিউকে কোলে নিয়ে এসে বসাল সিটে। পা দুটো ঝুলিয়ে রাখল বাইরের দিক। র*ক্ত পরা তখনও থামেনি। অথচ পিউ কা*ন্নাকা*টি করছেনা। সে ফ্যালফ্যাল করে এখনও তাকিয়ে। ধূসর পিউকে বসিয়ে নিজেও ফের হাটুভে*ঙে ওর সামনে বসে। ইকবালের বাড়িয়ে দেয়া ফার্স্ট এইডের বাক্স থেকে তুলো নিয়ে
ব্যাগ থেকে খুচরো টাকা বের করে বাদামওয়ালাকে দিলো পুষ্প। পুরনো নিউজপেপারে মোড়ানো বাদাম গুলো হাতে বয়ে বেঞ্চে বসল। কাধব্যাগটা রেখে দিলো পাশে। একটা একটা করে বাদাম ছিলে ছু*ড়ে ছু*ড়ে মুখে ভরল। ছোট খাটো পার্কের এই জায়গাটা সবচেয়ে নিরিবিলি। মানুষ জন কম আসে।
বিকেল হতে না হতেই বাড়ির গৃহীনিরা ছুটেছেন শপিং মলে। বিয়ে উপলক্ষে জমিয়ে কেনাকা*টা করবেন আজ। সাথে বগলদাবা করে নিয়ে গেলেন,রাদিফ আর রিক্তটাকেও। আপাতত বাড়ি শূণশাণ। সাদিফ,পিউ,পুষ্প ছাড়া কেউ নেই। আর তারা তিনজনই নিজেদের ঘরে। পিউ আজকেও উশখুশ করছে। একটু পরেই পড়াতে আসবে মারিয়া। আর সে কিছুতেই চায়না মেয়েটার কাছে
“ফোন ধরেছিলি কেন?” পিউ ভ*য়ে ভ*য়ে জানাল, ” এ..এমনি।” ” মিথ্যে বলছিস। ” ধূসরের অগাধ স্বরে পিউ ছ*টফট করে। এলোমেলো পাতা ফেলে চোখের। কী উত্তর দেবে এখন? সত্যিটা জীবন গেলেও বলতে পারবে না। ধূসর ভাই জানলে ক*বর দিয়ে দেবেন।
ধূসরের অপেক্ষা ফুরোচ্ছেনা। আর কতক্ষন বসে থাকবে এভাবে? সে বেজায় বির*ক্ত। ফোন টি*পতে টি*পতে অসহ্য লাগছে এখন। তবুও উঠে রুমে গেল না। আগে ছেলেটাকে দেখবে তারপর যাবে। এমন কোন রাজপুত্র, যাকে পিউয়ের এত্ত পছন্দ!
‘উনি? উনি কে?’ শান্তা নাজুক স্বরে জানাল ‘ ধূসর ভাই।’ হাবভাব দেখে পিউয়ের মাথা গরম হয়। নামটা বলার সময় এত লজ্জ্বা পাওয়ার কী আছে? কোমড়ে হাত দিয়ে বলল, ‘ উনি কী? ভাইয়া বলতে পারিস না?’
পিউয়ের মনে বৃষ্টি নেমেছে। খড়খড়ে মরুভূমিতে ঝুমঝুম শব্দের বারিপাত,উথাল-পাতাল করে দিচ্ছে ভেতরটা। প্রশান্তির হাওয়া বারেবার ছুঁচ্ছে কোমল,স্নিগ্ধ মুখমন্ডল। লজ্জ্বায় হাতদুটো জায়গা পাচ্ছে বক্ষে। হৃদস্পন্দন হচ্ছে কয়েকশ গুন বেশি৷ ধূসর ভাইয়ের এই আচরন তার কাঙ্ক্ষিত, তবে অপ্রত্যাশিত।
শীতল হুম*কিতে পিউয়ের নেত্র পল্লব কেঁ*পে ওঠে। সমস্ত দেহ ঠান্ডায় আঁটশাঁট। ধূসরের তীক্ষ্ণ,ধাঁ*রালো চাউনি হৃদয় নাড়িয়ে দেয়। ধূসর রুমের চারকোনায় চোখ বোলায়। খুঁজছে কিছু। পরপর এগিয়ে যায় নাক বরাবর। দাঁড় করানো লাগেজটা হাতে তোলে।
মুখ লুকানোর জো নেই। গ্রামের চারদিকে খবর ছড়িয়েছে। যে লোক বাড়িতে এসে বলেছেন,তিনিই মুলহোতা এর। এখন কী হবে? মান ইজ্জ্বত কিচ্ছু বাকী আছে? আমজাদ সিকদার চোখ রাখলেন মেঝেতে।
‘ শান্তা ওর হাতে আপনার নাম লিখেছে ধূসর ভাই। ও কেন লিখবে আপনার নাম? আপনার নাম শুধু আমি লিখব,আর কেউনা।’
পিউয়ের গাল ভিজে চুপচুপে। ঘন পাপড়ি বেঁয়ে পানি পরছে এখনও। দুরুদুরু বুক কাঁ*পে। ভেতরটা ছটফটায়। উদগ্রীব,ব্যকুল চোখদুটো সম্মুখের লম্বাচওড়া মানুষটার মুখমন্ডলে। এই যে সে কাঁ*দলো, অনেক শোকে হা-হুতাশ করল, এসব কী ধূসর ভাই কে পারল ছুঁতে?
