
Chapters
হাফসা পড়ালেখা করেছে আ্যারাবিক লাইনে।চাচার কাছেই কুরআন হিফয শেষ করেছে অল্প বয়সেই।তবে ফিকহ সহ অ্যারাবিক বইয়ের পাশাপাশি পড়ছে সাইকোলজি নিয়ে।সাইন্সের বিভিন্ন বিষয়ের বইয়েও চরম আগ্রহ ওর।ইসলামিক বই পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশনের বইও সংগ্রহে আছে ওর নিজের লাইব্রেরীতে।
কেটে গেলো আরো দূটি বসন্ত।ষোড়শী কিশোরী পা দিলো অষ্টাদশে। মামা সায়িদ আনসারের ছেলে রাদ আনসার দেশে এসেছে।পেশায় সে একজন সাইন্টিস্ট।ভালো এপার্টে জব করছে।মামার ইচ্ছা হাফসাকে উনার ছেলের স্ত্রী বানানোর।উনার জানামতে এখনকার জেনারেশনে হাফসার মতো মেয়ে পাওয়া দূষ্কর।রাদ খুব ছোটোবেলা ওকে দেখেছিলো।মামা হাফসার সাথে তার বিয়ের কথা উঠালে রাদ জানায় তার কোনো আপত্তি নেই।
আরহাম তাজওয়ার প্রথম বার্তাতেই বললেন, ‘আপনি কি আমার মাসনা হবেন?’ মাসনার কথা শ্রবণ হতেই হাফসা যেন পাথরে পরিণত হলো।মস্তিষ্ক কিছুক্ষণের জন্য কাজ করা যেনো বন্ধ করে দিলো।কোনোদিন যা কল্পনাও করেনি সেটাও সত্যি হতে পারে?কয়েক মিনিট স্থির থেকে নিজেকে সামলে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
হাফসা ঘুম ভাঙ্গতেই দেখে অন্ধকার রুম।ড্রীম লাইটে চারপাশ আধো আলোয় দৃশ্যমান।উঠতে গেলেই নিজেকে খুব ভারী মনে হয়।হাফসার নড়াচড়া পেয়ে তিনি লাইট অন করলেন।হাফসা চোখ কুঁচকে তাকালো লাইটের তীব্র আলোয়।নিজেকে আপাদমস্তক দর্শন করে দেখলো এখনো আগের অবস্থায়’ই আছে।সাজসজ্জা,ভারী ল্যাহেঙ্গা!
আরহাম তাজওয়ার একবার আহমাদের দিকে তাকালেন। অতপর রাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নেভার এভার।নাউ সি ইজ মাই ওয়াইফ।আমার অনুমতি ব্যতীত আপনি তাকে পাওয়া তো দূরের কথা উনার ছায়াটুকুও দেখতে পারবেন না।ঝামেলা আমার মোটেও পছন্দ নয়।আই রিকুয়েস্ট ইউ আপনি উনাকে ভুলে যান।উনি আপনাকে চান না।উনি খুশি থেকেই স্বইচ্ছায় আমাকে বিয়ে করেছেন।’
ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় রুমটা হালকা আলোকিত। আরহাম দরজায় নক করেও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে ভেতরে ডুকলেন।শেলফের পাশে হুইল চেয়ারে মাথা লাগিয়ে ঘুমিয়ে আছেন মাইমুনা।
‘ভালো যেমন বাসবো শাসন ও করবো।আপনি যদি উনার প্রতি জেলাস হোন আমি আপনাকে শাসন করবো।আর উনি হলে উনাকে।দূজন আপন হয়ে থাকবেন।হিংসা,ঈর্ষা এ দূটো জিনিস কখনোই যেনো আমার প্রিয়তম স্ত্রীদের মধ্যে না দেখি।”ভালো যেমন বাসবো শাসন ও করবো।আপনি যদি উনার প্রতি জেলাস হোন আমি আপনাকে শাসন করবো।আর উনি হলে উনাকে।দূজন আপন হয়ে থাকবেন।হিংসা,ঈর্ষা এ দূটো জিনিস কখনোই যেনো আমার প্রিয়তম স্ত্রীদের মধ্যে না দেখি।’
