বাদুড়গুলো নিজেদের দাঁত খিচিয়ে সমবেত মানুষগুলোকে হঠাৎই আক্রমন করে বসে। এই দিনটা ছিলো কিয়েভে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার সূচনা। ওগুলো কি ছিলো? একদল অতৃপ্ত আত্মা নাকি কতগুলো পিশাচ সত্ত্বা?
আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আজকের এই বৃষ্টিই জানান দিলো বর্ষাকাল এসে গেছে। এতে বেশ ভালোই হয়েছে। শীত আর বর্ষা এই দুই ঋতুতে এদুয়ার্দো বেশ আনন্দ অনুভব করে। ছোট ভাই আব্রাহামকে সাথে নিয়ে নানান রকম এডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়ে। তার ভাইটাও হুবুহু তার মতই। প্রকৃতি প্রেমি। আব্রাহামের অবশ্য আরও একটা নেশা আছে।প্রেমের নেশা। তার জীবনে প্রণয়িনীর অভাব নেই। তবুও সে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনের দুঃখ প্রকাশ করে বন্ধুদের কাছে।
দু’পায়ের ধারালো নখের আঁচড়ে ইনায়াকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। সূঁচালো দাঁতে কামড়ে ধরে ওর গায়ে। ইনায়া ভীত কন্ঠে পরপর দু’বার বীভৎস চিৎকার দিয়ে উঠে ডাকে, – দাদু!
হঠাৎই একটা কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী বাতাসের বেগে ইনায়ার চারপাশে ঘুরতে শুরু করে। বাদুড়গুলো ওকে ছেড়ে দিয়ে দল বেঁধে উড়ে যায় আকাশের দিকে। আবছা আলোয় ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া বাদুড়গুলোকে আরও ভয়ংকর লাগে দেখতে। যেন একঝাঁক মৌমাছি। বরং মৌমাছির থেকেও ভয়াবহ হিংস্র।
– জ্বিনা। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো রহস্যটা খুঁজে বের করার। – চেষ্টা নয়। আমি দু’দিনের মধ্যে এর রহস্য জানতে চাই। কথাটা বলে ঝড়ের বেগে কোথাও চলে যায় এদুয়ার্দো। নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে থাকে অ্যাভোগ্রেডো।
যুবতী দু’জন কামরার বাইরে বেরিয়ে গেল। পামেলা উঠে দাড়াল। পা টিপে টিপে কোমর দুলিয়ে হাঁটতে শুরু করল। পাতলা ফিনফিনে শর্ট গাউনে তাকে আবেদনময়ী লাগছিল। এই দুর্গে এসেছে একমাস হলো। এর মাঝে দু’বার রুলারের কাছাকাছি থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
তাছাড়া গুহায় তো কেউ ছিলো না। তাহলে এই মুহূর্তে ওর হাত ধরে আছে কে? – কোনো র’ক্তচোষা পি’শাচ নয়তো! ভাবতেই সিয়ার পুনরায় পিলে চমকে গেলো। এদুয়ার্দোর পেছন থেকে কিচ শব্দ করে উঠল। এদুয়ার্দো মনে মনে ভাবল
মুখের উপর তুলতুলে কিছুর স্পর্শ পেয়ে সিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিচ নিজের লেজ দিয়ে ওর মুখে সুরসুরি দিচ্ছিলো। সিয়া চোখ মেলে তাকাল। মশালের আলোয় আলোকিত গুহার চারদিকে নজর বুলাল।
ক্রিসক্রিংগল থমকালেন। ভয়ংকর ভাবে চমকালেন। পায়ের কাছ থেকে কিচকে কোলে তুলে নিলেন। কিন্তু কিচ ছটফট করতে শুরু করল। মনে হলো ও কিছু বলতে চায়ছে। ক্রিসক্রিংগল উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, – কিচ! সিয়া কোথায়?