কাজ ফেলে ছুটে এলেন তারা। জিজ্ঞাসা নিয়ে সাথে এলেন বাকীরাও। মিনা বেগম শুধালেন, ‘ কী হয়েছে?’ ‘ ওনারা এসে গেছেন। ‘ এক বাক্যে তটস্থ হলো সবাই। বসে থাকা সকলে তৎপর উঠে দাঁড়াল।
সাদিফ ভেজা তোয়ালে চেয়ারের হাতলের ওপর রাখল। হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। পড়নে কালো ট্রাউজার শুধু। উদাম ফর্সা গা বেয়ে পানি পরছে এখনও।
মৈত্রী কাঁ*দছে। চকচকে অশ্রুতে গাল ভেজা। জীবনের এতগুলো বছর কেটেছে,অসংখ্য ছেলের থেকে পেয়েছে প্রেমের প্রস্তাব। কখনও ফিরে তাকায়নি অবধি। অথচ এই প্রথম বার কাউকে ভালো লাগল,ভালোবাসল,কিন্তু মানুষটা রইল অধরা।
শান্তা ভ্রুঁ তুলে বলল ‘ দু-হাজার কম দিলো?’ ‘ তাইতো দেখছি।’ ‘ কত্ত বড় ধরিবাজ! ঠকালো আমাদের। দেখাচ্ছি মজা!’ সে তে*ড়ে যেতে নিলে পুষ্প থামিয়ে দিল। টেনে ধরে বলল ‘ যাসনা! এখন বললেও বিশ্বাস করবেনা।
পুষ্পর সরু নাক লালিত। একটু পরপর ফুলছে কান্নায়। ঠোঁটদ্বয় চেপে রেখেছে। মলিন চেহারা আর ভেজা দুটো চোখ চেয়ে আছে গেইটের দিকে। যেখান থেকে এইমাত্র গত হলো সৈকতদের গাড়ি। পুষ্পর চোখ ভরে ওঠে ফের।
পুষ্পর সঙ্গে সেই লুকোচুরি, প্রেম -প্রেম চোখাচোখি পর্যন্ত হয়নি। মেয়েটারও যে মন খা*রাপ! সেই যে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়েছে,আর ফেরেনি কোনও দিক। ধূসর ভাইয়ের অন্ধকার চেহারা প্রভাব ফেলেছে ওর মনেও।
পুষ্পর চোখ,মনোযোগ সেদিকে সরতেও পারল না,চট করে ওকে ঘুরিয়ে কাছে টেনে নিল । মেয়েটা চোখ বড় বড় করে তাকায়। শরীর শিহরিত হয় ইকবালের বুকের সঙ্গে মিশে।
‘ আই লাভ ইউ জান। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। বাঁচতে হলে একসঙ্গে বাঁচব,ম*রতে হলে একসঙ্গে মর*ব। আমাকে ছেড়ে যেওনা, প্লিজ জান।’
মেয়েটা ওভাবে কেন বলল? কোন অপরা*ধে? জেনে-বুঝে ওর কোনও ক্ষ*তি আদৌ কি করেছে? আর কেনই বা ওমন ফুটফুটে মেয়েটা আত্মহ*ত্যা করতে যাচ্ছিল? আচ্ছা, ধূসর ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে কী!