তখনি হঠাৎ কপালে কারো উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া পেতে হৃৎপিণ্ড ধক করে ওঠলো।বুকের ভেতরটা দ্রীম দ্রীম শব্দে বেজে উঠলো।আরহাম পরম আবেশে চোখ বুজে নিলেন।এ যেনো উমায়েরের কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে দামি উপহার।হাফসা সাথে সাথে সরে গিয়ে গুটিসুটি মেরে রয়।আরহাম কিছুক্ষণ মুচকি হেসে তাকে আবারো কাছে টেনে নিলেন।
ডিনারেও হাফসা চুপচাপ ছিলো।আরহাম মাছের কাটা বেছে বেছে দূপাশে দূজনকে খাইয়ে দিচ্ছেন।দূই লোকমা খাওয়ার পর হাফসা আরহামকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘এবার আপনি খান।’ উনি আবার দিতে চাইলে হাফসা উনাকে রিপিট করে।অথচ মাইমুনা একবারও উনাকে খাওয়ার কথা বলেননি।
উনার খালি বুকে তাকাতে হাফসা লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছিলো।উনি চিবুক ধরে বললেন, ‘লজ্জাবতী লাজুকলতা এত সাইনেস কই থাকে?এত্তো সাইনেস নিয়ে পিচ্চি হয়ে এত বড় মানুষকে বিয়ের চিঠি দিয়েছিলেন কীভাবে হুমম?’ : ‘জ্ জানিনা।আবেগ ছিলো।’ : ‘আবেগ ছিলো মানে?আমাকে ভালোবাসেন না?’
‘আজ যেনো এসে মাইমুনার কাছ থেকে কোনো অভিযোগ না শুনি ঠিক আছে?’ হাফসা মাথা নিচু করে নিলো।লজ্জায় নয় অপমানে। ‘আসি টেক কেয়ার।আল্লাহ হাফিজ।’ অতপর সালাম বিনিময় শেষে তিনি চলে গেলেন।
রুমে এসে দেখলেন হাফসা নামাজ পড়ছে। হিজাবের নিচ দিয়ে যখন হাতটা তুলে দোয়া করতে লাগলো তখন দেখা গেলো উনার হাতে সাদা ব্যান্ডেজ পেঁছানো, ব্যান্ডেজ পেরিয়ে ছোপ ছোপ রক্ত ভাসছে।এ চিএ দেখেই আরহাম দমে গেলেন।হাফসা জায়নামাজ থেকে উঠে কাবার্ডে গিয়ে হাতে কিছু একটা করছিলো।আরহাম নক করলেন না, পেছন থেকে এগিয়ে গেলেন।
হাফসা নিচে নামতেই আরহাম ওর সামনে এগিয়ে আসলেন।হাফসা একেবারে কাছে থেকে উনাকে দেখলো।অতিরিক্ত রাগে উনার কান লাল টকটকে হয়ে আছে।কপালের শিরা নড়ছে বারবার।সাদা মুখশ্রীখানা রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। ‘উনার সাথে খারাপ বিহ্যাভ করেছেন আপনি?’
সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই হাফসা পাশে থাকা আরহামকে দেখে চমকে গেলো।মানুষটা একদম জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছেন।তখনই খেয়াল করলো ব্ল্যাঙ্কেট টা তো ওর গায়ে।কিন্ত রাতে তো ছিলো না।উনার কি ঠান্ডা লেগেছিল?উনি তো শেয়ার করতে পারতেন?করলেন না কেন?’
কিছুক্ষণ পর কলিং বেল বাজলো।হাফসা কলিং বেলের শব্দে বারান্দায় বেরোলো।দোতলা থেকে দেখছে আশেপাশে কোনো ম্যাড নেই।কলিং বেল বেজেই যাচ্ছে। দরজা কেন কেউ খুলছে না।মায়ের শরীর ভালো না,তাই শুয়ে আছেন।ওষুধ খেয়ে ঘুমালে উনি লম্বা ঘুম দেন।কিন্তু আপু তো গিয়ে খুলতে পারেন।আর সার্ভেন্ট?সবাই গেল কোথায়?
