তুমি কি রোদে ভিজতে পারো? আমরা কিন্তু রোদে ভিজেছিলাম। সেসময়ে কলকাতা, কল্লোলিনী তিলোত্তমা ছিলো আজকের মতন ব্যাঙের ছাতা হয়ে যায়নি। ময়দানে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলে গঙ্গার জলো বাতাসে বুক ভরে উঠতো।
আজও মনে হয় এই যেন গতকালের কথা। আমি আর নবীন একটু তাড়াতাড়ি কলেজ থেকে বেরোবো ভেবেছিলাম, প্রিয়াতে "গুরুদক্ষিণা" দেখতে যাবার কথা। পচা, দেবু আর অনুসুয়াকে জানানো হয়নি, ওরা জানতে পারলে আর আস্ত রাখবে না আমাদের।
সেদিন আবার অনুসুয়ার মনে বান্ধবী প্রীতি জেগে ওঠে আর মধুছন্দাকে নিজের বাড়ি ডাকে। মধুছন্দার বাড়ি বেহালা আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। প্রথমে বেশ ইতস্তত করে মধুছন্দা, সন্ধ্যে হলে কি করে বাড়ি ফিরবে, বাড়িতে বলা নেই, মা চিন্তা করবে ইত্যাদি।
গলি থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত বেশ আস্তে আস্তে চালালাম, ইট পাতা রাস্তা বাইক নিয়ে চলা একটু মুশকিল। তাও বেশ সামলে চলতে হল কারন পেছনে যে বসে তাকে বেশি ঘাঁটানো যাবে না পাছে কি ভাবতে কি ভেবে বসে। বড় রাস্তায় বাইক চড়াতেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম।
আমার ভেতরে অট্টহাসির কলরব ফেটে পড়ার জোগাড়, জানি অনুকে একদিন জানাতেই হবে না জানালে আমাদের প্রেমের পরিণতি কি হবে সেটা বলা কঠিন। বাবা জ্যাঠা কাকার সামনে কোন ভাই বোনের আওয়াজ শোনা যায় না, ওদিকে মা কাকিমার সামনে প্রায় এক রকম অবস্থা।
সেই রক্তিম আভাময় মুখ খানি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "তোর যদি এতই সমস্যা হয় তাহলে এইখানে নিয়ে এলি কেন? অন্য কোথাও যাওয়া যেতে পারতিস, এই ধর কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার, রায়চক যেখানে খুশি।"
আমি ওকে কাছে টানতে গেলাম কিন্তু কিছুতেই কাছে আসবে না, না না বলে লাজুক হেসে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বললো, "সেই বিকেলে এসেছি আর অনুর ঘরের জানালা থেকে তোকে শুধু ঘর বাহির করতে দেখে গেলাম।"
অনুকে কোনোদিন লজ্জা পেতে দেখিনি, কিন্তু ওইদিন মেয়েটা লাজুক হেসে আমাকে বললো, "আগেকার কথা ছেড়ে দে। দেবুর সাথে ঝগড়া করতাম এই কারনে কেননা ওর বুকে সেই পাটা নেই। বিয়ের পরে দেখলাম ওকে আমাকেই খাইয়ে দিতে হচ্ছে।"
দুই বাড়ির কাজের দায়িত্ব আমার আর আকাশদার ঘাড়ে। বিশ্বজিৎদা তো মজাসে ছোড়দিকে নিয়ে কেনাকাটা করাতে ব্যাস্ত। ধুর ব্যাস্ত না ছাই, আমি হলফ করে বলতে পারি কেনাকাটার নাম করে অরা ওই কয়দিনে ঘুরে বেড়িয়েছে। কেননা যা কেনার সব আমি আকাশদা নবীন আর অনু মিলে করেছিলাম।
নিচে ঘোলা জল, মাথার ওপরে কালো মেঘ আর পাশে ভিজে জলপরী। গায়ের শাড়িটা সারা অঙ্গের সাথে লেপ্টে গেছে তাতে ওর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, মাঝ গঙ্গায় নৌকা দাঁড় করিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভিজলাম দুইজনে। আমার সাথে একটা ক্যামেরা থাকলে সেই অপূর্ব দৃশ্য সেদিন ক্যামেরা বন্দি করে রাখতাম তবে হৃদয়ে আঁকা ছবির কাছে সেই ছবি ম্লান।
ভিজে ভিজে ওই পাড়ে গিয়ে বাস ধরলাম বেহালা আসার জন্য। হাওড়া ব্রিজ পার হতেই ছন্দা আমার হাত ধরে বাস থেকে টেনে নামিয়ে নিল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কি ব্যাপার, কি হয়েছে?" আমার হাত বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সারা শরীরের উত্তাপ নিজের বুকে চেপে আদুরে কন্ঠে বললো, "আজকে না বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না আমার।"
ছেলেটা চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম। অনেকদিন পরে কাছে পেয়েছি তাও আবার একেবারে নিজের করে, এখানে বাধা দেওয়ার কেউ নেই, দেখার কেউ নেই শুধু মাত্র দুইজনে এক কামরায়।
বেশ কিছুক্ষণ সত্যজিতের মিশনে কাটিয়ে রাতের খাবার একে বারে সেরে হোটেলে ফিরে এলাম। গত রাতে ঘুম হয়নি তাঁর ওপরে আবার সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছিলাম দুইজনেই। হোটেল ঢুকে হাত পা ধুয়ে বিছানায় পড়তেই আমার শরীর ছেড়ে দিল কিন্তু মন ওদিকে কিছুতেই মানছে না। পাশে প্রেয়সী, এক বিছানায় একসাথে ঘুমাবে একটু আদর একটু সোহাগ।
আমি ওকে হেসে বললাম, "থার্মোডায়নামিক্স নিয়ে করব এই টুকু জানি, এখানে না বিদেশে সেটা এখন ভাবিনি। তবে জি আর ই দেওয়ার ইচ্ছে আছে সেটা অনেক কঠিন ব্যাপার তারপরে দেখা যাবে।" কিছুক্ষণ থেমে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি মাসিমাকে আমাদের ব্যাপারে কিছু বললে কি?"
আমার ছোট কাকা বললেন, "তোদের দুইজনের একসাথে বিয়ে। মানে অনু আর তোর, অধির বাবুর একমাত্র ছেলে, অনিন্দ্য ডিভিসিতে ইঞ্জিনিয়ার। আমরা ভাবলাম এই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে যখন যাবে তখন ওই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে এই বাড়িতে আসুক।"
অভিমানিনীর ওই সুর অনেকদিন শুনিনি, আমার দুকানে যেন কেউ মধু ঢেলে দিল। ছন্দা চেঁচিয়ে উঠলো অইপাশ থেকে, "তোমার কোন আক্কেল নেই? এই রাতে বলছ ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে? আমি তোমাকে বলেই দিয়েছি যে বিয়ে করবো না।"