পিউয়ের ওষ্ঠযূগল ঠকঠক করে কাঁ*পছে। ভ*য়ার্ত দুটি আঁখি ধূসরের র*ক্তাভ চেহারায়। ফর্সা মানুষ কাঁ*দলে, হাসলে,লাল হতে দেখেছে সে। কিন্তু শ্যামলা বর্নেও ধূসর লালিত হয়, অতিরিক্ত ক্ষো*ভে। নিঃশ্বাসে পায় হিঁসহিঁস শব্দ।
পিউ ঘুরিয়ে পেচিয়ে আগের প্রসঙ্গে ফিরে এলো। কণ্ঠ নরম করে বলল ‘ আপনাকে দেখে কখনও মনে হয়নি আপনি সব জানতেন। ‘ ধূসর বক্র হাসে। যেন কৌতুক শুনল কেবল। হাসিটা পিউকে বিভ্রমে ভোগাতে যথেষ্ট।
ইকবাল চলে এলো। ব্য*র্থ হয়ে বেঞ্চে বসল। পুষ্প কী রা*গ করবে সে ফুল না দিলে? তার ভাবনার মধ্যে কেউ একজন চে*পে ধরে দুই চোখ। খানিকটা হকচকাল সে। পরপর মুচকি হেসে হাতদুখানি আক*ড়ে ধরল।
পিউ হাঁস*ফাঁস, হাঁস*ফাঁস করে। অস্থির চিত্তেও শান্ত হয়ে বসে থাকে। লাজুকলতার ন্যায় গুটিয়ে রয় দেহ। বক্ষে তখন উথাল-পাতাল। ধড়াস ধড়াস লাফাচ্ছে হৃদপদ্মের ছোট্ট অবাধ্য খাঁচা।
বিভ্রান্ত নজর একবার স্ত্রীর চেহারায় বোলালেন। তাকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে। আজমল দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার ভাইয়ের পানে তাকালেন। ইতস্তত করে বললেন, ‘ ইয়ে,আমি কি কোনও ভুল কিছু চেয়ে বসলাম ভাইজান?’
পুষ্প বহু ক*ষ্টে ঘর অবধি এলো। তার পা চলছে না। এতটা ভারি হয়ত পাথরখন্ড ও হয়না। গলবিলে দলা পাঁকানো কা*ন্নার পরিমান হুহু করে বাড়ছে। কত ক*ষ্টে এতটা সময় চে*পে রেখেছে কেউ জানেনা।
পিউ খুব বির*ক্ত হলো। কপাল কুঁচকে বলল, ‘ সাদিফ ভাইয়ের কাছে কেন যাবি? উনি যে কিছু করবেন না সেতো জানা কথা।’
পুষ্পর দিয়ে যাওয়া বিশেষণ’ তুমি স্বার্থ*পর!’ কানে বাজছে নিরন্তর। সে কী আসলেই স্বার্থ*পর? এই পরিবারের জন্য সত্যিই বিষা*ক্ত? কেন? কেন সে স্বার্থ*পর হবে? পুষ্পটা তো জানেনা,পরিবারের সবার ওপর সেও না বলতে পারেনি। মেয়েটা দুবছর ধরে ভালোবেসে কেঁ*দে ব্যকুল।
ইকবাল আপ্লুত চোখে বন্ধুর দিক চেয়ে থাকল। সেই চোখ জ্ব*লে উঠল পরপর৷ কোটর ছড়িয়ে পল্লব ছুঁলো। বদনের ঘাম মোছার ভাণ করে মাথা নীচু করে শার্টের হাতা দিয়ে মুছে নিলো জল।
ইকবাল দাঁত কিড়*মিড় করল। দুপাশের চোয়াল মটমট করে ওঠে। চোখের পাশের পেশী গুলো অভ*ঙ্গুর। অদৃশ্য ভাবে সাদিফের গালে এলোপাথাড়ি থাপ্প*ড় বসাল সে।
কারো মুখে কথা নেই,চোখ ভাষাহীন। শুধু ক*ম্পিত হাত পা, আর ভ*য়ার্ত দুই লোঁচন নিবদ্ধ সিড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়ানো দুটো মানুষের ওপর। রুবায়দা ছুটে গিয়ে পিউকে আগলে ধরলেন।