‘কি হয়েছে আরহাম?তুমি এর আগেও কেঁদেছো।হাফসাও কেঁদেছে দেখলাম।মেয়েটা কিছু বলে না।সবকিছু নিজের ভেতর চেপে রাখে।কি হয়েছে দূজনের?কোনো কিছু নিয়ে কথা-কাটাকাটি হয়েছে?বলার মতো হলে বলো আমাকে।’ আরহাম কাঁদোকাঁদো হয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে বললেন, ‘সি হার্টস মি আম্মু।’
আরহাম নিচে নামতে নামতে কলিং বেল বাজলো।এত সকালে কে হতে পারে?নিউজপেপারের লোক হয়তো!সন্দেহ বশে দরজা খুলতেই আরহাম চমকে গেলেন।অল্পক্ষণের জন্য নিজের চোখ আর মস্তিষ্ক কে যেনো বিশ্বাস করতে পারলেন না।
হাফসার মনটা ভার হয়ে আছে বিকেলে রাদ’ ভাইয়ের সাথে কথা বলার পর থেকে।আরহাম বিকেলেও ফোন করে কথা বলতে চেয়েছিলেন।হাফসা অজুহাত দিয়ে চলে আসে।কথা বলে নি।কেন জানি অসহ্য লাগছে সবকিছু। একটা বিয়ে কিছু মানুষের জীবন কত অদ্ভুত ভাবে পাল্টে দিলো।যেমন আমি নিজে।তেমনি রাদ ভাই!
উমায়েরের বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে পুরো দেড় ঘন্টা ফুল স্পীডে গাড়ি রান করে এসেছেন।রাগ কমেনি এতক্ষণ পর্যন্ত।নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য একা ছেড়ে দিতেই বুঝতে পারলেন রাগটা অহেতুক।রাগটা না করলে এই শেষনিশিতে উনার প্রাণস্পর্শীর কাছেই হয়তো ঠাঁই থাকতো!
আরহাম ওপর থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলেন। আব্বুর মুখে শাস্তি শুনে আর বের হওয়ার সাহস পান নি।নাহলে উমায়ের এর সামনে কি নয় কি শাস্তি দিবেন আর মানসম্মানের ফালুদা হয়ে যাবে। ‘কি করেছে কি আমার ছেলে?আমার ছেলেকে শাস্তি দিবেন?’
ইফতার শেষে রুমে এসে নামাজ পড়ে আবার কিচেনে গেলো হাফসা।মাকে টুকটাক হেল্প করতে বেশ অনেকক্ষণ সময় চলে গেলো।মা অবশ্য মানা করেছিলেন কিছু করা লাগবে না।কিন্তু হাফসার বিবেকে বাঁধলো।সাহরির এতো রান্না মা একা করবেন।আব্বু আর উনি তো মায়ের হাতের রান্না ছাড়া খান না।আম্মুর বেশী কষ্ট হয়ে যায়।তাই সাহায্য করতে গিয়ে পড়লো ইশার আযান।
উনি বুঝতে পারলেন উমায়ের কাঁদছে।তাই আরো গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে কপালে গাঢ় চুমু দিয়ে বললেন, ‘ডোন্ট ক্রাই প্লিজ!ইট হার্টস মি হুয়েন ইউ ক্রাই।’ ‘ধরে নিন এটা আপনার শেষবারের মতো দূঃখ পাওয়া।আর একটুও দূঃখ দেব না।এই খারাপ বরটাকে ক্ষমা করে দিন শেষবারের মতো।’
আরো কিছুক্ষণ হাসি-আলাপ করে আরহাম রুমে চলে গেলেন ফ্রেশ হতে।হাফসা উনার যাওয়ার পানে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলল, ‘শুকরান লাক ইয়া মা’বুদ।’ অতঃপর বেলী আর গোলাপের সুবাসে নাক ডুবিয়ে মাতোয়ারা হয়ে গেলো।
মেয়েটি গোল চশমার আড়ালে সামনে থাকা অতি সুদর্শন পুরুষটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল বলল, ‘হ্যালো ওয়েট!আমি কি দেখতে খারাপ?আপনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন না কেন?নিচে কি দেখছেন আমার দিকে তাকান।’ আরহামের রাগ হচ্ছে।তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বললেন, ‘আমি যাব।পথ ছাড়ুন।”
হাফসা বললো না।আরহাম ওকে লাগাতার জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছেন কিন্তু হাফসা চুপ হয়ে আছে।ব্যর্থ হয়ে আরহাম ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রইলেন।ভাবতে থাকলেন, কীভাবে কষ্ট দিয়েছেন উমায়ের কে।মনে তো পরছে না কিছু।উমায়ের কখনো এমন একরোখা রাগ করে থাকেননি এর আগে!দেট মিনস সামথিং সিরিয়াস!
