প্রকাশিত: রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫
তেইশান্তে প্রেমালোক | গ্রন্থাগারে এক নীল নয়না
এখন রাত প্রায় সাড়ে ১০ টা। আশপাশ শীতল হাওয়া বইছে। রায়ান এই মুহূর্তে নিজের বাড়ির গেটের সামনে দারিয়ে আছে। ভেতরে ঢুকলে কত কিছু শুনতে হতে পারে তাই ভাবছে। রায়ান এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার দিকে হাত বারায়। কিন্তু ও দরজায় হাত রাখার আগেই দরজা খুলে যায়। রায়ান চোখ বড় বড় করে সামনে তাকাতেই সামনে থেকে ওর ছোট বোন রিয়া ভয় পেয়ে চিল্লিয়ে উঠে,
“ভাইয়াআআ…!!! তুই এখন? এভাবে?”
রিয়াকে চিল্লাতে দেখে রায়ান এবার বেশ বিরক্ত হল। কিন্তু রিয়া হঠাৎ করেই চিল্লানো বন্ধ করে জোরে জোরে হাসা শুরু করলো। মুলত নিজের বড় ভাইকে এভাবে নিজের বাড়ির দরজার সামনে ভীতুদের মতন দারিয়ে থাকতে দেখেই ওর হাসি পাচ্ছে, ভীষণ হাসি পাচ্ছে। রিয়ার এরকম জোরে জোরে হাসির শব্দে এবার ঘরের ভেতর থেকে তাদের মা নুরজাহান বেগম এদিকে আসেন।
“কিরে! কি হলো তোর? এভাবে পাগলের মতন হাসতাছস কেন?”
“আম্মু… ভাইয়া”
নুরজাহান বেগম রিয়ার কথায় দরজার দিকে তাকাতেই রায়ানকে দেখতে পান। তিনি রায়ানকে দেখা মত্রই দ্রুত দরজার কাছে আসেন। রায়ানকে ধরে ভেতরে এনে দরজা লাগিয়ে দেন। অতপর রায়ানের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত স্বরে বলেন,
“ঠিক আছিস বাবা?”
“হুম”
কিন্তু হঠাৎই উনার চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায়। উনি আবার অভিমানের স্বরে বলেন,
“বুঝলাম, সমস্যা ছিল তাই বাসায় আসতে পারস নাই। কিন্তু সেটা ফোন করে জানালে কি হত? আমাকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে তোর তাই না?”
“আরেহ আম্মু, তোমাকে না বলছি? আমি অফিসে থাকলে আমার ফোন বন্ধ থাকে? এত চিন্তা কেন কর তুমি? আমি কি এখনো বাচ্চা নাকি?”
“আমারি ভুল। কেন যে তোকে এসব বলতে গেলাম। মায়ের কষ্ট কি আর সবাই বুঝে?”
নুরজাহান বেগম কথাগুলো বলে কষ্টে রুমের দিকে চলে গেলেন। রায়ান সেদিকেই তাকিয়ে আছে। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে।
“ভাইয়া তুই আম্মুকে এভাবে কষ্ট না দিলেও পারতি। আম্মু তোকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে”
রিয়ার এ কথায় রায়ান এবার এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আবারো টেবিলের আসছে।
“কিরে ভাইয়া! তুই আজকে আমাদের সাথে খাবি নাকি?”
রিয়ার উত্তেজনা ছিল স্বাভাবিক। কেননা রায়ান আখন বাসায় খায় না। সারাদিন তো বাইরেই থাকে আর রাতেও বাইরে থেকেই খেয়ে আসে। তাই বাসার সবার সাথে বসে খাওয়া হয় না। কিন্তু আজ অন্যসব চিন্তায় বাইরে থেকে খেয়ে আসতে মনে ছিল না। তাই বাসায় সবার সাথে খেতে বসেছে। রায়ান বসার সাথে সাথে নুজাহান বেগম এসে ওর প্লেটে ভাত দিতে শুরু করলেন। মাকে এখন এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে রায়ান এবার বলল,
“আম্মু, এখনো রাগ করে আছো?”