বোনের ভালোবাসার গভীরতা হৃদয় দিয়ে মেপে নেয়। বিলম্বহীন জড়িয়ে ধরে দুহাতে। পিউ পালটা আকড়ে ধরল। পুষ্প ওমনভাবেই আবদার করল, ‘ আজ থেকে আমার সাথে ঘুমাবি? ‘ ‘ আচ্ছা।’
মেয়েটা অপ্রতিভ ভঙিতে সবার দিকে তাকায়। ইকবালের দুগাল লেপ্টে সরে গেল দুদিকে। ধূসরকে কষে একটা চুমু খেতে পারতো যদি! কেউ কিছু বলল না। পুষ্পর অস্বস্তি হচ্ছে। এত এত গুরুজনের মধ্য দিয়ে উঠে যাবে কী? ধূসর তাগাদা দিলো ‘ কী হলো? যা।’ ‘ হু? যাচ্ছি।’
পিউয়ের বুক কাঁ*পে লজ্জায়। ওই দৃশ্য যতবার মনে পড়ে ততবার সে কেঁ*পে ওঠে। হাঁস*ফাঁস করে। ম*রে যাওয়ার মত অনুভূতি হয়। পিউ চোখ নামিয়ে মৃদূ হাসল।
মারিয়া কাঁধব্যাগ বুকে চে*পে দাঁড়িয়ে রইল। সাদিফ বাইক ঘুরিয়ে ফের স্টার্ট দিতে গেলে ডাকল, ‘ শুনুন।’ সাদিফ ঘাড় কাত করে তাকায়, ‘ কিছু বলবেন?’ শ*ক্তপোক্ত চেহারা দেখে মেয়েটা গুলিয়ে ফ্যালে সব।
‘প্রতিদিন পৌঁছে দিলে কানাঘুষা হবে অফিসে। তবে বিপদে পরলে অন্য কথা। রাস্তাটাতো দুজনেরই এক। উঠুন।’ মারিয়া অবাক কণ্ঠে বলল ‘ সত্যিই পৌঁছে দেবেন? ‘ সাদিফ হেসে বলল, ‘ মিথ্যে মিথ্যে দেয়া যায়? উঠুন।’
লাঞ্চ টাইম শুরু। সবাই রওনা করল ক্যান্টিনে। কেউ বা ডেস্কেই বসল বাটি খুলে। বাড়ি থেকে আনা সুস্বাদু খাবারের ঘ্রানে মুহুর্তে অফিস ম ম করে উঠল। একেকজন যখন তৃপ্তি নিয়ে খেতে থাকে,সেই ক্ষনে চুপ করে বসে আছে মারিয়া। চেহারায় বিষাদের ছাঁয়া। পেট খুদায় চোঁ চোঁ করলেও খাওয়ার ইচ্ছে নেই।
ঢাকার বুকে তখন সন্ধ্যা। কমে এসেছে আলোর ছটা। বেড়েছে বিয়েবাড়ির হৈ-হুল্লোড়। ক্রমে ক্রমে হচ্ছে অতিথিদের আগমন। একেকজন কে একেকভাবে আপ্যায়নে ব্যস্ত সিকদার বাড়ির কর্তৃরা৷ মাগরিবের আজান পরায় সাউন্ড সিস্টেম আপাতত বন্ধ। জিরোচ্ছে ওটা। এসি বাড়িতেও মানুষের গায়ের ভ্যাপ্সা গরম ছোটাছুটি করছে।
প্রাণের চেয়েও প্রিয় মোবাইল ফোন কে বাঁচাতে পেরে বুক ভরে শ্বাস নেয়। এই ফোন,মায়ের কানের কাছে তার অক্লান্ত ঘ্যানঘ্যানানির ফল। এটা ন*ষ্ট হলে ভার্সিটি ওঠার আগে আর জুটবেনা কপালে। মেয়েটা পিউয়ের প্রতি একটু বিরক্ত হলো বটে। একটা মেসেজ দেখে এত কাঁ*পা-কাঁ*পির কী হলো?
ধূসর ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছে। না কিছু বলছে,না কিছু বোঝাচ্ছে। হয়না,বরফের মত কিছু শীতল দৃষ্টি, যা দেখলে হাত বা বিবশ হয়ে আসে! পিউয়ের বুক ধড়ফড় করছে। তানহা কখন উঠে গেল পাশ থেকে? উনিই বা এসে বসলেন কখন? কোন পর্যায়ের বেয়াক্কেল হলে একটা মানুষ কিচ্ছু টের পায়না!