হাফসার আর্তনাদ আরহামের কান পর্যন্ত পৌঁছলো না।হতাশ হয়ে দরজায় হেলান দিয়ে বসে পড়ে সে ভাবলো, ‘এমন মানুষ নিয়ে সংসার করা যায়?রাঁধতে দেবেন না বলে না খেয়েও থাকবেন।তবু কিচেনের কাজ করতে দেন না।অদ্ভুত!
উনি দরজা খুলে এসে হাফসাকে সামনাসামনি সোফায় বসে থাকতে দেখে হাতের বাটিটা টেবিলে রাখলেন।তারপর এসির পাওয়ার বাড়াতে বাড়াতে বললেন, ‘আম রিয়েলি সরি।ট্রাস্ট মি আমার মনেই ছিলো না যে আপনাকে দরজা বন্ধ করে রেখেছি।’ হাফসা উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ এত ক্লান্তির কারন কি উনার!
আরহামের ব্যথিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন হাফসার দিকে।সারাদিনের কান্না দেখার পরও কি এখন মন খারাপ দেখতে হবে!উনি কি বুঝেন?উনার মন খারাপে আমার মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে যায়!আপনার প্রতি ফোঁটা চোখের পানি আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরনের সমপরিমাণ যন্ত্রণা!
চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে সে।গাল বেয়ে এখনো শুকনো পানি।পাপড়িগুলো এখনো ভিজে আছে।ফর্সা হাতে-পায়ে রক্ত জমাট বেঁধে কালসে হয়ে আছে।অন্যহাত ছিলে গিয়েছে রশ্মির বাঁধনে।কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে। রুদ্র আলতো করে ওর গালের পানিগুলো মুছে দিলো। ব্যাথা পাওয়া জায়গায় মেডিসিন লাগিয়ে, মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দেখলো বেশ খানিক জায়গা কেটেছে।
নির্জন,নিস্তব্ধ জায়গা কিন্তু কোনো এক মসজিদ ফযরের থেকে ধীরসুরে আযান শোনা যাচ্ছে। হাফসা আযানের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু ক্লিয়ারলি শোনা যাচ্ছে না।চোখ তুলে তাকাতেই সেই চোখে জমানো ঘৃণা রুদ্রের বুকে গিয়ে লাগলো।গালে হাত দিয়ে একনজরে দেখেই যাচ্ছিলো হাফসাকে।
হাফসা গাল ফুলিয়ে বসে রইলো।বক্সটা হাতে নিয়ে চাবি ছাড়া অনেক রকম চেষ্টা করলো,বৃথা হয়ে মনে মনে আরহামের প্রতি রাগ নিয়ে বললো, ‘খুব চালাক লোক।এত কঠিন শর্ত না দিলেও পারতেন!আমারও লাগবে না চাবি,আপুর টা নিয়ে আসবো।’
ডিনারে লেট হয়ে গেলো।ঘড়িতে তখন এগারোটা।আদওয়ার ফ্যামিলি সহ আহনাফ তাজওয়ারকেও খেতে বসতে হলো।এরই মধ্যে অনেকক্ষণ পর আরহাম নিচে নামলেন।কোনোদিকে না তাকিয়ে চুপচাপ কিচেন থেকে প্লেটে খাবার নিয়ে মাইমুনার রুমের দিকে এগোলেন।
রাতে আলফাজের সাথে সুরাইম আসলো।এ বাসায় আসার পর ফাইয়াজ সবসময় এখানেই লেগে থাকে।বিকেল থেকে এখানেই তার থাকা,খাওয়া দাওয়া হচ্ছে। যাওয়ার কোনো টান নেই।বাসায় ফিরার কথা বললে সে বললো,’দূই আন্টিমণিকে বলো আমার সাথে আসতে।তাহলে আসবো আমি।’