সিয়া জানালার কাচ ঈষৎ ফাঁক করে উঠোনের দিকে তাকায়। মুহূর্তেই ওর শরীরের সমস্ত রক্তবিন্দু হিম হয়ে যায়। প্রশস্ত কালো কুচকুচে ডানার একটা বিশালাকৃতির প্রাণী আর্নির গলা চেপে ধরে। যার ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে ধারালো দু’টো শদন্ত বেরিয়ে আসে। ভয়ংকর দেখতে প্রাণীটা আর্নির ঘাড়ে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে।
কেউ কিছু বুঝল না। সিয়া মুখ তুলে তাকাল। ডিয়েটসকে উদ্দেশ্য করে বলল, – দাদু আর্নিকে বাঁচান। একমাত্র আপনিই পারবেন ওকে বাঁচাতে। – আর্নি কোথায়?___উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করলেন ডিয়েটস। সিয়া জানালার দিকে দৌড়ে গেল। বাকিরা ওর পিছন পিছন কামরায় প্রবেশ করল।
ভ্যাম্পায়ার’রা রসুনের সংস্পর্শে আসা তো দূরের কথা, রসুনের গন্ধও সহ্য করতে পারে না। ওরা রসুনের কথা চিন্তা করলেই অস্থির হয়ে উঠে। প্যানিক এ্যাটাকের শিকার হয়।
– এতো লম্বা চুল মেয়েটা সামলায় কি করে?___আব্রাহাম মনে মনে ভাবল। তার দেওয়া কামড়ের দাগ এখনো ইনায়ার গলায় স্পষ্ট হয়ে আছে। দাগটার দিকে দৃষ্টি দিতেই আব্রাহামের ভয়ানক রক্তের তৃষ্ণা জাগল। ঘ্রাণেন্দ্রিয় ভেদ করে মস্তিষ্কে পৌঁছে গেল মিষ্টি মধুর রক্তের সুবাস।
– মেয়েটা চরম বে’য়া’দব। ওভারলর্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন শুধুমাত্র তার মায়ের কথা শুনে চলে। তার একমাত্র দূর্বলতা ছোট বোন ইজাবেল। পাথরের থেকেও শক্ত হৃদয়ের এই র’ক্তচোষা পি’শাচের জীবনে আদৌও মায়া-দয়া বলে কিছু আছে কিনা কে জানে! থাকলে কি আর সিয়াকে এভাবে কষ্ট দিতে পারতো?
বেশকিছু দিন আগেও গ্রামের মানুষগুলো কত হাসি-খুশি ছিলো। সারাক্ষণ লোকজনের কোলাহলে সম্পূর্ণ গ্রামটা মুখরিত হয়ে থাকতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে র’ক্ত’চোষা পি’শাচদের কবলে পড়ে সবাই কেমন আতংকে জর্জরিত। সম্পূর্ণ গ্রামটাই যেন নির্জন, নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে শুধু শোনা যায় শিশুদের কান্নার শব্দ।
– এভাবে কি সেদিন আমার হাত পায়ের বাঁধনগুলো খোলা যেত? সিয়ার আফসোস হলো। সাথে অপরাধবোধ হলো এটা ভেবে, প্রয়োজনের সময় কেনো উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারেনি ও। কিন্তু সিয়া কি আর জানতো ওকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে শ’য়তানটা ওর দাদুকে তুলে নিয়ে যাবে?
আব্রাহাম আরও বিরক্ত হয়ে উঠল। হলরুমে উপস্থিত থাকা বাকিরা ওদের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এলিমিগ্রিন এসে ওদের দু’জনকে থামানোর চেষ্টা করল। সুযোগ বুঝে আব্রাহাম দ্রুতপায়ে হেঁটে হলরুমের বাইরে বেরিয়ে গেল।
ভীষণ মায়া হলো। সে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সিয়ার মলিন মুখখানার দিকে। আর্নির দু’চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠে। ইনায়া ব্যতিব্যস্ত কন্ঠস্বরে বলে, – এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বসো।
ওদের ঘোড়া দু’টো কি পক্ষিরাজ ঘোড়া? যেন চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। ইনায়া একহাতে শক্ত করে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল। অন্যহাতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজের ঘোড়াটাকে অনবরত চাবুক আঘাত করল।
রক্তশূন্য মুখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে রইল। সিয়ার ‘মা’ ডাক শুনতে পেয়ে ক্রিসক্রিংগল উরসুলাকে রেখে দৌড়ে এসে সিয়ার পাশে দাঁড়ালেন। মুহূর্তেই যেন তার সমগ্র দুনিয়া দুলে উঠল। বুকের ভেতরে প্রগাঢ় শূন্যতা অনুভব করলেন।