সব বুকের সাথে চে*পে রুদ্ধশ্বাস সমেত, ছু*ড়ে ফেলল বিছানায়। ফ্লোরের গুলো তুলে, সোজা হয়ে, কোমড়ে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানল। অথচ,ওষ্ঠপুটের সবদিকে জ্বলজ্বল করছে হাসি। ধূসর ভাইয়ের সাথে প্রথম বার ঘুরতে যাচ্ছে সে। এই একটি কথাই তাকে পৃথিবী সমান সুখ পাইয়ে দিতে যথেষ্ট।
পিউ ঘা*বড়ে গেল। বুকের কম্পন জোড়াল। জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁ*পা- কাঁপা পল্লবে তাকায়। ধূসরের পূর্ন দৃষ্টি তার ওপর। পরপর ঠোঁট এসে ভেড়ে ওর কানের পাশে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে, ‘একটু কাছে এলেই তো হাঁপানি রোগীর মত ছ*টফট করিস। রোমান্টিক হলে সুস্থ থাকবি?’
মেয়েটা দুচোখ ছাপানো বিস্ময় সমেত তার শক্ত চিবুকটা একযোগে দেখে যায় । বাকরুদ্ধ সে,হতবিহ্বল। পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ইকবাল, পুষ্পকে হা হুতাশ ভঙিতে বলল, ‘ সাহস দেখেছো? ব্যাটা আস্ত একটা জল্লা*দ! ভয়ড*র নেই।’
প্রখর তাপের মধ্য দুপুর। ঘড়ির কাঁটায় টিকটিক করছে দেড়টা। অফিসের সবাই লাঞ্চ করতে ঝটপট উঠল। মারিয়া মনিটর বন্ধ করে ব্যাগের চেইন খুলল। মা টিফিন দিয়েছেন ওকে। পরোটা আর ডিম পোচ হয়ত। খিদেও পেয়েছে বেশ। সে বাটি বের করতে গেল,এর মধ্যে সাদিফ এসে পাশে দাঁড়ায়। ‘ এই ম্যালেরিয়া,লাঞ্চ করবেন না?’
‘পৃথিবীটা কী অদ্ভূত পিউ ! আমরা একই বাড়িতে থাকব,একই ছাদের নীচে। সামনাসামনি, কাছাকাছি, মুখোমুখি আবার। অথচ আমাদের মধ্য থাকবে আকাশ সমান দূরত্ব। যে আকাশের প্রতিটি মেঘ অসিত , কুচকুচে, শ্রী- হীন হবে। যেই তোকে এত গুলো বছর স্বযত্নে,নিজের হিসেবে কল্পনা করে এলাম, সেই তুই হবি এখন আমার বড় ভাইয়ের বউ।’
আমজাদ সিকদারের চকচকে গাড়িটা লম্বা জ্যামের কবলে । বারবার তিনি হাত ঘড়ি দেখছেন। এই নিয়ে বিশ মিনিট হতে চলল,জট ছোটার নাম নেই। এই জ্যামের মুখাপেক্ষী হবেন না বলেই প্রতিদিন ভোরে বের হন। কিন্তু আজ,আজ আর রক্ষে পাওয়া গেল না।
ধূসর ঝড়ের গতিতে বাইরে এলো। বিধ্বস্ত লাগছে ওকে। সারা শরীর ঘামে জবজবে। বুকের মধ্যে দা-মামা বাজছে আ*তঙ্কের। উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে গেটের কাছে এলো সে। মনে পড়ল বাইক ফেলে যাচ্ছে। আবার পার্কিং লটের দিক পিছু দৌড়াল । ওর এত তাড়াহুড়ো দেখে দারোয়ান তটস্থ ভাবে গেট সরিয়ে দিলেন দুদিক।
নিশির তৃতীয় প্রহর। সাদিফ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ছাদের খোলা মেঝেতে। চতুর্দিকে নির্মল প্রভঞ্জনের ছোঁয়ায়, চোখ মুঁদে আসতে চাইছে। মাথার নীচে আড়া-আড়ি বাম হাত রেখে, উন্মুক্ত আকাশের দিক চেয়ে ও। একটা তারা নেই,না আছে চাঁদ হতে ছুটে আসা জ্যোৎস্নার কোনও অংশ। বরং গভীর অমানিশার তোপে সব কিছু অন্ধকার