ওর চোখ ছলছল হয়ে উঠলো।আরহাম চেয়ে রইলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে বলে উঠলো, ‘আচ্ছা ব্যাপার না।মানুষ মাএই ভুল।আপু তো অনুতপ্ত।’ আরহাম তৎক্ষনাৎ হাফসাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বললেন, ‘আমার জীবনে এমন কোন ভালো কাজের পুরষ্কার আপনি!জানি না!এত বেটার গিফট আমি ডিজার্ভ করতাম!আল্লাহর জন্য আপনাকে ভালোবাসি উমায়ের।’
আরহামের আক্ষেপের সুরে কথাটা বলার সাথে সাথেই মাইমুনার চোখের বাঁধ ভাঙ্গলো।অনুতপ্ত সুরে বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিন।প্লিজ শাহ।আর কখনো এমন ভুল হবে না।আই প্রমিস! আপনি অসন্তুষ্ট থাকলে মরে গেলেও শান্তি পাবো না।’
হাফসা তাও নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না।সময়ের সাথে ওর ভয় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।আরহাম ওর হেঁচকির মাএা সামলাতে বললেন, ‘কান্না বন্ধ করুন।প্লিজ।’ হাফসা কান্না থামালোই না।একেবারে না পারতেই আরহাম হাফসার ঠোঁট স্পর্শ করলেন।মুহুর্তেই হাফসার কান্না বন্ধ হয়ে অবাক বনে গেলো সে।
তারপর হাফসাকে বসিয়ে ওর পেটের মাঝে আলতো করে স্পর্শ করলেন আরহাম।উনার চোখেমুখে খুশি চকচক করছে।ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসেছেন আরহাম। হাফসার পেটে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘একটু কি অনুভব করা যায় তাকে?’
ঘটনার পেরিয়ে গেছে গোটা দূইদিন।আজ আইরার সাথে কথা বলতে গিয়েও আরহাম যারপরনায়ই আহত হলেন।অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ‘আইরা তুমি আমার বোন হও।তুমি বুঝবে,একটা মেয়ের সংসার ভাগ করতে কতটুক কষ্ট হয়।মনে আছে তোমার? মাহদিন ভাই শুধু ফান করে বলেছিল,সে মাসনা নিতে চায়।তুমি কি করেছিলে মনে আছে?আমাকে এসব বুঝাতে আসবে না।’
আরহাম কাঠখোট্টা স্বরে প্রশ্নটি করে উত্তরের আশা করলেন না।চুপচাপ বসে রইলেন অন্যদিকে তাকিয়ে।হাফসা কিছু বলতে যাচ্ছিলো আব্বু ফোন এগিয়ে দিলেন।আরহাম আব্বুর দিকে জিগ্গাসাদৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোন তুলে রুক্ষস্বরে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে উৎকন্ঠিত কন্ঠে ভেসে আসে, ‘আপনি সত্যি আমায় মেনে নিয়েছেন?নিজের মুখে বলুন।বাবার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না।’
উপরে উঠার সময় উমায়েরের রুম পেরিয়ে যেতে তাকে উনার রুমে যেতে বললেন।হাফসা কিছুসময় পর গেলো।উনি তখন টাওয়াল হাতে শাওয়ারে ডুকবেন।হাফসাকে আসতে দেখে টাওয়াল রেখে এগিয়ে এলেন।গালে হাত রেখে বললেন, ‘আমি যখন সামনে থাকি না তখন কাঁদেন না?’ ‘আপনার লেট হয়ে যাচ্ছে।’