“না। তোর সাথে রাগ করে আমার কি লাভ?”
“হুম। তাও ঠিক”
“তাও ঠিক মানে? কি ঠিক? রায়ান কিচ্ছুই তো আমি ঠিক দেখতাছি না। তোর চাহারাও না। কি অবস্থা তোর? তুই জানিস? তোরে পুরা জঙ্গলিদের মতন লাগতাছে। একবার আয়না দেখিস বুঝে যাবি”
নুরজাহান বেগমের কথার সাথে তাল মিলিয়ে এবার রিয়াও বলল,
“হ্যাঁ, আম্মু ঠিক বলছ। ভাইয়াকে দেখে হনুমানের মতোই লাগতাছে। বুড়া বুড়া লাগতাছে। দুই বাচ্চার বাপ”
রিয়ার কথায় এবার রায়ান উঠে রিয়ার মাথা মেরে বলে,
“আমি বুড়া হলে তুই বুড়ি। বেয়াদোপ”
“উফফ! ভাইয়া ব্যাথা পাইছি কিন্তু”
কিন্তু ঠিক তখনি সেখানে প্রবেশ করেন ওদের বাবা রাসেদুল হোসেন। উনাকে দেখা মাত্রই দুই ভাইবোন চুপচাপ ভদ্রভাবে খাওয়া শুরু করে। তিনি এসে চেয়ারে বসেন। সকলেই খাওয়া শুরু করেছে। রাসেদুল হোসেন নুরজাহান বেগমকে কিছু একটা ইশারা করেন। অতপর হালকা কেশে রায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“রায়ান! তোমার সাথে আমার কথা আছে”
বাবার কণ্ঠে গম্ভির্য স্পষ্ট। রায়ান বাবার কথায় সোজা হয়ে বসে আর সিরিয়াস হয়ে বলে,
“জি আব্বু”
“শোনো বাবা, তোমার বয়স কিন্তু কম হল না। এখন তো একটা বিয়ে করা দরকার”
বাবার মুখে নিজের বিয়ের কথা শুনে রায়ান ভীষম খেলো। রায়ান কাশতে কাশতে চেয়ার ধরে বসেছে। রায়ানের হঠাৎ এমন কাণ্ডে রিয়া এবং নুরজাহান বেগম ব্যাস্ত হয়ে পরেন ওকে পানি আগিয়ে দিতে। পানির গ্লাসটা হাতে নিয়েই রায়ান এর ডগে পুরা পানি শেষ করে। তারপর হাপাতে হাপাতে বলে,
“বাবা আমি এখনও এসবের জন্য রেডি না”
“তা তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে”
তারপর সবাই যে যার মতন খেয়ে রুমে চলে গেলো। রায়ানও তার রুমে চলে আসছে। রুমে ঢুকেই রায়ান কিছু একটা ভেবে আয়নার দিকে গেলো। নিরব, রিয়া, আম্মু সবাই খালি ওকে আয়না দেখতে বলতাছে। হইছে কি ওর? তা দেখার উদ্দেশ্যেই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সত্যিই ওর চেহারার অবস্থা করুন। চুলগুলো কাঠ পর্যন্ত পরে আছে, সামনের চুল গুলো চোখ ঢেকে রাখছে। আর দাড়িও অনেক বড় হয়েছে। এবার রায়ানের নিজেকেই হনুমান লাগছে। এইসব ওর নিজের অবহেলারই ফল। রায়ান এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ওর আর কিছুই করার নেই। ওর জীবনটা এমনি হয়ে গেছে। দীর্ঘনিঃশ্বাসের উপর টিকে আছে ওর জিবন। রায়ান নিজের জিবন নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে উঠে রেডি হয়ে চলে গেলো অফিসের উদ্দেশ্যে। রায়ান গাড়ি নিয়ে অফিসের দিকেই যাচ্ছিলো। কিন্তু হুট