বাইক চলতে চলতে পিউ জিজ্ঞেস করল, ‘ বাড়ি থেকে আমার সাথে এলেই তো পারতেন ধূসর ভাই।’ ‘ তখন এলে,তুই এত অবাক হতি?’ পিউয়ের কণ্ঠ ছল্কে উঠল, ‘আপনি কি আমাকে সারপ্রাইজ দিলেন?’ ধূসর আর জবাব দিলো না। কিন্তু পিউ একা একা হাসল।
পিউ ছুটে এসে লুটিয়ে পরল বিছানায়৷ চিরাচরিত সেই সিনেমায় হিরোয়িনদের মত ঝাঁপ দিলো এক প্রকার। বালিশটা বুকে চেপে হাঁস-ফাঁস করে উঠল। ধূসর ভাই ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছেন? এখনও স্তম্ভিত ফিরছেনা ওর। একটু আগের সবকিছু সত্যিই ঘটেছে? উনি নিজে থেকে কাছে এসেছিলেন? পিউয়ের মাথা চক্কর কাটছে বিশ্বাস- অবিশ্বাসের মাঝখানে ঝুলে।
আফতাব অস্থির,অধীর। গলবিলটা কেমন ফ্যাসফ্যাস করছে দুশ্চিন্তায়। মস্তকের সমগ্র কোষ যেন স্বীয় জায়গায় থমকেছে। ঘামছে বয়ষ্ক গতর। বাড়ি ফেরা থেকে এক দন্ড শান্তিতে বসতে পারছেন না। ভেতরটায় কেমন করছে! ক্ষণ বাদে বাদে মুচ*ড়ে উঠছে বা-পাশ।
পিউ মাত্রাতিরিক্ত হো*চট খেয়েছে। যাকে বলে অদৃশ্য ভাবে মুখ থুবড়ে পরেছে ধা*ক্কায়। কাশি সামলে বাবার দিক প্রকট আঁখিতে চাইল সে। রুদ্ধশ্বাসে বলল, ” আব্বু, আব্বু আমি এখন বিয়ে করব না।”
বুকের ভেতর উত্তেজনায় কেমন করছে ওর। ওষ্ঠপুটের চতুর্দিকে ঝলকে উঠছে প্রোজ্জ্বল হাসি। খবরটা শুনলে মারিয়া খুশি হবে! কিন্তু কতটা হবে সেটুকু জানেনা। হয়ত বসা থেকে লাফিয়ে উঠবে আনন্দে! সাদিফ একা একা হাসল। ওই মুহুর্তে মারিয়ার উচ্ছ্বল, দীপ্ত মুখখানি ভেবে সেই হাসি দ্বিগুন হলো।
তারা ব্যস্ত,ভীষণ ব্যস্ত বিয়ের তালিকা করতে। কথা ছিল আজকেই শপিং করতে যাবেন। কিন্তু পরবর্তীতে পিছিয়ে আনলেন সিদ্ধান্ত। বাড়ির কর্তারা একটা দিন বিশ্রাম নিচ্ছেন,এই দিন ঘর খালি করে কীভাবে যাবেন তারা?
এমনিতে বিয়ে হলে, মেয়ে বাড়ি গুটিয়ে থাকে বিষন্নতায়। কন্যা বিদায়ের, আজীবনের জন্যে তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর হাহাকারে বাবা মায়ের বক্ষ ছি*ড়েখুঁড়ে আসে। যেমনটা সেবার পুষ্পর বিয়েতে হয়েছিল।
পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সাদিফ। বক্ষপটে মাংসল হাত গুঁজে রাখা। গায়ের কালো পাঞ্জাবি মিশে গেছে তিঁমিরে। ক্ষীণ রশ্মিতে, চশমার গ্লাস চিকচিক করছে। অমানিশার এই সুবিধে টুকু, মারিয়া হামলে নিয়েছে প্রযত্নে। তৃষিত নয়নে,চেয়ে আছে ওর দিক। সে মানুষটার নজর সম্মুখে,একটু উঁচুতে,ঐ আকাশের রাস্তায়।
পিউ লজ্জা পেলো। সবার দৃষ্টি ওর দিক পড়তেই মাথার ঘোমটা টেনে নিলো আরেকটু। মুচকি হেসে কাছে এলে আফতাব চেয়ার টেনে বললেন, ‘ আজ আমার বউমা আমার পাশে বসবে। ‘ বসল পিউ। চাচার মুখে বউমা শব্দটায় ওর খুশিতে হুশ হারানোর জোগাড়। এত কিউট লাগছে কেন শুনতে?
ইকবাল ঘাম মুছতে মুছতে রুমে ঢুকল। বিছানায় বসা পুষ্পকে দেখে বলল, ‘ এ কী মাই লাভ! এখনও তৈরী হওনি কেন? একটু পরেই তো অনুষ্ঠান শুরু হবে।’ এত আনন্দের মাঝেও পুষ্পর মলিন আনন তার নজর কাড়ল। নিরুত্তর স্ত্রীর পাশে বসল এসে।