কিন্তু তিনি একবারও আসলেন না।কিচেনে ডিনার রেডি করছিল হাফসা।আম্মু এসে বললেন, ‘আমি রেডি করছি।আরহামকে নিয়ে আসো তুমি।’ প্রতিদিন এমন হলে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসতো।আজকে মনে হলো এটা খুব কঠিন ওর জন্য।হাফসার রুম বাদেই অল্প একটু ব্যাবধান।তারপর আরহামের রুম।প্রথমে নিজের রুমে গিয়ে নিজেকে ঠিকঠাক করে হাসিখুশি ফেইস করে বের হলো সে।
আরহাম হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেন।কান ধরেও দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ।সরিও বললেন।হাফসা মুখ ফিরিয়ে নিলো।প্রিয়তমার রাগ ভাঙ্গাতে ভাঙ্গাতে হাঁপিয়ে উঠলেন ঠিকই তবু রাগ ভাঙ্গানো গেল না।ছোট্ট প্রাণের আবরণে স্পর্শ করে বললেন, ‘তার জন্য হলেও শেষবারের মতো ক্ষমা করে দিন।আই প্রমিস,সবার সামনে আর কখনো আঘাত দিয়ে কথা বলব না।’
গত হয়েছে তিনদিন।পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ওই ঘটনার রেশ কারোর মন থেকেই পুরোপুরি মুছলো না। রাতের খাবারের আধঘন্টা পর হাফসার রুমে ফিরলেন আরহাম।ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে বিছানায় এসেই হাফসার পেটের মধ্যে লাগাতার চুমু খেতে থাকলেন।
আদওয়া লজ্জা পেয়ে একটু দূরে সরেই কমল দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লো।আরহাম হেসে ওকে কাছে টেনে বুকের মধ্যে এনে শোয়ালেন।আদওয়া তো অবাক!আদওয়াকে জড়িয়ে ধরে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললেন, ‘আপনিও ঘুমোচ্ছেন না আমাকেও ঘুমোতে দিচ্ছেন না।চুপচাপ ঘুমান তো।’
হাঁটতে হাঁটতে আরহামের হঠাৎ চোখ পড়লো পুকুরের দিকটায়।কাউকে দেখে আদওয়ার হাত খপ করে ধরলেন তিনি।’কাম ফাস্ট’ বলে ওকে টেনে টেনে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যেতে চাইলেন।আদওয়া আহাম্মক বনে গেলো।জিজ্ঞেস করতে লাগলো বারবার,’কি হয়েছে?এমন তাড়াহুড়ো করছেন কেন?’
খানিক পরই দরজায় করাঘাত হলো।আরহাম বেলকনি থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, অরেন্জের গ্লাস হাতে হাফসা দাঁড়িয়ে।সন্তুষ্টিতে আরহামের ঠোঁটে আরেক চিলতে হাসি বয়ে গেলো।পাশে বসিয়ে গ্লাসটা খালি করে শুকরিয়া জানালেন।
গা জ্বালানো শব্দটা বলে আরহাম চলে গেলেন।আদওয়া বের হয়ে দেখে আরহাম চলেই গিয়েছেন।মনে মনে নিজেকে গালি দিয়ে বলে, ‘বোকা!কেন যে মুখফুটে বললাম।লোকটা মুখের ওপর একপ্রকার না করে দিলেন।তাতে কি!আব্বুকে বলবো আমি।আমার জন্য এসব নিয়ে আসতে।যেমনটা কালকে ফুচকা আনিয়ে খেয়েছিলাম!