করেই ও গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। কিছু একটা ভেবে গারিতা এক ছোট রাস্তায় নিলো। মুলত সেই রাস্তার মাথায় একটা লাইব্রেরি আছে। লাইব্রেরিটা রায়ানের ভীষণ প্রিয়। ও আজ পর্যন্ত কোন সময় এই লাইব্রেরি থেকে খালি হাতে ফেরেনি। ও নিজের সব প্রস্নের উত্তর আইই লাইব্রেরিটাতেই পেয়েছে। লাইব্রেরিটা কোন বড় মানের লাইব্রেরিও না। বেশ পুরনো আর ছোট লাইব্রেরি এটা। কিন্তু রায়নের জন্য প্রিয়। রায়ান ছোট লাইব্রেরিটার সামনে গাড়ি থামাল। তারপর গাড়ি থেকে মেনে লাইব্রেরিতায় প্রবেশ করলো। ছোট লাইব্রেরিটায় এই মুহূর্তে একজন বয়স্ক ব্যাক্তি ব্যতীত আর কাওকেই দেখা যাচ্ছে না। রায়ান হেঁটে গিয়ে নিজের পছন্দের সাইটটায় যায়। যেখানে কিনা সব পুরনো বই। রায়ান একে একে সব পুরনো বইগুলো দেখছে। তখনি ওর চোখ যায় একটা বই “দ্য এজ অফ টাইম” নামের বইয়ের দিকে। রায়ান বইটা পড়ার উদ্দেশ্যে সেদিকে হাত বাড়ায়। বইটা সেলফ থেকে স্রিয়ে হাতে নিলো। কিন্তু যেই জায়গাটায় বইটা ছিল, সেখানটা এখন ফাকা থাকায় ওপাশের সেলফটা দেখা যাচ্ছে। বইটা হাতে নিয়ে রায়ান সেদিকে একবার তাকালো। কিন্তু রায়ানের চোখ আটকে গেলো। চোখের সাথে সাথে নিশ্বাসটাও আটকে গেলো তার। ওই সেলফটার সামনে দাড়িয়ে আছে এক রমণী। অদ্ভুদ সুন্দর মেয়েটা। মেয়েটার সৌন্দর্যকে অদ্ভুদই বলতে হচ্ছে। কেননা স্বাভাবিক কেও তো আর এতো সুন্দর হয় না। দুধে আলতা গায়ের রং আর কোমর ছড়িয়ে লম্বা কেশ। কালো রঙের থ্রি পিছের কারনে ফর্সা গায়ের রঙটা অস্বাভাবিক উজ্জল লাগছে। আর ছেরে রাখা কোমর ছারিয়ে লম্বা চুল গুলো বাতাসে উরাউরি করছে। মুখের সামনের ছোট ছোট চুলগুলো উরে উরে গালের উপর আছড়ে পরছে। কি অদ্ভুদ সুন্দর সেই দৃশ্য! মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে গল্পের বই পরছে আর মিটি মিটি হাসছে। অসম্ভব সুন্দর আর মিষ্টি সেই হাসি। রায়ানের পৃথিবী থেমে গেছে। হৃদস্পন্দন শুধু ছুটাছুটি। হঠাৎই রায়ানের হাত থেকে মোটা বইটা পরে গেলো। অত ভারি বই পরায় বেশ জোরেই শব্দ হলো। হঠাৎ এমন শব্দে মেয়েটাও কেপে উঠেছে। শব্দে মেয়েটা ভয় পেয়ে সামনের দিকে তাকালো। তখনি রায়ানের চোখ পড়লো এক জোরা নিল মণিতে। বইটা পড়ার শব্দে যতটা না হুস ফিরেছিল, মেয়েটার নিল মণি বিশিষ্ট মায়াবী চোখে চোখ পারায় তাও হারালো। রায়ানের শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। কালো শার্টটা গায়ের সাথে মিশে গেছে। আর তখনি এক মিষ্টি স্বর রায়ানের কানে আসলো।
“এইযে মিস্টার! এভাবে কি দেখেন?”