মাইমুনা তখন সবে শাওয়ার নিয়ে বেরোচ্ছিলেন,তখুনি আরহাম রুমে আসেন।স্নিগ্ধ বেলি ফুলের সুঘ্রাণে রুম ভরপুর। আরহাম মাইমুনাকে একেবারে কোলে নিয়ে ছাদে চলে এলেন। মাইমুনা জিজ্ঞাসাদৃষ্টিতে তাকালে তিনি বললেন, ‘একবার হেয়ারড্রায়ার এভোয়েড করুন।লেট মি ফিল ইউর হেয়ার’স স্মেল হানি।’
সন্ধ্যার পর নামাজ থেকে ফিরেই হাফসার রুমে গেলেন।আম্মু কিছু দরকারি কথাবার্তা সারছিলেন।আরহাম দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন।আম্মু বেরোতেই সোফায় গিয়ে পাশ ঘেষে বসে পড়লেন।হাফসা একপলক চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।আরহাম মুখ বাড়িয়ে তাকাতে মাথানিচু করে নিলো।
আরহামের ভেতরটা যেনো চুরমার হয়ে গেলো।অসহ্য রকম যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন ভেতর ভেতর।এত বড় সত্যির জন্য যে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না।’লাং ক্যান্সার’ শব্দটা কর্ণে দ্রীম দ্রীম আওয়াজ তুলতে থাকলো।বক্ষে কেউ পাথর চাপা দিয়েছে এমন যন্ত্রণা হলো।বাক্যগুলো হারিয়ে গেলো যেনো কন্ঠনালী থেকে।অপ্রস্ততের মতো এলোমেলো বাক্যে বলতে লাগলেন
আরহামের চোখের অবাধ্য জলগুলো আর বাঁধা মানলো না।অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবার দিকে তাকাতে তিনি বললেন, ‘আমার একটা অংশ ভালো নেই।এত অশান্তি নিয়ে কি করে যেতাম।’ আরহাম বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন তৎক্ষনাৎ।নি:শব্দে আঁখিদ্বয় ভিজে উঠলো।বাবার ফিরে আসায়,একটুও আফসোস হলো না।বরং খুশি হলেন।
আরহাম হেসে ফেললেন।সন্তুষ্টচিত্তে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।দিস ইজ ফার্স্ট টাইম,হুয়েন আই এ্যাম স্যাটিসফাইড অন ইউর রিপ্লাই।’ হাফসাকে খাইয়ে দিয়ে যখন রুমে আসলেন আদওয়া বলল, ‘আর কতদিন অপেক্ষা করলে ছোটু টাকে দেখতে পাবো?সময় যেনো শেষ হচ্ছেই না।’
এ মুহুর্ত গ্লাসের বাইরে দৃষ্টি আদওয়ার।দূর আকাশের তেজি তারকা এতই ঝলমল করছে যে তাদের বড় এক অংশ এখান থেকেই গুণা যায়।একটা তারা হুট করেই মিলিয়ে গেলো।দৃষ্টি ঘুরিয়ে আরহামের দিকে তাকালো আদওয়া।আরহাম পাশে বসলে বুঝালো,তারাগুলো গুনে দিতে।সে তাঁরা গুনলো,আরহাম ঠায় তাকিয়েই রইলেন।
আরহামের অগোছালো মস্তিষ্ক একেবারেই হ্যাং হয়ে গেল।আব্বু ছুটে গেলেন ব্লাডব্যাংকের দিকে।আরহামের পাশ দিয়েই তোয়ালে জড়ানো ছোট দেহটা বিশেষ গ্লাসে ভরে এনআইসিওর কক্ষে নেওয়া হলো।আরহাম শুধু তাকিয়ে রইলেন তাঁর সদ্য পৃথিবীতে আসা ফুলটার দিকে!উনার রক্ত!উনার অংশের দিকে!
চোখাচোখি হলো কেবল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।আরহাম দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন সাথে সাথে।মাইমুনা খুশিতে কাঁদবে না হাসবে বুঝতেই পারছে না।দাদূ উনার সাথে খোশালাপে ব্যস্ত ছিলেন তখন ড্রয়িংরুমে আসলেন আয়মান।মাও আসলেন। আরহাম উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন।মা, ইমরানা, তার হাজবেন্ড প্রথম থেকে সবকিছুর জন্য করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন।আরহাম কেবল শুনে গেলেন।
একজন স্ত্রী ঠিক ততটাই সুন্দর যতোটা তার স্বামীর দৃষ্টি সুন্দর! ইসস উমায়ের আপনি যদি আমার চোখ দিয়ে আপনার সৌন্দর্য দেখতে পারতেন, তাহলে….